Ajker Patrika

ডোনাল্ড ট্রাম্প কি পারবেন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে

এ কে এম শামসুদ্দিন 
ট্রাম্পের এবারের মেয়াদে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অম্লমধুর হবে? ছবি: এএফপি
ট্রাম্পের এবারের মেয়াদে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অম্লমধুর হবে? ছবি: এএফপি

৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৬০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাপটের সঙ্গে জয়লাভ করেছেন। ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প ইলেকটোরাল কলেজ ভোট এবং পপুলার ভোট উভয় ক্ষেত্রেই ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রানিংমেট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন।

চার বছর পর পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি দ্বিতীবার রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এর আগে এভাবে শুধু একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়ে চার বছর পর পুনরায় হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হয়েছিলেন। লাগাতার তিনটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রথম ও তৃতীয় দফায় জয়লাভ করা ব্যক্তি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে এই কীর্তি গড়েছিলেন ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ১৮৮৪ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২২তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৮৮৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি হেরে গিয়েছিলেন। তবে ১৮৯২ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি পুনরায় জয়লাভ করে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪তম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এবার ১৩২ বছর পর ট্রাম্পও সেই কীর্তির অধিকারী হলেন। শুধু কি তাই, ৩৪টি ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে ইতিহাস গড়বেন তিনি। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে সহিংস হামলা উসকে দেওয়ার মামলা এখনো তাঁর বিরুদ্ধে চলছে। ব্যবসায়িক নথিপত্রে জালিয়াতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেলেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া যায়, সেখানে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ২৯৫টি ভোট পেয়ে গেছেন। এ লেখা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত আরও তিনটি অঙ্গরাজ্যে ফল ঘোষণা বাকি। অপরদিকে কমলা পেয়েছেন ২২৬টি ভোট। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প শুধু দাপটের সঙ্গেই হোয়াইট হাউসে ফিরছেন না, তাঁর রিপাবলিকান দল কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে হারানো আধিপত্য ফিরে পেয়েছে। সিনেটে রিপাবলিকান দল সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫২টি আসন পেয়েছে। পাঁচটি আসনে তারা এগিয়ে আছে। অপরদিকে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পথে। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা পেয়েছেন ২০৮টি আসন। এর বিপরীতে ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছেন ১৮৯টি। প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ২১৮টি আসন পেতে হয়। এখনো কয়েকটি আসনের ফলাফল ঘোষণা বাকি রয়ে গেছে। এ নির্বাচনে সার্বিক বিচারে ট্রাম্প বেশ শক্তি সঞ্চয় করেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সাধারণত সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে প্রেসিডেন্টের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। যেকোনো নীতি বাস্তবায়ন, আইন পাস, এমনকি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে খুব সামান্য বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প অশ্লীল ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত। বিষয়টি সাধারণ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেন না। তারপরও এবার তাঁরা ট্রাম্পের এই বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা রেখে তাঁকে ভোট দিয়েছেন। নানা বিশ্লেষণে উঠে এসেছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপাবলিকানরা বেশি জোর দিয়েছিলেন। মূল্যবৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। কমলা হ্যারিসের মূল লক্ষ্য ছিল, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনোজ, আফ্রিকান-আমেরিকান, নারী, কলেজ-শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ যুবসমাজ এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের সমর্থন পাওয়া। কিন্তু শেষ চারটি ক্ষেত্রেই কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত যুক্তরাষ্ট্রে এবারের নির্বাচনে অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। গ্রামীণ ভোটারদের বড় অংশ চিরাচরিতভাবে রিপাবলিকান দলের সমর্থক। সাধারণত শহরের শ্রমিক-কর্মচারী শ্রেণি ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ভোট দেয়। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত অনেক ডেমোক্র্যাট ভোটার ট্রাম্পকে অপছন্দ করলেও এবার শেষ মুহূর্তে তাঁর প্রতি আস্থা রেখেছেন। অনেক ডেমোক্র্যাট সমর্থক আবার বুথমুখো হননি। যার ফলে ‘দোদুল্যমান’ অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোট এবার ট্রাম্পের পক্ষেই গেছে।

মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক মন্দা এবং উৎপাদন শিল্পের নিম্নগতিকে কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প ভোটারদের মনে আউটসোর্সিং, ছাঁটাইয়ের ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারকালে ভোটারদের কাছে ট্রাম্প বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রচারকালে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বারবার যে প্রশ্নটি রেখেছেন সেটি ভালোভাবেই কাজে দিয়েছে। তিনি তাঁদের জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আমার সময়ে যেমন ছিলেন, তারচেয়ে কি আপনারা এখন ভালো আছেন?’ এ বিষয়টি ভোটারদের মনে দাগ কেটেছে। তাঁরা তুলনা করে দেখেছেন, বর্তমান অবস্থা থেকে ট্রাম্পের আমলেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাঁরা ভালো ছিলেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদির মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাঁদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তা ছাড়া কাজ হারানোর ফলে অথবা হারানোর আশঙ্কায় শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন। সামগ্রিকভাবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে সাড়া ফেলেছে ট্রাম্পের আবেদন। এমনকি, স্প্যানিশভাষী ল্যাটিনোজ আর কৃষ্ণাঙ্গ প্রভাবিত পেনসিলভানিয়াতেও।

মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি অভিবাসন সমস্যা নিয়ে এবারের নির্বাচনে প্রচার বড়সড় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ‘রাস্ট বেল্ট’ হিসেবে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলোতেও ট্রাম্পের জয় প্রমাণ করছে ডেমোক্র্যাটদের চিরাচরিত শ্রমিক-কর্মচারী ভোটব্যাংকে ফাটল ধরাতে পেরেছেন ট্রাম্প। রাস্ট বেল্ট অঙ্গরাজ্যগুলো হলো পেনসিলভানিয়া, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আপস্ট্যাট নিউইয়র্ক অঞ্চল, ওয়াহো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান ইত্যাদি। ভোটের প্রচারকালে তিনি বারবার বলেছেন, ভোটে জয়লাভ করলে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সুরক্ষিত করবেন কলকারখানা, দপ্তরের কর্মীশ্রেণির নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তা। এই অবৈধ অভিবাসন নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন সাধারণ ভোটাররা। বাইডেন প্রশাসনের সময় দেশে অবৈধ অভিবাসন সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ট্রাম্প এই বিষয়টিও ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি ৭৮ লাখ অভিবাসী বসবাস করেন। যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক-কর্মচারীদের অনেকে মনে করেছেন তাঁদের রোজগারের নিশ্চয়তায় আঘাত হানছেন অভিবাসীরা। কমলা এ বিষয়ে শক্ত অবস্থান ঘোষণা না করায় ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন তাঁরা। অপরদিকে ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এবারের নির্বাচনী প্রচারকালে ট্রাম্প নাগরিকদের কাছে একটি ‘স্বপ্ন’ বিক্রি করেছেন একটি স্লোগানের মাধ্যমে—‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। ট্রাম্পের এই স্লোগান ভোটারদের আকর্ষণ করেছে। এই স্লোগানটি তাঁর প্রথম মেয়াদের নির্বাচনী প্রচারেও তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।

মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য বাইডেন প্রশাসনের কিছু বিষয়ে বাড়াবাড়িকে দায়ী করা হচ্ছে। ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছে, অথচ এই অর্থ দেশে ব্যয় করলে তাঁদেরই উপকার হতো। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে ধারাবাহিকভাবে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বাইডেন সরকার। অন্যদিকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর শুরু হয়েছে ধারাবাহিক পাল্টা আক্রমণ। লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য ইসরায়েলকে কোনো শর্ত ছাড়াই ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েছেন বাইডেন। তা ছাড়া, তিন দফায় উপসাগরীয় অঞ্চলে বাড়তি সেনা পাঠাতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ফলে, এর বাড়তি অর্থের বোঝা বইতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের। এমতাবস্থায় দোদুল্যমান ভোটারদের একাংশ মনে করেছেন, স্বভাবে বেপরোয়া হলেও ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। এসব কিছু বিবেচনা করেই তাঁরা কমলাকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। তাঁরা ভেবেছেন, বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কমলাকে ভোট দিলে সেই একই ঘটনা ঘটবে। তাঁরা পরিবর্তন চেয়েছেন। এই নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

আগেই উল্লেখ করেছি, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় অনেক নীতি বাস্তবায়নে ট্রাম্পের সুবিধা হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও তাঁর জন্য সহজতর হবে। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার পর যে কাজগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করবেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন তা হলো, অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করা, অর্থনীতিতে মনোযোগী হওয়া, জলবায়ু নীতিতে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা, গর্ভপাতের অধিকার রদ করা এবং ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে হামলাকারীদের ক্ষমা করে দেওয়া। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ট্রাম্প তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালান ট্রাম্পের সমর্থকেরা। এ দাঙ্গায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়। এ দাঙ্গা লাগানোর উসকানিদাতা হিসেবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। দাঙ্গাকারীদের অনেকেই আটক হয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি পুনরায় ক্ষমতায় গেলে তাঁদের কয়েকজনকে

মুক্তি দেবেন। আগেই উল্লেখ করেছি, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলা চলমান। এর দুটি ফৌজদারি মামলার তদন্ত করছেন মার্কিন কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথ। মামলা দুটি হলো, ক্যাপিটল ভবনে দাঙ্গায় উসকানিদাতা ও সরকারি গোপন নথি সরানোসংক্রান্ত অভিযোগ। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় জ্যাক স্মিথের তদন্তকাজ চালিয়ে যাওয়া একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মামলা দুটির অভিযোগ ট্রাম্প অস্বীকার করে একসময় বলেছিলেন, তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরে যাওয়ার ‘দুই সেকেন্ডের মধ্যে’ জ্যাক স্মিথকে অপসারণ করবেন। কাজেই ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প যে শক্তিবলে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসছেন, তাতে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের অপসারণ করে তাঁর পছন্দমতো কর্মকর্তা নিয়োগ দেবেন। শুধু তাই নয়, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার বদৌলতে নিজ পছন্দের বিচারক নিয়োগেও তিনি পিছপা হবেন না।

নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর প্রথমবার জনসমক্ষে এসেই পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করায় ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি দেশবাসীর জন্য প্রতিদিন লড়াই করবেন। দেশের সব সমস্যা সমাধান করবেন তিনি। অভিবাসীদের বিষয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসা যাবে তবে বৈধ উপায়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কি পারবেন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে? বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে, ট্রাম্পের যে স্বভাব তাতে তাঁর আগামী জমানায় বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যে অম্লমধুর হবে, সে কথা বলাই যায়।

এ কে এম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এক অন্তর্দীপের নিভে যাওয়া

সম্পাদকীয়
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫৭
এক অন্তর্দীপের নিভে যাওয়া

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নিভে গেল আরেকটি আলো। এত দীর্ঘ লড়াই, এত প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসমসাহসী এই নারী শেষ বাঁকে এসে আর পারলেন না।

জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে শোকের নীরবতায় থমকে গেল দেশ। আর কাঁপিয়ে দিয়ে গেল রাজনৈতিক-মানসিক ভূমিকম্পের সূক্ষ্ম রেখাগুলো। সংগ্রাম, কারাবাস, অসুস্থতা—সবকিছুর মধ্যেও তিনি ছিলেন অবিচল; বিশ্বাসে দৃঢ় আর নেতৃত্বে অনমনীয়।

কারাগারের দেয়াল, হাসপাতালের শয্যা, রাজনীতির নির্মম অন্ধকার—সব মিলিয়ে দীর্ঘ বছর খালেদা জিয়া কাটিয়েছেন লড়াইয়ের ভার বহন করে; যে মানুষটি রাজপথে কখনো মাথানত করেননি। এমনিতে একটি লড়াই থেকে আরেকটিতে যাত্রা করতে করতে তাঁর শরীর হয়ে উঠেছিল ভঙ্গুর, মন ক্ষয়ে গিয়েছিল প্রতিহিংসার ধারাবাহিক আঘাতে। বিদেশে চিকিৎসা, দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, পরিবারের অসীম ব্যাকুলতা—সবই ছিল, সবই হলো; তবু তাঁকে আর ফেরানো গেল না।

তুমুল জনপ্রিয় এই নেত্রীর প্রস্থান শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যু নয়; এটি একটি যুগের সমাপ্তি। সেই যুগের মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধের অন্ধকারে তাঁর বন্দিত্ব, স্বামীর শাহাদাতে জীবনচক্রের ভেঙে পড়া, সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের অশ্রু, ওয়ান-ইলেভেনের নিঃসঙ্গ বন্দিত্ব, আর পুরান ঢাকার কারাগারের শীতল দেয়ালে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস। সবকিছুর পরও তিনি দাঁড়িয়েছিলেন—বাধা, ব্যথা আর ব্যর্থতা পেরিয়ে।

খালেদা জিয়ার জীবন ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ। একদিকে তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের সংগ্রামের মুখ; অন্যদিকে সমালোচনাও তাঁর পিছু ছাড়েনি। গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে গিয়ে যেমন ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তীব্র বিরোধিতাও কম ছিল না। অনেক ভুলের দায় তাঁকে বহন করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর অটলতা, প্রতিকূলের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা, আর ব্যক্তিজীবনের অবর্ণনীয় ক্ষতবিক্ষত অধ্যায় তাঁকে আলাদাভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে।

শোকের এই মুহূর্তে আমরা এক রাজনীতিককে নয়; এক দৃঢ় চরিত্র নারীকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। যাঁর জীবনের গল্প শুধু সংগ্রামের নয়, অবিচল থাকার অনুশাসনও বটে। একটি অন্তর্দীপ নিভে গেছে; কিন্তু তার আলো অনেক দিন ধরে পথ দেখাবে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে।

অসুস্থ শরীর নিয়েও যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন, তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন—দৃঢ়তা কীভাবে জন্ম নেয়। তাঁর কণ্ঠে ছিল সংগ্রামের ইতিহাস, নীরবতায় ছিল ত্যাগের গভীরতা। আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে শূন্যতা শুধু রাজনীতিতে নয়, জাতির অনুভূতিতেও।

খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনীতির এক অশ্বারোহিণী। যিনি প্রতিদিন আহত হন, প্রতিদিন অভিযুক্ত হন, আবার প্রতিদিনই ঘুরে দাঁড়ান। জয়-পরাজয়ের হিসাবের বাইরে ছিল তাঁর দৃঢ়তার বর্ণমালা। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু যে অন্ধকার-আলো মেশানো উপস্থিতি তিনি রেখে গেলেন, তা বহুদিন পর্যন্ত রাজনীতির ভাষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোঝাপড়া এবং ইতিহাসের নির্মোহ রেকর্ডে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকবে। ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে—ভালোবাসা, বিতর্ক আর অবিচল সাহসের এক অনন্য নাম হিসেবে।

বিদায় খালেদা জিয়া।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সংগ্রামী জীবনের সমাপ্তি

রাকিবুল ইসলাম
খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারা আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়। কেউ ক্ষমতার উষ্ণতা সহ্য করতে পারেনি, কেউ বিকৃত রাজনৈতিক বাস্তবতায় চরিত্রহীন হয়ে গিয়েছিল, কেউ আবার নিজের আগুনেই ভস্মীভূত হয়েছে। কিন্তু এমনও কিছু নেতৃত্ব আছেন, যাঁরা সময়ের দহনক্ষেত্র পেরিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে এক ‘ধারাবাহিক প্রতিরোধের আদর্শ’ হিসেবে। এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক বাস্তবতায় যদি কারও নাম নেওয়া যায়, তিনি হলেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়া মূলত এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে। যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, বন্দিত্ব, দলন, চক্রান্ত, আন্দোলন, ক্ষমতা, পতন, প্রতিরোধ সব ধারাই তাঁর জীবনকে স্পর্শ করেছে। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, তিনি শুরু করেছিলেন একদম সাধারণ নিরহংকারী গৃহবধূ থেকে।

১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া ‘পুতুল’ নামের সেই মেয়ে জানতেও পারেননি, ভবিষ্যৎ তাঁকে কোন অগ্নিপরীক্ষার দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ক্ষমতার বাস্তবতা মানবজীবনে অনেক সময় নির্মম। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে। সেই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি মানুষ, একটি পরিবার, একটি রাজনৈতিক দলকে নয়, পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখনো রাজনীতির ময়দানে খালেদা জিয়া অপরিচিত। কিন্তু ইতিহাস সেই শান্ত গৃহবধূকে ঘরেই থাকতে দিল না। দল, নেতা-কর্মী, সমর্থক—সবাই তাঁকে ডাকলেন। ভেঙে পড়া থেকে একটি দলকে বাঁচাতে, একটি জাতির নেতৃত্বশূন্যতা রোধ করতে তাঁকে সামনে আসতেই হলো। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করলেন; ১৯৮৩ সালে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান; ১৯৮৪ সালে দলের সর্বোচ্চ নেতা চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন এরশাদ সরকারকে সরিয়ে দিলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নতুন দ্বারে দাঁড়ায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হলো। দেশ পেল তার ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। এই অর্জন শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশীয় নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক বিশাল অধ্যায়। তাঁর প্রথম মেয়াদে তিনি যা করলেন, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ও ফ্রি টিউশন, বৃক্ষরোপণ আন্দোলন, সার্কে নেতৃত্ব, যমুনা সেতুর ভিত্তি—এসবই দেশের পরবর্তী উন্নয়ন ধারার মূল স্থপতির পদে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য ও বিরল কৃতিত্ব হলো, তাঁর অংশ নেওয়া প্রতিটি নির্বাচনে তিনি জয় পেয়েছেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচটি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং মোট ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে জয়লাভ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এত ভিন্ন ভিন্ন আসনে একসঙ্গে জয়লাভের নজির আর কোনো নেতার নেই।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়। খালেদা জিয়ার তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাবকে সর্বোচ্চে নিয়ে যায়। এই মেয়াদে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।

বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যখন রাজনীতি নানা চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় রচনা শুরু করে। কিন্তু সবচেয়ে নির্মম অধ্যায় শুরু হয় ২০১৮ সালে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি যান পুরোনো নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের একটি একক সেলে। খালেদা জিয়ার বয়স, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা এবং নির্বাচনের আগমুহূর্তে হাজারো নেতা-কর্মীর গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা—সব মিলিয়ে বিএনপি যেন এক অচেনা অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। আর তখন দলের প্রধান নেত্রীর অনুপস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য ভেঙে যায়।

অবশেষে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রেক্ষাপটে ‘দণ্ড স্থগিত’ করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়, শর্ত সাপেক্ষে। তিনি বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না; বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। ফলে তিনি মুক্তি পেলেও তৈরি হয় নতুন একধরনের রাজনৈতিক বন্দিত্ব।

এরপর ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তীব্রভাবে বদলে দেয়। পরদিন রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দীর্ঘ দমন-পীড়ন, কারাবাস, নিপীড়ন—সব পেরিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন রাজনৈতিক ময়দানে সেই দৃঢ়তার সঙ্গেই, যেভাবে তিনি জীবনের প্রতিটি সংকট মোকাবিলা করেছেন।

ইতিহাস তাঁদেরই শ্রদ্ধা জানায়, যাঁরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথানত করেন না। সেই ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম আলাদা লেখা থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী

আব্দুল্লাহ নাজিম আল মামুন
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানকেও প্রদানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করে দেন। তবে চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকার জিয়াউর রহমানের পুরস্কার পুনরায় বহাল রেখেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম স্বাধীনতা পুরস্কার চালু করেন।

প্রতিপক্ষের প্রতি কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে ভূষিত হওয়া পুরস্কার বাতিল করা হয়, তা আমরা শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই দেখতে পেয়েছি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক। শত্রুকেও বুকে টেনে নিতেন। ন্যায়ের ভাষায় কথা বলতেন। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অপ্রতিরোধ্য। তিনি ছিলেন আপসহীন। আপস করেননি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে। এমনকি গণতন্ত্র রক্ষার্থে তিনি নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়াই যেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে আরও জোরদার করেছিল, যা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর অন্যতম উপায়। যুগে যুগে দেখা গেছে, কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকতে পারেনি। গণতন্ত্রের উত্তরণে বিএনপির ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। রাজনীতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল।

সেই অনুরাগ ভাঙাতে এগিয়ে আসেন দলের একাংশের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁদের অনুরোধে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ। জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির নেতৃত্বে আসেন খালেদা জিয়া, ১৯৮৩ সালে। তিনি প্রথমে এককভাবে এবং পরে ৭ দলীয় জোট গঠন করে তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রধান এরশাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে বিরোধিতা করেন, যা তৎকালীন বিরোধীদের মধ্যে দৃঢ় নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে এবং আপসহীনতার স্পষ্টতা ফুটে ওঠে। এরপর ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত টানা হরতাল, মিছিল, সমাবেশ, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া।

১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথরেখায় এটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

খালেদা জিয়াই প্রথম গণভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন, যা গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন তিনি, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তনের অন্যতম বড় মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং স্বল্পতম সময়ে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে শান্তিপূর্ণভাবে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তন।

এরপর ২০০১ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু নারী বলে নয়; একজন দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃত হয়েছে।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন কখনো সহজ ছিল না। তিনি হয়েছেন কারাবন্দী, হয়েছেন গৃহবন্দী। তাঁর ওপর চাপানো হয়েছে মামলার পাহাড়, স্বাস্থ্য নিয়ে করা হয়েছে অবহেলা। তবু তিনি কখনো নিজের নীতিতে আপস করেননি। তাঁর ‘আপসহীন’ তকমাটি শুধু কাগুজে নয়, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি অভিধা।

২০১৮ সালের পর থেকে বারবার অসুস্থ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, তা বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অথচ দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি ছিল তাঁর প্রাপ্য মৌলিক অধিকার।

এই দেশের মা, মাটির প্রতি খালেদা জিয়ার ছিল আবেগ ও অসম্ভব ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি আর মানুষই আমার সবকিছু’—এই আবেগমাখা উচ্চারণ ছিল তাঁর।

তিনি চলে গেলেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাঁর অদম্য প্রজ্ঞা, সাহসিকতা, মানবিকতা, উদারতা ও আপসহীনতা। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, ইতিহাসের পাতায়—ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ফিরে দেখা ২০২৫ সাল

সেলিম জাহান 
ফিরে দেখা ২০২৫ সাল

আরও একটি বছরের যবনিকাপাত ঘটল। শেষ হয়ে গেল ২০২৫ সাল। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, প্রত্যাশা-হতাশার মাঝে সমাপ্তি ঘটেছে বছরটির। সময় এখন পেছন ফিরে তাকানোর—কী পেয়েছি, কী পাইনি; কী আশা করেছিলাম, কোথায় হতাশ হয়েছি, কী কী করতে চেয়েছি, কী কী করতে পারিনি—স্বাভাবিকভাবেই ২০২৫ সালের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে এই হিসাব মেলানোর একটি বিরাট তাৎপর্য আছে; আমাদের অর্জনগুলোর উদ্‌যাপন এবং আমাদের ভুলগুলো থেকে শেখার জন্য। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সেগুলো একটি পাথেয় হয়ে থাকতে পারে।

রাজনৈতিক দিক থেকে পুরো বছরটি নানা উদ্বেগ, শঙ্কার, আশা-নিরাশার মধ্যে ছিল। জনগণের কাছে নানান রাজনৈতিক সমীকরণ এবং সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার ছিল না। রাজনৈতিক অঙ্গনে কোন দল প্রাধান্য পাচ্ছে, কে কার সঙ্গে জোট বাঁধছে, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা সারা বছর ধরে ছিল। জনমনে, বিশেষত নারীদের মনে প্রশ্ন ছিল যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে নারী-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে কি না। নির্বাচন হবে, নাকি হবে না, তা নিয়েও নানান মহল প্রশ্ন তুলেছিল। নির্বাচনের তারিখ নিয়েও একটা ধোঁয়াশা ছিল। নানা রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময় উল্লেখ করছিল সম্ভাব্য নির্বাচন সম্পর্কে। অন্তর্বর্তী সরকারও বিভিন্ন সময়ে নানা সময়কালের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তারিখ বলছিল না। অবস্থাটা এমনই ছিল যে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও কথা বলেছিলেন নানা বিজ্ঞজন। জনমনে একটা বড় জিজ্ঞাসা ছিল যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে আসবেন। সে ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত ছিল।

২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সেই সব শঙ্কা-আশঙ্কার অবসান ঘটেছে। নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ভোটার তালিকাও সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন আসনে প্রার্থী তালিকাও বেরোচ্ছে। তারেক রহমানও কদিন আগে দেশে ফিরেছেন। সুতরাং রাজনীতির অঙ্গনে নানান বিষয়ে একটা স্বস্তি এবং ভারসাম্য ফিরে এসেছে। যদিও বিভিন্ন দিকে নানা অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান। এসব অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে বলেছেন, কোনো কোনো অপশক্তি এই নির্বাচন বানচাল করার জন্য তৎপর। রাজনীতি-সম্পৃক্ত সহিংসতা বেশ ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে নানান জায়গায় সন্ত্রাসও চলছে। সত্যি কথা বলতে, আমরা এখনো যথার্থ রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন করতে পারিনি এবং গণতন্ত্রের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি।

অস্বীকার করার উপায় নেই, ২০২৫ সালে অর্থনীতি বিষয়টিই সাধারণ মানুষের মনের বিরাট অংশ জুড়ে ছিল। ২০২৫ সালে তাদের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা ছিল অনেক, কিন্তু চিন্তাও তাদের কম ছিল না। সে প্রত্যাশা আর চিন্তা আবর্তিত হয়েছে তাদের জীবনের অর্থনীতি নিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মব সহিংসতা ইত্যাদি।

শেষ হয়ে যাওয়া বছরটিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ছিল অনেকটাই নেতিবাচক। বাংলাদেশের প্রবহমান সমস‍্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র‍্য ও অসমতা। গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র‍্য হার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র‍্যসীমার নিচে বাস করে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র‍্যের ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। দারিদ্র‍্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের নিরাপদ সুপেয় জলের সুবিধা নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ছয় বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে—২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাল‍্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ, যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজনের একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। বাংলাদেশের উচ্চতম ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদের মালিক, আর দেশের নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষ (দেশের অর্ধেক লোক) ৪ শতাংশ সম্পদ ভোগ করে। দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত‍্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সে হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামীণ বাংলায় আয় অসমতা স্থিতিশীল রয়েছে, দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।

কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ‍্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশ অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ কর্মসংস্থান চলে গেছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ‍্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ‍্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ‍্যালয়ের সনদপ্রাপ্তদের মধ‍্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ‍্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ‍্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ঋণভার এবং ঋণ পরিশোধের দায়ভার একটি সংকটজনক জায়গায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানি আয়ের অনুপাত ১৯২ শতাংশ, যেখানে এই অনুপাত ১৮০ শতাংশ হলেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার সেটাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করে।

২০২৫ সালে বাংলাদেশে সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে একটি শ্লথতা ছিল। দেশের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এখনো প্রার্থিত স্তরে পৌঁছায়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট এবং সেই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা এই উৎপাদন স্তরকে আরও বিপর্যস্ত করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের যাপিত জীবনকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশে বিনিয়োগ নিম্নস্তরে রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা অর্থনীতিতে নানা নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার জন্ম দিয়েছে। পোশাকশিল্পে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বহু উদ্যোক্তা সক্রিয় নয়, বিদেশি বিনিয়োগেও স্থবিরতা আছে। ফলে দেশের উৎপাদন ভিত্তিও দুর্বল এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি সমস্যা হিসেবে বিরাজ করেছে। একদিকে উচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় একটি সমস্যা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকিও একটি ভাবনার ব্যাপার। প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সম্পাদন এবং সেই সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে আমদানি করা উপকরণের ওপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। জ্বালানি খাতে যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতি এবং সেই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বালানি খাতে যে বিপুলভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ভোগ করে সমাজের ধনাঢ্য এবং সম্পদশালী অংশ। আমাদের জ্বালানি খাতে দেওয়া ভর্তুকির ৫৪ শতাংশই যায় দেশের ৪০ শতাংশ সবচেয়ে সম্পদশালী গোষ্ঠীর কাছে।

২০২৫ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতির অন‍্যতম বাস্তবতা ছিল নানান বিষয়ে বৈশ্বিক চাপ। প্রথমত, এ বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি প্রবৃদ্ধি-শ্লথতায় ভুগেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশ অর্থনীতিতেও পড়েছে। বিশ্বের নানান জায়গার যুদ্ধ এবং সংঘাতের প্রভাবও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। যদিও উত্তরণ সময় পিছিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছে, কিন্তু সম্ভবত ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে। এর ফলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছু কিছু সুযোগ হারাবে। যেমন স্বল্প বা শূন্য শুল্কে রপ্তানি সুবিধা, অনুদান সুবিধা ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশ পর্যায়ে উন্নীত হলে বাংলাদেশ এসব সুবিধা পাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন‍্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা, সংনম‍্যতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।

অসমতা বা বৈষম‍্য তো শুধু অর্থনৈতিক নয়, তা ব‍্যাপ্ত হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বলয়েও। বৈষম‍্য শুধু ফলাফলে নয়, তা পরিস্ফুট হয়েছে সুযোগেও। দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসুবিধায় বঞ্চিত।

নারীর প্রতি বৈষম‍্য এবং সহিংসতা বাংলাদেশি সমাজের অসমতার অন‍্যতম বাস্তবতা। সুযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা বৈষম‍্যের শিকার হয়, যা প্রতিফলিত হয় ফলাফলে। ঘরে-বাইরে নানা হয়রানি আর সহিংসতার শিকার হয় নারীরা। সেসব নির্যাতনের অংশ হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, গৃহাভ‍্যন্তরের সহিংসতা এবং ধর্ষণ।

২০২৫ সালে একধরনের অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের সমাজের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে অব্যাহত ছিল। সেই সঙ্গে সহিংসতা, সন্ত্রাস এবং মবতন্ত্রের ফলে এ দেশের সমাজ একটি শঙ্কার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত সময় পার করেছে। ‘মব ভায়োলেন্সকে’ ‘মব জাস্টিস’ বলে যৌক্তিকতা দানের প্রচেষ্টা পরিপূর্ণভাবে অন্যায়। ন্যায্যতা অনেক উঁচু মার্গের বিষয়। সহিংসতার মতো বিকৃত একটি পন্থা দিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য যৌক্তিক, অর্থবহ এবং প্রাসঙ্গিক অনেক পন্থা আছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে ‘মব ভায়োলেন্সকে’ কিছুতেই ‘মবোক্রেসির’ সমার্থক বলা যায় না। একটি হিংসাত্মক প্রক্রিয়াকে ‘ডেমোক্রেসির’ সঙ্গে তুলনা করা অন্যায়। চূড়ান্ত বিচারে, ‘মব ভায়োলেন্স’ হিংস্র সহিংসতা ভিন্ন কিছুই নয়।

দুই মাসের কম সময়ে বাংলাদেশ একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে গণমানুষের প্রত্যাশা অনেক। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি সেই দিকে। আগামী নির্বাচন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক পথযাত্রার শুরু করুক, গতিময়তা আনুক, সমাজে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুক, সেটাই আমরা চাই। ২০২৬ সাল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা এবং সমবৃদ্ধির সুবাতাস নিয়ে আসুক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত