Ajker Patrika

গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রকৌশলে প্রাচীন মিসরের অবদান

জিনাতুন নূর
গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রকৌশলে প্রাচীন মিসরের অবদান

গণিত, প্রকৌশল, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যার মতো বিষয়ে উচ্চতর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছিল প্রাচীন মিসরীয়দের। তাঁরা তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। অনেকের ধারণা, বিজ্ঞান আধুনিককালের আবিষ্কার, যার শিকড় প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায়। গ্রিকরা আধুনিক বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার সূচনা করলেও তাঁদের আগেও মানুষ ব্যবহারিক বিজ্ঞান চর্চা করতেন।

প্রাচীন মিসরীয়রা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিদ্যায় অসাধারণ উন্নতি সাধন করেছিলেন। এই জ্ঞান তাঁদের পিরামিড, মন্দির নির্মাণ, ক্যালেন্ডার তৈরি এবং সমাজ পরিচালনায়ও সহায়তা করে। যদিও প্রাচীন মিসরীয়দের বিজ্ঞান অনেকাংশেই আজকের দিনে জাদু বা কল্পকাহিনির মতো মনে হতে পারে, তবু এর কিছু কিছু দিক আধুনিক বিশ্বে এখনো প্রাসঙ্গিক।

মিসরীয়দের গণিতর্চচা

প্রাচীন মিসরীয়দের হিসাবের খাতা দেখলে একজন আধুনিক মানুষের কাছে খুব অচেনা মনে হবে। কারণ, মিসরীয়রা আধুনিক আরবি সংখ্যাপদ্ধতি তো নয়ই, প্রাচীন রোমান সংখ্যাপদ্ধতিও ব্যবহার করতেন না। তাঁরা হায়ারোগ্লিফিকস নামে একধরনের চিত্রলিপি ব্যবহার করে সংখ্যা বোঝাতেন। তাঁদের সংখ্যা পদ্ধতিতে দশমিকভিত্তিক ও পুনরাবৃত্তিমূলক। ১, ১০, ১০০০, ১০০০০, ১০০০০০ ও ১,০০০,০০০ এমন র্নিদিষ্ট কিছু সংখ্যার জন্য তাঁরা আলাদা চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহার করতেন।

তাঁদের সংখ্যাগুলো ছোট থেকে বড় ক্রম অনুযায়ী লেখা হতো। লেখার দিক হতো বাঁ থেকে ডানে, আবার কখনো ডান থেকে বাঁয়ে, তবে তা পাঠ্য অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারত। মিসরীয়দের মধ্যে কোনো ‘শূন্য’র ধারণা ছিল না। তাই তাঁরা শূন্য ব্যবহার করতেন না। তবে মাঝে মাঝে তাঁরা ফাঁকা জায়গা দিয়ে শূন্য বোঝাতেন। মিসরীয় গণিতসংক্রান্ত যে চারটি প্যাপিরাস (প্রাচীন কাগজে লেখা দলিল) এখনো টিকে আছে, সেগুলো হলো—মস্কো, বার্লিন, কাহুন ও রাইন্ড প্যাপিরাস।

আধুনিক গবেষণায় রাইন্ড প্যাপিরাসকে সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত করা হয়। এই সংখ্যাপদ্ধতি জটিল হলেও ব্যবহারের দিক থেকে ছিল সহজ। যোগের ক্ষেত্রে লেখক শুধু একটি সংখ্যার পর আরেকটি সংখ্যা লিখে দিতেন। যাঁরা ভাষা জানতেন, তাঁরা বুঝতে পারতেন, কোথায় একটি সংখ্যা শেষ হয়ে অন্য সংখ্যাটি শুরু হয়েছে। গুণের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি আদি হলেও এখনো বোঝা সহজ। ছোট সংখ্যাগুলো গুণ করা হতো পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে (যেমন: ১, ১, ১, ১ = ৪), আর ১০,০০০ এর বেশি সংখ্যার ক্ষেত্রের প্রথমে বড় সংখ্যাটি লেখা হতো এবং নিচে এক এক করে গুণনীয়ক লেখা থাকত। উদাহরণস্বরূপ, যদি ১০০,০০০ এর নিচে চারটি এক লেখা থাকত, তাহলে এর মান হতো ৪ গুণ ১০০,০০০ = ৪০০,০০০।

‘r’ ধ্বনির জন্য ব্যবহৃত চিহ্নটি ছিল মানুষের মুখের মতো এবং এটি কোনো সংখ্যার ওপরে লেখা হলে তা ভগ্নাংশ বোঝাত। যেমন ‘r’ চিহ্ন যদি চারটি একের (১) ওপর লেখা হতো, তাহলে তা ১/৪ বোঝাত। গুণের বিপরীত প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে ভাগফল নির্ধারণ করা হতো। মিসরীয়রা জ্যামিতিরও বিকাশ ঘটায়। আধুনিককালেও প্রচলিত ৩.১৬ সংখ্যা এবং বৃত্তের ব্যাসার্ধের ৮/৯ বা আট নবমাংশকে বর্গ করে পাই (π) এর মান নির্ধারণ করেছিলেন মিসরীয়রা। উল্লেখ্য, মিসরীয়রা তাত্ত্বিক গণিতের বিকাশ ঘটাতে পারেননি। তাঁরা বাস্তব প্রয়োজনে হিসাব-নিকাশ, প্রকৌশল ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনার মতো প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গণিত ব্যবহার করতেন।

মিসরীয়দের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা

সমসাময়িক মেসোপটেমীয়দের তুলনায় প্রাচীন মিসরীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞানে কম মনোযোগ দিলেও তাঁরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। মিসরীয়রা অ্যাস্ট্রোল্যাবের মতো ‘মেরখেট’ নামের একটি যন্ত্রের সাহায্যে ঊর্ষা মেজর বা সপ্তর্ষিমণ্ডল এবং অরিয়ন বা কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করতেন। তাঁরা মেরখেটের সঙ্গে পামগাছের পাতার মাঝখানের শিরা বা তন্তু দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনির্দেশক যন্ত্র ব্যবহার করতেন। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ—এই চার দিক বরাবর পুরোনো আমলের পিরামিড ও সূর্যমন্দিরগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করেছিলেন প্রাচীন মিসরের গবেষকেরা।

মধ্য রাজবংশ (২০৫৫–১৬৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং পরবর্তী সময়ে (৬৬৪–৩৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) আকাশ পর্যবেক্ষণ কফিনে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন মিসরীয়রা। এসব নক্ষত্রচিত্রকে নক্ষত্রঘড়ি বা তির্যক ক্যালেন্ডার বলা হয়। কারণ, মিসরীয়রা পুরো রাতের আকাশের নক্ষত্রগুলোকে ৩৬টি লম্বে ভাগ করতেন, প্রতিটি লম্বে ৩৬ ধরনের নক্ষত্র থাকত। এটি সময় গণনা পদ্ধতি, যা থেকে রাতে কোন সময়ে কোন নক্ষত্র আকাশে উঠবে, তা বোঝা যেত। এটা ছিল মিসরীয়দের রাতের সময় পরিমাপের পদ্ধতি।

2

এসব নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিরিয়াস নামের নক্ষত্র, এটিকে মিসরীয়রা সোপদেত নামে চিনতেন। এটি ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং প্রতিবছরের জুলাই মাসে নীল নদের বার্ষিক প্লাবনের সময় এর দেখা মিলত। মধ্য রাজত্বকাল (২০৫৫–১৬৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পর্যন্ত মিসরীয় বিজ্ঞানীরা পাঁচটি গ্রহ চিহ্নিত করেন। বৃহস্পতি, মঙ্গল, বুধ, শনি ও শুক্র নামকরণ হয় এগুলোর।

প্রাচীন মিসরীয়দের প্রকৌশল দক্ষতা

প্রাচীন মিসরীয়রা তাঁদের প্রকৌশল দক্ষতা, কার্যক্রম এবং কাজের টেকসই ফলের কারণে বেশি পরিচিত। মিসরীয় প্রকৌশলবিদ্যার আলোচনা করতে গেলে ইমহোটেপের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি ছিলেন মিসরের প্রথম পরিচিত স্থপতি, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী। ইমহোটেপের কর্ম ও জীবন সম্পর্কে প্রাচীন মিসরীয় লিপিতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তিনি যে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৭-২৬৪৮ আমলের রাজা জোসারের ‘ভিজিয়ার’ বা প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, সেটুকু জানা যায়।

প্রাচীন রাজশাসনে ভিজিয়ারদের অনেক গুরুত্ব ছিল। কারণ, তাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজার প্রতিনিধি হিসেবে শাসন চালাতেন। ইমহোটেপকে জোসার অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে শুধু ভিজিয়ারই নিযুক্ত করেননি তিনি, পাশাপাশি নিজের এক স্থাপত্যে ইমহোটেপের নাম খোদাই করেন। কিছু জীবনীমূলক লেখা থেকে জানা যায়, ইমহোটেপের পূর্বপুরুষ স্থপতি ও প্রকৌশলী ছিলেন।

সেই উত্তরাধিকার তিনি ও তাঁর সন্তানেরাও চর্চা করেছেন। নির্দিষ্ট একটি পিরামিড নির্মাণে অবদানের কারণে মিসরীয় প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীর মধ্যে ইমহোটেপ সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। রাজা জোসার তাঁর একটি পিরামিড নকশার দায়িত্ব ইমহোটেপকে দিয়েছিলেন। প্রকৌশলী ইমহোটেপ রাজার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এমন এক নকশা উদ্ভাবন করেন, যা ছিল পিরামিড তৈরির একেবারে আদি ধাপ।

3

জোসারের আগে প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের রাজারা সমাহিত হতেন ‘মাস্তাবা’ নামের কবরে। মাস্তাবা ছিল আয়তাকার কাদামাটির তৈরি সমাধি, যার নিচে ছিল কবরকক্ষ। প্রথম দুটি রাজবংশের জন্য মাস্তাবা যথেষ্ট কার্যকর ছিল। কিন্তু রাজা জোসার আরও বিশাল, জাঁকজমকপূর্ণ ও চিরস্থায়ী কিছু একটা চেয়েছিলেন। মাস্তাবার নকশা পুরো বাদ না দিয়ে তাঁর ওপর ছোট আরেকটি মাস্তাবা বসিয়ে এটিকে আরও উন্নত করেন।

নির্মাণ শেষ হলে দেখা যায়, ওই নকশায় স্টেপ পিরামিডের ছয়টি ধাপ এবং নেক্রপলিসের ওপর ১৯৬ ফুট উচ্চতায় দণ্ডায়মান ছিল। স্থায়ী স্টেপ পিরামিড পাথরের তৈরি ও কাদামাটির মাস্তাবার চেয়ে অনেক বেশি টেকসই হওয়ায় এটি গুরুত্বপূর্ণ হয় ওঠে। ইমহোটেপের ধারণাকে আরও উন্নত করে চতুর্থ রাজবংশের সত্যিকারের পিরামিড নির্মাণ করা হয়। তবে ইমহোটেপের অনুপ্রেরণা ছাড়া তাঁদের এ কাজ কখনো সম্ভব হতো না।

ইমহোটেপ কেবল প্রকৌশলী বা স্থপতিই নন, চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল। ইমহোটেমের মৃত্যুর অনেক পরে (মধ্য রাজত্বকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় পর্যন্ত) মিসরীয় লিপিতে ইমহোটেপকে নিয়ে এমন দাবি করা হয়। সম্ভবত তাঁকে ‘র্সবশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী’ হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে পরে চিকিৎসা দক্ষতাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাচীন চিকিৎসাবিষয়ক পাণ্ডু লিপি ‘এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস’ ভিত্তি করে অনেক মিসরতত্ত্ববিদ মনে করেন, ইমহোটেপ সত্যিই একজন চিকিৎসক ছিলেন।

Untitled-4

প্রাচীন মিসরীয় চিকিৎসাবিদ্যা

এক ডজনের বেশি প্রাচীন চিকিৎসাসংক্রান্ত পাণ্ডুলিপি প্যাপিরাস থেকে প্রাচীন মিসরতত্ত্ববিদেরা প্রাচীন মিসরীয় চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস’। এডউইন স্মিথ নামের এক ব্যক্তি ১৮৬২ সালে পাণ্ডুলিপিটি কিনে নেন, তাঁরই নামে পাণ্ডুলিপির নামকরণ করা হয়। এই প্যাপিরাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো, প্রাচীন মিসরে জাদু ও চিকিৎসা গভীরভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু এতে কোনো জাদুবিদ্যার উল্লেখ নেই, যা প্রাচীন মিসরের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক; বরং এটি যৌক্তিকতানির্ভর এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা অনুসরণ করে।

এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস পাণ্ডুলিপিকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ১৫৫০ সালে নতুন রাজবংশের আমলের হিসেবে ধরা হয়। তবে অনেক মিসরতত্ত্ববিদ মনে করেন, এর শব্দভান্ডার ও ব্যাকরণ প্রমাণ করে, ‘এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস’ পুরাতন রাজবংশ যুগের কোনো গ্রন্থের ভিত্তিতে লেখা। সত্যি তাই হলে ইমহোটেপ হবেন এডউইন স্মিথ প্যাপিরাসের মূল লেখক।

যখন চিকিৎসাবিষয়ক সকল প্যাপিরাস একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়, তখন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরে রাখা দরকার। প্রথমত, এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস প্রাচীনতম আর লন্ডন ও লাইডেন প্যাপিরাস সর্বশেষ—যেগুলো ২৫০ খ্রিষ্টাব্দের। এটি গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, সে সময় মিসর প্রায় ৫০০ বছর ধরে প্রথমে গ্রিক ও পরে রোমানদের শাসনাধীনে ছিল। যাঁরা এই প্যাপিরাসগুলো লিখেছিলেন, তাঁরা নিশ্চয় গ্রিক-রোমান তত্ত্ব ও পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অনেক প্যাপিরাসই সাধারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে লেখা, আবার কিছু কিছু ছিল ‍বিশেষায়িত। যেমন ‘কাহুন প্যাপিরাস’ মূলত স্ত্রীরোগসংক্রান্ত চিকিৎসা (গাইনোকোলজিক্যাল মেডিসিন) নিয়ে লেখা, ‘ব্রুকলিন প্যাপিরাস’ সাপের দংশনসম্পর্কিত ও ‘লন্ডন প্যাপিরাস’ জাদুবিদ্যাবিষয়ক।

উল্লেখ্য, প্রাচীন মিসরের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিরা সাধারণত একাধিক ভূমিকা পালন করতেন। এসবের মধ্যে ধর্মীয় পুরোহিত হওয়া প্রায় সাধারণ ব্যাপার ছিল।

মমি তৈরির চর্চার কারণে সমসাময়িক মেসোপটেমীয়দের তুলনায় মানবদেহের গঠন সম্পর্কে মিসরীয়রা অনেক ভালো ধারণা রাখতেন। তাঁরা মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অনেক অঙ্গের নাম জানতেন। মমি তৈরির সময় তাঁরা ফুসফুস, যকৃৎ, পাকস্থলী, অন্ত্রসমূহ বের করে দেবতার মুখখচিত কাঠের তৈরি বয়ামে সংরক্ষণ করতেন। তবে হৃৎপিণ্ড ও কিডনি সাধারণত অক্ষত অবস্থায় রাখা হতো। একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে নাক দিয়ে মস্তিষ্ক বের করে ফেলা হতো। গবেষকদের ধারণা, সম্ভবত মিসরীয়রা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ভালো বুঝতেন না। মাথায় আঘাত লাগলে মানুষের যে মৃত্যু হতে পারে, শুধু এটুকু জানতেন।

5

প্রাচীন মিসরীয় ওষুধবিজ্ঞান

প্রাচীন মিসরে রোগের উৎস বা কারণ ও ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করার ধারণা বিকশিত ছিল না। তাই তাঁদের চিকিৎসাপদ্ধতিতে রোগের মূল কারণ নির্ণয় না করে বরং রোগের লক্ষণ চিকিৎসা করা হতো। খনিজ, প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ—এই তিনটি উৎসের একক বা মিলিত উপাদান দিয়ে তাঁরা চিকিৎসা করতেন। সাধারণত ন্যাট্রন নামের একটি খনিজ পদার্থ মমি তৈরির সময় শরীর শুকানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। সেই সঙ্গে ক্ষত থেকে পুঁজ বের করার জন্যও ব্যবহার করা হতো।

প্রাণিজ উপাদানগুলোর মধ্যে ছিল প্রস্রাব ও গোবর—এগুলো সাধারণত শরীরের বাইরের অংশে অর্থাৎ চামড়ায় ব্যবহার করা হতো। উদ্ভিজ্জ উপাদানের মধ্যে ছিল এমার নামে একধরনের প্রাচীন গম, হেম্প নামের এক জাতের গাঁজা ও রেড়ির তেল অর্থাৎ ভেন্নাগাছের বিচি থেকে তৈরি তেল—এই উপাদানগুলো সাধারণত মুখে খাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো। এসব ওষুধের কার্যকারিতা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ব্যথানাশক হিসেবে কার্যকর ছিল।

এবার্স প্যাপিরাসে শিশুদের কান্নার প্রতিষেধক হিসেবে সম্ভাব্য আফিমজাতীয় ওষুধের উল্লেখ আছে। তাতে বিশেষভাবে বলা আছে, ‘অতিরিক্ত কান্না থামানোর প্রতিষেধক’: শেপেন বা আফিম, দেয়ালের ওপর থাকা মাছির মল—এই উপাদানগুলোর মিশ্রণ তৈরি করে চার দিন খেতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে কান্না বন্ধ হয়ে যাবে।’

গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, প্রাচীন মিসরীয় ভাষায় আফিমগাছ বোঝাতে শেপেন শব্দটি ব্যবহৃত হতো। মিসরীয়রা আরও কিছু নেশাজাতীয় পদার্থ ব্যবহার করতেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল গাঁজা, যার মিসরীয় নাম ছিল‍ (শেমশেমেট)। এটি দড়ি তৈরিতে এবং সম্ভবত ব্যথা উপশমেও ব্যবহৃত হতো। সম্ভবত মিসরীয়রা ম্যানড্রেক—প্রাচীন ঔষধি গাছ, যার শিকড়ে ব্যথানাশক ও নেশাজাতীয় উপাদান থাকে এবং নিমফিয়া নামে নেশাজাতীয় জলজ উদ্ভিদ ব্যবহার করতেন।

6

চিকিৎসাপদ্ধতি

মিসরীয় চিকিৎসাপদ্ধতির অনেকাংশই ওষুধের নিয়মকানুনসহ প্যাপিরাস বা পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে। স্ত্রীরোগের চিকিৎসা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে লেখা আছে।

এসব লেখায় দেখা যায়, শরীর সম্পর্কে মিসরীয়দের জ্ঞান মোটামুটি উন্নতই ছিল। কিন্তু অনেক রোগেরই চিকিৎসা তাঁরা জানতেন না। যেমন ইবার্স প্যাপিরাসে নারীদের মাসিক বন্ধ হওয়া রোগ ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক ওষুধ বা চিকিৎসা কী হবে, তার উল্লেখ নেই।

সেখানে বলা হয়েছে, ‘অনেক বছর ধরে মাসিক বন্ধ থাকা নারীকে পরীক্ষার সময় যদি তিনি বিশেষ ধরনের বমি করেন এবং যদি তাঁর পেট আগুনের মতো জ্বলতে থাকে; কিন্তু বমির পর জ্বালাভাব কমে যায়। তখন জরায়ুতে রক্ত উঠেছে বলে ধরে নিতে হবে।’

চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে চার দিন ধরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন একটি তরল ওষুধ খেতে বলা হতো। যদিও এই ওষুধ খুব বেশি উপকারে আসত না, তারপরও লেখা থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন মিসরীয়দের মানবদেহ সম্পর্কে উন্নত জ্ঞান ছিল। মিসরীয়রা মানব দেহসম্পর্কিত জ্ঞান ব্যবহার করে অস্ত্রোপচারও করতেন।

চিকিৎসাবিষয়ক বেশির ভাগ মিসরীয় প্যাপিরাসে হাড় ভাঙার সচরাচর উল্লেখ আছে। পিরামিড, মন্দির বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির মতো খাটুনির কাজে থাকা পুরুষদের হাড় ভাঙার ঘটনা খুবই সাধারণ ছিল। তাই মিসরীয় চিকিৎসকদের হাড় ভাঙার চিকিৎসার অনেক সুযোগ হয়েছিল। এডউইন স্মিথ প্যাপিরাসে সাধারণ হাড় ভাঙা কীভাবে জোড়া লাগানো যাবে, তার নানা পদ্ধতির বর্ণনা দেওয়া আছে।

কাঁধের হাড় ভাঙলে কীভাবে তার চিকিৎসা করতে হবে, তার একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, ‘পিঠের ওপর চিত করে শোয়াতে হবে, দুই কাঁধের মাঝখানে ভাঁজ করা কাপড় রাখতে হবে। এরপর দুই কাঁধ ছড়িয়ে দিতে হবে, দুই কাঁধ টান টান রাখতে হবে; যাতে ভাঙা হাড়টি নিজের জায়গায় চলে আসে। এরপর লিনেন কাপড় দিয়ে স্প্লিন্ট বানাতে হবে, একটি রাখতে হবে বাহুর ওপরের অংশের ভেতরের দিকে, আরেকটি নিচের দিকে। তারপর এটি কাপড় দিয়ে বেঁধে দিতে হবে এবং প্রতিদিন মধু দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে পুরো সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।’

প্রাচীন মিসরীয় চিকিৎসাবিষয়ক প্যাপিরাসে ওপরের বিষয়গুলো ছাড়াও পশুর কামড় ও প্রাণীর দংশন এবং দাঁতের চিকিৎসার কথা উল্লেখ আছে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য কিছুটা কম পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো যন্ত্র পাওয়া যায়নি, যা বিশেষভাবে অস্ত্রোপচার বা অন্যান্য চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে বলে শনাক্ত করা যায়। মিসরীয় বিজ্ঞান ছিল বহুমুখী, বেশ কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক। প্রাচীন মিসরীয়রা তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ না করলেও তাঁদের সৃষ্ট জ্ঞান প্রয়োজন মেটাত—হোক সেটা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশল কিংবা চিকিৎসা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

২০২৫ সালে যেসব ঐতিহাসিক রহস্যের সমাধান দিল বিজ্ঞান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ডেনমার্কে সংরক্ষিত ২ হাজার বছর আগের হিয়র্টস্প্রিং নৌকা। ছবি: সংগৃহীত
ডেনমার্কে সংরক্ষিত ২ হাজার বছর আগের হিয়র্টস্প্রিং নৌকা। ছবি: সংগৃহীত

দশকের পর দশক কিংবা শতাব্দীকাল ধরে মানবসভ্যতার নানা অধ্যায়ে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বিশ্বজুড়ে এ বছর গবেষকেরা যেন গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব, জেনেটিক বিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ২০২৫ সালে উন্মোচিত হয়েছে বহু ঐতিহাসিক রহস্য।

মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বিদায়ী এই বছরটিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইস্টার আইল্যান্ডের একটি খনিতে পড়ে থাকা অসমাপ্ত পাথরের মূর্তিগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জানতে পেরেছেন, প্রাচীন পলিনেশীয়রা কীভাবে পাহাড় কেটে ধাপে ধাপে বিশাল মোয়াই মূর্তি তৈরি করত।

এদিকে, ইতালির পম্পেই নগরীতে নতুন করে খননকাজ শুরু হওয়ার পর একটি পাথরের সিঁড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হওয়ার আগে শহরটি দেখতে কেমন ছিল তা জানতে সহায়তা করেছে।

পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫ হাজার ২০০টি গর্ত নিয়েও নতুন ধারণা দিয়েছেন গবেষকেরা। এই গর্তগুলোর নির্মাতা কারা এবং কেন এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল—ড্রোন ফুটেজ ও উদ্ভিদকণা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।

কিছু গবেষণা আবার নতুন প্রশ্নও উসকে দিয়েছে। যেমন—চিকিৎসা নথি না থাকায় বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জেন অস্টেনের মৃত্যুর কারণ জানতে গবেষকেরা তাঁর লেখার ভাষা ও শব্দচয়ন বিশ্লেষণ করছেন।

রহস্যময় এই মমিটির পরিচয় উদ্ঘাটন হয়েছে। ছবি: সিএনএন
রহস্যময় এই মমিটির পরিচয় উদ্ঘাটন হয়েছে। ছবি: সিএনএন

এ বছর ঐতিহাসিক বিষয়ে আলোচিত আবিষ্কারগুলোর একটি হলো, অস্ট্রিয়ার প্রত্যন্ত গির্জায় সংরক্ষিত রহস্যময় একটি মমি। ১৭০০ সাল থেকে ‘বাতাসে শুকানো যাজক’ নামে পরিচিত এই দেহটির পরিচয় দীর্ঘদিন অজানা ছিল। আধুনিক স্ক্যান ও রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা গেছে, তিনি ছিলেন ফ্রাঞ্জ জাভের সিডলার ফন রোজেনেগ নামে একজন অভিজাত ব্যক্তি। পরবর্তীতে তিনি গির্জার যাজক হয়েছিলেন। গবেষকেরা তাঁর দেহ সংরক্ষণের এক অজানা পদ্ধতি ও মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণও চিহ্নিত করেছেন।

এদিকে ডেনমার্কে সংরক্ষিত হিয়র্টস্প্রিং নৌকাটির উৎস নিয়েও রহস্যের পর্দা উঠেছে। ২০০০ বছরেরও বেশি সময় আগের এই নৌকাটি অস্ত্রে ভরা ছিল, যা ইঙ্গিত দেয় এটি দ্বীপে আক্রমণ করার উদ্দেশে যোদ্ধাদের বহন করছিল। বিশ্লেষণে একটি আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এটিকে তৎকালীন কোনো নাবিকের সরাসরি প্রমাণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রমাণ মিলেছে—অভিযাত্রী আর্নেস্ট শ্যাকলটনের জাহাজ এইচএমএস অ্যান্ডিউরেন্স ভাঙা স্টিয়ারিং নয়, বরং কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই ডুবে গিয়েছিল।

১৪ হাজার বছর আগের এই দুটি প্রাণীকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। ছবি: সিএনএন
১৪ হাজার বছর আগের এই দুটি প্রাণীকে ভুলভাবে শনাক্ত করা হয়েছিল। ছবি: সিএনএন

১৪ হাজার বছর আগে বরফ যুগের ‘টুমাট পাপিজ’ নামে পরিচিত দুটি সংরক্ষিত শাবককে এত দিন গৃহপালিত কুকুর মনে করা হলেও নতুন জেনেটিক গবেষণায় জানা গেছে, এগুলো আসলে নেকড়ে শাবক ছিল এবং মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

এ ছাড়া ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান নিয়েও নতুন তথ্য মিলেছে। সেই সময়ে নিহত ফরাসি সেনাদের দাঁতের নমুনা বিশ্লেষণ করে টাইফাসের পাশাপাশি প্যারাটাইফয়েড ও রিল্যাপসিং ফিভারের জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা ওই বাহিনীর বিপুল প্রাণহানির অন্যতম কারণ হতে পারে।

সব মিলিয়ে, ২০২৫ সাল বিজ্ঞানের হাত ধরে ইতিহাসের বহু অন্ধকার কোণ আলোকিত করেছে এবং আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে মানবসভ্যতার দীর্ঘ ও জটিল পথচলা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কক্ষপথে স্যাটেলাইট সংঘর্ষের ঝুঁকি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ‘ক্র্যাশ ক্লক’ সতর্কতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট
ছবি: নিও সায়েন্টিস্ট

কোনো বড় ধরনের সৌরঝড় বা প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের কারণে যদি পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলো হঠাৎ নিজেদের গতিপথ পরিবর্তনের সক্ষমতা হারায়, তবে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এক গবেষণা বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব স্যাটেলাইট একযোগে অচল হয়ে পড়লে প্রথম সংঘর্ষ ঘটতে সময় লাগবে গড়ে মাত্র ২.৮ দিন।

গত সাত বছরে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইটের সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রায় ৪ হাজার স্যাটেলাইট ছিল, এখন সেই সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজারে পৌঁছেছে। এই বিস্ফোরণধর্মী বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্প। নিম্ন-পৃথিবী কক্ষপথে (৩৪০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়) বর্তমানে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটই রয়েছে ৯ হাজারের বেশি।

কক্ষপথে এত বেশি স্যাটেলাইট থাকার কারণে নিয়মিত সংঘর্ষ এড়াতে ‘কলিশন অ্যাভয়ডেন্স ম্যানুভার’ বা গতিপথ পরিবর্তনের কৌশল নিতে হয়। স্পেসএক্স জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে তারা ১ লাখ ৪৪ হাজারেরও বেশি সংঘর্ষ এড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করেছে।

গত মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে নিও সায়েন্টিস্ট জানিয়েছে, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা থিয়েল ও তাঁর সহকর্মীরা স্যাটেলাইটের অবস্থানসংক্রান্ত উন্মুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সংঘর্ষ ঝুঁকি পরিমাপের জন্য নতুন একটি সূচক তৈরি করেছেন। এই সূচকের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্র্যাশ ক্লক’।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে যদি সব স্যাটেলাইট হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারাত, তবে প্রথম সংঘর্ষ হতে সময় লাগত প্রায় ১২১ দিন। কিন্তু বর্তমানে সেই সময় নেমে এসেছে মাত্র ২.৮ দিনে। এই তথ্য বিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করেছে।

সব স্যাটেলাইট একসঙ্গে অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম হলেও ২০২৪ সালের মে মাসে শক্তিশালী সৌরঝড়ে স্টারলিংক স্যাটেলাইটগুলোতে অস্বাভাবিক ঢেউয়ের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী সৌরঝড় হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—আগামী বছরগুলোতে স্পেসএক্স, অ্যামাজন ও চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও হাজার হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। ফলে কক্ষপথে ভিড় আরও বাড়বে, আর ‘ক্র্যাশ ক্লক’-এর সময়সীমা আরও এগিয়ে আসবে। এই পরিস্থিতি মহাকাশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইতালির পার্কে মিলল ২১ কোটি বছর আগের হাজার হাজার ডাইনোসরের পায়ের ছাপ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪৫
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি
একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো এক আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে। ছবি: বিবিসি

উত্তর ইতালির একটি ন্যাশনাল পার্কে ২১ কোটি বছর আগের ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। তাও আবার একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার। এই পায়ের ছাপগুলোর কয়েকটির ব্যাস ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত। আর এগুলো সমান্তরাল সারিতে সাজানো। এসবের মধ্যে অনেকগুলোতে আঙুল ও নখের ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই ডাইনোসরগুলো ছিল ‘প্রোসাওরোপড’ (prosauropod) প্রজাতির। এ প্রজাতির ডাইনোসরের গলা লম্বা ও মাথা ছোট এবং ধারালো নখবিশিষ্ট তৃণভোজী প্রাণী ছিল।

মিলানভিত্তিক জীবাশ্মবিদ ক্রিস্টিয়ানো ডাল সাসো বলেন, ‘কখনো কল্পনাও করিনি, আমি যে অঞ্চলে বাস করি, সেখানেই এমন এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দেখা পাব।’

গত সেপ্টেম্বরে মিলানের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কের একটি খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই পায়ের ছাপগুলো একজন আলোকচিত্রীর চোখে ধরা পড়ে।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে ট্রায়াসিক যুগে এই পাহাড়ের অংশটি ছিল একটি সমুদ্র তীরবর্তী সমতল ভূমি, যা পরে আল্পাইন পর্বতমালায় রূপান্তরিত হয়।

ডাল সাসো আরও বলেন, এই জায়গা ডাইনোসরে পরিপূর্ণ ছিল; এটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক সম্পদ।

ডাল সাসো আরও যোগ করেন, ডাইনোসরের দলগুলো সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করত এবং সেখানে আরও কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলো থেকে মনে হয়, পশুরা আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে দলবদ্ধ হয়ে বৃত্তাকারে অবস্থান নিত।

আবিষ্কারকেরা বলছেন, প্রোসাওরোপডগুলো ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারত। তারা সাধারণত দুই পায়ে হাঁটত, তবে কিছু ক্ষেত্রে পায়ের ছাপের সামনে হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তারা সম্ভবত মাঝেমধ্যে থেমে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাদের সামনের পা মাটিতে রাখত।

আলোকচিত্রী এলিয়ো ডেলা ফেরেরা এই স্থান আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই আবিষ্কার আমাদের সবার মধ্যে ভাবনার খোরাক জোগাবে এবং আমরা যেখানে বাস করি, আমাদের ঘর, আমাদের পৃথিবী, এই জায়গাগুলো সম্পর্কে আমরা কতটা কম জানি, তা বোঝায়।’

ইতালির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম এবং যাতায়াতের কোনো পথ নেই। তাই গবেষণার কাজে ড্রোনের পাশাপাশি রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

উল্লেখ্য, আগামী বছর ইতালিতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর ডাইনোসরের পায়ের ছাপ পাওয়া স্টেলভিও ন্যাশনাল পার্কটি সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ইতালির সীমান্তবর্তী ফ্রায়েল উপত্যকায় অবস্থিত। মন্ত্রণালয় জানায়, এটি যেন অনেকটা এমন যে, স্বয়ং ইতিহাসই বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ক্রীড়া ইভেন্টকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে; প্রকৃতি ও ক্রীড়ার মধ্যে এক প্রতীকী সেতুবন্ধনের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় গেঁথেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জোট বেঁধে শিকার ধরতে ছুটছে কিলার হোয়েল ও ডলফিন, বিস্মিত বিজ্ঞানীরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৪০
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন। ছবি: ইউবিসি
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন। ছবি: ইউবিসি

ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে একদিন। স্যামন মাছের ঝাঁক পড়িমড়ি করে ছুটতে দেখা গেল। তাদের পিছেই চোখে পড়ল কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিনের দলকে। তাও আবার একসঙ্গে! এই দুই শিকারী প্রাণীকে জোটবেঁধে স্যামন শিকারে ছুটতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। শিকার একই হওয়ায় দুই শিকারী জোট বেঁধেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

এ নিয়ে একটি গবেষণাও প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এই দুই শিকারি প্রাণীর মধ্যে হয়তো একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

গবেষকেরা বলছেন, ‘কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া উপকূলে প্যাসিফিক হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন ও নর্দার্ন রেসিডেন্ট কিলার হোয়েলের মধ্যে এ ধরনের একটি রহস্যজনক সম্পর্ক দেখা যায়, যেখানে এই দুই সিটাসিয়ান প্রজাতিকে প্রায়ই একে অপরের কয়েক মিটারের মধ্যেই দেখা যায়।’

ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লাইবনিজ ইনস্টিটিউট ও হাকাই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করা বিজ্ঞানীরা ড্রোন ভিডিও ও শব্দগত রেকর্ডিং সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে জানান, এই প্রথম অরকা ও ডলফিনের এভাবে খাদ্য চাহিদা পূরণে যৌথভাবে কাজ করতে দেখা গেল।

গবেষণার প্রধান লেখক সারা ফরচুন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘স্যামন শিকারের পারদর্শিতায় শীর্ষস্থানে রয়েছে এই তিমিগুলো। তারা অত্যন্ত দক্ষ ও বিশেষায়িত শিকারি। মনে হচ্ছিল ডলফিনগুলো তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অরকাদের এভাবে ডলফিনের অনুসরণ করতে দেখা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত আর ভীষণ রোমাঞ্চকর।’

দুই শিকারির মধ্যে সদ্য গড়ে ওঠা এই সম্পর্কের কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। একটি সম্ভাবনা হলো ক্লেপ্টোপ্যারাসিটিজম, যেখানে ডলফিনেরা অরকার শিকার ছিনিয়ে নিতে পারে।

আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, ডলফিনেরা স্তন্যপায়ীভোজী ট্রানসিয়েন্ট কিলার হোয়েল এবং কিছুটা কম মাত্রায় বড় হাঙরের হাত থেকে সুরক্ষা পেতে এই সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

তবে সারা ফরচুনের মতে, যদি ডলফিনেরা পরজীবীর মতো আচরণ করত, তাহলে সদ্য ধরা শিকার নিয়ে সাধারণত অত্যন্ত রক্ষণশীল কিলার হোয়েলেরা এতটা শান্ত থাকত না, যেমনটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। এতে গবেষকদের সামনে সবচেয়ে জোরালো ব্যাখ্যাটি উঠে এসেছে, এই দুই শিকারি আসলে পরস্পরকে সহযোগিতা করছে।

সারা ফরচুন আরও বলেন, ‘অরকাগুলো নিজেদের অবস্থান এমনভাবে নিচ্ছিল, যেন তারা ডলফিনদের অনুসরণ করছে। ফলে ডলফিনদেরই নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছিল। বিষয়টি আমাদের আরও গভীরভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে এবং আসলে কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করতে আগ্রহী করে তোলে।’

এই সহযোগিতা নিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে, কারণ নর্দার্ন রেসিডেন্ট অরকারা মূলত স্যামন শিকারে বিশেষজ্ঞ আর হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন সাধারণত হেরিং ও অ্যাঙ্কোভির মতো ছোট মাছ খেয়ে থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১১৯ আসনে প্রার্থী ঘোষণা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের, মনোনয়ন পেলেন যাঁরা

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২-এর বেশি বহাল থাকছে যেসব প্রতিষ্ঠানে

দিল্লিতে ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের, উত্তেজনা

জমিয়তে উলামাকে যে ৪টি আসন ছেড়ে দিল বিএনপি

দিল্লির পর কলকাতায় ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে প্রবেশের চেষ্টা

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত