শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে সম্প্রতি রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান জাকিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। এই রোগীকে দেখার পর তাঁকে এমআরআই করাতে বলেন চিকিৎসক। কিন্তু হাসপাতালের একমাত্র এমআরআই যন্ত্রটি নষ্ট থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এবার চিকিৎসক তাঁকে এমআরআইয়ের পরিবর্তে সিটি স্ক্যান করাতে বলেন। এখানেও একই পরিস্থিতিতে পড়েন রোগী।
হাসপাতালের দুটি সিটি স্ক্যান যন্ত্রের একটি অচল থাকায় সিরিয়াল পাননি তিনি। বাধ্য হয়ে এসব পরীক্ষা করানোর জন্য বেসরকারি একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছুটতে হয় তাঁকে।
শুধু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালই নয়, দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের অতিপরিচিত দৃশ্য এটি। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজের মতো হাসপাতালেও রোগীকে এমআরআই মেশিন নষ্ট বলে শুনতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে এমআরআই বা সিটি স্ক্যানের মতো পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালে গেলেই দেখা যায় মেশিন নষ্ট, নয়তো সিরিয়াল পেতে অস্বাভাবিক অপেক্ষা। ফলে ভোগান্তি এড়াতে বেসরকারি ডায়াগনস্টি সেন্টারে যেতে হয় রোগীদের। এতে বেড়ে যায় চিকিৎসা খরচ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে যেসব সিটি স্ক্যান ও এমআরআই যন্ত্র রয়েছে,
তার প্রায় অর্ধেকই অচল। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটি স্ক্যান যন্ত্র আছে ৩১টি, এর মধ্যে ১১টিই অচল। বাকি যে ২০টি সচল আছে ভাগ্য ভালো হলে সেখান থেকে পরীক্ষা করাতে পারেন ভর্তি না হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।
সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় এমআরআই করাতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এমআরআই যন্ত্র আছে ২৪টি, এর মধ্যে ১০টিই অচল। মন্ত্রণালয় ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দড়ি টানাটানিতে সেগুলো সচল করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
একই অবস্থা ১৮টি বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রেরও। এসব প্রতিষ্ঠানে ১৭টি সিটি স্ক্যান যন্ত্রের মধ্যে ৭টি অচল, আর ৯টি এমআরআই যন্ত্রের মধ্যে ৪টি অচল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬১টি জেলা সদর হাসপাতালে সিটি স্ক্যান যন্ত্র আছে মাত্র ১০টি। এর মধ্যে ১টি নষ্ট। আর এমআরআই যন্ত্র আছে মাত্র ৫টি, যার ২টি অচল। তবে প্রকৃত তথ্য হলো, সচল দেখানো যন্ত্রগুলোর মধ্যে বেশ কিছু বেশির ভাগ সময় নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ করা একমাত্র সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় করোনাকালে। এখন সেটির কোনো ব্যবহার হচ্ছে না। অন্যদিকে কিডনি হাসপাতালও সিটি স্ক্যান পরীক্ষা করাতে পারছে না।
চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে রোগীদের
জটিল ও কঠিন রোগ নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান ও এমআরআই পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এসব পরীক্ষার সুবিধা থাকলে রোগীদের সাশ্রয় হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে যন্ত্র বিকল থাকায় বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এসব পরীক্ষা করাতে দুই থেকে আড়াই গুণ অর্থ বেশি খরচ করতে হয় তাঁদের।
সরকারি হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে সিটি স্ক্যান করাতে ২ হাজার টাকার মতো ফি দিতে হয়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করালে খরচ হয় ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
সরকারি হাসপাতালে ৩ হাজার টাকায় চেস্ট সিটি করানো যায়। বেসরকারি হাসপাতালে এ পরীক্ষার জন্য ছয় থেকে ৮ হাজার টাকা লাগে। একইভাবে ব্রেনের সিটি স্ক্যান করাতে সরকারিতে লাগে ২ হাজার, বেসরকারিতে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্ত্রের পূর্ণ সিটি করাতে সরকারি হাসপাতালে ব্যয় হয় ৪ হাজার, বেসরকারিতে গুনতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তবে কোনো রোগীর যদি কন্ট্রাস্ট প্রয়োজন হয়, তাহলে এর সঙ্গে আরও ২ হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। একইভাবে সরকারি হাসপাতালে স্পাইন, ব্রেন, নি-জয়েন্ট ইত্যাদি পরীক্ষা ৩ হাজার টাকায় হলেও বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় হয় ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা।
সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৪ হাজার টাকায় হোল অ্যাবডোমিন এমআরআই করানো গেলেও বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় হয় ১৪ হাজার টাকা।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি সিটি স্ক্যান বা এমআরআই যন্ত্রে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন রোগীর পরীক্ষা হয়। কিন্তু অর্ধেক যন্ত্র নষ্ট থাকায় বিপুলসংখ্যক রোগী এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নষ্ট যন্ত্র সচলে জটিলতা কোথায়
মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, অচল যন্ত্রগুলোর মধ্যে কিছু আছে, যা আর কখনোই সচল হবে না। অন্যদিকে কিছু আছে, সেগুলো মেরামত করে পুনরায় সচল করা সম্ভব। অচল যন্ত্রের অর্ধেকই মেরামত-অযোগ্য। যদিও মেরামতযোগ্য যন্ত্রগুলোর সচল না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এসব যন্ত্রের বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদ (ওয়ারেন্টি পিরিয়ড) আগেই শেষ হয়ে গেছে।
এসব যন্ত্র কেনার সময় নিয়মানুযায়ী সরকার এবং বিক্রেতা বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশেষ চুক্তি হয়ে থাকে, যা কমপ্রিহেন্সিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট (সিএমসি) নামে পরিচিত। সেই চুক্তির আলোকে বিক্রেতা বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে কোনো সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিএমসি করতে রাজি হচ্ছে না। কারণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে যন্ত্রের ক্রয়মূল্যের সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে সিএমসি। কিন্তু যন্ত্রগুলো পুরোনো হওয়ায় এবং যন্ত্র কেনার সময়ের তুলনায় বর্তমানে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত হারে সিএমসি করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় ও বিক্রেতাদের অনড় অবস্থানের কারণে যন্ত্রগুলোর স্বাভাবিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে, এতে বাড়ছে শুধু রোগী দুর্ভোগ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক হাসপাতাল ও লাইন ডাইরেক্টর হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচএসএম) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, মেরামত উপযোগী যন্ত্রগুলো মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে। সিএমসির জন্য আলোচনা চলছে। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মন্ত্রণালয় নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি দাবি করছে। মেরামতের ব্যয়ে যদি নতুন যন্ত্র কেনা যায়, তাহলে সে রকম সিদ্ধান্তই নিতে হবে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে