Ajker Patrika

ব্যবসার অনুমতি পেতেই পকেট খালি যেসব দেশে

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২১, ১৯: ০৩
ব্যবসার অনুমতি পেতেই পকেট খালি যেসব দেশে

প্রবাদ আছে, টাকা বানাতে চাইলে আগে অবশ্যই টাকা খরচ করতে হবে। পৃথিবীর যেকোনো দেশে ব্যবসা শুরু করতে হলে সেটি যত ছোটই হোক না কেন, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা খরচ করতেই হবে। কিন্তু দেশ ভেদে এই অর্থের পরিমাণটা উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। যেমন, সংযুক্ত আরব আমিররাতে ব্যবসা শুরু করা সবচেয়ে ব্যয়বহুল। তবে রুয়ান্ডায় একবারে কপর্দকশূন্য হাতেই শুরু করা যায় ব্যবসা।

তবে সাধারণ মত হচ্ছে, ব্যবসার শুরুতেই যদি বেশি পয়সা খরচ হয়ে যায়, তাহলে পণ্যের গুণ–মানে মনোযোগ দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, ব্যবসার শুরুটা অবশ্যই সুলভ হওয়া চাই। কারণ, একটি ব্যবসায় সফল হওয়া মানে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা। দেশের সম্পদ বৃদ্ধিতে অবদান রাখা। সরকারকে একটা মোটা অঙ্কের কর দেওয়ারও সুযোগ তৈরি হয়। তার মানে, সব পক্ষই লাভবান হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—উদ্যোক্তা মাগনা হওয়া যায় না। অন্তত বিশ্বের সব অঞ্চলে এমন সুযোগ নেই।

বিশ্বের সব দেশেই ব্যবসা শুরুর কিছু হ্যাপা আছে। বেশ কিছু প্রশাসনিক ঝক্কির ভেতর দিয়ে যেতে হয় একজন উদ্যোক্তাকে। উপযুক্ত অনুমোদন, লাইসেন্স ইত্যাদির জন্য নানা দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। এর জন্য কিছু অর্থও চলে যায়। সেই সঙ্গে খরচ হয় মূল্যবান সময়ও।

এই ঝক্কিঝামেলার পেছনে কত অর্থ, আর সময় ব্যয় হয়—সে ব্যাপারে হবু উদ্যোক্তার পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই। বিশ্ব ব্যাংকের এ–সংক্রান্ত উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বিজনেস ফাইনান্সিং ডট কো ডট ইউকে চমৎকার ও সহজবোধ্য একটি মানচিত্র তৈরি করেছে। এই মানচিত্রে দেশ ভেদে ব্যবসা শুরুর খরচের পার্থক্যটি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এর আগে কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা যাক—

তুলনার সুবিধার্থে, ব্যবসায় খরচের হিসাবটা মার্কিন ডলারে রূপান্তর করা হয়েছে। মেট্রিক পদ্ধতিতে রূপান্তরের পর তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, ব্যবসা শুরুর জন্য সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। এই দেশে উদ্যোক্তার বাজারে আসার আগেই পকেট থেকে চলে যাবে ৭ হাজার ৪৪৩ দশমিক ৫১ ডলার। আর সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল দেশ হলো আফ্রিকার রুয়ান্ডা। এই দেশে আক্ষরিক অর্থেই ব্যবসার প্রথম দুই বছর এক পয়সাও খরচ করতে হয় না। আর ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়াতে বিভিন্ন অনুমোদনের জন্য কোনো ফি দিতে হয় না। খালি ৮ হাজার ৯০০ ডলার পুঁজি থাকলেই যে কেউ ব্যবসা শুরু করতে পারে।

অবশ্য এই সাধারণ হিসাবের ভিত্তিতে সব দেশের তুলনা করা একেবারে ঠিক হবে না। এই টাকার অঙ্কগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের জীবনমানের সঙ্গেও তুলনা করা দরকার। কারণ, এই জীবনমানই সেই দেশের মানুষের আপেক্ষিক আর্থিক সামর্থ্য নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, কাজাখস্তানে একটি দোকান দেওয়ার খরচ মাত্র ১২ ডলার। এই পরিমাণ অর্থ সেই দেশের মানুষের মাসিক আয়ের মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু কঙ্গোতে একই ব্যবসা শুরু করতে খরচ করতে হয় ১ হাজার ২৩২ ডলার। এটি কঙ্গোবাসীর বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণের বেশি।

এ ক্ষেত্রে ইউরোপে খুব বৈচিত্র্য দেখা যায়। সবচেয়ে কম খরচে ব্যবসা শুরু করা যায়—এমন দেশগুলোর মধ্যে ১২টিতে ১০০ ডলারেরও কম খরচ হয়। আর বেশি খরচের দেশগুলোতে লাগে হাজার ডলারের বেশি। একমাত্র স্লোভেনিয়া বাদে, ব্যবসা শুরুর বা সূচনা ব্যয়ের দিক থেকে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী যুক্তরাজ্য। এমনকি বেলারুশে যেখানে খরচ হয় গড়ে ১৮ দশমিক ১৮ ডলার, সেখানে যুক্তরাজ্যে মাত্র ১২ পাউন্ড বা ১৭ ডলারে কোম্পানিজ হাউসে নিবন্ধন করেই যে কেউ ব্যবসা শুরু করে দিতে পারে।

উত্তর আমেরিকার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হলো ঐতিহাসিকভাবেই উদ্যোক্তাদের জন্য এক স্বপ্নের দেশ

আর ইউরোপের মধ্যে যে দেশে ব্যবসার সূচনা ব্যয় সবচেয়ে বেশি, সেটি হলো ইতালি। ইতালিতে যেকোনো আজিয়েন্দা বা ব্যবসা খুলতে চাইলে শুরুতেই শুধু নানা অনুমোদন, নিবন্ধন ইত্যাদি বাবদ ৪ হাজার ৮৯৫ ডলার পকেট থেকে নেমে যাবে। এই পরিমাণ টাকা দেশটির নাগরিকদের মাসিক গড় আয়ের (২,৪০৩ ডলার) দ্বিগুণের বেশি।

আর উত্তর আমেরিকার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হলো ঐতিহাসিকভাবেই উদ্যোক্তাদের জন্য এক স্বপ্নের দেশ। এই দেশে ব্যবসা শুরু করতে খরচ করতে হয় ৭২৫ ডলার। যেখানে মেক্সিকোতে লাগে ১ হাজার ৪৬৩ দশমিক ৮১ ডলার। তবে কানাডাতে ব্যবসা করা আরও সহজ ও সাশ্রয়ী। যুক্তরাষ্ট্রের চার ভাগের এক ভাগ খরচ হয় এ দেশে। কানাডাতে ব্যবসার সূচনা ব্যয় মাত্র ১৬৬ দশমিক ১৯ ডলার।

আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসার সূচনা ব্যয়টি বেশি মনে হলেও নাগরিকদের গড় মাথাপিছু আয়ের তুলনায় কিন্তু বেশ কম। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী এ দেশের নাগরিকদের মাসিক আয় ৪ হাজার ৪৫৮ ডলার। সে হিসাবে দেশটিতে ব্যবসার সূচনা ব্যয় মাসিক আয়ের ১৬ শতাংশ। মেক্সিকোতে কোম্পানির মালিক হতে যে পরিমাণ খরচ হয়, সে তুলনায় এটি অনেক কম। সে দেশে ব্যবসার সূচনায় ব্যয় নাগরিকদের মাসিক আয়ের আড়াই গুণ।

নাগরিকদের সামর্থ্য বিচারে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যবসা শুরু করতে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়

উত্তর আমেরিকায় ব্যবসা শুরুর জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী দেশ হলো বেলিজ। সেখানে খরচ করতে হয় মাত্র ৯৯ দশমিক ৩১ ডলার, যা সে দেশের মাসিক আয়ের প্রায় ৩৩ শতাংশ। সে হিসাবে টাকার পরিমাণ হিসাব করলে ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ বাহামা। সেখানে খরচ হয় ১ হাজার ৮১০ দশমিক ৯২ ডলার। আর হাইতিতে খরচ হয় ৯৩২ দশমিক ৮০ ডলার। এটি হাইতির চারজন নাগরিকের মাসিক আয়ের সমান। দেশটির নাগরিকদের গড় মাসিক আয় ৬৭ ডলার।

নাগরিকদের সামর্থ্য বিচারে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ব্যবসা শুরু করতে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। সুরিনাম, ইকুয়েডর, বলিভিয়া ও উরুগুয়েতে ব্যবসার সূচনা খরচ অনেক বেশি। তবে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো আবার তুলনামূলক সাশ্রয়ী। বিশেষ করে ভেনেজুয়েলা ও চিলি দারুণ সাশ্রয়ী।

ব্যবসার শুরুর করার ক্ষেত্রে সুরিনাম সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এ দেশে ব্যবসার সূচনা ব্যয় ৩ হাজার ৩০ ডলার, যা দেশটির নাগরিকদের মাসিক আয়ের ১১ গুণের বেশি। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয় নোটারি সার্ভিসের জন্য ৮ শতাংশ সেবামূল্য।

ব্যবসা শুরুর জন্য আফ্রিকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ হলো ইকুয়েটোরিয়াল গিনি

অথচ ভেনেজুয়েলাতে খরচ হয় মাত্র ২১ ডলার। কোম্পানির নাম সংরক্ষণ, স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে সেটি প্রকাশ এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা বাবদ এ অর্থ খরচ হয়। দেশটির নাগরিকদের মাসিক আয়ের (১ হাজার ২৩২ ডলার) মাত্র এক শতাংশ বা তারও কম। এরপরও কিন্তু ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম। এর মানে দাঁড়ায়, দেশটিতে নতুন উদ্যোগ শুরু ও ব্যবসা পরিচালনার সামনে আরও অনেক বাধা আছে। কমিউনিস্ট দেশটিতে সবকিছুতে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এর একটি অন্যতম কারণ।

আফ্রিকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য শান দেওয়া আছে দুইধারী তলোয়ার। এ মহাদেশে সস্তায় কায়িক শ্রম পেতে কোম্পানিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সরকারও সেটি উৎসাহিত করে। কিন্তু স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কোম্পানির মালিক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন করে রাখা হয়েছে। অনেক দেশেই এই বাধাগুলো প্রায় স্থায়ীভাবে গেঁড়ে বসেছে। তবে ইদানীং কিছু দেশ স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।

ব্যবসা শুরুর জন্য আফ্রিকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ হলো ইকুয়েটোরিয়াল গিনি। এই দেশে খরচ হয় ২ হাজার ৩২২ ডলার। অর্থাৎ, ব্যবসা শুরু করতে চাইলে নানা আনুষ্ঠানিকতা করতেই নাগরিকদের গড়ে ৭ দশমিক ২ মাসের আয় পকেট থেকে বেরিয়ে যায়। প্রতিবেশী কঙ্গোতেও অস্বাভাবিক ব্যয় করতে হয়। তুলনামূলকভাবে সে দেশে ব্যবসা শুরুর খরচ সবচেয়ে বেশি। সেখানে ব্যবসার সূচনা ব্যয় একজন নাগরিকের সাড়ে ২৫ মাসের বেতনের সমান।

তবে কঙ্গো নদীর অববাহিকায় অবস্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে আবার ব্যবসার সূচনার খরচ বেশ কম, মাত্র ৮০ ডলার। আফ্রিকায় যে কয়টা দেশে ১০০ ডলারে কম খরচ করেই ব্যবসা শুরু করা যায়, তার মধ্যে এই দেশ অন্যতম। এর মধ্যে মিসর ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশও আছে, যাদের আফ্রিকা মহাদেশের অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস বলা হয়।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনা করলে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশগুলো রয়েছে প্রথমটিতেই। আর সবচেয়ে সাশ্রয়ী দেশ মধ্য এশিয়ায়। শুরুতেই বলা হয়েছে, ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু নাগরিকদের সামর্থ্যের বিচারে তাকে কিন্তু সবচেয়ে ব্যয়বহুল বলা যাবে না। এখানে ব্যবসা শুরু করতে চাইলে নানা আনুষ্ঠানিকতা বাবদ যে খরচ হয়, তা নাগরিকদের গড়ে ২ দশমিক ২৫ মাসের উপার্জনের সমান।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই ব্যবসা শুরুর জন্য অনেক বেশি খরচ করতে হয়

আর প্রতিবেশী কাতার ও সৌদি আরবও কিন্তু সাশ্রয়ী নয়। দেশ দুটিতে খরচ হয় যথাক্রমে ৩ হাজার ৯৫১ দশমিক ৯৪ ও ১ হাজার ২৬৬ দশমিক ৫৭ ডলার। তবে বাহরাইনে খরচ হয় মাত্র ২৩০ দশমিক ৭৮ ডলার। অথচ যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেনে এ বাবদ খরচ হয় ৮০৭ দশমিক ৭৯ ডলার।

মধ্য এশিয়ার মধ্যে ব্যবসা শুরুর জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী দেশ কিরগিজস্তান। সেখানে খরচ করতে হয় মাত্র ৮ দশমিক ৩৫ ডলার। এই দেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও খরচ বেশ কম। আফগানিস্তানেও ব্যবসা শুরুর খরচ বেশ কম। অবশ্য গৃহযুদ্ধের মধ্যে সেখানে নিশ্চয় কেউ নতুন ব্যবসা খুলতে চাইবেন না!

নিচের দেশগুলোর একটিতেও ব্যবসার সূচনা ব্যয় চার অঙ্কের নয় এবং তুলনামূলক ব্যয় কম হলেও এ অঞ্চলে ব্যবসা শুরুর ব্যয় সাশ্রয়ী ও সামর্থ্যের মধ্যেই আছে।

কম্বোডিয়া ব্যবসার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে। তবে সেখানেও ব্যবসা শুরুর জন্য গড়ে ৭৪৬ ডলার খরচ করতে হয়। এই পরিমাণ টাকা দেশটির নাগরিকদের প্রায় সাড়ে সাত মাসের উপার্জনের সমান। সে হিসাবে এ অঞ্চলে ব্যবসা শুরুর ব্যয়ে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ এটি। আর সবচেয়ে সাশ্রয়ী দেশ হলো পূর্ব তিমুর। দেশটিতে খরচ হয় মাত্র ১০ ডলার। তবে এরপরও নাগরিকদের মাসিক আয়ের ৯ শতাংশ।

সবদিক বিবেচনায় ব্যবসা শুরুর জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক দেশ হলো নিউজিল্যান্ড। দেশটিতে আনুষ্ঠানিকতা বাবদ খরচ হয় মাত্র ৪৩ দশমিক ৪৮ ডলার। এটি মাসিক আয়ের (২ হাজার ৮৩৮ ডলার) মাত্র ২ শতাংশ। সে হিসাবে টাকার পরিমাণে এবং সামর্থ্য—দুদিক থেকেই উদ্যোক্তাবান্ধব দেশ এটি। ব্যবসা শুরুর সহজসাধ্যতার বিবেচনায় তালিকায় এক নম্বরে নিউজিল্যান্ডকে রেখেছে বিশ্ব ব্যাংক। এখানে একটি মাত্র প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ব্যবসা শুরু যায়, যেখানে সময় লাগে এক দিনেরও কম।

বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ব্যবসা শুরুর সহজসাধ্যতার সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১। আর ব্যবসা পরিচালনার সহজসাধ্যতার সূচকে অবস্থান ১৬৮।

মধ্য এশিয়ায় দেশগুলোতে ব্যবসা শুরুর জন্য তুলনামূলক কম ব্যয় হয়

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সময়ের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এখনো ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নন। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের মতামত জরিপের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় বাংলাদেশে ব্যবসার বাধা হিসেবে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো হলো—দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, সরকারি আমলাদের দুর্বলতা, বিনিয়োগের জন্য অর্থ না পাওয়া, নীতির ধারাবাহিকতা না থাকা, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার নীতি, করহার, শিক্ষিত কর্মীর অভাব, করব্যবস্থার জটিলতা, অপরাধ, উদ্ভাবনী দক্ষতার অভাব, শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি।

ঘুষ ও দুর্নীতি, ক্রয় প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিচার বিভাগে দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, কপিরাইটের অপব্যবহার ও পাইরেসির ছড়াছড়ি, মেধাস্বত্ব অধিকারের প্রয়োগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল—এসবও বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এ ছাড়া সাধারণত অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানে, অত্যন্ত ক্ষুদ্র পুঁজির ভাসমান দোকানের ব্যবসাগুলোতে যেসব পক্ষ থেকে বাধা আসে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। যেমন, ফুটপাতের দোকানে দিতে হলে পুলিশ, স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক নেতা ইত্যাদি পক্ষকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। এতে দেখা যায়, লাভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চাঁদার পেছনেই ব্যয় হয়ে যায়। এ ছাড়া নানা ধরনের হয়রানি তো তাঁদের নিত্যসঙ্গীই।

ফলে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর ব্যয় যে ১৪৯ দশমিক ২৫ ডলার বলা হচ্ছে, তা আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হলেও তা আসলে কম নয়। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। গত মে মাসে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ তথ্য জানিয়েছেন। এই হিসাবকে বিবেচনায় নিলে এটি মাথাপিছু আয়ের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মাস হিসেবে এটি গড় মাসিক আয়ের চেয়ে কম। সে হিসাবে, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর ব্যয় কমই বলতে হবে। কিন্তু এই কম ব্যয়ের কারণে ব্যবসা শুরু করাটা যে এখানে সহজ, সে কথা বলা যাবে না। তার কারণগুলো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়ে গুঞ্জন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়ে গুঞ্জন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়ে গুঞ্জন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়ে গুঞ্জন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়ে গুঞ্জন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত