Ajker Patrika

স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যালট ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা 

আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ১৬
স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যালট ছিনতাইয়ের প্রথম ঘটনা 

১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরই ডাকসু বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে প্যানেল দিয়ে অংশ নিয়েও জয়লাভ করতে পারেনি। অথচ এক বছর আগে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। বাহাত্তরের ডাকসু নির্বাচনে জয়ের পর ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমছিল, আর বাড়ছিল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের। স্বাধীন দেশে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের যে ডাক ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি বা বলা যায়, সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি নিয়ে চলাটা ছাত্ররা ভালোভাবে নেয়নি। বরং ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগের সরকার তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী গরম গরম বক্তব্য সাধারণ ছাত্রদের বেশি আকর্ষণ করতে থাকে। রোমান্টিকতা তারুণ্যের ধর্ম- এটা অস্বীকার করা যায় না।

একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। আমাদের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সলিমুল্লাহ খান। তিনি বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ভালো ছাত্র এবং জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সলিমুল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে কলাভবনে চক্কর দিতেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফা তাঁর স্বাধীন ও ভিন্ন চিন্তার জন্য তখন অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে ‘হিরো’ ছিলেন। ছফা ভাই সলিমুল্লাহ খানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন ‘সলিমুল্লাহর মতো মেধাবী ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কখনো আসেনি’। সলিমুল্লাহর কারণেও মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জাসদ ছাত্রলীগের দিকে ঝুঁকতো বলে আমার ধারণা।

একসময় মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রগতিশীল ধারার প্রতি আকর্ষণ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের নামে আরও একটি সংগঠন যাত্রা শুরু করার পর মেধাবীদের একটি অংশ ওদিকে চলে যায়, ছাত্র ইউনিয়নে কিছুটা মেধার সংকট দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি গুলিতে দুই কর্মীর মৃত্যু ও কয়েকজন আহত হওয়ার পর ছাত্র ইউনিয়ন আকস্মিকভাবে জ্বলে ওঠলেও আবার দপ করে নিভে যায়। এটা অনেকের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের ‘আত্মসমর্পণ’ বলে মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের পাল্টা হামলা মোকাবিলায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব ‘সিপিবির পরামর্শে’ ভীরুতার পরিচয় দিয়েছে বলে, এমনকি, ছাত্র ইউনিয়নের অনেক কর্মী ও সাধারণ সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেছে। যেভাবে ও যেসব যুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটাও সাধারণ ছাত্ররা পছন্দ করেনি। স্বাধীনতার পর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজে হাত দিলেও কিছু মহলের ক্রমাগত অপপ্রচার বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কেও ভুল ধারণা তৈরি করতে থাকে। তাঁর অতি উদার মানবিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো অবাধে ষড়যন্ত্র-নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের একটি অংশও এমন সব কাজে জড়াতে থাকেন, যেটা মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করতে থাকে। নবসৃষ্ট জাসদ নেতৃত্ব এবং প্রবীণ নেতা মওলানা ভাসানীসহ আরও নানা শক্তির কঠোর মুজিববিরোধী ও ভারতবিরোধী রাজনীতি দেশের ভেতর একটি গুমোট ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তোলে।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যায়। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর, থানা-ফাঁড়িতেও হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশার শিকার তরুণদের একাংশ বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসের পথে ধাবিত হয়। সুযোগ নেয় রাজাকার আলবদর আলশামসের সদস্যরাও।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়ে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সারাদিন ভোট গ্রহণ হয়। ডাকসুতে ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ উল আলম লেনিন এবং জিএস পদে ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। সংক্ষেপে বলা হতো লেনিন-গামা পরিষদ। অন্যদিকে ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ। ভিপি পদে আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জিএস পদে জহুর হোসেন।

নির্বাচনী প্রচার দেখে মনে হয়েছিল, লেনিন-গামা পরিষদের বিজয় ঠেকায় কে! কিন্তু আসলে তা হয়নি। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী- সমর্থকেরা খুব ভালোভাবে নেয়নি বলেই আমার ধারণা। হয়তো বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির পছন্দের বাইরে হতো না, তাই ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের মনোভাবের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে যৌথ প্যানেলে নির্বাচনে গিয়েছিল। এতে ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রশংসিত হয়নি। আবার ছাত্রলীগের মধ্যেও ছাত্র ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল। ফলে বাইরে বাইরে যৌথ প্যানেল নিয়ে যেরকম রমরমা ভাব ছিল, ভেতরে ভেতরে তেমন ছিল না।

অন্য হলের কথা আমি ভালো জানি না, কিন্তু জগন্নাথ হলে আমি ঐক্যবিরোধী মনোভাবই প্রবল দেখেছি। যৌথ প্যানেলের পক্ষে কর্মীদের বোঝানোর জন্য একাধিক মিটিং জগন্নাথ হলে হয়েছে। তার একটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও উপস্থিত ছিলেন। আমি ওই সভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখিছি, সেলিম ভাইয়ের মতো তুখোড় নেতা, যিনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায় ছিলেন অতুলনীয়, তাঁকেও সাধারণ কর্মীদের প্রশ্নের জবাব দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না মেনে উপায় নেই বলেই যৌথ প্যানেল হয়েছিল কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এটা মেনে নেননি। জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠন শক্তি ছিল মজবুত। এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া অন্য সংগঠন থাকলেও সদস্য-সমর্থক বেশি ছিল না। একক নির্বাচন করলেও এই তিন হলে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয় ছিল নিশ্চিত। এই অবস্থায় ছাত্রলীগকে আসন ছেড়ে দিতে আপত্তি ছিল সঙ্গত।

সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এমন মনোভাব কেন তৈরি হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা না করাটি ছিল তখন একটি বড় ভুল। দেশে তখন দ্রুত এমন সব ঘটনা ঘটছিল যা ছিল অপ্রত্যাশিত। উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণের কারণে ছাত্রলীগের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছিল। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিরোধ ছিল, গ্রুপিং ছিল। স্বাধীনতার পর শফিউল আলম প্রধানকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। শফিউল আলম প্রধানের বাবা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন মুসলিম লীগের ডাকসাইটে নেতা। তিনি শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক স্পিকার ছিলেন।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই পর্যায়ে হঠাৎ মনে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অল্প সময় পরই আমিও বাংলা বিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমি যে এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলাম তা নয়। কারণ যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আমার ভয় ছোটবেলা থেকেই। আমি স্কুলে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। বিস্কুট দৌড় নামে একটি প্রতিযোগিতা ছিল। আমি এই ভেবে অংশ নিয়েছিলাম যে পুরস্কার না পেলেও দড়িতে ঝোলানো একটি বিস্কুট অন্তত মুখে পুড়তে পারব! অবশ্য ওই প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগী কম থাকায় একটি পুরস্কার আমিও পেয়েছিলাম। তিনজনের মধ্যে আমি তৃতীয় হয়েছিলাম। এমন বিপুল সাফল্যের পর প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলতাম কোনো না কোনো অজুহাত তুলে। পরে অবশ্য বাঙালির তিন হাতের কথা জেনেছি। ডান হাত, বাম হাতের চেয়েও আমাদের শক্তিশালী তৃতীয় হাতটির নাম অজুহাত।

বাংলা বিভাগের নির্বাচনে আমাকে কেন প্রার্থী করা হলো তার কারণ আমি জানি না। হয়তো মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকা এবং ততদিনে ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’র কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াই এর কারণ ছিল। আমি মনে করি, আমার চেয়ে যোগ্যপ্রার্থী ছিল জুলিয়াস, খোন্দকার শওকত হোসেন। সে ঢাকায় লেখাপড়া করেছে। জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তাছাড়া ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের কাজের সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। আমি মফস্বল থেকে আসা একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। পোশাকেরও তেমন ছিরিছাঁদ ছিল না। মনোনয়নপত্র জমা দিলাম প্রচার সম্পাদক পদে।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আমার ভয় দূর না হয়ে গেল বহুগুণে বেড়ে। হেরে গেলে তো লজ্জার ব্যাপার। আবার এটাও মনে হলো, কোথায় যেন শুনেছি, জয়ের চেয়ে নাকি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আনন্দই বেশি।

আনন্দের খবর পেতে অবশ্য আমাকে ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জানা গেল আমি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিববাদী ছাত্রলীগের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় আমার বিজয় নিশ্চিত হয়।

আমরা অবশ্য বিভিন্ন বর্ষের ক্লাসে গিয়ে প্যানেলের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছি। ভিপি পদে আমাদের প্রার্থীর নাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে জিএস প্রার্থী ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তার বাড়িও দিনাজপুরের বীরগঞ্জে। মিজান ভাই দেখতে সুদর্শন ছিলেন। হাঁটতেন একটু খুড়িয়ে। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে তিনি যখন করিডোরে হাঁটতেন, তখন তাকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতোই লাগতো। নামে যেমন মিল, দেখতেও যেন কিছুটা মিল ছিল।

মিজান ভাই ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। তার কথায় মুগ্ধ হওয়ার অনেক উপাদান থাকতো। ক্লাসে ক্লাসে তিনি যখন ভোট চেয়ে বক্তৃতা করতেন তখন সবাই মনোযোগ দিয়েই শুনতেন। ফলে তিনি যে ভোটে জিতবেন- এটা আমি বুঝতে পারছিলাম। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে জিএসসহ কয়েকজন এবং ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপিসহ কয়েকজন জেতেন। একটি ঘটনার কথা বেশ মনে পড়ছে।

তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ড. নীলিমা ইব্রাহিম। তিনি একই সঙ্গে রোকেয়া হলের প্রভোস্টও ছিলেন। আমাদের সংসদের প্রথম মিটিংয়ে ঘটলো এক মজার ঘটনা। সভা শুরু হওয়ার আগে প্রথমেই কথা বললেন জিএস মিজান ভাই। তিনি শুরু করলেন এভাবে: আমাদের সভা শুরু হলো। আজকের সভায় সভাপতিত্ব করছি আমি মিজানুর রহমান চৌধুরী।

ছাত্রলীগের থেকে নির্বাচিত ভিপি (নাম মনে নেই) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? আমি ভিপি, সভায় সভাপতিত্ব করব আমি। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত অন্যরাও বললেন, জিএস নয়, সভাপতিত্ব করবেন ভিপি।

মিজান ভাই এক অদ্ভুত যুক্তি হাজির করলেন। বললেন, দেশে এখন রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি নেই। এখন প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারপ্রধান। কখনো শুনেছেন, এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন? এখন মন্ত্রিসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখানে আমাদের এই সংসদেও ভিপি নন, জিএসই সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিতরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়েই বোধহয় মিজান ভাইয়ের প্রস্তাব মেনে নেন।

মিজান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কিন্তু বাংলা বিভাগের জন্য একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। আমার মনে আছে, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আমরা প্রচুর বই সৌজন্য হিসেবে এনেছিলাম। বিভাগীয় প্রধান নীলিমা আপা ছাত্রলীগের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হলেও আমাদেরও তিনি অসহযোগিতা করেননি।

মিজান ভাইয়ের ক্যারিশমার কারণে পরের বছর বিভাগীয় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের পুরো প্যানেল জয়লাভ করেছিল। সেবার ভিপি হয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জিএস হয়েছিলেন উম্মে তুকা মোকাদ্দেসা আপা, পুরো নাম এখন পড়ছে না।

মিজান ভাই পরে বিটিভিতে অভিনয় করেছেন, বিটিভির জন্য একাধিক নাটকও লিখেছেন। তার লেখা একটি নাটক একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শেষ দিকে মিজান ভাই ঢাকা থেকে বীরগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। বীরগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন বেশ কয়েক বছর।

ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরি নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হয়। প্রতিটি হলে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। অধিকাংশ ভোটারের বুকে ঝুলছিল লেনিন-গামা পরিষদের ব্যাজ, মাহবুব-জহুর পরিষদের ব্যাজও ছিল, তবে তুলনামূলক কম। যৌথ প্যানেলের নেতা-কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে চরকির মতো ঘুরছিলেন। আমি শুরুতে লেনিন-গামা পরিষদের বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান থাকলেও শেষদিকে মনে হচ্ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও এই প্যানেলই জিতবে। মাহবুব-জহুর পরিষদের উপস্থিতি নজর এড়ানোর মতো না থাকলেও কিছুটা নিষ্প্রভ তো ছিলই। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মতো একটি সংগঠনের মিলিত প্যানেল জিতবে না– এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। তবে ভেতরে ভেতরে যে একটি চোরাস্রোত বইছিল, সেটা আমাদের অনেকের উপলব্ধিতে ছিল না।

ভোট শেষে আমি হল থেকে বেরিয়ে কলাভবনে গিয়েছিলাম ফলাফল ঘোষণার বিষয়ে জানতে। হলে হলে ভোট গননা হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ডাকসুর ফল ঘোষণা হবে মনে করে আমি কলাভবনের সামনে গিয়েছিলাম। কলাভবনের চারতলায় সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলে যে যৌথ প্যানেল জিতবে তাতে আমার একটুও সন্দেহ ছিল না। আমাদের হলে জাসদ ছাত্রলীগের সামান্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তবে যারা হলে না থেকে বাইরে থাকতেন তাদের কিছু ভোট তারা পাবে কিন্তু সেটা শয়ের ঘর পেরুবে না বলে আমার ধারণা ছিল। মেয়েদের দুই হলে জেতার ব্যাপারেও আমার কোনো সংশয় ছিল না।

সন্ধ্যা হয় হয় সময় দেখলাম রোকেয়া হলের প্রভোস্ট নীলিমা ইব্রাহিম হন্তদন্ত হয়ে কলাভবনের সামনে এসে শেখ শহীদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ কামালসহ নেতাদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলে আবার হলে ফিরে গেলেন। নেতাদের একটু চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন মনে হলো। শেখ কামাল তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে একটি জিপে উঠে এসএম হলের দিকে গেলেন। কিছু একটা ঘটছে– এ আশঙ্কা থেকে আমি প্রায় দৌড়ে হলে ফিরলাম। জগন্নাথ হলের অ্যাসেমব্লি ভবনে ভোট গননা চলছিল। ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে জটলা করছিল আর ফল শোনার অপেক্ষা করছিল।

আমি অ্যাসেমব্লির সামনে যেতে না যেতেই দেখি ১৫/২০ জনের একটি মিছিল পূর্ববাড়ির গেট দিয়ে ঢুকছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিচ্ছিল। দেখতে না দেখতেই তারা যেখানে ভোট গননা চলছিল সেখানে ঢুকে গেল এবং গুলি বা পটকা ফোটানোর শব্দ কানে এলো। ওই মিছিলকারীরা চিৎকার করে মুজিববাদীদের খুঁজছিল।

মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে এবং সেটা করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। দৌড়াদৌড়ি ধ্বস্তাধ্বস্তিও কিছু হলো। কে যে কাকে ধাওয়া করছে বুঝতে না পেরে আমি উত্তরবাড়ির দিকে একটি নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল শুরু হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ মিছিল। স্লোগান দেওয়া হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথা জাসদ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অল্প সময়ের মধ্যে এটাও জানা গেল যে নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাসদ ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই করেছে। ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করা হলেও ঘটনা যে উল্টো তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আমি যাদের জগন্নাথ হলে ঢুকতে দেখেছি, তাদের দুয়েকজনকে আমি মুজিববাদী ছাত্রলীগের মিছিলে আগে দেখেছি। তাছাড়া ওই সময়ে যে অবস্থা ক্যাম্পাসে ছিল তাতে জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে ব্যালট ছিনতাই করা অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার এই মনোভাব তাৎক্ষণিকভাবে কারো কাছে প্রকাশ করিনি।

দশে চক্রে ভগবান ভূত। সবাই মিলে তখন আমরা জাসদের গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করলাম। ভোটের পরদিন সকালেই সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও জয়ধ্বনি সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত আমাকে বললেন, সকাল ১১টায় জাসদ ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন। আমি যেন জয়ধ্বনির পক্ষ থেকে ওই সংবাদসম্মলনে উপস্থিত থেকে ওরা কি বলে তা ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে জানাই।

আদেশ শিরোধার্য করে আমি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বলাকা ভবনে জাসদ ছাত্রলীগ কার্যালয়ে উপস্থিত হলাম। একটু ভয় যে করছিল না, তা নয়। আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন হিসেবে চিনে যদি গণধোলাই শুরু করে তাহলে কী হবে ভাবছিলাম। তবে আমি ঢাকায় তখনো ছাত্র ইউনিয়নের সামান্য কর্মীর মতোই ছিলাম। তাই আমাকে মেরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে চাইবে না- এটাও মনে হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের জন্য মূলত মুজিববাদী ছাত্রলীগকেই দায়ী করা হয়। বলা হয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ছাত্রলীগ এটা করেছে। রোকেয়া হলের ভোট গননা শেষ হয়েছিল। যৌথ প্যানেল হেরেছিল।

আমার তখনই আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়ে যায়। যৌথ প্যানেল হেরেছে দেখে ফল ঘোষণা না করে নীলিমা আপা নেতাদের কাছে গিয়ে তাদের পরাজয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরাজয় এড়ানোর জন্যই ব্যালট ছিনতাই নাটক।

সংবাদ সম্মেলনে জাসদ ছাত্রলীগ নেতারা আরও নানা তথ্যাদি উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে ঘটনাটি তারা ঘটাননি। যা হোক, সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি ১০ নম্বর পুরানা পল্টনে ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবিস্তারে সব কিছু জানাই।

পরের দিন দৈনিক সংবাদে আব্দুল কাইয়ুম মুকুলের (এখন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক) একটি লেখা ছাপা হয়, যে লেখায় নানা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা হয় যে জাসদ ছাত্রলীগই ডাকসুর ব্যালট ছিনতাই করেছে।

ডাকসুর ব্যালট ছিনতাইয়ের ঘটনার দায় যেভাবে জাসদ ছাত্রলীগের ওপর চাপানো হয়েছিল, সেটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ছাত্রলীগের অপকর্মের ভাগ বহনের এই নীতি মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে। আমরা আমাদের ভালোত্ব দিয়ে ছাত্রলীগকে খারাপ কাজকর্ম থেকে বিরত করে ভালোর পথে নিয়ে আসব– এই ধারণা থেকেই তো তাদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি ভাবা হয়েছিল বলে আমি মনে করেছিলাম। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর আমরা তাদের খারাপটা শুধু মেনে নিলাম না, খারাপের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিলাম।

নেতারা তখন যে সব যুক্তি দিয়েছিলেন, সেগুলো আমার কাছে অনেকটা কুযুক্তি মনে হয়েছে। ডাকসু জাসদ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে গেলে দেশে কী এমন ওলটপালট হতো তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। কোনো সংগঠনের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল না আমার পরিচিত তেমন শিক্ষর্থীরা আমাকে বলতো, তোমরা হলে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!

জাসদ ছাত্রলীগই ব্যালট ছিনতাই করেছে বলে বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু মন থেকে তেমন জোর পেতাম না। কারণ আসল সত্য তো আমি জানতাম। এ নিয়ে যারা বাঁকা কথা বলতো বা টিজ করতো তাদের এড়িয়ে চলতাম। আমার ধারণা, ওই নির্বাচনের পর আমার মতো আরও অনেক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীর মনের জোর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের দূরত্ব বাড়ছিল।

একবার কোনো সংগঠনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লে তাতে আবার জোয়ার সৃষ্টি করা সহজ নয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি এবং একই বছরের সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন ছাত্র ইউনিয়নকে পেছনে ঠেলেছে, আর সামনে সেভাবে আগানোর কোনো উপলক্ষ তৈরি হয়নি বা বলা যায় ছাত্র ইউনিয়ন তেমন উপলক্ষ তৈরিও করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শ শিরোধার্য করে কমিউনিস্ট পার্টি নীতিনির্ধারণ করায় কিছু সমস্যা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থ আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ নিশ্চয়ই অভিন্ন ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র ইউনিয়ন তার গণভিত্তি মজবুত করতে পেরেছিল এ কারণেই যে তখন কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সোভিয়েতের সরাসরি নিয়মিত নির্দেশনা ছিল না। 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে গুলি: সীমান্তে মানুষ পার করা ফিলিপকে খুঁজছে পুলিশ, তাঁর দুই সহযোগী আটক

ড. ইউনূস যদি চান, সারা বাংলাদেশকে কারাগার বানাতে পারেন—আদালতে আনিস আলমগীর

একটা লাশ পড়লে আমরাও কিন্তু লাশ নেব, অত সুশীলতা করে লাভ নেই: মাহফুজ আলম

আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার স্বৈরাচারী আমলে সাংবাদিক দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি

ফুল, প্রশংসা আর ডলারে ভাসছেন বন্ডাই বিচের ‘নায়ক’ আল-আহমেদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

চিররঞ্জন সরকার
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্‌যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ। কিন্তু ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই দৃশ্য ফিকে হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় আয়োজন কাটছাঁট হয়েছে, সামাজিক উদ্‌যাপনও স্পষ্টভাবে কমে গেছে। অথচ ১৬ ডিসেম্বর কেবল একটি দিনের নাম নয়, এটি একটি জাতির জন্মঘোষণা। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা মানে শুধু রাষ্ট্র পাওয়া নয়, মানুষের মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সমতার প্রতিশ্রুতি; লাখো শহীদের রক্ত আর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠা সেই বাংলাদেশ কোনো সমঝোতার ফল নয়, ছিল বঞ্চনা ও দমনের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ।

এই কারণেই বিজয় দিবসকে উপেক্ষা করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। একাত্তরের বিজয় ছাড়া আজকের বাংলাদেশ যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর কথাও অর্থহীন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি, আর এ দেশের কিছু রাজাকার হানাদারদের সহযোগিতা করে যুদ্ধাপরাধ করেছে—এই সত্য ইতিহাসে অমোচনীয়। তাই বিজয় দিবস শুধু উৎসবের দিন নয়; এটি আত্মজিজ্ঞাসার দিন। প্রশ্ন একটাই: যে আদর্শের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছিল, আমরা কি সেই আদর্শ রক্ষা করছি, নাকি স্মরণকে দায়হীন আনুষ্ঠানিকতায় নামিয়ে এনেছি? একটি জাতি টিকে থাকে তখনই, যখন সে নিজের ইতিহাসের সঙ্গে সৎ থাকে।

২০২৫ সালের বিজয় দিবসে এসে এই আত্মসমালোচনাই সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের ক্ষমতাকাঠামো ও সমাজের প্রভাবশালী অংশে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় বা জনপরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন, তাঁদের বক্তব্য, সিদ্ধান্ত ও আচরণে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রতিফলন খুব স্পষ্ট নয়। বরং একটি ইতিহাসবিমুখ প্রবণতা ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে, যেখানে একাত্তরের আদর্শকে পাশ কাটিয়ে অন্য এক পুরোনো মানসিকতাকে নতুন করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক দমনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিসত্তার চূড়ান্ত প্রতিবাদ। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মূল সমস্যা ছিল সেখানে মানুষ নাগরিক ছিল না, ছিল অনুগত প্রজা। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারকে সেখানে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। সেই রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে আমাদের চিন্তা ও সমাজের কোনো মিল ছিল না বলেই আমরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। আজ যখন সেই একই ধরনের ভাবধারার প্রতিধ্বনি নতুন ভাষায়, নতুন মোড়কে ফিরে আসার আভাস দেয়, তখন উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অন্য কোনো সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে তার গুরুত্ব খাটো করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়েই গণ-আন্দোলন হয়েছে, মানুষ রাস্তায় নেমেছে, আত্মত্যাগ করেছে। সেগুলোর মূল্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধ ছিল অস্তিত্বের যুদ্ধ। সেটিই আমাদের রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। কোনো আন্দোলনই তার সমতুল্য হতে পারে না। এই পার্থক্য মুছে ফেলার চেষ্টা আসলে ইতিহাসের ভিত্তিকেই দুর্বল করে।

সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হলো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান অবমাননা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিদ্রূপ, তাঁদের ভাতা বা সম্মান নিয়ে কটাক্ষ, এমনকি তাঁদের আত্মত্যাগকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগের গল্প হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা বাড়ছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে, খেতাবপ্রাপ্ত আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আদালতে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কোথাও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসা ও ন্যূনতম মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অথচ প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে ভুয়া সনদধারীরা সুবিধা ভোগ করছেন। এই বৈষম্য শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা মানে একটি জাতির নিজের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা। যে মানুষগুলো পরিবার, স্বপ্ন ও জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের প্রতি অসম্মান দেখালে সমাজ ধীরে ধীরে আত্মসম্মান হারায়। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সমাজের বড় অংশ নীরব থাকছে। হয়তো ক্লান্তি থেকে, হয়তো ভয় থেকে, কিংবা ইতিহাসকে ঝামেলার বিষয় মনে করে। কিন্তু এই নীরবতা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। ইতিহাস কখনো নীরবতার দায় ক্ষমা করে না।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে আদর্শিক শূন্যতার। সংবিধানের যে চারটি মূলনীতি একাত্তরের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছিল, সেগুলো আজ প্রশ্নের মুখে। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি জোরালো হচ্ছে, গণতন্ত্রের জায়গায় শক্তির রাজনীতি দৃশ্যমান, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে বৈষম্য প্রকট। এসব একসঙ্গে মিলেই রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।

এখানে একটি বিষয় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা জরুরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো একক রাজনৈতিক দল, সরকার বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পত্তি নয়। এটি কোনো ক্ষমতাসীন মতাদর্শের লাইসেন্সও নয়, আবার কোনো বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধ-যুক্তিও নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি জাতির সামষ্টিক নৈতিক অর্জন, যা রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। একে অস্বীকার করা মানে শুধু একটি ইতিহাসকে অস্বীকার করা নয়; মানে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। এই চেতনাকে নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, ব্যাখ্যার পার্থক্য স্বাভাবিক, এমনকি সমালোচনাও গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তা অস্বীকার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, অস্বীকারের মধ্য দিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়, আর ইতিহাস মুছে গেলে সমাজ দিশাহীন হয়ে পড়ে।

যাঁরা বলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করলেই সমাজ বিভক্ত হয়, তাঁদের এই বক্তব্য আসলে বিভক্তির কারণ ও ফলাফলকে গুলিয়ে ফেলার শামিল। বিভক্তি তৈরি হয় সত্য উচ্চারণে নয়, বিভক্তি তৈরি হয় সত্য চাপা দিতে গিয়ে। ইতিহাসের বেদনাদায়ক অধ্যায় নিয়ে নীরবতা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে না; বরং অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিকৃত বয়ানের সুযোগ তৈরি করে। কোনো জাতি যদি নিজের জন্মকথা খোলাখুলি স্বীকার করতে না পারে, তবে সে জাতির ঐক্য হয় ভঙ্গুর, বাহ্যিক ও স্বার্থনির্ভর। প্রকৃত ঐক্য আসে ঐতিহাসিক সত্য মেনে নেওয়ার মাধ্যমে, ভুলে যাওয়ার অভিনয়ের মাধ্যমে নয়।

বিজয় দিবস তাই নিছক আনুষ্ঠানিকতা বা রাষ্ট্রীয় উৎসবের দিনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এটি আমাদের সামনে একটি নৈতিক আয়না মেলে ধরে, যেখানে আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, আমরা কি সত্যিই সেই দেশের দিকে এগোচ্ছি, যে দেশের স্বপ্নে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী-পুরুষনির্বিশেষে মানুষ জীবন দিয়েছিল? রাষ্ট্রীয় নীতি, সামাজিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি সেই মানবিকতা, সাম্য ও মর্যাদার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? নাকি আমরা এমন এক সমাজ নির্মাণ করছি, যেখানে ক্ষমতা ও সুবিধার হিসাব ইতিহাসের দায়কে ছাপিয়ে যাচ্ছে?

এই প্রশ্ন আরও তীব্র হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রসঙ্গে। আমরা কি আমাদের সন্তানদের এমন একটি ইতিহাস দিতে পারছি, যেখানে তারা আত্মবিশ্বাস ও গর্ব নিয়ে বলতে পারবে, এই দেশ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, মানুষের মর্যাদার পক্ষে লড়েছিল? নাকি আমরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করছি, যেখানে জন্মকথা বলতে গিয়ে তাদের অস্বস্তি হবে, দ্বিধা হবে, কিংবা নীরব থাকাই নিরাপদ মনে হবে? একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কিছু হতে পারে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই দেশ কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা বা প্রশাসনিক আপসের ফল নয়। এটি রক্ত, বেদনা ও আত্মত্যাগের ফল। একাত্তরের চেতনা কোনো জাদুঘরের প্রদর্শনী নয়, কোনো বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতার অংশও নয়। এটি একটি জীবন্ত নৈতিক কম্পাস, যা আমাদের বলে দেয় কোন পথে গেলে আমরা মানুষ হিসেবে উন্নত হব, আর কোন পথে গেলে ক্ষমতাশালী হলেও নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ব। সেই কম্পাস যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, আমরা হয়তো এগোতে থাকব, অর্থনৈতিক সূচক বাড়বে, অবকাঠামো দাঁড়াবে, কিন্তু জানব না আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি, কিংবা কী হারাচ্ছি।

বিজয় দিবসে তাই আমাদের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত এই চেতনাকে নতুন করে ধারণ করা। আবেগের আতিশয্যে নয়, প্রতিহিংসার ভাষায় নয়, বরং মানবিকতা, সংযম ও দৃঢ়তার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করতে, আবার ভিন্নমতের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতেও নয়। এই ভারসাম্যই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেই শিক্ষা ভুলে না গেলে মুক্তিযুদ্ধ অতীত হয়েও ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে গুলি: সীমান্তে মানুষ পার করা ফিলিপকে খুঁজছে পুলিশ, তাঁর দুই সহযোগী আটক

ড. ইউনূস যদি চান, সারা বাংলাদেশকে কারাগার বানাতে পারেন—আদালতে আনিস আলমগীর

একটা লাশ পড়লে আমরাও কিন্তু লাশ নেব, অত সুশীলতা করে লাভ নেই: মাহফুজ আলম

আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার স্বৈরাচারী আমলে সাংবাদিক দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি

ফুল, প্রশংসা আর ডলারে ভাসছেন বন্ডাই বিচের ‘নায়ক’ আল-আহমেদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল বাঙালি।	ছবি: অমিয় তরফদার
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল বাঙালি। ছবি: অমিয় তরফদার

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বাত্মক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যায়নি, লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্ব করেছেন। এরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নন, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করতেও তাঁরা প্রস্তুত থেকেছেন। লুণ্ঠনকারীরা সেটাই করেন; মুফতে-পাওয়া সম্পত্তির প্রতি তাঁদের কোনো মায়া, মমতা থাকে না। বাম উগ্রপন্থীদের কেউ কেউ আবার বলতে চেয়েছেন যে স্বাধীনতা আসেনি, রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে মাত্র। এসব বিচ্ছেদ ও বিভ্রান্তির কারণে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে—এমন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারেনি।

একাত্তরের পরে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। তাঁদের দলীয় তরুণদের একাংশ দেখছিল তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারছে না, অপরাংশের তুলনায় তারা সুবিচার পাচ্ছে না। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বের হয়ে এসে নতুন সংগঠন গড়েছে, নাম দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাদেরও যেহেতু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন ছিল এবং এই শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কাছ থেকে পাবে বলে আশা করা যাচ্ছিল না, তাই তারা জনগণের কাছে গেল। জানত তারা যে জনগণ পুরোনো আওয়াজে আর সাড়া দেবে না। তাই নতুন রণধ্বনি তুলল সমাজতন্ত্রের এবং হাজার হাজার তরুণ, যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছিল, যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পায়নি, তারা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ওই দলে। ওই দলের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে, কিন্তু মূল দলসহ বাদবাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে।

আলবদর, রাজাকাররা ফিরে এসেছে, অধিক শক্তিমত্তায়। মৌলবাদ শক্তিশালী হয়েছে। এর মূল কারণ ওই একটাই, চব্বিশের রেজিম পরিবর্তনে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজ একটা ধাক্কা খেয়েছে, সে নড়ে উঠেছে, কিন্তু এমনভাবে আধুনিক হয়নি যে রাজাকার ও মৌলবাদ অতীতের প্রাণী বলে চিহ্নিত হবে, পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে। ক্ষমতায় যারা যাতায়াত করে, রাজাকার ও মৌলবাদ তাদের কাছে যথার্থ অর্থে দূরের নয়। কারও জন্য খুব কাছের, কারও জন্য ততটা কাছের নয়; ব্যবধান এইটুকুই, সেটা মাত্রাগত, গুণগত নয়। সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের চেষ্টা যদি চলত তাহলে এরা প্রশ্রয় পেত না। শাসকশ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে দুই কারণে। এক. জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়িত্বের অভিপ্রায়ে। দুই. নিজেরাই যেসব অন্যায় করছে, তার দরুন তৈরি অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ভরসায়।

বাংলাদেশের জন্য গ্রামই ছিল ভরসা। আন্দোলনে গ্রাম না এলে জয় আসেনি। বিপদের সময় গ্রাম যদি আশ্রয় না দিত তবে বিপদ ভয়াবহ হতো। গ্রামেই রয়েছে উৎপাদক শক্তি। গ্রামবাসীর শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন করেই ধনীরা ধনী হয়েছেন। এখনো গ্রাম কাজে লাগছে বিদেশ থেকে সাহায্য, ঋণ, দান ইত্যাদি এনে তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করার অজুহাত ও অবলম্বন হিসেবে।

একাত্তরে আমরা গ্রামে গেছি। বাড়িঘর, মজা পুকুর, হারিয়ে যাওয়া খেত, মৃতপ্রায় গাছপালা—এসবের খোঁজখবর করেছি। শহর তখন চলে গেছে শত্রুর কবলে, যাকগে, আমরা গ্রামেই থাকব—এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের পতন ঘটেছে সর্বাগ্রে, গ্রামের ঘটেনি; যদি ঘটত তাহলে আমাদের পক্ষে অত দ্রুত বিজয় সম্ভব হতো না।

কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র গ্রামে যারা গিয়েছিল তারা যত দ্রুতগতিতে গেছে তার চেয়ে দ্রুতগতিতে ফেরত চলে এসেছে। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর, কারখানা, অফিস, পদ, গাড়ি—যে যেটা পেরেছে লুণ্ঠন করেছে। পাকিস্তানিরা অব্যাহতভাবে লুণ্ঠন করেছিল ২৪ বছর, বিশেষ করে ৯ মাসে তাদের তৎপরতা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল, তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। স্বাধীনতার পরে সুবিধাভোগীরা শোধ নিয়েছে। লুটপাট করেছে স্বাধীনভাবে। এখনো করছে।

গ্রাম রইল সেখানেই, যেখানে ছিল। বস্তুত খারাপই হলো তার অবস্থা। পাকিস্তানিরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছে। ঘর পুড়িয়েছে, ফসল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে গ্রামবাসী পুরোনো জীবন ফিরে পায়নি। অবকাঠামো গিয়েছিল ভেঙে। বন্যা এল। এল দুর্ভিক্ষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল।

গ্রাম এখন ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আশ্রয়দাতা হিসেবে নয়, আসছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। তার হাত দুটি মুক্তিযোদ্ধার নয়, হাত তার ভিখারির। ফলে শহর এখন বিপন্ন মনে করছে নিজেকে। ভাবছে আবার তার পতন ঘটবে—এবার পাকিস্তানিদের হাতে নয়, গরিব বাংলাদেশিদের হাতে। মনে হচ্ছে আবারও একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই দুটি দাবি এসেছিল মুক্তির জাগ্রত আকাঙ্ক্ষা থেকেই। পাকিস্তান আমলে তৈরি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত বিভাজনকে নাকচ করে দিতে চেয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মূলনীতি দুটি যে বিদায় করে দেওয়া হলো, সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বাভাবিক ঘটনা বটে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাসের একমাত্র জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে জনতার জয় হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী জনতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, ক্ষমতা আগের মতোই চলে যাচ্ছিল অল্পকিছু মানুষের হাতে। পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর নতুন যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা শুধু ক্ষমতাই বুঝেছেন, অন্য কিছু বুঝতে চাননি। তাঁরা জনগণের লোক নন, জনগণের আদর্শ তাঁদের নয়। তাঁদের আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থান ছিল না। তাঁরা তাঁদের আদর্শকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপর ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিলেও, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেছেন, সেটা বলা যাবে না। সংগত কারণে তাঁরাও তো সরিয়ে দেওয়া মূলনীতি দুটি ফেরত আনেননি। ফেরত আনা পরের কথা, তাঁরা সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে। এই উদাসীনতা তাৎপর্যহীন নয়। বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হয়তোবা অতীতের স্মৃতিতেই পরিণত হবে, কারও কারও হয়তো মনে এমন আশা রয়েছে।

মূল সত্যটা হচ্ছে এই যে জনগণের কাছে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা থেকে তারা অনেক দূরে। সামরিক সরকারের আমলে দূরে ছিল, নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেই দূরেই রয়ে গেছে। বর্তমান আমলেও তদ্রূপ। এই দূরত্ব আগামী দিনে বাড়বে না, বরং কমে আসবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তা তো বলা যাবে না। জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কই? কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কোথায়?

রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বড় পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো এমনি এমনি ঘটেনি, বিত্তবানদের কারণেও ঘটেনি। প্রতিটির পেছনেই জনগণ ছিল। ১৯৪৬-এ সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। ১৯৭১-এ সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাতেই রাষ্ট্র বদলেছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ; ওই স্বাধীনতায় মুক্তি এল না। উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ল। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকারের, তার সামনে মুক্তির লক্ষ্যটা ছিল আরও স্পষ্ট, আরও প্রত্যক্ষ। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে কি? মুক্তি এসেছে কি মানুষের? সে তো মনে হয় অনেক দূরের ব্যাপার।

মুক্তি না আসার কারণটি হচ্ছে এই যে সংগ্রাম জনগণই করেছে এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ কী? জনগণ তো ব্যক্তি নয়, এক নয়, তারা বহু, অসংখ্য, কে নেতা হবে কাকে ফেলে? জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের স্বার্থ দেখবে—এমন সংগঠনের হাতে নেতৃত্ব থাকা। স্বার্থটাই আসল কথা। আওয়াজ উঠতে পারে নানাবিধ, আওয়াজ মানুষকে উদ্বুদ্ধও করে নানাভাবে, কিন্তু ধ্বনি যথেষ্ট নয়, কার স্বার্থে ধ্বনি উঠেছে সেটাই জরুরি।

না, তেমন যুদ্ধ ঘটবে না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ তো চলছেই কোনো না কোনোভাবে। মানুষ যে মুক্ত হয়নি, সেটা কারও কাছেই অস্পষ্ট নয়। ওই যুদ্ধকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা শাসকশ্রেণির দল করবে না। তার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। ডান দিকের নয়, বাম দিকের।

বলা হয়, গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরুর শাসন। কিন্তু আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা, অর্থাৎ ধনীরা শাসন করেন সংখ্যাগুরুকে, অর্থাৎ গরিবকে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। এটা চলবেও না। এই জন্য যে সংখ্যাগুরু সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা মুক্তি চান। পরিবর্তন একটা ঘটবেই। প্রশ্ন হলো, কবে এবং কীভাবে। স্বাধীনতা ওই বড় পরিবর্তনের জন্যই প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বে যদি জাতীয় মুক্তি না আসে।

মুক্তির প্রশ্নটি এখন আর আঞ্চলিক নয়। দ্বন্দ্ব এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নয়, প্রশ্নটি এখন শ্রেণিগত, দ্বন্দ্ব এখন বাঙালি ধনীর সঙ্গে বাঙালি গরিবের। বিষয়টা এমন পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেত না বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো। স্বাধীনতা আমাদের খুবই জরুরি ছিল, সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে গুলি: সীমান্তে মানুষ পার করা ফিলিপকে খুঁজছে পুলিশ, তাঁর দুই সহযোগী আটক

ড. ইউনূস যদি চান, সারা বাংলাদেশকে কারাগার বানাতে পারেন—আদালতে আনিস আলমগীর

একটা লাশ পড়লে আমরাও কিন্তু লাশ নেব, অত সুশীলতা করে লাভ নেই: মাহফুজ আলম

আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার স্বৈরাচারী আমলে সাংবাদিক দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি

ফুল, প্রশংসা আর ডলারে ভাসছেন বন্ডাই বিচের ‘নায়ক’ আল-আহমেদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আজ বিজয়ের দিন

সম্পাদকীয়
আজ বিজয়ের দিন

ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় আজকের দিনে। ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে; তবু ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এত বড় অর্জন আর দ্বিতীয়টি হয় না। লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা গৌরবের। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই সব শহীদের আত্মদানের কথা, যাঁদের রক্ত দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের মানুষ এত বছরেও স্বস্তি পায়নি। যারা যখনই এ দেশকে শাসন করতে চেয়েছে বা করেছে, তাদের অসৎ, অসাধু, দুর্নীতিবাজ আচরণ জনগণকে স্বস্তি দিতে পারেনি। যার যার মতো করে তারা দেশের ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সাজাতে চেয়েছে। ফলে মত-দ্বিমতের জালে বারবার আটকা পড়েছে সেই ইতিহাস। তবে সেই সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো যে মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং চেতনায় ধারণ করতে হবে। অগ্রজদের দায়িত্ব এই চেতনা তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া—বিকৃত করে নয় বরং সঠিক ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে। এই জানানোটা যেন আবার যান্ত্রিক কিংবা শুধু কেতাবি না হয়। মা-বাবা বা যেকোনো অভিভাবক তাঁদের কথা, কাজ, আচরণে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকাশ করবেন, তখনই একটি পরিবারের নতুন প্রজন্ম সেই চেতনাকে ধারণ করতে শিখবে, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সত্যিকারের স্বাদ পাবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে যে দেশটি বাঙালি জাতি গড়েছিল, সেই দেশে কোনো দুর্নীতি, অসততা, অপরাধ, বৈষম্য থাকবে না বলেই তো শপথ নেওয়া হয়েছিল। বিজয়ের ৫৪ বছরেও যাঁরা প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাবের খাতা খুলে বসেন, তাঁরা হয়তো দেনার হিসাবটা করেন না। তবে তাঁরাও এ বিষয়ে সহমত হবেন যে ওই সব শপথ পূরণ করতে পারেনি কোনো রাজনৈতিক দলই। বরং সবাই মিলে শপথ ভঙ্গই করেছে। কোন আমলে হয়নি দুর্নীতি, খুনখারাবি, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ?

অথচ সবাই মিলেই গড়ে তোলা যেত একটি আদর্শ সমাজ। যে সমাজে কোনো নেতা প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হতেন না, কোনো শিশু বা বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করা হতো না, কারও বাড়িতে ঢুকে তাকে খুন করা হতো না। সেই সমাজ শতভাগ গড়া না গেলেও অন্তত অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা অসম্ভব কিছু নয়।

‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়’—এই সত্য বুকে ধারণ করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া কি এতটাই কঠিন? জাতিকে বিভাজিত করে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ বানিয়ে শান্তি আনা যায় না, এ কথা সবার মনে রাখা উচিত।

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে গুলি: সীমান্তে মানুষ পার করা ফিলিপকে খুঁজছে পুলিশ, তাঁর দুই সহযোগী আটক

ড. ইউনূস যদি চান, সারা বাংলাদেশকে কারাগার বানাতে পারেন—আদালতে আনিস আলমগীর

একটা লাশ পড়লে আমরাও কিন্তু লাশ নেব, অত সুশীলতা করে লাভ নেই: মাহফুজ আলম

আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার স্বৈরাচারী আমলে সাংবাদিক দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি

ফুল, প্রশংসা আর ডলারে ভাসছেন বন্ডাই বিচের ‘নায়ক’ আল-আহমেদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি মহলের বিতর্কিত কথাবার্তা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩২

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। ‌এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।

দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।

কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?

এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।

গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।

এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।

মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?

যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?

একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।

আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।

এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?

ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।

সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?

এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।

জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।

যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদিকে গুলি: সীমান্তে মানুষ পার করা ফিলিপকে খুঁজছে পুলিশ, তাঁর দুই সহযোগী আটক

ড. ইউনূস যদি চান, সারা বাংলাদেশকে কারাগার বানাতে পারেন—আদালতে আনিস আলমগীর

একটা লাশ পড়লে আমরাও কিন্তু লাশ নেব, অত সুশীলতা করে লাভ নেই: মাহফুজ আলম

আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার স্বৈরাচারী আমলে সাংবাদিক দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি

ফুল, প্রশংসা আর ডলারে ভাসছেন বন্ডাই বিচের ‘নায়ক’ আল-আহমেদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত