Ajker Patrika

তালেবানকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যেতে চায় ইমরান খানের পাকিস্তান?

ইয়াসিন আরাফাত 
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২১, ১৫: ১৪
তালেবানকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যেতে চায় ইমরান খানের পাকিস্তান?

ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর প্রভাব ইত্যাদি পাকিস্তানের পরিচয় হয়ে আছে অনেক দিন ধরেই। ইমরান খান সরকারের সময় এ দুই পরিচয় আরও প্রকট হয়েছে। সঙ্গে মার্কিন মিত্র থেকে চীনের মিত্র হিসেবে নতুন পরিচয়ও যুক্ত হয়েছে দেশটির নামের সঙ্গে। আর ভারতের সঙ্গে সীমান্ত লড়াইয়ের বিষয়টি তো আছেই। এই সবগুলো পরিচয়ের দিকেই এখন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা কড়া নজর রাখছেন। কারণ প্রতিবেশী আফগানিস্তান এবং এর ক্ষমতায় সদ্য বসা তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্ষমতা কেন্দ্রের সম্পর্ক। একদিকে চীনের সঙ্গে মৈত্রী, অন্যদিকে তালেবানের উৎস ও বিস্তারভূমি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের পরিচয়; একদিকে ধর্মীয় লেবাস, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ছদ্ম শাসন—সব মিলিয়ে ইমরান খান সরকারের অধীনে পাকিস্তান ঠিক কোন দিকে হাঁটছে, তা এক বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তানে এখনো ধর্ম অবমাননার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কারও শাস্তি কার্যকর না হলেও এই শাস্তি কিন্তু প্রায়ই শোনানো হয়। আশির দশকে ধর্ম অবমাননার আইন সংশোধনের পর প্রায় ২ হাজার মানুষকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধর্ম অবমাননার দায়ে এ পর্যন্ত ১২৮ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন। 

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরমাণু শক্তিসমৃদ্ধ পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যেখানে বিজ্ঞানচর্চা কাগজে-কলমে থাকলেও গোঁড়ামিটা ঠিকই রয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যা-ই আসুক না কেন, ধর্মের প্রসঙ্গ এলে আর কোনো কিছু টেকে না। তখন শুধু সংস্কারই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। 

এই পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান। দেশটির সঙ্গে ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। সম্প্রতি আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। সেখানে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সরকারের পতন ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। যদিও সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষই তালেবান ক্ষমতায় আসায় খুশি। 

পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী চামান শহরের কোমল পানীয় বিক্রেতা জয়নুল্লাহ আচাকজাইও রয়েছেন এই দলে। দ্য ইকোনমিস্টকে তিনি বলেন, ‘এটি এক মহান অর্জন।’ 

আবার অনেক পাকিস্তানি কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় আসাকে অমঙ্গল হিসেবেই দেখছে। তাদের শঙ্কা, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তা সন্ত্রাসীদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হবে। এর প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওপরও। এরই মধ্যে তালেবানের পতাকা ইসলামাবাদের মসজিদে টানানো হয়েছে। এমন আরও অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা এই শঙ্কাকে ক্রমশ দৃঢ় করছে। 

পর্যবেক্ষক সংস্থা সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়, পাকিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩২৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আফগান সীমান্তে। 

পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেক বন্দীকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। এঁদের মধ্যে পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতা ফকির মোহাম্মাদও রয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। ধারণা করা হয়, টিটিপির প্রায় ৫ হাজার সদস্য আফগানিস্তানে লুকিয়ে রয়েছে। ফকির মোহাম্মদের মুক্তির মধ্য দিয়ে এই ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হবে। আর তাদের লক্ষ্য যে পাকিস্তানকেও আফগানিস্তানের ধারায় নেওয়া, তা তো বলা অবান্তর। মুক্তি পাওয়ার পরই ফকির মোহাম্মাদ বলেছেন, তালেবানের নিয়মই পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন তিনি। 

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান আসাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছেবর্তমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। একসময়কার বিখ্যাত এই ক্রিকেট অলরাউন্ডারের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিলেতে। তাঁর গায়ে প্লেবয়ের তকমাও রয়েছে। তবে এখন নৈতিকতাবাদী ধর্মীয় রক্ষণশীল, অর্থনৈতিক অবস্থানে একজন লোকরঞ্জনবাদী এবং পাকিস্তানে গুলি চালানো জেনারেলদের একজন আজ্ঞাবহ সেবক হিসেবেই পরিচিত তিনি। সম্প্রতি তাঁর সরকার একটি আইন প্রস্তাব করেছে। সেখানে বলা হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবমাননাজনক কোনো কিছু বললে দুই বছরের জেল হতে পারে। 

ধর্মের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবস্থান নিয়েছেন ইমরান। গত সপ্তাহে ইসলামিক নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ইমরান খান বলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো আইন তাঁর সরকার করবে না। 

ইমরান খানের সঙ্গে তালেবানের সখ্য দেখে কেউ কেউ তাঁকে ‘তালেবান খান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আগেই। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি এখনো পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কোনো ফোনালাপ করেননি। তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য তাঁর এই নতুন নামকে আরও শক্ত ভিত দিচ্ছে। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইমরান খান তাঁর দেশে আফগান পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিমা বাহিনী আফগান জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। সোভিয়েত বাহিনী, যারা আফগানিস্তানে লড়াই করেছিল, তাদের সঙ্গে পশ্চিমা বাহিনীর কোনো পার্থক্য দেখেন না ইমরান খান। তিনি ওই মতামতধর্মী নিবন্ধে লিখেছেন, ৩ লাখ সুসজ্জিত আফগান সেনাবাহিনীর তালেবানের সঙ্গে না পারার কারণ অবশ্যই পাকিস্তান নয়। 

তবে নিজের সেই লেখায় মুদ্রার আরেক পিঠ দেখাননি ইমরান খান। তিনি উল্লেখ করেননি যে পাকিস্তানি ইসলামপন্থী দল ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে তালেবান নেতাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান খান বলেছেন, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাঁর দেশে ১৬ হাজার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর এগুলোর জন্য ভারতকে দুষেছেন তিনি। তবে আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন ইমরান খান। এ ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের গুপ্তচরেরা তালেবানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। পাকিস্তানের জাতিগত গোষ্ঠী পশতুনদের ঐক্য নিয়ে তারা কখনোই কিছু বলে না এবং পাকিস্তানের কোনো অঞ্চল তালেবান নিজেদের বলে দাবি করে না। এ ছাড়া পাকিস্তান যে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকেও আশ্রয় দিয়েছিল, সে বিষয়টিও ইমরান খানের লেখায় ঊহ্য ছিল। 

 ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন ইমরান খান। অনেক পাকিস্তানি মনে করেন, পাকিস্তানে প্রকৃত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। পাকিস্তানের কথিত দুর্নীতিবাজ সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইমরান খানের নিরলস যুদ্ধের নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে নির্বাসনে পাঠানোসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইমরান খান বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করতে সফল হয়েছেন। তিনি জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি বিভাজনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের মালিকদের হুমকি দিয়ে এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তান সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের আনাড়ি প্রচেষ্টা করছে। এমনকি সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়ানো হচ্ছে দাবি করে এমন চর্চা প্রতিহতের কথা বলে রাষ্ট্র-নিযুক্ত পর্যবেক্ষণ বোর্ড তৈরির একটি আইনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। 

ইমরান খান এখন তালেবানের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার এবং পাকিস্তানের দরিদ্র ‘ভাইদের’ জন্য সাহায্য পাঠানোর জন্য বিশ্বের কাছে যুক্তি উত্থাপন করছেন। পাকিস্তানে করোনার প্রকোপ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম ছিল। ইরানে করোনায় পাকিস্তানের চেয়ে দশগুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে। গত বছর করোনা শুরুর পর ভারতের মতো পুরোপুরি লকডাউন জারি করেননি ইমরান খান। এ জন্য অবশ্য ভারতের মতো ভুগতে হয়নি পাকিস্তানকে। এ ক্ষেত্রে ইমরান খান সফলই বলা যায়। গত আগস্টে হওয়া জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা প্রায় ৪৮ শতাংশ, যা তাঁর শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই সময় পর্যন্ত ইমরান খান ক্ষমতায় থাকতে পারলে তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় ছিলেন। এখন পর্যন্ত তাঁর জনপ্রিয়তার গ্রাফ যা, তাতে তিনি টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। 

ইমরানের এই জনপ্রিয়তায় পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টই সবচেয়ে বেশি খুশি বলে মনে করেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের মাধিয়া আফযান। তাঁর মতে, নওয়াজ শরিফ সেনাদের আজ্ঞার বাইরে চলতেন। ফলে তারা ইমরান খানকেই সমর্থন দেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতার অন্যতম বড় ভাগীদার; নিয়ন্ত্রক বললেও ভুল হবে না। বহুবার তারা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছে। তবে ক্রমেই তারা বুঝেছে, সময় বদলেছে। সরাসরি শাসনের চেয়ে রাজনৈতিক পন্থায় শাসনই শ্রেয়। আফগানিস্তানে যে ফল এসেছে, তা নিয়েও সন্তুষ্ট তারা। কারণ, তারা এর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে। 

ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় গুপ্তচরদের অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে আফগানিস্তানকে বিভিন্ন নাশকতার কাজে ব্যবহার করে। নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে পাকিস্তান আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে ভারতের বিরুদ্ধে। গত আগস্টে কাবুলের দ্রুত পতন পাকিস্তানের খাতায় বোনাস পয়েন্ট হিসেবে যুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য আরেকটি বাড়তি সুবিধা হলো এটি চীনকে বুঝিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে টিকবে না। ফলে এই খেলায় বেইজিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণে তারা চীনকেও পাশে পাচ্ছে। 

তালেবানের সব পক্ষই হয়তো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষে নয়। তবে গত সেপ্টেম্বরে তালেবান যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে, সেখানে হাক্কানি নেটওয়ার্কের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা রয়েছেন। এটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সমর্থিত অংশ। এ ছাড়া তালেবান প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মোল্লা ওমরের ছেলে আফগানিস্তানের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ইয়াকুবের পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। তালেবানের সরকার গঠনের আগমুহূর্তে কাবুলে ছুটে গিয়েছিলেন আইএসআইয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইজ হামিদ। বিশ্লেষকদের ধারণা, আফগানিস্তানের তালেবান সরকারে আইএসআই তথা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও ইমরান খান সরকারের প্রভাব নিশ্চিত করতেই কাবুল সফরে গিয়েছিলেন তিনি।

আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠনেও পাকিস্তানের প্রভাব ছিল বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষকপাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তারা যদি কাবুলের সরকার পরিবর্তন থেকে লাভবান হন, তবে অন্য সবার কী হবে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১১ শতাংশ। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানে রুপির দাম ডলারের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কমেছে। দেশটির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশ আর্থিক সংকটে ভুগছে। বর্তমানে প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি আর্থিক সাহায্য দরকার দেশটির। ওই টাকা দিয়ে ২০২১ থেকে ২০২৩ আর্থিক বছরে পাকিস্তান তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। 

আর্থিক এই সংকটের চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও। সেখানে বলা হয়, বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার মামলায় পাকিস্তান শীর্ষ ১০ দেশের তালিকার একটি। 

কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। কিন্তু বাদ সাধে ভঙ্গুর অর্থনীতি। অর্থনীতির পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হন তিনি। সংস্থাটি ২০১৯ সালে পাকিস্তানকে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়। এই অর্থের পুরোটা এখনো ছাড় করেনি আইএমএফ। এর মধ্যেই গত জুলাইয়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২২ বিলিয়ন ডলার। 

ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান। এর বিনিময়ে বেইজিং পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে। গড়ে তোলা হয়েছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিশেষ অর্থনৈতিক করিডর (ইপিইসি)। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে এসব প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। তবে সমালোচকেরা বলছেন, ইসলামাবাদ চীনা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডডেটা জানিয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার শর্তযুক্ত ঋণ। 

সামরিক খাতেও ইসলামাবাদের চীনা নির্ভরশীলতা আগের তুলনায় বাড়ছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চীন যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করেছে, তার ৩৮ শতাংশের গন্তব্য ছিল পাকিস্তান—এমনটা জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তবে চীন-পাকিস্তান মৈত্রীতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাগুলো। পাকিস্তানের মাটিতে চীনা প্রকল্পগুলোয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর এসব হামলা ঠেকাতে সফল হয়নি পাকিস্তান। এ অবস্থায় চীনকে খুশি রাখতে জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা সরকারের নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে পাকিস্তান সরকার। 

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টার মনে করে, পাকিস্তান নিজেদের পুনর্বাসনের জন্য আফগানিস্তানকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। পাকিস্তান এখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে তালেবান সরকারের পাশাপাশি অন্য দেশগুলোকে সাহায্য করতে চায়। ইমরান খানের সামনে এখন মোটাদাগে তিনটি চ্যালেঞ্জ—পতনশীল অর্থনীতিকে দ্রুত টেনে তোলা, চীনের সঙ্গে মৈত্রী ধরে রেখে জিনজিয়াং নিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি স্পষ্ট করা এবং আফগানিস্তানে সম্ভাব্য মানবিক সংকট কার্যকর উপায়ে সামাল দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁকে কৌশলী হতে হবে। একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে তাঁর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে হবে। তাহলে সফলভাবে টিকে যাবে ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় গেজেট

ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির ভিডিও ভাইরাল, ব্যাখ্যা দিলেন ইশরাক

হাতিয়ায় চর দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গোলাগুলি, নিহত ৫

ভারতে নারী সরকারি কর্মকর্তাকে ‘রিল তারকা’ বলায় ৪ কলেজশিক্ষার্থী আটক

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত