Ajker Patrika

একটি বাড়ির কথা

একটি বাড়ির কথা

উত্তরের ছোট্ট জেলা পঞ্চগড়। আগে অবশ্য জেলা ছিল না। ছিল দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার একটি থানা। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো নতুন জেলা বানালে পঞ্চগড় জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার একটি উপজেলা বোদা। এই নামটি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কারও কারও আপত্তি আছে। এতে বোদাবাসী কোনো পরোয়া করে না। কারণ, এই নামের একটি ইতিহাস আছে। এক সময় ছিল নদী বন্দর। পাথরাজ ও ঝিনাইকুড়ি নদীর তীরে বোদা বন্দর। ছোটবেলায় আমরাও শুনেছি গ্রামের মানুষ বলতেন, ‘বন্দর যামো’। এই বোদার একটি বাড়ির কথা ঈদের অবসরে পাঠকদের জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

আমাদের বালকবেলায় দূর অঞ্চলের কেউ এই এলাকায় বেড়াতে এসে যদি বোদার কোনো বিখ্যাত বাড়ির কথা জানতে চাইতেন, তাহলে তাঁকে নিশ্চিতভাবে বলা হতো ‘কারকুন বাড়ি’-এর কথা। এই বাড়ি নিয়ে কিছু কথা।

কারকুন বাড়ির কর্তা হিসেবে আমরা পেয়েছি যোগেন চন্দ্র কারকুনকে। যোগেন কারকুনের বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরী, ছোট ভাইয়ের নাম সুরেন্দ্রনাথ খাঁভাদুরী। এক পরিবারে দু-রকম পদবি হলো কী করে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার লোক এখন আর পাওয়া যাবে কি-না, আমি জানি না। তবে আমার অনুসন্ধানে দুটি তথ্য বেরিয়েছে। ১. যোগেন বাবুও খাঁভাদুরী পদবি লিখতেন। কিন্তু কুচবিহার মহারাজা তাঁকে তাঁর জমিদারি তদারকির জন্য ‘কারকুন’ উপাধি দিয়েছিলেন বলে তিনি খাঁভাদুরী ত্যাগ করে কারকুন ব্যবহার শুরু করেন। ২. জনৈক কারকুন পদবিধারী জমিদার যোগেন বাবুকে তার বালকবেলায় দত্তক নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কারকুন পদবি ব্যবহার করেন। ওই দত্তক গ্রহণকারীর জমিদারি যোগেন বাবু উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর বাবার আসলে জমিদারি ছিল না।

এই দুই তথ্য নিয়ে এখন আর বিভ্রান্তি তৈরির কিছু নেই। আমরা যোগেন বাবুকে কারকুন হিসেবেই জানি এবং আমাদের কাছে তাঁর বাড়িটি কারকুন বাড়ি হিসেবেই পরিচিত।

ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরীকে মানুষ ‘পাগলা মাস্টার’ বলে কেন ডাকত? সম্ভবত তিনি কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কারও কারও নামের শেষে ‘পাগলা’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ফইম পাগলা, সিরাজ পাগলা ইত্যাদি।

ত্রৈলোক্যনাথ বাবু ছিলেন পরোপকারী মানুষ। কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। অভাবী মানুষকে সহায়তা করতেন। কখনো কখনো নিজের সামর্থ্যের কথা খুব একটা চিন্তা না করেও। দুটো ঘটনার কথা বললে তাঁর পাগলামির কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে। বোদা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা বলেছি। স্কুলের আর্থিক সংকট দেখা দিলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। বলতেন, ‘বেচাও গাছ, বাঁচাও স্কুল’। তাঁদের শাল বাগান ছিল। ওই বাগান থেকে শাল গাছ বিক্রি করে স্কুল তহবিলে টাকা দিতেন। তাঁদের শাল বাগানের কিছু অংশ আমরাও দেখেছি। এখন সম্ভবত কারকুনদের শাল গাছ আর নেই।

একবার যোগেন বাবু বোদা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তো সেটা দেশ ভাগের আগে। তখন পর্যন্ত সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চালু হয়নি। মানুষ এক জায়গায় সমবেত হয়ে প্রার্থীর পক্ষের লাইনে দাঁড়ালে মাথা গুনে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হতো। যোগেন বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাসাইনগরের মহিরউদ্দিন সরকার। ভোটের দিন দেখা গেল দুই প্রার্থীর লাইনে সমানসংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়েছেন। যোগেন বাবুর বাবাকে এই খবর দেওয়া হলো। তিনি ভোট দিতে যাননি। তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ছেলের লাইনে দাঁড়ালেই ছেলে প্রেসিডেন্ট; অর্থাৎ, চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। ত্রৈলোক্যনাথ বাবু দৌড়াতে দৌড়াতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বলছিলেন, ‘এক দিকে পুত্র, আর একদিকে ছাত্র। এখন কী করি?’

সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তিনি গিয়ে মহিরউদ্দিন সরকারের লাইনে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি বিজয়ী হলেন। যোগেন কারকুন পরাজিত হলেন। ত্রৈলোক্য বাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘পুত্র তো প্রেসিডেন্ট হলেও আমার, না হলেও আমার। কিন্তু ছাত্রও যে আমার, সেটা প্রমাণের আর উপায় কী ছিল?’ এমন মানুষকে ‘পাগলা’ না বলে কী বলা হবে!

বাবার রক্তের ধারা বহন করছিলেন বলে যোগেন বাবুও কিছুটা কম বৈষয়িক ছিলেন বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন খুব শৌখিন ও রুচিবান মানুষ। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। বাড়িতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তিনি নিজেও একসময় মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর বই পড়ার বাতিক এবং বাড়িতে বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালার কথা আগেই বলেছি। আর একটি কাজ তিনি করতেন, সেটা হলো ভ্রমণ। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেছেন।

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কারকুন বাড়ি ছিল যেন বোদার অনেকের ‘ফুসফুস’। কারকুন বাড়ি কারও কারও কাছে ছিল মন ভালো করার ‘যন্তরমন্তর’। ওই বাড়িতে যাওয়া এবং পাতপেড়ে খাওয়া ছিল একটি নিত্য ঘটনা। কারকুন বাড়িতে গেছেন, অথচ কিছু না খেয়ে এসেছেন—এটা অবিশ্বাস্য। আমারও ছিল অবাধ যাতায়াত। কারণ, কারকুন-গিন্নি, ঊষারানী কারকুন ছিলেন আমার পিসিমা। মার চেয়ে আপনার মাসিমা নয়, মার চেয়ে আপনার পিসিমা। কীভাবে তিনি আমার পিসি হলেন? আমাদের তো কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তাহলে?

আমার বাবা-কাকারা ছিলেন তিন ভাই। তাঁদের আপন কোনো বোন ছিল না। সে হিসেবে আমার কোনো পিসি থাকার কথা নয়। তারপরও কারকুন বাড়ির ঊষারানী কারকুন, যোগেন চন্দ্র কারকুনের স্ত্রী, আমার পিসি হয়েছিলেন। আমার বাবা-কাকার কাকাতো বোন, আমার সুনীতি পিসির সঙ্গে ছিল তাঁর দারুণ হৃদ্যতা, বোনের মতো। পিসির বোন, তাই আমারও পিসি। আমার এই পিসি হলেন বোদার কার্তিক সরকার, জ্যোতিষ সরকারের মা। আমার পিসা মহাশয়ের নাম শরৎচন্দ্র সরকার। তিনি ছিলেন আবার যোগেন কারকুনের ভাইতুল্য। এই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা, যোগাযোগের সূত্রেই আমাদের সঙ্গেও কারকুন পরিবারের পরিচয় ও প্রায়-আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক।

কারকুনবাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না—এমন মানুষ অবশ্য সে সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। ওই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল বোদার গণ্যমান্য বলে পরিচিত সবারই। যোগেন বাবু মিশুকে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। ব্রাহ্মণ হলেও তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার অবাধ যাতায়াত ছিল কারকুন বাড়িতে। ওই বাড়ির সবাই ছিলেন আধুনিক ও উদার মনের মানুষ। অথচ এই যোগেন বাবুকেও একবার (ষাটের দশকের মাঝামাঝি) বোদা হাইস্কুলের কিছু উগ্র ছাত্রের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল।

যোগেন কারকুন ছিলেন বোদা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। কমিটির কোনো এক সভায় তিনি নাকি ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তার জের ধরে কয়েকজন শিক্ষক কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে।

কারকুন পরিবারের একটি ট্র্যাজেডি হলো অতি রূপবতী-গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে না হওয়া। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘অতি বড়ো ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড়ো সুন্দরী না পায় বর’। কারকুন বাড়ির দিদিদের দেখেও আমার তাই মনে হতো। কিন্তু ব্যতিক্রম একটি ঘটেছিল, যেটা আবার পরিবারকে ফেলেছিল লজ্জায়। ষাটের দশকের শেষ দিকেই কারকুন বাড়ির দ্বিতীয় কন্যা, আমাদের ইরাদি (ইরা রাণী কারকুন) পালিয়ে বিয়ে করলেন বোদা থানা সার্কেল অফিসারকে (উন্নয়ন)। তখন মানুষ বলত সিও (ডেভ.)। আব্দুর রৌফ চৌধুরী ছিল সম্ভবত ভদ্রলোকের নাম। ইরাদির এই বিয়ে ছিল তখন এক ব্যাপক আলোচিত বিষয়। কারকুন পরিবার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি।

মেয়ের এভাবে বিয়ে করা এবং ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার দুটি ঘটনা সম্ভবত যোগেন পিসা মহাশয়কে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। মানসিকভাবে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। এর পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাজারে আসা-যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ঝড়ে বিশাল বৃক্ষ উপড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল তাঁর।

যোগেন কারকুন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আগে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি এবং আমার প্রিয় বন্ধু বিজন দত্ত সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম কারকুন বাড়িতে। তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তুলসিতলায়। বিশাল দেহের সৌম্যকান্তি মানুষটির অমন শয্যা দেখে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠেছিল। তার আগে আমি কখনো কোনো মরদেহ দেখতে যাইনি। সে হিসেবে ওটাই আমার প্রথম কোনো মৃতদেহ দেখা। প্রাণহীন একজন মানুষকে ভূমিশয্যায় দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল এবং আরও যে বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল, তা এখন আর বর্ণনা করতে পারব না। জীবন-মৃত্যুর যিনি নিপুণ কারিগর সেই বিশ্বস্রষ্টার প্রতি আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। একজন প্রিয় ও পছন্দের মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বস্রষ্টার অপার ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও বেড়েছিল। সংসারের কর্তা চলে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সব দায়িত্ব পিসিমার কাঁধে বর্তায়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলেন।

যোগেন কারকুনের মৃত্যুর অল্প পরেই শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী-অনুচরদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে অসংখ্য মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বোদা থেকেও আমরা অনেকেই বাধ্য হয়েই ভারতে গিয়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক জনগোষ্ঠী। কারকুন বাড়ি দুই কারণেই টার্গেট ছিল। তারা একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কুমার কারকুন দুলাল ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী, স্বাধীনতার পক্ষের একজন সংগঠক।

যেদিন বোদা প্রথম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, সেদিনই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একজন আমার দাদাশ্বশুর (পরবর্তী সময়ে) যতীন্দ্র মোহন সাহা। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বোদার প্রথম শহীদ। তার পর হত্যা করা হয়েছিল বোদার তখনকার পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নানকে। তৃতীয় যাঁকে হত্যা করা হয়, তিনি আব্দুল লতিফ। লতিফ মেম্বর বলেই তাঁকে সবাই চিনত। তিনি পাকিস্তানিদের সহযোগী হয় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘর, দোকানপাট চিনিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একটা রহস্য। কিছু দালাল হত্যা করে পাকিস্তানিরা বোধ হয় বুঝিয়েছিল যে, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকাই ভালো। পাকিস্তানিরা বোদা বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ব্যাপক লুটপাট। আমাদের একটি গালা মালের দোকান ছিল। দোকানের সব মালামাল লুট হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। ওই লুটেরার দল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই লুটপাট অব্যাহত রেখেছিল। আমার পরিবারের সবাই বলতে গেলে এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়ে আর ফিরে আসা হয়নি। আমাদের তখনকার বাড়িটি ছিল দিনাজপুর-পঞ্চগড় হাইওয়ের পাশে পাথরাজ ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে আখ ক্রয়কেন্দ্রের লাগোয়া। আমাদের বাড়িটি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কারকুন বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশত্যাগ করলেও পিসিমা, ঊষারানী কারকুন জেদ ধরলেন তিনি কিছুতেই সদ্যপ্রয়াত স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র লুট হয়েছে। পাড়াপড়শিরাও লুটে অংশ নিয়েছে। রান্না-খাওয়ার বাসনকোসনও লুট হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ভিটে ছাড়া করা যায়নি। তাঁর জেদ কিংবা মনোবলের কাছে ভয়ভীতি পরাজিত হয়েছিল।

তাঁকে হত্যার জন্য রাজাকার কমান্ডার চন্দনবাড়ির হবিবর রহমান একদিন কারকুন বাড়ি গিয়েও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। পিসিমা আগেই টের পেয়ে ঘর ছেড়ে বাড়ির পেছন দিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। তাঁকে খুঁজতে ওই ঝোপের দিকেও গিয়েছিলেন হবিবর রহমান। তিনি পিসিমাকে দেখতেও পেয়েছিলেন। রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ার আগে একটি সাপ তার দিকে ছোবল হানতে গেলে প্রাণভয়ে তিনি দৌড়ে পালান। জীবন রক্ষা হয় পিসিমার।

হবিবর রহমান ছিলেন আনসার কমান্ডার। সে জন্য তাঁকে মানুষ হবিবর কমান্ডার বলেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তাঁকে কেউ ভয়াবহ চরিত্রের মানুষ বলে মনে করত না। ২৬ বা ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর ছাউনি থেকে পালিয়ে আসা একজন পাকিস্তানি সৈনিককে পাকড়াও করে বোদা হাইস্কুল মাঠে বহু মানুষের উপস্থিতিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যারা গুলি করেছিলেন, তাদের মধ্যে হবিবর কমান্ডারও ছিলেন। তিনি একসময় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন। বেশ হাসি-খুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-কাকাদের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে চাচা বলতাম। তিনিও আমাকে নাম ধরে না ডেকে ‘বাবাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমরা বন্ধুরা স্কুলে পড়ার সময়ই কিছুদিন বেশ নাটক পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এক বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছি। হবিবর চাচা দু-একটি নাটক নির্দেশনা বা পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। মনে আছে, রিহার্সালের জায়গা না পেয়ে আমরা রাতের বেলা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাথরাজ ব্রিজের ওপরও রিহার্সাল করেছি। তখন অবশ্য জায়গাটি এখনকার মতে ঘিঞ্জি ছিল না।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিবর রহমান হয়ে ওঠেন এক ভয়ংকর মানুষ। বোদায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্য তাঁর নাম ওপরের দিকেই রাখতে হবে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর একসময় প্রকাশ্যে আসেন এবং বোদায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বোদা বাজার থেকে কয়েক মাইল দূরের চন্দনবাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন সত্ত্বেও স্বাধীন দেশে প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি বোদা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বোদা গেলে তাঁর সভামঞ্চে হবিবর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। আবার ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ ফরহাদের পক্ষাবলম্বন করে আমাদের লজ্জায় ফেলেছিলেন।

হবিবর কমান্ডার কারকুন-গিন্নিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর ওপর উপদ্রব একটু কমে আসে। একজন পাকিস্তানি মেজরও তাঁর দেশ ছেড়ে না যাওয়ার কথা শুনে তাঁকে দেখতে আসেন। ওই মেজরও তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তী সময়ে জেনেছি যে, পিসিমাকে গোপনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মাঝগ্রাম নিবাসী দবিরউদ্দিন হাজী সাহেব। চাল-ডাল, এমনকি হাড়িপাতিলও দবির চাচাই কারকুন বাড়িতে সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে পাঠাতেন। আজিজার রহমানও (যিনি পরে বোদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন) গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, খোঁজ-খবর দিতেন। শত্রুকবলিত দেশে পিসিমা শত্রুর সঙ্গে মিত্রও পেয়েছিলেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সবাই শত্রু ছিল না, আবার মিত্রও সবাই নয়। আমরা আজ শত্রু-মিত্র একাকার করে এক বিপন্ন অবস্থা তৈরি করেছি।

কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর এবং মন্দির নিয়ে কিছু মিথ বা কাহিনি শোনা যায়। মন্দিরে শিবের মূর্তি ছিল। সে জন্য শিব মন্দির হিসেবেই ওটা পরিচিতি পেয়েছিল। বোদার হিন্দু নারীরা ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর রাতে সমবেতভাবে ওই মন্দিরে পূজা অর্চনা করতেন। শিব রাত্রিতে ভক্তরা যে বাসনা করেন, তা নাকি ভগবান শিব পূরণ করেন। এই মন্দিরে পূজা দিয়ে অনেকেরই নাকি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। সে জন্য ওই মন্দিরকে একসময় জাগ্রত মন্দির বলা হতো। তবে এখন সে রামও নেই, নেই সে অযোধ্যাও। পাকিস্তান আমলেই একবার মন্দির থেকে শিবের বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় ভক্তরা খুবই অসহায় বোধ করেছিলেন। অবিশ্বাসীরা তখন শিবের ‘ক্ষমতা’ নিয়ে বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি! মন্দিরটি কিছুটা জীর্ণ দশা প্রাপ্ত হলেও এখনো শিবরাত্রি পালনের জন্য বিপুলসংখ্যক হিন্দু নারী ওই মন্দিরে সমবেত হন। ব্রত পালন করেন।

কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর বা দিঘিটি কত বছর আগে খনন করা হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বোদার প্রবীণ লোকদের ধারণা, কমপক্ষে দুই শ বছর আগে পুকুরটি খনন করা হয়ে থাকতে পারে। প্রায় ১৮ বিঘা জমির ওপর ওই বিশাল পুকুরটি একসময় হয়তো শুধু কারকুন বাড়ি নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দৈনন্দিন জলের সমস্যা মেটাত। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, পুকুরের পাড়জুড়ে কত গাছগাছালি। পুকুরে তখনো ছিল গভীর জল। পুকুরজুড়ে শাপলা ও পদ্ম যখন ফুটত, তখন চমৎকার লাগত দেখতে।

নানা গল্প চালু আছে এই পুকুর নিয়ে। একসময় নাকি মানুষের পূজা-পার্বণ কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির জন্য থালা-বাসন দরকার হলে ওই পুকুরপাড়ে চাহিদাপত্র দিলে পুকুরই তা সরবরাহ করত। মানুষ প্রয়োজন শেষে সেগুলো আবার পুকুরে দিয়ে আসত। আমরা অবশ্য এমন মানুষের সন্ধান পাইনি, যে বা যারা পুকুর থেকে বাসনকোসন নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছেন! মানুষ এসব ‘গল্প’ একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করত বলেই এগুলো চালু ছিল। এখন বিশ্বাস করে না বলেই শোনা যায় না। কথায় আছে: বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর।

আচ্ছা, শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে কি সত্যি কিছু অর্জন করা যায়? আমরা কিছু হলেই ‘দোয়া’ ‘প্রার্থনা’ করি। দোয়া কি কাউকে রোগ বা বিপদমুক্ত করতে পারে? জানি না। তবে দোয়ার সঙ্গে ‘দাওয়া’ বলেও একটা কথা আছে। দোয়ার গুণের চেয়ে দাওয়ার গুণ টের পাওয়া যায় বেশি।

কারকুন বাড়িতে আম-কাঁঠালের অনেক গাছ ছিল। ঝড়ের দিনে শুধু মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ ছিল না, কারকুন বাড়িতেও সে সুখ ছিল। কারকুন বাড়ির ব্যাপার ছিল আরও আলাদা। গাছেরটা খাওয়া এবং তলারটা কুড়ানো—দুটোই চলত। অর্থাৎ, যেগুলো গাছ থেকে ঝরে পড়ত সেগুলো যেমন যে কেউ নিতে পারত, তেমনি গাছের পাকা ফলও চাইলেই পাওয়া যেত। কারকুন বাড়ি থেকে পাকা আম-কাঁঠালের বোঝা আমিও বহন করেছি।

আমাদের ছোটবেলার সময়টা ছিল অন্য রকম। বাড়ি, পরিবার, গ্রামগুলো কেমন সুন্দর মমতায় জড়ানো ছিল। মানুষের মনে এবং চোখে অন্ধকার ছিল। অর্থাৎ, শিক্ষিতের হার কম ছিল, আবার বিদ্যুৎও ছিল না। চোখের অন্ধকার দূর করত কেরোসিনের বাতি। কিন্তু মনের অন্ধকার? সেটা ছিল বলেই মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করত। জিন-ভূতের গল্প বেশি শোনা যেত। এই পথে সন্ধ্যায় যাওয়া যাবে না—ভূতের ভয় আছে, এই পুকুরের এই ক্ষমতা আছে—এসব মানুষ অবলীলায় বিশ্বাস করত।

এখন মানুষের মন এবং চোখ দুটোতেই আলো। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে পেয়ে বসছে এক নতুন ধরনের অন্ধত্ব, যার নাম ধর্মান্ধতা। আমাদের সেইকালে ধর্মবিশ্বাস ছিল, ধর্মান্ধতা ছিল কম। সে জন্য চমৎকার সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। কারকুন বাড়ি ছিল সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের এক মিলনক্ষেত্র।

কারকুনবাড়ির অনেক কিছুই আজ আর নেই। জীবন কারকুন এবং অচিন্ত্য কারকুন—দুই ভাই দিদি শর্বাণীকে নিয়ে আছেন। শর্বাণীদির বিয়ে হয়নি। কিন্তু জীবন-অচিন্ত্য বিয়ে করেছে। জীবনের এক পুত্র সন্তান, অচিন্ত্যর তিন মেয়ে। ওরা নিশ্চয়ই এখন এক হাঁড়িতে খায় না। কত দিন ওই বাড়িতে যাই না। বছর তিনেক আগে বোদা গিয়ে বন্ধু বিজন দত্তকে নিয়ে কারকুন বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি। একসময়ের প্রাণময় বাড়িটি কেমন নিষ্প্রাণ মনে হলো। জীবন সম্ভবত আগের ভিটায় আছে। অচিন্ত্য সামনের দিকে নতুন পাকা বাড়ি বানিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অচিন্ত্য ছিল আমার প্রয়াত ছোট ভাই নিরঞ্জনের ক্লাসফ্রেন্ড। ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিল।

আগে বাড়িতে গেলে শোনা যেতো প্রাণের স্পন্দন, এখন মনে হয় ঘুমঘোর।

ভেতরের লম্বা ঘরটি, যেটার বিভিন্ন কক্ষে মাসিমা এবং দিদিরা থাকতেন, সেটাও সেভাবেই আছে, নাকি সেখানেও নতুন ঘর উঠেছে, জানি না। বাইরের পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে, ভেতরেও নিশ্চয়ই অনেক অদলবদল হয়েছে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো, সেই নানা গল্পগাথার পুকুরটি আর আগের মতো নেই। যে পুকুর খননের সময় পানি না ওঠায় নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নরবলি দিতে হয়েছিল, যে পুকুরের মাঝখানে নাকি ছিল একটি রহস্যময় বড় সিন্দুক জাতীয় কিছু, সেই পুকুরের ওপর দিয়ে এখন হয়েছে মহাসড়ক। পুকুরটি দুই ভাগ হয়েছে, ছোট হয়েছে। আগে পুকুরপাড়ে গেলে কখনো কখনো যেমন গা ছমছম করত, এখন আর তা করে না। অসংখ্য মানুষের যাতায়াত, যোগাযোগ সহজতর করার জন্য একটি পরিবারের ঐতিহ্য, স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। এটাই বোধ হয় আধুনিক সভ্যতার নিয়ম। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকা নয়, নতুনকে আবাহন করাই যেন প্রগতি ও অগ্রগতির লক্ষণ।

কারকুন বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কারকুন, আমাদের দুলালদা, যিনি ছোট-বড় সবার কাছেই একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন, সবাইকে ছেড়ে শেষ বিদায় নেন ১৯৮১ সালে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে পিতা ও পুত্রের মৃত্যু কারকুন বাড়িতে ভাঙনের যে সুর বাজিয়েছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে ছোট দুই কারকুন বিয়ে করে সংসার শুরুর পর।

পিসিমা, ঊষারানী কারকুন বেঁচে থাকতে ওই বাড়িতে আগের ধারা, মানুষের যাতায়াত, আহার-বিহার অব্যাহত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সে রকম আছে কি-না, জানি না। পিসির মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে। কী আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তাঁর বিদায়ের দিনেও আমি বোদায় ছিলাম এবং বিজনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম।

কারকুন বাড়ির দুই উত্তরাধিকার জীবন ও অচিন্ত্য ওদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আর আগের অবস্থায় যেতে চায় কি-না, যেতে চাইলেও আর যেতে পারবে কি-না, জানি না। 

শর্বাণী কারকুন, আমাদের বাণীদি, কত দিন তাঁকে দেখি না। কত দিন তাঁর আপ্যায়নবঞ্চিত। কেমন আছেন বাণীদি? বয়স কি তাঁর সৌন্দর্য আড়াল করতে পেরেছে? এর পর বোদা গেলে বাণীদিকে অবশ্যই এক নজর দেখে আসব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

মাকে দেখতে মাঝরাতে হাসপাতালে তারেক রহমান

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র মাহফুজ আলম, এনসিপির পক্ষে মনোনয়নপত্র নিলেন বড় ভাই মাহবুব

এনসিপির নির্বাচনকালীন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন নুসরাত তাবাসসুম

ভারতীয়দের ওয়ার্ক পারমিট বাতিলসহ ৪ দফা দাবি ঘোষণা করল ইনকিলাব মঞ্চ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

স্বস্তিটাকে স্থায়ী রূপ দিতে পারবেন তো

কোনো রাজনীতিকের সামনে সুযোগ বারবার আসে না। সেদিক থেকে তারেক রহমান সৌভাগ্যবান। তাঁর সামনে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ এসেছে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার, শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর। রাষ্ট্রকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ধাঁচে নিয়ে যাওয়ার অপতৎপরতা রুখে দিতেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন।

আজাদুর রহমান চন্দন
সংকটকালে তারেক রহমানের ওপর আস্থা রাখতে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষকে। ছবি: আজকের পত্রিকা
সংকটকালে তারেক রহমানের ওপর আস্থা রাখতে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষকে। ছবি: আজকের পত্রিকা

সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা-ভঙ্গুরতার কারণে এই অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন এমন কোনো দল বা নেতার প্রয়োজন বোধ করছিলেন মনেপ্রাণে, ঠিক সে সময়ে তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছরের ‘নির্বাসিত’ জীবন শেষ করে দেশে ফিরে সবাইকে নিয়ে সবার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা-প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘আজ আমাদের সময় এসেছে, সবাই মিলে দেশ গড়ার। এ দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছেন, এ দেশে একইভাবে সমতলেরও মানুষ আছেন; এ দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন।’ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আসুন, আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, যে রাজনৈতিক দলেরই সদস্য হই, অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই, আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যেকোনো মূল্যে এ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে; যেকোনো মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে; যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারেন। শিশু হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, যেকোনো বয়স, যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকেন, এই হোক আমাদের চাওয়া।’

এটা ঠিক, এ দেশে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য মানুষ খুব কমই আমলে নেয়। ‘ওসব তো রাজনীতির কথা’—এমন মন্তব্যের মাধ্যমে রাজনীতিবিদেরাও নানা সময়ে বুঝিয়ে দেন, তাঁদের বক্তব্য নিছকই কথার কথা। তা সত্ত্বেও সংকটে-দুর্বিপাকে মানুষ রাজনীতিকদের ওপরই ভরসা করে থাকেন। এমনই এক সংকটকালে তারেক রহমানের ওপর আস্থা রাখতে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক মানুষকেও, যাঁরা একসময় তাঁকে পছন্দ করতেন না। অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা সত্ত্বেও তারেক রহমান ছাড়া ভরসা করার মতো কাউকে কি এ মুহূর্তে চোখে পড়ছে? রাজনীতিসচেতন মানুষদের কাছে বিএনপির পরিচয় একটি ডান বা মধ্য-ডানপন্থী দল হিসেবে। অতি ডানপন্থার ঝুঁকির মধ্যে এই দলের নেতা কি পারবেন ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে? এমন অনেক প্রশ্ন আছে অনেক মানুষের।

এই অবস্থায় তারেক রহমানও আজ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। তাঁর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এ মুহূর্তে তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের ভেতরের কোন্দল মেটানো, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সকল পর্যায়ে দলীয় সিদ্ধান্ত মানতে নেতা-কর্মীদের বাধ্য করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানো, নেতাদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করাও তাঁর জন্য জরুরি। এরই মধ্যে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র বা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের বুঝিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা তারেক রহমানের জন্য এক কঠিন কাজ হবে। মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির ভেতরে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তা নিরসন করাও খুব সহজ কাজ নয়। বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণার পাশাপাশি মিত্রদের জন্য কিছু আসন ছাড়ার পর কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ হয়েছে। যশোর-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মনিরামপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। নীলফামারী-১ আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রার্থী ঘোষণা করার পর সেখানেও একই ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। কিশোরগঞ্জ-৪ ও ঝিনাইদহ-৪ আসনেও মিত্রদের ছাড় দেওয়ায় তৃণমূল নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করেছেন বিএনপির আলোচিত নেত্রী রুমিন ফারহানা।

গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনার মুখে আছে বিএনপি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ২৫৯টি ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৬৬ জন নিহত এবং ২ হাজার ৯২৩ জন আহত হয়েছেন। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, দলে শৃঙ্খলা ফেরানো কতটা জরুরি। তারেক রহমান এত বছর দল পরিচালনা করেছেন ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে। এখন তিনি দেশে উপস্থিত থাকার সময় যদি দলীয় নেতা-কর্মীরা অপকর্মে জড়ান, তবে তাতে তাঁর সুনাম নষ্ট হবে এবং প্রতিপক্ষ আরও বেশি করে সমালোচনার সুযোগ পাবে।

তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন কি না, সে নিয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। সে সুযোগে যাঁরা অনেকটা ‘ফাঁকা মাঠে’ গোল দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে বিএনপির নেতার প্রত্যাবর্তন। উদীয়মান কোনো কোনো দল তো এখন টলমল অবস্থায়। কিছুদিন আগেও যেখানে বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেওয়ার খবর পাওয়া যেত, সেখানে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে গেছে। তবে আসন্ন ক্ষমতার হাতছানি দেখে গণমাধ্যমের আনত মস্তকে বন্দনায় মেতে ওঠাটা বিপজ্জনক। বন্দনা ও চাটুকারিতা প্রশ্রয় পেয়ে গেলে নেতৃত্বের সামনে বিপথে চালিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ ঝুঁকি কতটা এড়িয়ে চলতে পারেন, সেটিও দেখার বিষয়।

জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন মাস তিনেক আগে বলেছিলেন, ‘এ দেশে শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান হলেও নানা ধর্মের মানুষ ও জাতিগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করছেন। এখানে সব মত-পথ এবং ধর্মের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারে—এমন নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী অথচ সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতার প্রয়োজন। এ ধরনের নেতা তারেক রহমানকে ছাড়া কাউকে দেখছি না। কারণ, তারেক রহমান মধ্যপন্থী ধারার রাজনীতি করলেও ইসলামি মূলধারার রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদী নেতার যেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই; তেমনি ইঙ্গো-মার্কিন চেতনা এবং বাম চেতনায় বিশ্বাসী তথাকথিত প্রগতিশীল নেতার গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাপিত জীবনে ইসলামি চেতনা ধারণ করেন; কিন্তু কথাবার্তা ও কর্মের মাধ্যমে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’ বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়ত মাওলানা আবু জাফর কাশেমীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এবং সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান খায়রুল আহসানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল দৈনিক ইনকিলাব ভবনে সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। এ এম এম বাহাউদ্দীনের এই মূল্যায়নের মর্যাদাও যদি তারেক রহমান রাখতে পারেন, তবে সামনের দিনগুলোতে সেটিও দেশের জন্য একেবারে কম হবে না।

কোনো রাজনীতিকের সামনে সুযোগ বারবার আসে না। সেদিক থেকে তারেক রহমান সৌভাগ্যবান। তাঁর সামনে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ এসেছে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার, শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর। রাষ্ট্রকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ধাঁচে নিয়ে যাওয়ার অপতৎপরতা রুখে দিতেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁর পিতা জিয়াউর রহমান শাসনকালের সূচনার দিকে তখনকার বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি (মোহাম্মদ গোলাম) তোয়াবের দিক থেকে এমনই এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। এম জি তোয়াব আগে থেকেই কট্টর পাকিস্তানপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দিক থেকে চ্যালেঞ্জ থাকার কারণেই তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও সীমিত সমর্থন পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এ মুহূর্তে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও নিরাপত্তার কড়াকড়িতে তারেক রহমানের চলাফেরাসহ কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাটে পোহানো কষ্টটুকু মানুষ মন থেকে মেনে নিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা না-ও হতে পারে। বিষয়টির দিকে বিএনপির নেতার সুনজর বিবেচনা রাখে। সামগ্রিকভাবে তারেক রহমান সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, সে অনুযায়ী অগ্রসর হলেই আপাতত পাওয়া স্বস্তিটুকু স্থায়ী হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

মাকে দেখতে মাঝরাতে হাসপাতালে তারেক রহমান

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র মাহফুজ আলম, এনসিপির পক্ষে মনোনয়নপত্র নিলেন বড় ভাই মাহবুব

এনসিপির নির্বাচনকালীন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন নুসরাত তাবাসসুম

ভারতীয়দের ওয়ার্ক পারমিট বাতিলসহ ৪ দফা দাবি ঘোষণা করল ইনকিলাব মঞ্চ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পঞ্চাশ বছরের উচ্চশিক্ষা

বিমল সরকার
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখা যাবে না
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখা যাবে না

বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়, বারবার রাজনৈতিক কলহ, শত রকমের বাধাবিপত্তি ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যেও এ সময়ে কী পাইনি আমরা! আসলে নির্মোহ ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে দেখতে পারলে দুটি পক্ষের কোনোটির মতামতকেই উপেক্ষা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না—‘কী পেয়েছি’ আর ‘কী পাইনি’।

এখানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি নিয়ে আমার ছিটেফোঁটা আলোকপাত করার প্রয়াস। ইংরেজরা প্রথমবারের মতো ১৯০৫ সালে বাংলাকে (ব্রিটিশ বাংলা) ভাগ এবং ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রদেশ সৃষ্টি করে। নবগঠিত প্রদেশটির রাজধানী স্থাপন করা হয় ঢাকায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জন-অধ্যুষিত এলাকার চাহিদা ও অন্যান্য যৌক্তিক কারণে করা হলেও মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯১১ সালে তা বাতিল করা হয়। বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকাসহ গোটা পূর্ববঙ্গ ও এই এলাকার মুসলিম জনগণের প্রতি শাসককুল ইংরেজদের একটি বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।

বঙ্গভঙ্গের সময় অবিভক্ত বাংলায় একটিই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (স্থাপিত ১৮৫৭ সাল)। এ ছাড়া অবিভক্ত বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম প্রভৃতি) কলেজ ছিল মোট ৩৭টি। এই ৩৭টির মধ্যে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসামে’ (নবগঠিত প্রদেশ) ১১টি এবং অবশিষ্ট বঙ্গে ছিল ২৬টি কলেজ। একই সময় (১৯০৫) সারা বাংলায় এমএ পড়ার কলেজ ছিল মোট তিনটি। বিখ্যাত ঢাকা কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহী কলেজ, জগন্নাথ কলেজসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের তখন ‘ভরা যৌবন’; খ্যাতি ও গৌরব-গরিমা অনেক দিক থেকেই। তা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ও আসামে (নবগঠিত প্রদেশের অংশ) এমএ পড়ার মতো কোনো কলেজ বা বন্দোবস্ত ছিল না সে সময়।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন শর্ত অনুযায়ী ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী ২৫ মাইল পরিধি এলাকায় অবস্থিত কলেজগুলোই (ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ প্রভৃতি ৭টি) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রাখা হয়। পূর্ববঙ্গের বাকি সব কলেজ থেকে যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (যা ১৯৪৭ সালে দেশভাগ পর্যন্ত বহাল থাকে)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গের প্রথম, অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় (প্রথমটি কলকাতা) এবং উপমহাদেশের ১১তম বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই অঞ্চলে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় কলেজসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। পূর্ববঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে এবং তখনই পূর্ববঙ্গ শিক্ষা অধ্যাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কাম শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ‘এফিলিয়েশন’-এর ব্যবস্থা যোগ করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর (ডিগ্রি স্তরের ৩৪টি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরের ২৩টি) এফিলিয়েশন ও তত্ত্বাবধানের ভার এই বিশ্ববিদ্যালয়টির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ওপর ন্যস্ত হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় বাংলাদেশ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় একটিই ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল কলেজও একটিই, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ইংরেজ আমলে ১৯৪৬ সালে স্থাপিত)। এ ছাড়া সারা দেশে কলেজ ছিল মোট ৫৫টি (ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরে; এগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ ৪টি)। ঠিক এ সবকিছু নিয়েই পাকিস্তান আমলে যাত্রা শুরু হয় আমাদের।

পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরে অন্যায়, শোষণ আর বৈষম্যের মধ্যেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কাজ সম্পন্ন হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এ সময়ে (পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর ২০ বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। এ ছাড়া পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একে একে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় আটটি।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে নানাবিধ, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশে বর্তমানে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি আছে ১১৫টি। সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি; বেসরকারি ৭৩টি। বিভাগীয় পাঁচ শহরে রয়েছে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় গোটা জাতিকে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মাথায় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় আর কী হতে পারে?

আসলেই তো! আগে যেমনই থাক বা না থাক, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে কি নেই আমাদের? স্বীকার না করে উপায় নেই, উচ্চশিক্ষায় আমাদের দেশে এ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। সরকারি-বেসরকারি দেড় শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় (১৭২টি)। একইভাবে এক শর বেশি মেডিকেল কলেজ (১১০টি)। রয়েছে পাঁচ বিভাগীয় শহরে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ৭০৮টি সরকারি কলেজ। ডিগ্রি স্তরে পাঠদান উপযোগী কলেজ দুই হাজারের বেশি (২,২৫৭টি)। আর সরকারি-বেসরকারি সাড়ে আট শ কলেজে (৮৮২) অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স (১৭৫) পড়ানোর ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত রয়েছে। এসব বিবেচনায় শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপ্লব বলা যেতে পারে।

আমি আবারও কিছুটা অতীতমুখী হতে চাই। ১৯৪৭ সালে একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় আর একটি মেডিকেল কলেজ দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। ২৪ বছর পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়, আটটি মেডিকেল কলেজ, ডিগ্রি স্তরের ১১০টি কলেজ, (যেগুলোর মধ্যে ২৬টি সরকারি) আর অনার্স পড়ানোর মতো কলেজ ২০টি। সে তুলনায় আজ অভাবনীয় পরিবর্তন ও অগ্রগতি সহজেই দৃশ্যমান। তবে উপযুক্ত দেখভালের অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক কিছু থাকার পরও কী যেন নেই আমাদের। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক যাযাবরের (বিনয়কুমার মুখোপাধ্যায়) অমর সৃষ্টি ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে। যাযাবর তাঁর কালজয়ী উপন্যাস শেষ করেন এই বাক্যটি দিয়ে—‘যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।’ আমাদের উচ্চ শিক্ষপ্রতিষ্ঠানেও যেন এমন শিক্ষারূপী আগুন আছে, যা আলো দেয় না অথচ প্রতিনিয়ত দহন করে চলেছে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

মাকে দেখতে মাঝরাতে হাসপাতালে তারেক রহমান

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র মাহফুজ আলম, এনসিপির পক্ষে মনোনয়নপত্র নিলেন বড় ভাই মাহবুব

এনসিপির নির্বাচনকালীন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন নুসরাত তাবাসসুম

ভারতীয়দের ওয়ার্ক পারমিট বাতিলসহ ৪ দফা দাবি ঘোষণা করল ইনকিলাব মঞ্চ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এনসিপিতে অস্থিরতা

সম্পাদকীয়
এনসিপিতে অস্থিরতা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী আসন সমঝোতার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দল থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য তাসনিম জারা। এখন তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। গতকাল পদত্যাগ করেন আরেক নেত্রী তাজনূভা জাবীন। এর আগে দল থেকে পদত্যাগ করেন এনসিপিতে জামায়াতবিরোধী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত মীর আরশাদুল হক। এরপর ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দলের ৩০ জন নেতা এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামকে ‘সম্ভাব্য জোট বিষয়ে নীতিগত আপত্তি’র বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতে তাঁরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো ধরনের জোট এনসিপির নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের জোট এনসিপির বহু কর্মী, সমর্থক এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মসহ অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে এনসিপির নিজস্ব মধ্যপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কিছুদিন আগে বিএনপি ও জামায়াত জোটের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এনসিপি ও এবি পার্টি মিলে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠন করেছিল। আপাতত এ জোটের কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ‘জামায়াতে ইসলামী নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। গতকাল ২৮ ডিসেম্বর সকালে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ মিডিয়া গ্রুপে এ মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশে জোটগত রাজনীতি একটা পুরোনো সংস্কৃতি। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য সমমনা দলের সঙ্গে জোট করা নতুন বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগকে পরাস্ত করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্ত ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। এরপর নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করার জন্য ত্রিদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। তাদের সম্মিলিত আন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। তবে নির্বাচনী জোটে দেশ ও জনগণের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। যেমন বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে সরকার গঠন করেছিল। এরপর শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী হওয়ার ক্ষেত্রে এই জোটের ভূমিকাও ছিল। সবচেয়ে ক্ষতির দিক হলো, ছোট দলগুলো সুবিধার জন্য জোট করে পরবর্তী সময়ে বড় দলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তাদের আর নিজস্ব রাজনীতি থাকে না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করা দল এনসিপি সম্ভবত একই ভুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নানা সমালোচনার পরও দলটি যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সাময়িক নির্বাচনী সুবিধার জন্য সে সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার পথে। এতে হতাশ হবে তরুণদের একটি বড় অংশ। হতাশ হবে দেশের নতুন রাজনীতিপ্রত্যাশী একটি শক্তি, যারা বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের বাইরে বিকল্প খুঁজছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

মাকে দেখতে মাঝরাতে হাসপাতালে তারেক রহমান

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র মাহফুজ আলম, এনসিপির পক্ষে মনোনয়নপত্র নিলেন বড় ভাই মাহবুব

এনসিপির নির্বাচনকালীন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন নুসরাত তাবাসসুম

ভারতীয়দের ওয়ার্ক পারমিট বাতিলসহ ৪ দফা দাবি ঘোষণা করল ইনকিলাব মঞ্চ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয়

ড. কামরুল হাসান মামুন।

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৫১

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।

সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।

আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?

আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।

চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।

গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে

গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?

ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।

ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?

এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।

শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

মাকে দেখতে মাঝরাতে হাসপাতালে তারেক রহমান

লক্ষ্মীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র মাহফুজ আলম, এনসিপির পক্ষে মনোনয়নপত্র নিলেন বড় ভাই মাহবুব

এনসিপির নির্বাচনকালীন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন নুসরাত তাবাসসুম

ভারতীয়দের ওয়ার্ক পারমিট বাতিলসহ ৪ দফা দাবি ঘোষণা করল ইনকিলাব মঞ্চ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত