বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধান সত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত। কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষ বিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদের মধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সে-কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদ যেমন আন্তর্জাতিক, তার বিকল্পও হওয়া দরকার তার চেয়ে গভীরভাবে আন্তর্জাতিক। সমাজবিপ্লবের জন্য খুব বেশি করে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ও প্রস্তুতির। সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, আলোচনা-বিতর্ক, নাটক, নৃত্য, প্রচারমাধ্যম—সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটা এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
পুঁজিবাদ ওই কাজকেই বিশেষ রকমের কঠিন করে তুলেছে। বৈশ্বিক এই আদর্শের কাছে সবকিছুরই ওজন হয় মুনাফার বাটখারায়। সংস্কৃতির চর্চাকেও সে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে তুমুলভাবে আগ্রহী। স্পর্শমাত্র পণ্যে পরিণত করার ক্ষমতা সে রাখেও। সংস্কৃতির বাণিজ্যিক চর্চার বিপক্ষে এবং মানবিক চর্চার পক্ষে আজ দাঁড়ানো চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির মানবিক চর্চারই অপর নাম সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা।
পুঁজিবাদ মনেপ্রাণে সংস্কৃতির এই চর্চার বিরোধী। সংস্কৃতিচর্চা বিনোদন সরবরাহ করবে, এটা ঠিক আছে। অশ্লীল হলে তো আরও ভালো। তাতে বাণিজ্য জমবে এবং তার চেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি ঘটবে, সেটা হলো মানুষকে সামাজিক বিপ্লববিরোধী করা যাবে। বিপ্লববিরোধিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার চমৎকার নিদর্শন এখন পাওয়া যাচ্ছে সর্বাধিক উন্নত-বলে-কথিত আমেরিকায়। সেখানে শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী উন্মত্ততা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে হত্যা শুরু হওয়ার দশা। এবং ওই বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই জিতিয়েছেন এবং তাঁর বিজয়ে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদ গভীর ধরনের সাহিত্যের চর্চা একেবারেই পছন্দ করে না। সে জন্য দেখছি পাঠককে যে-সাহিত্য ধাক্কা দেয়, চিন্তিত করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রচার নেই, বাজারও নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা। সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বব ডিলানকে, যিনি উঁচু মানের একজন সংগীত রচয়িতা এবং সংগীতশিল্পী অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে তিনি সাহিত্যিক
বলে মনে করেন না, যে জন্য পুরস্কার গ্রহণে তাঁর রীতিমতো দ্বিধা ছিল। এর পরে এক বছর তো পুরস্কার দেওয়াই হলো না দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণে। তবে অন্তরালে যা-ই থাকুক, সামনে থেকে তো বোঝা যাচ্ছে সাহিত্যচর্চা তার আগের, এবং সর্বকালের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সাহিত্য তো থাকবে। এই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, ঠিক তত দিন সাহিত্যও থাকবে। কারণ, সাহিত্য মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ ও লালন করে। কিন্তু সে জন্য সাহিত্যকে গভীর হতে হবে, মনভোলানোর ছলাকলানির্ভর হলে চলবে না। যাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, সে-কালে আওয়াজ উঠেছে ‘আনন্দের সাহিত্য চাই’, কেউবা আবার ঘোষণাই দিয়েছেন, সহেনা সহেনা প্রাণে জনতার জঘন্য মিতালী। উদারনীতিক যিনি, তিনি বলেছেন, অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি নিশ্চয়ই আছেন, যিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়াটায় ও পোড়োবাড়িটায়।
মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কবিও চেষ্টা করেছেন বিপ্লবী মার্ক্সের সঙ্গে ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের মিলন ঘটানোর। এসব কাজ সাহিত্যকে গভীরতা দেয়নি, এমনকি সাহিত্যের গুরুত্বকে যে দৃশ্যমান করবে, সে কাজটাও করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির চর্চার। এটা বোধ করি মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে। গাছপালা, নদ-নদী, অর্থনীতির কৃষিনির্ভরতা, বহুকালের খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু নরম ধরনের। মাংসের চেয়ে মাছ ও শাকসবজি এখানকার মানুষের অধিক পছন্দ। তারা স্বল্পে সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
আমাদের সমাজ অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক, ভীষণভাবে পিতৃতান্ত্রিক; কিন্তু সংস্কৃতিতে মাতার ভূমিকা থাকে, সেটা যত অপ্রত্যক্ষ ততই কার্যকর, শিরা-উপশিরার মতো। ঘরগেরস্তালির নিত্যদিনের পরিচালনা ও সন্তানের লালন-পালনের মাধ্যমে এবং আহার প্রস্তুত ও পরিবেশনার ভেতরে মা আছেন। মা থাকেন। সবকিছুতে স্নেহের মিশ্রণ ঘটিয়ে। মা নিজে কিন্তু বিষণ্নই থাকেন। বাধ্য হন থাকতে। ওদিকে সংস্কৃতিতে আবার ভয়ও কাজ করে। সুদীর্ঘকালের পরাধীনতা মানুষকে দরিদ্র করে রেখেছে। এ দেশে সম্পদ কখনোই কম ছিল না; শ্রম দিয়ে মানুষ উৎপাদনও করেছে, কিন্তু এখানকার সম্পদ পাচার হয়ে গেছে, বিদেশে।
ভূমি উর্বর। ফসল ফলে সহজে। কিন্তু সে-ফসল উৎপাদনকারীরা পায় না। লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আবার বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক কিছু। ভয়টা আর কাটে না।সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান শিক্ষা। সেই শিক্ষাতেও ওই ভয়টা নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হয়। বাল্যশিক্ষার বইতে আমরা একেবারে প্রথমেই পড়েছি ‘অ’তে অজগর আসছে তেড়ে। এখন হয়তো বর্ণপরিচয়ের বইতে ‘অ’বর্ণের ওই পরিচয়টি নেই; কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়টা ব্যাপ্ত রয়ে গেছে। ভয় ফেল করবার। ফেল করলে শাস্তি পাবার।
ভয়ের উল্টো পিঠে থাকে লোভ। বর্ণপরিচয়ে ‘আ’তে ছিল, ‘আমটি আমি খাব পেড়ে।’ আমগাছটি আমি লাগাইনি, আমের ফলনে আমার কোনো শ্রম নেই; কিন্তু গাছে যেহেতু সেটি ঝুলছে, তাই আমি সেটি পেড়ে নেব, খেয়ে ফেলব, কাউকে দেব না। কি পুঁজিবাদী কি সামন্তবাদী—সব ব্যবস্থাতেই ভীতি ও প্রলোভনের এই দ্বৈত শিক্ষাটা অনবরত দেওয়া হচ্ছে। দারিদ্র্য, ভীতি ও লোভ (যা পূরণ হয় না), এরা মিলে বাড়িয়ে তোলে মাতার বিষণ্নতা। বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বাঙালির
এই বিষণ্নতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। এই বিষণ্নতার অন্তরে রয়েছে গভীর বেদনা, দুর্ভর হতাশা। কিন্তু বাঙালির ভেতর আবার বিদ্রোহও আছে। আসলে বেদনা ও বিদ্রোহ—দুটো মিলিয়েই বাঙালির সংস্কৃতি। বেদনা ও বিদ্রোহের ভেতরকার সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক; এতে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না, তবে বাড়ে বিষণ্নতা। জীবনানন্দ দাশ যেমন বেদনাকে মূর্ত করেছেন, তেমনি তাঁরই সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যও ওই বিদ্রোহের, তথা বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা, তারই কবি। সময় জিনিসটা জীবনানন্দ ও সুকান্ত—উভয়ের জন্যই সত্য।
সময়কে বোঝাবার জন্য ঘড়ির রূপক দুজনেই ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতা ‘ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত’ কবিতাতে বলছেন যে ঘড়ির কাঁটা তাঁদেরকে, তাঁকে ও তাঁর প্রিয়তমাকে, নিয়ে যেতে চায় যেন ‘শব্দহীন মাটি ঘাসের দিকে’, যেখানে ‘সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনো দিন যাবে না’; তবু সেদিকেই যেতে হয়, ‘কী গভীর সহজ অভ্যাসে’। অভ্যাসটা মৃত্যুর দিকে যাওয়ারই। কিন্তু সাহস সংকল্প প্রেম, এরা তো মিথ্যা নয়; তারা আছে, তারা মৃত্যুর দিকে যাবে না।
আর ওই সাহস সংকল্প প্রেমই দেখি মুখর হয়ে উঠেছে সুকান্তের ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতায়: ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি।’বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধানসত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত।কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষবিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদেরমধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সেই কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের পরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না। পৃথিবীটাকে বদলাবেন। তার জন্য প্রয়োজন হবে বেদনার্ত মানুষদের ঐক্য, আর সে-ঐক্য গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক যা, তা হলো সমাজ-রূপান্তরকামী সংস্কৃতির চর্চা।
সাহিত্য তাতে খুব বড় একটা ভূমিকা রাখবে। সাহিত্যের মূল কাজটাই তো হলো সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংহতি গড়ে তোলা; পুঁজিবাদ যেটা চায় না। পুঁজিবাদের কাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা। সাহিত্যও সংস্কৃতিরই অংশ; এবং সংস্কৃতির কাজও হচ্ছে ঐক্য সৃষ্টি। তবে সাহিত্যে যেমন, সংস্কৃতিতেও তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলতা কার্যকর থাকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-পুরুষে বৈষম্য, উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসবের লালন-পালন প্রতিক্রিয়াশীলতার তৎপরতারই অংশ। নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়বার জন্য তাই প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের।
সত্য হলো এই যে পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সমানে চলছে। মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য ঘণ্টাধ্বনি অনবরত বাজছে। সেটা না শুনলে বিপদ এগিয়ে আসবে। এই ঘণ্টাধ্বনি কেবল বাংলাদেশে নয়, বাজছে বিশ্বব্যাপী। ডাক দিচ্ছে সংবেদনশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য, পুঁজিবাদের বিষাক্ত নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ডাক দিচ্ছে বিপ্লবাভিমুখী বিদ্রোহের।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদ যেমন আন্তর্জাতিক, তার বিকল্পও হওয়া দরকার তার চেয়ে গভীরভাবে আন্তর্জাতিক। সমাজবিপ্লবের জন্য খুব বেশি করে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ও প্রস্তুতির। সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, আলোচনা-বিতর্ক, নাটক, নৃত্য, প্রচারমাধ্যম—সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটা এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
পুঁজিবাদ ওই কাজকেই বিশেষ রকমের কঠিন করে তুলেছে। বৈশ্বিক এই আদর্শের কাছে সবকিছুরই ওজন হয় মুনাফার বাটখারায়। সংস্কৃতির চর্চাকেও সে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে তুমুলভাবে আগ্রহী। স্পর্শমাত্র পণ্যে পরিণত করার ক্ষমতা সে রাখেও। সংস্কৃতির বাণিজ্যিক চর্চার বিপক্ষে এবং মানবিক চর্চার পক্ষে আজ দাঁড়ানো চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির মানবিক চর্চারই অপর নাম সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা।
পুঁজিবাদ মনেপ্রাণে সংস্কৃতির এই চর্চার বিরোধী। সংস্কৃতিচর্চা বিনোদন সরবরাহ করবে, এটা ঠিক আছে। অশ্লীল হলে তো আরও ভালো। তাতে বাণিজ্য জমবে এবং তার চেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি ঘটবে, সেটা হলো মানুষকে সামাজিক বিপ্লববিরোধী করা যাবে। বিপ্লববিরোধিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার চমৎকার নিদর্শন এখন পাওয়া যাচ্ছে সর্বাধিক উন্নত-বলে-কথিত আমেরিকায়। সেখানে শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী উন্মত্ততা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে হত্যা শুরু হওয়ার দশা। এবং ওই বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই জিতিয়েছেন এবং তাঁর বিজয়ে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদ গভীর ধরনের সাহিত্যের চর্চা একেবারেই পছন্দ করে না। সে জন্য দেখছি পাঠককে যে-সাহিত্য ধাক্কা দেয়, চিন্তিত করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রচার নেই, বাজারও নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা। সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বব ডিলানকে, যিনি উঁচু মানের একজন সংগীত রচয়িতা এবং সংগীতশিল্পী অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে তিনি সাহিত্যিক
বলে মনে করেন না, যে জন্য পুরস্কার গ্রহণে তাঁর রীতিমতো দ্বিধা ছিল। এর পরে এক বছর তো পুরস্কার দেওয়াই হলো না দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণে। তবে অন্তরালে যা-ই থাকুক, সামনে থেকে তো বোঝা যাচ্ছে সাহিত্যচর্চা তার আগের, এবং সর্বকালের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সাহিত্য তো থাকবে। এই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, ঠিক তত দিন সাহিত্যও থাকবে। কারণ, সাহিত্য মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ ও লালন করে। কিন্তু সে জন্য সাহিত্যকে গভীর হতে হবে, মনভোলানোর ছলাকলানির্ভর হলে চলবে না। যাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, সে-কালে আওয়াজ উঠেছে ‘আনন্দের সাহিত্য চাই’, কেউবা আবার ঘোষণাই দিয়েছেন, সহেনা সহেনা প্রাণে জনতার জঘন্য মিতালী। উদারনীতিক যিনি, তিনি বলেছেন, অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি নিশ্চয়ই আছেন, যিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়াটায় ও পোড়োবাড়িটায়।
মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কবিও চেষ্টা করেছেন বিপ্লবী মার্ক্সের সঙ্গে ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের মিলন ঘটানোর। এসব কাজ সাহিত্যকে গভীরতা দেয়নি, এমনকি সাহিত্যের গুরুত্বকে যে দৃশ্যমান করবে, সে কাজটাও করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির চর্চার। এটা বোধ করি মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে। গাছপালা, নদ-নদী, অর্থনীতির কৃষিনির্ভরতা, বহুকালের খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু নরম ধরনের। মাংসের চেয়ে মাছ ও শাকসবজি এখানকার মানুষের অধিক পছন্দ। তারা স্বল্পে সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
আমাদের সমাজ অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক, ভীষণভাবে পিতৃতান্ত্রিক; কিন্তু সংস্কৃতিতে মাতার ভূমিকা থাকে, সেটা যত অপ্রত্যক্ষ ততই কার্যকর, শিরা-উপশিরার মতো। ঘরগেরস্তালির নিত্যদিনের পরিচালনা ও সন্তানের লালন-পালনের মাধ্যমে এবং আহার প্রস্তুত ও পরিবেশনার ভেতরে মা আছেন। মা থাকেন। সবকিছুতে স্নেহের মিশ্রণ ঘটিয়ে। মা নিজে কিন্তু বিষণ্নই থাকেন। বাধ্য হন থাকতে। ওদিকে সংস্কৃতিতে আবার ভয়ও কাজ করে। সুদীর্ঘকালের পরাধীনতা মানুষকে দরিদ্র করে রেখেছে। এ দেশে সম্পদ কখনোই কম ছিল না; শ্রম দিয়ে মানুষ উৎপাদনও করেছে, কিন্তু এখানকার সম্পদ পাচার হয়ে গেছে, বিদেশে।
ভূমি উর্বর। ফসল ফলে সহজে। কিন্তু সে-ফসল উৎপাদনকারীরা পায় না। লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আবার বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক কিছু। ভয়টা আর কাটে না।সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান শিক্ষা। সেই শিক্ষাতেও ওই ভয়টা নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হয়। বাল্যশিক্ষার বইতে আমরা একেবারে প্রথমেই পড়েছি ‘অ’তে অজগর আসছে তেড়ে। এখন হয়তো বর্ণপরিচয়ের বইতে ‘অ’বর্ণের ওই পরিচয়টি নেই; কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়টা ব্যাপ্ত রয়ে গেছে। ভয় ফেল করবার। ফেল করলে শাস্তি পাবার।
ভয়ের উল্টো পিঠে থাকে লোভ। বর্ণপরিচয়ে ‘আ’তে ছিল, ‘আমটি আমি খাব পেড়ে।’ আমগাছটি আমি লাগাইনি, আমের ফলনে আমার কোনো শ্রম নেই; কিন্তু গাছে যেহেতু সেটি ঝুলছে, তাই আমি সেটি পেড়ে নেব, খেয়ে ফেলব, কাউকে দেব না। কি পুঁজিবাদী কি সামন্তবাদী—সব ব্যবস্থাতেই ভীতি ও প্রলোভনের এই দ্বৈত শিক্ষাটা অনবরত দেওয়া হচ্ছে। দারিদ্র্য, ভীতি ও লোভ (যা পূরণ হয় না), এরা মিলে বাড়িয়ে তোলে মাতার বিষণ্নতা। বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বাঙালির
এই বিষণ্নতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। এই বিষণ্নতার অন্তরে রয়েছে গভীর বেদনা, দুর্ভর হতাশা। কিন্তু বাঙালির ভেতর আবার বিদ্রোহও আছে। আসলে বেদনা ও বিদ্রোহ—দুটো মিলিয়েই বাঙালির সংস্কৃতি। বেদনা ও বিদ্রোহের ভেতরকার সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক; এতে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না, তবে বাড়ে বিষণ্নতা। জীবনানন্দ দাশ যেমন বেদনাকে মূর্ত করেছেন, তেমনি তাঁরই সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যও ওই বিদ্রোহের, তথা বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা, তারই কবি। সময় জিনিসটা জীবনানন্দ ও সুকান্ত—উভয়ের জন্যই সত্য।
সময়কে বোঝাবার জন্য ঘড়ির রূপক দুজনেই ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতা ‘ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত’ কবিতাতে বলছেন যে ঘড়ির কাঁটা তাঁদেরকে, তাঁকে ও তাঁর প্রিয়তমাকে, নিয়ে যেতে চায় যেন ‘শব্দহীন মাটি ঘাসের দিকে’, যেখানে ‘সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনো দিন যাবে না’; তবু সেদিকেই যেতে হয়, ‘কী গভীর সহজ অভ্যাসে’। অভ্যাসটা মৃত্যুর দিকে যাওয়ারই। কিন্তু সাহস সংকল্প প্রেম, এরা তো মিথ্যা নয়; তারা আছে, তারা মৃত্যুর দিকে যাবে না।
আর ওই সাহস সংকল্প প্রেমই দেখি মুখর হয়ে উঠেছে সুকান্তের ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতায়: ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি।’বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধানসত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত।কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষবিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদেরমধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সেই কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের পরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না। পৃথিবীটাকে বদলাবেন। তার জন্য প্রয়োজন হবে বেদনার্ত মানুষদের ঐক্য, আর সে-ঐক্য গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক যা, তা হলো সমাজ-রূপান্তরকামী সংস্কৃতির চর্চা।
সাহিত্য তাতে খুব বড় একটা ভূমিকা রাখবে। সাহিত্যের মূল কাজটাই তো হলো সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংহতি গড়ে তোলা; পুঁজিবাদ যেটা চায় না। পুঁজিবাদের কাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা। সাহিত্যও সংস্কৃতিরই অংশ; এবং সংস্কৃতির কাজও হচ্ছে ঐক্য সৃষ্টি। তবে সাহিত্যে যেমন, সংস্কৃতিতেও তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলতা কার্যকর থাকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-পুরুষে বৈষম্য, উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসবের লালন-পালন প্রতিক্রিয়াশীলতার তৎপরতারই অংশ। নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়বার জন্য তাই প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের।
সত্য হলো এই যে পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সমানে চলছে। মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য ঘণ্টাধ্বনি অনবরত বাজছে। সেটা না শুনলে বিপদ এগিয়ে আসবে। এই ঘণ্টাধ্বনি কেবল বাংলাদেশে নয়, বাজছে বিশ্বব্যাপী। ডাক দিচ্ছে সংবেদনশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য, পুঁজিবাদের বিষাক্ত নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ডাক দিচ্ছে বিপ্লবাভিমুখী বিদ্রোহের।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধান সত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত। কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষ বিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদের মধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সে-কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের ওপরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদ যেমন আন্তর্জাতিক, তার বিকল্পও হওয়া দরকার তার চেয়ে গভীরভাবে আন্তর্জাতিক। সমাজবিপ্লবের জন্য খুব বেশি করে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ও প্রস্তুতির। সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, আলোচনা-বিতর্ক, নাটক, নৃত্য, প্রচারমাধ্যম—সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটা এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
পুঁজিবাদ ওই কাজকেই বিশেষ রকমের কঠিন করে তুলেছে। বৈশ্বিক এই আদর্শের কাছে সবকিছুরই ওজন হয় মুনাফার বাটখারায়। সংস্কৃতির চর্চাকেও সে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে তুমুলভাবে আগ্রহী। স্পর্শমাত্র পণ্যে পরিণত করার ক্ষমতা সে রাখেও। সংস্কৃতির বাণিজ্যিক চর্চার বিপক্ষে এবং মানবিক চর্চার পক্ষে আজ দাঁড়ানো চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির মানবিক চর্চারই অপর নাম সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা।
পুঁজিবাদ মনেপ্রাণে সংস্কৃতির এই চর্চার বিরোধী। সংস্কৃতিচর্চা বিনোদন সরবরাহ করবে, এটা ঠিক আছে। অশ্লীল হলে তো আরও ভালো। তাতে বাণিজ্য জমবে এবং তার চেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি ঘটবে, সেটা হলো মানুষকে সামাজিক বিপ্লববিরোধী করা যাবে। বিপ্লববিরোধিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার চমৎকার নিদর্শন এখন পাওয়া যাচ্ছে সর্বাধিক উন্নত-বলে-কথিত আমেরিকায়। সেখানে শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী উন্মত্ততা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে হত্যা শুরু হওয়ার দশা। এবং ওই বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই জিতিয়েছেন এবং তাঁর বিজয়ে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদ গভীর ধরনের সাহিত্যের চর্চা একেবারেই পছন্দ করে না। সে জন্য দেখছি পাঠককে যে-সাহিত্য ধাক্কা দেয়, চিন্তিত করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রচার নেই, বাজারও নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা। সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বব ডিলানকে, যিনি উঁচু মানের একজন সংগীত রচয়িতা এবং সংগীতশিল্পী অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে তিনি সাহিত্যিক
বলে মনে করেন না, যে জন্য পুরস্কার গ্রহণে তাঁর রীতিমতো দ্বিধা ছিল। এর পরে এক বছর তো পুরস্কার দেওয়াই হলো না দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণে। তবে অন্তরালে যা-ই থাকুক, সামনে থেকে তো বোঝা যাচ্ছে সাহিত্যচর্চা তার আগের, এবং সর্বকালের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সাহিত্য তো থাকবে। এই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, ঠিক তত দিন সাহিত্যও থাকবে। কারণ, সাহিত্য মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ ও লালন করে। কিন্তু সে জন্য সাহিত্যকে গভীর হতে হবে, মনভোলানোর ছলাকলানির্ভর হলে চলবে না। যাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, সে-কালে আওয়াজ উঠেছে ‘আনন্দের সাহিত্য চাই’, কেউবা আবার ঘোষণাই দিয়েছেন, সহেনা সহেনা প্রাণে জনতার জঘন্য মিতালী। উদারনীতিক যিনি, তিনি বলেছেন, অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি নিশ্চয়ই আছেন, যিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়াটায় ও পোড়োবাড়িটায়।
মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কবিও চেষ্টা করেছেন বিপ্লবী মার্ক্সের সঙ্গে ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের মিলন ঘটানোর। এসব কাজ সাহিত্যকে গভীরতা দেয়নি, এমনকি সাহিত্যের গুরুত্বকে যে দৃশ্যমান করবে, সে কাজটাও করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির চর্চার। এটা বোধ করি মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে। গাছপালা, নদ-নদী, অর্থনীতির কৃষিনির্ভরতা, বহুকালের খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু নরম ধরনের। মাংসের চেয়ে মাছ ও শাকসবজি এখানকার মানুষের অধিক পছন্দ। তারা স্বল্পে সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
আমাদের সমাজ অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক, ভীষণভাবে পিতৃতান্ত্রিক; কিন্তু সংস্কৃতিতে মাতার ভূমিকা থাকে, সেটা যত অপ্রত্যক্ষ ততই কার্যকর, শিরা-উপশিরার মতো। ঘরগেরস্তালির নিত্যদিনের পরিচালনা ও সন্তানের লালন-পালনের মাধ্যমে এবং আহার প্রস্তুত ও পরিবেশনার ভেতরে মা আছেন। মা থাকেন। সবকিছুতে স্নেহের মিশ্রণ ঘটিয়ে। মা নিজে কিন্তু বিষণ্নই থাকেন। বাধ্য হন থাকতে। ওদিকে সংস্কৃতিতে আবার ভয়ও কাজ করে। সুদীর্ঘকালের পরাধীনতা মানুষকে দরিদ্র করে রেখেছে। এ দেশে সম্পদ কখনোই কম ছিল না; শ্রম দিয়ে মানুষ উৎপাদনও করেছে, কিন্তু এখানকার সম্পদ পাচার হয়ে গেছে, বিদেশে।
ভূমি উর্বর। ফসল ফলে সহজে। কিন্তু সে-ফসল উৎপাদনকারীরা পায় না। লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আবার বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক কিছু। ভয়টা আর কাটে না।সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান শিক্ষা। সেই শিক্ষাতেও ওই ভয়টা নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হয়। বাল্যশিক্ষার বইতে আমরা একেবারে প্রথমেই পড়েছি ‘অ’তে অজগর আসছে তেড়ে। এখন হয়তো বর্ণপরিচয়ের বইতে ‘অ’বর্ণের ওই পরিচয়টি নেই; কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়টা ব্যাপ্ত রয়ে গেছে। ভয় ফেল করবার। ফেল করলে শাস্তি পাবার।
ভয়ের উল্টো পিঠে থাকে লোভ। বর্ণপরিচয়ে ‘আ’তে ছিল, ‘আমটি আমি খাব পেড়ে।’ আমগাছটি আমি লাগাইনি, আমের ফলনে আমার কোনো শ্রম নেই; কিন্তু গাছে যেহেতু সেটি ঝুলছে, তাই আমি সেটি পেড়ে নেব, খেয়ে ফেলব, কাউকে দেব না। কি পুঁজিবাদী কি সামন্তবাদী—সব ব্যবস্থাতেই ভীতি ও প্রলোভনের এই দ্বৈত শিক্ষাটা অনবরত দেওয়া হচ্ছে। দারিদ্র্য, ভীতি ও লোভ (যা পূরণ হয় না), এরা মিলে বাড়িয়ে তোলে মাতার বিষণ্নতা। বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বাঙালির
এই বিষণ্নতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। এই বিষণ্নতার অন্তরে রয়েছে গভীর বেদনা, দুর্ভর হতাশা। কিন্তু বাঙালির ভেতর আবার বিদ্রোহও আছে। আসলে বেদনা ও বিদ্রোহ—দুটো মিলিয়েই বাঙালির সংস্কৃতি। বেদনা ও বিদ্রোহের ভেতরকার সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক; এতে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না, তবে বাড়ে বিষণ্নতা। জীবনানন্দ দাশ যেমন বেদনাকে মূর্ত করেছেন, তেমনি তাঁরই সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যও ওই বিদ্রোহের, তথা বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা, তারই কবি। সময় জিনিসটা জীবনানন্দ ও সুকান্ত—উভয়ের জন্যই সত্য।
সময়কে বোঝাবার জন্য ঘড়ির রূপক দুজনেই ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতা ‘ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত’ কবিতাতে বলছেন যে ঘড়ির কাঁটা তাঁদেরকে, তাঁকে ও তাঁর প্রিয়তমাকে, নিয়ে যেতে চায় যেন ‘শব্দহীন মাটি ঘাসের দিকে’, যেখানে ‘সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনো দিন যাবে না’; তবু সেদিকেই যেতে হয়, ‘কী গভীর সহজ অভ্যাসে’। অভ্যাসটা মৃত্যুর দিকে যাওয়ারই। কিন্তু সাহস সংকল্প প্রেম, এরা তো মিথ্যা নয়; তারা আছে, তারা মৃত্যুর দিকে যাবে না।
আর ওই সাহস সংকল্প প্রেমই দেখি মুখর হয়ে উঠেছে সুকান্তের ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতায়: ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি।’বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধানসত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত।কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষবিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদেরমধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সেই কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের পরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না। পৃথিবীটাকে বদলাবেন। তার জন্য প্রয়োজন হবে বেদনার্ত মানুষদের ঐক্য, আর সে-ঐক্য গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক যা, তা হলো সমাজ-রূপান্তরকামী সংস্কৃতির চর্চা।
সাহিত্য তাতে খুব বড় একটা ভূমিকা রাখবে। সাহিত্যের মূল কাজটাই তো হলো সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংহতি গড়ে তোলা; পুঁজিবাদ যেটা চায় না। পুঁজিবাদের কাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা। সাহিত্যও সংস্কৃতিরই অংশ; এবং সংস্কৃতির কাজও হচ্ছে ঐক্য সৃষ্টি। তবে সাহিত্যে যেমন, সংস্কৃতিতেও তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলতা কার্যকর থাকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-পুরুষে বৈষম্য, উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসবের লালন-পালন প্রতিক্রিয়াশীলতার তৎপরতারই অংশ। নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়বার জন্য তাই প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের।
সত্য হলো এই যে পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সমানে চলছে। মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য ঘণ্টাধ্বনি অনবরত বাজছে। সেটা না শুনলে বিপদ এগিয়ে আসবে। এই ঘণ্টাধ্বনি কেবল বাংলাদেশে নয়, বাজছে বিশ্বব্যাপী। ডাক দিচ্ছে সংবেদনশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য, পুঁজিবাদের বিষাক্ত নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ডাক দিচ্ছে বিপ্লবাভিমুখী বিদ্রোহের।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদ যেমন আন্তর্জাতিক, তার বিকল্পও হওয়া দরকার তার চেয়ে গভীরভাবে আন্তর্জাতিক। সমাজবিপ্লবের জন্য খুব বেশি করে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ও প্রস্তুতির। সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, আলোচনা-বিতর্ক, নাটক, নৃত্য, প্রচারমাধ্যম—সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটা এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
পুঁজিবাদ ওই কাজকেই বিশেষ রকমের কঠিন করে তুলেছে। বৈশ্বিক এই আদর্শের কাছে সবকিছুরই ওজন হয় মুনাফার বাটখারায়। সংস্কৃতির চর্চাকেও সে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে তুমুলভাবে আগ্রহী। স্পর্শমাত্র পণ্যে পরিণত করার ক্ষমতা সে রাখেও। সংস্কৃতির বাণিজ্যিক চর্চার বিপক্ষে এবং মানবিক চর্চার পক্ষে আজ দাঁড়ানো চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির মানবিক চর্চারই অপর নাম সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা।
পুঁজিবাদ মনেপ্রাণে সংস্কৃতির এই চর্চার বিরোধী। সংস্কৃতিচর্চা বিনোদন সরবরাহ করবে, এটা ঠিক আছে। অশ্লীল হলে তো আরও ভালো। তাতে বাণিজ্য জমবে এবং তার চেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি ঘটবে, সেটা হলো মানুষকে সামাজিক বিপ্লববিরোধী করা যাবে। বিপ্লববিরোধিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার চমৎকার নিদর্শন এখন পাওয়া যাচ্ছে সর্বাধিক উন্নত-বলে-কথিত আমেরিকায়। সেখানে শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী উন্মত্ততা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে হত্যা শুরু হওয়ার দশা। এবং ওই বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই জিতিয়েছেন এবং তাঁর বিজয়ে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদ গভীর ধরনের সাহিত্যের চর্চা একেবারেই পছন্দ করে না। সে জন্য দেখছি পাঠককে যে-সাহিত্য ধাক্কা দেয়, চিন্তিত করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রচার নেই, বাজারও নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা। সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বব ডিলানকে, যিনি উঁচু মানের একজন সংগীত রচয়িতা এবং সংগীতশিল্পী অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে তিনি সাহিত্যিক
বলে মনে করেন না, যে জন্য পুরস্কার গ্রহণে তাঁর রীতিমতো দ্বিধা ছিল। এর পরে এক বছর তো পুরস্কার দেওয়াই হলো না দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণে। তবে অন্তরালে যা-ই থাকুক, সামনে থেকে তো বোঝা যাচ্ছে সাহিত্যচর্চা তার আগের, এবং সর্বকালের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সাহিত্য তো থাকবে। এই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, ঠিক তত দিন সাহিত্যও থাকবে। কারণ, সাহিত্য মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ ও লালন করে। কিন্তু সে জন্য সাহিত্যকে গভীর হতে হবে, মনভোলানোর ছলাকলানির্ভর হলে চলবে না। যাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, সে-কালে আওয়াজ উঠেছে ‘আনন্দের সাহিত্য চাই’, কেউবা আবার ঘোষণাই দিয়েছেন, সহেনা সহেনা প্রাণে জনতার জঘন্য মিতালী। উদারনীতিক যিনি, তিনি বলেছেন, অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি নিশ্চয়ই আছেন, যিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়াটায় ও পোড়োবাড়িটায়।
মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কবিও চেষ্টা করেছেন বিপ্লবী মার্ক্সের সঙ্গে ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের মিলন ঘটানোর। এসব কাজ সাহিত্যকে গভীরতা দেয়নি, এমনকি সাহিত্যের গুরুত্বকে যে দৃশ্যমান করবে, সে কাজটাও করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির চর্চার। এটা বোধ করি মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে। গাছপালা, নদ-নদী, অর্থনীতির কৃষিনির্ভরতা, বহুকালের খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু নরম ধরনের। মাংসের চেয়ে মাছ ও শাকসবজি এখানকার মানুষের অধিক পছন্দ। তারা স্বল্পে সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
আমাদের সমাজ অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক, ভীষণভাবে পিতৃতান্ত্রিক; কিন্তু সংস্কৃতিতে মাতার ভূমিকা থাকে, সেটা যত অপ্রত্যক্ষ ততই কার্যকর, শিরা-উপশিরার মতো। ঘরগেরস্তালির নিত্যদিনের পরিচালনা ও সন্তানের লালন-পালনের মাধ্যমে এবং আহার প্রস্তুত ও পরিবেশনার ভেতরে মা আছেন। মা থাকেন। সবকিছুতে স্নেহের মিশ্রণ ঘটিয়ে। মা নিজে কিন্তু বিষণ্নই থাকেন। বাধ্য হন থাকতে। ওদিকে সংস্কৃতিতে আবার ভয়ও কাজ করে। সুদীর্ঘকালের পরাধীনতা মানুষকে দরিদ্র করে রেখেছে। এ দেশে সম্পদ কখনোই কম ছিল না; শ্রম দিয়ে মানুষ উৎপাদনও করেছে, কিন্তু এখানকার সম্পদ পাচার হয়ে গেছে, বিদেশে।
ভূমি উর্বর। ফসল ফলে সহজে। কিন্তু সে-ফসল উৎপাদনকারীরা পায় না। লুণ্ঠিত হয়ে যায়। আবার বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক কিছু। ভয়টা আর কাটে না।সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান শিক্ষা। সেই শিক্ষাতেও ওই ভয়টা নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হয়। বাল্যশিক্ষার বইতে আমরা একেবারে প্রথমেই পড়েছি ‘অ’তে অজগর আসছে তেড়ে। এখন হয়তো বর্ণপরিচয়ের বইতে ‘অ’বর্ণের ওই পরিচয়টি নেই; কিন্তু পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়টা ব্যাপ্ত রয়ে গেছে। ভয় ফেল করবার। ফেল করলে শাস্তি পাবার।
ভয়ের উল্টো পিঠে থাকে লোভ। বর্ণপরিচয়ে ‘আ’তে ছিল, ‘আমটি আমি খাব পেড়ে।’ আমগাছটি আমি লাগাইনি, আমের ফলনে আমার কোনো শ্রম নেই; কিন্তু গাছে যেহেতু সেটি ঝুলছে, তাই আমি সেটি পেড়ে নেব, খেয়ে ফেলব, কাউকে দেব না। কি পুঁজিবাদী কি সামন্তবাদী—সব ব্যবস্থাতেই ভীতি ও প্রলোভনের এই দ্বৈত শিক্ষাটা অনবরত দেওয়া হচ্ছে। দারিদ্র্য, ভীতি ও লোভ (যা পূরণ হয় না), এরা মিলে বাড়িয়ে তোলে মাতার বিষণ্নতা। বাঙালির, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের বাঙালির
এই বিষণ্নতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। এই বিষণ্নতার অন্তরে রয়েছে গভীর বেদনা, দুর্ভর হতাশা। কিন্তু বাঙালির ভেতর আবার বিদ্রোহও আছে। আসলে বেদনা ও বিদ্রোহ—দুটো মিলিয়েই বাঙালির সংস্কৃতি। বেদনা ও বিদ্রোহের ভেতরকার সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক; এতে কোনো পক্ষই জয়ী হয় না, তবে বাড়ে বিষণ্নতা। জীবনানন্দ দাশ যেমন বেদনাকে মূর্ত করেছেন, তেমনি তাঁরই সমসাময়িক কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যও ওই বিদ্রোহের, তথা বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা, তারই কবি। সময় জিনিসটা জীবনানন্দ ও সুকান্ত—উভয়ের জন্যই সত্য।
সময়কে বোঝাবার জন্য ঘড়ির রূপক দুজনেই ব্যবহার করেছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতা ‘ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত’ কবিতাতে বলছেন যে ঘড়ির কাঁটা তাঁদেরকে, তাঁকে ও তাঁর প্রিয়তমাকে, নিয়ে যেতে চায় যেন ‘শব্দহীন মাটি ঘাসের দিকে’, যেখানে ‘সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনো দিন যাবে না’; তবু সেদিকেই যেতে হয়, ‘কী গভীর সহজ অভ্যাসে’। অভ্যাসটা মৃত্যুর দিকে যাওয়ারই। কিন্তু সাহস সংকল্প প্রেম, এরা তো মিথ্যা নয়; তারা আছে, তারা মৃত্যুর দিকে যাবে না।
আর ওই সাহস সংকল্প প্রেমই দেখি মুখর হয়ে উঠেছে সুকান্তের ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতায়: ‘বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?/ এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি।’বেদনা ও বিপদ এখন সারা পৃথিবীতে প্রধানসত্য। নানাবিধ বিষের ক্রিয়ায় মানুষ জর্জরিত।কিন্তু বেদনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছে না, মানুষবিদ্রোহী হয়ে যে উঠবে, তেমনটা ঘটছে না। বিপদেরমধ্যে আরেক বিপদ, বড় বিপদই বলা যায়, এখন দেশজুড়ে। যাঁরা আস্থা রাখেন মানুষের ভবিষ্যতের ওপর এবং সেই কারণে মানুষের মনুষ্যত্বের পরই, তাঁরা নিশ্চয়ই পরাভূত হবেন না। পৃথিবীটাকে বদলাবেন। তার জন্য প্রয়োজন হবে বেদনার্ত মানুষদের ঐক্য, আর সে-ঐক্য গড়ে তোলার জন্য অত্যাবশ্যক যা, তা হলো সমাজ-রূপান্তরকামী সংস্কৃতির চর্চা।
সাহিত্য তাতে খুব বড় একটা ভূমিকা রাখবে। সাহিত্যের মূল কাজটাই তো হলো সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংহতি গড়ে তোলা; পুঁজিবাদ যেটা চায় না। পুঁজিবাদের কাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা। সাহিত্যও সংস্কৃতিরই অংশ; এবং সংস্কৃতির কাজও হচ্ছে ঐক্য সৃষ্টি। তবে সাহিত্যে যেমন, সংস্কৃতিতেও তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলতা কার্যকর থাকে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, নারী-পুরুষে বৈষম্য, উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসবের লালন-পালন প্রতিক্রিয়াশীলতার তৎপরতারই অংশ। নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়বার জন্য তাই প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের।
সত্য হলো এই যে পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সমানে চলছে। মনুষ্যত্বের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য ঘণ্টাধ্বনি অনবরত বাজছে। সেটা না শুনলে বিপদ এগিয়ে আসবে। এই ঘণ্টাধ্বনি কেবল বাংলাদেশে নয়, বাজছে বিশ্বব্যাপী। ডাক দিচ্ছে সংবেদনশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য, পুঁজিবাদের বিষাক্ত নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ডাক দিচ্ছে বিপ্লবাভিমুখী বিদ্রোহের।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১১ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১১ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক।
২০ আগস্ট ২০২৫
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১১ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১১ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে, কিন্তু ব্যারিস্টার বা উকিল হলেই দেশের ইতিহাস ভালো জানবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাঁদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা কটাক্ষের ব্যাপারে তেমন কোনো কড়া কথা আমি অন্তত বলতে শুনিনি।
যতদূর স্মরণ করতে পারি, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকে ছোট করার জন্য সংঘটিত হয়নি। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে শামিল হয়েছিল দেশের আপামর মানুষ। এদের সবাই একই ভাবনা নিয়ে সামনের পথে এগোয়নি। সরকার পতন হলে কী হতে পারে কৌশল—এ রকম ভাবনাও কারও মাথায় ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রাণের তাগিদে। যখন লাশ পড়ছিল একের পর এক, তখন রাজপথকেই বেছে নিয়েছিল তারা। কিন্তু এই প্রচণ্ড আলোড়নে সরকার পড়ে যাবে—এ রকম ভাবনা হয়তো তাদের ছিল না। ছিল না সে রকম কোনো প্রস্তুতি। তাই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় কিছু প্রগাঢ় নীতিকথার জন্ম দিলেও রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কোনো দিশা দেয়নি। শুধু কি নীতিকথা? অশ্রাব্য উচ্চারণ করে লাইক-কমেন্টে ছেয়ে যাওয়া একদল নেতার সন্ধান আজকাল পাওয়া যাচ্ছে, যাঁরা টিনের চালে কাউয়ার পাশাপাশি আরও কত কিছু দেখছেন! বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে করতে চাঁদাবাজি করার পথে শামিল হচ্ছেন। আর এই ধরনের অরাজকতা চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রচার করছেন গণমাধ্যমে। তাঁরা ভাবছেন, স্বাধীনতার সব অর্জনকে কটাক্ষ করতে পারলে এ দেশের মানুষ একদিন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর সহযাত্রী হয়ে উঠবে আবারও।
কী হতে কী হয়ে গেল, এখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় মানুষ। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বা বিজয় শব্দগুলো কি নিষিদ্ধ হয়ে গেল নাকি? গত বছর শিল্পকলা একাডেমি যখন বিজয় উৎসব পালন করছিল, তখন ভয়ে ভয়ে তারা ‘বিজয় উৎসব’কে ‘ডিসেম্বর উৎসব’ লিখেছিল, সে কথা কি মনে আছে কারও? পরে প্রবল আপত্তির মুখে আবার তারা ‘বিজয় উৎসব’-এ ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা আর বিজয় শব্দ দুটি উচ্চারণ করার মতো বুকের পাটা নেই একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের—এটা যে কত বড় দুর্ভাবনার ব্যাপার, তা কি বলে বোঝানো যাবে?
১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে, তার ছাপ পাওয়া যায় সারা বিশ্বে। সে সময়কার বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোন কোন ব্যাপার নিয়ে অস্থিরতা চলছিল। মনে করিয়ে দিই, রাশিয়া-চীনের দ্বন্দ্বের কারণে কমিউনিস্ট দুনিয়ার ভাঙন, পরাশক্তি হিসেবে মার্কিনদের বিজয়যাত্রা, সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ, উপনিবেশগুলো ভেঙে নতুন নতুন স্বাধীন দেশ গঠন এবং তার কোনো কোনো দেশের বাম দিকে ঘেঁষা রাজনীতি, কিছু কিছু দেশে নব্য স্বৈরাচারের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা প্যাঁচে পড়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক রাজনীতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন আলোচনায় রয়েছে। এ রকমই একটা অবস্থায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ৬ দফা। সেই ৬ দফা নতুন কিছু ছিল না। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে কিংবা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারেও এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টির দেখা মেলে। ১৯৬৬ সালের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চালানো শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি আমূল প্রকাশিত হয়ে পড়লে তা বাঙালির আবেগকে তাড়িত করেছিল। ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ জানান দিয়েছিল, মাথায় হাত বোলানোর রাজনীতি আর চলবে না এখানে।
এত বড় বড় দল থাকতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কী করে আওয়ামী লীগ এত বড় বিজয় পেল, সে ইতিহাস নানাভাবে লেখা হয়েছে। এটাই ছিল বাংলার রায়। দেশের জনগণ সেই রায়ে ক্ষমতা দিয়েছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। সলিমুল্লাহ খানদের গুরু আহমদ ছফার বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রযোজ্য। ছফা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যারা এই সত্য অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হব না।’ ভুল শোনেননি, ছফা এ কথাই বলেছেন। এবং এখানেই তা শেষ করেননি। তিনি যোগ করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যত পণ্ডিত হোন না কেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না।’
ছফাকে এসব কথা বলতে হলো কেন? তিনি তো তাঁর শিষ্যদের মতোই শেখ মুজিবকে অগ্রাহ্য করে অথবা জাতির ভিলেন বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। কেন ছফা সেটা করেননি? আমার মনে হয়, ছফা ভেবে দেখেছেন, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিলে ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে তা ধরা পড়বেই। তখন আত্মপরিচয়েই টান পড়বে। শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করলেও ছফা স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ মতামত দিয়েছেন।
ইতিহাসবিমুখ পাকিস্তানপ্রেমী অর্বাচীনেরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ইতিহাস বিকৃতি করে চলেছেন। এতে আমাদের তরুণসমাজ কতটা বিভ্রান্ত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এত দ্রুত পাওয়া যাবে না।
বিষয়টি বুঝতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। আমাদের সমাজে এই প্রতীকগুলো কীভাবে আছে, তা বুঝতে পারলেই স্বাধীনতা বা বিজয় আমাদের দেশে এখন কোন মর্যাদায় আছে, তা বোঝা যাবে। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেমকে হুমকির মুখে ফেলতে হলে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যাতে শুরুতেই ভয় আর আতঙ্ককে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তারপর প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে বাজে কথা বলা—এভাবেই আস্তে আস্তে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাদের পায়ের নিচে মাটি খোঁজে।
পাঠক, আপনি মনে করুন একটি পরীক্ষা দিতে বসেছেন। আমি কিছু প্রশ্ন রেখে যাব, পাঠক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিজেই এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলোয় নম্বর দেবেন। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন, কেমন আছে আজকের বাংলাদেশ।
প্রশ্নগুলো এমন: কেমন আছে দেশের বিচারব্যবস্থা? কেমন আছে নির্বাচন কমিশন? তারা কি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোন অবস্থায় আছে? সাংবাদিক-লেখক-গবেষকেরা কি নির্দ্বিধায় নির্বিঘ্নে কাজ করার মতো পরিবেশ পাচ্ছেন?
সমাজে কোনো বড় সংঘাত নেই তো? ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সব জায়গা থেকে। দেশের ডাকসাইটে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সেই ঐক্য কি দেখা যাচ্ছে? বিভাজনের রাজনীতিকে কি সরিয়ে দেওয়া গেছে? সন্দেহ-অবিশ্বাসের রাজনীতি কি আছে, নাকি বিদায় নিয়েছে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণ কি সন্তুষ্ট? মব বলুন আর চাপ প্রয়োগের রাজনীতি বলুন, সেগুলো কি জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে?
আপনি কি এমন কিছু লক্ষ করছেন, যেখানে সত্য ও মিথ্যাকে কাছাকাছি রেখে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয়?
আপনি কি সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করেছেন? আউল-বাউলের দেশে গানবাজনা কি হুমকির মুখে পড়েছে? ‘তৌহিদি জনতা’ আদতে কাদের কোন লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে? সরকার কি এদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে? উত্তেজনা ছড়ায় যারা, তাদের পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, আর যারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এ রকম কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?
সমষ্টিগত শক্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো বাঁশিওয়ালা কি বাঁশি বাজাচ্ছে? আপনি কি লক্ষ করেছেন শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নয়, নানাভাবে যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁদের মারধর করে সংখ্যাগুরু অংশ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে?
আপনি কি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো অঙ্গীকার দেখতে পাচ্ছেন, যাতে তাদের ইশতেহার অনুযায়ী জনগণ একটি ‘সোনার বাংলা’য় বসবাস করবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে লিখুন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ করুন। যোগফল মেলান, তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসুন।
আপনি তখন বুঝতে পারবেন, গণ-অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ স্বাধীনতাবিরোধিতার জায়গায় সুকৌশলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যে তরুণেরা সেই অপচেষ্টা রুখে দিতে পারে, সে তরুণদের প্রতীক্ষায় আছি।

হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে, কিন্তু ব্যারিস্টার বা উকিল হলেই দেশের ইতিহাস ভালো জানবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের দেশের কিছু আইন ব্যবসায়ী আমাদের বিজয় নিয়ে, বিজয়ের নায়কদের নিয়ে যেসব কথা বলে চলেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া দরকার। তাঁদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করা কটাক্ষের ব্যাপারে তেমন কোনো কড়া কথা আমি অন্তত বলতে শুনিনি।
যতদূর স্মরণ করতে পারি, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকে ছোট করার জন্য সংঘটিত হয়নি। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারে শামিল হয়েছিল দেশের আপামর মানুষ। এদের সবাই একই ভাবনা নিয়ে সামনের পথে এগোয়নি। সরকার পতন হলে কী হতে পারে কৌশল—এ রকম ভাবনাও কারও মাথায় ছিল বলে মনে হয় না। দেশের ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল প্রাণের তাগিদে। যখন লাশ পড়ছিল একের পর এক, তখন রাজপথকেই বেছে নিয়েছিল তারা। কিন্তু এই প্রচণ্ড আলোড়নে সরকার পড়ে যাবে—এ রকম ভাবনা হয়তো তাদের ছিল না। ছিল না সে রকম কোনো প্রস্তুতি। তাই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয় কিছু প্রগাঢ় নীতিকথার জন্ম দিলেও রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কোনো দিশা দেয়নি। শুধু কি নীতিকথা? অশ্রাব্য উচ্চারণ করে লাইক-কমেন্টে ছেয়ে যাওয়া একদল নেতার সন্ধান আজকাল পাওয়া যাচ্ছে, যাঁরা টিনের চালে কাউয়ার পাশাপাশি আরও কত কিছু দেখছেন! বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে করতে চাঁদাবাজি করার পথে শামিল হচ্ছেন। আর এই ধরনের অরাজকতা চালানোর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতার মালা পরিয়ে প্রচার করছেন গণমাধ্যমে। তাঁরা ভাবছেন, স্বাধীনতার সব অর্জনকে কটাক্ষ করতে পারলে এ দেশের মানুষ একদিন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর সহযাত্রী হয়ে উঠবে আবারও।
কী হতে কী হয়ে গেল, এখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় মানুষ। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বা বিজয় শব্দগুলো কি নিষিদ্ধ হয়ে গেল নাকি? গত বছর শিল্পকলা একাডেমি যখন বিজয় উৎসব পালন করছিল, তখন ভয়ে ভয়ে তারা ‘বিজয় উৎসব’কে ‘ডিসেম্বর উৎসব’ লিখেছিল, সে কথা কি মনে আছে কারও? পরে প্রবল আপত্তির মুখে আবার তারা ‘বিজয় উৎসব’-এ ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতা আর বিজয় শব্দ দুটি উচ্চারণ করার মতো বুকের পাটা নেই একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের—এটা যে কত বড় দুর্ভাবনার ব্যাপার, তা কি বলে বোঝানো যাবে?
১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছিল এই ভূখণ্ডে, তার ছাপ পাওয়া যায় সারা বিশ্বে। সে সময়কার বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোন কোন ব্যাপার নিয়ে অস্থিরতা চলছিল। মনে করিয়ে দিই, রাশিয়া-চীনের দ্বন্দ্বের কারণে কমিউনিস্ট দুনিয়ার ভাঙন, পরাশক্তি হিসেবে মার্কিনদের বিজয়যাত্রা, সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ, উপনিবেশগুলো ভেঙে নতুন নতুন স্বাধীন দেশ গঠন এবং তার কোনো কোনো দেশের বাম দিকে ঘেঁষা রাজনীতি, কিছু কিছু দেশে নব্য স্বৈরাচারের আবির্ভাব ইত্যাদি নানা প্যাঁচে পড়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক রাজনীতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন আলোচনায় রয়েছে। এ রকমই একটা অবস্থায় ষাটের দশকের মধ্যভাগে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন ৬ দফা। সেই ৬ দফা নতুন কিছু ছিল না। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে কিংবা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারেও এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টির দেখা মেলে। ১৯৬৬ সালের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চালানো শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টি আমূল প্রকাশিত হয়ে পড়লে তা বাঙালির আবেগকে তাড়িত করেছিল। ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ জানান দিয়েছিল, মাথায় হাত বোলানোর রাজনীতি আর চলবে না এখানে।
এত বড় বড় দল থাকতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কী করে আওয়ামী লীগ এত বড় বিজয় পেল, সে ইতিহাস নানাভাবে লেখা হয়েছে। এটাই ছিল বাংলার রায়। দেশের জনগণ সেই রায়ে ক্ষমতা দিয়েছিল ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। সলিমুল্লাহ খানদের গুরু আহমদ ছফার বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রযোজ্য। ছফা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যারা এই সত্য অস্বীকার করবে, তাদের সঙ্গে কোনো রকমের বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ করতেও আমরা রাজি হব না।’ ভুল শোনেননি, ছফা এ কথাই বলেছেন। এবং এখানেই তা শেষ করেননি। তিনি যোগ করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে শেখ মুজিবের নাম এমন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে, যত পণ্ডিত হোন না কেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নিপুণতা এবং যুক্তির মারপ্যাঁচ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তি একটা থেকে আর একটাকে পৃথক করতে পারবেন না।’
ছফাকে এসব কথা বলতে হলো কেন? তিনি তো তাঁর শিষ্যদের মতোই শেখ মুজিবকে অগ্রাহ্য করে অথবা জাতির ভিলেন বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারতেন। কেন ছফা সেটা করেননি? আমার মনে হয়, ছফা ভেবে দেখেছেন, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিলে ইতিহাসের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে তা ধরা পড়বেই। তখন আত্মপরিচয়েই টান পড়বে। শেখ মুজিব সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করলেও ছফা স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ মতামত দিয়েছেন।
ইতিহাসবিমুখ পাকিস্তানপ্রেমী অর্বাচীনেরা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ইতিহাস বিকৃতি করে চলেছেন। এতে আমাদের তরুণসমাজ কতটা বিভ্রান্ত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর এত দ্রুত পাওয়া যাবে না।
বিষয়টি বুঝতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। আমাদের সমাজে এই প্রতীকগুলো কীভাবে আছে, তা বুঝতে পারলেই স্বাধীনতা বা বিজয় আমাদের দেশে এখন কোন মর্যাদায় আছে, তা বোঝা যাবে। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেমকে হুমকির মুখে ফেলতে হলে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যাতে শুরুতেই ভয় আর আতঙ্ককে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তারপর প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে বাজে কথা বলা—এভাবেই আস্তে আস্তে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাদের পায়ের নিচে মাটি খোঁজে।
পাঠক, আপনি মনে করুন একটি পরীক্ষা দিতে বসেছেন। আমি কিছু প্রশ্ন রেখে যাব, পাঠক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নিজেই এই পরীক্ষার প্রশ্নগুলোয় নম্বর দেবেন। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন, কেমন আছে আজকের বাংলাদেশ।
প্রশ্নগুলো এমন: কেমন আছে দেশের বিচারব্যবস্থা? কেমন আছে নির্বাচন কমিশন? তারা কি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোন অবস্থায় আছে? সাংবাদিক-লেখক-গবেষকেরা কি নির্দ্বিধায় নির্বিঘ্নে কাজ করার মতো পরিবেশ পাচ্ছেন?
সমাজে কোনো বড় সংঘাত নেই তো? ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে সব জায়গা থেকে। দেশের ডাকসাইটে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সেই ঐক্য কি দেখা যাচ্ছে? বিভাজনের রাজনীতিকে কি সরিয়ে দেওয়া গেছে? সন্দেহ-অবিশ্বাসের রাজনীতি কি আছে, নাকি বিদায় নিয়েছে?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ জনগণ কি সন্তুষ্ট? মব বলুন আর চাপ প্রয়োগের রাজনীতি বলুন, সেগুলো কি জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে?
আপনি কি এমন কিছু লক্ষ করছেন, যেখানে সত্য ও মিথ্যাকে কাছাকাছি রেখে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয়?
আপনি কি সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করেছেন? আউল-বাউলের দেশে গানবাজনা কি হুমকির মুখে পড়েছে? ‘তৌহিদি জনতা’ আদতে কাদের কোন লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে? সরকার কি এদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে? উত্তেজনা ছড়ায় যারা, তাদের পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, আর যারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এ রকম কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে?
সমষ্টিগত শক্তি ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো বাঁশিওয়ালা কি বাঁশি বাজাচ্ছে? আপনি কি লক্ষ করেছেন শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নয়, নানাভাবে যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁদের মারধর করে সংখ্যাগুরু অংশ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে?
আপনি কি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো অঙ্গীকার দেখতে পাচ্ছেন, যাতে তাদের ইশতেহার অনুযায়ী জনগণ একটি ‘সোনার বাংলা’য় বসবাস করবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে লিখুন। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ করুন। যোগফল মেলান, তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসুন।
আপনি তখন বুঝতে পারবেন, গণ-অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ স্বাধীনতাবিরোধিতার জায়গায় সুকৌশলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যে তরুণেরা সেই অপচেষ্টা রুখে দিতে পারে, সে তরুণদের প্রতীক্ষায় আছি।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক।
২০ আগস্ট ২০২৫
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১১ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেড. মঞ্জুরে খোদা

গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোদি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। এই আস্থা ও হৃদ্যতা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গভীর মাত্রাকেই নির্দেশ করে। পুতিন তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের ২৫ বছরে ১০ বার ভারত সফর করেছেন। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম ভারত সফর।
পুতিনের এই ভারত সফর নিছক কোনো রুটিন বিষয় ছিল না। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। তাঁদের সাক্ষাৎ ছিল বিশ্বরাজনীতির আগ্রহের বিষয়, কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক নিয়ে মোদির সঙ্গে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল ও বরফ গলছিল, তখনই পুতিন ভারত সফর করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-রাশিয়া এই বৈঠকে কে কী অর্জন করল, তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা যাক।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
পুতিনের এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করল। রাশিয়া এখনো ভারতের প্রধান সমরাস্ত্রের সরবরাহকারী। যদিও ১৯৭০-৮০-এর দশকে ভারতের অস্ত্রের প্রায় ৮০ ভাগই রাশিয়া সরবরাহ করত। পুতিন এবারের সফরে ভারতকে এস ৫০০ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম হস্তান্তর, অতিরিক্ত সামরিক প্ল্যাটফর্ম, হেলিকপ্টার ও ইঞ্জিন কো-প্রোডাকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো নিয়ে আবারও তাদের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেছে। ‘প্রিভিলেজ কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিকস পার্টনারশিপ’ চুক্তির আওতায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী ভারতের যেকোনো স্থল, বিমান ও নৌবন্দরকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক প্রয়োজনে একে অন্যের ভূমিও ব্যবহার করতে পারবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে এই প্রতিরক্ষা বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারত তাদের কৌশলগত নিজস্বতা নিশ্চিত করল।
জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সুবিধা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে বিপুল তেল আমদানি করছে। এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের জ্বালানিনিরাপত্তা, পরিশোধন সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি তেল-গ্যাস চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করল। রাশিয়ার সস্তা অপরিশোধিত তেল ভারতের মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও সঞ্চয় করতে এবং পরিশোধন মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হলে রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতেও ভূমিকা রাখবে।
বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও এই বাণিজ্য ভারসাম্যমূলক নয়। রাশিয়ায় ভারতীয় আমদানি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে পুতিন-মোদি শীর্ষ সম্মেলনে উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যপণ্যের তালিকা সম্প্রসারণ ঘটবে।
রাশিয়া ভারতীয় সরঞ্জাম, কাঁচামাল এবং খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় করার উপায়গুলো অনুসন্ধান করবে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ওপর ভারত-রাশিয়া আন্তসরকারি কমিশনও গঠিত হবে। মহাকাশ গবেষণা ও ভারত-রাশিয়ার যৌথ সামরিক যন্ত্রাংশ নির্মাণ এবং ভারত তা তৃতীয় কোনো দেশে নিজের উৎপাদিত পণ্য বলে বিক্রিও করার সুবিধা পাবে। ভারতে রুশ নকশায় দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য চীন-রাশিয়া ব্লকের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করবে। ভবিষ্যতে চীন সীমান্ত সমস্যায় রাশিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়া, আর্কটিক, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর—এইসব কৌশলগত এলাকায় সহযোগিতা বাড়ানো ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া চীনের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং একে অন্যের বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্ক তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখার মাধ্যমে চীনকেও জানিয়ে দেওয়া যে, রাশিয়া এখনো ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।
রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে ভারতের সাংবাদিকেরা পুতিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কোনো সংঘাত ও যুদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে ভারত কি আশা করতে পারে যে রাশিয়া তাদের পাশে দাঁড়াবে? তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, ভারতের সঙ্গে চীনের যে বিরোধগুলো আছে, সেগুলো তারা মিটিয়ে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটি প্রস্তাবও দিয়েছিল হিমালয়ের ওপর দিয়ে সীমান্ত রেখা নিয়ে যে সমস্যা, সেটাকে তারা জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া সহায়তা করতে পারে।’
পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সামরিক ও জ্বালানি সুবিধা নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পুতিনের ভারত সফর পরিষ্কার করে দিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার মূল অংশীদার এখনো ভারতই। এটি ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।
ব্রিকস সম্প্রসারণের সময় ভারত-রাশিয়া সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসের নেতৃত্বে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদের ভারতের আকাঙ্ক্ষাকে রাশিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির কথাও জানা গেছে। গ্লোবাল সাউথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ভারত দেখাতে চায় যে তার পশ্চিমা ও অ-পশ্চিমা উভয় ব্লকের ওপর প্রভাব আছে।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হলেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে এই সংযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে মিত্রতা মানেই নির্ভরতা নয়, নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। ভারতের এই অবস্থান ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট
বার্তা দেয় যে ‘India will cooperate, but not at the cost of its autonomy.’ ভারত-রাশিয়ার এই কৌশলগত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সমীকরণে নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে দেখিয়েছে যে ভারত কারও বা কোনো বলয়ে আবদ্ধ বা দায়বদ্ধ নয়। ভারতের এই স্বতন্ত্র অবস্থান বলে দেয়, জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং এটি তাদের একটি মূলনীতির দৃঢ় প্রকাশ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
পুতিনের ভারত সফর একটি ভূকৌশলগত বার্তা—ভারত তার বহুমুখী বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে। পুতিনের এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ থাকবে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বও বজায় রাখবে। অর্থাৎ ভারত কারও পরনির্ভর নয়; বরং নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি করবে। রাশিয়া এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার একচেটিয়া কূটনীতির বিকল্প হিসেবে ভারতকে দেখছে।
কয়েক মাস ধরে আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে রাশিয়ার তেল আমদানি ও রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের চাপ তৈরি করেছে শুল্ক বৃদ্ধির অস্ত্রকে ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও ভারত তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নিজস্ব নীতিতে অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে। এ জন্যই দেশ দুটি সামরিক ও সামরিক প্রযুক্তিগত অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। পুতিনের সফরের আগে এক ব্রিফিংয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, তার সবই ভাগ করে নেওয়া হবে। পুতিনও এই সফরের মাধ্যমে রাশিয়াকে একঘরে করার যে পশ্চিমা প্রচার ছিল, তার অনেকটা ভুল প্রমাণ করেছেন।

গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোদি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন। এই আস্থা ও হৃদ্যতা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গভীর মাত্রাকেই নির্দেশ করে। পুতিন তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের ২৫ বছরে ১০ বার ভারত সফর করেছেন। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম ভারত সফর।
পুতিনের এই ভারত সফর নিছক কোনো রুটিন বিষয় ছিল না। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করে। তাঁদের সাক্ষাৎ ছিল বিশ্বরাজনীতির আগ্রহের বিষয়, কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক নিয়ে মোদির সঙ্গে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল ও বরফ গলছিল, তখনই পুতিন ভারত সফর করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-রাশিয়া এই বৈঠকে কে কী অর্জন করল, তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা যাক।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
পুতিনের এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করল। রাশিয়া এখনো ভারতের প্রধান সমরাস্ত্রের সরবরাহকারী। যদিও ১৯৭০-৮০-এর দশকে ভারতের অস্ত্রের প্রায় ৮০ ভাগই রাশিয়া সরবরাহ করত। পুতিন এবারের সফরে ভারতকে এস ৫০০ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম হস্তান্তর, অতিরিক্ত সামরিক প্ল্যাটফর্ম, হেলিকপ্টার ও ইঞ্জিন কো-প্রোডাকশনসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো নিয়ে আবারও তাদের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেছে। ‘প্রিভিলেজ কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিকস পার্টনারশিপ’ চুক্তির আওতায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী ভারতের যেকোনো স্থল, বিমান ও নৌবন্দরকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। সামরিক প্রয়োজনে একে অন্যের ভূমিও ব্যবহার করতে পারবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে এই প্রতিরক্ষা বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভারত তাদের কৌশলগত নিজস্বতা নিশ্চিত করল।
জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সুবিধা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়া থেকে অনেক কম মূল্যে বিপুল তেল আমদানি করছে। এই সফরের মাধ্যমে ভারত তাদের জ্বালানিনিরাপত্তা, পরিশোধন সক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি তেল-গ্যাস চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করল। রাশিয়ার সস্তা অপরিশোধিত তেল ভারতের মুদ্রাস্ফীতি কমাতে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও সঞ্চয় করতে এবং পরিশোধন মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হলে রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতেও ভূমিকা রাখবে।
বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও এই বাণিজ্য ভারসাম্যমূলক নয়। রাশিয়ায় ভারতীয় আমদানি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে পুতিন-মোদি শীর্ষ সম্মেলনে উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যপণ্যের তালিকা সম্প্রসারণ ঘটবে।
রাশিয়া ভারতীয় সরঞ্জাম, কাঁচামাল এবং খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রসারিত ও বৈচিত্র্যময় করার উপায়গুলো অনুসন্ধান করবে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ওপর ভারত-রাশিয়া আন্তসরকারি কমিশনও গঠিত হবে। মহাকাশ গবেষণা ও ভারত-রাশিয়ার যৌথ সামরিক যন্ত্রাংশ নির্মাণ এবং ভারত তা তৃতীয় কোনো দেশে নিজের উৎপাদিত পণ্য বলে বিক্রিও করার সুবিধা পাবে। ভারতে রুশ নকশায় দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়।
ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি
রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য চীন-রাশিয়া ব্লকের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করবে। ভবিষ্যতে চীন সীমান্ত সমস্যায় রাশিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়া, আর্কটিক, নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর—এইসব কৌশলগত এলাকায় সহযোগিতা বাড়ানো ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় রাশিয়া চীনের ওপর ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং একে অন্যের বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্ক তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখার মাধ্যমে চীনকেও জানিয়ে দেওয়া যে, রাশিয়া এখনো ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।
রুশ প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের আগে ভারতের সাংবাদিকেরা পুতিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে যদি কোনো সংঘাত ও যুদ্ধ হয়, সে ক্ষেত্রে ভারত কি আশা করতে পারে যে রাশিয়া তাদের পাশে দাঁড়াবে? তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করি, ভারতের সঙ্গে চীনের যে বিরোধগুলো আছে, সেগুলো তারা মিটিয়ে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া একটি প্রস্তাবও দিয়েছিল হিমালয়ের ওপর দিয়ে সীমান্ত রেখা নিয়ে যে সমস্যা, সেটাকে তারা জিপিএস পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাধান করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া সহায়তা করতে পারে।’
পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সামরিক ও জ্বালানি সুবিধা নিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পুতিনের ভারত সফর পরিষ্কার করে দিয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার মূল অংশীদার এখনো ভারতই। এটি ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।
ব্রিকস সম্প্রসারণের সময় ভারত-রাশিয়া সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসের নেতৃত্বে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদের ভারতের আকাঙ্ক্ষাকে রাশিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির কথাও জানা গেছে। গ্লোবাল সাউথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ভারত দেখাতে চায় যে তার পশ্চিমা ও অ-পশ্চিমা উভয় ব্লকের ওপর প্রভাব আছে।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার হলেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে এই সংযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে মিত্রতা মানেই নির্ভরতা নয়, নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেওয়া নয়। ভারতের এই অবস্থান ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট
বার্তা দেয় যে ‘India will cooperate, but not at the cost of its autonomy.’ ভারত-রাশিয়ার এই কৌশলগত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সমীকরণে নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে দেখিয়েছে যে ভারত কারও বা কোনো বলয়ে আবদ্ধ বা দায়বদ্ধ নয়। ভারতের এই স্বতন্ত্র অবস্থান বলে দেয়, জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং এটি তাদের একটি মূলনীতির দৃঢ় প্রকাশ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
পুতিনের ভারত সফর একটি ভূকৌশলগত বার্তা—ভারত তার বহুমুখী বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে। পুতিনের এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ থাকবে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বও বজায় রাখবে। অর্থাৎ ভারত কারও পরনির্ভর নয়; বরং নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি করবে। রাশিয়া এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার একচেটিয়া কূটনীতির বিকল্প হিসেবে ভারতকে দেখছে।
কয়েক মাস ধরে আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে রাশিয়ার তেল আমদানি ও রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের চাপ তৈরি করেছে শুল্ক বৃদ্ধির অস্ত্রকে ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও ভারত তাকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের নিজস্ব নীতিতে অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষা অংশীদার—পাকিস্তান যত আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছে, ভারত তত কাছে পেয়েছে রাশিয়াকে। এ জন্যই দেশ দুটি সামরিক ও সামরিক প্রযুক্তিগত অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। পুতিনের সফরের আগে এক ব্রিফিংয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, তার সবই ভাগ করে নেওয়া হবে। পুতিনও এই সফরের মাধ্যমে রাশিয়াকে একঘরে করার যে পশ্চিমা প্রচার ছিল, তার অনেকটা ভুল প্রমাণ করেছেন।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক।
২০ আগস্ট ২০২৫
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১১ ঘণ্টা আগে
ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
এই দেড় বছরে মেট্রোরেল লাইনে কাপড়, ব্যাগ, ড্রোন, তার নিক্ষেপের কারণে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। এখনই যদি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটা ভালো ব্যাপার যে, মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা এমন যে রেললাইনে সামান্যতম বাধা সৃষ্টি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায়। এটি দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভালো দিক হলেও, মানবসৃষ্ট কারণে ঘন ঘন এই থমকে যাওয়া আধুনিক এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
জনগণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যাও যে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিছুদিন আগে ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এই আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম বারবার বিকল হওয়া বা খুলে পড়ার ঘটনাটি মেট্রোরেলের কারিগরি তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নিহতের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেলে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মেট্রোরেলের লাইনে বস্তু শনাক্ত করতে ‘অবজেক্ট ডিটেকশন সেন্সর’ ও ‘এআই-চালিত সিসিটিভি’ স্থাপন করা, ড্রোন পড়া প্রতিরোধে ‘ড্রোন ডিটেকশন রাডার’ ও ‘জিওফেন্সিং সিস্টেম’ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনে সুরক্ষা নেট বসালে বাইরে থেকে তার বা বস্তু নিক্ষেপ ঠেকানো সম্ভব।
মেট্রোরেল দেশের সম্পদ। জনগণের মধ্যে সে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডিএমটিসিএলকে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামান্য ভুল বা অসচেতনতা হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই কেবল মেট্রোরেলের মসৃণ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব। এই আধুনিক পরিষেবা যেন মাঝে মাঝে থমকে যাওয়ার দুর্নাম থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।
এই দেড় বছরে মেট্রোরেল লাইনে কাপড়, ব্যাগ, ড্রোন, তার নিক্ষেপের কারণে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। এখনই যদি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটা ভালো ব্যাপার যে, মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা এমন যে রেললাইনে সামান্যতম বাধা সৃষ্টি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায়। এটি দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভালো দিক হলেও, মানবসৃষ্ট কারণে ঘন ঘন এই থমকে যাওয়া আধুনিক এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
জনগণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যাও যে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিছুদিন আগে ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এই আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম বারবার বিকল হওয়া বা খুলে পড়ার ঘটনাটি মেট্রোরেলের কারিগরি তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নিহতের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেলে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মেট্রোরেলের লাইনে বস্তু শনাক্ত করতে ‘অবজেক্ট ডিটেকশন সেন্সর’ ও ‘এআই-চালিত সিসিটিভি’ স্থাপন করা, ড্রোন পড়া প্রতিরোধে ‘ড্রোন ডিটেকশন রাডার’ ও ‘জিওফেন্সিং সিস্টেম’ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনে সুরক্ষা নেট বসালে বাইরে থেকে তার বা বস্তু নিক্ষেপ ঠেকানো সম্ভব।
মেট্রোরেল দেশের সম্পদ। জনগণের মধ্যে সে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডিএমটিসিএলকে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামান্য ভুল বা অসচেতনতা হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই কেবল মেট্রোরেলের মসৃণ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব। এই আধুনিক পরিষেবা যেন মাঝে মাঝে থমকে যাওয়ার দুর্নাম থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রত্যাশা আমাদের।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক।
২০ আগস্ট ২০২৫
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে
হঠাৎ করেই বিজয়ের মাসে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করছে একদল মানুষ। এই প্রবণতাকে পাত্তা না দিলেও চলত, কিন্তু সেগুলো যদি জাতীয় প্রচারমাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়, তখন সত্যিই একটু ভাবতে হয়। এর যে প্রতিবাদ হওয়া দরকার, সেটা অনুভব করতে হয়। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলে আইন ভালোভাবে শেখা হয় বটে...
১১ ঘণ্টা আগে
গত সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফর ও উভয় নেতার শীর্ষ বৈঠক অনেক কিছুরই ইঙ্গিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পুতিনকে যেভাবে আলিঙ্গন করেছেন, স্বাগত জানিয়েছেন, একই গাড়িতে যাত্রা করেছেন, তা আলাস্কায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সাক্ষাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১১ ঘণ্টা আগে