বিভুরঞ্জন সরকার

১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরই ডাকসু বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে প্যানেল দিয়ে অংশ নিয়েও জয়লাভ করতে পারেনি। অথচ এক বছর আগে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। বাহাত্তরের ডাকসু নির্বাচনে জয়ের পর ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমছিল, আর বাড়ছিল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের। স্বাধীন দেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের যে ডাক ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি বা বলা যায়, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়ে চলাটা ছাত্ররা ভালোভাবে নেয়নি। বরং ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগের সরকার তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী গরম গরম বক্তব্য সাধারণ ছাত্রদের বেশি আকর্ষণ করতে থাকে। রোমান্টিকতা তারুণ্যের ধর্ম- এটা অস্বীকার করা যায় না।
একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমাদের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সলিমুল্লাহ খান। তিনি বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ভালো ছাত্র এবং জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সলিমুল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলাভবনে চক্কর দিতেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর স্বাধীন ও ভিন্ন চিন্তার জন্য তখন অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে ‘হিরো’ ছিলেন। ছফা ভাই সলিমুল্লাহ খানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন ‘সলিমুল্লাহর মতো মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনো আসেনি’। সলিমুল্লাহর কারণেও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জাসদ ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকতো বলে আমার ধারণা।
একসময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রগতিশীল ধারার প্রতি আকর্ষণ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের নামে আরও একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করার পর মেধাবীদের একটি অংশ ওদিকে চলে যায়, ছাত্র ইউনিয়নে কিছুটা মেধার সংকট দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি গুলিতে দুই কর্মীর মৃত্যু ও কয়েকজন আহত হওয়ার পর ছাত্র ইউনিয়ন আকস্মিকভাবে জ্বলে ওঠলেও আবার দপ করে নিভে যায়। এটা অনেকের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের ‘আত্মসমর্পণ’ বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পাল্টা হামলা মোকাবিলায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব ‘সিপিবির পরামর্শে’ ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে বলে, এমনকি, ছাত্র ইউনিয়নের অনেক কর্মী ও সাধারণ সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেছে। যেভাবে ও যেসব যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটাও সাধারণ ছাত্ররা পছন্দ করেনি। স্বাধীনতার পর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজে হাত দিলেও কিছু মহলের ক্রমাগত অপপ্রচার বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কেও ভুল ধারণা তৈরি করতে থাকে। তাঁর অতি উদার মানবিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো অবাধে ষড়যন্ত্র-নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের একটি অংশও এমন সব কাজে জড়াতে থাকেন, যেটা মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করতে থাকে। নবসৃষ্ট জাসদ নেতৃত্ব এবং প্রবীণ নেতা মওলানা ভাসানীসহ আরও নানা শক্তির কঠোর মুজিববিরোধী ও ভারতবিরোধী রাজনীতি দেশের ভেতর একটি গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তোলে।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর, থানা-ফাঁড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশার শিকার তরুণদের একাংশ বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হয়। সুযোগ নেয় রাজাকার আলবদর আলশামসের সদস্যরাও।
এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সারাদিন ভোট গ্রহণ হয়। ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ উল আলম লেনিন এবং জিএস পদে ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। সংক্ষেপে বলা হতো লেনিন-গামা পরিষদ। অন্যদিকে ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ। ভিপি পদে আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জিএস পদে জহুর হোসেন।
নির্বাচনী প্রচার দেখে মনে হয়েছিল, লেনিন-গামা পরিষদের বিজয় ঠেকায় কে! কিন্তু আসলে তা হয়নি। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী- সমর্থকেরা খুব ভালোভাবে নেয়নি বলেই আমার ধারণা। হয়তো বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির পছন্দের বাইরে হতো না, তাই ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের মনোভাবের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে যৌথ প্যানেলে নির্বাচনে গিয়েছিল। এতে ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রশংসিত হয়নি। আবার ছাত্রলীগের মধ্যেও ছাত্র ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল। ফলে বাইরে বাইরে যৌথ প্যানেল নিয়ে যেরকম রমরমা ভাব ছিল, ভেতরে ভেতরে তেমন ছিল না।
অন্য হলের কথা আমি ভালো জানি না, কিন্তু জগন্নাথ হলে আমি ঐক্যবিরোধী মনোভাবই প্রবল দেখেছি। যৌথ প্যানেলের পক্ষে কর্মীদের বোঝানোর জন্য একাধিক মিটিং জগন্নাথ হলে হয়েছে। তার একটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও উপস্থিত ছিলেন। আমি ওই সভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখিছি, সেলিম ভাইয়ের মতো তুখোড় নেতা, যিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় ছিলেন অতুলনীয়, তাঁকেও সাধারণ কর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না মেনে উপায় নেই বলেই যৌথ প্যানেল হয়েছিল কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এটা মেনে নেননি। জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন শক্তি ছিল মজবুত। এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া অন্য সংগঠন থাকলেও সদস্য-সমর্থক বেশি ছিল না। একক নির্বাচন করলেও এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয় ছিল নিশ্চিত। এই অবস্থায় ছাত্রলীগকে আসন ছেড়ে দিতে আপত্তি ছিল সঙ্গত।
সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এমন মনোভাব কেন তৈরি হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা না করাটি ছিল তখন একটি বড় ভুল। দেশে তখন দ্রুত এমন সব ঘটনা ঘটছিল যা ছিল অপ্রত্যাশিত। উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণের কারণে ছাত্রলীগের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিরোধ ছিল, গ্রুপিং ছিল। স্বাধীনতার পর শফিউল আলম প্রধানকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। শফিউল আলম প্রধানের বাবা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা। তিনি শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্পিকার ছিলেন।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই পর্যায়ে হঠাৎ মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প সময় পরই আমিও বাংলা বিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি যে এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম তা নয়। কারণ যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমার ভয় ছোটবেলা থেকেই। আমি স্কুলে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। বিস্কুট দৌড় নামে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। আমি এই ভেবে অংশ নিয়েছিলাম যে পুরস্কার না পেলেও দড়িতে ঝোলানো একটি বিস্কুট অন্তত মুখে পুড়তে পারব! অবশ্য ওই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগী কম থাকায় একটি পুরস্কার আমিও পেয়েছিলাম। তিনজনের মধ্যে আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। এমন বিপুল সাফল্যের পর প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলতাম কোনো না কোনো অজুহাত তুলে। পরে অবশ্য বাঙালির তিন হাতের কথা জেনেছি। ডান হাত, বাম হাতের চেয়েও আমাদের শক্তিশালী তৃতীয় হাতটির নাম অজুহাত।
বাংলা বিভাগের নির্বাচনে আমাকে কেন প্রার্থী করা হলো তার কারণ আমি জানি না। হয়তো মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকা এবং ততদিনে ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’র কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই এর কারণ ছিল। আমি মনে করি, আমার চেয়ে যোগ্যপ্রার্থী ছিল জুলিয়াস, খোন্দকার শওকত হোসেন। সে ঢাকায় লেখাপড়া করেছে। জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তাছাড়া ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের কাজের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। আমি মফস্বল থেকে আসা একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। পোশাকেরও তেমন ছিরিছাঁদ ছিল না। মনোনয়নপত্র জমা দিলাম প্রচার সম্পাদক পদে।
মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আমার ভয় দূর না হয়ে গেল বহুগুণে বেড়ে। হেরে গেলে তো লজ্জার ব্যাপার। আবার এটাও মনে হলো, কোথায় যেন শুনেছি, জয়ের চেয়ে নাকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দই বেশি।
আনন্দের খবর পেতে অবশ্য আমাকে ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জানা গেল আমি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় আমার বিজয় নিশ্চিত হয়।
আমরা অবশ্য বিভিন্ন বর্ষের ক্লাসে গিয়ে প্যানেলের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছি। ভিপি পদে আমাদের প্রার্থীর নাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে জিএস প্রার্থী ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তার বাড়িও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে। মিজান ভাই দেখতে সুদর্শন ছিলেন। হাঁটতেন একটু খুড়িয়ে। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে তিনি যখন করিডোরে হাঁটতেন, তখন তাকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতোই লাগতো। নামে যেমন মিল, দেখতেও যেন কিছুটা মিল ছিল।
মিজান ভাই ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। তার কথায় মুগ্ধ হওয়ার অনেক উপাদান থাকতো। ক্লাসে ক্লাসে তিনি যখন ভোট চেয়ে বক্তৃতা করতেন তখন সবাই মনোযোগ দিয়েই শুনতেন। ফলে তিনি যে ভোটে জিতবেন- এটা আমি বুঝতে পারছিলাম। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএসসহ কয়েকজন এবং ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপিসহ কয়েকজন জেতেন। একটি ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে।
তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড. নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একই সঙ্গে রোকেয়া হলের প্রভোস্টও ছিলেন। আমাদের সংসদের প্রথম মিটিংয়ে ঘটলো এক মজার ঘটনা। সভা শুরু হওয়ার আগে প্রথমেই কথা বললেন জিএস মিজান ভাই। তিনি শুরু করলেন এভাবে: আমাদের সভা শুরু হলো। আজকের সভায় সভাপতিত্ব করছি আমি মিজানুর রহমান চৌধুরী।
ছাত্রলীগের থেকে নির্বাচিত ভিপি (নাম মনে নেই) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? আমি ভিপি, সভায় সভাপতিত্ব করব আমি। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত অন্যরাও বললেন, জিএস নয়, সভাপতিত্ব করবেন ভিপি।
মিজান ভাই এক অদ্ভুত যুক্তি হাজির করলেন। বললেন, দেশে এখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি নেই। এখন প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারপ্রধান। কখনো শুনেছেন, এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন? এখন মন্ত্রিসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখানে আমাদের এই সংসদেও ভিপি নন, জিএসই সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিতরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়েই বোধহয় মিজান ভাইয়ের প্রস্তাব মেনে নেন।
মিজান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কিন্তু বাংলা বিভাগের জন্য একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমার মনে আছে, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আমরা প্রচুর বই সৌজন্য হিসেবে এনেছিলাম। বিভাগীয় প্রধান নীলিমা আপা ছাত্রলীগের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হলেও আমাদেরও তিনি অসহযোগিতা করেননি।
মিজান ভাইয়ের ক্যারিশমার কারণে পরের বছর বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের পুরো প্যানেল জয়লাভ করেছিল। সেবার ভিপি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জিএস হয়েছিলেন উম্মে তুকা মোকাদ্দেসা আপা, পুরো নাম এখন পড়ছে না।
মিজান ভাই পরে বিটিভিতে অভিনয় করেছেন, বিটিভির জন্য একাধিক নাটকও লিখেছেন। তার লেখা একটি নাটক একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শেষ দিকে মিজান ভাই ঢাকা থেকে বীরগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। বীরগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন বেশ কয়েক বছর।
ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরি নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। প্রতিটি হলে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। অধিকাংশ ভোটারের বুকে ঝুলছিল লেনিন-গামা পরিষদের ব্যাজ, মাহবুব-জহুর পরিষদের ব্যাজও ছিল, তবে তুলনামূলক কম। যৌথ প্যানেলের নেতা-কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে চরকির মতো ঘুরছিলেন। আমি শুরুতে লেনিন-গামা পরিষদের বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান থাকলেও শেষদিকে মনে হচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এই প্যানেলই জিতবে। মাহবুব-জহুর পরিষদের উপস্থিতি নজর এড়ানোর মতো না থাকলেও কিছুটা নিষ্প্রভ তো ছিলই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মতো একটি সংগঠনের মিলিত প্যানেল জিতবে না– এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ভেতরে ভেতরে যে একটি চোরাস্রোত বইছিল, সেটা আমাদের অনেকের উপলব্ধিতে ছিল না।
ভোট শেষে আমি হল থেকে বেরিয়ে কলাভবনে গিয়েছিলাম ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে জানতে। হলে হলে ভোট গননা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ডাকসুর ফল ঘোষণা হবে মনে করে আমি কলাভবনের সামনে গিয়েছিলাম। কলাভবনের চারতলায় সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলে যে যৌথ প্যানেল জিতবে তাতে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। আমাদের হলে জাসদ ছাত্রলীগের সামান্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তবে যারা হলে না থেকে বাইরে থাকতেন তাদের কিছু ভোট তারা পাবে কিন্তু সেটা শয়ের ঘর পেরুবে না বলে আমার ধারণা ছিল। মেয়েদের দুই হলে জেতার ব্যাপারেও আমার কোনো সংশয় ছিল না।
সন্ধ্যা হয় হয় সময় দেখলাম রোকেয়া হলের প্রভোস্ট নীলিমা ইব্রাহিম হন্তদন্ত হয়ে কলাভবনের সামনে এসে শেখ শহীদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ কামালসহ নেতাদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলে আবার হলে ফিরে গেলেন। নেতাদের একটু চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন মনে হলো। শেখ কামাল তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে একটি জিপে উঠে এসএম হলের দিকে গেলেন। কিছু একটা ঘটছে– এ আশঙ্কা থেকে আমি প্রায় দৌড়ে হলে ফিরলাম। জগন্নাথ হলের অ্যাসেমব্লি ভবনে ভোট গননা চলছিল। ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে জটলা করছিল আর ফল শোনার অপেক্ষা করছিল।
আমি অ্যাসেমব্লির সামনে যেতে না যেতেই দেখি ১৫/২০ জনের একটি মিছিল পূর্ববাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিচ্ছিল। দেখতে না দেখতেই তারা যেখানে ভোট গননা চলছিল সেখানে ঢুকে গেল এবং গুলি বা পটকা ফোটানোর শব্দ কানে এলো। ওই মিছিলকারীরা চিৎকার করে মুজিববাদীদের খুঁজছিল।
মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে এবং সেটা করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। দৌড়াদৌড়ি ধ্বস্তাধ্বস্তিও কিছু হলো। কে যে কাকে ধাওয়া করছে বুঝতে না পেরে আমি উত্তরবাড়ির দিকে একটি নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ মিছিল। স্লোগান দেওয়া হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথা জাসদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অল্প সময়ের মধ্যে এটাও জানা গেল যে নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাসদ ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই করেছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করা হলেও ঘটনা যে উল্টো তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আমি যাদের জগন্নাথ হলে ঢুকতে দেখেছি, তাদের দুয়েকজনকে আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগের মিছিলে আগে দেখেছি। তাছাড়া ওই সময়ে যে অবস্থা ক্যাম্পাসে ছিল তাতে জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে ব্যালট ছিনতাই করা অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার এই মনোভাব তাৎক্ষণিকভাবে কারো কাছে প্রকাশ করিনি।
দশে চক্রে ভগবান ভূত। সবাই মিলে তখন আমরা জাসদের গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করলাম। ভোটের পরদিন সকালেই সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও জয়ধ্বনি সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, সকাল ১১টায় জাসদ ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন। আমি যেন জয়ধ্বনির পক্ষ থেকে ওই সংবাদসম্মলনে উপস্থিত থেকে ওরা কি বলে তা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে জানাই।
আদেশ শিরোধার্য করে আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বলাকা ভবনে জাসদ ছাত্রলীগ কার্যালয়ে উপস্থিত হলাম। একটু ভয় যে করছিল না, তা নয়। আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে চিনে যদি গণধোলাই শুরু করে তাহলে কী হবে ভাবছিলাম। তবে আমি ঢাকায় তখনো ছাত্র ইউনিয়নের সামান্য কর্মীর মতোই ছিলাম। তাই আমাকে মেরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে চাইবে না- এটাও মনে হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য মূলত মুজিববাদী ছাত্রলীগকেই দায়ী করা হয়। বলা হয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ছাত্রলীগ এটা করেছে। রোকেয়া হলের ভোট গননা শেষ হয়েছিল। যৌথ প্যানেল হেরেছিল।
আমার তখনই আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়ে যায়। যৌথ প্যানেল হেরেছে দেখে ফল ঘোষণা না করে নীলিমা আপা নেতাদের কাছে গিয়ে তাদের পরাজয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরাজয় এড়ানোর জন্যই ব্যালট ছিনতাই নাটক।
সংবাদ সম্মেলনে জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা আরও নানা তথ্যাদি উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ঘটনাটি তারা ঘটাননি। যা হোক, সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি ১০ নম্বর পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবিস্তারে সব কিছু জানাই।
পরের দিন দৈনিক সংবাদে আব্দুল কাইয়ুম মুকুলের (এখন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক) একটি লেখা ছাপা হয়, যে লেখায় নানা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা হয় যে জাসদ ছাত্রলীগই ডাকসুর ব্যালট ছিনতাই করেছে।
ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনার দায় যেভাবে জাসদ ছাত্রলীগের ওপর চাপানো হয়েছিল, সেটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ছাত্রলীগের অপকর্মের ভাগ বহনের এই নীতি মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে। আমরা আমাদের ভালোত্ব দিয়ে ছাত্রলীগকে খারাপ কাজকর্ম থেকে বিরত করে ভালোর পথে নিয়ে আসব– এই ধারণা থেকেই তো তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি ভাবা হয়েছিল বলে আমি মনে করেছিলাম। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আমরা তাদের খারাপটা শুধু মেনে নিলাম না, খারাপের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিলাম।
নেতারা তখন যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন, সেগুলো আমার কাছে অনেকটা কুযুক্তি মনে হয়েছে। ডাকসু জাসদ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে গেলে দেশে কী এমন ওলটপালট হতো তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। কোনো সংগঠনের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল না আমার পরিচিত তেমন শিক্ষর্থীরা আমাকে বলতো, তোমরা হলে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!
জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়ছিল।
একবার কোনো সংগঠনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে তাতে আবার জোয়ার সৃষ্টি করা সহজ নয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন ছাত্র ইউনিয়নকে পেছনে ঠেলেছে, আর সামনে সেভাবে আগানোর কোনো উপলক্ষ তৈরি হয়নি বা বলা যায় ছাত্র ইউনিয়ন তেমন উপলক্ষ তৈরিও করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ শিরোধার্য করে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিনির্ধারণ করায় কিছু সমস্যা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থ আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ নিশ্চয়ই অভিন্ন ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র ইউনিয়ন তার গণভিত্তি মজবুত করতে পেরেছিল এ কারণেই যে তখন কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সোভিয়েতের সরাসরি নিয়মিত নির্দেশনা ছিল না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরই ডাকসু বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে প্যানেল দিয়ে অংশ নিয়েও জয়লাভ করতে পারেনি। অথচ এক বছর আগে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। বাহাত্তরের ডাকসু নির্বাচনে জয়ের পর ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমছিল, আর বাড়ছিল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের। স্বাধীন দেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের যে ডাক ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি বা বলা যায়, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়ে চলাটা ছাত্ররা ভালোভাবে নেয়নি। বরং ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগের সরকার তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী গরম গরম বক্তব্য সাধারণ ছাত্রদের বেশি আকর্ষণ করতে থাকে। রোমান্টিকতা তারুণ্যের ধর্ম- এটা অস্বীকার করা যায় না।
একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমাদের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সলিমুল্লাহ খান। তিনি বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ভালো ছাত্র এবং জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সলিমুল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলাভবনে চক্কর দিতেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর স্বাধীন ও ভিন্ন চিন্তার জন্য তখন অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে ‘হিরো’ ছিলেন। ছফা ভাই সলিমুল্লাহ খানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন ‘সলিমুল্লাহর মতো মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনো আসেনি’। সলিমুল্লাহর কারণেও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জাসদ ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকতো বলে আমার ধারণা।
একসময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রগতিশীল ধারার প্রতি আকর্ষণ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের নামে আরও একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করার পর মেধাবীদের একটি অংশ ওদিকে চলে যায়, ছাত্র ইউনিয়নে কিছুটা মেধার সংকট দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি গুলিতে দুই কর্মীর মৃত্যু ও কয়েকজন আহত হওয়ার পর ছাত্র ইউনিয়ন আকস্মিকভাবে জ্বলে ওঠলেও আবার দপ করে নিভে যায়। এটা অনেকের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের ‘আত্মসমর্পণ’ বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পাল্টা হামলা মোকাবিলায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব ‘সিপিবির পরামর্শে’ ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে বলে, এমনকি, ছাত্র ইউনিয়নের অনেক কর্মী ও সাধারণ সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেছে। যেভাবে ও যেসব যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটাও সাধারণ ছাত্ররা পছন্দ করেনি। স্বাধীনতার পর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজে হাত দিলেও কিছু মহলের ক্রমাগত অপপ্রচার বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কেও ভুল ধারণা তৈরি করতে থাকে। তাঁর অতি উদার মানবিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো অবাধে ষড়যন্ত্র-নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের একটি অংশও এমন সব কাজে জড়াতে থাকেন, যেটা মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করতে থাকে। নবসৃষ্ট জাসদ নেতৃত্ব এবং প্রবীণ নেতা মওলানা ভাসানীসহ আরও নানা শক্তির কঠোর মুজিববিরোধী ও ভারতবিরোধী রাজনীতি দেশের ভেতর একটি গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তোলে।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর, থানা-ফাঁড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশার শিকার তরুণদের একাংশ বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হয়। সুযোগ নেয় রাজাকার আলবদর আলশামসের সদস্যরাও।
এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সারাদিন ভোট গ্রহণ হয়। ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ উল আলম লেনিন এবং জিএস পদে ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। সংক্ষেপে বলা হতো লেনিন-গামা পরিষদ। অন্যদিকে ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ। ভিপি পদে আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জিএস পদে জহুর হোসেন।
নির্বাচনী প্রচার দেখে মনে হয়েছিল, লেনিন-গামা পরিষদের বিজয় ঠেকায় কে! কিন্তু আসলে তা হয়নি। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী- সমর্থকেরা খুব ভালোভাবে নেয়নি বলেই আমার ধারণা। হয়তো বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির পছন্দের বাইরে হতো না, তাই ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের মনোভাবের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে যৌথ প্যানেলে নির্বাচনে গিয়েছিল। এতে ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রশংসিত হয়নি। আবার ছাত্রলীগের মধ্যেও ছাত্র ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল। ফলে বাইরে বাইরে যৌথ প্যানেল নিয়ে যেরকম রমরমা ভাব ছিল, ভেতরে ভেতরে তেমন ছিল না।
অন্য হলের কথা আমি ভালো জানি না, কিন্তু জগন্নাথ হলে আমি ঐক্যবিরোধী মনোভাবই প্রবল দেখেছি। যৌথ প্যানেলের পক্ষে কর্মীদের বোঝানোর জন্য একাধিক মিটিং জগন্নাথ হলে হয়েছে। তার একটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও উপস্থিত ছিলেন। আমি ওই সভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখিছি, সেলিম ভাইয়ের মতো তুখোড় নেতা, যিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় ছিলেন অতুলনীয়, তাঁকেও সাধারণ কর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না মেনে উপায় নেই বলেই যৌথ প্যানেল হয়েছিল কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এটা মেনে নেননি। জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন শক্তি ছিল মজবুত। এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া অন্য সংগঠন থাকলেও সদস্য-সমর্থক বেশি ছিল না। একক নির্বাচন করলেও এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয় ছিল নিশ্চিত। এই অবস্থায় ছাত্রলীগকে আসন ছেড়ে দিতে আপত্তি ছিল সঙ্গত।
সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এমন মনোভাব কেন তৈরি হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা না করাটি ছিল তখন একটি বড় ভুল। দেশে তখন দ্রুত এমন সব ঘটনা ঘটছিল যা ছিল অপ্রত্যাশিত। উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণের কারণে ছাত্রলীগের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিরোধ ছিল, গ্রুপিং ছিল। স্বাধীনতার পর শফিউল আলম প্রধানকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। শফিউল আলম প্রধানের বাবা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা। তিনি শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্পিকার ছিলেন।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই পর্যায়ে হঠাৎ মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প সময় পরই আমিও বাংলা বিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি যে এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম তা নয়। কারণ যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমার ভয় ছোটবেলা থেকেই। আমি স্কুলে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। বিস্কুট দৌড় নামে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। আমি এই ভেবে অংশ নিয়েছিলাম যে পুরস্কার না পেলেও দড়িতে ঝোলানো একটি বিস্কুট অন্তত মুখে পুড়তে পারব! অবশ্য ওই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগী কম থাকায় একটি পুরস্কার আমিও পেয়েছিলাম। তিনজনের মধ্যে আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। এমন বিপুল সাফল্যের পর প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলতাম কোনো না কোনো অজুহাত তুলে। পরে অবশ্য বাঙালির তিন হাতের কথা জেনেছি। ডান হাত, বাম হাতের চেয়েও আমাদের শক্তিশালী তৃতীয় হাতটির নাম অজুহাত।
বাংলা বিভাগের নির্বাচনে আমাকে কেন প্রার্থী করা হলো তার কারণ আমি জানি না। হয়তো মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকা এবং ততদিনে ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’র কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই এর কারণ ছিল। আমি মনে করি, আমার চেয়ে যোগ্যপ্রার্থী ছিল জুলিয়াস, খোন্দকার শওকত হোসেন। সে ঢাকায় লেখাপড়া করেছে। জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তাছাড়া ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের কাজের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। আমি মফস্বল থেকে আসা একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। পোশাকেরও তেমন ছিরিছাঁদ ছিল না। মনোনয়নপত্র জমা দিলাম প্রচার সম্পাদক পদে।
মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আমার ভয় দূর না হয়ে গেল বহুগুণে বেড়ে। হেরে গেলে তো লজ্জার ব্যাপার। আবার এটাও মনে হলো, কোথায় যেন শুনেছি, জয়ের চেয়ে নাকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দই বেশি।
আনন্দের খবর পেতে অবশ্য আমাকে ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জানা গেল আমি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় আমার বিজয় নিশ্চিত হয়।
আমরা অবশ্য বিভিন্ন বর্ষের ক্লাসে গিয়ে প্যানেলের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছি। ভিপি পদে আমাদের প্রার্থীর নাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে জিএস প্রার্থী ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তার বাড়িও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে। মিজান ভাই দেখতে সুদর্শন ছিলেন। হাঁটতেন একটু খুড়িয়ে। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে তিনি যখন করিডোরে হাঁটতেন, তখন তাকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতোই লাগতো। নামে যেমন মিল, দেখতেও যেন কিছুটা মিল ছিল।
মিজান ভাই ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। তার কথায় মুগ্ধ হওয়ার অনেক উপাদান থাকতো। ক্লাসে ক্লাসে তিনি যখন ভোট চেয়ে বক্তৃতা করতেন তখন সবাই মনোযোগ দিয়েই শুনতেন। ফলে তিনি যে ভোটে জিতবেন- এটা আমি বুঝতে পারছিলাম। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএসসহ কয়েকজন এবং ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপিসহ কয়েকজন জেতেন। একটি ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে।
তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড. নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একই সঙ্গে রোকেয়া হলের প্রভোস্টও ছিলেন। আমাদের সংসদের প্রথম মিটিংয়ে ঘটলো এক মজার ঘটনা। সভা শুরু হওয়ার আগে প্রথমেই কথা বললেন জিএস মিজান ভাই। তিনি শুরু করলেন এভাবে: আমাদের সভা শুরু হলো। আজকের সভায় সভাপতিত্ব করছি আমি মিজানুর রহমান চৌধুরী।
ছাত্রলীগের থেকে নির্বাচিত ভিপি (নাম মনে নেই) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? আমি ভিপি, সভায় সভাপতিত্ব করব আমি। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত অন্যরাও বললেন, জিএস নয়, সভাপতিত্ব করবেন ভিপি।
মিজান ভাই এক অদ্ভুত যুক্তি হাজির করলেন। বললেন, দেশে এখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি নেই। এখন প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারপ্রধান। কখনো শুনেছেন, এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন? এখন মন্ত্রিসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখানে আমাদের এই সংসদেও ভিপি নন, জিএসই সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিতরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়েই বোধহয় মিজান ভাইয়ের প্রস্তাব মেনে নেন।
মিজান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কিন্তু বাংলা বিভাগের জন্য একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমার মনে আছে, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আমরা প্রচুর বই সৌজন্য হিসেবে এনেছিলাম। বিভাগীয় প্রধান নীলিমা আপা ছাত্রলীগের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হলেও আমাদেরও তিনি অসহযোগিতা করেননি।
মিজান ভাইয়ের ক্যারিশমার কারণে পরের বছর বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের পুরো প্যানেল জয়লাভ করেছিল। সেবার ভিপি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জিএস হয়েছিলেন উম্মে তুকা মোকাদ্দেসা আপা, পুরো নাম এখন পড়ছে না।
মিজান ভাই পরে বিটিভিতে অভিনয় করেছেন, বিটিভির জন্য একাধিক নাটকও লিখেছেন। তার লেখা একটি নাটক একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শেষ দিকে মিজান ভাই ঢাকা থেকে বীরগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। বীরগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন বেশ কয়েক বছর।
ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরি নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। প্রতিটি হলে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। অধিকাংশ ভোটারের বুকে ঝুলছিল লেনিন-গামা পরিষদের ব্যাজ, মাহবুব-জহুর পরিষদের ব্যাজও ছিল, তবে তুলনামূলক কম। যৌথ প্যানেলের নেতা-কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে চরকির মতো ঘুরছিলেন। আমি শুরুতে লেনিন-গামা পরিষদের বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান থাকলেও শেষদিকে মনে হচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এই প্যানেলই জিতবে। মাহবুব-জহুর পরিষদের উপস্থিতি নজর এড়ানোর মতো না থাকলেও কিছুটা নিষ্প্রভ তো ছিলই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মতো একটি সংগঠনের মিলিত প্যানেল জিতবে না– এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ভেতরে ভেতরে যে একটি চোরাস্রোত বইছিল, সেটা আমাদের অনেকের উপলব্ধিতে ছিল না।
ভোট শেষে আমি হল থেকে বেরিয়ে কলাভবনে গিয়েছিলাম ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে জানতে। হলে হলে ভোট গননা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ডাকসুর ফল ঘোষণা হবে মনে করে আমি কলাভবনের সামনে গিয়েছিলাম। কলাভবনের চারতলায় সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলে যে যৌথ প্যানেল জিতবে তাতে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। আমাদের হলে জাসদ ছাত্রলীগের সামান্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তবে যারা হলে না থেকে বাইরে থাকতেন তাদের কিছু ভোট তারা পাবে কিন্তু সেটা শয়ের ঘর পেরুবে না বলে আমার ধারণা ছিল। মেয়েদের দুই হলে জেতার ব্যাপারেও আমার কোনো সংশয় ছিল না।
সন্ধ্যা হয় হয় সময় দেখলাম রোকেয়া হলের প্রভোস্ট নীলিমা ইব্রাহিম হন্তদন্ত হয়ে কলাভবনের সামনে এসে শেখ শহীদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ কামালসহ নেতাদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলে আবার হলে ফিরে গেলেন। নেতাদের একটু চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন মনে হলো। শেখ কামাল তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে একটি জিপে উঠে এসএম হলের দিকে গেলেন। কিছু একটা ঘটছে– এ আশঙ্কা থেকে আমি প্রায় দৌড়ে হলে ফিরলাম। জগন্নাথ হলের অ্যাসেমব্লি ভবনে ভোট গননা চলছিল। ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে জটলা করছিল আর ফল শোনার অপেক্ষা করছিল।
আমি অ্যাসেমব্লির সামনে যেতে না যেতেই দেখি ১৫/২০ জনের একটি মিছিল পূর্ববাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিচ্ছিল। দেখতে না দেখতেই তারা যেখানে ভোট গননা চলছিল সেখানে ঢুকে গেল এবং গুলি বা পটকা ফোটানোর শব্দ কানে এলো। ওই মিছিলকারীরা চিৎকার করে মুজিববাদীদের খুঁজছিল।
মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে এবং সেটা করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। দৌড়াদৌড়ি ধ্বস্তাধ্বস্তিও কিছু হলো। কে যে কাকে ধাওয়া করছে বুঝতে না পেরে আমি উত্তরবাড়ির দিকে একটি নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ মিছিল। স্লোগান দেওয়া হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথা জাসদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অল্প সময়ের মধ্যে এটাও জানা গেল যে নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাসদ ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই করেছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করা হলেও ঘটনা যে উল্টো তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আমি যাদের জগন্নাথ হলে ঢুকতে দেখেছি, তাদের দুয়েকজনকে আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগের মিছিলে আগে দেখেছি। তাছাড়া ওই সময়ে যে অবস্থা ক্যাম্পাসে ছিল তাতে জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে ব্যালট ছিনতাই করা অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার এই মনোভাব তাৎক্ষণিকভাবে কারো কাছে প্রকাশ করিনি।
দশে চক্রে ভগবান ভূত। সবাই মিলে তখন আমরা জাসদের গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করলাম। ভোটের পরদিন সকালেই সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও জয়ধ্বনি সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, সকাল ১১টায় জাসদ ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন। আমি যেন জয়ধ্বনির পক্ষ থেকে ওই সংবাদসম্মলনে উপস্থিত থেকে ওরা কি বলে তা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে জানাই।
আদেশ শিরোধার্য করে আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বলাকা ভবনে জাসদ ছাত্রলীগ কার্যালয়ে উপস্থিত হলাম। একটু ভয় যে করছিল না, তা নয়। আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে চিনে যদি গণধোলাই শুরু করে তাহলে কী হবে ভাবছিলাম। তবে আমি ঢাকায় তখনো ছাত্র ইউনিয়নের সামান্য কর্মীর মতোই ছিলাম। তাই আমাকে মেরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে চাইবে না- এটাও মনে হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য মূলত মুজিববাদী ছাত্রলীগকেই দায়ী করা হয়। বলা হয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ছাত্রলীগ এটা করেছে। রোকেয়া হলের ভোট গননা শেষ হয়েছিল। যৌথ প্যানেল হেরেছিল।
আমার তখনই আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়ে যায়। যৌথ প্যানেল হেরেছে দেখে ফল ঘোষণা না করে নীলিমা আপা নেতাদের কাছে গিয়ে তাদের পরাজয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরাজয় এড়ানোর জন্যই ব্যালট ছিনতাই নাটক।
সংবাদ সম্মেলনে জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা আরও নানা তথ্যাদি উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ঘটনাটি তারা ঘটাননি। যা হোক, সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি ১০ নম্বর পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবিস্তারে সব কিছু জানাই।
পরের দিন দৈনিক সংবাদে আব্দুল কাইয়ুম মুকুলের (এখন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক) একটি লেখা ছাপা হয়, যে লেখায় নানা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা হয় যে জাসদ ছাত্রলীগই ডাকসুর ব্যালট ছিনতাই করেছে।
ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনার দায় যেভাবে জাসদ ছাত্রলীগের ওপর চাপানো হয়েছিল, সেটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ছাত্রলীগের অপকর্মের ভাগ বহনের এই নীতি মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে। আমরা আমাদের ভালোত্ব দিয়ে ছাত্রলীগকে খারাপ কাজকর্ম থেকে বিরত করে ভালোর পথে নিয়ে আসব– এই ধারণা থেকেই তো তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি ভাবা হয়েছিল বলে আমি মনে করেছিলাম। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আমরা তাদের খারাপটা শুধু মেনে নিলাম না, খারাপের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিলাম।
নেতারা তখন যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন, সেগুলো আমার কাছে অনেকটা কুযুক্তি মনে হয়েছে। ডাকসু জাসদ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে গেলে দেশে কী এমন ওলটপালট হতো তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। কোনো সংগঠনের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল না আমার পরিচিত তেমন শিক্ষর্থীরা আমাকে বলতো, তোমরা হলে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!
জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়ছিল।
একবার কোনো সংগঠনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে তাতে আবার জোয়ার সৃষ্টি করা সহজ নয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন ছাত্র ইউনিয়নকে পেছনে ঠেলেছে, আর সামনে সেভাবে আগানোর কোনো উপলক্ষ তৈরি হয়নি বা বলা যায় ছাত্র ইউনিয়ন তেমন উপলক্ষ তৈরিও করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ শিরোধার্য করে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিনির্ধারণ করায় কিছু সমস্যা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থ আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ নিশ্চয়ই অভিন্ন ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র ইউনিয়ন তার গণভিত্তি মজবুত করতে পেরেছিল এ কারণেই যে তখন কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সোভিয়েতের সরাসরি নিয়মিত নির্দেশনা ছিল না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।
৭ ঘণ্টা আগে
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়।
৭ ঘণ্টা আগে
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার...
৭ ঘণ্টা আগে
আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই...
৭ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।
জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে শোকের নীরবতায় থমকে গেল দেশ। আর কাঁপিয়ে দিয়ে গেল রাজনৈতিক-মানসিক ভূমিকম্পের সূক্ষ্ম রেখাগুলো। সংগ্রাম, কারাবাস, অসুস্থতা—সবকিছুর মধ্যেও তিনি ছিলেন অবিচল; বিশ্বাসে দৃঢ় আর নেতৃত্বে অনমনীয়।
কারাগারের দেয়াল, হাসপাতালের শয্যা, রাজনীতির নির্মম অন্ধকার—সব মিলিয়ে দীর্ঘ বছর খালেদা জিয়া কাটিয়েছেন লড়াইয়ের ভার বহন করে; যে মানুষটি রাজপথে কখনো মাথানত করেননি। এমনিতে একটি লড়াই থেকে আরেকটিতে যাত্রা করতে করতে তাঁর শরীর হয়ে উঠেছিল ভঙ্গুর, মন ক্ষয়ে গিয়েছিল প্রতিহিংসার ধারাবাহিক আঘাতে। বিদেশে চিকিৎসা, দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পরিবারের অসীম ব্যাকুলতা—সবই ছিল, সবই হলো; তবু তাঁকে আর ফেরানো গেল না।
তুমুল জনপ্রিয় এই নেত্রীর প্রস্থান শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যু নয়; এটি একটি যুগের সমাপ্তি। সেই যুগের মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকারে তাঁর বন্দিত্ব, স্বামীর শাহাদাতে জীবনচক্রের ভেঙে পড়া, সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের অশ্রু, ওয়ান-ইলেভেনের নিঃসঙ্গ বন্দিত্ব, আর পুরান ঢাকার কারাগারের শীতল দেয়ালে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। সবকিছুর পরও তিনি দাঁড়িয়েছিলেন—বাধা, ব্যথা আর ব্যর্থতা পেরিয়ে।
খালেদা জিয়ার জীবন ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ। একদিকে তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের সংগ্রামের মুখ; অন্যদিকে সমালোচনাও তাঁর পিছু ছাড়েনি। গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে গিয়ে যেমন ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তীব্র বিরোধিতাও কম ছিল না। অনেক ভুলের দায় তাঁকে বহন করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর অটলতা, প্রতিকূলের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা, আর ব্যক্তিজীবনের অবর্ণনীয় ক্ষতবিক্ষত অধ্যায় তাঁকে আলাদাভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে।
শোকের এই মুহূর্তে আমরা এক রাজনীতিককে নয়; এক দৃঢ় চরিত্র নারীকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। যাঁর জীবনের গল্প শুধু সংগ্রামের নয়, অবিচল থাকার অনুশাসনও বটে। একটি অন্তর্দীপ নিভে গেছে; কিন্তু তার আলো অনেক দিন ধরে পথ দেখাবে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে।
অসুস্থ শরীর নিয়েও যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন, তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন—দৃঢ়তা কীভাবে জন্ম নেয়। তাঁর কণ্ঠে ছিল সংগ্রামের ইতিহাস, নীরবতায় ছিল ত্যাগের গভীরতা। আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে শূন্যতা শুধু রাজনীতিতে নয়, জাতির অনুভূতিতেও।
খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনীতির এক অশ্বারোহিণী। যিনি প্রতিদিন আহত হন, প্রতিদিন অভিযুক্ত হন, আবার প্রতিদিনই ঘুরে দাঁড়ান। জয়-পরাজয়ের হিসাবের বাইরে ছিল তাঁর দৃঢ়তার বর্ণমালা। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু যে অন্ধকার-আলো মেশানো উপস্থিতি তিনি রেখে গেলেন, তা বহুদিন পর্যন্ত রাজনীতির ভাষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোঝাপড়া এবং ইতিহাসের নির্মোহ রেকর্ডে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকবে। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে—ভালোবাসা, বিতর্ক আর অবিচল সাহসের এক অনন্য নাম হিসেবে।
বিদায় খালেদা জিয়া।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।
জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে শোকের নীরবতায় থমকে গেল দেশ। আর কাঁপিয়ে দিয়ে গেল রাজনৈতিক-মানসিক ভূমিকম্পের সূক্ষ্ম রেখাগুলো। সংগ্রাম, কারাবাস, অসুস্থতা—সবকিছুর মধ্যেও তিনি ছিলেন অবিচল; বিশ্বাসে দৃঢ় আর নেতৃত্বে অনমনীয়।
কারাগারের দেয়াল, হাসপাতালের শয্যা, রাজনীতির নির্মম অন্ধকার—সব মিলিয়ে দীর্ঘ বছর খালেদা জিয়া কাটিয়েছেন লড়াইয়ের ভার বহন করে; যে মানুষটি রাজপথে কখনো মাথানত করেননি। এমনিতে একটি লড়াই থেকে আরেকটিতে যাত্রা করতে করতে তাঁর শরীর হয়ে উঠেছিল ভঙ্গুর, মন ক্ষয়ে গিয়েছিল প্রতিহিংসার ধারাবাহিক আঘাতে। বিদেশে চিকিৎসা, দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পরিবারের অসীম ব্যাকুলতা—সবই ছিল, সবই হলো; তবু তাঁকে আর ফেরানো গেল না।
তুমুল জনপ্রিয় এই নেত্রীর প্রস্থান শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যু নয়; এটি একটি যুগের সমাপ্তি। সেই যুগের মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকারে তাঁর বন্দিত্ব, স্বামীর শাহাদাতে জীবনচক্রের ভেঙে পড়া, সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের অশ্রু, ওয়ান-ইলেভেনের নিঃসঙ্গ বন্দিত্ব, আর পুরান ঢাকার কারাগারের শীতল দেয়ালে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। সবকিছুর পরও তিনি দাঁড়িয়েছিলেন—বাধা, ব্যথা আর ব্যর্থতা পেরিয়ে।
খালেদা জিয়ার জীবন ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ। একদিকে তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের সংগ্রামের মুখ; অন্যদিকে সমালোচনাও তাঁর পিছু ছাড়েনি। গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে গিয়ে যেমন ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তীব্র বিরোধিতাও কম ছিল না। অনেক ভুলের দায় তাঁকে বহন করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর অটলতা, প্রতিকূলের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা, আর ব্যক্তিজীবনের অবর্ণনীয় ক্ষতবিক্ষত অধ্যায় তাঁকে আলাদাভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে।
শোকের এই মুহূর্তে আমরা এক রাজনীতিককে নয়; এক দৃঢ় চরিত্র নারীকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। যাঁর জীবনের গল্প শুধু সংগ্রামের নয়, অবিচল থাকার অনুশাসনও বটে। একটি অন্তর্দীপ নিভে গেছে; কিন্তু তার আলো অনেক দিন ধরে পথ দেখাবে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে।
অসুস্থ শরীর নিয়েও যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন, তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন—দৃঢ়তা কীভাবে জন্ম নেয়। তাঁর কণ্ঠে ছিল সংগ্রামের ইতিহাস, নীরবতায় ছিল ত্যাগের গভীরতা। আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে শূন্যতা শুধু রাজনীতিতে নয়, জাতির অনুভূতিতেও।
খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনীতির এক অশ্বারোহিণী। যিনি প্রতিদিন আহত হন, প্রতিদিন অভিযুক্ত হন, আবার প্রতিদিনই ঘুরে দাঁড়ান। জয়-পরাজয়ের হিসাবের বাইরে ছিল তাঁর দৃঢ়তার বর্ণমালা। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু যে অন্ধকার-আলো মেশানো উপস্থিতি তিনি রেখে গেলেন, তা বহুদিন পর্যন্ত রাজনীতির ভাষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোঝাপড়া এবং ইতিহাসের নির্মোহ রেকর্ডে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকবে। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে—ভালোবাসা, বিতর্ক আর অবিচল সাহসের এক অনন্য নাম হিসেবে।
বিদায় খালেদা জিয়া।

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গ
১৭ এপ্রিল ২০২৩
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়।
৭ ঘণ্টা আগে
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার...
৭ ঘণ্টা আগে
আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই...
৭ ঘণ্টা আগেরাকিবুল ইসলাম

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়। কেউ ক্ষমতার উষ্ণতা সহ্য করতে পারেনি, কেউ বিকৃত রাজনৈতিক বাস্তবতায় চরিত্রহীন হয়ে গিয়েছিল, কেউ আবার নিজের আগুনেই ভস্মীভূত হয়েছে। কিন্তু এমনও কিছু নেতৃত্ব আছেন, যাঁরা সময়ের দহনক্ষেত্র পেরিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে এক ‘ধারাবাহিক প্রতিরোধের আদর্শ’ হিসেবে। এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক বাস্তবতায় যদি কারও নাম নেওয়া যায়, তিনি হলেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া মূলত এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে। যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, বন্দিত্ব, দলন, চক্রান্ত, আন্দোলন, ক্ষমতা, পতন, প্রতিরোধ সব ধারাই তাঁর জীবনকে স্পর্শ করেছে। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, তিনি শুরু করেছিলেন একদম সাধারণ নিরহংকারী গৃহবধূ থেকে।
১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া ‘পুতুল’ নামের সেই মেয়ে জানতেও পারেননি, ভবিষ্যৎ তাঁকে কোন অগ্নিপরীক্ষার দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ক্ষমতার বাস্তবতা মানবজীবনে অনেক সময় নির্মম। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে। সেই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি মানুষ, একটি পরিবার, একটি রাজনৈতিক দলকে নয়, পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখনো রাজনীতির ময়দানে খালেদা জিয়া অপরিচিত। কিন্তু ইতিহাস সেই শান্ত গৃহবধূকে ঘরেই থাকতে দিল না। দল, নেতা-কর্মী, সমর্থক—সবাই তাঁকে ডাকলেন। ভেঙে পড়া থেকে একটি দলকে বাঁচাতে, একটি জাতির নেতৃত্বশূন্যতা রোধ করতে তাঁকে সামনে আসতেই হলো। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করলেন; ১৯৮৩ সালে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান; ১৯৮৪ সালে দলের সর্বোচ্চ নেতা চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন এরশাদ সরকারকে সরিয়ে দিলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নতুন দ্বারে দাঁড়ায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলো। দেশ পেল তার ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। এই অর্জন শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশীয় নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক বিশাল অধ্যায়। তাঁর প্রথম মেয়াদে তিনি যা করলেন, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ও ফ্রি টিউশন, বৃক্ষরোপণ আন্দোলন, সার্কে নেতৃত্ব, যমুনা সেতুর ভিত্তি—এসবই দেশের পরবর্তী উন্নয়ন ধারার মূল স্থপতির পদে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য ও বিরল কৃতিত্ব হলো, তাঁর অংশ নেওয়া প্রতিটি নির্বাচনে তিনি জয় পেয়েছেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচটি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং মোট ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জয়লাভ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এত ভিন্ন ভিন্ন আসনে একসঙ্গে জয়লাভের নজির আর কোনো নেতার নেই।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়। খালেদা জিয়ার তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাবকে সর্বোচ্চে নিয়ে যায়। এই মেয়াদে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যখন রাজনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় রচনা শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে নির্মম অধ্যায় শুরু হয় ২০১৮ সালে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি যান পুরোনো নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের একটি একক সেলে। খালেদা জিয়ার বয়স, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা এবং নির্বাচনের আগমুহূর্তে হাজারো নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা—সব মিলিয়ে বিএনপি যেন এক অচেনা অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। আর তখন দলের প্রধান নেত্রীর অনুপস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য ভেঙে যায়।
অবশেষে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রেক্ষাপটে ‘দণ্ড স্থগিত’ করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়, শর্ত সাপেক্ষে। তিনি বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না; বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। ফলে তিনি মুক্তি পেলেও তৈরি হয় নতুন একধরনের রাজনৈতিক বন্দিত্ব।
এরপর ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তীব্রভাবে বদলে দেয়। পরদিন রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দীর্ঘ দমন-পীড়ন, কারাবাস, নিপীড়ন—সব পেরিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন রাজনৈতিক ময়দানে সেই দৃঢ়তার সঙ্গেই, যেভাবে তিনি জীবনের প্রতিটি সংকট মোকাবিলা করেছেন।
ইতিহাস তাঁদেরই শ্রদ্ধা জানায়, যাঁরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথানত করেন না। সেই ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম আলাদা লেখা থাকবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়। কেউ ক্ষমতার উষ্ণতা সহ্য করতে পারেনি, কেউ বিকৃত রাজনৈতিক বাস্তবতায় চরিত্রহীন হয়ে গিয়েছিল, কেউ আবার নিজের আগুনেই ভস্মীভূত হয়েছে। কিন্তু এমনও কিছু নেতৃত্ব আছেন, যাঁরা সময়ের দহনক্ষেত্র পেরিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে এক ‘ধারাবাহিক প্রতিরোধের আদর্শ’ হিসেবে। এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক বাস্তবতায় যদি কারও নাম নেওয়া যায়, তিনি হলেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া মূলত এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে। যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, বন্দিত্ব, দলন, চক্রান্ত, আন্দোলন, ক্ষমতা, পতন, প্রতিরোধ সব ধারাই তাঁর জীবনকে স্পর্শ করেছে। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, তিনি শুরু করেছিলেন একদম সাধারণ নিরহংকারী গৃহবধূ থেকে।
১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া ‘পুতুল’ নামের সেই মেয়ে জানতেও পারেননি, ভবিষ্যৎ তাঁকে কোন অগ্নিপরীক্ষার দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ক্ষমতার বাস্তবতা মানবজীবনে অনেক সময় নির্মম। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে। সেই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি মানুষ, একটি পরিবার, একটি রাজনৈতিক দলকে নয়, পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখনো রাজনীতির ময়দানে খালেদা জিয়া অপরিচিত। কিন্তু ইতিহাস সেই শান্ত গৃহবধূকে ঘরেই থাকতে দিল না। দল, নেতা-কর্মী, সমর্থক—সবাই তাঁকে ডাকলেন। ভেঙে পড়া থেকে একটি দলকে বাঁচাতে, একটি জাতির নেতৃত্বশূন্যতা রোধ করতে তাঁকে সামনে আসতেই হলো। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করলেন; ১৯৮৩ সালে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান; ১৯৮৪ সালে দলের সর্বোচ্চ নেতা চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন এরশাদ সরকারকে সরিয়ে দিলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নতুন দ্বারে দাঁড়ায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলো। দেশ পেল তার ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। এই অর্জন শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশীয় নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক বিশাল অধ্যায়। তাঁর প্রথম মেয়াদে তিনি যা করলেন, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ও ফ্রি টিউশন, বৃক্ষরোপণ আন্দোলন, সার্কে নেতৃত্ব, যমুনা সেতুর ভিত্তি—এসবই দেশের পরবর্তী উন্নয়ন ধারার মূল স্থপতির পদে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য ও বিরল কৃতিত্ব হলো, তাঁর অংশ নেওয়া প্রতিটি নির্বাচনে তিনি জয় পেয়েছেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচটি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং মোট ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জয়লাভ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এত ভিন্ন ভিন্ন আসনে একসঙ্গে জয়লাভের নজির আর কোনো নেতার নেই।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়। খালেদা জিয়ার তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাবকে সর্বোচ্চে নিয়ে যায়। এই মেয়াদে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যখন রাজনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় রচনা শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে নির্মম অধ্যায় শুরু হয় ২০১৮ সালে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি যান পুরোনো নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের একটি একক সেলে। খালেদা জিয়ার বয়স, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা এবং নির্বাচনের আগমুহূর্তে হাজারো নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা—সব মিলিয়ে বিএনপি যেন এক অচেনা অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। আর তখন দলের প্রধান নেত্রীর অনুপস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য ভেঙে যায়।
অবশেষে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রেক্ষাপটে ‘দণ্ড স্থগিত’ করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়, শর্ত সাপেক্ষে। তিনি বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না; বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। ফলে তিনি মুক্তি পেলেও তৈরি হয় নতুন একধরনের রাজনৈতিক বন্দিত্ব।
এরপর ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তীব্রভাবে বদলে দেয়। পরদিন রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দীর্ঘ দমন-পীড়ন, কারাবাস, নিপীড়ন—সব পেরিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন রাজনৈতিক ময়দানে সেই দৃঢ়তার সঙ্গেই, যেভাবে তিনি জীবনের প্রতিটি সংকট মোকাবিলা করেছেন।
ইতিহাস তাঁদেরই শ্রদ্ধা জানায়, যাঁরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথানত করেন না। সেই ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম আলাদা লেখা থাকবে।

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গ
১৭ এপ্রিল ২০২৩
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।
৭ ঘণ্টা আগে
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার...
৭ ঘণ্টা আগে
আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই...
৭ ঘণ্টা আগেআব্দুল্লাহ নাজিম আল মামুন

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানকেও প্রদানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করে দেন। তবে চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকার জিয়াউর রহমানের পুরস্কার পুনরায় বহাল রেখেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম স্বাধীনতা পুরস্কার চালু করেন।
প্রতিপক্ষের প্রতি কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে ভূষিত হওয়া পুরস্কার বাতিল করা হয়, তা আমরা শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই দেখতে পেয়েছি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক। শত্রুকেও বুকে টেনে নিতেন। ন্যায়ের ভাষায় কথা বলতেন। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অপ্রতিরোধ্য। তিনি ছিলেন আপসহীন। আপস করেননি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে। এমনকি গণতন্ত্র রক্ষার্থে তিনি নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়াই যেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে আরও জোরদার করেছিল, যা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর অন্যতম উপায়। যুগে যুগে দেখা গেছে, কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকতে পারেনি। গণতন্ত্রের উত্তরণে বিএনপির ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। রাজনীতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল।
সেই অনুরাগ ভাঙাতে এগিয়ে আসেন দলের একাংশের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁদের অনুরোধে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ। জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির নেতৃত্বে আসেন খালেদা জিয়া, ১৯৮৩ সালে। তিনি প্রথমে এককভাবে এবং পরে ৭ দলীয় জোট গঠন করে তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রধান এরশাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে বিরোধিতা করেন, যা তৎকালীন বিরোধীদের মধ্যে দৃঢ় নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে এবং আপসহীনতার স্পষ্টতা ফুটে ওঠে। এরপর ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত টানা হরতাল, মিছিল, সমাবেশ, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া।
১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথরেখায় এটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
খালেদা জিয়াই প্রথম গণভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন, যা গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন তিনি, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তনের অন্যতম বড় মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং স্বল্পতম সময়ে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে শান্তিপূর্ণভাবে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তন।
এরপর ২০০১ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু নারী বলে নয়; একজন দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন কখনো সহজ ছিল না। তিনি হয়েছেন কারাবন্দী, হয়েছেন গৃহবন্দী। তাঁর ওপর চাপানো হয়েছে মামলার পাহাড়, স্বাস্থ্য নিয়ে করা হয়েছে অবহেলা। তবু তিনি কখনো নিজের নীতিতে আপস করেননি। তাঁর ‘আপসহীন’ তকমাটি শুধু কাগুজে নয়, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি অভিধা।
২০১৮ সালের পর থেকে বারবার অসুস্থ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, তা বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অথচ দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি ছিল তাঁর প্রাপ্য মৌলিক অধিকার।
এই দেশের মা, মাটির প্রতি খালেদা জিয়ার ছিল আবেগ ও অসম্ভব ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি আর মানুষই আমার সবকিছু’—এই আবেগমাখা উচ্চারণ ছিল তাঁর।
তিনি চলে গেলেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাঁর অদম্য প্রজ্ঞা, সাহসিকতা, মানবিকতা, উদারতা ও আপসহীনতা। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, ইতিহাসের পাতায়—ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানকেও প্রদানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করে দেন। তবে চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকার জিয়াউর রহমানের পুরস্কার পুনরায় বহাল রেখেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম স্বাধীনতা পুরস্কার চালু করেন।
প্রতিপক্ষের প্রতি কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে ভূষিত হওয়া পুরস্কার বাতিল করা হয়, তা আমরা শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই দেখতে পেয়েছি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক। শত্রুকেও বুকে টেনে নিতেন। ন্যায়ের ভাষায় কথা বলতেন। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অপ্রতিরোধ্য। তিনি ছিলেন আপসহীন। আপস করেননি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে। এমনকি গণতন্ত্র রক্ষার্থে তিনি নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়াই যেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে আরও জোরদার করেছিল, যা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর অন্যতম উপায়। যুগে যুগে দেখা গেছে, কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকতে পারেনি। গণতন্ত্রের উত্তরণে বিএনপির ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। রাজনীতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল।
সেই অনুরাগ ভাঙাতে এগিয়ে আসেন দলের একাংশের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁদের অনুরোধে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ। জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির নেতৃত্বে আসেন খালেদা জিয়া, ১৯৮৩ সালে। তিনি প্রথমে এককভাবে এবং পরে ৭ দলীয় জোট গঠন করে তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রধান এরশাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে বিরোধিতা করেন, যা তৎকালীন বিরোধীদের মধ্যে দৃঢ় নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে এবং আপসহীনতার স্পষ্টতা ফুটে ওঠে। এরপর ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত টানা হরতাল, মিছিল, সমাবেশ, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া।
১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথরেখায় এটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
খালেদা জিয়াই প্রথম গণভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন, যা গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন তিনি, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তনের অন্যতম বড় মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং স্বল্পতম সময়ে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে শান্তিপূর্ণভাবে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তন।
এরপর ২০০১ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু নারী বলে নয়; একজন দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃত হয়েছে।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন কখনো সহজ ছিল না। তিনি হয়েছেন কারাবন্দী, হয়েছেন গৃহবন্দী। তাঁর ওপর চাপানো হয়েছে মামলার পাহাড়, স্বাস্থ্য নিয়ে করা হয়েছে অবহেলা। তবু তিনি কখনো নিজের নীতিতে আপস করেননি। তাঁর ‘আপসহীন’ তকমাটি শুধু কাগুজে নয়, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি অভিধা।
২০১৮ সালের পর থেকে বারবার অসুস্থ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, তা বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অথচ দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি ছিল তাঁর প্রাপ্য মৌলিক অধিকার।
এই দেশের মা, মাটির প্রতি খালেদা জিয়ার ছিল আবেগ ও অসম্ভব ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি আর মানুষই আমার সবকিছু’—এই আবেগমাখা উচ্চারণ ছিল তাঁর।
তিনি চলে গেলেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাঁর অদম্য প্রজ্ঞা, সাহসিকতা, মানবিকতা, উদারতা ও আপসহীনতা। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, ইতিহাসের পাতায়—ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়।

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গ
১৭ এপ্রিল ২০২৩
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।
৭ ঘণ্টা আগে
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়।
৭ ঘণ্টা আগে
আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই...
৭ ঘণ্টা আগেসেলিম জাহান

আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই ২০২৫ সালের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে এই হিসাব মেলানোর একটি বিরাট তাৎপর্য আছে; আমাদের অর্জনগুলোর উদ্যাপন এবং আমাদের ভুলগুলো থেকে শেখার জন্য। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সেগুলো একটি পাথেয় হয়ে থাকতে পারে।
রাজনৈতিক দিক থেকে পুরো বছরটি নানা উদ্বেগ, শঙ্কার, আশা-নিরাশার মধ্যে ছিল। জনগণের কাছে নানান রাজনৈতিক সমীকরণ এবং সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ছিল না। রাজনৈতিক অঙ্গনে কোন দল প্রাধান্য পাচ্ছে, কে কার সঙ্গে জোট বাঁধছে, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা সারা বছর ধরে ছিল। জনমনে, বিশেষত নারীদের মনে প্রশ্ন ছিল যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে নারী-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে কি না। নির্বাচন হবে, নাকি হবে না, তা নিয়েও নানান মহল প্রশ্ন তুলেছিল। নির্বাচনের তারিখ নিয়েও একটা ধোঁয়াশা ছিল। নানা রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় উল্লেখ করছিল সম্ভাব্য নির্বাচন সম্পর্কে। অন্তর্বর্তী সরকারও বিভিন্ন সময়ে নানা সময়কালের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তারিখ বলছিল না। অবস্থাটা এমনই ছিল যে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও কথা বলেছিলেন নানা বিজ্ঞজন। জনমনে একটা বড় জিজ্ঞাসা ছিল যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে আসবেন। সে ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত ছিল।
২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সেই সব শঙ্কা-আশঙ্কার অবসান ঘটেছে। নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ভোটার তালিকাও সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন আসনে প্রার্থী তালিকাও বেরোচ্ছে। তারেক রহমানও কদিন আগে দেশে ফিরেছেন। সুতরাং রাজনীতির অঙ্গনে নানান বিষয়ে একটা স্বস্তি এবং ভারসাম্য ফিরে এসেছে। যদিও বিভিন্ন দিকে নানা অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান। এসব অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে বলেছেন, কোনো কোনো অপশক্তি এই নির্বাচন বানচাল করার জন্য তৎপর। রাজনীতি-সম্পৃক্ত সহিংসতা বেশ ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে নানান জায়গায় সন্ত্রাসও চলছে। সত্যি কথা বলতে, আমরা এখনো যথার্থ রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন করতে পারিনি এবং গণতন্ত্রের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ২০২৫ সালে অর্থনীতি বিষয়টিই সাধারণ মানুষের মনের বিরাট অংশ জুড়ে ছিল। ২০২৫ সালে তাদের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা ছিল অনেক, কিন্তু চিন্তাও তাদের কম ছিল না। সে প্রত্যাশা আর চিন্তা আবর্তিত হয়েছে তাদের জীবনের অর্থনীতি নিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মব সহিংসতা ইত্যাদি।
শেষ হয়ে যাওয়া বছরটিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ছিল অনেকটাই নেতিবাচক। বাংলাদেশের প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। দারিদ্র্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের নিরাপদ সুপেয় জলের সুবিধা নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ছয় বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে—২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ, যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজনের একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। বাংলাদেশের উচ্চতম ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদের মালিক, আর দেশের নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষ (দেশের অর্ধেক লোক) ৪ শতাংশ সম্পদ ভোগ করে। দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সে হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামীণ বাংলায় আয় অসমতা স্থিতিশীল রয়েছে, দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।
কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশ অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ কর্মসংস্থান চলে গেছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্তদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ঋণভার এবং ঋণ পরিশোধের দায়ভার একটি সংকটজনক জায়গায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানি আয়ের অনুপাত ১৯২ শতাংশ, যেখানে এই অনুপাত ১৮০ শতাংশ হলেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করে।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে একটি শ্লথতা ছিল। দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এখনো প্রার্থিত স্তরে পৌঁছায়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট এবং সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা এই উৎপাদন স্তরকে আরও বিপর্যস্ত করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশে বিনিয়োগ নিম্নস্তরে রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে নানা নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার জন্ম দিয়েছে। পোশাকশিল্পে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বহু উদ্যোক্তা সক্রিয় নয়, বিদেশি বিনিয়োগেও স্থবিরতা আছে। ফলে দেশের উৎপাদন ভিত্তিও দুর্বল এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করেছে। একদিকে উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় একটি সমস্যা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকিও একটি ভাবনার ব্যাপার। প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে আমদানি করা উপকরণের ওপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। জ্বালানি খাতে যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বালানি খাতে যে বিপুলভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ভোগ করে সমাজের ধনাঢ্য এবং সম্পদশালী অংশ। আমাদের জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকির ৫৪ শতাংশই যায় দেশের ৪০ শতাংশ সবচেয়ে সম্পদশালী গোষ্ঠীর কাছে।
২০২৫ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্যতম বাস্তবতা ছিল নানান বিষয়ে বৈশ্বিক চাপ। প্রথমত, এ বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি প্রবৃদ্ধি-শ্লথতায় ভুগেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশ অর্থনীতিতেও পড়েছে। বিশ্বের নানান জায়গার যুদ্ধ এবং সংঘাতের প্রভাবও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। যদিও উত্তরণ সময় পিছিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছে, কিন্তু সম্ভবত ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এর ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু কিছু সুযোগ হারাবে। যেমন স্বল্প বা শূন্য শুল্কে রপ্তানি সুবিধা, অনুদান সুবিধা ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশ পর্যায়ে উন্নীত হলে বাংলাদেশ এসব সুবিধা পাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা, সংনম্যতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।
অসমতা বা বৈষম্য তো শুধু অর্থনৈতিক নয়, তা ব্যাপ্ত হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বলয়েও। বৈষম্য শুধু ফলাফলে নয়, তা পরিস্ফুট হয়েছে সুযোগেও। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত।
নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা বাংলাদেশি সমাজের অসমতার অন্যতম বাস্তবতা। সুযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়, যা প্রতিফলিত হয় ফলাফলে। ঘরে-বাইরে নানা হয়রানি আর সহিংসতার শিকার হয় নারীরা। সেসব নির্যাতনের অংশ হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গৃহাভ্যন্তরের সহিংসতা এবং ধর্ষণ।
২০২৫ সালে একধরনের অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের সমাজের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে অব্যাহত ছিল। সেই সঙ্গে সহিংসতা, সন্ত্রাস এবং মবতন্ত্রের ফলে এ দেশের সমাজ একটি শঙ্কার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত সময় পার করেছে। ‘মব ভায়োলেন্সকে’ ‘মব জাস্টিস’ বলে যৌক্তিকতা দানের প্রচেষ্টা পরিপূর্ণভাবে অন্যায়। ন্যায্যতা অনেক উঁচু মার্গের বিষয়। সহিংসতার মতো বিকৃত একটি পন্থা দিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য যৌক্তিক, অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক অনেক পন্থা আছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে ‘মব ভায়োলেন্সকে’ কিছুতেই ‘মবোক্রেসির’ সমার্থক বলা যায় না। একটি হিংসাত্মক প্রক্রিয়াকে ‘ডেমোক্রেসির’ সঙ্গে তুলনা করা অন্যায়। চূড়ান্ত বিচারে, ‘মব ভায়োলেন্স’ হিংস্র সহিংসতা ভিন্ন কিছুই নয়।
দুই মাসের কম সময়ে বাংলাদেশ একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে গণমানুষের প্রত্যাশা অনেক। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি সেই দিকে। আগামী নির্বাচন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পথযাত্রার শুরু করুক, গতিময়তা আনুক, সমাজে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুক, সেটাই আমরা চাই। ২০২৬ সাল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা এবং সমবৃদ্ধির সুবাতাস নিয়ে আসুক।

আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই ২০২৫ সালের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে এই হিসাব মেলানোর একটি বিরাট তাৎপর্য আছে; আমাদের অর্জনগুলোর উদ্যাপন এবং আমাদের ভুলগুলো থেকে শেখার জন্য। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সেগুলো একটি পাথেয় হয়ে থাকতে পারে।
রাজনৈতিক দিক থেকে পুরো বছরটি নানা উদ্বেগ, শঙ্কার, আশা-নিরাশার মধ্যে ছিল। জনগণের কাছে নানান রাজনৈতিক সমীকরণ এবং সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ছিল না। রাজনৈতিক অঙ্গনে কোন দল প্রাধান্য পাচ্ছে, কে কার সঙ্গে জোট বাঁধছে, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা সারা বছর ধরে ছিল। জনমনে, বিশেষত নারীদের মনে প্রশ্ন ছিল যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে নারী-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে কি না। নির্বাচন হবে, নাকি হবে না, তা নিয়েও নানান মহল প্রশ্ন তুলেছিল। নির্বাচনের তারিখ নিয়েও একটা ধোঁয়াশা ছিল। নানা রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় উল্লেখ করছিল সম্ভাব্য নির্বাচন সম্পর্কে। অন্তর্বর্তী সরকারও বিভিন্ন সময়ে নানা সময়কালের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তারিখ বলছিল না। অবস্থাটা এমনই ছিল যে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও কথা বলেছিলেন নানা বিজ্ঞজন। জনমনে একটা বড় জিজ্ঞাসা ছিল যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে আসবেন। সে ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত ছিল।
২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সেই সব শঙ্কা-আশঙ্কার অবসান ঘটেছে। নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ভোটার তালিকাও সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন আসনে প্রার্থী তালিকাও বেরোচ্ছে। তারেক রহমানও কদিন আগে দেশে ফিরেছেন। সুতরাং রাজনীতির অঙ্গনে নানান বিষয়ে একটা স্বস্তি এবং ভারসাম্য ফিরে এসেছে। যদিও বিভিন্ন দিকে নানা অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান। এসব অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে বলেছেন, কোনো কোনো অপশক্তি এই নির্বাচন বানচাল করার জন্য তৎপর। রাজনীতি-সম্পৃক্ত সহিংসতা বেশ ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে নানান জায়গায় সন্ত্রাসও চলছে। সত্যি কথা বলতে, আমরা এখনো যথার্থ রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন করতে পারিনি এবং গণতন্ত্রের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ২০২৫ সালে অর্থনীতি বিষয়টিই সাধারণ মানুষের মনের বিরাট অংশ জুড়ে ছিল। ২০২৫ সালে তাদের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা ছিল অনেক, কিন্তু চিন্তাও তাদের কম ছিল না। সে প্রত্যাশা আর চিন্তা আবর্তিত হয়েছে তাদের জীবনের অর্থনীতি নিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মব সহিংসতা ইত্যাদি।
শেষ হয়ে যাওয়া বছরটিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ছিল অনেকটাই নেতিবাচক। বাংলাদেশের প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। দারিদ্র্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের নিরাপদ সুপেয় জলের সুবিধা নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ছয় বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে—২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ, যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজনের একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। বাংলাদেশের উচ্চতম ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদের মালিক, আর দেশের নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষ (দেশের অর্ধেক লোক) ৪ শতাংশ সম্পদ ভোগ করে। দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সে হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামীণ বাংলায় আয় অসমতা স্থিতিশীল রয়েছে, দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।
কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশ অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ কর্মসংস্থান চলে গেছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্তদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ঋণভার এবং ঋণ পরিশোধের দায়ভার একটি সংকটজনক জায়গায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানি আয়ের অনুপাত ১৯২ শতাংশ, যেখানে এই অনুপাত ১৮০ শতাংশ হলেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করে।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে একটি শ্লথতা ছিল। দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এখনো প্রার্থিত স্তরে পৌঁছায়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট এবং সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা এই উৎপাদন স্তরকে আরও বিপর্যস্ত করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশে বিনিয়োগ নিম্নস্তরে রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে নানা নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার জন্ম দিয়েছে। পোশাকশিল্পে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বহু উদ্যোক্তা সক্রিয় নয়, বিদেশি বিনিয়োগেও স্থবিরতা আছে। ফলে দেশের উৎপাদন ভিত্তিও দুর্বল এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করেছে। একদিকে উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় একটি সমস্যা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকিও একটি ভাবনার ব্যাপার। প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে আমদানি করা উপকরণের ওপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। জ্বালানি খাতে যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বালানি খাতে যে বিপুলভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ভোগ করে সমাজের ধনাঢ্য এবং সম্পদশালী অংশ। আমাদের জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকির ৫৪ শতাংশই যায় দেশের ৪০ শতাংশ সবচেয়ে সম্পদশালী গোষ্ঠীর কাছে।
২০২৫ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্যতম বাস্তবতা ছিল নানান বিষয়ে বৈশ্বিক চাপ। প্রথমত, এ বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি প্রবৃদ্ধি-শ্লথতায় ভুগেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশ অর্থনীতিতেও পড়েছে। বিশ্বের নানান জায়গার যুদ্ধ এবং সংঘাতের প্রভাবও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। যদিও উত্তরণ সময় পিছিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছে, কিন্তু সম্ভবত ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এর ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু কিছু সুযোগ হারাবে। যেমন স্বল্প বা শূন্য শুল্কে রপ্তানি সুবিধা, অনুদান সুবিধা ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশ পর্যায়ে উন্নীত হলে বাংলাদেশ এসব সুবিধা পাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা, সংনম্যতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।
অসমতা বা বৈষম্য তো শুধু অর্থনৈতিক নয়, তা ব্যাপ্ত হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বলয়েও। বৈষম্য শুধু ফলাফলে নয়, তা পরিস্ফুট হয়েছে সুযোগেও। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত।
নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা বাংলাদেশি সমাজের অসমতার অন্যতম বাস্তবতা। সুযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়, যা প্রতিফলিত হয় ফলাফলে। ঘরে-বাইরে নানা হয়রানি আর সহিংসতার শিকার হয় নারীরা। সেসব নির্যাতনের অংশ হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গৃহাভ্যন্তরের সহিংসতা এবং ধর্ষণ।
২০২৫ সালে একধরনের অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের সমাজের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে অব্যাহত ছিল। সেই সঙ্গে সহিংসতা, সন্ত্রাস এবং মবতন্ত্রের ফলে এ দেশের সমাজ একটি শঙ্কার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত সময় পার করেছে। ‘মব ভায়োলেন্সকে’ ‘মব জাস্টিস’ বলে যৌক্তিকতা দানের প্রচেষ্টা পরিপূর্ণভাবে অন্যায়। ন্যায্যতা অনেক উঁচু মার্গের বিষয়। সহিংসতার মতো বিকৃত একটি পন্থা দিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য যৌক্তিক, অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক অনেক পন্থা আছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে ‘মব ভায়োলেন্সকে’ কিছুতেই ‘মবোক্রেসির’ সমার্থক বলা যায় না। একটি হিংসাত্মক প্রক্রিয়াকে ‘ডেমোক্রেসির’ সঙ্গে তুলনা করা অন্যায়। চূড়ান্ত বিচারে, ‘মব ভায়োলেন্স’ হিংস্র সহিংসতা ভিন্ন কিছুই নয়।
দুই মাসের কম সময়ে বাংলাদেশ একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে গণমানুষের প্রত্যাশা অনেক। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি সেই দিকে। আগামী নির্বাচন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পথযাত্রার শুরু করুক, গতিময়তা আনুক, সমাজে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুক, সেটাই আমরা চাই। ২০২৬ সাল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা এবং সমবৃদ্ধির সুবাতাস নিয়ে আসুক।

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গ
১৭ এপ্রিল ২০২৩
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।
৭ ঘণ্টা আগে
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়।
৭ ঘণ্টা আগে
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার...
৭ ঘণ্টা আগে