Ajker Patrika

অন্ধ হলে কি প্রলয় মিথ্যা হয়ে যাবে

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২২, ১২: ১৮
অন্ধ হলে কি প্রলয় মিথ্যা হয়ে যাবে

ঢাকায় গত শুক্রবার কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। এই খবর দিয়েছে বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। অনেকেই কাকভেজা হয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন পোস্ট দেখা গেছে। এই বান্দা নিজেও ভেজাদের একজন। 

কিন্তু এক বন্ধুবর প্রতিবাদ করে বসলেন। তিনি বললেন, বিকেলে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুমানোর সময় ছিল প্রচণ্ড গরম ও কাঠফাটা রোদ। ঘুম ভাঙার পর পেয়েছেন সন্ধ্যার স্তিমিত রোদ ও ঠান্ডা বাতাস। তবে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরতে তিনি তখন দেখেননি। ফলে ঢাকায় শুক্রবার বিকেলে কালবৈশাখী হয়েছে বলে তিনি মেনে নিতে পারছেন না! 

অবাক হচ্ছেন নাকি? আরে আমাদের চারপাশে এখন এমন ‘যুক্তি’সম্পন্ন মানুষ ঢের আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এসবের বহুল চর্চা চোখে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এখন এই ধরন কিছু কিছু গণমাধ্যমেও ঢুকে পড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘ব্যাপক অনুসন্ধান’ করে প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে পড়া তথ্যের ঠিক বিপরীত বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে।

সেটি করা যেতেই পারে। পরম সত্য বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই। সব সত্যের বাইরেই আরও কিছু বিষয় থাকে, যেটির কারণে সত্য তথ্যের রূপ এদিক-সেদিক হতেই পারে। কিন্তু যদি এমনটা বারবার হতে থাকে, তবে মনে হতেই পারে, ইচ্ছা করেই কালবৈশাখীর অস্তিত্ব নাকচ করার চেষ্টা হচ্ছে। কারণ, কালবৈশাখী ঝড় ও তা থেকে উদ্ভূত বিপুল বৃষ্টিপাতে ময়লা-আবর্জনা যেমন ধুয়ে যায়, তেমনি ভেতরের (রাস্তার বা পয়োনিষ্কাশনের) কঙ্কালটাও বের হয়ে আসতে পারে। তবে কি কঙ্কালের বিশ্রী হাসি ঠেকাতেই কালবৈশাখীকে অস্বীকার করা হবে? 

উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। যেমন ধরুন, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের বিষয়টি। সেই সংঘর্ষে দুজনের প্রাণ গেল। একজনের ক্ষেত্রে (নাহিদ) প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা গেল যে তিনি কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়েছিলেন এবং সংঘর্ষস্থলে পরে তাঁকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে শোরগোল ওঠার কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সামনে তুলে ধরা হলো এক নতুন তথ্য। তাতে বলা হতে থাকল, নাহিদ আসলে সংঘর্ষকারীদের একজন। সেটি প্রমাণের জন্য দেখিয়ে দেওয়া হলো একটি নির্দিষ্ট ডিজাইনের টি-শার্ট। বলা হতে থাকল—ওই টি-শার্ট পরেই তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, ছবিতেও ওই টি-শার্ট পরা একজনকে পেছন থেকে দেখা গেছে, তাঁকে যাঁরা ওই টি-শার্ট দিয়েছিলেন, তাঁরাও বলতে থাকলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই কোম্পানির এই ডিজাইনের টি-শার্ট আমরাই দিয়েছিলাম’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে টি-শার্টই হয়ে গেলে নাহিদের সংঘর্ষে জড়ানোর প্রমাণ। 

আচ্ছা, প্রশ্ন কি তোলা যায় না যে ওই কোম্পানির ওই ডিজাইনের টি-শার্ট কি শুধু নাহিদের জন্যই বানানো হয়েছিল? আর কাউকে দেওয়া হয়নি? নাহিদের চেহারার সঙ্গে কি ছবির চেহারা প্রযুক্তির সাহায্যে মেলানো হয়েছিল? নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী বা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক না থাকার সম্ভাবনা খালি চোখে দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও কেন নাহিদ সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন? তার কারণ কি জানা হয়েছিল? নাকি ‘ব্যাপক’ অনুসন্ধানের ফাঁক গলে তা বেরিয়ে গিয়েছিল?

সংঘর্ষে নিহত দোকান কর্মচারী মোরসালিন ও ডেলিভ্যারিম্যান নাহিদমূল বিষয় হলো, নাহিদ মারা গেছেন। তাঁকে আঘাত করেই বিনা বিচারে মারা হয়েছে। একই মৃত্যু মোরসালিনেরও হয়েছে। আমরা এখন জানি না, তাঁরা সংঘাতে অংশ নিয়েছিলেন কি না। যদি সংঘাতে অংশও নেন, তবেই কি তাঁদের রাস্তায় মৃতপ্রায় পড়ে থাকাটা জায়েজ? যদি সেটিই জায়েজ হয়, তবে বিনা বিচারে সরকারি বা বেসরকারি বুলেটে মারা যাওয়া সবার মৃত্যুই তো জায়েজ হয়ে যায়। মৃত্যু জায়েজ করার কারণই কি তবে আমরা খুঁজতে চাই?

বর্তমানের এই দুরবস্থা জায়েজ করার ‘ট্রেন্ড’ বুঝতে হলে ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ, একই ধরনের ভুল প্রমাণের হিসাব আমরা পাই দারিদ্র্যের ক্ষেত্রেও। বেশ কিছুদিন আগে শুধু দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চেয়েছিলেন বগুড়ার মো. আলমগীর কবির। তিনি একটি বিজ্ঞপ্তিও টাঙিয়েছিলেন। আর তা নিয়েই শুরু হয় হট্টগোল। প্রায় অনেকেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন তাঁর ভাতের কষ্ট পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণের জন্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আর আলমগীরকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য করা হয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রমণও। 

এ নিয়ে আলমগীরকে পুলিশের দপ্তরেও হাজিরা দিতে হয়েছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। এ-সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে আমরা কতটা অমানবিক প্রশ্ন করতে পারি, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কেউ কেউ তুলেছিলেন আলমগীরের ভাতের কষ্ট প্রমাণের প্রসঙ্গ। তাঁর চরিত্র নিয়ে টানাটানির চেষ্টাও হয়েছিল। কেন সে ধরনের প্রশ্ন করা হচ্ছিল, তা বোঝা গিয়েছিল ‘দেশের ভাবমূর্তি’, ‘দেশকে ছোট করার হীন প্রচেষ্টা ইত্যাদি শব্দবন্ধে। 

স্থানীয় পুলিশ অবশ্য পরে জানিয়েছিল যে পোস্টার ছাপানোর ব্যাপারে আলমগীরের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয়নি। আলমগীরের চাকরির বিষয়েও সহযোগিতা করে পুলিশ। কিন্তু যে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল এর আগেই হলো এবং তা যে ক্ষত তৈরি করল আলমগীরের মনে, তার মলম আবিষ্কার হয়েছে কি? 

আলমগীর কবির ও ভাতের খোঁজে তাঁর লাগানো পোস্টারসৎ নাকি অসৎ, সেই প্রসঙ্গে আমরা যেতেই পারি। সেটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান হতেই পারে। আলমগীরের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো ‘কেচ্ছা’ আছে কি না, তা-ও হুট করে জানা সম্ভব নয়। থাকতেও পারে। একজন মানুষকে আমরা কতটাই বা চিনি? তবে অতীতের ব্যক্তিগত কোনো বিষয়কে ইস্যু করে বর্তমান জলজ্যান্ত ইস্যুকে খেলো বানানোর চেষ্টা উদ্দেশ্যমূলক বোধ হয়। ধরুন, একজন আগে চোর ছিলেন। পরে জেল খেটে শাস্তি পেয়ে ভালো হয়েছেন। এখন চোরজীবন ছেড়ে আসার ঢের বছর পর যদি তিনি কোনো অপরাধের শিকার হন, তবে কি তাঁর বৈধতা থাকবে না? একদা চোর ছিলেন, এই বলে কী পরিস্থিতির শিকারকে নিগৃহীত করাই এ সমাজের রীতি? 

এই একই বিষয় আবার শুরু হয়েছে বাগেরহাটের পাঁচ বছরের একটি শিশুকে নিয়ে। তার চাল কিনতে শাক বেচতে রাস্তায় নামার দাবি কেউ কেউ মেনে নিতে চাইছেন না। পাঁচ বছরের শিশুটিরও ‘চরিত্র’ নিয়ে টানাটানি চলছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হচ্ছে, ছেলেটি নাকি বখাটে! তার মা বসে বসে খেতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঁচ বছরের শিশুর চরিত্রের ছিদ্রান্বেষণ করে আসলে কী পাওয়া যাচ্ছে? তাকে সরকারি বা বেসরকারি যাঁরা সহায়তা দিয়েছেন, সবাই কি চিলের কান নেওয়ার কথা শুনেই দিয়েছেন? সহায়তা দেওয়ার আগে একবারও কি খোঁজখবর নেননি? 

গত এক মাসে পথচলতি সময়ে বেশ কয়েকজন আমার কাছে হাত পেতেছেন। চাল-ডাল কেনার জন্যই। এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা যখন শুধু এক কেজি ডাল কিনে দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছিলেন, তখন দুর্বলতায় তাঁর শরীর কাঁপছিল। সাহায্য দেওয়ার বদলে কি এখন তবে এই প্রশ্ন তুলব যে চাল চাননি যখন, তখন চাল কেনার পয়সা নিশ্চয়ই তাঁর আছে। তাহলে ডাল কিনছেন না কেন? কেন দুর্বল শরীরে আরও বেশি সময় ধরে রিকশা টানছেন না? তবেই তো ডালের পয়সা উঠে যায়! 

অনেকেই ভিড় করছেন টিসিবির ট্রাক সেলে।এই একই তরিকায় টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে ‘ন্যায্যমূল্যে’ পণ্য কেনা আমজনতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। বলে দেওয়াই যায় যে এসবই কতিপয়ের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ‘অভাব’। আহা, এভাবে যদি ক্ষমতাবান ও দুর্নীতিবাজদের নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা যেত, কত ভালোই না হতো! 

এসব ঘটনা থেকে অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে এ দেশে নিজের দুর্দশার কথা মায় রাস্তায় মরে পড়ে থাকার কথা তুললেও হাজারো ‘অনুসন্ধানী’ চোখ ও মুখের বাক্যবাণের সামনে অসহায় হয়ে থাকতে হবে। এসব এড়াতে চাইলে অবশ্যই দুর্দশার ইতিবৃত্ত ভুলে আপাত ‘সুখী’ হওয়ার ট্রেন্ড তৈরি করতে হবে। ধরুন, আপনার পেটে ভাত নেই, তবু ভাবতে হবে পেট মোর ভরা! ওটিই এখন সবচেয়ে নিরাপদ হয়তো। 

অবস্থাদৃষ্টে বোধ হচ্ছে, এ দেশের অনেকে হয়তো ‘ডিনায়াল সিনড্রোম’-এ ভুগছে। ডিনায়াল সিনড্রোম একটি বিশেষ ধরনের মানসিক অবস্থা। এতে ভুগলে মানুষ সত্যিকারের ঘটে যাওয়া ঘটনা বা ফ্যাক্টস অস্বীকার করতে শুরু করে। মনোবিদেরা মনে করেন, এই ‘ডিনায়াল’ বা অস্বীকার আসলে ব্যক্তির একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম। মূলত ‘অ্যাংজাইটি’ বা উদ্বেগ উদ্রেককারী বিষয়েই মানুষ এই সিনড্রোমে ভোগে। এর মূল উদ্দেশ্য থাকে অস্বীকারের মাধ্যমে সেই উদ্বেগ সৃষ্টিকারী অস্বস্তিকে মুছে ফেলা। 

আমরা কি সেই কারণেই হুট করে অস্বীকারের সংস্কৃতিতে গা ভাসাচ্ছি? যদি তাতেও কারও কারও মনে শান্তি আসে, তবে খারাপ কী! মনের শান্তিই তো বড় শান্তি, তা যতই বানানো হোক না কেন! 

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেন থমকে যাচ্ছে মেট্রোরেল

সম্পাদকীয়
কেন থমকে যাচ্ছে মেট্রোরেল

ঢাকা শহরের যানজটের সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। তবে এটা চালুর প্রায় দেড় বছরে এই আধুনিক গণপরিবহনব্যবস্থা মাঝে মাঝে বন্ধ হয়েছে। সেটা একটা ভাবনার বিষয়। মূলত এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ বার মেট্রোরেল চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার বেশির ভাগই জনগণের গাফিলতির কারণে হয়েছে।

এই দেড় বছরে মেট্রোরেল লাইনে কাপড়, ব্যাগ, ড্রোন, তার নিক্ষেপের কারণে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে। এখনই যদি এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটা ভালো ব্যাপার যে, মেট্রোরেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা এমন যে রেললাইনে সামান্যতম বাধা সৃষ্টি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যায়। এটি দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য ভালো দিক হলেও, মানবসৃষ্ট কারণে ঘন ঘন এই থমকে যাওয়া আধুনিক এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

জনগণ দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে করণীয় নিয়ে এখনই ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যাও যে আছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিছুদিন আগে ফার্মগেট এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি এই আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করেছে। বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম বারবার বিকল হওয়া বা খুলে পড়ার ঘটনাটি মেট্রোরেলের কারিগরি তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণে আরও গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এক সূত্র থেকে জানা যায়, এই নিহতের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেলে আগের তুলনায় ১০ শতাংশ যাত্রী কমে গেছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন মেট্রোরেলের লাইনে বস্তু শনাক্ত করতে ‘অবজেক্ট ডিটেকশন সেন্সর’ ও ‘এআই-চালিত সিসিটিভি’ স্থাপন করা, ড্রোন পড়া প্রতিরোধে ‘ড্রোন ডিটেকশন রাডার’ ও ‘জিওফেন্সিং সিস্টেম’ ব্যবহার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক লাইনে সুরক্ষা নেট বসালে বাইরে থেকে তার বা বস্তু নিক্ষেপ ঠেকানো সম্ভব।

মেট্রোরেল দেশের সম্পদ। জনগণের মধ্যে সে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডিএমটিসিএলকে প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে তাদের সামান্য ভুল বা অসচেতনতা হাজার হাজার যাত্রীর ভোগান্তি এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও প্রযুক্তিগত সুরক্ষা—এই দুইয়ের সমন্বয়েই কেবল মেট্রোরেলের মসৃণ ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সম্ভব। এই আধুনিক পরিষেবা যেন মাঝে মাঝে থমকে যাওয়ার দুর্নাম থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রত্যাশা আমাদের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

বিধান রিবেরু
বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

আমরা এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে নানা ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের মানুষ পরস্পরের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জারিত হয়ে সমাজের বৈচিত্র্যকে উদ্‌যাপন করবে। আমরা এমন এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি, যে রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখবে। বৈষম্য ও দারিদ্র্যকে মুখে মুখে নয়, প্রকৃত অর্থেই জাদুঘরে পাঠাবে। এমন সমাজ ও রাষ্ট্র পাওয়ার স্বপ্ন আমরা মূর্ত করে তুলেছিলাম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু গন্ডগোলটা বাধল যখন একটি গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নিজের মত ও বিশ্বাসকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতে শুরু করল এবং চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। এতে করে সমাজে দেখা দিল সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ, রাষ্ট্রে প্রতিভাত হলো স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ।

একটি সমাজে নানা মত ও পথের মানুষ থাকবে। বিশ্বাসী থাকবে। অবিশ্বাসী থাকবে। সবাইকে নিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্র। ভিন্ন ভিন্ন দল ও মতের হয়েও তাহলে কেমন করে মানুষ এক সূত্রে গাঁথা থাকবে? কেমন করে একটি মানচিত্রের ভেতর চিহ্নিত হবে অভিন্নতা? জাতি থেকে জাতীয়তাবোধ, সেখান থেকে আমরা পেলাম জাতিরাষ্ট্র। সাতচল্লিশের আগে ভারতবর্ষে ধর্মকে জাতি ঠাওরে বা সুবিধার জন্য মনে মনে ধরে নিয়ে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করা হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতি যে সোনার পাথরবাটি, তা ১৯৭১ সালেই আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি। জাতি গঠনে গণমানুষের সম্মিলিত কল্পনাশক্তির একটা ভূমিকা আছে সত্যি, কিন্তু সেটার সুবিধা নিয়ে কেউ যদি জাতি গঠনের জন্য ধর্মকে ভিত্তি বানায়, তাহলে বলতে হয় কেউ চোরাবালির ওপর প্রাসাদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে। দুই যুগ পূরণ হওয়ার আগেই তাই স্বপ্নভঙ্গের ঘটনাও ঘটেছে। বাস্তবে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। তখন ভেবেছি এবার অসাম্প্রদায়িক ও সমতার সমাজ গঠন করা সহজ হবে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো কি?

কেউ বলেন জাতি হলো এক কল্পিত জনগোষ্ঠী। কেউবা বলেন এটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এক সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি। আমাদের ভেতর একটি সামাজিক অনুভূতি কাজ করে যে, আমরা সবাই একই দেশের নাগরিক। এখানে যদি ফাটল থাকে, তাহলে সে দেশের ললাট থেকে শনির দশা কাটে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যতই প্রচার করা হোক না কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, কোথায় গিয়ে যেন তৃতীয় আরেকটি মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং তারা ১৯৪৭-এর দিকে তাকিয়ে ১৯৭১ সালকে গৌণ করে দিতে চায়। সাতচল্লিশে ধর্মকে জাতি জ্ঞান করে যে বিভাজন হয়েছিল, ১৯৭১ সালে কিন্তু সেই ভ্রম কেটে যায় এবং স্পষ্টতই মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে জালিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু আজ সেই তৃতীয় পক্ষ ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করতে চায়, ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবেও তারা মানতে নারাজ। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ তারিখ নিয়েও কেউ কেউ অত্যন্ত আপত্তিজনক মন্তব্য করে ফেলছেন। যেটি রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। তবে কি জাতি হিসেবে নিজেদের ভাবার ক্ষেত্রে পাটাতনে আবার সেই ধর্মভিত্তিক চিন্তাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? নয় তো কেন হঠাৎ আবার এত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটল? কেনইবা সমাজে ধর্মের প্রতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি এই পক্ষপাত লক্ষ করা যাচ্ছে? বাংলাদেশের সমাজে ইদানীং মানুষ নিজেদের মানব, বিশ্বনাগরিক বা একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার বদলে ধর্মপরিচয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে, সর্বাগ্রে স্থান দিচ্ছে। এই পরিবর্তন কেন ঘটল, কেমন করে ঘটল, তার হদিস সমাজবিজ্ঞানীরা ভালো করতে পারবেন। তবে এই পরিবর্তনের দায় কোনোভাবেই রাজনীতিবিদ ও শাসকশ্রেণি এড়াতে পারবে না।

যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব করার মতো আত্মপরিচয় দিয়েছে, যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যে মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ এক সাগর রক্ত ঢালতে পারে অনায়াসে, সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজ অত্যন্ত আপত্তিকর কথা উঠছে। তারা ফিরে যেতে চাইছে সাতচল্লিশে। কী উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ! একটি গোষ্ঠী ও কিছু তথাকথিক কনটেন্ট ক্রিয়েটর নিজেদের বিপুল অনুসারী সহযোগে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত যে ভয়ংকর মিথ্যা তথ্য প্রচার এবং চরম অপমানজনক বাক্য ব্যবহার করছে, তাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হয়ে উপায় নেই। যেকোনো সুস্থ মানুষ, যাঁরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে সব দল-মত ও পথের ঊর্ধ্বে রেখে, যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের কথা মাথায় রেখে, বাংলাদেশকে নিজেদের অস্তিত্বের অংশ মনে করেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আজ বিমর্ষবোধ করছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ ছিল, সেটিকে যেন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দেখা যাচ্ছে, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিতদের সংখ্যা নিয়ে কুতর্কের দোকান খুলে বসেছে। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় বাংলা’র পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন কি না, সেটি আবিষ্কার করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। যেন শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় পাকিস্তান’ বললেই গোটা ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ ও ভাষণ শুনতে আসা লাখো মানুষের মনের ভেতর থাকা স্বাধীনতার জন্য সমুদ্রসমান কল্লোল মিথ্যা হয়ে যায়। যদিও তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সেদিনের বিশাল জনসভায় সশরীরের উপস্থিত থাকা অনেক বিশিষ্ট মানুষই শোনেননি ‘জয় পাকিস্তান’ বলা হচ্ছে। তাহলে এখন কেন এসব ছোটখাটো কথা নিয়ে এত সময়ক্ষেপণ? এসব করলেই কি এই জনপদের মানুষ যে পাকিস্তানি শাসকদের, বলতে গেলে খালি হাতে যুদ্ধ করে পরাজিত করেছিল, তা লুকিয়ে ফেলা যাবে? কারা এই অপচেষ্টা করছে আজকে? যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে গৌরব ও অর্জনের ইতিহাস, তাই একে প্রশ্নবিদ্ধ করে তর্ক জুড়ে দিলে, মনে করা হচ্ছে মানুষ ওটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। আর এই ফাঁকে স্বার্থ উদ্ধার করে নেবে সুযোগসন্ধানীরা।

আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা না বললেই নয়, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণেই ভারত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এটা ঠিক, তাদের জনতুষ্টিমূলক সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়, এটা নিয়ে আপত্তি বজায় রেখেই বলতে চাই, সে সময় ভারত পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিয়ে যে নজির স্থাপন করেছিল, সেটি অস্বীকার করার জো নেই। তাদের আচরণ অনেক সময় বড়ভাইসুলভ ও কিছুটা আপত্তিজনক হলেও, মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে সেনাসদস্য মারা গেছেন তা তো আর মিথ্যা নয়। কাজেই যার যেটা প্রাপ্য তাকে সেটা দিতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

ইদানীং যে প্রবণতা প্রবল আকারে দেখা যাচ্ছে, সেটিকে আমি বলব, মাছির লক্ষণাক্রান্ত। ধরুন শেখ মুজিবুর রহমানের যে ভূমিকা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, সেটি যেকোনো বিচারেই বাংলাদেশ গঠনের পর বাকশাল গঠনের চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু আজকাল দেখি তাঁর ওই অবদানের কথা উল্লেখ না করে কেবল বাকশাল নিয়ে আলাপ করা হয়। বাকশাল নিয়ে অবশ্যই আলাপ করা জরুরি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ছাপিয়ে সেটিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ভেতর যে ভাষাবলয় পরিলক্ষিত হয়, যে বয়ান প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে, সেটি হুবহু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসরদের বয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। স্বাধীনতালাভের অর্ধশতাব্দী পর এসেও বাংলাদেশ-বিরোধিতা এমনভাবে ফিরে আসার জন্য আমি মনে করি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করেছেন তাঁরাই মূলত দায়ী। তাঁরাই আসলে খাল কেটে কুমির এনেছেন। এখন খাল খননকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পলাতক, কিন্তু জনপদের মানুষ কুমিরের ভয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছে।

শুধু এটুকু বলে শেষ করি, গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়। ভোট দেওয়ার ভেতর দিয়ে মানুষকে গণিতে পরিণত করা হয়। মাথা গোনার আরেক নাম ভোট। গণতন্ত্র তার চেয়েও বেশি কিছু। ভোট প্রদান জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও অধিক জরুরি এই জনপদের মানুষের কাছে গণতন্ত্রের ধারণাকে স্পষ্ট করে তোলা। এটা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন আসলে এই খাল কাটা ও কুমিরের খেলা চলতে থাকবে। কারণ, এতে খননকারী ও কুমির উভয়েরই লাভ রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

অ্যাডভোকেট সাহিদা আক্তার 
পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

পথকুকুর বা বিড়াল হত্যা গুরুতর অপরাধ এবং এটি জনস্বাস্থ্য ও পশু সুরক্ষার দিক থেকে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, এই ধরনের পশু হত্যা নিষ্ঠুরতা এবং মানবিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশের আইনে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা বা অমানবিক আচরণ রোধ করার জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে। ১৯২০ সালে প্রণীত ‘পশু সুরক্ষা আইন’-এর মাধ্যমে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা বা অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি জেনেবুঝে বা অবহেলায় কোনো প্রাণীকে আঘাত করে বা হত্যা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে এবং শাস্তি হতে পারে।

২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘পশু সুরক্ষা আইন সংশোধনী ২০১০’ প্রণয়ন করে, যাতে পশু হত্যা বা তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের জন্য আরও কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করা হয়।

পথকুকুর বা বিড়াল হত্যা হলে সাধারণত অভিযোগ দায়েরের দায়িত্ব স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বা স্থানীয় পরিষদের ওপর পড়ে। তবে, এটি শুধু পুলিশের কাজ নয়; যেকোনো নাগরিক, পশু অধিকার রক্ষা সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এই ধরনের ঘটনার বিষয়ে মামলা করতে পারে।

যেকোনো হত্যা বা পশু নির্যাতনের ঘটনা প্রমাণ করতে হলে, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক তদন্ত করতে হবে।

স্থানীয় মানুষ বা প্রত্যক্ষদর্শীরা যদি এই হত্যার সাক্ষী হন, তাঁরা এই বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এ ছাড়া প্রাণী অধিকার রক্ষা সংগঠনগুলোরও সক্রিয় ভূমিকা থাকে এবং তারা এগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে সাহায্য করে।

পথকুকুর বা বিড়াল হত্যা করার শাস্তি বাংলাদেশে নির্দিষ্ট। ‘পশু সুরক্ষা আইন’ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি জেনেবুঝে বা অমানবিকভাবে কোনো প্রাণীকে আঘাত করে বা হত্যা করে, তাহলে তাকে শাস্তি প্রদান করা হয়।

জরিমানা: পশু হত্যার অপরাধে একজন ব্যক্তির ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তবে, এটি সাধারণত প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে নির্ধারিত হয়।

কারাদণ্ড: কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত যদি হত্যাটি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে সংঘটিত হয়, তাহলে শাস্তি হিসেবে এক মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। এই শাস্তি সংশ্লিষ্ট আদালত নির্ধারণ করবেন।

অবহেলাজনিত হত্যা: যদি কেউ অবহেলাজনিত কোনো প্রাণীকে হত্যা করে, যেমন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বা কোনো অজ্ঞাত কারণে, তখনো শাস্তি আরোপ করা হতে পারে। তবে, যদি হত্যা প্রমাণিত না হয়, শাস্তি কিছুটা কম হতে পারে।

বিষ প্রয়োগ: যদি কেউ প্রাণীকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে, তাহলে শাস্তি আরও কঠোর হতে পারে। বিষ প্রয়োগ বা নিষিদ্ধ কোনো উপাদান দিয়ে প্রাণী হত্যার জন্য তিন বছরের কারাদণ্ডও হতে পারে এবং জরিমানাও আদায় করা হতে পারে।

বাংলাদেশে যদিও আইন রয়েছে, তবে পথকুকুর বা বিড়াল হত্যা সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকে।

প্রমাণের অভাব: অনেক সময় পথকুকুর বা বিড়াল হত্যা প্রমাণ করা কঠিন হয়, কারণ এই ধরনের ঘটনা সাধারণত অপরিচিত জায়গায় ঘটে এবং প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আবেগগত দ্বন্দ্ব: অনেক মানুষের কাছে পথকুকুর বা বিড়াল হত্যার গুরুত্ব তেমন অনুভূত হয় না, কারণ তারা মনে করে এসব প্রাণী কেবল ‘যাযাবর’ এবং তাদের কোনো বিশেষ মূল্য নেই। কিন্তু, এটি একটি ভুল ধারণা এবং এ ধরনের চিন্তা সমাজে পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার পথ প্রশস্ত করে।

আইন প্রয়োগের দুর্বলতা: অনেক সময় পুলিশের মনোযোগ এবং কার্যকর তদন্তের অভাবের কারণে এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। পথকুকুর বা বিড়াল হত্যা বন্ধ করতে এবং তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা কমাতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

সচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষের মধ্যে পশুর প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা তৈরি করতে হবে। জনগণকে জানাতে হবে যে পশু হত্যা শুধু একটি অপরাধ নয়, বরং এটি মানবিকতারও প্রশ্ন।

আইনের প্রয়োগ আরও কঠোর করা: আইন প্রয়োগে গাফিলতি দূর করতে পুলিশের প্রশিক্ষণ এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

প্রাণী অধিকার রক্ষা সংগঠনের সহায়তা: প্রাণী অধিকার রক্ষা সংস্থাগুলোর তদারকি এবং কাজকে আরও সক্রিয় ও জনপ্রিয় করতে হবে।

সাহিদা আক্তার, আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

সুধীর বরণ মাঝি
জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

মানুষের জীবন শুধু বেঁচে থাকার নাম নয়; জীবন মানে হচ্ছে পূর্ণতার সন্ধান, মানসিক শান্তি ও শারীরিক সুস্থতার সুষম সমন্বয়। এই সমন্বয় সাধনের দুটি প্রধান উপাদান হলো সংগীত ও শরীরচর্চা। সংগীত আত্মাকে প্রশান্ত করে, মনকে উজ্জীবিত করে; আর শরীরচর্চা দেহকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখে। এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবেই গড়ে ওঠে এক পরিপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ ও অর্থবহ জীবন। যে সমাজে মানুষ সংগীতের মাধুর্য ও শরীরচর্চার শৃঙ্খলাকে গ্রহণ করে, সে সমাজ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, সৃজনশীল ও মানবিক গুণে পরিপূর্ণ।

সংগীত মানুষের হৃদয়ের ভাষা। ভাষা যখন থেমে যায়, তখন সুরই হয়ে ওঠে প্রকাশের মাধ্যম। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ তার অনুভূতি, আনন্দ, দুঃখ, প্রেম, প্রার্থনা কিংবা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সংগীতকে বেছে নিয়েছে। প্রকৃতির শব্দের ভেতরেও সংগীতের ছোঁয়া—বৃষ্টির ঝরঝর শব্দ, পাখির কলতান, ঢেউয়ের মৃদু গর্জন—সবই জীবনের ছন্দের বহিঃপ্রকাশ। এই ছন্দ থেকেই মানুষ খুঁজে পেয়েছে সংগীতের রূপ, যা তাকে দিয়েছে মানসিক মুক্তি, সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা ও আত্মার প্রশান্তি। আজও যখন কোনো মানুষ ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন বা নিঃসঙ্গ হয়, তখন সংগীতই তার একমাত্র সান্ত্বনা হয়ে ওঠে।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখা যায়, সংগীত মানুষের মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংগীত থেরাপি আজ বিশ্বজুড়ে একটি স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি। মানসিক অবসাদ, হতাশা বা উদ্বেগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যখন সংগীতের ছন্দে নিজেকে মেলে ধরতে পারে, তখন তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। তাই সংগীত শুধু বিনোদন নয়, এটি এক গভীর মানসিক ও আত্মিক চিকিৎসা। শিশুরা যখন ছোটবেলা থেকেই সংগীতচর্চায় যুক্ত হয়, তখন তাদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, শৃঙ্খলা ও আবেগময় সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ সংগীত শুধু মনোরঞ্জন নয়, এটি চরিত্র গঠনেরও সহায়কশক্তি।

অন্যদিকে, শরীরচর্চা মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশের অন্যতম প্রধান অনুঘটক। একটি লাতিন প্রবাদ হলো, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন’। শারীরিক সুস্থতা ছাড়া মানসিক উৎকর্ষ সম্ভব নয়। নিয়মিত শরীরচর্চা হৃদ্‌যন্ত্রকে শক্তিশালী করে, রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ উন্নত করে এবং বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু এর থেকেও বড় কথা হলো, শরীরচর্চা মানুষকে দেয় আত্মনিয়ন্ত্রণ, অধ্যবসায়, সাহস ও ইতিবাচক মনোভাব। প্রতিদিনের শরীরচর্চা যেন জীবনের এক ধ্রুব অনুশাসন, যা আমাদের শেখায় পরিশ্রম, ধৈর্য ও শৃঙ্খলার মূল্য।

আজকের যুগে যখন প্রযুক্তিনির্ভর জীবন মানুষকে ক্রমেই নিস্তেজ ও স্থবির করে তুলছে, তখন শরীরচর্চা আমাদের জাগ্রত রাখে। অফিস, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়—সব জায়গায় এখন বসে থাকার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, বিষণ্নতা ইত্যাদি নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠছে। নিয়মিত ব্যায়াম, হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার বা যোগব্যায়াম কেবল শরীরকে সুস্থ রাখে না, মানসিক চাপও কমায়।

সংগীত ও শরীরচর্চার মধ্যে এক গভীর সম্পর্কও রয়েছে। যেমন যোগব্যায়াম বা ধ্যানের সময় সুমধুর সংগীত মনকে কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে। আবার অনেক ব্যায়াম বা ক্রীড়া কার্যক্রমে ছন্দময় সংগীত শরীরকে উদ্দীপিত করে তোলে। জিমে ব্যায়াম করার সময় বা দৌড়ানোর সময় অনুপ্রেরণাদায়ক গান শুনলে শরীরে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও সংগীত ও শরীরচর্চার ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক শিক্ষা শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়; এটি দেহ, মন ও বুদ্ধির সমন্বিত বিকাশ চায়। তাই বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। সংগীত শিক্ষার্থীর কল্পনাশক্তি ও নান্দনিক বোধকে জাগিয়ে তোলে, আর শরীরচর্চা তাকে করে তোলে সুস্থ, পরিশ্রমী ও আত্মনিয়ন্ত্রিত। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও এই দুই বিষয়কে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ এ দুটি ছাড়া পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব গঠন অসম্ভব।

সংগীত ও শরীরচর্চা জীবনের দুটি অনিবার্য স্তম্ভ। একদিকে সংগীত আত্মাকে দেয় শান্তি, অন্যদিকে শরীরচর্চা দেহে আনে শক্তি। এই দুইয়ের সমন্বয়ই আমাদের দেয় জীবনকে উপভোগ করার সক্ষমতা। যে ব্যক্তি সংগীতের সৌন্দর্য বোঝে ও নিয়মিত শরীরচর্চা করে, সে শুধু দীর্ঘজীবীই নয়, প্রকৃত অর্থে সুখী মানুষ। জীবন তখন আর নিছক বেঁচে থাকা নয়; বরং এক সুরেলা, উদ্দীপনাময়, অর্থবহ যাত্রা। তাই বলা যায়, সংগীত ও শরীরচর্চা ছাড়া জীবন বোধহীন, প্রাণহীন এক জড় অস্তিত্বমাত্র।

শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত