Ajker Patrika

হামাস গঠনে কেন সহায়তা করেছিল ইসরায়েল?

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১৮: ১৮
হামাস গঠনে কেন সহায়তা করেছিল ইসরায়েল?

হামাস একটা ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপ। তারা আইএসের মতোই বর্বর। হামাস শান্তি চায় না। তারা ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে চায়। তারা পৃথিবীর সব ইহুদিকে নির্মূল করতে চায়। এটাই তাদের একমাত্র মিশন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় আরেক ধর্মান্ধ গ্রুপ লিবিয়ার হিজবুল্লাহ। এই উভয় ধর্মান্ধ উগ্র ইসলামপন্থী গ্রুপের পেছনে রয়েছে ধর্মান্ধ শিয়া রাষ্ট্র ইরান। 

ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী সশস্ত্র গ্রুপ হামাস সম্পর্কে এই হলো ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। হামাসের ওপর সব দায় চাপিয়ে দুই দশক ধরে অবরুদ্ধ গাজাবাসীর ওপর নির্বিচার বোমা হামলা, বর্বরতা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। পশ্চিমারাও বলে আসছে, ইসরায়েলের অবশ্যই আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। যদিও পশ্চিম তীরে হামাসের অস্তিত্ব না থাকলেও, সেখানে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে এযাবৎ কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন হামাসকে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বলা হয়, হামাস গাজার ২২ লাখ নিরপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে ঢাল বানিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও ফিলিস্তিনে ২০০৭ সালের পর আর কোনো জাতীয় নির্বাচন হয়নি। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল হামাস। এর আগে যখন হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন ইসরায়েলি গুপ্তহত্যার শিকার হন, তখন গাজায় হামাসের পক্ষে বিশাল বিক্ষোভ দেখে ইসরায়েলও রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিল। 

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, হামাস—যা আরবিতে ‘ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ—ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত না হলে হয়তো গাজায় এত শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে টিকে থাকতে পারত না, অথবা অস্তিত্বই থাকত না! 

ইসরায়েল ও আমেরিকার একাধিক সরকারি কর্মকর্তার বরাতেই জানা যায়, ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে একগুচ্ছ ফিলিস্তিনি ইসলামপন্থী গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে একটি একক সশস্ত্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীতে পরিণত করতে সহায়তা দিয়েছে খোদ ইসরায়েল! আজকের ‘হামাস’ নামের সেই গোষ্ঠীটিই এখন ইসরায়েলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, জেনেবুঝে একটি উগ্র ইসলামপন্থী সংগঠনকে শক্তি-সামর্থ্যে পুষ্ট করা কি দুধ-কলা দিয়ে বিষধর সাপ পোষার মতো নয়? ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের নিশ্চয়ই সেই বোধবুদ্ধি আছে। কী এমন স্বার্থ থাকতে পারে এর পেছনে? 

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জানার চেষ্টা করা যাক, এটি কেন একটি নিছক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নয়। এর পেছনে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মুখে শোনা যাক সেই গল্প। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইতজাক সেগেভ, ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক গভর্নর ছিলেন। সেগেভ পরে নিউইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন, ইসরায়েল সরকারের সিদ্ধান্তেই তিনি ফিলিস্তিনি ইসলামি আন্দোলনকে অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন। 

সেগেভ বলেন, ‘ইসরায়েল সরকার আমাকে একটি বাজেট দিয়েছিল এবং গাজার সামরিক সরকার সেই টাকা মসজিদে দেয়। 

‘আমার বড় খেদের বিষয় হলো হামাস ইসরায়েলের সৃষ্টি।’ এটিও কিন্তু একজন উচ্চপদস্থ ইসরায়েলি কর্মকর্তার বক্তব্য। আভনার কোহেন, ইসরায়েলের ধর্মীয় বিষয়ক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। গাজায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। ২০০৯ সালে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে তিনি এ কথা বলেন। 

২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস করে উইকিলিকস। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের অংশে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রসঙ্গও এসেছে। 

সেখানে বলা হয়েছে, গাজায় ফাতাহ এবং হামাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০০৭ সালের জুনে ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন পরিচালক মেজর জেনারেল আমোস ইয়াদলিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড জোনসকে বলেন, হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে ইসরায়েল খুশিই হবে। কারণ, ইসরায়েল তখন গাজাকে সরাসরি শত্রুভূমি হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। মার্কিন দূত তখন বলেন, ফাতাহ সেখানে নিয়ন্ত্রণ হারালে মাহমুদ আব্বাস পশ্চিম তীরে আলাদা সরকার গঠনের তাগিদ বোধ করতে পারেন। জবাবে ইয়াদলিন বলেন, এ ধরনের কিছু ঘটলে ইসরায়েল খুশি হবে। কারণ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর (আইডিএফ) তখন হামাসের মতো একটি রাষ্ট্রহীন গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। আর ফাতাহ নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম তীরে তখন ইসরায়েল সহযোগিতা করতে পারবে। 

হামাস সৃষ্টির পেছনে ইসরায়েলের সম্ভাব্য ভূমিকা প্রসঙ্গে উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিতে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনের প্রথম ইন্তিফাদাহ নস্যাৎ করে দিতে ‘প্রোটেক্টিভ এজ’ সামরিক অভিযানকালে ইসরায়েল হামাসকে শক্তিশালী করার আগ্রহ দেখায়। ১৯৮৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক আলাপের নথিতে পাওয়া যাচ্ছে, ওই সময় পশ্চিম তীরের অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করতেন—ইসরায়েল হামাসকে সহযোগিতা করছে। অনেক দোকানি বলেছেন, ফাতাহ যখন ইসরায়েলি বাহিনীর ভয়ে গোপনে লিফলেট বিলি করছিল, তখন হামাসকে প্রকাশ্যেই তাদের লিফলেট বিলি করতে দেখা গেছে। ওই সময় মার্কিন নথিতে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক গ্রেপ্তার হলেও হামাসের লোক খুব কমই গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস, ইসরায়েল হামাসের ব্যাপারে শুধু চোখ বন্ধ করেই থাকছে না, বরং তারা হামাসকে সহযোগিতা করছে। 

একুশ শতকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল হামাসের সঙ্গে তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং চলতি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখনো চলমান। প্রথম তিন যুদ্ধে ইসরায়েল গাজায় প্রায় আড়াই হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। আর চলমান যুদ্ধে এরই মধ্যে গাজায় নিহত তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। 

আর হামাস, এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ইসরায়েলি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে, তা ফিলিস্তিনের কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সশস্ত্র গোষ্ঠীর চেয়ে অনেক বেশি। চলমান যুদ্ধে ১ হাজার ৪০০-র বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে তেল আবিব। আর গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি কমপক্ষে ২০০। এর মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধও রয়েছেন। স্পষ্টত হামাসের কারণে ইসরায়েলকেও কম মানবিক মূল্য দিতে হয়নি! 

নাকের ডগায় এই হামাসকে এত দিন কেন বাড়তে দিল ইসরায়েল? যাদের এখন নির্মূল করার জন্য গাজায় নির্বিচারে বোমা ফেলছে নেতানিয়াহুর সরকার? ৭ অক্টোবরের ঘটনার বারবার উল্লেখ করে এই নৃশংসতাকে তারা ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পশ্চিমের গণমাধ্যমগুলোও সাফাই গাইছে। 

এর উত্তরটিও দিয়েছেন ইসরায়েলের কর্মকর্তারা। 

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইৎজাক সেগেভ নিউইয়র্ক টাইমসে বলেছিলেন, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও বামপন্থী এবং ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহ পার্টির বিপরীতে অক্ষশক্তি হিসেবে ফিলিস্তিনি ইসলামি আন্দোলনকে অর্থ সহায়তা করেছিল ইসরায়েল। 

ইয়াসির আরাফাত নিজেও হামাসকে ‘ইসরায়েলের সৃষ্টি’ বলে অভিমত দিয়েছিলেন। 

আর গাজার সাবেক ধর্মবিষয়ক কর্মকর্তা আভনার কোহেন ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থীদের সহযোগিতা দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। 

সেই প্রতিবেদনে কোহেন ফিলিস্তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের সমর্থন করে অধিকৃত অঞ্চলে ‘বিভাজন ও শাসনের’  (ডিভাইড অ্যান্ড রুল) খেলা বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতনদের সতর্ক করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি...এই বাস্তবতা আমাদের মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে, এই দানবকে ভেঙে দেওয়ার উপায় খুঁজে বের করার প্রচেষ্টার ওপর মনোযোগ দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।’ 

কিন্তু ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা কথা শোনেননি। এমনকি বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অগোচরেই তারা হামাসকে সংগঠিত হতে সহযোগিতা করে গেছে। 

অবশ্য একই ভুল যুক্তরাষ্ট্রও আফগানিস্তানে করেছে। সেখানে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিতে মুজাহিদিনদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ, রসদ সবকিছুই দিয়েছে। মুজাহিদিনদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সোভিয়েতদের সফলভাবেই হটিয়ে দিয়েছে আমেরিকা। কিন্তু সেখানে গড়ে উঠেছে আরেক দানব—তালেবান। এর মূল্য দিতে হয়েছে নাইন-ইলেভেনে। এরপর আফগানিস্তানে দীর্ঘ ক্লান্তিকর এবং অবশ্যই ব্যয়বহুল একটি যুদ্ধ বয়ে বেড়াতে হয়েছে। পরিহাসের বিষয়, পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে মার্কিন সেনারা, সেই আফগানিস্তানের মসনদে এখন আবার সেই তালেবান। 

ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদাহতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন সারা বিশ্বের বামপন্থীরা। স্নায়ুযুদ্ধের কালে সেটি একটি বড় আতঙ্কের বিষয় তো বটেই। সেই আন্দোলনকে হীনবল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে বিভাজনের কৌশলকেই বেছে নিয়েছিল ইসরায়েল। সেটি যে একাবারে কাজে দেয়নি তা নয়। ফিলিস্তিন এখন বহুধা বিভক্ত। সেখানে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ, আর হামাস। অবশ্য গাজার বাইরে হামাসের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পশ্চিম তীর এবং রামাল্লাও ফাতাহর একক নিয়ন্ত্রণে নেই। সেখানে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হচ্ছে। ফলে শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধি কে হবে—সেই প্রশ্ন তুলে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েল। 

আরেকটি বড় সুবিধা ইসরায়েল এখনো নিচ্ছে, সেটি হলো—ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যা-তা প্রোপাগান্ডাকে পশ্চিমা বিশ্বে সহজে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারার সুযোগ। চলমান যুদ্ধেও হামাস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নারীদের নির্যাতন, ধর্ষণ, শিশুদের শিরশ্ছেদ করার মতো প্রোপাগান্ডা শুরুতে পশ্চিমে প্রায় বিশ্বাসযোগ্য করতে পেরেছিল ইসরায়েল। যদিও শেষ পর্যন্ত এসব অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। কিন্তু নাইন-ইলেভেনের পর পশ্চিমে ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে যে ধারণা প্রোথিত হয়েছে তাতে এ ধরনের সংগঠনের বিরুদ্ধে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বরতার অভিযোগও পশ্চিম চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে প্রস্তুত। এতে সুবিধা হলো, গাজায় প্রতিশোধমূলক নির্বিচার নৃশংসতার ন্যায্যতা আদায় করে নেওয়া গেল! 

তবে একই সঙ্গে এটিও সত্য যে হামাস এখন ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে কঠিন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। ঘটনাটির ক্রম এমন: প্রথমত, ইসরায়েলিরা হামাস এবং তার মুসলিম ব্রাদারহুডের পূর্বসূরিদের সংগঠিত করে ফিলিস্তিনে রাজনৈতিক ইসলামের একটি যুদ্ধংদেহী ধারা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে; এরপর, ইসরায়েলিরা কৌশল পরিবর্তন করেছে এবং হামাসকে নির্মূল করার কৌশল নিয়েছে। সেই কৌশলের ভুক্তভোগী গাজার ২২ লাখ মানুষ, যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী বোমা, অবরোধ ও অপমান। 

১৯৮০-এর দশকে গাজায় অবস্থানকারী ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আরববিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডেভিড হাচাম পরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যখন আমি ঘটনার শৃঙ্খলের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমার মনে হয়, আমরা একটি ভুল করেছি। কিন্তু সেই সময়ে, সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে কেউ ভাবেনি।’ 

উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রথম ইন্তিফাদাহ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি ইমাম এবং অধিকারকর্মী শেখ আহমেদ ইয়াসিন তাঁর মুজামা আল ইসলামিয়া নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেই হামাসে রূপ দেন। এই ধর্মীয় দাতব্য সংস্থাটি প্রথমে গাজায় প্রতিষ্ঠিত করেন ১৯৭৩ সালে। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হয় এ সংগঠন। 

 ১৯৯০-এর দশক থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জড়িয়েছে হামাস। মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গাজা নিয়ন্ত্রণে নেয় হামাস। শুরুর দিকে তারা ফাতাহ প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রস্তাবে সম্মত থাকার কথা জানিয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পরও ক্ষমতায় বসতে না পারা হামাস এখনো ফিলিস্তিনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী বলে দাবি করে। ফলে ফিলিস্তিনের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। 

জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত