Ajker Patrika

এআই, সমরাস্ত্র ও নিখাদ ইউরেনিয়ামের আকাঙ্ক্ষা, মার্কিন সহায়তা পাবেন কি এমবিএস

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ৩৬
সৌদি যুবরাজ এমবিএস যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহায়তায় নিজ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত
সৌদি যুবরাজ এমবিএস যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহায়তায় নিজ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চাইছেন, যা কাতার–যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিকেও ম্লান করে দেবে। তাঁর চাহিদার তালিকায় আছে এআই চিপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–চালিত ড্রোন, আর সম্ভবত তাঁর দেশে মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন।

আজ রোববার ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন এমবিএস। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার মধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চাপ তিনি হজম করে গেছেন। এমনকি ইসরায়েল–ইরান যুদ্ধেও নিজ দেশকে রক্ষা করে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর বিপরীতে আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যিনি সৌদি আরবকে নিজ পক্ষপুটে আনতে আলোচনা টেবিলে নিজ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—পারমাণবিক ও এআই প্রযুক্তির বিষয়টি উত্থাপনে প্রস্তুত।

একসময় মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা হোয়াইট হাউসে যেতেন এমন সব চুক্তি নিয়ে, যেগুলো মূলত বোয়িং আর লকহিড মার্টিনকে ব্যস্ত রাখত। ইরানের শাহ অস্ত্র ব্যবস্থার বিশ্বকোষসম জ্ঞানের জন্য এমন সফরে কুখ্যাত ছিলেন। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, মোহাম্মদ বিন সালমানের জটিল ‘শপিং লিস্ট’ এক পরিণত ও দূরদর্শী রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তোলে।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক থিংক ট্যাংক এডেলম্যান পাবলিক অ্যান্ড গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্সের মধ্যপ্রাচ্য প্রধান আইয়্যাম কামেল বলেন, ‘এমবিএস কেবল একটি খাতে সহযোগিতা চান না, তিনি দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি আরব সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে চান। সেটা প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের দ্বিমুখী প্রবাহের মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, ‘সৌদি আরব এখনো বহুমেরুবিশ্বের অংশ হতে চায়, কিন্তু তারা ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ নিতেও প্রস্তুত।’

বিশেষজ্ঞরা যে দিকটিতে নজর রাখা উচিত বলে মনে করছেন তা হলো—যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ছাতার নিচে জায়গা পেতে সৌদি আরবের আগ্রহ। কাতারে হামাসের মধ্যস্থতাকারীদের ওপর ইসরায়েলের হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে।

পাকিস্তানের হাতে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে বলে ধারণা করা হয়। দুই দেশের বিবরণে বলা হয়, চুক্তিতে সামরিক সব ধরনের বিকল্পই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে সৌদির পারমাণবিক আলোচনার বিষয়বস্তু গোপনে রাখা হয়েছে। তবে সাবেক এক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন, সৌদি আরবকে মার্কিন সামরিক সুরক্ষার আওতায় আনার ধারণা কার্যকর হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এতে সৌদিরা পাকিস্তানের পারমাণবিক ছাতার বাইরে আসবে এবং নিজেদের কাতারের চেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করবে।’

সৌদি আরব মূলত নিরাপত্তা শঙ্কার জায়গা থেকেই মার্কিন পারমাণবিক শক্তি ছায়াতলে আশ্রয় নিতে চাইছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর স্থাপনায় ইরানের হামলার পর থেকে সৌদি আরব ভয় পেতে শুরু করে। সর্বশেষ, কাতারে ইসরায়েলি হামলা সেই ভয়কে আরও বাড়িয়েছে।

কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর দোহারের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন, যাতে কাতারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং উপসাগরীয় এই দেশে যে কোনো হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শান্তি ও নিরাপত্তার’ প্রতি হুমকি হিসেবে ধরা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

ওয়াশিংটন বা উপসাগরীয় অঞ্চলের খুব কম কর্মকর্তাই এই প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দেন। কারণ, আনুষ্ঠানিক চুক্তি প্রতিশ্রুতির তুলনায় নির্বাহী আদেশ যেকোনো সময় বাতিল করা যায় এবং নতুন মার্কিন প্রশাসন এই ধরনের নির্বাহী আদেশ মানবে—এমন নিশ্চয়তাও নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব আরও শক্তিশালী কিছু চায়।

সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাআদ আল আইবান এ সপ্তাহের শুরুতেই ওয়াশিংটনে গিয়ে সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা অঙ্গীকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ওয়াশিংটনে যুবরাজের পা পড়ার আগেই তাঁর সফরের একটি বড় সাফল্য হলো—দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ইসরায়েল ইস্যুকে আলাদা করে ফেলা।

ট্রাম্প মে মাসে সৌদি সফরে যাওয়ার আগেই রিয়াদ আগাম আলোচ্যসূচি ঠিক করে নিয়েছিল, যাতে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রসঙ্গ আলোচনায় না আসে। এখন গাজায় নাজুক যুদ্ধবিরতি চলছে। ট্রাম্প দাবি করছেন, বছরের শেষের মধ্যে রিয়াদ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। কিন্তু পশ্চিমা ও আরব কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, সৌদি আরব আগের মতোই এ আলোচনায় ফিরতে অনিচ্ছুক। সৌদি আরব যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের দিকে বাস্তব অগ্রগতি দেখতে চায়। কিন্তু একটি এমন শর্ত, যা মানতে ইসরায়েল দৃশ্যত প্রস্তুত নয়।

সৌদি আরব কি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে

সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেসামরিক পারমাণবিক জ্বালানি নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, তা মূলত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাব্য পুরস্কার হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। এখন সেই স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া শীতল হয়ে গেলেও, আলোচনা থেমে নেই। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি মন্ত্রী ক্রিস রাইট সৌদি আরবে আসেন পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে সহযোগিতার বিষয়ে কথা বলতে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আব্রাহাম অ্যাকর্ডের চুক্তিগুলোকে নিজের পররাষ্ট্র নীতির বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি ব্যবসায়িক চুক্তিতেও আগ্রহী। ওয়েস্টিংহাউস ও বেকটেলের মতো মার্কিন কোম্পানিগুলো পারমাণবিক চুল্লি ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি নির্মাণে যে ভূমিকা রাখে, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তিতে তাদের মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা এই আলোচনাকে আরও এগিয়ে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

২০০৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘১২৩ চুক্তি’ করে। সেখানে তারা অঙ্গীকার করে যে, তারা নিজস্বভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করবে না, বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির অনুমতি দেয়। কিন্তু সৌদি যুবরাজ এমন চুক্তি চাইছেন, যেখানে নিজেদের মাটিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অধিকার থাকবে। তাদের দাবি, দেশে বিপুল ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে।

বছরের শুরুতে সৌদি জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন সালমান বলেন, ‘আমরা এটি সমৃদ্ধ করব, বিক্রি করব এবং আমরা ইয়েলোকেক তৈরি করব।’ ইয়েলোকেক হলো খনি থেকে উত্তোলনের পর সমৃদ্ধকরণের আগের পর্যায়।

এক সৌদি বিশ্লেষক বলেন, ‘সমৃদ্ধ না করা সৌদিদের জন্য বড় ছাড় হবে। এটি অর্থনৈতিক ইস্যুও। কারণ, ইউরেনিয়াম রপ্তানি করার চেয়ে নিজেরাই সমৃদ্ধ করলে তারা বেশি লাভ করবে। পাশাপাশি এটি জাতীয় মর্যাদার ব্যাপার। প্রশ্ন হলো, যদি সৌদিরা সমৃদ্ধ না করে, তাহলে বিনিময়ে ট্রাম্প থেকে তারা কী পাবে?’

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বার্নার্ড হায়কেল আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিনিময়ে সৌদি আরব ‘পারমাণবিক অস্ত্র সুরক্ষা’ চাইতে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘আমি মনে করি আপাতত তারা সমৃদ্ধকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে সরে আসতে পারে, কিন্তু তারা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সুরক্ষা চাইবে। এতে সৌদি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েনও থাকতে পারে।’

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার গ্রেগরি গস বলেন, ‘ইতিহাসে আমরা নানা জায়গায় পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছি। কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই সৌদি আরবে এমন মোতায়েন সম্ভব।’ তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, ট্রাম্প চাইলে ভারত মহাসাগরে এসব সাবমেরিন টহল দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে পারেন।

সৌদি আরব কি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান পাবে

যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা জানান, সফরে সৌদি আরবের যুবরাজ ১৮টি বিমানে করে ১ হাজার কর্মকর্তা নিয়ে ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের পর এমবিএসের প্রথম হোয়াইট হাউস সফর এটি। সেই সফরের সাত মাস পর ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাশোগিকে হত্যা করা হয়। এতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনা করে এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনও তীব্র নিন্দা জানান।

বাইডেন প্রশাসনের শুরুর দিকে ওয়াশিংটন-রিয়াদ সম্পর্ক ঠান্ডা থাকলেও ২০২২ সালে তা আবার উষ্ণ হয়। মূলত রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর যুক্তরাষ্ট্রের সৌদি জ্বালানি প্রয়োজন হওয়ায়। এই সময়ে সৌদি যুবরাজ আরও শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসেন। তিনি ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করেন এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করেন। অনেক আগেই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠেছেন। এবারকার সফর মূলত ট্রাম্পের গালফ সফরের সময় যে বিশাল প্যাকেজ চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছিল তা চূড়ান্ত করা।

দুই পক্ষ তখন ১৪২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বিক্রির ঘোষণা দেয়। এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানও সেই সম্ভাব্য চুক্তির অংশ ছিল। গত সপ্তাহে রয়টার্স জানায়, এই প্যাকেজে সৌদি আরবের জন্য ৪৮টি পর্যন্ত এফ-৩৫ থাকতে পারে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই এ বিক্রির বিষয়ে উদ্বেগ আছে। ইসরায়েল বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র দেশ যারা এফ-৩৫ চালায় এবং তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে আমিরাতকে এফ-৩৫ বিক্রির পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু চীনের প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার নিয়ে উদ্বেগের কারণে বাইডেন প্রশাসন তা আটকে দেয়। সেই একই উদ্বেগ সৌদি আরব নিয়েও রয়েছে বলে বর্তমান ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা জানান।

অ্যারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরির মহাকাশ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড আবুলালাফিয়া বলেন, চুক্তি হলেও ডেলিভারি পেতে তিন থেকে চার বছর লাগবে, কারণ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আগেই অর্ডার করেছে।

তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের সামরিক প্রাধান্য নিশ্চিত করতে অতীতেও সৌদিদের দেওয়া অস্ত্র ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে সৌদি আরবকে যে এফ-১৫ এস স্ট্রাইক ইগল বিক্রি করা হয়েছিল, সেখানে রাডার ও ইলেকট্রনিক প্রতিরক্ষায় কিছুটা দুর্বল সংস্করণ দেওয়া হয়। এফ-৩৫ সম্পর্কে আবুলালাফিয়া বলেন, ‘এই বিমানগুলোতে দূর থেকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে যে কোনো সময় এগুলো বন্ধ করে দিতে পারে।

ইসরায়েল নিজস্ব সংস্করণ এফ-৩৫ আই অ্যাডায়ারে অনেক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাদের তৈরি অতিরিক্ত জ্বালানি বহনক্ষমতা বিমানটির স্টেলথ ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রেখে দীর্ঘ দূরত্বে উড্ডয়ন সম্ভব করেছে। এই পরিবর্তিত এফ-৩৫ ব্যবহার করেই ইরানে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে।

সৌদি নিরাপত্তা বিশ্লেষক আল–গান্নাম বলেন, এ ধরনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ‘স্থানীয়করণ’ই সৌদির প্রধান লক্ষ্য। তাঁর ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সহায়তা ছাড়া’ সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় অস্ত্র নির্মাতা সৌদি অ্যারাবিয়ান মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ আন্তর্জাতিক মানের কোনো কোম্পানিতে পরিণত হতে পারবে না।

ড্রোন থেকে ডেটা সেন্টার: সৌদি আরবের এআই উচ্চাভিলাষ

এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব শত শত এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন বিক্রির বিষয়েও আলোচনা চালাচ্ছে। তবে প্রতিরক্ষা খাতের অভ্যন্তরীণ সূত্র ও কর্মকর্তাদের মতে, সৌদি আরব এখন ক্রমশ বাছাই করে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নিচ্ছে। তাই এই সফরের সময় নজর রাখার জায়গা হচ্ছে তুলনামূলক ছোট প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তি।

সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ শিল্ড এআই-এর সঙ্গে আলোচনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির এআই-সমর্থিত ভি-ব্যাট ড্রোন ইতিমধ্যেই ইউক্রেনে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোম্পানিটি আরও একটি ‘ভার্টিকাল টেকঅফ’ ড্রোন নিয়ে কাজ করছে, যা আকাশ থেকে আকাশে ও আকাশ থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম অস্ত্র বহন করতে পারে।

আলাপ সম্পর্কে অবহিত এক ব্যক্তি বলেন, ‘রিয়াদ তাদের (শিল্ড এআই) বড় আগ্রহের এলাকা। সৌদিরা মাঝারি আকারের ড্রোন চাচ্ছে। তারা এমন কোলাবরেটিভ কমব্যাট এয়ারক্রাফট চায়, যা যুদ্ধবিমানের সঙ্গে পাশাপাশি উড়তে পারে; আর তারা এমন ড্রোনও খুঁজছে যা সামুদ্রিক নজরদারিতে কার্যকর।’

প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সৌদি আরবও মার্কিন এআই চিপের দিকে নজর দিচ্ছে। মে মাসে এনভিডিয়া ঘোষণা করেছে যে, তারা সৌদি আরবের এক ট্রিলিয়ন ডলারের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের মালিকানাধীন এআই প্রতিষ্ঠান ‘হিউমেইন’-কে তাদের উন্নত ব্ল্যাকওয়েল চিপের হাজারো ইউনিট বিক্রি করবে।

সৌদি আরব নিজেকে এআই হাব হিসেবে তুলে ধরছে, কম দামের বিদ্যুৎ দিয়ে ডেটা সেন্টার চালানোর সুবিধা তুলে ধরে। হিউমেইন রিয়াদ থেকে দাম্মাম পর্যন্ত ডেটা সেন্টার নির্মাণ করছে; ২০৩৪ সালের মধ্যে এসব সেন্টারের মোট সক্ষমতা হবে ৬.৬ গিগাওয়াট। সৌদির আরেক এআই কোম্পানি ডেটাভল্ট লোহিত সাগর উপকূলে ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি ডেটা সেন্টার তৈরি করছে।

যদিও মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সৌদি সফরে নানা এআই চুক্তি ঘোষণা করা হয় ছিলো বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে, কিন্তু সেই চিপের সরবরাহ আটকে আছে, প্রকাশ্যে কোনো অগ্রগতির খবরও নেই। কিছু মার্কিন কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সৌদি আরবে এসব মার্কিন এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে চীন হয়তো প্রবেশাধিকার পেতে পারে। যুবরাজ ওয়াশিংটনে গিয়ে এসব চুক্তির অগ্রগতি বাড়াতেই চাপ তৈরি করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লন্ডন থেকে রাত সোয়া ১২টায় দেশের পথে রওনা দেবেন তারেক রহমান, বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা

রাজধানীর মগবাজারে ‘ককটেল’ বিস্ফোরণে যুবক নিহত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

তারেক রহমানের জন্য উড়োজাহাজে এ-১ আসন নির্ধারণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার যানজট

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লন্ডন থেকে রাত সোয়া ১২টায় দেশের পথে রওনা দেবেন তারেক রহমান, বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা

রাজধানীর মগবাজারে ‘ককটেল’ বিস্ফোরণে যুবক নিহত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

তারেক রহমানের জন্য উড়োজাহাজে এ-১ আসন নির্ধারণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার যানজট

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লন্ডন থেকে রাত সোয়া ১২টায় দেশের পথে রওনা দেবেন তারেক রহমান, বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা

রাজধানীর মগবাজারে ‘ককটেল’ বিস্ফোরণে যুবক নিহত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

তারেক রহমানের জন্য উড়োজাহাজে এ-১ আসন নির্ধারণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার যানজট

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লন্ডন থেকে রাত সোয়া ১২টায় দেশের পথে রওনা দেবেন তারেক রহমান, বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা

রাজধানীর মগবাজারে ‘ককটেল’ বিস্ফোরণে যুবক নিহত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

তারেক রহমানের জন্য উড়োজাহাজে এ-১ আসন নির্ধারণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার যানজট

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লন্ডন থেকে রাত সোয়া ১২টায় দেশের পথে রওনা দেবেন তারেক রহমান, বিমানবন্দরে বাড়তি নিরাপত্তা

রাজধানীর মগবাজারে ‘ককটেল’ বিস্ফোরণে যুবক নিহত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

তারেক রহমানের জন্য উড়োজাহাজে এ-১ আসন নির্ধারণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার যানজট

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত