Ajker Patrika

বিশ্ব বাঁশ দিবস

রম্যরচনা /পাণ্ডা কেন বাঁশ খায় আর কফিলে সান্ডা?

আবদুল বাছেদ, ঢাকা
আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০: ১৯
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

আজ বিশ্ব বাঁশ দিবস। জীবনে নানাভাবেই বাঁশ খেয়েই চলেছি, আক্ষরিক অর্থে না হলেও ভাবগত দিক থেকে তো বটেই। এই রুঢ় জীবন বাস্তবতায় সব মানুষকেই কখনো না কখনো একটু-আধটু বাঁশ খেতেই হয়। তো বাঁশ দিবসে কাজের ফাঁকে আমার বন্ধু কফিলের সঙ্গে এই ‘বাঁশ খাওয়া’ নিয়েই আলাপ করছিলাম।

আলাপচারিতার এক ফাঁকে বন্ধু কফিল হঠাৎ গম্ভীর মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করল, দোস্ত, তুই কি বলতে পারিস, পাণ্ডা কেন বাঁশ খায়? আমি তখন ভেবেছিলাম ও হয়তো জীববিজ্ঞানের কোনো জটিল বিষয় জানতে চাইছে অথবা আমার জানাশোনার দৌড় যাচাই করছে। আমি ভাবান্তরেই বললাম, পাণ্ডার পাচনতন্ত্রে হয়তো বাঁশ হজম করার বিশেষ এনজাইম আছে—তাই বোধহয়।

কফিল তৎক্ষণাৎ হো হো করে হেসে উঠল, যেন আমি নিরেট গাধা। এরপর ও নিজেই ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, ঠিক যেন দর্শনের ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছে। দীর্ঘ বক্তৃতায় ও আমাকে যা বোঝাল, তাতে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবার কোনো হেতু পাইনি। কফিল বলল, ‘বোকা! পাণ্ডা বাঁশ খায় কারণ ওর কপালে সান্ডা জোটে না। এই দেশে অনেক চতুর কফিল আছে। তাঁদের কপালেই জোটে চর্বিযুক্ত সান্ডার নানা রেসিপি।’

আমি বললাম, ‘ব্যাটা, তোর নামও তো কফিল। নিজের নাম-জাতকে এভাবে শোষকদের কাতারে তুলছিস কীভাবে?’ বন্ধু কফিল বলে, ‘শুধু নাম দিয়ে কি সব হয়, আমি তো আর কামের কফিল না।’ এই বলেই কি এক আক্ষেপ তাঁর, যেন হতাশার সাগরে ডুবে গেল!

আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘দোয়া করি, তোর প্লেটেও একদিন পড়ুক সান্ডার ফ্রাই!’

কফিল আমার কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে এক মনে বলতে থাকে, ‘বুঝলি রে ব্যাটা, আমাদের দেশের জনগণ পাণ্ডার মতোই অলস আর নির্বোধ, কিন্তু আছে একদল ধূর্ত কফিল। এরা আশ্চর্য এক প্রাণী, চেহারা–সুরতে মানুষ, কিন্তু স্বভাবে হিংস্র হায়েনা, খায় শুধু সান্ডার ফ্রাই। সান্ডা না পেলে কফিলেরা রাতে ঘুমোতে পারে না।’

পাঁচ বছর পরপর এই কফিলেরা জনগণের কাছে ভোট চাইতে যায়। তখন ওদের ভাষা একেবারে ভদ্রলোকের মতো। মধুময় কণ্ঠে বলবে, ‘ভাই, একবার ভোটটা দেন, প্রতিবেলা আপনার প্লেটে থাকবে সান্ডা। রাস্তাঘাটে উন্নয়নের সান্ডা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধির সান্ডা, বৈদেশিক বিনিয়োগে ঝাঁকে ঝাঁকে সান্ডা।’

জনগণও তখন ভাবে, ‘আহা, এতদিন তো চতুর্মুখী বাঁশ খেয়েছি, এবার বুঝি সত্যি সত্যি সান্ডার স্বাদ পাব।’

এসে যায় ভোটের দিন। একেবারে পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবমুখর পরিবেশ। শুধু হালখাতা নেই, আছে সান্ডার লোভে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। খাই খাই রোদ, কপালে ঘাম, হাতে ব্যালট পেপার। পাশ থেকে কফিলের লোকজন বারবার মনে করিয়ে দেয়, ভুলে যাইয়েন না কিন্তু, সান্ডা মার্কায় ভোট দিলেই পাবেন এক একটি সান্ডা! জনগণও ভোট দেয়, আর মনে মনে ভাবে, এই ভোটই আমাদের বাঁশ খাওয়া থেকে মুক্তির পথ।

কিন্তু হায়! ভোটের পরদিন থেকেই অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হয়। কফিলেরা হঠাৎই বিদেশ ভ্রমণে যায়, নতুন গাড়ি কেনে, অট্টালিকা তোলে। সান্ডার ফ্রাই সব চলে যায় পাঁচতারা হোটেলের ভোজনশালায়।

আর জনগণ খায় সেই চিরাচরিত বাঁশ। দ্রব্যমূল্যের বাজারে বাঁশ, চাকরির বাজারে বাঁশ, ট্যাক্স দিতে গিয়ে বাঁশ, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েও বাঁশ। এর প্রতিবাদ করলে মেলে বেউড় বাঁশ, খেয়ে হয়ে যায় সবাই চুপ। যেন সেই গানের লাইনের মতো, ‘চুপ চুপ চুপ, অনামিকা চুপ, কথা বলো না...তুমি আমি বাঁশ খাই, কেউ জানে না। শুধু কথা বলো না।’ কোথাও কোনো অনামিকা আর কথা বলেও না।

তবে সান্ডার বদলে বাঁশ দেওয়া নিয়ে কফিলের যুক্তির কমতি নেই। একদিন টকশোতে কফিলকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘জনগণকে তো সান্ডা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এখন বাঁশ কেন?’

কফিল গম্ভীর মুখে বলল, ‘বাঁশে আছে ফাইবার, আছে ক্যালসিয়াম। খেলে দাঁত শক্ত হয়, শরীর হালকা থাকে। আমরা জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করি। তাই বাঁশ দিচ্ছি।’

শুনে শ্রোতারা হাততালি দেয়। কফিলের যুক্তিতে কারও কারও জেগে ওঠে দেশপ্রেম। বাঁশ খেয়ে গর্ব করে বলে, ‘আমরা আসল নাগরিক, আমরা দেশের তরে কঠিন বাঁশ খাই ও সহ্য করি!’

কফিল থামে না। দেশের রাজনীতিতে বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার জাহির করে ঢুকে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বলতে থাকে, শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা দুনিয়ায় একই অবস্থা। ধনী দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে বাঁশ দিয়ে বলে, ‘তোমাদের তো মেরুদণ্ড দুর্বল, শক্তভাবে বিশ্বমঞ্চে দাঁড়াতে পারো না। তোমাদের মেরুদণ্ডকে বাঁশ দিয়ে প্রতিস্থাপন করো, শক্তিমান হও, তবেই না বিশ্বমঞ্চে জোরগলায় দুটো কথা বলতে পারবে।’

গরিব দেশগুলো বলে, সাধু সাধু! কতই না ভুল বুঝি আপনাদের। দিন, আমাদের আরও আরও বাঁশ দিন।’

আমি এবার বন্ধু কফিলকে থামাতে বাধ্য হই। বন্ধু কফিলকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুই কি শুধু নামের নয়, কামের কফিলও হতে চাস।’ উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসে কফিল। আপনিও ওর মতো মুচকি হাসছেন সম-বাসনায়?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

লেখা ছেড়ে দেওয়া বিষয়ে

সম্পাদকীয়
লেখা ছেড়ে দেওয়া বিষয়ে

ভালো-মন্দ সব জায়গাতেই আছে। সাহিত্য জগতেও যে ভালো মানুষ পাইনি, তা তো নয়। একজন লেখক অসম্ভব স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল মানুষ। লেখালেখি বিষয়টাই তো সাংঘাতিক স্পর্শকাতর—লেখক এবং লেখা উভয়েই সামান্য কারণে আহত হয়!

...লেখালেখি বিষয়টি একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে কোমল আর সূক্ষ্ম অনুভূতি দাবি করে, সবচেয়ে গভীর মনোযোগ দাবি করে, আমার তো এ-ও মনে হয় যে ধ্যানমগ্নতা ছাড়া একজনের পক্ষে লেখকই হওয়া সম্ভব নয়। তো সতীর্থদের নোংরামি দেখে, ভণ্ডামি দেখে, বদমায়েশি দেখে কি একজন প্রকৃত লেখকের আহত হওয়ার কথা নয়?

...আমি তো সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি—শিল্পীদের লোভ থাকতে নেই। লোভ থাকলে শিল্প হয় না, যেমন হয় না অসৎ মানুষেরও। শিল্পীর সততা থাকাটা খুব জরুরি, আমি বলব অপরিহার্য। যাই হোক, আমি শুধু সাহিত্য জগতের ভণ্ডামি দেখে লেখালেখি থেকে দূরে সরে এসেছি, সেটা বলা ঠিক হবে না। এটা একটা কারণ ছিল বটে, তবে আরও কারণ নিশ্চয়ই আছে।

আগেই তো তোমাকে বলেছি, আমি শেষের দিকে এসে একঘেয়েমিতে ভুগছিলাম। তা ছাড়া একটা সময় এসব কিছুকেই ভীষণ অর্থহীন মনে হলো আমার কাছে। কী করছি, কেন করছি, এসবের ফলাফল কী, আদৌ এসব করার কোনো অর্থ হয় কি না—এই সব আরকি! সব মিলিয়ে লেখালেখিটা আর ভালো লাগেনি। অবশ্য একবারে পরিকল্পনা করে, সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখালেখি বন্ধ করেছিলাম, তা নয়। এ রকম তো সব লেখকেরই হয় যে মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে, মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে, মাঝে মাঝে বন্ধ্যত্বও দেখা দেয়। আমার সেটাই হয়েছিল। কিন্তু সব লেখকই সেই সময়টি পেরিয়ে আবার লেখালেখিতে আসেন। আমার আর ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। আর এখন তো শারীরিক কারণেই অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। যে উদ্দাম জীবন আমি যাপন করেছি, সেটা শুনলে তোমরা অবাক হয়ে যাবে, আর এখন তো দিনের পর দিন ঘরে বন্দী হয়ে থাকি, বেরুতেই পারি না...

সূত্র: আহমাদ মোস্তফা কামাল কর্তৃক মাহমুদুল হকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘হিরণ্ময় কথকতা’, পৃষ্ঠা ৯০-৯১

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ন্যাশনাল জুট মিলস বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
ন্যাশনাল জুট মিলস বধ্যভূমি

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহর। গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ১ ডিসেম্বর চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যা। শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পারে খলাপাড়া গ্রামে ‘ন্যাশনাল জুট মিলস লি.’ নামে যে কারখানাটি অবস্থিত, সেখানেই নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযোদ্ধাসহ মিলের মুক্তিকামী শ্রমিক-কর্মচারীদের। শতাধিক বাঙালিকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে পাকিস্তানি সেনারা। তাঁদের অপরাধ ছিল একটাই—মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের পরিকল্পনা করা। গণহত্যার পর হানাদার বাহিনী মিলের দক্ষিণ দিকের দেয়াল ভেঙে চলে যায়। মরদেহগুলো তিন-চার দিন মিলের সুপারিবাগানে পড়ে থাকে। শিয়াল-শকুন খুবলে খায় সেগুলো। দেশ স্বাধীন হলে গ্রামবাসী মিলের ভেতরে গিয়ে ১৩৬ জনের লাশ পান। মিলের দক্ষিণ পাশে ১০৬ জনের মৃতদেহকে গণকবরে শায়িত করা হয়। বাকিদের মরদেহ নিয়ে যান স্বজনেরা। ১৯৯৬ সালে শহীদদের সম্মানে মিল কর্তৃপক্ষ ‘শহীদ স্মরণে’ স্মৃতিফলকটি নির্মাণ করে গণকবরের জায়গাটিতে।

ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বধ্যভূমি ৭১

সম্পাদকীয়
বধ্যভূমি ৭১

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ সড়কে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স-সংলগ্ন ভুরভুরিয়াছড়ার পাশেই বধ্যভূমি ৭১ পার্ক অবস্থিত। সেখানে প্রাচীন একটি বটগাছ রয়েছে, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে। পাকিস্তান আমলে গাছটির নিচে ছিল এক সাধুর আস্তানা। চা-শ্রমিক ও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে এসে পূজা দিত, মনোবাসনা পূরণে মানত করত। সবাই জায়গাটিকে চিনত ‘সাধু বাবার থলি’ নামে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। হত্যার আগে বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে তাঁদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজন ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষও বাদ যাননি। গাছের ডালে উল্টো করে বেঁধে রাখা হতো তাঁদের। নির্যাতনের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তাঁরা শহীদ হন। সেই সব শহীদের ত্যাগকে অমর করে রাখতে এখানে নির্মিত হয় ‘বধ্যভূমি ৭১’ নামের স্মৃতিস্তম্ভটি। একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিটিতে আরও রয়েছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১’ নামে একটি ভাস্কর্য।

ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রহনপুর গণকবর

সম্পাদকীয়
রহনপুর গণকবর

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে। শহীদদের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার! রহনপুর সরকারি এ বি উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এখানেও শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই শহীদদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই বধ্যভূমিটি রহনপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নামে পরিচিত।

ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত