Ajker Patrika

ভারতের প্রত্যাশার বিপরীতে হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাঁর দেশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং ‘পেনাল্টি’ আরোপ করেছেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই শুল্কের খামখেয়ালিপনার মুখে ভারত ভয় পাবে না, তবে কৌশল বদলাতে পারে—বলে মনে করেন শশী থারুর। কংগ্রেসের এই এমপি বলেছেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখবে, তবে সম্পর্কটা হতে পারে আগের চেয়ে বেশি স্বার্থভিত্তিক। আদর্শ নয়, নিজের লাভ-ক্ষতির দিকটাই গুরুত্ব পাবে। একই সঙ্গে ভারত নিজেকে আরও স্বনির্ভর করে তোলার দিকেও নজর দেবে।

শশী থারুর
একসময়ের বন্ধু মোদির দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের। ছবি: সংগৃহীত
একসময়ের বন্ধু মোদির দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ভারসাম্যমূলক। দুই দেশের মধ্যে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির মতো কিছু অভিন্ন মূল্যবোধ রয়েছে। কিন্তু আবার অনেক সময়ই দুই দেশের জাতীয় স্বার্থ ভিন্ন পথে চলে। তাই সম্পর্কটি কখনো খুব ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

তবে সাম্প্রতিক কিছু কূটনৈতিক ঘটনায় ভারত দারুণ অস্বস্তিতে পড়েছে। এখন নয়াদিল্লিতে মধ্যে প্রশ্ন উঠছে—এই সম্পর্ক কি বড় কোনো পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে?

ভারতের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক ধরনের ‘ভূরাজনৈতিক নাটকীয়তা’ দেখিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাত থামানোর কৃতিত্ব তাঁরই। তিনি বলেন, তিনি পাকিস্তানকে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাই পাকিস্তান পিছু হটেছে। ভারত এই দাবিতে খুবই ক্ষুব্ধ। কারণ, একদিকে ভারত তার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে খুব সংবেদনশীল, আর অন্যদিকে ট্রাম্পের এই দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দুজনেই বলেছেন, সেই সময় ট্রাম্প তাঁদের কারও সঙ্গে ফোনেও কথা বলেননি। সংঘাতের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাণিজ্য বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। ফলে ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর।

হয়তো ট্রাম্প পাকিস্তানের ওপর কিছুটা চাপ দিয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের ওপর তাঁর কোনো প্রভাব ছিল না। ভারত এমনিতেই শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। তাই বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ বা সংঘাতে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাই ভারতের ছিল না।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের পেহেলগামে তথাকথিত ‘পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা’ ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ পরিচালনা করে। এটি ছিল নির্ভুল, দ্রুত এবং সীমিত পাল্টা ব্যবস্থা। এতে পাকিস্তানের ভেতরে ৯টি চিহ্নিত জঙ্গি ঘাঁটি ও অন্যান্য স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল শুধুই সেই সন্ত্রাসীরা, যারা ভারতীয় পর্যটকদের হত্যা করেছিল। এটা কোনোভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার পদক্ষেপ ছিল না। তবে পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যে, সন্ত্রাসীরা তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা করেছে।

পাকিস্তান এরপর পাল্টা হামলা চালায় এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাতে থাকে। ভারত জবাবে পাকিস্তানের ১১টি বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়, তবে তা ছিল আবারও হিসেব করে নেওয়া এবং কৌশলগতভাবে পরিমিত এক প্রতিক্রিয়া। এরপর পাকিস্তানও ভারতের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে এবং ভারতের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে, যার মধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমানও ছিল।

এই দ্বিতীয় দফা হামলার পরই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে আগ্রহ দেখায়। হয়তো যুক্তরাষ্ট্র সেসময় পাকিস্তানকে চাপ দিয়েছিল। তবে এতে ট্রাম্পের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি নিজেই কৃতিত্ব দাবি করেছেন, যা ভারতের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে—তাঁরা কোনো হুমকি বা প্রলোভনে নয়, নিজেদের সিদ্ধান্তেই এই সব পদক্ষেপ নিয়েছে।

ট্রাম্পের এমন আচরণ ভারতে অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে। তবে এটিই একমাত্র ঘটনা নয়, যা ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছে। চলতি বছরের জুন মাসে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন। সেখানে পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। ভারতের সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই আসিম মুনিরকে একজন কট্টর ইসলামপন্থী ও ভারতবিদ্বেষীয় হিসেবে দেখে। তাঁর সঙ্গে ট্রাম্পের এই ঘনিষ্ঠতা ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

চীনের ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থানও ভারতের কাছে ধোঁয়াশাপূর্ণ। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন তিনি উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেন, বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন, এমনকি চীনকে সরাসরি আক্রমণাত্মক ভাষায় আক্রমণও করেন।

কিন্তু এখন ট্রাম্পের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। একদিকে তিনি চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে আবার শুল্ক বসাচ্ছেন, আর অন্যদিকে তিনি বলছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আমন্ত্রণে তিনি বেইজিং সফর করতে পারেন। আবার কখনো তিনি চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য সমঝোতা চাইছেন বলেও মন্তব্য করছেন। এই দ্বৈত আচরণে ভারত বিভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—এই নতুন চীন নীতিতে ভারতের অবস্থান কোথায়? আদৌ কি ট্রাম্পের মাথায় ভারত আছে?

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলেও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং চীনের প্রভাব প্রতিরোধে একটি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করত।

ভারত নিজেও তখন ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’ বা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছে। অর্থাৎ, সরাসরি কোনো শিবিরে যায়নি, বরং নিজের স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত কোয়াড জোট (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত) পুনরুজ্জীবিত করতেও উৎসাহ দেখিয়েছে।

এটা ভারতের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ, চীন কেবল ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করছে না, বরং পাকিস্তানকেও জোরালো সমর্থন দিচ্ছে। এখন চীন সরাসরি ভারতের শিল্প খাতকে দুর্বল করার কৌশল নিয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভারতীয় প্রকৌশলী শিক্ষার্থীদের যাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, ভারতীয় কারখানাগুলোর কাছে উন্নত চীনা যন্ত্রপাতি পৌঁছানো বন্ধ করছে।

ইতিমধ্যে এর প্রভাব ভারতের ইলেকট্রনিকস ও উৎপাদন শিল্পে পড়তে শুরু করেছে। এদিকে চীনের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে—ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকেও তারা প্রভাবিত করছে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি উভয় মহলই চীনকে এখন বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে অস্পষ্ট। ভারতের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, অন্তত পাকিস্তানকে চীন যে সামরিক গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে—বিশেষ করে উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার সাহায্য—সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরব হবে।

কিন্তু ট্রাম্প এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। বরং তিনি আবার ভারতের ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ করেছেন। ৩০ জুলাই তিনি ঘোষণা দেন, ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। একই সঙ্গে তিনি ভারতকে আরও এক ধরনের ‘পেনাল্টি’ দেওয়ার ঘোষণা দেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই শাস্তি হতে পারে আরও ১০ শতাংশ শুল্ক, কারণ ভারত এখনো রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কিনছে।

যদি বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তবে ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককেও ট্রাম্প ব্যবহার করতে পারেন—এমন ভয়ও এখন ভারতের মধ্যে রয়েছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের কৌশলগত দুশ্চিন্তা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনো ভারতের জন্য নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিল না—সে ইতিহাস ভারত ভুলে যায়নি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিপিএস ডেটা চেয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে ভারত নিজেই তার নিজস্ব ন্যাভিগেশন সিস্টেম গড়ে তোলে।

এখন ভারতের সামনে দুটি প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—১. ভারত কি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করবে? ২. নাকি যুক্তরাষ্ট্রকেও একইভাবে দূরে ঠেলে দিয়ে বাস্তববাদী কূটনীতি অনুসরণ করবে? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো—একটি সম্পর্ক যদি কোনো এক ব্যক্তির খামখেয়ালিপূর্ণ মেজাজের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সেই সম্পর্কের মূল্যই বা কতটুকু?

ভারত অবশ্য হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। কিন্তু এটা ঠিক যে, ভবিষ্যতে ভারত অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। ভারতের কোনো সামরিক চুক্তিভিত্তিক জোটে অংশ নেই, তাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের তুলনায় ভারতের কৌশলগত স্বাধীনতা অনেক বেশি।

সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত এখন কিছুটা ভিন্ন পথে হাঁটার কথা ভাবছে। এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের জুলাই মাসের বেইজিং সফরে। এটা দেখায় যে, ভারত চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে। তবে এর মানে এই নয় যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দিচ্ছে। বরং ভারত এখন আত্মনির্ভরতার ওপর জোর দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের মতো আদর্শভিত্তিক না রেখে বাস্তব স্বার্থভিত্তিক করে তুলছে।

ভারতের নতুন কৌশলগত নীতির মূল কথা হলো, ‘সন্ত্রাসে কোনো ছাড় নয়, সিদ্ধান্তে দৃঢ়তা থাকবে এবং প্রয়োজন হলে দ্রুত জবাব দেওয়া হবে।’ পাকিস্তানে থাকা জঙ্গি ঘাঁটিতে ভারতের হামলা এই নীতির বাস্তব উদাহরণ।

যত দিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, ভারত সেই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। কিন্তু সেই সম্পর্ক যদি একপেশে হয়ে পড়ে, তবে ভারত নিজস্ব পথেই হাঁটবে। কারণ, এখনকার বাস্তবতা এটাই—ভারতকে নিজের স্বার্থে, নিজের মতো করে পথ বেছে নিতে হবে।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকা সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দিল্লিতে মোদির এতোবড় নিরাপত্তা ব্যর্থতা সত্ত্বেও কেন নীরব বিরোধীরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
দিল্লি বিস্ফোরণের দুদিন পর গত বুধবার হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এক্স
দিল্লি বিস্ফোরণের দুদিন পর গত বুধবার হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এক্স

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘নতুন স্বাভাবিক’ (নিউ নরমাল) প্রতিষ্ঠার দাবির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চলতি বছর স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে মোদি বলেছিলেন, দেশ এখন সন্ত্রাসবাদকে আর সহ্য করবে না, অথচ এর মাত্র ছয় মাস পর সোমবার (১০ নভেম্বর) ঐতিহাসিক লাল কেল্লার কাছেই এক গাড়ি বিস্ফোরণে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিস্ফোরণের উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে প্রাথমিক অনিশ্চয়তা থাকলেও, ঘটনাটি পরে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কার্যকলাপ বলে নিশ্চিত করেছে সরকার।

যদিও সরকার এই ঘটনাকে সন্ত্রাসবাদী হামলা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে দু’দিন সময় নিয়েছেন। কিন্তু এরপরও প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য সরাসরি দায়ী করতে গিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নজিরবিহীনভাবে সতর্ক এবং নীরব ভূমিকা পালন করছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর সরকারের কঠোর নীতির প্রমাণ হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর উল্লেখ করে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁর সরকার আর পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং তাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করবে না। কিন্তু লাল কেল্লার অদূরে বিস্ফোরণটি সেই কঠোর দাবির বিপরীতে সরকারের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে।

সোমবার সন্ধ্যায় বিস্ফোরণটি ঘটে, যখন বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ও শেষ দফার ভোট গ্রহণের একদিন আগে রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। ঘটনার দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিস্ফোরণস্থল ও লোক নায়ক জয় প্রকাশ নারায়ণ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেও, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভুটানের সাবেক রাজার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই দিনের সফরে হিমালয়ের ওই দেশটিতে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ‘অসংবেদনশীলতা’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তোলে বিরোধী পক্ষ। বুধবার দিল্লি ফিরে তিনি দ্রুত হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।

বিস্ফোরণের প্রকৃতি এবং উৎস নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় প্রথমদিকে বহু রাজনীতিবিদ নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক ও সমবেদনা জানানোর মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন পোস্ট দেন।

বিস্ফোরণের সঙ্গে একটি ‘সন্ত্রাসী মডিউলের’ যোগসূত্রের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পরেও কোনো শীর্ষ বিরোধী নেতা বিস্ফোরণস্থল বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করেননি। এই নীরবতা রাজনৈতিক মহলে সমালোচিত হচ্ছে। শুধু আম আদমি পার্টি (এএপি) এবং কংগ্রেসের দিল্লি ইউনিটের স্থানীয় প্রতিনিধিরা আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। তবে এই স্থানীয় নেতারাও সন্ত্রাসবাদ বা জাতীয় নিরাপত্তার বৃহত্তর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে, কেবল বিস্ফোরণের পরবর্তী পরিস্থিতি ও সরকারি ব্যবস্থাপনার ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সাংসদ পার্থ ভৌমিক ঘটনার আদালত-পর্যবেক্ষিত তদন্ত দাবি করেন। অন্যদিকে, এএপির মুখপাত্র সঞ্জয় সিং এবং কংগ্রেসের সুপ্রিয়া শ্রীনাতে প্রধানমন্ত্রীর ভুটান সফরের সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকারের প্রতি তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সঞ্জয় সিং এক্স-এ লেখেন, ‘দেশ যন্ত্রণায় ভুগছে আর মোদি প্লেনে...এমন অসংবেদনশীল প্রধানমন্ত্রীকে জাতি আকত দিনদিন সহ্য করবে?’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লির বিস্ফোরণে বিরোধী দলগুলোর এই ‘নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া’ এক কৌশলগত দুর্বলতার প্রতিফলন। তারা জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে দ্বিধা বোধ করছেন, কারণ এই ক্ষেত্রে বিজেপিকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের কাছে স্পষ্ট কোনো কৌশল নেই।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও মোদির জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় যুক্তি দিয়েছেন, মোদিকে বিদ্রূপ করার জন্য ‘যুদ্ধবাজ’ সাজার চেষ্টা করা সঠিক কৌশল নয়। তাঁর মতে, বিরোধী দলকে মোদির ‘বড়াই ও মিথ্যা সাহসের অন্তঃসারশূন্যতা’ এবং নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।

ভারতের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা যশোবর্ধন ঝা আজাদ বলেন, বিরোধী দলগুলোর উচিত মোদি সরকারের কাছে ‘নির্দিষ্ট ও তীক্ষ্ণ’ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে দায়বদ্ধতা স্থির করা। তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসী মডিউলটি ‘প্রধান ও বিপজ্জনক’ ছিল। এ নিয়ে প্রশ্ন না করলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা স্মরণ করিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বিজেপি নেতৃত্ব, বিশেষ করে মোদি নিজে, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার সময় তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নিরাপত্তা ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনায় মুখর ছিলেন। কিন্তু বর্তমান বিরোধী পক্ষের নীরবতার খুবই দৃষ্টিকটু।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গণতন্ত্র নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে পশ্চিমা বিশ্বে, জরিপে উদ্বেগজনক চিত্র

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ২৩: ৪৫
স্টেট অব ডেমোক্রেসি জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অন্তর্ভুক্ত নয়টি দেশের অধিকাংশ মানুষ বলেছেন, গত পাঁচ বছরে তাদের দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা উন্নত হওয়ার চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। ছবি: এএফপি
স্টেট অব ডেমোক্রেসি জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অন্তর্ভুক্ত নয়টি দেশের অধিকাংশ মানুষ বলেছেন, গত পাঁচ বছরে তাদের দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা উন্নত হওয়ার চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। ছবি: এএফপি

পশ্চিমা বিশ্বের ৯টি দেশে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এসব দেশের মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে গভীর অসন্তোষ বিরাজ করছে। জরিপে অংশ নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে আটটিতে গণতন্ত্র নিয়ে সন্তুষ্টি ৫০ শতাংশের নিচে। মাত্র একটি দেশ ছাড়া সবটিতেই ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইপসোস পরিচালিত এই জরিপে ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্পেন, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১০ হাজার মানুষের মতামত নেওয়া হয়।

জরিপে দেখা গেছে, ৯ দেশের মধ্যে শুধু সুইডেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে সন্তুষ্ট (প্রায় ৬৫ শতাংশ)। নেদারল্যান্ডসে মতামত বিভক্ত; ৩৬ শতাংশ সন্তুষ্ট, ৩৭ শতাংশ অসন্তুষ্ট। পোল্যান্ডে ৪০ শতাংশ সন্তুষ্ট, ৩১ শতাংশ অসন্তুষ্ট।

বাকি দেশগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ। ছয় দেশে গড় সন্তুষ্টির হার ২৪ শতাংশের কম। ক্রোয়েশিয়ায় ১৮ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ২৬ শতাংশ, স্পেনে ২৭ শতাংশ এবং ইতালিতে ২৯ শতাংশ।

জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, গত পাঁচ বছরে তাঁদের দেশে গণতন্ত্রের মান আরও খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্স (৮১ শতাংশ) ও নেদারল্যান্ডসে (৭৬ শতাংশ); যেখানে চলতি বছর সরকার পতনের ঘটনা ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্রে ৬১ শতাংশ এবং স্পেন ও যুক্তরাজ্যে ৫৮ শতাংশ মানুষ একই মত প্রকাশ করেন। একমাত্র ব্যতিক্রম পোল্যান্ড; সেখানে ৪২ শতাংশ মনে করেন গণতন্ত্রের মান কিছুটা ভালো হয়েছে, ৩০ শতাংশ বলেছেন খারাপ হয়েছে।

সুইডেন বাদে বাকি সব দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করা গেছে। ফ্রান্সে ৮৬ শতাংশ, স্পেনে ৮০ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ও পোল্যান্ডে ৭৫ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসে ৭৪ শতাংশ, ক্রোয়েশিয়ায় ৭৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯ শতাংশ এবং ইতালিতে ৬৪ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যতের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন।

গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে; ভুয়া তথ্য (ডিসইনফরমেশন), রাজনৈতিক জবাবদিহির অভাব, চরমপন্থা ও দুর্নীতি।

ফ্রান্স (৫৬ শতাংশ), যুক্তরাজ্য (৬৪ শতাংশ), সুইডেন (৬৭ শতাংশ), নেদারল্যান্ডস (৭৫ শতাংশ) ও পোল্যান্ডে (৭৬ শতাংশ) সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছে ভুয়া তথ্যকে। অন্যদিকে, দুর্নীতিকে সর্বোচ্চ হুমকি হিসেবে দেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৬৩ শতাংশ, স্পেনের ৭৩ শতাংশ, ক্রোয়েশিয়ার ৮০ শতাংশ ও ইতালির ৪৭ শতাংশ মানুষ। তবে ইতালিতে অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও সমান বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হয়েছে।

গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা যেসব সমাধানের কথা বলেছেন, তা হলো—কঠোর দুর্নীতিবিরোধী আইন ও এর বাস্তবায়ন, সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর আরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ, নাগরিক শিক্ষা উন্নয়ন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা।

জরিপে দেখা গেছে, গণতন্ত্রের প্রতি মোটের ওপর জোরালো সমর্থন রয়েছে। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, এটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও রক্ষাযোগ্য। তবে ক্রোয়েশিয়ায় অনেকে মনে করেন, কোনো দেশে গণতন্ত্র বজায় রাখা উচিত কি না—তা সেই দেশের মানুষের জীবনের মানের ওপর নির্ভর করে।

এদিকে, বেশির ভাগ দেশে বেড়েছে মৌলিক বা ‘র‌্যাডিক্যাল’ পরিবর্তনের দাবি। অনেকে মনে করেন বর্তমান ব্যবস্থাটি ধনীদের স্বার্থে, এটি সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। স্পেনে ৫২ শতাংশ, ইতালিতে ৫৫ শতাংশ, পোল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে ৬০ শতাংশ, ফ্রান্সে ৬৬ শতাংশ এবং ক্রোয়েশিয়ায় ৬৯ শতাংশ মানুষ র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তনের দাবি করেন।

তবে পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রবল হলেও, প্রায় সব দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমঝোতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ট্রাম্পের হাতে মাদুরোর পতন রাশিয়া ও সৌদি আরবকে যেভাবে বিপদে ফেলবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ৪১
চলতি বছরের শুরুর দিকে মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ছবি: এএফপি
চলতি বছরের শুরুর দিকে মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ছবি: এএফপি

ভেনেজুয়েলায় রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড-এর নেতৃত্বে একটি বিশাল সামরিক বহর ক্যারিবীয় সাগরে মোতায়েন করা হয়েছে। এই রণতরী বহর যে কোনো মুহূর্তে ভেনেজুয়েলায় সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় সক্রিয় মাদক কার্টেলগুলোকে ‘ধ্বংস’ করার লক্ষ্য স্পষ্ট জানালেও, প্রশ্ন উঠেছে সামরিক আঘাত কি কেবল মাদক দমন অভিযানে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি তা সরাসরি নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে উৎখাত করার পূর্ণাঙ্গ সামরিক উদ্যোগে রূপ নেবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা সীমিত করতে কংগ্রেসের ‘ওয়ার পাওয়ারস রেজোলিউশন’ প্রয়োগের প্রচেষ্টা গত বৃহস্পতিবার নিম্নকক্ষে ব্যর্থ হওয়ায়, ট্রাম্পের হাতে এখন সব ধরনের সামরিক পদক্ষেপের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, ভেনেজুয়েলায় সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা কম।

সামরিক বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, পূর্ণাঙ্গ স্থল আক্রমণের সম্ভাবনা কম। তবে মার্কিন নৌ ও বিমান শক্তি দেশটির অভ্যন্তরীণ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে মাদুরোর সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই কৌশলগত অবস্থান মাদুরো সরকারের ওপর চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিকোলাস মাদুরোর শাসনাধীন ভেনেজুয়েলার জনগণ দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে চান ভেনেজুয়েলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া করিনা মাচাদো মাদুরো শাসনের বিরুদ্ধে পরিবর্তন আনার জন্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশ্য সর্বশেষ নির্বাচনের পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে মাচাদো ট্রাম্প প্রশাসনের সামরিক উদ্যোগকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। মাদুরো-বিরোধীরা আশা করছেন, মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনী, সম্ভবত কিছু গোপন স্থল বাহিনীর সহায়তায়, অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের সঙ্গে মিলে মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। তখন মাচাদোর নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠানের দুয়ার খুলে যাবে।

ভেনেজুয়েলা সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বের জ্বালানি মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার মতো তেলসম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসন (ইআইএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার প্রমাণিত তেলের মজুত ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। দেশটির মজুত সৌদি আরবের (২৬৭ বিলিয়ন ব্যারেল) এবং ইরানের (২০৮ বিলিয়ন ব্যারেল)-এর থেকেও বেশি।

কিন্তু সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ-এর সময়ে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও সরকারি কিছু অদক্ষতার কারণে দেশটির একসময়কার বিশ্বের অন্যতম লাভজনক তেল শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে। বর্তমানে ভেনেজুয়েলা তেল উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে এবং রপ্তানি করে বছরে মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অথচ সৌদি আরব বছরে প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়া ১২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল রপ্তানি করে থাকে। এই বিপুল সম্পদ যদি সমাজতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক নতুন ঢেউ আনবে।

যদি মাদুরোর শাসনের পতন হয় এবং মার্কিন সরকারের পূর্ণ সমর্থন থাকে (নিশ্চিতভাবে তা থাকবে), তবে তেল শিল্প দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং একই সঙ্গে ধসের মুখেও পড়তে পারে। ২০ বছর আগেও ভেনেজুয়েলা দৈনিক ৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদুরোর পতন হলে খুব দ্রুতই দেশটি সেই স্তরে ফিরে যেতে পারে।

এই বিপুল পরিমাণ তেল যদি বাজারে আসে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ভেনেজুয়েলাকে ওপেক-এর বাইরে রাখতে চান (অতি অবশ্যই রাখবেন), তাহলে তেলের দাম মারাত্মকভাবে কমবে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ৫০ ডলারের নিচে নেমে যেতে পারে, এমনকি ৩০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই মূল্যপতন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় যে তিনটি পরিণতি নিয়ে আসবে সেগুলো হলো:

সংকটে পড়বে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া: তেলের দাম কমলে রাশিয়ার তেল বিক্রি থেকে রাজস্ব মারাত্মকভাবে কমে যাবে। ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারে বিক্রি হলে, রাশিয়া তাদের ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে পারবে না। বিশ্ববাজারে ভেনেজুয়েলার সস্তা তেল সহজলভ্য হলে, নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রাশিয়ার তেল কেনার আগ্রহ আরও কমে যাবে।

সৌদি আরবের ওপর চরম আর্থিক চাপ: কম তেলের দামের কারণে সৌদি আরবও বিশাল আর্থিক চাপের মুখে পড়বে। এখনই দেশটির বাজেট ঘাটতি বাড়ছে; তেলের রাজস্ব কমে গেলে এই সংকট আরও গভীর হবে এবং যুবরাজ তাঁর স্বপ্নের প্রকল্পে ব্যয় কমাতে বাধ্য হবে।

বিশ্ব অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি: তেল রপ্তানিকারকদের ক্ষতি হলেও, বিশ্বের বাকি অর্থনীতির জন্য ক্রমহ্রাসমান তেলের দাম অত্যন্ত সহায়ক। এর ফলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে, মানুষের হাতে অন্যান্য জিনিসের জন্য বেশি অর্থ থাকবে এবং তা বিশ্ব অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে উদ্দীপিত করবে।

তবে এই সামরিক পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায়, বা হোয়াইট হাউস হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নেবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু যদি এই অভিযান সফল হয়, তবে এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে নাটকীয় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাকিস্তানে ‘ব্যালটের বিপরীতে উর্দিকে প্রাধান্য’ দিতেই কি সংবিধান সংশোধন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৫: ২৩
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি (মাঝে), প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ (ডানে) এবং দুজনের সামনে সেনাপ্রধান আসিম মুনির। ছবি: পাকিস্তান সরকার
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি (মাঝে), প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ (ডানে) এবং দুজনের সামনে সেনাপ্রধান আসিম মুনির। ছবি: পাকিস্তান সরকার

পাকিস্তানের সংবিধানের ২৭ তম সংশোধনীর প্রস্তাব গত সোমবার দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে পাস হয়। এরপর, গতকাল বুধবার তা নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদেও পাস হয়। এখন শুধু উচ্চকক্ষে সামান্য পরিবর্তিত হয়ে তা প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে। এই সংশোধনী দেশটির বিচারব্যবস্থা এবং সামরিক বাহিনীর কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

সমালোচনা আছে যে, সংশোধনীটির মূল উদ্দেশ্য সরকার এবং বিপুল ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ওপর তদারকি দুর্বল করা। প্রধান বিরোধী দল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) উভয় কক্ষেই এই বিলের বিরোধিতা করে অধিবেশন বয়কট করেছে। উচ্চ আদালতের বিচারকেরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, কিছু পরিবর্তন যুক্তিসংগত।

২৭তম সংশোধনী সংবিধানের অংশ হয়ে গেলে মূলত এটি দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের যেকোনো ধরনের ফৌজদারি মামলায় দায়মুক্তি দেবে এবং সামরিক কমান্ড কাঠামো পুনর্গঠন করবে। এই পরিবর্তনগুলো পাকিস্তানের সংবিধানের ধারা ২৪৩-এর মাধ্যমে করা হবে। সংশোধনীর অন্য ধারা ফেডারেল সংবিধানিক কোর্ট (এফসিসি) স্থাপনের মতো বিভিন্ন আইনি সংস্কারের ব্যবস্থা করবে।

অনেক সংবিধান সংশোধনীই বিতর্কিত হয়, কিন্তু সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন—বর্তমান সংশোধনী এত দ্রুত কেন আনা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার এটি গত শনিবার সিনেটে উপস্থাপন করেন, সেই দিনই মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করে। আজারবাইজান সফরে থাকা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে অনুমোদন দেন। তাঁর সফরে সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরও ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে শাহবাজ শরিফের সব রাষ্ট্রীয় সফরে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে দেখা গেছে। গত রোববার ইসলামাবাদে ফেরার পর শাহবাজ আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টে হাজির হন।

সংবিধানের ধারা–২৪৩ পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করে। পরিবর্তিত বিধান অনুসারে, ধারা ২৪৩-এ সেনাপ্রধানের অধীনে চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস (সিডিএফ) নামে নতুন পদ সৃষ্টি করা হবে। এর অর্থ, সেনাপ্রধান বিমান ও নৌবাহিনীর ওপরও নিয়ন্ত্রণ রাখবেন। সংশোধনী আইনে পরিণত হলে, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি চলতি মাসের শেষে বাতিল হবে। বর্তমানে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি দায়িত্ব পালন করছেন চার-তারকা জেনারেল সাহির শামশাদ আছেন। তিনি ২৭ নভেম্বর অবসর নেবেন।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। চারটি অভ্যুত্থান এবং দশকব্যাপী সরাসরি ও অপ্রত্যক্ষ সামরিক শাসন এই প্রভাবকে ক্রমেই দৃঢ় করেছে। সেনাপ্রধান দীর্ঘদিন ধরে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত।

বর্তমান সেনাপ্রধান আসিম মুনির ২০২২ সালের নভেম্বরে সেনাপ্রধান হন এবং ভারতের সঙ্গে চার দিনের সংঘাতের ১০ দিন পর, গত ২০ মে পাঁচ তারকা র‍্যাঙ্কে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হন। ২৭ তম সংশোধনী পাঁচ তারকা জেনারেলদের আজীবন দায়মুক্তি দেবে এবং তাঁদের ‘র‍্যাঙ্ক, সুবিধা এবং ইউনিফর্ম জীবনভর বজায় রাখার’ বিধান থাকবে।

পাকিস্তানের দ্বিতীয় সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পাঁচ-তারকা র‍্যাঙ্ক অর্জন করেছেন আসিম মুনির। এর আগে ১৯৬০-এর দশকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানই একমাত্র ছিলেন। সামরিক বাহিনীর অন্য কোনো শাখার—যেমন বিমান বা নৌবাহিনীর কোনো কর্মকর্তা পাঁচ তারকা পাননি।

প্রস্তাবিত সংশোধনী জাতীয় কৌশলগত কমান্ড (এনএসসি) কমান্ডারের পদও সৃষ্টি করছে। এই পদধারী ব্যক্তি পারমাণবিক কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সংশোধনী অনুসারে এনএসসি প্রধান কেবল সেনাবাহিনী থেকে সেনাপ্রধান বা চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেসের পরামর্শে নিযুক্ত করা হবে।

পাকিস্তানের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, ধারা–২৪৮ বলে ‘প্রেসিডেন্ট বা কোনো প্রদেশের গভর্নরের বিরুদ্ধে মেয়াদকাল চলাকালে কোনো ফৌজদারি মামলার বিচার শুরু বা চালিয়ে যাওয়া যাবে না।’ কিন্তু পদত্যাগের পর তাঁদের এমন সুবিধা নেই। বর্তমান জেনারেলদের কোনো আইনি সুরক্ষা নেই। ২৭ তম সংশোধনীর আগে ফিল্ড মার্শালের পদকে শুধু গৌরবসূচক ধরা হতো, কোনো অতিরিক্ত ক্ষমতা বা সুবিধা ছিল না। তবে প্রস্তাবিত পরিবর্তন মূলত এই পদটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবে।

সংশোধনীটি আইনে পরিণত হওয়ার পর পাঁচ-তারকা কোনো কর্মকর্তাকে অপসারণ করতে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে। অথচ, কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোট পেলেই হয়। এ ছাড়া, পাঁচ তারকা কর্মকর্তা আজীবন যাবতীয় ফৌজদারি মামলা থেকে দায়মুক্তি পাবেন।

লাহোরভিত্তিক সংবিধানবিদ রিদা হোসাইন বলেন, ‘যেখানে অবাধ ক্ষমতা সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে গণতন্ত্র টিকে থাকে না। এই সংশোধনী অনির্বাচিত সেনা কর্মকর্তাকে এমন বিশেষাধিকার ও ক্ষমতা দেবে, যা কিনা দেশের কোনো নির্বাচিত নেতাও পান না।’

খসড়া সংশোধনীতে একটি স্থায়ী ফেডারেল সংবিধানিক আদালত (এফসিসি) গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই আদালতের নেতৃত্ব দেবেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান বিচারপতি এবং এতে চার প্রদেশ থেকে সমান সংখ্যক বিচারকসহ ইসলামাবাদ থেকেও বিচারক থাকবেন। এটি ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তি করবে।

এফসিসি-এর বিচারকের বয়সসীমা ৬৮ বছর, যদিও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের বয়স হতে পারে সর্বোচ্চ ৬৫ বছর। এফসিসির প্রধান বিচারপতির মেয়াদ সর্বোচ্চ তিন বছর। এই সংশোধনী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাও বাড়াচ্ছে। এর ফলে, তিনি পাকিস্তানের জুডিশিয়াল কমিশনের (জেসিপি) প্রস্তাবের ভিত্তিতে একজন বিচারককে এক হাইকোর্ট থেকে অন্য হাইকোর্টে স্থানান্তর করতে পারবেন।

গত বছর ২৬তম সংশোধনী পাস হওয়ার পর, হাইকোর্ট থেকে হাইকোর্টে বিচারক স্থানান্তর কেবল রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে হতে পারত। কিন্তু বিচারকের ব্যক্তিগত সম্মতি আবশ্যক ছিল, পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি এবং সংশ্লিষ্ট দুই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শও জরুরি ছিল।

নতুন সংশোধনীর অধীনে এটি বদলে যাবে। প্রেসিডেন্ট সেজিপির প্রস্তাব অনুযায়ী বিচারককে স্থানান্তর করতে পারবেন, সংশ্লিষ্ট বিচারকের সম্মতি ছাড়াই। একই সঙ্গে, যদি কোনো বিচারক স্থানান্তর অস্বীকার করেন, তবে তিনি জেসিপির সামনে তার কারণ উপস্থাপন করার সুযোগ পাবেন এবং যদি জেসিপি কারণগুলো আইন বহির্ভূত মনে করে, তাহলে বিচারককে অবসর গ্রহণ করতে হবে।

রিদা হোসাইন বলেন, সংশোধনী অনুযায়ী বিচারকদের সম্মতি ছাড়াই অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা যাবে এবং অস্বীকৃতি দিলে তাদের বিরুদ্ধে জেসিপি পদক্ষেপ নিতে পারবে। তিনি বলেন, ‘অস্বীকৃতির ফলে দায়বদ্ধতার প্রক্রিয়া শুরু হয়, এটি প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ভীতি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সূক্ষ্ম হুমকি। এটি স্বাধীন বিচারিক পদকে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে এল, যেখানে সর্বদা শাস্তিমূলক বা প্রতিশোধমূলক স্থানান্তরের ভয়ে কাজ করতে হবে।’

জেনেভাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জাস্টিসের আইন উপদেষ্টা রীমা ওমর বলেন, নতুন সংশোধনীটি স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে উদ্বেগজনক প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, এর ফলে ‘সরকারের নির্বাহী বিভাগই সেই বিচারকদের নিয়োগ করবে, যাদের একমাত্র এখতিয়ারই হলো নির্বাহী বিভাগকে দায়বদ্ধ করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি স্পষ্টতই বিদ্যমান সেট-আপকে বিচারিক তদারকি ও দায়বদ্ধতা থেকে রক্ষা করার জন্য করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এফসিসির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তগুলোকে সংবিধানিক বৈধতা দেওয়া সম্ভব হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারকেরাও সংশোধনীর সমালোচনা করছেন। জ্যেষ্ঠ বিচারক মানসুর আলি শাহ সোমবার প্রধান বিচারপতি ইয়াহিয়া আফ্রিদিকে খোলা চিঠিতে লিখেছেন, এফসিসি কোনো ‘সত্যিকারের সংস্কার এজেন্ডা’ নয়, বরং এটি বিচার বিভাগকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রণ করার একটি ‘রাজনৈতিক কল’। তিনি বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়ায় এ ধরনের প্ররোচনা ইতিহাসে ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত হয়; এটি সংবিধানিক অভিভাবকের ব্যর্থতা হিসেবে রেকর্ড হয় এবং যখন এমন মুহূর্তগুলোতে প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব থাকে, তখন তারা নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করা কাঠামোকেই দুর্বল করে।’

সরকারের যুক্তি—এই প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া সংবিধানিক মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব মামলার জট ‘নিয়মিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার সময়মতো নিষ্পত্তিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে।’ সরকার জানিয়েছে, ধারা–২৪৩-এ পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে ‘সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কিত প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা এবং প্রশাসনিক কাঠামো উন্নত করার’ জন্য।

কিছু বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। ইসলামাবাদভিত্তিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাফিজ আহসান আহমদ খোকার বলেছেন, একটি স্থায়ী কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালত বা এফসিসি ‘সমন্বিত দক্ষতা এবং সময়মতো বিচার’ নিশ্চিত করবে। তিনি বলেন, ‘এটি সংবিধান ব্যাখ্যা করার, কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্কিত বিতর্ক সমাধান করার, আইনের বৈধতা নির্ধারণ করার এবং পরামর্শমূলক মতামত প্রদানের ক্ষমতা রাখে। এটি দক্ষতা এবং সময়মতো বিচার নিশ্চিত করে।’

খোকারের যুক্তি, এফসিসি গঠনের ফলে সংবিধানিক বিচার প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্য, দ্রুততা এবং শৃঙ্খলা আসবে। এ ছাড়া, কমান্ডার অব ডিফেন্স ফোর্সেস অফিসের সূচনা কৌশলগত কমান্ডকে একীভূত করবে এবং সমন্বয় বাড়াবে, কিন্তু বিদ্যমান বাহিনীর স্বায়ত্তশাসন ক্ষুণ্ন করবে না। তিনি বলেন, ‘উভয় সংস্কার পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার বাস্তবতা এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলির জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এই পদক্ষেপগুলো পাকিস্তানকে একটি পরিপক্ব, নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করবে, যেখানে বিচারিক, নাগরিক ও প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিশেষায়িত ভূমিকায় সামঞ্জস্যের সঙ্গে কাজ করবে।’

তবে এই ব্যাখ্যাগুলো অনেককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। পাকিস্তান হিউম্যান রাইটস কমিশন সংশোধনী বিলের তাগিদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছে, সরকারের তাড়াহুড়ো, রাজনৈতিক বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো অর্থবহ শলা-পরামর্শের অভাব, আইনজীবী সমাজ এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা না করা—এসবই সংশোধনী বিল আনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) রীমা ওমর সতর্ক করেছেন, এই সংশোধনী বিচারব্যবস্থার জন্য একটি ‘মূলগত পরিবর্তন’ চিহ্নিত করছে। তিনি বলেন, ‘২৭ তম সংশোধনী পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টকে শুধু আপিল আদালত হিসেবে সীমিত করে। এটি আর পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নয়, নিছক সুপ্রিম কোর্ট এবং এর প্রধান বিচারপতি হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি নয়।’

ওমর আরও বলেন, অন্তত স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে, বিচারব্যবস্থা প্রধানত নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। তিনি বলেন, ‘নির্বাহী ও সংসদের বাস্তব কোনো জবাবদিহি বা পর্যালোচনার সুযোগ এখন সম্ভবত অল্প এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) পক্ষে আর কোনো সহায়তা পাওয়া সম্ভব নয়।’

রিদা হোসাইন সতর্ক করেছেন, সংশোধনীর অধীনে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক তদারকি এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ইচ্ছার মুখাপেক্ষী থাকলেও অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি ব্যালটের পরিবর্তে উর্দির প্রাধান্যকে প্রতিস্থাপন করেছে।’

ওমের বলেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো—যার মধ্যে বর্তমান শাসক পাকিস্তান মুসলিম লীগ–নওয়াজ ও জোটসঙ্গী পাকিস্তান পিপলস পার্টি রয়েছে—অতীতে সামরিক বাহিনীর জন্য সংবিধানিক সুরক্ষার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এখন তা পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘২৭ তম সংশোধনী হলো সাংবিধানিক আত্মসমর্পণ।’


আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত