Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /এনসিপি: নানা সংকটেও নতুন কিছু করার প্রত্যয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ৩৫
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের শাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর চলতি বছর যখন ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার ঘোষণা দেন, তখন তাঁদের পরিকল্পনা শুনতে বাংলাদেশের হাজারো মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু এখন দলটি তাদের মাঠের ক্ষমতাকে ভোটে রূপান্তরিত করতে হিমশিম খাচ্ছে।

বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে চলে আসা ‘স্বজনপ্রীতি এবং দুই দলের আধিপত্য’ থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে লড়াই করছে ছাত্র নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দলটিকে বিশাল নেটওয়ার্ক ও ব্যাপক সম্পদশালী শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

এনসিপির প্রধান (আহ্বায়ক) নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংগঠন দুর্বল। কারণ, গড়ে তোলার জন্য আমরা যথেষ্ট সময় পাইনি।’ নাহিদ ইসলাম গত বছর রক্তক্ষয়ী সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পরিচিত মুখ এবং নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্বও পালন করেছেন।

২৭ বছর বয়সী নাহিদ রাজধানী ঢাকার একটি সুউচ্চ ভবনে দলীয় কার্যালয়ে বসে এসব কথা বলেন। সেই কার্যালয়ের দেয়ালজুড়ে ছিল জনতার বিদ্রোহের গ্রাফিতি। তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা এটা সম্পর্কে অবগত, তবুও আমরা এই চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি।’

জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাওয়া এনসিপির সমর্থন মাত্র ৬ শতাংশ, যা তাদের জনসমর্থনের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৩০ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছে। এমনকি ইসলামপন্থী জামায়াতে ইসলামীও এনসিপির চেয়ে ভালো করবে বলে বলছে জরিপ। ডিসেম্বরে ইউএস-ভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, জামায়াত ২৬ শতাংশ সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে।

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ২৫ বছর বয়সী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, ‘যখন তারা প্রথম শুরু করেছিল, তখন আমি সবার মতোই তাদের মধ্যে আশা দেখেছিলাম।’ তিনি কয়েক দশকের প্রধান দুই দলের শাসনের অবসান ঘটাতে এই নবাগত দলটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন বলছেন তিনি হতাশ হয়েছেন। এই নারীবাদী কর্মী আরও যোগ করেন, ‘তারা নিজেদের মধ্যপন্থী বললেও তাদের কাজের সঙ্গে তার মিল নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন সংখ্যালঘু অধিকার বা নারীর অধিকার, এই সব বিষয়ে তারা অবস্থান নিতে দ্বিধা করে। আর যখন নেয়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।’

অসন্তোষ বাড়ার আরেকটি লক্ষণ হলো, সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দলটির একটিও আসনে জিততে না পারা। উল্লেখ্য, এই বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল সেই বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু, যা হাসিনাকে নয়াদিল্লিতে পালাতে বাধ্য করেছিল।

এনসিপির নেতারা বলছেন, দুর্বল কাঠামো, তহবিলের অভাব এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের মতো প্রধান বিষয়গুলোতে অস্পষ্ট অবস্থানের কারণে এনসিপি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা রয়টার্সকে ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘যদি আমরা এককভাবে দাঁড়াই, তবে একটি আসনও না জেতার আশঙ্কা রয়েছে।’

অন্যদিকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, জোট করলে দলটির ‘বিপ্লবী’ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকাভিত্তিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘যদি তারা জোট করে, তবে জনগণ তাদের আর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরের একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দেখবে না।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং এনসিপির আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিদ্রোহটি দল-মতনির্বিশেষে ছাত্রদের সাময়িকভাবে ঐক্যবদ্ধ করলেও বেশির ভাগই পরে নিজ নিজ গ্রুপে ফিরে যায়, ফলে এনসিপি গঠনের জন্য মাত্র একটি ছোট অংশ অবশিষ্ট থাকে। এখন দলটি দীর্ঘদিনের সুপ্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক ও সুসংগঠিত সম্পদ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোমুখি।

নাহিদ ইসলাম বলেন, দলকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় বাধা—অর্থ। দলের কর্মী-সদস্যদের পূর্ণকালীন চাকরি থেকে পাওয়া বেতন, ছোট অনুদান এবং গণতহবিল সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে তাদের প্রচারণা চালু রাখছে দলটি।

আবার অনেকে দলের ২৮ বছর বয়সী হাসনাত আবদুল্লাহর মতো গ্রামে গ্রামে গিয়ে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। তিনি যে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছেন, সে প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় আমি লোকজনকে বলি যে আমার পকেটে কোনো টাকা নেই। আমি তাঁদের বলেছি, একজন নেতার প্রধান কাজ ভোটারদের টাকা দেওয়া নয়, বরং সরকারি তহবিল যেন সঠিকভাবে বরাদ্দ ও ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করা।’

তবে কিছু এনসিপি নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, যা দলটি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নিজেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল নীতিতে বিশ্বাসী বলে দাবি করেছে, তাদের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবু কিছু তরুণ এখনো এই দলটিকে সমর্থনে আগ্রহী। তাঁরা দলটিকে টাকা, পেশিশক্তি ও পরিবারতান্ত্রিক ক্ষমতার দ্বারা গঠিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি আরও সমতাবাদী সংস্কৃতির জন্য সংগ্রাম হিসেবে দেখছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী এবং এনসিপির এমন একজন সমর্থক মঞ্জিলা রহমান। তিনি বলেন, ‘তারা তরুণ, তারা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং আমি আশাবাদী যে তারা পরিবর্তন আনতে পারবে—যদি না তারা নিজেরাই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে।’

এনসিপি গত নভেম্বরে প্রার্থী অনুসন্ধানে এক ভিন্ন পথে হেঁটেছিল। সে সময় তারা দুদিন ধরে দেশজুড়ে ১ হাজার জনের বেশি সাধারণ নাগরিক আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার নেয়। তরুণ দলীয় নেতারা বুথ থেকে বুথে ঘুরে প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেন। এই প্রত্যাশীদের মধ্যে ছিলেন এক রিকশাচালকও। তিনি এই পরীক্ষার জন্য একদিন তাঁর কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। এ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আংশিকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারানো ২৩ বছর বয়সী এক ছাত্রও এই পরীক্ষায় অংশ নেন।

৩২ বছর বয়সী মোহাম্মদ সুজন খান বলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারেন যে, একজন রিকশাচালকের সংসদে দেওয়ার মতো কিছু নেই। আমাকে একটি সুযোগ দিন এবং দেখুন আমি দেশ পরিবর্তন করতে কী করি।’

এ ধরনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এনসিপি নেত্রী ডা. তাসনিম জারাকে আকৃষ্ট করে। তিনি কেমব্রিজে তাঁর সফল কর্মজীবন ছেড়ে এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন, যাতে শুরু থেকেই এটি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতিকে ক্ষমতাবান পরিবারগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে চাই এবং সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চাই।’

বিএনপি ও জামায়াত নেতারাও ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গুরুত্ব দেখছেন। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ভবিষ্যতে তরুণেরাই রাজনীতিতে আধিপত্য করবে, তাই আমরা যদি তাদের সংসদে জায়গা দিতে পারি, তবে তা ভালো হবে।’

এনসিপি নেতারা বলছেন যে তারা কেবল আসন্ন ভোট নিয়ে নয়, দীর্ঘ মেয়াদে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের কথা ভাবছেন। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘জিতি বা হারি, শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই আমরা নতুন কিছু আনার প্রস্তাব করছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

লন্ডনে চিকিৎসা যাত্রায় খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী ১৪ জন, তালিকায় ছয় চিকিৎসক ও দুই এসএসএফ

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

ঢাকার তিনটিসহ আরও ২৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা বাকি থাকল

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ