রোববার, ০৪ জুন ২০২৩

সেকশন

 

বৃদ্ধনিবাসে পরিণত হচ্ছে কেরালার যে শহর

আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৬:৫৫

কুমবানাদের সরকারি এই স্কুলে শিক্ষার্থী আছে কেবল ৫০ জন। ছবি: বিবিসি শুনে অবাক হবেন, ভারতের মতো জনবহুল দেশের কোনো কোনো শহর ধুঁকছে জনসংখ্যা সংকটে। এসব জায়গায় জন্মহার যেমন কম, তেমনি অনেকেই শহর ছেড়েছেন উন্নত জীবনের আশায়। অনেকটা মৃত শহর বা ঘোস্ট টাউনে পরিণত হয়েছে এগুলো, যেখানে বাস মূলত বয়স্কদের। এমনই এক জায়গা কেরালার কুমবানাদ। সেখানে গিয়েছিলেন বিবিসির সৌতিক বিশ্বাস। 

বিগত বছরগুলোতে কেরালার এই অলস শহরের স্কুলগুলো অস্বাভাবিক এক সমস্যায় ভুগছে। শিক্ষার্থী বড় দুষ্প্রাপ্য এখানে, তাদের খোঁজে বের হতে হয় শিক্ষকদের। শুধু তাই নয়, স্কুলে ছাত্রছাত্রী আনতে গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয় তাঁদের। 

১৫০ বছর আগে স্থাপিত কুমবানাদের সরকারি আপার প্রাইমারি স্কুলে এখন শিক্ষার্থী আছে কেবল টেনেটুনে ৫০ জন। ১৯৮০ সালের দিকে সংখ্যাটা ছিল ৭০০। এই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই আবার দরিদ্র পরিবারের, যাদের শহরের প্রান্তে অবস্থান। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শ্রেণি গ্রেড সেভেনের শিক্ষার্থী কেবল সাতজন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের এই শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসা-যাওয়ার ভাড়াও গুনতে হয়। এমনকি এখানে যে কয়েকটি বেসরকারি স্কুল আছে, তার শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থীর খোঁজে বের হতে হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী আছে যে স্কুলে, সেটির শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ৭০। 

বাসিন্দারা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ায় ১৫ শতাংশ ঘরেই ঝুলছে তালা। ছবি: বিবিসি ‘আমাদের কী করার আছে? শহরে কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, এখানে খুব কম মানুষই বাস করে।’ বলেন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল জয়াদেবী আর.। 

কথাটা মোটেই মিথ্যা নয়। কুমবানাদ শহরটির অবস্থান কেরালার পাথানামথিতা জেলার ঠিক কেন্দ্রে। এখানে জনসংখ্যা যেমন কমছে, তেমনি যারা বাস করছেন তাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক। 

কুমবানাদ ও আশপাশের আধা ডজন গ্রামে মোটামুটি হাজার পঁচিশেক মানুষের বাস। এখানকার ১১ হাজার ১১৮পি বাড়ির শতকরা ১৫ শতাংশ বাড়িতে ঝুলছে তালা। এসব বাড়ির বাসিন্দারা অন্য কোথাও চলে গেছেন কিংবা ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। জানান স্থানীয় গ্রাম কাউন্সিল প্রধান আশা সি জে। 

আন্নাম্মা জেকব তাঁর দুই তলা বাড়িতে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন কয়েক দশক ধরে। ছবি: বিবিসি একটি হাসপাতাল, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত একটি ক্লিনিক, ৩০টির বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ৩টি বৃদ্ধনিবাস এখানকার চুলে পাক ধরা লোকের হার যে বেশি তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এদিকে দুই ডজনের বেশি ব্যাংক, এর মধ্যে আধ কিলোমিটারেরও কম জায়গার মধ্যে ৮টি শাখা পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাস ও কাজ করা শহরের মানুষদের অর্থ গ্রহণের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। গত বছর ভারতে প্রবাসীদের কাছ থেকে যে ১০ হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা পায় তার ১০ শতাংশ আসে কেরালায়। 

ভারতে এক যুগের জনসংখ্যা বৃদ্ধির শেষ যে জরিপ (২০০১-১১) করা হয়, তাতে তলানিতে ছিল কেরালা ও তার প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ু। জাতীয় গড় আয়ু ৬৯ হলেও কেরালায় জন্মগ্রহণকারী শিশু ৭৫ বছর আয়ুর আশা করতে পারে। 

চাক্কো মাম্মেন তাঁর কলার খামারে দিনে চার ঘণ্টা শ্রম দেন। ছবি: বিবিসি জন্মহারও কম। একজন নারী গড়ে এখানে ১.৭ থেকে ১.৯টি সন্তান জন্ম দেন। ছোট পরিবারগুলো সন্তানদের শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। এতে তরুণেরা ভালো সুযোগের জন্য দেশে ও দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছেন বয়স্ক মা-বাবাকে রেখে। 

আন্নাম্মা জেকব তাঁর দোতলা বাড়িতে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন কয়েক দশক ধরে। ৭৪ বছরের অন্নাম্মার স্মৃতিতে কেবল নিঃসঙ্গতা। তাঁর যন্ত্রকৌশল প্রকৌশলী স্বামী ১৯৮০-র দশকেই মারা যান। তাঁর পঞ্চাশে পা দেওয়া ছেলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে আবুধাবিতে বাস ও কাজ করছেন। অন্নাম্মার এক মেয়ে থাকেন কয়েক মাইলের মধ্যে, তবে তাঁর স্বামী দুবাইয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করছেন তিন যুগ ধরে। 

আন্নাম্মার নিকটতম দুই প্রতিবেশীর একজন বাড়িতে তালা দিয়ে মা-বাবাকে নিয়ে গেছে বাহরাইনে, সেখানে নার্সের কাজ করেন তিনি। অপর প্রতিবেশী দুবাই চলে গেছেন, বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন এক বৃদ্ধ দম্পতিকে। 

পুলিশ একাকী থাকা বয়স্ক ব্যক্তিদের বাড়ি যায় তাঁদের খোঁজ নিতে। ছবি: বিবিসি তবে কুমবানাদের অনেক অধিবাসী জায়গাটি ছেড়ে চলে গেলেও ক্ষয় একে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরেনি। ফাঁকা বাড়িগুলো নিয়মিত রং করা হয়, যেন যেকোনো দিন মানুষ আশা করছে। যদিও এ ধরনের আগমনের ঘটনা ঘটে কমই। 

 ‘এটা খুব নিঃসঙ্গ এক জীবন। আমার শরীরও ভালো থাকে না।’ বলেন আন্নাম্মা জেকব। তবে হার্টে সমস্যা ও বাত থাকার পরও ছেলে ও নাতিদের সঙ্গে সময় কাটাতে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। 

আন্নাম্মার বাড়ি থেকে কয়েক লেন দূরে চাক্কো মাম্মেন তাঁর কলার খামারে দিনে চার ঘণ্টা শ্রম দেন। তাঁরও হার্টের সমস্যা আছে, সঙ্গে ডায়াবেটিস। ৬৪ বছরের চাক্কো তিন দশক ওমানে কাজ করে পরে দেশে ফিরে আসেন।

পুলিশ একাকী থাকা এই বৃদ্ধদের খোঁজ-খবর নেয় নিয়মিত। তবে এখানে অপরাধের হার কম। পুলিশ জানায়, চুরির ঘটনা এখানে একেবারেই কম, কারণ মানুষ ঘরে বেশি টাকা বা মূল্যবান জিনিস রাখে না। শেষ কবে এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে তাও মনে করতে পারেন না তাঁরা। 

বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া শহরের বড় এক সমস্যা। ছবি: বিবিসি ‘সবকিছু মিলিয়ে খুব শান্তিপূর্ণ জায়গা এটি। আমরা কেবল প্রতারণার অভিযোগ পাই। আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে প্রতারিত হন বৃদ্ধরা, কিংবা তাঁদের স্বাক্ষর নকল করে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।’ বলেন স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের চিফ ইন্সপেক্টর সাজিশ কুমার ভি। 

শহরে অপরাধ কম হওয়ায় পুলিশ বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখভালে বেশি সময় দিতে পারে। ২০২০ সালে একটি বাড়িতে বারবার বেল চেপে সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ। দেখতে পায়, ওই বাড়ির বাসিন্দায় এক বয়স্ক নারী মাটিতে পড়ে আছেন। 

 ‘আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে সুস্থ হন তিনি। আমাদের আরেকটি কর্তব্য শহরের বাসিন্দাদের বৃদ্ধনিবাস বা ওল্ড হোমে নিয়ে যাওয়া। আমরা নিয়মিত বয়স্কদের খবর নিই, তাঁদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই।’ বলেন চিফ ইন্সপেক্টর কুমার। 

শহরে হুইলচেয়ারে পৌঁছা যায় এমন তিনটি ওল্ড হোম আছে। এগুলো বেশ খোলামেলা, দরজা ও হলওয়ে প্রশস্ত। এদের একটি পাঁচতলা দালানের দ্য আলেক্সান্ডার মারথোমা মেমোরিয়াল জেরিয়াট্রিক সেন্টার। এর সঙ্গেই আছে ১৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল। এই বৃদ্ধনিবাসে ৮৫ থেকে ১০১ বছর বয়সী ১০০ জন বৃদ্ধের দেখভাল করা হয়। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ শয্যাশায়ী, পরিবারকে মাসে ৫০ হাজার রুপি করে গুনতে হয় এই সেবার বিনিময়ে। কখনো ছেলেমেয়েরা এসে থাকেন তাঁদের সঙ্গে। 

এর কাছেই ৭৫ বছরের পুরোনো ধর্মগিরি ওল্ড এজ হোম। সেখানে ৬০ জন স্থানীয় বাসিন্দার বাস, যাদের প্রত্যেকের বয়স ৬০-র বেশি। 

অসুস্থ বয়স্ক মানুষ, বৃদ্ধনিবাস, শ্রমিক সংকট, তরুণদের অভিবাসন, জনসংখ্যা হ্রাস, মৃতপ্রায় শহর—এই সবকিছুই যেন এখন কুমবানাদের চিত্র। 

‘জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের এক গল্প এই শহর। শেষ পর্যন্ত গোটা ভারতের গল্প হবে এটি।’ বলেন মুম্বাইভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সের অধ্যাপক কে এস জেমস। 

বিবিসি থেকে অনুবাদ ইশতিয়াক হাসান

আরও খবর পড়ুন:

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনা: সামনে-পেছনে শুধু মৃতদেহ, ভেসে আসছে কান্নার শব্দ

    ‘অশ্লীল’ আখ্যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ অঙ্গরাজ্যের স্কুলে বাইবেল নিষিদ্ধ

    ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনা: ‘কাঁদতে কাঁদতে শিশুটিও কিছুক্ষণ পর মারা যায়’

    ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত বেড়ে ২৮৮

    ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনা: ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবে নিহতদের পরিবার 

    ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত বেড়ে ২৩৩, আহত ৯০০

    গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হলেন আজমত 

    সত্যিই কি বিচ্ছেদের পথে রাজ-পরী

    ১৩ বছরে কৃষিতে ভর্তুকি প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা: সংসদে কৃষিমন্ত্রী

    ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল থেকে ছিটকে গেলেন হ্যাজলউড 

    মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার অভিযোগ

    ৪ মাসে বয়সে মা হারানো যমুনা বেড়ে উঠছে হাসপাতালে, মানুষ দেখলেই উচ্ছ্বাস