Ajker Patrika

দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ /মিয়ানমারে জান্তা ও বিদ্রোহীদের লাগাম এখন চীনের হাতে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৭: ৩৯
মিয়ানমারের শান রাজ্য কেন্দ্রিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) সদস্য ও অস্ত্রশস্ত্র। ছবি: ফেসবুক
মিয়ানমারের শান রাজ্য কেন্দ্রিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) সদস্য ও অস্ত্রশস্ত্র। ছবি: ফেসবুক

মিয়ানমারে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানটি ঘটে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর থেকেই দেশটিতে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা চলছে। জান্তা সরকারের সহিংস দমন-পীড়নের বিপরীতে তৃণমূলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিরোধ দেশটিকে বহুধা বিভক্ত করে ফেলেছে। মাত্র চার বছরের কিছু বেশি সময়ে সারা দেশে পাঁচ শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। পুরোনো জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো তো আছেই।

গোষ্ঠীগুলো জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত গেরিলা যুদ্ধ শুরু করলেও তা এখন পূর্ণাঙ্গ, বহুমুখী সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মধ্যে ১৬ হাজারের বেশি সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।

এই গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে বড় মোড় আসে ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর। সেদিন থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স—আরাকান আর্মি (এএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করে। অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে তারা জান্তার ওপর বড় আঘাত হানে। জোটটি মিয়ানমারের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয় এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলো থেকে সামরিক বাহিনীকে বিতাড়িত করে।

তবে সবচেয়ে বড় প্রতীকী জয় সম্ভবত ছিল এমএনডিএএ ও মিত্রদের উত্তর শান রাজ্যের লাশিওতে অবস্থিত জান্তা বাহিনীর উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক সামরিক কমান্ড দখল। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন অর্জন।

আপাতদৃষ্টিতে মিয়ানমারে মূল খেলোয়াড় জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীরা হলেও দেশটির রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে চীন দীর্ঘদিনের নীরব কিন্তু শক্তিশালী খেলোয়াড়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বেইজিং ‘হস্তক্ষেপ না করার’ নীতি মেনে চলার কথা বলে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে বেইজিং সেই নীতি পরিবর্তন করছে। দেশটির লক্ষ্য হলো—মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতা থেকে নিজেদের কৌশলগত বিনিয়োগ রক্ষা করা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখা।

‘অপারেশন ১০২৭’—এর দ্বিতীয় ধাপের পর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ভূমিকা লক্ষণীয়ভাবে আরও দৃঢ়, এমনকি জবরদস্তিমূলক হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে জান্তা সরকার ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে চীনকে নিরপেক্ষ সহায়তাকারী হিসেবে দেখা হলেও দেশটির সর্বশেষ মধ্যস্থতা আগের অবস্থান থেকে স্পষ্ট ‘বিচ্যুতি’।

এবার বেইজিং দৃঢ়ভাবে এমন একটি সমাধানের জন্য চাপ দিচ্ছে, যা তার নিজের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তারা সামরিক জান্তা ও প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। চীন নিশ্চিত করেছে, যাতে কোনো একক পক্ষ চীনের আঞ্চলিক প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে না পারে।

কূটনৈতিক চাপ ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা—দুয়ে মিলে চীন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে সফল হয়েছে। চলতি এপ্রিলে নয় মাস লাশিও দখলে রাখার পর এমএনডিএএ শহরটি জান্তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। চীনা হস্তক্ষেপ ছাড়া এই পদক্ষেপ অকল্পনীয়। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি মিয়ানমারের মাটিতে ফলাফল নির্ধারণে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধিরই ইঙ্গিত।

কে আলোচনার টেবিলে বসবে, আর কে বসবে না—বেইজিং কেবল সেটিই নির্ধারণ করছে না, বরং আলোচনায় কে কী পাবে, সেটিও নির্ধারণ করে দিচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর জন্য এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। চীনের এই দৃঢ়তা কেবল সামরিক কৌশলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রকেও নতুন করে সাজাচ্ছে। চীন যখন মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন এর সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে তিনটি।

প্রথমত—চীন সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর কৌশলগত অর্জনকে সক্রিয়ভাবে সীমিত করছে। প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর জন্য চূড়ান্ত কৌশল স্পষ্ট—সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সামরিক জান্তাকে উৎখাত করা। এই ধারণা জনমত ও কৌশলগত পরিকল্পনা উভয় ক্ষেত্রেই প্রাধান্য বিস্তার করেছে।

তবে চীনের জবরদস্তিমূলক মধ্যস্থতার ধরন এই উদ্দেশ্যকে সূক্ষ্মভাবে ক্ষুণ্ন করে। প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে থাকা প্রতিটি শহর বা নগর নিয়ে বেইজিং হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, তবে তার স্বার্থ ঝুঁকির মুখে পড়লে হস্তক্ষেপ করার নমুনা দেশটি দেখিয়েছে। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—প্রতিরোধ বাহিনীগুলো কত দূর যেতে পারবে তার একটি নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে এবং এটি নির্ধারণ করে দেবে চীনই।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—জান্তা বা প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর কোনো এক পক্ষকে বেছে নেওয়ার অবস্থা এখন নেই। বরং চীনের তৎপরতা এখন একটি বৃহত্তর কৌশলগত হিসাবকে প্রতিফলিত করে। এই হিসাবকে মিয়ানমারের অস্থির ক্ষমতার সমীকরণে নিজ হাতে ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখার কৌশল বলা যেতে পারে এবং চীন এমনটিই চাচ্ছে।

বেইজিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ভৌগোলিকভাবে খণ্ডিত মিয়ানমারের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত মিয়ানমার অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। দুর্বল ও বিভক্ত—কিন্তু এখনো অখণ্ড—একটি দেশ চীনের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করে। এই কৌশল মিয়ানমার রাষ্ট্রের পতন না ঘটিয়েই আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকির বাইরে থেকে চীনকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়। বেইজিংয়ের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি হলো—এমন একটি দুর্বল মিয়ানমার, যাতে তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায়, অথচ চীনের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র হিসেবে অখণ্ড থেকে যায়।

দ্বিতীয় পরিণতি হলো—‘চীনা বৈশিষ্ট্যযুক্ত সংঘাত সমাপ্তি মডেলের’ উত্থান, যা মিয়ানমারের জন্য নির্ধারক ‘নির্দেশিকা’ হয়ে উঠতে পারে। বছরের পর বছর ধরে পশ্চিমা দাতা ও সরকারগুলো মিয়ানমারের শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ, সংলাপ সহজীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করেছে।

তবুও ফলাফল খুবই সীমিত, টেকসই ফলাফল প্রায় হয়নি বললেই চলে। বিপরীতে, চীন এখন নিজস্ব মডেল এগিয়ে নিচ্ছে, যা দৃঢ় মধ্যস্থতা ও যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। সম্প্রতি লাশিওর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরে বেইজিংয়ের ভূমিকা এর উদাহরণ।

লাশিও প্রক্রিয়া যদি কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে মিয়ানমারে ভবিষ্যতের সংঘাতগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে এবং বেইজিংয়ের কৌশলগত হিসাব কীভাবে মিয়ানমারের ভূ–কৌশলগত বিষয়াবলিতে পরিণতি পাবে, তার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে এটি। একই সময়ে উত্তেজনা হ্রাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিভিন্ন সংগঠনগুলোতে অর্থায়ন কমাচ্ছে।

উপরন্তু, বেইজিং কেবল মূল অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়দের ওপরই নয়, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো প্রভাবশালী আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপরও যথেষ্ট প্রভাব রাখে। এই প্রভাব অনিবার্যভাবে প্রতিটি আলোচনা প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তবে চীন সহিংসতা কমাতে সহায়ক হলেও টেকসই শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় গভীর কাঠামোগত সংস্কারকে উৎসাহিত করার সম্ভাবনা কম। ন্যায়বিচার, সমতা ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের দ্বারা সংজ্ঞায়িত ইতিবাচক শান্তি বেইজিংয়ের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে। আর আজকের মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে এটি বাস্তবসম্মত উদ্দেশ্য বলেও মনে হয় না।

চূড়ান্ত ও সম্ভবত সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিণতিটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে চীনের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্তমানে বিশ্বমঞ্চে দুটি সম্ভাব্য গতিপথ দেখা যাচ্ছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘ভূ-রাজনৈতিক উপেক্ষা’ ও ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা’। উভয় পরিস্থিতিই মিয়ানমারের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করে।

ভূ-রাজনৈতিক উপেক্ষার ক্ষেত্রে, অন্যান্য সংকট ও অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারে ব্যস্ত থাকা ক্লান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্ভবত মিয়ানমারকে চীনের কাছেই ছেড়ে দেবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের প্রতিবেশীসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলো টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক শাসনের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত স্বার্থরক্ষা করাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে চীন তার পছন্দের পরিণতির বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিরোধও চাইবে না এবং নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ অনুযায়ী মিয়ানমারের সংঘাতপরবর্তী রূপান্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভালোভাবেই প্রস্তুত থাকবে। এই অবস্থান কার্যকরভাবে বেইজিংকে দেশটির ভবিষ্যৎ গঠনের সক্ষমতা দেবে।

তবে বিকল্প পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হতে পারে। বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার পুনরাবির্ভাবে দেশটিকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা বাড়তে পারে, যা দেশটিকে আরও গভীর বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতার কেন্দ্রের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়তে পারে এবং অস্ত্র পাচার থেকে শুরু করে মাদক কারবারের মতো অবৈধ অর্থনীতি এই অস্থিরতায় ফুলেফেঁপে উঠবে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দ্বিতীয় পথটি (ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা) বিপর্যয়কর হতে পারে।

উপেক্ষা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়ার ব্যর্থতা মিয়ানমারকে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে, যা শান্তি বা সমৃদ্ধি দ্বারা নয়, বরং ভঙ্গুরতা ও বিদেশি হস্তক্ষেপ দ্বারা সংজ্ঞায়িত হবে।

মিয়ানমার ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের আগের রাজনৈতিক সংকটকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে। দেশটি এখন একটি দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যেখানে সামরিক জান্তা ও প্রতিরোধ বাহিনী উভয়ই নিজ নিজ অনমনীয় এজেন্ডায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটির প্রতি ক্রমবর্ধমানভাবে উদাসীন, বহুমাত্রিক বৈশ্বিক সংকটে বিভ্রান্ত এবং সেখানে নাক গলাতে অনিচ্ছুক। এই প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারকে হয়তো শেষ পর্যন্ত সংঘাত ও খণ্ডিত হওয়ার চক্র থেকে মুক্তির পথ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পণ্ডিত জন সিডেনহ্যাম ফার্নিভ্যাল একবার সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘কমবেশি দীর্ঘ অরাজকতার পর আমাদের বংশধরেরা হয়তো বার্মাকে চীনের একটি প্রদেশ হিসেবে খুঁজে পাবে।’ বক্তব্যটি অতিশয়োক্তি বা অযৌক্তিক ভীতি তৈরি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু গভীর অস্থিরতার এই সময়ে ফার্নিভ্যালের কথাগুলো অস্বস্তিকর প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে অনুরণিত হচ্ছে। মিয়ানমারের আক্ষরিকভাবে চীনের প্রদেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কম হলেও দেশটির রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পুনর্গঠনে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব স্পষ্ট ও ক্রমশ নির্ণায়ক হয়ে উঠছে।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত