ঘোড়াকে পোষ মানাতে মানুষের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা সফল হয় ৪২০০ বছর আগে

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

বুনো পরিবেশে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো ঘোড়াকে বশে আনার মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছিল তা অন্য কোনো প্রাণীর বেলায় ঘটেনি। যুদ্ধ, বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ঘোড়ার ব্যবহার করে আসছে মানুষ। তবে এই ঘোড়ারা একসময় মানুষের বশে ছিল না। বুনো ঘোড়াকে বশে আনার প্রক্রিয়াটিও সহজে ঘটেনি। শত শত বছরের প্রচেষ্টায় একদিন সফল হয়েছিল মানুষ। প্রাচীন এবং আধুনিক ঘোড়ার জিনোমগুলোর একটি যুগান্তকারী বিশ্লেষণ ঘোড়াকে বশে আনার সেই মুহূর্তটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। 

সম্প্রতি নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, ঘোড়াকে গৃহপালিত করার ঘটনা মানব সভ্যতায় অন্তত দুইবার ঘটেছে। এর মধ্যে প্রথম প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে ২২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অর্থাৎ প্রায় ৪ হাজার ২০০ বছর আগে ইউরেশিয়াতে ঘোড়া ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটি গতিশীল সমাজের উত্থান ঘটেছিল। অতীতে ধারণা করা সময়ের সময়ের তুলনায় যা কয়েক শতাব্দী পরে ঘটেছিল। 

এ বিষয়ে বার্সেলোনার ইনস্টিটিউট অব ইভোলিউশনারি বায়োলজির বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী পাবলো লিব্রাডো বলেন, ‘প্রাণীদের গৃহপালন মানুষের ইতিহাস পরিবর্তন করেছে। কিন্তু ঘোড়ার মতো অন্য কোনো প্রাণী নতুন যুগের সূচনা করতে পারেনি।’ 

জিনোম বিশ্লেষণে দেখা গেছে—আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ায়, বিশেষ করে উত্তর কাজাখস্তানে বোতাই সংস্কৃতিতে ঘোড়াকে প্রথমবার গৃহপালিত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই গৃহপালনের উদ্দেশ্য ছিল মূলত ঘোড়ার মাংস এবং দুধ আহরণ করা। এটিকে যে পরিবহনে ব্যবহার সম্ভব সেই বিষয়টি তখনকার দিনের মানুষের কল্পনায়ও ছিল না। আর ঘোড়ার ব্যবহার শুধু সেই সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, বাইরে ছড়িয়ে পড়েনি। ধারণা করা হয়, মঙ্গোলিয়ার ফেরেল প্রজেওয়ালস্কি ঘোড়াগুলো সেই বোতাই সংস্কৃতির ঘোড়াগুলোরই বংশধর। 

ঘোড়ার দ্বিতীয় রক্তরেখায় দেখা যায়, আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ বছর আগে পশ্চিম রাশিয়ার তৃণভূমি অঞ্চলগুলোতে দ্রুতগামী এই প্রাণীটিকে গৃহপালিত করতে সক্ষম হয়েছিল মানুষ। এই প্রচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত গতিশীলতা এবং পরিবহনের জন্য ঘোড়ার ব্যাপক ব্যবহারের প্রচলন ঘটায়। সমীক্ষা অনুসারে, ৪ হাজার ২০০ বছর আগে সেই ঘোড়ার বংশধরেরা ইউরেশিয়া জুড়ে মানুষ এবং মালামাল পিঠে নিয়ে ছুটে চলার আগে তাদের গৃহপালিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি কয়েক শ বছর ধরে চলেছিল। আজকের দিনে মানুষের তৈরি আস্তাবলে থাকা ঘোড়ারা গুরুত্বপূর্ণ সেই মুহূর্তের ধারাবাহিকতা থেকেই এসেছে। 

গবেষকেরা গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়টিতেই ঘোড়ার প্রজনন অনুশীলনে একটি বড় পরিবর্তন শনাক্ত করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, সেই সময়টিতে ঘোড়ার নতুন প্রজন্মগুলোর মধ্যে সময়ের ব্যবধানকে ৮ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছরে নিয়ে এসেছিল মানুষ। অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রজনন ঘটানোর মাধ্যমে মানুষ অতীতের তুলনায় ঘোড়ার এক প্রজনন থেকে অন্য প্রজননের সময়সীমা অর্ধেক কমিয়ে এনেছিল। আর এটা করা হচ্ছিল ঘোড়ার নিজের রক্তের আত্মীয়দের মধ্যে মিলন ঘটিয়ে। লিব্রাডো বলেন, ‘আমরা শুধু সেই সময় থেকেই ঘোড়াগুলোর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে মিলন শনাক্ত করি। সুদূর অতীতে এমনটি ছিল না।’ 

লিব্রাডো জানান, রক্তের সম্পর্কিত নিজের আত্মীয়দের মধ্যে মিলনের মধ্য দিয়ে প্রজননের বিষয়টি বুনো কিংবা গৃহপালিত ঘোড়ারা এড়িয়ে চলে, যদি না মানুষ তাদের এই প্রক্রিয়ায় যেতে বাধ্য না করে। 

সেই সময়টিতে ঘোড়ার গতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বড় দূরত্ব অতিক্রম করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। এর ফলে যোগাযোগ, বাণিজ্য নেটওয়ার্ক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ইউরোপ এবং এশিয়াজুড়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। ঘোড়ার টানা রথ এবং অশ্বারোহীরা যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। 

সেন্টার ফর অ্যানথ্রোপোবায়োলজি অ্যান্ড জিনোমিক্স অব টুলুজের সহ-লেখক লুডোভিক অরল্যান্দো জানান, ঘোড়ার ব্যবহার মানব ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। পৃথিবী ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছিল। ঘোড়ার এমন আধিপত্য ১৯ শতকের শেষ দিকে জ্বালানিচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। 

গবেষকদের নতুন অনুসন্ধান দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত একটি বিশ্বাসকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। প্রচলিত ওই বিশ্বাস অনুযায়ী, আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগেই ঘোড়ার গতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ইউরেশিয়া জুড়ে ব্যাপক মানব অভিবাসন শুরু হয়েছিল এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো ছড়াতে শুরু করেছিল। নতুন গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেই সময়টিতে যদি মানব অভিবাসনের ঘটনা ঘটেও থাকে তবে তা ঘোড়ার পিঠে চড়ে হয়নি। 

জিনগত এই গবেষণায় ঘোড়ার গৃহপালিত হওয়ার সময়রেখাকেই শুধু নতুনভাবে লেখা হয়নি, বরং ঘোড়ার গতিশীলতা পৃথিবীজুড়ে যে পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল সেই বিষয়টির ওপরও আলোকপাত করেছে। বিশেষ করে—প্রাচীন সভ্যতা, যুদ্ধ এবং প্রাচীন বিশ্বের আন্তঃসম্পর্কের ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত