Ajker Patrika

বড় হচ্ছে গুপ্তহত্যার ক্লাব, নতুন সদস্য ভারত

আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০: ৪৮
বড় হচ্ছে গুপ্তহত্যার ক্লাব, নতুন সদস্য ভারত

গত বছরের জুনে নিখিল গুপ্ত নিজের মোবাইল ফোন থেকে তাঁর এক পরিচিতজনকে একটি ভিডিও পাঠান। কানাডায় শিখদের প্রার্থনাগৃহ গুরুদুয়ারার বাইরে এক ব্যক্তিকে পরপর ৩৪টি গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একটি গাড়ির পাশে ঢলে পড়েন। এই ঘটনারই ভিডিও সেটি।

নিহত ওই ব্যক্তি হরদীপ সিং নিজ্জার। কানাডা পুলিশ বলছে, নিখিলের বেশ কয়েকজন টার্গেটের মধ্যে হরদীপ একজন। কারণ নিখিল তাঁর সেই পরিচিতজনকে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অনেক টার্গেট রয়েছে।’ 

মার্কিন কৌঁসুলিদের মতে, নিখিল নিউইয়র্কভিত্তিক আইনজীবী এবং শিখস ফর জাস্টিস সংগঠনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, শিখস ফর জাস্টিসের দুই নেতা পান্নুন এবং নিজ্জার স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সপক্ষে বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনে কাজ করছিলেন। এ কারণেই তাঁদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এই গণভোটের মাধ্যমে পাঞ্জাবকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ সৃষ্টি করা। 

কানাডা এখনো নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, নিখিলকে গত জুনে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে দাখিল করা একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, নিখিল পান্নুনকে হত্যার জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চালচক্রে ভাড়াটে খুনি খুঁজতে গিয়ে মার্কিন পুলিশেরই এক সোর্সকে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন তিনি।

এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে ভারত এমন একটি ক্লাবের সদস্য হয়ে উঠবে যারা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে গুপ্তহত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে ফের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরুর ইঙ্গিত মিলছে, যে চর্চাটি দীর্ঘকাল ধরে শুধু বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই ছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিরোধীদের গুপ্তহত্যার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশের মাটিতে ভারত সরকারের গুপ্তহত্যার লক্ষ্য পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি শিখ নেতা নিজ্জার হত্যার ঘটনার পর ভারতের বিরুদ্ধে সেই সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে। 

বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যার রেকর্ড সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলের। হামাসের সিনিয়র নেতাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে দেশটি গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা নতুন করে সাজাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই মধ্যেই হামাসের অন্তত তিনজন সিনিয়র নেতাকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। 

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকলে, কোনো নিন্দা না হলে, বিচার না হলে এটি বাড়বে। এগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও স্থায়ীকরণের উপাদান।’ 

সৌদি আরবের গুপ্তহত্যার তদন্তকারী কমিটির নেতৃত্বদানকারী ক্যালামার্ড বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যবস্তু করা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো আমাদের আরও খারাপ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ 

আন্তর্জাতিক আইনে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা নিঃসন্দেহে বেআইনি। আর কূটনৈতিক কনভেনশন অনুযায়ী এটি আরও বড় অপরাধ, যা যুদ্ধের সমতুল্য। 

এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পরিণতি নিয়ে ভয় এবং আন্তর্জাতিক সুযোগ–সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে বিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় বেশির ভাগ দেশ গুপ্তহত্যা থেকে বিরত ছিল। এরপরও যেসব দেশ জড়িয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ আইন মেনে কাকে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে তা নির্ধারণ করেছে। 

গুপ্তহত্যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র
স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের দুটি পরাশক্তি গুপ্তহত্যায় জড়িয়েছিল, যদিও খুবই ভিন্ন উদ্দেশ্যে। ১৯৬৪ সালের সিআইএ মেমো রিপোর্ট বলছে, সোভিয়েতরা গুপ্তহত্যার টার্গেট করত কেবল সেই ব্যক্তিদের যারা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক এবং যাদের কোনোভাবেই অপহরণ করা যায় না। 

সাধারণভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তহত্যা নিজ দেশের সেসব নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যারা বিদেশ থেকে সোভিয়েত শাসনের সমালোচনা করছিল। ১৯৪০ সালে মেক্সিকো সিটির একটি বাড়িতে লিওন ট্রটস্কিকে বরফ ভাঙার সুচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে ক্রেমলিনের শত্রুদের দেশে এবং বিদেশের মাটিতে অপহরণ বা হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমও করেছে: জার্মান আইনজীবী ওয়াল্টার লিন্সকে মার্কিন–অধিকৃত বার্লিন থেকে অপহরণ এবং ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়েছিল। 

আমেরিকার বিশ্ব নেতাদের খুনের তালিকায় রাখার প্রবণতা রয়েছে। ২০০৭ সালে সিআইএর কুখ্যাত গুপ্তহত্যার তথ্য ফাঁস হয়, এই নথি ‘ফ্যামিলি জুয়েলস’ নামে বিখ্যাত। সেখানে দেখা যায়, বিদেশি কমিউনিস্ট নেতাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু করেছে সিআইএ। এর মধ্যে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার অসংখ্য পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া সিআইএর হত্যার তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনগো দিন দিম এবং কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। তবে সিআইএ তাঁদের হত্যা করার আগেই মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থানে তাঁরা নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ডের গোপন নথি প্রকাশ পেলে মার্কিন সিনেটে ‘চার্চ কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

তদন্ত শেষে কমিটি জানায়, যুদ্ধের অংশ হিসেবে হলেও ‘গুপ্তহত্যা’ আমেরিকান নীতি, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বৈদেশিক নীতির হাতিয়ার এটি হতে পারে না, একে প্রত্যাখ্যান করা উচিত। 

এরপর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৬ সালে একটি নির্বাহী আদেশে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হন এবং আইন পাস করেন। 

গুপ্তহত্যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া 
গুপ্তহত্যার বেশির ভাগই করেছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। ব্যতিক্রম হিসেবে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে বিদেশের মাটিতে প্রায় দুই ডজন গুপ্তহত্যার পেছনে ইরানকে দায়ী করা হয়। এসবের কিছু ফলও ভোগ করতে হয়েছে তেহরানকে। 

 ১৯৮০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ারকে হত্যাচেষ্টার জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ইরানের একটি হিট স্কোয়াডকে ক্ষমা করে দেয় ফ্রান্স। ইরান এক দশক পরে প্যারিসে বখতিয়ারকে শেষমেশ হত্যা করেই ছাড়ে। 

নিউইয়র্ক সিটিতে নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী মাসিহ আলিনেজাদ অন্তত দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষের মতে, ইরানের ভাড়াটে বন্দুকধারীরা ২০২১ সালে তাঁকে আটক করে ইরানে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশ তা ব্যর্থ করে দেয়। ২০২২ সালে এই লেখককে হত্যার উদ্দেশ্যে আরেকটি দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারও তারা পুলিশের হাতে আটক হয়।

গত বছরের হ্যালিফ্যাক্স আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ফোরামে আলিনেজাদ বলেন, যে লোকটিকে আসলে ব্রুকলিনে আমার বাড়ির সামনে থেকে একে–৪৭ বন্দুকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি আগে ইউরোপের একটি অপরাধী চক্রের অংশ ছিলেন। সুতরাং বাস্তবতা হলো—স্বৈরাচারীরা কেবল নিজ দেশের লোকদেরই নয়, সীমানার বাইরের লোকদেরও নিপীড়ন করতে তারা একে অপরকে সাহায্য এবং সমর্থন করছে।

উত্তর কোরিয়া গুপ্তহত্যায় উচ্চাভিলাষী হলেও ততটা চতুর নয়। ১৯৬৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং–হিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ব্লু হাউসে’ ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৭ সালে কিম জং ইলের ভাতিজা ই হান–ইয়ংকে হত্যার পেছনেও পিয়ংইয়ংকে দায়ী করা হয়। 

২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নাম কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মারাত্মক স্নায়ুগ্যাসে আক্রান্ত হন। ধারণা করা হয়, পিয়ংইয়ং এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। 

৯/১১ ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার নতুন যুগ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একবিংশ শতাব্দীতে সিআইএ এখন আর গুপ্তহত্যার অভিযানকে অগ্রাধিকার দেয় না। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আরও বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এখন গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি আর নেই বলেই মনে হচ্ছে। 

এখন স্নায়ুযুদ্ধ না থাকলেও অনেক কিছুই বদলেছে। ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা এবং ৯/১১ হামলা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা করেছে। 

নাইন–ইলেভেনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ‘সমস্ত প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শক্তি’ ব্যবহারের জন্য মার্কিন কংগ্রেস ২০০১ সালে একটি তালিকা অনুমোদন করে। এরপর ২০১১ সালের অপারেশনে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২০ সালে ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সামরিক কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।

গুপ্তহত্যা এখন চলছে আকাশপথে, ফলে খুনিদের ঝুঁকি কমেছে। আইনে এখনো এসব হত্যাকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মার্কিন ড্রোন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া নথিতে অনেক কিছু বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিশ্লেষক ড্যানিয়েল হেল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ইন্টারসেপ্টকে এসব নথি দেন। নথিতে দেখা যায়, মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সোমালিয়া এবং ইয়েমেনে কমপক্ষে নয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করেছে। 

সামরিক অভিযানের আওতায় একই ধরনের ড্রোন কর্মসূচি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার দাবি করে, এসব আক্রমণ হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সামরিক শক্তির বৈধ ব্যবহার, যা ২০০১ সালের কংগ্রেসে অনুমোদিত। 

সবাইকে ছাড়িয়ে ইসরায়েল
তবে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনি নেতা এবং নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যা করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মাটিতে এসব করে না। তবে ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ গেমসের সময় ইসরায়েলি অলিম্পিক দলের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। 

এরপরে একটি ইসরায়েলি গোষ্ঠী মিউনিখ হামলার সঙ্গে জড়িত প্রায় দুই ডজন ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করে বলে মনে করা হয়। ইউরোপের মাটিতে খুন না করার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ইসরায়েল ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশে এসব হত্যাকাণ্ড চালায়। 

ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন গোয়েন্দা ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্টরি অব ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’—এর লেখক রনেন বার্গম্যানকে বলেন, এসব খুনের ঘটনাগুলো ধোঁয়াশাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুপ্তহত্যা চালানো আসলেই ভয় উদ্রেককারী। ইসরায়েল এসবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও, এটি সত্য যে, একজন ইসরায়েলিই সেই বন্দুকের ট্রিগার চেপেছে।

ইসরায়েলের নতুন গুপ্তহত্যা অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের নেতারা। ২০০৪ সালে দেশটি হামাস নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যার জন্য একটি হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠায় ইসরায়েল। এই অভিযানে নয়জন পথচারী নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। যদিও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়। 

অতি সম্প্রতি, দখলদার দেশটি ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের নির্মূল করার জন্য গুপ্তহত্যা পরিকল্পনাকে প্রসারিত করেছে, এমনকি যারা তেহরানের অস্ত্র কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না তাঁদেরও হত্যা করেছে। 

তবে ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’ বইটিতে বার্গম্যান ইসরায়েলের টার্গেটেড কিলিং প্রোগ্রাম এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্যে একটি ফারাক দেখিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এখন যেসব কমান্ড–অ্যান্ড–কন্ট্রোল সিস্টেম, যুদ্ধকক্ষ, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পাইলটবিহীন বিমান বা ড্রোন আমেরিকা এবং মিত্রদের সেবা দেয়; সবই ইসরায়েলে বিকশিত হয়েছে।’ 

বার্গম্যান অনুমান করেন, ২০০০–এর আগের দশকগুলোতে ইসরায়েল প্রায় ৫০০টি গুপ্তহত্যা করেছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় নিয়ে বার্গম্যান লিখেছেন, এই সময় সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ৮০০টি অপারেশন হয়েছিল। সেই হাজার হাজার গুপ্তহত্যার অভিযানে টার্গেট ও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে। 

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যুদ্ধোত্তর সময়ে ইসরায়েল আবারও এসব গুপ্তহত্যা কর্মসূচি বাড়াতে চায়। গাজার বাইরে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে—সম্ভবত কাতার বা অন্য কোথাও। 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমরা তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করে হত্যা করা প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছি। এটিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আংশিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনোভাবেই বিদেশের মাটিতে গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করা যায় না।’ 

গত ২ জানুয়ারি লেবাননের বৈরুত শহরতলিতে একটি হামাসের অফিসে ড্রোন হামলায় গোষ্ঠীটির সিনিয়র নেতা সালেহ আল–আরৌরি নিহত হন। ওই হামলায় হামাসের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। 

গুপ্তহত্যার বিশ্বমঞ্চে পুতিন
বিশ্ব রাজনীতিতে আরেক যুগের সূচনা হয় ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে দিয়ে। তাঁর নেতৃত্বে মস্কো বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের হত্যার সোভিয়েত রীতি বজায় রেখেছে। তবে মস্কো যেসব অঞ্চলকে জাতিগত এবং ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ বলে মনে করে, এমন প্রতিবেশী দেশগুলোর নাগরিকদেরও টার্গেট করছে। 

ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের কৌশলগুলো ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০০৬ সালে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে দলত্যাগী আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো এবং সাবেক ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালের বিষক্রিয়া এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। 

কিন্তু রাশিয়া এটাও প্রমাণ করেছে যে, খুনের কালিমা থেকে রেহাই পাওয়া কতটা সহজ! স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টার ঘটনায় বেশ কিছু নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও ২০১৭ সালে বাজফিড নিউজের তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গোপনে বিশ্বাস করেছিল, রাশিয়া অগণিত গুপ্তহত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যেসবের জন্য মস্কোকে সরাসরি অভিযুক্ত ও তিরস্কার করা হয়নি।

উন্নত গোয়েন্দা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের জন্য গ্রেপ্তার তেমন নেই। সন্দেহ রয়েছে, এই দেশগুলো পশ্চিমা তদন্তকারীদের এড়াতে কৌশল এবং তথ্য বিনিময় করছে। 

গুপ্তহত্যায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান
এমনকি যে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতি রক্ষা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ব্লগার জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পেছনে রিয়াদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

সিআইএ ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগি হত্যার জন্য সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশে ১৫ জনের হিট স্কোয়াডকে দায়ী করেছে। এরপরেও এখনো ট্রাম্প নির্বিকার স্বরে বলেন, ‘হয়তো তিনি করেছেন, হয়তো করেননি।’ 

বিচারবহির্ভূত বা নির্বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ র‍্যাপোর্টার ক্যালামার্ড সৌদি আরবকে জবাবদিহি করতে বিশ্বের ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর ও রিপোর্টের চার বছর পর ক্যালামার্ড বলেন, সামান্য পরিবর্তন হয়েছে এবং তবে বিচারের পথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধই রয়েছে।

পাকিস্তানও এই কাণ্ডে সমানভাবে দায়ী হতে পারে। দরিদ্র পাকিস্তানি প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার আইনজীবী কারিমা বালুচকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে টরন্টোতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কানাডার পুলিশ বলেছে, পাকিস্তানের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ নেই, তবে তাঁর পরিবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি করেছে। এ ছাড়া আইনজীবীরা কয়েক মাস আগে সুইডেনে নির্বাসিত পাকিস্তানি সাজিদ হোসেনের মৃত্যুর সঙ্গে আগের ঘটনার মিল আছে বলে দাবি করেছেন। 

গুপ্তহত্যা ক্লাবের নতুন মুখ ভারত
বিচার প্রক্রিয়ার অভাবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার হর্তাকর্তারা বৈদেশিক নীতিকে এগিয়ে নিতে গুপ্তহত্যা অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকারী দেশগুলোর ক্লাবে নতুন সদস্য যোগ হচ্ছে। সেই ক্লাবে ভারতকে নতুন সদস্য বলে মনে হচ্ছে। কানাডায় নিজ্জার হত্যা এবং নিউইয়র্কে পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা ছাড়াও পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বিশ্বাস করেন, ইন্টারসেপ্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারত অন্তত দুই পাকিস্তানি বাসিন্দাকে টার্গেট করেছে। একটি পৃথক ভারতীয় মেমো বলছে, কথিত রয়েছে, পশ্চিমে ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো এই ‘অত্যাধুনিক ক্র্যাকডাউন স্কিম’ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। 

এদিকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এমন প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশে দেশটির সমালোচকদের ওপর নজরদারি ও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বাড়িয়েছে। 

সমাধান মিলবে কি?
ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি; যেখানে কোনো দেশ বা সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই সরকারগুলো তার প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।’ 

ক্যালামার্ড নিজের প্রতিবেদনে জাতিসংঘকে ‘টার্গেটেড কিলিংয়ের’ সমীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দল করার আহ্বান জানিয়েছেন, যারা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের খুঁটিনাটি তদন্ত করবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, ‘আমরা এখনো এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নই এবং কারা এসব করে তার সম্পূর্ণ সন্দেহভাজন তালিকাও আমাদের কাছে নেই।’ 

ক্যালামার্ড মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বা কমিটি থাকা উচিত, যারা এসব মামলার তদন্ত করবে। এটি গঠিত হলে খুব শক্তিশালী বার্তা যাবে যে, এসব আর সহ্য করা হবে না।’

ক্যালামার্ড ফরেন পলিসিকে আরও বলেন, ‘আমি তখন যে পয়েন্টটি তৈরি করছিলাম এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছি তা হলো—নির্দিষ্ট ঘটনা তদন্তের জন্য আমাদের ক্ষমতার প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খ করা। যা এসব ঘটনা রোধ করবে এবং আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।’ 

তবে এসব সুপারিশ এখনো উপেক্ষিত। আশ্চর্যের কিছু নেই, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্তত দুটি রাষ্ট্র তাঁদের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে নিয়মিত গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখনো দায়সারাভাবেই গুপ্তহত্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। অনেক সময় ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হলেও মূল হোতা দেশ বা সংস্থা দায় এড়ায়। 

ক্যালামার্ড বলেন, দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় বা কূটনৈতিক স্তরে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক আইন পরিচালনার কোনো উপায় নয়। বিশ্ব গুপ্তহত্যা ঠেকানো থেকে আরও দূরে চলে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে সীমাহীন যুদ্ধের এক স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে। 

হিট স্কোয়াড, বিষযুক্ত টুথপেস্ট বা সশস্ত্র ড্রোন যাই হোক না কেন, বিদেশের মাটিতে হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তা নীতি, ভূ–রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক এবং উদ্বাস্তুরা এই বাস্তবতার শিকার সবচেয়ে বেশি—সম্ভবত জঙ্গি ও রাজনৈতিক নেতাদের চেয়েও। 

ক্যালামার্ড যুক্তি দেন, এই ধরনের হত্যা বিশ্বকে নিরাপদ করা তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা তৈরি ছাড়া আর কিছুই করে না। আর এমন পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলো। 

ক্যালামার্ড বলেন, ‘গত ২০ বছরে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনা যে “ন্যায্যতা” এনেছে তা সত্যিই নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, দৃঢ় কণ্ঠে এসব ঘটনার নিন্দা করার ক্ষমতাকেও ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে।’

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত