Ajker Patrika

বিমানের খুলে যাওয়া চাকা ও বাস্তবতা

চিররঞ্জন সরকার
সম্প্রতি উড্ডয়নের পর একটি বিমানের চাকা খুলে পড়লেও বিমানটি নিরাপদে অবতরণ করেছে
সম্প্রতি উড্ডয়নের পর একটি বিমানের চাকা খুলে পড়লেও বিমানটি নিরাপদে অবতরণ করেছে

এককালে চাকা খুলে যাওয়া বলতে বোঝাত ভাঙা ঠেলাগাড়ি, পুরোনো সাইকেল কিংবা ফুচকার ভ্যান। কিন্তু আজকাল সেই সাদামাটা ঘটনা আর মহল্লার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন আকাশেও বিমানের চাকা খুলে যাচ্ছে! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমাদের জাতীয় উড়োজাহাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার পথে পেছনের একটি চাকা খুলে পড়ে গেছে!

এই দৃশ্য কোনো মঞ্চনাটকের অংশ নয়, কোনো সিনেমার ভিএফএক্সও নয়, বরং একেবারে বাস্তব, রিয়েল-টাইম এক ‘মিরাকল’। পেছনের চাকা ছাড়াই বিমান আকাশে উড়ছে, অবতরণ করছে এবং অক্ষত থাকছে। পাইলট সাহেব যেভাবে একপাশে ভর দিয়ে বিমানটিকে নামিয়েছেন, তা দেখে মনে হয় যেন তিনি ছোটবেলায় গরুর গাড়ির কাত হয়ে চলার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

আমরা এত দিন শুনে এসেছি, ‘চাকা না থাকলে গাড়ি চলে কীভাবে?’ এখন বুঝছি, ‘চাকা না থাকলেও দেশ চলে, প্রতিষ্ঠান চলে, এমনকি বিমানও চলে!’ শুধু একটু বেশি ইমান, একচিমটি দক্ষতা আর এক ঢোক ম্যাজিক রিয়ালিজম হলেই যথেষ্ট।

বিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর লেখায় দাদার ভূতের সঙ্গে নাতির ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প বলতেন, আর আমরা লিখছি উড়োজাহাজের চাকা খুলে পড়ার পরেও নিরাপদে অবতরণের কাহিনি। এ যেন ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব মেইনটেন্যান্স এরর’। একদিকে পেছনের চাকা খসে পড়ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে—‘পাইলটের উপস্থিত বুদ্ধি আমাদের গর্ব।’ এদিকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীদের চাকরির বয়স বাড়ছে, বেতন বাড়ছে, অথচ তাঁরা কী করছেন? হয়তো নাট-বোল্ট পরীক্ষা না করে চাকার ওপর ফুলের নকশা আঁকছেন। ‘ভাই, বিমানে বেগুনি গোলাপের কাজ আছে, চাকা একটু ঢিলা হলেও চলবে!’

এটা কি নিছক কারিগরি ব্যর্থতা? নাকি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সেই চিরায়ত ‘যেমন পারো চালাও’ নীতির বাস্তব প্রতিফলন? এই যে চাকা ছাড়াই বিমান নিরাপদে অবতরণ করল, এটা কি কেবল পাইলটের সাহস, নাকি জনগণের ভাগ্য?

বিমানবন্দরে যাত্রীদের মুখে হাসি, চোখে জল। তাঁরা নিচে নেমেই বলছেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে!’ কেউ কেউ তো বলেই ফেলছেন, ‘জানতাম, দেশ যেভাবে চলে, তাতে বিমানের চাকা না থাকলেও চলবে!’ এ একধরনের বিশ্বাস, যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না—এটা আমাদের জাতীয় ‘সারভাইভাল স্কিল’।

বিমান চলছে। অথচ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেল, ব্যাংকিং—সব খাতে চাকা খসে খসে পড়ছে একের পর এক। কিন্তু কেউ যেন তা দেখছে না। কারণ, এখানে চাকার মূল্য নেই, আছে কেবল ‘ন্যারেটিভ’। যেমন ধরুন, যখন ব্যাংকের টাকা উধাও হয়, তখন বলা হয় ‘এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, আর যখন বিমানের চাকা উধাও হয়, তখন বলা হয়, ‘এটা একটা বিরল ঘটনা!’

সবাই বলছে, পাইলট দক্ষ। তা ঠিক, পাইলট সাহেব আরেকটু সাহসী হলে তো হয়তো একেবারে চাকা ছাড়াই সরাসরি বনানী স্টেডিয়ামে নামতেন, সঙ্গে কয়েকটা গোলও দিতেন! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই চাকা খুলে পড়ার জন্য কে দায়ী হবে? নাকি সবকিছুর মতো এটাও একটা ‘মিরাকল’ বলে চালিয়ে দেওয়া হবে?

প্রকৌশলীরা নিশ্চয়ই বলবেন, ‘চাকা খুলে পড়লেও সেটা তো যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং এটা প্রকৃতির আহ্বান। একধরনের “চাকার মুক্তি আন্দোলন”। এত দিন যা বাঁধা ছিল, এখন তা মুক্ত!’

অবশ্য বাংলাদেশ এখন ‘চাকা ছাড়া এগিয়ে চলার’ ফর্মুলা তৈরি করে ফেলেছে। বিমানের চাকা যায়, মানুষের ন্যায়বিচারের চাকা বন্ধ, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকা জ্যাম, আর সংসদের চাকা তো ঘোরেই না—কেবল হুইলচেয়ারগুলো ঘোরে মাঝে মাঝে।

তবু সবাই বলছে, ‘চলছে তো, সমস্যা কী?’ বিমান চলছে চাকা ছাড়া। দেশও চলছে দায়বদ্ধতা ছাড়া। সবকিছু চলছে, কিছুই ঠিকমতো না চললেও। আমরা বলি—‘বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনার অন্যতম দিক হলো ‘উড়োজাহাজ চাকা ছাড়াও উড়তে পারে’—এমন এক অনন্য গৌরব।

বিমান বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা ফটোশপে এডিট করা পাসপোর্ট ছবির মতো—দেখতে ঝকঝকে, কিন্তু ভেতরে জং ধরা চাকা। বাইরে লাল-সবুজ রঙের গাঢ় দেশপ্রেম, ভেতরে পাইলটদের মাথায় হাত। ঠিক যেন বাইরে পতাকা, ভেতরে পলিথিন!

একসময় ছিল, ‘বিমান’ শব্দটা শুনলেই গর্বে বুক ফুলে উঠত—এখন তো বুকের ভেতর ধড়ফড় করে ‘আজ চাকা যাবে, না ব্রেক ফেল?’ চাকা খুলে পড়ার ঘটনায় বোঝা গেল, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স এখন ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে চলে। মানে, আগে চলাই, পরে দেখি কিছু খুলে পড়ে কি না।

বিমান বাংলাদেশ এখন আকাশে উড়ে বেড়ানো এক ক্লাসিক ব্যর্থতার প্রতীক। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে খাবার নেই, আর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে টয়লেটের পানির ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের বিনোদনের একমাত্র ভরসা—সামনের সিটে বসে থাকা কোনো শিশুর কান্না কিংবা জানালার বাইরের কুয়াশা। যেখানে অন্য দেশে বিমান খারাপ হলে মেইনটেন্যান্স টিম এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়, সেখানে আমাদের দেশে খারাপ চাকা খুলে ‘জাদুঘরে পাঠানো হয় কি না’—সে নিয়েও সন্দেহ। বোধ হয় তাদের অফিসে লেখা আছে: ‘চাকার গায়ে ফাটল ধরা মানেই এটা পুরাকীর্তি, রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সংরক্ষণ!’ আর প্রকৌশলীদের ভূমিকা এমন, যেন তাঁরা বিমানের অংশ নন, বরং বিমানের বিপরীতে এক স্বতন্ত্র শিল্পকলা আন্দোলন চালাচ্ছেন। তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা বাঙালি বাবার গাড়ির মিস্ত্রির কাছে বলা সেই চিরায়ত ডায়ালগের মতো—‘চালায়ে দেখেন ভাই, নিজের থেকেই ঠিক হইয়া যায় কি না।’

বিমান বাংলাদেশ বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, অথচ একটুও বিমর্ষ নয়। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এমন, যেন ডায়াবেটিস রোগী প্রতিদিন তিনবার জিলাপি খায়—‘যা হওয়ার হবে, আগে মজা নে!’

একবার বলা হয়েছিল, ‘বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, সেটা ছিল বিমানের ককপিটে বসে কল্পনার গল্প লেখার চেষ্টা। লাভ তো দূরের কথা, যাত্রীরা সঠিক সময়ে প্লেনে উঠতে পারলেই আমরা বলি–‘এই তো, সব ঠিকঠাক চলছে!’

যাত্রীদের কাছে এখন বিমানের টিকিট মানে লটারি। আপনি হয়তো সিলেট যাচ্ছেন, কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলেন—‘এই ফ্লাইট এখন বরিশাল হয়ে যাচ্ছে, কারণ রানওয়ের পাশে জ্যাম!’ কোনো প্ল্যান নেই, কোনো ব্যাকআপ নেই, শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত এক আকাশযান।

আরও ভয়ংকর সত্য হলো, দুর্নীতি-দুর্বলতা-দায়মুক্তি এতটাই সাধারণ হয়ে গেছে যে আজ চাকা খুলে পড়লেও আমরা তেমন ভয় পাই না। কারণ, আমরা জানি, ‘বিমান বাঁচবে না বাঁচবে না করেও শেষমেশ বাঁচেই। ইনশা আল্লাহ।’ এই জাতীয় আস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই।

এত কিছুর পরও যদি কেউ বলে—‘বিমান ভালো চলছে,’ তবে ধরে নিতে হবে তিনি হয় খোলা আকাশে ইমান দিয়ে উড়ছেন, অথবা তিনি বিমানের জেনারেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ম্যানুয়ালের লেখক।

চাকা খুলে পড়ছে, সিস্টেম কাজ করছে না, লোকসান বাড়ছে, যাত্রীরা আতঙ্কে ভুগছে—এ সবকিছুর মধ্যেও একটা কিছুর স্থিতি আছে: ‘আমরা অভিযোগ করি না। কারণ আমরা অভ্যস্ত।’

তাই বলি ভাই, ম্যাজিক রিয়ালিজম আমাদের বাস্তবতা। শুধু একটা অনুরোধ—পরেরবার চাকা খসে পড়লে প্লেনের নিচে একটা বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দিন—‘আমরা চলি, কারণ থামলে দায় দিতে হয়।’

আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আর যন্ত্র নয়, ওরা এখন ‘বিশ্বাসনির্ভর’। চোখে কিছু দেখা গেলেও বলার দরকার নেই। আপনি যদি বলেন, ‘বিমানের চাকা পড়েছে’—তখনই আপনি রাষ্ট্রবিরোধী, কারণ আপনি বললেন, রাষ্ট্রের ভারসাম্য কমেছে।

পরিশেষে অনেক বছর আগে শোনা বিমান বাংলাদেশ নিয়ে একটি কৌতুক:

বিমানের সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে—

স্বাগতম ফ্লাইট ৪২০-এ, মোগাদিসু টু ঢাকা! সুপ্রভাত, সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ। আমি ক্যাপ্টেন আবদুল কুদ্দুস, সঙ্গে আছেন কো-পাইলট মালেক বিন মজিদ ও আকলিমা পারভীন। ৬ দিনের বিলম্বে যাত্রা শুরু—আবহাওয়া, ইঞ্জিন সমস্যা আর আমার পেটের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ—সব মিলিয়েই এই বিলম্ব। আমাদের গন্তব্য? নিশ্চিত না। উপমহাদেশের যেকোনো জায়গায়, এমনকি কারও গ্রামের পুকুরেও নামতে পারি। সাঁতার জানা থাকলে আপনি বিশেষ সুবিধাভোগী! গর্বের সঙ্গে বলি: গত বছর আমাদের ৩৬ শতাংশ যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছেছেন। যাত্রাপথে ইঞ্জিনের শব্দ বিরক্তিকর লাগলে জানাবেন, ইঞ্জিন বন্ধ করে দেব। বিনিময়ে থাকছে ‘ডাইল’ চা আর ‘বেলা’ বিস্কুট। আজ কোনো সিনেমাই নেই। ‘রহিমার নাতি কেন হাজতে’ সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে জানালায় চোখ রাখুন—পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ক্যাটরিনা কাইফ নাচছেন কি না, দেখে নিতে পারেন। ধোঁয়া? আতঙ্ক নয়। ইঞ্জিন থেকেই বেরোয়। আমাদের প্রকৌশলী ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে পারেন। ছাদ থেকে পানি পড়লে সেটাও স্বাভাবিক। তোয়ালে আর হাতপাখা চাইলে বিমানবালার শরণাপন্ন হন। সিটবেল্ট বেঁধে নিন। না পেলে কোমরের বেল্ট দিয়ে কাজ চালান। দাঁড়িয়ে থাকলে নিজেকে স্যুটকেসে বেঁধে ফেলুন। সম্মানিত বিমানবালাদের খুব কাছাকাছি গিয়ে সাহায্য চাইবেন না, আপনারও ঘরে মা-বোন আছেন! এই প্রথম ও শেষ ফ্লাইটে ভ্রমণ করার জন্য ধন্যবাদ। কেয়ামতের দিন পুলসিরাতে আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন। ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি...

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নির্বাচনী ব্যয়

সম্পাদকীয়
নির্বাচনী ব্যয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।

সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।

নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।

‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

অরুণ কর্মকার
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।

দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!

তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?

কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

হাসান আলী 
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।

প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।

পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।

আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।

বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।

প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।

আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত