Ajker Patrika

আল জাজিরার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা

যেখানে ইসরায়েলের মিত্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ

মোহামেদ এলমাসরি
আল জাজিরার ওপর সাম্প্রতিক  নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
আল জাজিরার ওপর সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

গত সপ্তাহে প্যালেস্টেনিয়ান অথরিটি (পিএ) বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে নিষিদ্ধ করেছে, যা কিনা সংবাদভিত্তিক কয়েকটি আন্তর্জাতিক আউটলেটের মধ্যে একটি এবং যারা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী দখলদারত্ব, গাজায় চলমান গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূল অভিযানের খবর ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে আসছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপকে পর্যবেক্ষকেরা অতীব বেদনাদায়ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তির ওপর আলোকপাত করার জন্য নিবেদিত কয়েকটি আন্তর্জাতিক কণ্ঠের একটিকে দুর্বল করতে দৃশ্যত ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংস্থা কি বাধ্য করতে পারে? এটি বোঝার জন্য বিস্তৃত প্রেক্ষাপট পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বৃহত্তর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) একটি অংশ। তারা নিজেদের ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে। তবে প্রকৃতপক্ষে এরা অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ শাসন করে। কিন্তু বহু বছর ধরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদারত্বকে সমর্থন ও সেবা করা।

‘পবিত্র’ অংশীদারত্ব

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আসলে ১৯৯০-এর দশকের অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার ফল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি রাজনৈতিক অবলম্বন দিয়েছে। তবে দখলের স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখার জন্য এটি অনেক ক্ষেত্রে একটি ঢাল হিসেবে বিবেচিত হয়।

সেই সময়ে ফিলিস্তিনি অঞ্চলের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য পিএলও সংগ্রাম করছিল এবং এ জন্য তাদের অর্থনৈতিক সহায়তার প্রয়োজন ছিল। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির মাধ্যমে পিএলওর সঙ্গে রাজনৈতিক ও আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। এই চুক্তির ফলে নবগঠিত পিএ ইসরায়েলের দখলদারির কাজে সাহায্য করার মতো কিছু নোংরা কাজ করতে রাজি হয়, যা পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করে।

‘নিরাপত্তা সমন্বয়ের’ ছদ্মবেশে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলি দখলদারত্বের প্রধান ‘সাবকন্ট্রাক্টর ও সহযোগী’ হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই নিরাপত্তা সমন্বয়কে ‘পবিত্র’ বলে বর্ণনা করেন, যা অংশীদারত্বের গভীরতাকে নির্দেশ করে। ঐতিহাসিকভাবে এই সমন্বয়ের কথা বলে ইসরায়েলের পক্ষে সাংবাদিকতাসহ সব ধরনের ভিন্নমতের শ্বাসরোধ করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের’ অপরাধে ১ হাজার ৬০০-র বেশি ফিলিস্তিনিকে আটক করে। ২০২০ ও ২০২১ সালেও ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করে তারা। ২০২২ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সমালোচনাকারী কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করা হয়।

অনেক ফিলিস্তিনি আল জাজিরাকে সংবাদমাধ্যম হিসেবে ইতিবাচকভাবেই দেখেন। আল জাজিরার ওপর সাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞা তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যারা আল জাজিরার রিপোর্টকে বিশ্বাস করেন।

সমন্বয়ের প্রমাণ

ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ইসরায়েলের সহযোগী হিসেবে দেখছে, যার ফলে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জনমতেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বাধা হিসেবে মনে করে। কারণ, তাদের আচরণ ও সিদ্ধান্তগুলো ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের খোলামেলা সমন্বয় আর কখনোই দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের আল জাজিরাকে নিষিদ্ধ ও এর রামাল্লার অফিসে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করার কয়েক মাস পরেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আল জাজিরার প্রচার নিষিদ্ধ করার এই সিদ্ধান্ত এল। তাদের দুর্বল অনুকরণ ফিলিস্তিনিদের চোখ এড়িয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম।

একইভাবে জেনিনে প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসের ওপর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক দমন অভিযান ইসরায়েলি কৌশলের অনুকরণ বলেই মনে হচ্ছে। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সহিংস অভিযানে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক ও একজন নারী সাংবাদিকসহ মোট আটজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আল জাজিরা টিভিতে প্রচারিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখানো হয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা ২১ সেপ্টেম্বর ৪৫ দিনের বন্ধের আদেশ জারি করতে পশ্চিম তীরের রামাল্লায় আল জাজিরার অফিসে ঢুকেছে। এই পদক্ষেপগুলো পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের কৌশলের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।

দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের পর ২০২৪ সালের আগস্টে ইসরায়েল সেখানে তার বৃহত্তম সামরিক অভিযান শুরু করে। তারা শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা, হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করে। এটা সম্ভবত অনেক ফিলিস্তিনি বুঝতে পেরেছে যে ইসরায়েলের কাছ থেকে পাঠ নিয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এর অন্ধ অনুকরণ করে চলেছে।

প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সমালোচকদের গালিগালাজ করছেন। বোঝাই যাচ্ছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের তৈরি নিয়ম মেনে চলছে।

হামাসকে বাসের নিচে ফেলে দেওয়া

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক দমনপীড়নের লক্ষ্য ছিল সম্ভবত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এবং যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার প্রশাসনে তারা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়, তা দেখানো। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হয়তো এটা দেখাতে চায় যে তারা হামাসকে বিতাড়িত করতে চাইছে, যারা কিনা গাজা শাসন করছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এসব করছে এই কারণে যে তারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং নিজেদের অগ্রাধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠা চায়।

গত জুন মাসে বেইজিংয়ে হামাস ও ফাতাহ একটি ঐক্যের সরকার গঠনের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিটি ঐতিহাসিক ছিল, কারণ হামাস একটি ইসলামপন্থী দল, আর ফাতাহ ধর্মনিরপেক্ষ। এ ছাড়া দল দুটি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী। ঐক্যের সরকারের জন্য যে গতি গড়ে উঠছিল, তা এখন মৃতপ্রায়।

হামাস আল জাজিরার ওপর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা এবং জেনিনে এর অনুপ্রবেশ—উভয়েরই কঠোর নিন্দা করেছে। তারা এটিকে হামাসসহ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবেই দেখে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হয়তো হামাসকে এতটাই নিম্নমানের বলে মনে করে যে তারা ইসলামপন্থী গোষ্ঠীটিকে ছাড়াই গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে পারে। তবে এটিই প্রথম নয় যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হামাসকে বাসের নিচে ফেলে দিয়েছে।

২০০৬ সালে হামাস আইনসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। কিন্তু ফাতাহ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এ ফলাফলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। পাশাপাশি একটি অভ্যুত্থানেরও চেষ্টা করে। অভ্যুত্থানচেষ্টার ফলে গৃহযুদ্ধ বাধে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিভাজন ঘটে।

প্রতিরোধের বিষয়

গাজা ও পশ্চিম তীরে উভয় ক্ষেত্রেই ইসরায়েলের প্রাথমিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সব উপাদান নির্মূল করা। ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার দিকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বৃহত্তর ইসরায়েলের ধারণার কথা কখনো তার জনগণকে বলে না। বরং তারা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে নির্মূল করতে বেশি আগ্রহী।

অনেক ফিলিস্তিনি এই সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কারণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে তাদের মুক্তির পথে বাধা হিসেবে দেখছে। যাই হোক, ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা হামাসকে নির্মূল করতে পারেনি। আর তারা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে নির্মূল করতে সক্ষম হবে না। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিম তীরে গণহত্যা ও আগ্রাসী ইসরায়েলি সম্প্রসারণ দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিরোধের তীব্রতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আল জাজিরার ওপর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা, জেনিনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ফিলিস্তিনিদের মনে এই দৃঢ় ধারণার জন্ম দেয় যে তাদের অধিকার রক্ষা করা নয়, বরং ইসরায়েলি স্বার্থ দেখতে অনেক বেশি আগ্রহী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।

সামনের দিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য পশ্চিম তীরে তাদের শাসিত অংশগুলো সম্ভবত আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠবে। গাজায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা তো দূর অস্ত।

মোহামেদ এলমাসরি, অধ্যাপক, মিডিয়া স্টাডিজ, দোহার ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ

(মিডল ইস্ট আইতে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

অরুণ কর্মকার
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।

দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!

তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?

কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

হাসান আলী 
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।

প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।

পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।

আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।

বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।

প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।

আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

সাদিয়া সুলতানা রিমি
সংকট, সম্ভাবনার  সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেও শান্ত থাকা যায়, কীভাবে উত্তেজনার মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা যায়। ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, সংকটের সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই অস্থির সময়ের কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড। আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই গভীর শোকের কারণ। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যে কণ্ঠ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; তরুণদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল আশা, সাহস ও প্রতিবাদের ভাষা। সেই কণ্ঠ আজ নীরব। আর এই নীরবতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

একজন নাগরিকের প্রাণহানি কখনোই ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হতে পারে না। বিশেষত, যখন সেই নাগরিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হাদির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই হত্যার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং পরিবারটির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই দায়বদ্ধতারই একটি বার্তা দেয়। তবে ঘোষণা ও আশ্বাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে এমন হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

কিন্তু শোক ও ক্ষোভের প্রকাশ যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা নিজ উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় এবং দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মানে কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে গণতন্ত্রের শিরায় আঘাত করা। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন সহিংসতা কখনোই ন্যায্যতা পায় না।

বিশেষ করে, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করার ঘটনা আমাদের আরও সতর্ক করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। মতভিন্নতার কারণে কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সমাজকে বিভক্ত করে, যুক্তিকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে। আজ যদি আমরা যুক্তির বদলে লেবেলিংকে বেছে নিই, তবে কাল আর কেউই নিরাপদ থাকবে না।

এই অস্থিরতার পেছনে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য বড় ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন তথ্য, আবেগতাড়িত পোস্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মুহূর্তের মধ্যে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়; বরং তথ্য যাচাই করা, সংযত ভাষা ব্যবহার করা এবং উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে বিরত থাকা। এক একটি ভুয়া পোস্ট এক একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ—যা পুরো সমাজকে দগ্ধ করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনও সমান জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। পুলিশি তৎপরতা যদি একপক্ষীয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা উত্তেজনা কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেবে। তাই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সংলাপ, ব্যাখ্যা ও আস্থার রাজনীতি জরুরি।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উসকানি নয়, সংলাপ; প্রতিহিংসা নয়, সহনশীলতা—এই নীতিই হতে হবে পথনির্দেশক। দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে প্রতিটি দলের ধৈর্য ধরার পরীক্ষা চলছে। নেতারা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, কর্মীদের সংযত না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।

নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। অস্থিতিশীলতা সেই ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দেয়। শরিফ ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অক্ষুণ্ন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই শক্তিশালী করতে হবে।

বিশেষ করে তরুণসমাজের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদির কণ্ঠ যে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছিল, আজ তাদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই দর্শনই পারে দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে। আবেগের বশে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারে।

বাংলাদেশ আজ সংকট, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে শোক, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনা। কোন পথ বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সামষ্টিক প্রজ্ঞা ও সংযমের ওপর। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয় বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি আমরা এই শক্তিকে ধারণ করতে পারি, তবে হাদির রক্ত বৃথা যাবে না; বরং তা হয়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে এক কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক সংগ্রামের প্রেরণা।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত