বিভুরঞ্জন সরকার
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন, রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে রাজনৈতিক দল শতাধিক থাকতেই পারে। সব দলের নাম সবাই না জানলেও ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন জন্ম নেওয়া একটি দলের নাম এর মধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন। দলটির নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। মূলত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ নিয়ে গঠিত এই দল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কৌতূহল আছে, আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। প্রচারেই প্রসার বলে একটি কথা আমাদের দেশে চালু আছে। এনসিপি নিয়ে যেহেতু প্রচার আছে, সেহেতু এর প্রসারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শাসক দল হওয়ার আশা নিয়েই দলটি যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে জন্ম নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে শাসক দল হওয়ার গৌরব অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আর জাতীয় পার্টির জনক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দুজনই সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিতে আসা মানুষ, সেনাশাসক হিসেবে পরিচিত।
এনসিপির তেমন কোনো একক প্রতিষ্ঠাতার নাম বলা যাবে না। তবে দলের প্রথম আহ্বায়ক যেহেতু সাবেক সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সেহেতু দলের একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম বলা হলে অন্যায় হবে বলে মনে হয় না। শাসক হওয়ার লক্ষণ এই দলের আছে। কোনো সেনাশাসকের প্রেরণায় না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশীর্বাদের হাত এই দলের উদ্যোক্তাদের মাথার ওপর আছে বলেই মানুষের ধারণা। ড. ইউনূস রাজনীতির মানুষ না হয়েও এখন দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থাৎ, তিনিই এখন দেশের প্রধান শাসক। এই দলের ওপর আশীর্বাদ আছে আরও অন্তত দুজন উপদেষ্টার। আবার নাহিদ ইসলামও সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাই শাসক দলের তকমা এনসিপির গায়ে না থাকলেও শাসক দল হওয়ার তীব্র বাসনা এই দলের থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
২২ জুন নির্বাচন কমিশনে নতুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার দিন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দেওয়া বক্তব্যে সেই শাসক দল হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশন ৪০০ আসনের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে ৩০০টি আসনে বিজয়ী হবে এনসিপি। এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী, সাহসী ও চমকপ্রদ রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেটি কি বাস্তবসম্মত?
প্রথমেই বলা দরকার, ৪০০ আসনের প্রস্তাব এখনো অনুমোদিত নয়, এটি রয়েছে কেবল কমিশনের সুপারিশ পর্যায়ে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৩০০টি সাধারণ এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। এই কাঠামো পরিবর্তনের কোনো আইনি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে একটি অনিবন্ধিত নবীন রাজনৈতিক দল যদি দাবি করে যে তারা ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০টি আসন পাবে, তাহলে তা কারও কাছে অবান্তর বলে বিবেচিত হতে পারে। যে দলের এখনো দেশজুড়ে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠেনি, মাঠপর্যায়ের তৎপরতা নগণ্য এবং এখনো কোনো নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি, সেই দলের একজন নেতার এমন উচ্চারণ বাত কা বাত ভাবার কোনো কারণ নেই। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ হলো ‘সব সম্ভবের দেশ’।
বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বড় জয় কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অসম্ভব নয়, তবে তা এসেছে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই, সাংগঠনিক প্রাচুর্য এবং জনসম্পৃক্ততার ভিত্তিতে। যেমন ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয় পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল তার মূল ভিত্তি। আবার ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসনে জয় পায় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে এই জয় ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুফল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৫০টির বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল সেনাশাসনের আবহে একটি বিরোধীবিহীন নির্বাচনের ফসল। এরশাদ আমলেই একমাত্র প্রায় ৩০০ আসনের পূর্ণ দখলের নজির রয়েছে, যা ছিল বিতর্কিত ও নিয়ন্ত্রিত ভোটব্যবস্থার প্রতিফলন।
আগের নির্বাচনগুলোতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলেও এবার তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা নিয়েই রাজনীতির মাঠে আছে। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপির ৩০০ আসনে জয়ী হওয়ার আশাকে নিছক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বললে ভুল হবে। এর ভেতর আরেকটি বার্তা নিহিত—এনসিপি নিজেকে শুধু একটি নতুন দল নয়, বরং বিকল্প সরকার হিসেবে ভাবছে। তারা হয়তো ধরেই নিচ্ছে যে আওয়ামী লীগ গত আগস্টে হঠাৎ ‘নাই’ হওয়া, জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো—এই ফাঁকে তারা সেই ‘শূন্যস্থানে’ জায়গা করে নেবে। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন, বর্তমানে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে কেন গণনার বাইরে রাখছে এনসিপি? বিএনপিকে দেখেও না দেখার কি কোনো বিশেষ মাজেজা আছে? অথচ লন্ডন বৈঠকে ইউনূস-তারেক সমঝোতার খুশির জোয়ারে ভাসছে বিএনপি।
এখানেই আরেকটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে আসে—আগামী নির্বাচন কি তাহলে ১৯৭৯ বা ১৯৮৬ সালের মডেলে হতে যাচ্ছে? যেমন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিএনপিকে বিজয়ী করেছিলেন। এরশাদ তাঁর সময়েও একই কৌশলে জাতীয় পার্টিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এবং নির্বাচনী বৈধতা নিশ্চিত করেছিলেন। এখন যদি ক্ষমতার আশপাশে অবস্থানরত কোনো মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় এনসিপি তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কি তৃতীয় শক্তির নামান্তর? প্রশ্নগুলো অমূলক নয়। ইতিহাস বলছে—নতুন দল হঠাৎ করেই ২০০ বা ৩০০ আসন জেতার নজির কেবল স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরেই সংঘটিত হয়েছে।
এনসিপির বক্তব্যের আরও একটি দিক নজর কাড়ে—তাদের প্রতীকপ্রীতি। তারা নির্বাচন কমিশনে ‘শাপলা’ প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে। দলটির নেতারা বলছেন, শাপলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক, গ্রামীণ জনজীবনের প্রতিচ্ছবি এবং গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতীক। তাঁরা দাবি করেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হলেও আইনগতভাবে শাপলা গ্রহণে বাধা নেই।’ অথচ সংবিধান ও ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ১৩০ নম্বর আদেশ অনুযায়ী, শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক। এই প্রতীকের কোনো অবমাননা, বিকৃতি বা রাজনৈতিক ব্যবহারে আইনি নিষেধ রয়েছে। আইনের ভাষায়, কেউ যদি জাতীয় প্রতীক অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক বছরের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে এনসিপি যদি ‘শাপলা’ প্রতীক চায়, তাহলে তা সরাসরি জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের চেষ্টার মধ্যে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক শাহদীন মালিক স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হিসেবে যেহেতু শাপলা আইন করে নির্ধারিত, সেহেতু রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে এর ব্যবহার বেআইনি।’ এনসিপির পক্ষ থেকে অবশ্য যুক্তি এসেছে—জাতীয় ফল কাঁঠাল একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক, ধানের শীষও কোনো না কোনোভাবে জাতীয় পর্যায়ের প্রতীক। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি বড় পার্থক্য। কাঁঠাল বা ধানের শীষ জাতীয় প্রতীক হলেও তা রাষ্ট্রীয় সিলমোহর নয়, কিন্তু শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে রয়েছে—জাতীয় পতাকার পাশে এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়, সরকারি দলিল ও কাগজপত্রে তার ছাপ থাকে। অতএব এর ব্যবহার একেবারে সীমিত, তা রাজনৈতিক প্রতীক হতে পারে না।
প্রসঙ্গত, নাগরিক ঐক্য নামক একটি ছোট দলও একই প্রতীক চেয়ে পায়নি। এখন যদি শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া হয়, তাহলে তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং সেটি অবৈধ ঘোষণা হলে নতুন করে বিতর্ক জন্ম নেবে। তবে এনসিপির নেতারা কৌশলগতভাবে বলছেন, ‘শাপলা না পেলে অন্য প্রতীক নেব, তবে শাপলাই আমাদের প্রধান পছন্দ।’ এর পেছনেও রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে। প্রতীকের মাধ্যমে গ্রামীণ ভোটারদের মনোযোগ পাওয়া সহজ। শাপলা ফুল প্রতীক হিসেবে পেলে রাজনৈতিকভাবে আবেগ তৈরি করতে পারে।
একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ—এনসিপি আসলে কারা? কারা এই দলটির পেছনে? এত আত্মবিশ্বাস, সংবাদমাধ্যমে এত সাড়া—এসব কি কেবল উৎসাহপ্রাপ্ত কিছু নাগরিকের উদ্যোগের ফল? নাকি এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক সুবিধাভোগীদের একাংশ বা এটা ক্ষমতার একাংশের কোনো বিশেষ প্রজেক্ট? বাংলাদেশে এমন ‘প্রজেক্ট দল’-এর অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তবে সব ‘প্রজেক্ট দল’ আবার সফল হয় না। অতীতেও দেখা গেছে, হঠাৎ তৈরি হওয়া দল কিছুদিন পরে হারিয়ে গেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বিকল্প শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী দলও শেষ পর্যন্ত বড় দুই পুরোনো দলের সঙ্গে মিতালি করতে গিয়ে মরুপথে হারিয়েছে দিশা। জনগণ যদি প্রকৃত অর্থে বিকল্প রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, তবে সেই দলকে অবশ্যই মাঠে, পাড়ায়, ইউনিয়নে, রাস্তায়, ক্যানভাসে প্রমাণ করতে হয়। কেবল টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলে দল বড় হয় না।
এনসিপির এই আত্মবিশ্বাস যদি বাস্তব হয়, তাহলে তাকে মাঠে প্রমাণ দিতে হবে। যদি অলীক হয়, তবে সেটি জনতার চোখে ধরা পড়বে। দলটির পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, ‘৩০০ আসন আমাদের ঘরে থাকবে’—তবে সেই ঘরের দরজা খুলে দেখতে হবে, সেখানে প্রকৃতপক্ষে কী রসদ জমা আছে!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় বা বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি সেই শক্তির গ্রহণযোগ্যতা অর্জন একটি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রা। এনসিপি যদি সত্যিই জনগণের শক্তি হতে চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে বাস্তববাদী রাজনীতি, সক্রিয় সাংগঠনিক বিস্তার এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে আসা। বক্তৃতা আর প্রতীক দিয়ে রাজনীতি হয় না, লাগে ত্যাগ, লাগে পথচলা, লাগে জনগণের হৃদয় জয় করার সাহস। ৩০০ আসনের দাবি তখনই অর্থবহ হবে, যখন জনগণ সত্যি হাত তুলে এগিয়ে যাবে এনসিপির দিকে। আর যদি জনগণ না চায়, তবে হাজার বক্তব্য দিয়েও তা সম্ভব হবে না। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনগণ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:

বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন, রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে রাজনৈতিক দল শতাধিক থাকতেই পারে। সব দলের নাম সবাই না জানলেও ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন জন্ম নেওয়া একটি দলের নাম এর মধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন। দলটির নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। মূলত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ নিয়ে গঠিত এই দল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কৌতূহল আছে, আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। প্রচারেই প্রসার বলে একটি কথা আমাদের দেশে চালু আছে। এনসিপি নিয়ে যেহেতু প্রচার আছে, সেহেতু এর প্রসারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শাসক দল হওয়ার আশা নিয়েই দলটি যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে জন্ম নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে শাসক দল হওয়ার গৌরব অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আর জাতীয় পার্টির জনক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দুজনই সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিতে আসা মানুষ, সেনাশাসক হিসেবে পরিচিত।
এনসিপির তেমন কোনো একক প্রতিষ্ঠাতার নাম বলা যাবে না। তবে দলের প্রথম আহ্বায়ক যেহেতু সাবেক সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সেহেতু দলের একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম বলা হলে অন্যায় হবে বলে মনে হয় না। শাসক হওয়ার লক্ষণ এই দলের আছে। কোনো সেনাশাসকের প্রেরণায় না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশীর্বাদের হাত এই দলের উদ্যোক্তাদের মাথার ওপর আছে বলেই মানুষের ধারণা। ড. ইউনূস রাজনীতির মানুষ না হয়েও এখন দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থাৎ, তিনিই এখন দেশের প্রধান শাসক। এই দলের ওপর আশীর্বাদ আছে আরও অন্তত দুজন উপদেষ্টার। আবার নাহিদ ইসলামও সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাই শাসক দলের তকমা এনসিপির গায়ে না থাকলেও শাসক দল হওয়ার তীব্র বাসনা এই দলের থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
২২ জুন নির্বাচন কমিশনে নতুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার দিন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দেওয়া বক্তব্যে সেই শাসক দল হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশন ৪০০ আসনের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে ৩০০টি আসনে বিজয়ী হবে এনসিপি। এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী, সাহসী ও চমকপ্রদ রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেটি কি বাস্তবসম্মত?
প্রথমেই বলা দরকার, ৪০০ আসনের প্রস্তাব এখনো অনুমোদিত নয়, এটি রয়েছে কেবল কমিশনের সুপারিশ পর্যায়ে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৩০০টি সাধারণ এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। এই কাঠামো পরিবর্তনের কোনো আইনি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে একটি অনিবন্ধিত নবীন রাজনৈতিক দল যদি দাবি করে যে তারা ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০টি আসন পাবে, তাহলে তা কারও কাছে অবান্তর বলে বিবেচিত হতে পারে। যে দলের এখনো দেশজুড়ে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠেনি, মাঠপর্যায়ের তৎপরতা নগণ্য এবং এখনো কোনো নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি, সেই দলের একজন নেতার এমন উচ্চারণ বাত কা বাত ভাবার কোনো কারণ নেই। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ হলো ‘সব সম্ভবের দেশ’।
বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বড় জয় কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অসম্ভব নয়, তবে তা এসেছে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই, সাংগঠনিক প্রাচুর্য এবং জনসম্পৃক্ততার ভিত্তিতে। যেমন ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয় পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল তার মূল ভিত্তি। আবার ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসনে জয় পায় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে এই জয় ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুফল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৫০টির বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল সেনাশাসনের আবহে একটি বিরোধীবিহীন নির্বাচনের ফসল। এরশাদ আমলেই একমাত্র প্রায় ৩০০ আসনের পূর্ণ দখলের নজির রয়েছে, যা ছিল বিতর্কিত ও নিয়ন্ত্রিত ভোটব্যবস্থার প্রতিফলন।
আগের নির্বাচনগুলোতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলেও এবার তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা নিয়েই রাজনীতির মাঠে আছে। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপির ৩০০ আসনে জয়ী হওয়ার আশাকে নিছক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বললে ভুল হবে। এর ভেতর আরেকটি বার্তা নিহিত—এনসিপি নিজেকে শুধু একটি নতুন দল নয়, বরং বিকল্প সরকার হিসেবে ভাবছে। তারা হয়তো ধরেই নিচ্ছে যে আওয়ামী লীগ গত আগস্টে হঠাৎ ‘নাই’ হওয়া, জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো—এই ফাঁকে তারা সেই ‘শূন্যস্থানে’ জায়গা করে নেবে। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন, বর্তমানে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে কেন গণনার বাইরে রাখছে এনসিপি? বিএনপিকে দেখেও না দেখার কি কোনো বিশেষ মাজেজা আছে? অথচ লন্ডন বৈঠকে ইউনূস-তারেক সমঝোতার খুশির জোয়ারে ভাসছে বিএনপি।
এখানেই আরেকটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে আসে—আগামী নির্বাচন কি তাহলে ১৯৭৯ বা ১৯৮৬ সালের মডেলে হতে যাচ্ছে? যেমন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিএনপিকে বিজয়ী করেছিলেন। এরশাদ তাঁর সময়েও একই কৌশলে জাতীয় পার্টিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এবং নির্বাচনী বৈধতা নিশ্চিত করেছিলেন। এখন যদি ক্ষমতার আশপাশে অবস্থানরত কোনো মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় এনসিপি তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কি তৃতীয় শক্তির নামান্তর? প্রশ্নগুলো অমূলক নয়। ইতিহাস বলছে—নতুন দল হঠাৎ করেই ২০০ বা ৩০০ আসন জেতার নজির কেবল স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরেই সংঘটিত হয়েছে।
এনসিপির বক্তব্যের আরও একটি দিক নজর কাড়ে—তাদের প্রতীকপ্রীতি। তারা নির্বাচন কমিশনে ‘শাপলা’ প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে। দলটির নেতারা বলছেন, শাপলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক, গ্রামীণ জনজীবনের প্রতিচ্ছবি এবং গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতীক। তাঁরা দাবি করেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হলেও আইনগতভাবে শাপলা গ্রহণে বাধা নেই।’ অথচ সংবিধান ও ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ১৩০ নম্বর আদেশ অনুযায়ী, শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক। এই প্রতীকের কোনো অবমাননা, বিকৃতি বা রাজনৈতিক ব্যবহারে আইনি নিষেধ রয়েছে। আইনের ভাষায়, কেউ যদি জাতীয় প্রতীক অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক বছরের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে এনসিপি যদি ‘শাপলা’ প্রতীক চায়, তাহলে তা সরাসরি জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের চেষ্টার মধ্যে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক শাহদীন মালিক স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হিসেবে যেহেতু শাপলা আইন করে নির্ধারিত, সেহেতু রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে এর ব্যবহার বেআইনি।’ এনসিপির পক্ষ থেকে অবশ্য যুক্তি এসেছে—জাতীয় ফল কাঁঠাল একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক, ধানের শীষও কোনো না কোনোভাবে জাতীয় পর্যায়ের প্রতীক। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি বড় পার্থক্য। কাঁঠাল বা ধানের শীষ জাতীয় প্রতীক হলেও তা রাষ্ট্রীয় সিলমোহর নয়, কিন্তু শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে রয়েছে—জাতীয় পতাকার পাশে এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়, সরকারি দলিল ও কাগজপত্রে তার ছাপ থাকে। অতএব এর ব্যবহার একেবারে সীমিত, তা রাজনৈতিক প্রতীক হতে পারে না।
প্রসঙ্গত, নাগরিক ঐক্য নামক একটি ছোট দলও একই প্রতীক চেয়ে পায়নি। এখন যদি শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া হয়, তাহলে তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং সেটি অবৈধ ঘোষণা হলে নতুন করে বিতর্ক জন্ম নেবে। তবে এনসিপির নেতারা কৌশলগতভাবে বলছেন, ‘শাপলা না পেলে অন্য প্রতীক নেব, তবে শাপলাই আমাদের প্রধান পছন্দ।’ এর পেছনেও রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে। প্রতীকের মাধ্যমে গ্রামীণ ভোটারদের মনোযোগ পাওয়া সহজ। শাপলা ফুল প্রতীক হিসেবে পেলে রাজনৈতিকভাবে আবেগ তৈরি করতে পারে।
একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ—এনসিপি আসলে কারা? কারা এই দলটির পেছনে? এত আত্মবিশ্বাস, সংবাদমাধ্যমে এত সাড়া—এসব কি কেবল উৎসাহপ্রাপ্ত কিছু নাগরিকের উদ্যোগের ফল? নাকি এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক সুবিধাভোগীদের একাংশ বা এটা ক্ষমতার একাংশের কোনো বিশেষ প্রজেক্ট? বাংলাদেশে এমন ‘প্রজেক্ট দল’-এর অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তবে সব ‘প্রজেক্ট দল’ আবার সফল হয় না। অতীতেও দেখা গেছে, হঠাৎ তৈরি হওয়া দল কিছুদিন পরে হারিয়ে গেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বিকল্প শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী দলও শেষ পর্যন্ত বড় দুই পুরোনো দলের সঙ্গে মিতালি করতে গিয়ে মরুপথে হারিয়েছে দিশা। জনগণ যদি প্রকৃত অর্থে বিকল্প রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, তবে সেই দলকে অবশ্যই মাঠে, পাড়ায়, ইউনিয়নে, রাস্তায়, ক্যানভাসে প্রমাণ করতে হয়। কেবল টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলে দল বড় হয় না।
এনসিপির এই আত্মবিশ্বাস যদি বাস্তব হয়, তাহলে তাকে মাঠে প্রমাণ দিতে হবে। যদি অলীক হয়, তবে সেটি জনতার চোখে ধরা পড়বে। দলটির পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, ‘৩০০ আসন আমাদের ঘরে থাকবে’—তবে সেই ঘরের দরজা খুলে দেখতে হবে, সেখানে প্রকৃতপক্ষে কী রসদ জমা আছে!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় বা বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি সেই শক্তির গ্রহণযোগ্যতা অর্জন একটি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রা। এনসিপি যদি সত্যিই জনগণের শক্তি হতে চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে বাস্তববাদী রাজনীতি, সক্রিয় সাংগঠনিক বিস্তার এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে আসা। বক্তৃতা আর প্রতীক দিয়ে রাজনীতি হয় না, লাগে ত্যাগ, লাগে পথচলা, লাগে জনগণের হৃদয় জয় করার সাহস। ৩০০ আসনের দাবি তখনই অর্থবহ হবে, যখন জনগণ সত্যি হাত তুলে এগিয়ে যাবে এনসিপির দিকে। আর যদি জনগণ না চায়, তবে হাজার বক্তব্য দিয়েও তা সম্ভব হবে না। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনগণ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
বিভুরঞ্জন সরকার
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন, রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে রাজনৈতিক দল শতাধিক থাকতেই পারে। সব দলের নাম সবাই না জানলেও ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন জন্ম নেওয়া একটি দলের নাম এর মধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন। দলটির নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। মূলত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ নিয়ে গঠিত এই দল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কৌতূহল আছে, আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। প্রচারেই প্রসার বলে একটি কথা আমাদের দেশে চালু আছে। এনসিপি নিয়ে যেহেতু প্রচার আছে, সেহেতু এর প্রসারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শাসক দল হওয়ার আশা নিয়েই দলটি যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে জন্ম নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে শাসক দল হওয়ার গৌরব অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আর জাতীয় পার্টির জনক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দুজনই সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিতে আসা মানুষ, সেনাশাসক হিসেবে পরিচিত।
এনসিপির তেমন কোনো একক প্রতিষ্ঠাতার নাম বলা যাবে না। তবে দলের প্রথম আহ্বায়ক যেহেতু সাবেক সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সেহেতু দলের একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম বলা হলে অন্যায় হবে বলে মনে হয় না। শাসক হওয়ার লক্ষণ এই দলের আছে। কোনো সেনাশাসকের প্রেরণায় না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশীর্বাদের হাত এই দলের উদ্যোক্তাদের মাথার ওপর আছে বলেই মানুষের ধারণা। ড. ইউনূস রাজনীতির মানুষ না হয়েও এখন দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থাৎ, তিনিই এখন দেশের প্রধান শাসক। এই দলের ওপর আশীর্বাদ আছে আরও অন্তত দুজন উপদেষ্টার। আবার নাহিদ ইসলামও সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাই শাসক দলের তকমা এনসিপির গায়ে না থাকলেও শাসক দল হওয়ার তীব্র বাসনা এই দলের থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
২২ জুন নির্বাচন কমিশনে নতুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার দিন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দেওয়া বক্তব্যে সেই শাসক দল হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশন ৪০০ আসনের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে ৩০০টি আসনে বিজয়ী হবে এনসিপি। এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী, সাহসী ও চমকপ্রদ রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেটি কি বাস্তবসম্মত?
প্রথমেই বলা দরকার, ৪০০ আসনের প্রস্তাব এখনো অনুমোদিত নয়, এটি রয়েছে কেবল কমিশনের সুপারিশ পর্যায়ে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৩০০টি সাধারণ এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। এই কাঠামো পরিবর্তনের কোনো আইনি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে একটি অনিবন্ধিত নবীন রাজনৈতিক দল যদি দাবি করে যে তারা ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০টি আসন পাবে, তাহলে তা কারও কাছে অবান্তর বলে বিবেচিত হতে পারে। যে দলের এখনো দেশজুড়ে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠেনি, মাঠপর্যায়ের তৎপরতা নগণ্য এবং এখনো কোনো নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি, সেই দলের একজন নেতার এমন উচ্চারণ বাত কা বাত ভাবার কোনো কারণ নেই। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ হলো ‘সব সম্ভবের দেশ’।
বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বড় জয় কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অসম্ভব নয়, তবে তা এসেছে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই, সাংগঠনিক প্রাচুর্য এবং জনসম্পৃক্ততার ভিত্তিতে। যেমন ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয় পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল তার মূল ভিত্তি। আবার ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসনে জয় পায় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে এই জয় ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুফল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৫০টির বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল সেনাশাসনের আবহে একটি বিরোধীবিহীন নির্বাচনের ফসল। এরশাদ আমলেই একমাত্র প্রায় ৩০০ আসনের পূর্ণ দখলের নজির রয়েছে, যা ছিল বিতর্কিত ও নিয়ন্ত্রিত ভোটব্যবস্থার প্রতিফলন।
আগের নির্বাচনগুলোতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলেও এবার তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা নিয়েই রাজনীতির মাঠে আছে। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপির ৩০০ আসনে জয়ী হওয়ার আশাকে নিছক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বললে ভুল হবে। এর ভেতর আরেকটি বার্তা নিহিত—এনসিপি নিজেকে শুধু একটি নতুন দল নয়, বরং বিকল্প সরকার হিসেবে ভাবছে। তারা হয়তো ধরেই নিচ্ছে যে আওয়ামী লীগ গত আগস্টে হঠাৎ ‘নাই’ হওয়া, জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো—এই ফাঁকে তারা সেই ‘শূন্যস্থানে’ জায়গা করে নেবে। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন, বর্তমানে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে কেন গণনার বাইরে রাখছে এনসিপি? বিএনপিকে দেখেও না দেখার কি কোনো বিশেষ মাজেজা আছে? অথচ লন্ডন বৈঠকে ইউনূস-তারেক সমঝোতার খুশির জোয়ারে ভাসছে বিএনপি।
এখানেই আরেকটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে আসে—আগামী নির্বাচন কি তাহলে ১৯৭৯ বা ১৯৮৬ সালের মডেলে হতে যাচ্ছে? যেমন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিএনপিকে বিজয়ী করেছিলেন। এরশাদ তাঁর সময়েও একই কৌশলে জাতীয় পার্টিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এবং নির্বাচনী বৈধতা নিশ্চিত করেছিলেন। এখন যদি ক্ষমতার আশপাশে অবস্থানরত কোনো মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় এনসিপি তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কি তৃতীয় শক্তির নামান্তর? প্রশ্নগুলো অমূলক নয়। ইতিহাস বলছে—নতুন দল হঠাৎ করেই ২০০ বা ৩০০ আসন জেতার নজির কেবল স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরেই সংঘটিত হয়েছে।
এনসিপির বক্তব্যের আরও একটি দিক নজর কাড়ে—তাদের প্রতীকপ্রীতি। তারা নির্বাচন কমিশনে ‘শাপলা’ প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে। দলটির নেতারা বলছেন, শাপলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক, গ্রামীণ জনজীবনের প্রতিচ্ছবি এবং গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতীক। তাঁরা দাবি করেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হলেও আইনগতভাবে শাপলা গ্রহণে বাধা নেই।’ অথচ সংবিধান ও ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ১৩০ নম্বর আদেশ অনুযায়ী, শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক। এই প্রতীকের কোনো অবমাননা, বিকৃতি বা রাজনৈতিক ব্যবহারে আইনি নিষেধ রয়েছে। আইনের ভাষায়, কেউ যদি জাতীয় প্রতীক অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক বছরের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে এনসিপি যদি ‘শাপলা’ প্রতীক চায়, তাহলে তা সরাসরি জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের চেষ্টার মধ্যে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক শাহদীন মালিক স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হিসেবে যেহেতু শাপলা আইন করে নির্ধারিত, সেহেতু রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে এর ব্যবহার বেআইনি।’ এনসিপির পক্ষ থেকে অবশ্য যুক্তি এসেছে—জাতীয় ফল কাঁঠাল একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক, ধানের শীষও কোনো না কোনোভাবে জাতীয় পর্যায়ের প্রতীক। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি বড় পার্থক্য। কাঁঠাল বা ধানের শীষ জাতীয় প্রতীক হলেও তা রাষ্ট্রীয় সিলমোহর নয়, কিন্তু শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে রয়েছে—জাতীয় পতাকার পাশে এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়, সরকারি দলিল ও কাগজপত্রে তার ছাপ থাকে। অতএব এর ব্যবহার একেবারে সীমিত, তা রাজনৈতিক প্রতীক হতে পারে না।
প্রসঙ্গত, নাগরিক ঐক্য নামক একটি ছোট দলও একই প্রতীক চেয়ে পায়নি। এখন যদি শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া হয়, তাহলে তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং সেটি অবৈধ ঘোষণা হলে নতুন করে বিতর্ক জন্ম নেবে। তবে এনসিপির নেতারা কৌশলগতভাবে বলছেন, ‘শাপলা না পেলে অন্য প্রতীক নেব, তবে শাপলাই আমাদের প্রধান পছন্দ।’ এর পেছনেও রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে। প্রতীকের মাধ্যমে গ্রামীণ ভোটারদের মনোযোগ পাওয়া সহজ। শাপলা ফুল প্রতীক হিসেবে পেলে রাজনৈতিকভাবে আবেগ তৈরি করতে পারে।
একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ—এনসিপি আসলে কারা? কারা এই দলটির পেছনে? এত আত্মবিশ্বাস, সংবাদমাধ্যমে এত সাড়া—এসব কি কেবল উৎসাহপ্রাপ্ত কিছু নাগরিকের উদ্যোগের ফল? নাকি এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক সুবিধাভোগীদের একাংশ বা এটা ক্ষমতার একাংশের কোনো বিশেষ প্রজেক্ট? বাংলাদেশে এমন ‘প্রজেক্ট দল’-এর অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তবে সব ‘প্রজেক্ট দল’ আবার সফল হয় না। অতীতেও দেখা গেছে, হঠাৎ তৈরি হওয়া দল কিছুদিন পরে হারিয়ে গেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বিকল্প শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী দলও শেষ পর্যন্ত বড় দুই পুরোনো দলের সঙ্গে মিতালি করতে গিয়ে মরুপথে হারিয়েছে দিশা। জনগণ যদি প্রকৃত অর্থে বিকল্প রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, তবে সেই দলকে অবশ্যই মাঠে, পাড়ায়, ইউনিয়নে, রাস্তায়, ক্যানভাসে প্রমাণ করতে হয়। কেবল টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলে দল বড় হয় না।
এনসিপির এই আত্মবিশ্বাস যদি বাস্তব হয়, তাহলে তাকে মাঠে প্রমাণ দিতে হবে। যদি অলীক হয়, তবে সেটি জনতার চোখে ধরা পড়বে। দলটির পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, ‘৩০০ আসন আমাদের ঘরে থাকবে’—তবে সেই ঘরের দরজা খুলে দেখতে হবে, সেখানে প্রকৃতপক্ষে কী রসদ জমা আছে!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় বা বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি সেই শক্তির গ্রহণযোগ্যতা অর্জন একটি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রা। এনসিপি যদি সত্যিই জনগণের শক্তি হতে চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে বাস্তববাদী রাজনীতি, সক্রিয় সাংগঠনিক বিস্তার এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে আসা। বক্তৃতা আর প্রতীক দিয়ে রাজনীতি হয় না, লাগে ত্যাগ, লাগে পথচলা, লাগে জনগণের হৃদয় জয় করার সাহস। ৩০০ আসনের দাবি তখনই অর্থবহ হবে, যখন জনগণ সত্যি হাত তুলে এগিয়ে যাবে এনসিপির দিকে। আর যদি জনগণ না চায়, তবে হাজার বক্তব্য দিয়েও তা সম্ভব হবে না। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনগণ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:

বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন, রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে রাজনৈতিক দল শতাধিক থাকতেই পারে। সব দলের নাম সবাই না জানলেও ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন জন্ম নেওয়া একটি দলের নাম এর মধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন। দলটির নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। মূলত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশ নিয়ে গঠিত এই দল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কৌতূহল আছে, আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। প্রচারেই প্রসার বলে একটি কথা আমাদের দেশে চালু আছে। এনসিপি নিয়ে যেহেতু প্রচার আছে, সেহেতু এর প্রসারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শাসক দল হওয়ার আশা নিয়েই দলটি যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে জন্ম নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে শাসক দল হওয়ার গৌরব অর্জন করার সৌভাগ্য হয়েছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান আর জাতীয় পার্টির জনক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দুজনই সামরিক বাহিনী থেকে রাজনীতিতে আসা মানুষ, সেনাশাসক হিসেবে পরিচিত।
এনসিপির তেমন কোনো একক প্রতিষ্ঠাতার নাম বলা যাবে না। তবে দলের প্রথম আহ্বায়ক যেহেতু সাবেক সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম, সেহেতু দলের একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম বলা হলে অন্যায় হবে বলে মনে হয় না। শাসক হওয়ার লক্ষণ এই দলের আছে। কোনো সেনাশাসকের প্রেরণায় না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশীর্বাদের হাত এই দলের উদ্যোক্তাদের মাথার ওপর আছে বলেই মানুষের ধারণা। ড. ইউনূস রাজনীতির মানুষ না হয়েও এখন দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থাৎ, তিনিই এখন দেশের প্রধান শাসক। এই দলের ওপর আশীর্বাদ আছে আরও অন্তত দুজন উপদেষ্টার। আবার নাহিদ ইসলামও সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তাই শাসক দলের তকমা এনসিপির গায়ে না থাকলেও শাসক দল হওয়ার তীব্র বাসনা এই দলের থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
২২ জুন নির্বাচন কমিশনে নতুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার দিন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দেওয়া বক্তব্যে সেই শাসক দল হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশন ৪০০ আসনের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে ৩০০টি আসনে বিজয়ী হবে এনসিপি। এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী, সাহসী ও চমকপ্রদ রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেটি কি বাস্তবসম্মত?
প্রথমেই বলা দরকার, ৪০০ আসনের প্রস্তাব এখনো অনুমোদিত নয়, এটি রয়েছে কেবল কমিশনের সুপারিশ পর্যায়ে। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৩০০টি সাধারণ এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। এই কাঠামো পরিবর্তনের কোনো আইনি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে একটি অনিবন্ধিত নবীন রাজনৈতিক দল যদি দাবি করে যে তারা ৪০০ আসনের মধ্যে ৩০০টি আসন পাবে, তাহলে তা কারও কাছে অবান্তর বলে বিবেচিত হতে পারে। যে দলের এখনো দেশজুড়ে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠেনি, মাঠপর্যায়ের তৎপরতা নগণ্য এবং এখনো কোনো নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি, সেই দলের একজন নেতার এমন উচ্চারণ বাত কা বাত ভাবার কোনো কারণ নেই। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ হলো ‘সব সম্ভবের দেশ’।
বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বড় জয় কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য অসম্ভব নয়, তবে তা এসেছে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই, সাংগঠনিক প্রাচুর্য এবং জনসম্পৃক্ততার ভিত্তিতে। যেমন ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয় পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল তার মূল ভিত্তি। আবার ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসনে জয় পায় এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে এই জয় ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুফল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৫০টির বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল সেনাশাসনের আবহে একটি বিরোধীবিহীন নির্বাচনের ফসল। এরশাদ আমলেই একমাত্র প্রায় ৩০০ আসনের পূর্ণ দখলের নজির রয়েছে, যা ছিল বিতর্কিত ও নিয়ন্ত্রিত ভোটব্যবস্থার প্রতিফলন।
আগের নির্বাচনগুলোতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলেও এবার তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা নিয়েই রাজনীতির মাঠে আছে। এই প্রেক্ষাপটে এনসিপির ৩০০ আসনে জয়ী হওয়ার আশাকে নিছক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বললে ভুল হবে। এর ভেতর আরেকটি বার্তা নিহিত—এনসিপি নিজেকে শুধু একটি নতুন দল নয়, বরং বিকল্প সরকার হিসেবে ভাবছে। তারা হয়তো ধরেই নিচ্ছে যে আওয়ামী লীগ গত আগস্টে হঠাৎ ‘নাই’ হওয়া, জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো—এই ফাঁকে তারা সেই ‘শূন্যস্থানে’ জায়গা করে নেবে। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন, বর্তমানে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে কেন গণনার বাইরে রাখছে এনসিপি? বিএনপিকে দেখেও না দেখার কি কোনো বিশেষ মাজেজা আছে? অথচ লন্ডন বৈঠকে ইউনূস-তারেক সমঝোতার খুশির জোয়ারে ভাসছে বিএনপি।
এখানেই আরেকটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে আসে—আগামী নির্বাচন কি তাহলে ১৯৭৯ বা ১৯৮৬ সালের মডেলে হতে যাচ্ছে? যেমন জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে বিএনপিকে বিজয়ী করেছিলেন। এরশাদ তাঁর সময়েও একই কৌশলে জাতীয় পার্টিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এবং নির্বাচনী বৈধতা নিশ্চিত করেছিলেন। এখন যদি ক্ষমতার আশপাশে অবস্থানরত কোনো মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় এনসিপি তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কি তৃতীয় শক্তির নামান্তর? প্রশ্নগুলো অমূলক নয়। ইতিহাস বলছে—নতুন দল হঠাৎ করেই ২০০ বা ৩০০ আসন জেতার নজির কেবল স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরেই সংঘটিত হয়েছে।
এনসিপির বক্তব্যের আরও একটি দিক নজর কাড়ে—তাদের প্রতীকপ্রীতি। তারা নির্বাচন কমিশনে ‘শাপলা’ প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে। দলটির নেতারা বলছেন, শাপলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতীক, গ্রামীণ জনজীবনের প্রতিচ্ছবি এবং গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতীক। তাঁরা দাবি করেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হলেও আইনগতভাবে শাপলা গ্রহণে বাধা নেই।’ অথচ সংবিধান ও ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ১৩০ নম্বর আদেশ অনুযায়ী, শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক। এই প্রতীকের কোনো অবমাননা, বিকৃতি বা রাজনৈতিক ব্যবহারে আইনি নিষেধ রয়েছে। আইনের ভাষায়, কেউ যদি জাতীয় প্রতীক অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক বছরের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে এনসিপি যদি ‘শাপলা’ প্রতীক চায়, তাহলে তা সরাসরি জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের চেষ্টার মধ্যে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক শাহদীন মালিক স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘জাতীয় প্রতীক হিসেবে যেহেতু শাপলা আইন করে নির্ধারিত, সেহেতু রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে এর ব্যবহার বেআইনি।’ এনসিপির পক্ষ থেকে অবশ্য যুক্তি এসেছে—জাতীয় ফল কাঁঠাল একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক, ধানের শীষও কোনো না কোনোভাবে জাতীয় পর্যায়ের প্রতীক। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি বড় পার্থক্য। কাঁঠাল বা ধানের শীষ জাতীয় প্রতীক হলেও তা রাষ্ট্রীয় সিলমোহর নয়, কিন্তু শাপলা ফুল বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে রয়েছে—জাতীয় পতাকার পাশে এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়, সরকারি দলিল ও কাগজপত্রে তার ছাপ থাকে। অতএব এর ব্যবহার একেবারে সীমিত, তা রাজনৈতিক প্রতীক হতে পারে না।
প্রসঙ্গত, নাগরিক ঐক্য নামক একটি ছোট দলও একই প্রতীক চেয়ে পায়নি। এখন যদি শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া হয়, তাহলে তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে এবং সেটি অবৈধ ঘোষণা হলে নতুন করে বিতর্ক জন্ম নেবে। তবে এনসিপির নেতারা কৌশলগতভাবে বলছেন, ‘শাপলা না পেলে অন্য প্রতীক নেব, তবে শাপলাই আমাদের প্রধান পছন্দ।’ এর পেছনেও রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে। প্রতীকের মাধ্যমে গ্রামীণ ভোটারদের মনোযোগ পাওয়া সহজ। শাপলা ফুল প্রতীক হিসেবে পেলে রাজনৈতিকভাবে আবেগ তৈরি করতে পারে।
একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ—এনসিপি আসলে কারা? কারা এই দলটির পেছনে? এত আত্মবিশ্বাস, সংবাদমাধ্যমে এত সাড়া—এসব কি কেবল উৎসাহপ্রাপ্ত কিছু নাগরিকের উদ্যোগের ফল? নাকি এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক সুবিধাভোগীদের একাংশ বা এটা ক্ষমতার একাংশের কোনো বিশেষ প্রজেক্ট? বাংলাদেশে এমন ‘প্রজেক্ট দল’-এর অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তবে সব ‘প্রজেক্ট দল’ আবার সফল হয় না। অতীতেও দেখা গেছে, হঠাৎ তৈরি হওয়া দল কিছুদিন পরে হারিয়ে গেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বিকল্প শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী দলও শেষ পর্যন্ত বড় দুই পুরোনো দলের সঙ্গে মিতালি করতে গিয়ে মরুপথে হারিয়েছে দিশা। জনগণ যদি প্রকৃত অর্থে বিকল্প রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, তবে সেই দলকে অবশ্যই মাঠে, পাড়ায়, ইউনিয়নে, রাস্তায়, ক্যানভাসে প্রমাণ করতে হয়। কেবল টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলে দল বড় হয় না।
এনসিপির এই আত্মবিশ্বাস যদি বাস্তব হয়, তাহলে তাকে মাঠে প্রমাণ দিতে হবে। যদি অলীক হয়, তবে সেটি জনতার চোখে ধরা পড়বে। দলটির পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, ‘৩০০ আসন আমাদের ঘরে থাকবে’—তবে সেই ঘরের দরজা খুলে দেখতে হবে, সেখানে প্রকৃতপক্ষে কী রসদ জমা আছে!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় বা বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি সেই শক্তির গ্রহণযোগ্যতা অর্জন একটি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য যাত্রা। এনসিপি যদি সত্যিই জনগণের শক্তি হতে চায়, তাহলে তাদের উচিত হবে বাস্তববাদী রাজনীতি, সক্রিয় সাংগঠনিক বিস্তার এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক নীতিমালা নিয়ে এগিয়ে আসা। বক্তৃতা আর প্রতীক দিয়ে রাজনীতি হয় না, লাগে ত্যাগ, লাগে পথচলা, লাগে জনগণের হৃদয় জয় করার সাহস। ৩০০ আসনের দাবি তখনই অর্থবহ হবে, যখন জনগণ সত্যি হাত তুলে এগিয়ে যাবে এনসিপির দিকে। আর যদি জনগণ না চায়, তবে হাজার বক্তব্য দিয়েও তা সম্ভব হবে না। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনগণ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের...
২৫ জুন ২০২৫
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেজাহীদ রেজা নূর

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের...
২৫ জুন ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেস্বপ্না রেজা

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের...
২৫ জুন ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেসানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?
বাংলাদেশে আর যা কিছুরই অভাব থাক না কেন রাজনৈতিক দলের কোনো অভাব নেই। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। সব দলের নাম যেমন সবার জানা নেই, তেমনি সব দলের নেতাদের নামও বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা। ছোট দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক। সব মানুষ আবার এক চিন্তার নয়। তাই ১৭-১৮ কোটি মানুষের...
২৫ জুন ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে