Ajker Patrika

কোন ভুলে বিপ্লব ব্যর্থ বা বেহাত হয়, ইতিহাসের দৃষ্টান্ত

জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০: ২৫
কোন ভুলে বিপ্লব ব্যর্থ বা বেহাত হয়, ইতিহাসের দৃষ্টান্ত

মানব ইতিহাসের যুগে যুগে বিপ্লব এসেছে। পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু বলতে গেলে অধিকাংশ বিপ্লবের স্মৃতি দ্রুতই মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে, অথবা ঝাপসা বিভ্রান্তিকর ইতিহাসের পাঠ দিতে শুরু করেছে। মানুষ মনে রেখেছে শুধু সেসব বিপ্লব, যেসব শুধু সত্যিকারের পরিবর্তন এনেছে, পুরোনোকে উচ্ছেদ করে নতুনকে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে। 

অবশ্য আধুনিককালের বিপ্লবের শর্ত ও গতিপথ বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। যেমন ২০২২ সালের শেষের দিকে ইতিহাসবিদ এবং বৈদেশিক নীতির নিবন্ধকার অ্যাডাম টুজ ‘জেইজেইস্ট’ বা যুগের/কালের বৈশিষ্ট্যকে নথিবদ্ধ করেছিলেন এভাবে—বিশ্ব এখন একটি ‘পলিক্রাইসিস’ বা বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এটি এমন একটি সময় যখন ‘সংকট এবং অভিঘাতগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে একটি সূত্রে গাঁথা। এগুলোর সামগ্রিক অভিঘাত বিভিন্ন অংশের মোট যোগফলের চেয়ে বেশি।’ 

বিস্তৃতি ও ব্যাপকতার দিক থেকে আধুনিককালের চেয়ে কম গতিশীল ও জটিল হলেও ইতিহাসে কিন্তু এমন যুগ বারবার এসেছে। এর কিছু আমরা মনে রাখি; কারণ, সেই পরিস্থিতিগুলো বিরাজ করত একটি সফল বিপ্লবী পরিবর্তনের আগে। অন্য যুগগুলো সেভাবে কারও স্মরণে নেই; কারণ, সেই বিপ্লবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অর্জিত হয়নি। যদিও মানুষ বড় ধরনের অস্থিরতা ও অভিঘাতের ভেতর দিয়ে গেছেন, কিন্তু আগের ব্যবস্থাই আবার জগদ্দল হয়ে বসেছে। 

এই সময়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জি এম ট্রেভেলিয়ানের পর্যবেক্ষণগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, ইতিহাসের আমূল বাঁকবদলের শর্ত তৈরি হওয়ার পরও কেন বিপ্লব ব্যর্থ হয়। 

১৮৪৮ সালের ঘটনাকে ট্রেভেলিয়ান উল্লেখ করেছেন এমনই একটি ব্যর্থ বাঁক হিসেবে। যদিও সে বছর ইউরোপজুড়ে রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দিয়েছিল। তবে ১৭৮৯ (ফরাসি বিপ্লব) বা ১৯৪৫ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি)-এর সন্ধিক্ষণের মতো এটি তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।

তবু ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার ক্লার্কের একটা মনুমেন্টাল কাজ বলা যেতে পারে এটিকে: রেভল্যুশনারি স্প্রিং: ইউরোপ আফ্লেম অ্যান্ড দ্য ফাইট ফর আ নিউ ওয়ার্ল্ড। এই বইয়ে ১৮৪৮–৪৯ বিপ্লবের শর্ত ও গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন তিনি। এই একটি বছরের বিপ্লবের পরিণতি দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রভাব রেখেছে ইউরোপের পরবর্তী ইতিহাসে। 

এই বই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবে এবং বুঝতে সহায়তা করবে যে, কেন কিছু সংকট (অবশ্যই বহুমাত্রিক) শেষ পর্যন্ত একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, আর কিছু সংকটের মধ্যে এমন পরিবর্তনের শর্ত থাকে না। যাঁরা বিপ্লবের সুফল পেতে চান বা বিপ্লবকে বুঝতে চান, তাঁদের অবশ্যই ইতিহাসের এসব ব্যর্থ বা বেহাত বিপ্লবের প্রতিটি মুহূর্ত, ঘটনা ও ইঙ্গিতকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। 

ক্লার্কের ৮৩২ পৃষ্ঠার বইটি ধরেই ইতিহাসের বাঁকবদলের চিত্র ও বিশ্লেষণ বোঝার চেষ্টা করা যাক। কারণ, এই বইয়ে লেখক সময়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাগুলোর ওপর বিশদভাবে আলোকপাত করেছেন, যা পরবর্তী সময়ে একটি বিপ্লবকে সম্ভব করেছে। 

ধরা যাক ইউরোপের ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের কথা: এই বিপ্লবের শর্ত তৈরির ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটিই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বিপ্লবের বছরের আগের দশকগুলোতে অভূতপূর্ব শিল্পায়ন ইউরোপকে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলোর অসম বণ্টনের সমস্যা প্রকট হচ্ছিল এবং যারা এটি থেকে সামান্যতম হলেও উপকৃত হয়েছিল, তাদের আবার মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। কারিগর, শিল্পী ও দোকানদারেরা তাঁদের মর্যাদা এবং উপার্জন—দুটোরই ক্রমাবনতি দেখছিলেন। দরিদ্র এবং শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন; কারণ, নতুন শহরে বসবাসের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বাজে এবং কাজের পরিবেশ ছিল শোষণমূলক, স্বৈরাচারী। 

তখনো কৃষকেরা ইউরোপীয় সমাজের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। তারা ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েছিল: বাণিজ্যিক কৃষি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। সামন্তদের বা বড় উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাচ্ছিল সাধারণ কৃষিজমি। এই প্রবণতা কৃষির বেসরকারীকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণকেই উৎসাহিত করেছে। চাষের নতুন কৌশল বৃহৎ কৃষকদের হাতে চলে গিয়েছিল, তাদের হাতেই ছিল নতুন কৃষিপ্রযুক্তি। এই নতুন কৌশল এবং প্রযুক্তি সাধারণ কৃষকদের নাগালের বাইরে ছিল; বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সামন্তীয় বিশেষাধিকার তখনো বজায় রেখেছিলেন। 

তবে একমাত্র উপাদান হিসেবে নিম্নবিত্তের অসন্তোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিস্থিতিকে বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ক্লার্ক যেমন লিখেছেন, দারিদ্র্য ‘মানুষকে সমন্বিত কর্মে চালিত করার চেয়ে বরং “বাক্‌শক্তিহীন” এবং নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাবনা বেশি’। যদি জনদুর্ভোগ এবং বিপ্লবের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র থাকতই, তাহলে সবচেয়ে খারাপ বস্তুগত অবস্থা যেসব জায়গায় বা অঞ্চলে ছিল বা রয়েছে, সেখানে বড় বিপ্লব সংঘটিত হতো। এই যুক্তি অনুযায়ী ১৮৪৮ সালে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ দেখার দেওয়া কথা—কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। 

বিপ্লবের শর্ত সম্পর্কে ক্লার্কের যুক্তি হলো, বিপ্লব সাধারণত বিস্তৃত ব্যাপার, এটি শাসনব্যবস্থার সঙ্গে শ্রেণিনির্বিশেষে অসন্তোষ ও সংঘাতের ফলাফল। ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত এটি কেবল ঘনীভূত হতে শুরু করেছিল। যদিও ওই সময় ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই শ্রেণির আয়তন ও সম্পদ বৃদ্ধি করছিল। মধ্যবিত্তের অসন্তোষ যতটা না অর্থনৈতিক উদ্বেগ থেকে উদ্ভূত, তার চেয়ে বেশি তারা রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার এবং পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ ছিল। 

সমাজের শীর্ষ স্তরে ছিল ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা। তারা বিপুল জমির মালিক, যারা সদ্য অভিজাত হয়ে উঠেছিল, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইতিমধ্যে ক্রমবর্ধমানসংখ্যক পেশাদার, বণিক এবং হোয়াইট-কলার শ্রমিকেরা আরও সমৃদ্ধ, শিক্ষিত হয়ে উঠছিল। তথ্যপ্রবাহের সুফল তারা ভোগ করছিল, তারা অনেক কিছু জানত। কিন্তু ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলে এই গোষ্ঠীর সদস্যদের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। এমনকি মর্যাদাপূর্ণ সরকারি এবং সামাজিক অবস্থান থেকেও তারা বঞ্চিত ছিল। 

ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদও ব্যাপক অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাম্রাজ্যগুলোতে এই জাতীয়তাবাদ বিশেষভাবে বাধার মুখে পড়েছিল। কারণ, এসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত বিষয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। সেই এলাকাগুলোতে স্বায়ত্তশাসন, এমনকি স্বাধীনতার দাবি জোরদার হচ্ছিল; বিশেষ করে বর্তমান হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া (পরবর্তী সময়ে) ও বিভিন্ন স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্থিতিশীলতাকে ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। 

১৮৪০-এর দশকে, ইউরোপজুড়ে একটি ধারণা ছিল যে এখানে আর কোনো রাজনৈতিক সম্ভাবনা নেই। যেমন ক্লার্ক এক বেলজিয়ান চরমপন্থীর পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেছেন তাঁরই ভাষায়, ‘কোনো জাতি বা সরকার জানত না, তারা কোথায় যাচ্ছে।’ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট বহুমুখী সংকট স্পষ্ট হলেও বিপ্লব তখনো অনিবার্য হয়ে ওঠেনি। ক্লার্ক যেমন লিখেছেন, বিপ্লব দুটি পর্যায়ে আবির্ভূত হয়: ধীরে ধীরে এবং এরপর হঠাৎ করে। 

১৮৪৮ সালের ক্ষেত্রে, দুটি প্রধান অনুঘটক অবশেষে বিপ্লবের জন্ম দেয়। প্রথমটি ছিল: অর্থনৈতিক সংকট। ১৮৪৫ সালের শুরুতে, ইউরোপে কয়েক মৌসুম ফসল মার খায়। বিশেষভাবে ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে আলুর ফলন-বিপর্যয়ের প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। আলুর ফলন বিপর্যয়ের কারণে নেমে আসে অর্থনৈতিক মন্দা এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক। কৃষিতে এই সামগ্রিক বিপর্যয়ের কারণে কিছু জায়গায় ভয়াবহ খাদ্যঘাটতি এবং এমনকি দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল আয়ারল্যান্ডে। 

দ্বিতীয় অনুঘটকটি আঘাত হেনেছিল ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ফরাসি শ্রমিকদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা রাজা লুই ফিলিপ এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া গুইজোতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং দ্বিতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র (সেকেন্ড রিপাবলিক) গঠনের দিকে চালিত করে।

অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের তৎকালীন চ্যান্সেলর ক্লেমেন্স ভন মেটারনিক যেমন ঘটনার এক দশক আগেই বলেছিলেন, ‘ফ্রান্স যখন হাঁচি দেয়, তখন ইউরোপে সর্দি লাগে!’ 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, রেডিও বা এমনকি ব্যাপক সাক্ষরতার অভাব সত্ত্বেও, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউরোপজুড়ে ব্যাপক বিদ্রোহ শুরু হয়। যে শাসনব্যবস্থাগুলোকে সুরক্ষিত এবং চিরস্থায়ী বলে মনে হয়েছিল, একের পর এক সেগুলোর পতন ঘটে বা তারা ছাড় দিতে বাধ্য হয়। অথচ এত দিন ভাবা হতো এই ব্যবস্থা বদলাবার নয়! 

ক্লার্ক লিখেছেন, ‘গণমানুষের উত্থান মহাদেশজুড়ে ব্রাশফায়ারের মতো ছড়িয়ে পড়ে, শহর থেকে শহরে জ্বলে ওঠে।’ বার্লিন, প্রাগ, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, মিউনিখ, মিলান, ভেনিস এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শহর তখন উত্তাল। এসব শহরের চেহারা দেখেই মানুষ বুঝে ফেলেছিল বিপ্লব আসন্ন। 

বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর মানুষ অভিভূত ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কিন্তু মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে রাজতান্ত্রিক একনায়কত্ব ইউরোপের সমস্ত অঞ্চলে আবার ফিরে আসে। অথচ সব কটিকে ১৮৪৮ সালের বসন্তে বিতাড়িত করা হয়েছিল। 

১৮৪৮-এর এই বসন্ত বিপ্লবের শর্ত, বিকাশ, বিজয় এবং বিজয়-পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ইউরোপের এই বিপ্লবের ব্যর্থতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যকার দুর্বলতা। আন্দোলনকারীরা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়া যায়, সে সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না। পুরোনো ব্যবস্থার পতনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে গভীর বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে। 

মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত একটি উদারনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, কিন্তু পুরোনোটিকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করার জন্য একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা চায়নি। তারা শুধু এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিল, যেখানে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা দেবে না। তবে তারা সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পক্ষে শ্রমিকদের দাবির প্রতি সদয় ছিল না; বরং দুই প্রস্তাবই তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। কৃষকেরা রাজনৈতিক সংস্কারে কম আগ্রহী ছিল, বরং তারা সম্পত্তি রক্ষার নিশ্চয়তা চেয়েছিল। পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ অংশসহ যেখানে কৃষিই প্রধান পেশা, সেখানে সামন্তীয় বিশেষাধিকার এবং জমির মালিকানা বিলুপ্তির মাধ্যমে নিজেদের সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষিত করেছিল কৃষকেরা। 

১৮ শতকের ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি দ্বারা তাড়িত হয়ে রাজারা ১৮৪৮ সালে অধিকতর মধ্যপন্থী দাবিগুলোর প্রতি নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেন, কিছু ক্ষেত্রে দ্রুতই সেগুলো মেনে নেন। উদাহরণস্বরূপ, সংবিধান প্রণয়ন এবং অনেক সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা দূর করতে সম্মত হন রাজারা। এর ফলে উদারপন্থী এবং কৃষকেরা অনেকাংশে সন্তুষ্ট হয়। এই পরিবর্তনগুলো অবশ্য আন্দোলনের কর্মীদের (অ্যাকটিভিস্ট) এবং কট্টরপন্থীদের সন্তুষ্ট করেনি। এই গোষ্ঠীগুলো কেবল পূর্ণ গণতন্ত্রীকরণই নয়, ন্যূনতম মজুরি, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং কাজের অধিকারের মতো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারও নিশ্চিত করার দাবিতে অনড় থাকেন।

লেখক: আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

নতুন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শিক্ষকের ক্ষমতা

সম্পাদকীয়
শিক্ষকের ক্ষমতা

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?

আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

নতুন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।

যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।

আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।

যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।

এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।

সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।

সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।

যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।

সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।

শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।

মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।

তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীন­তাকেই খোঁজে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

নতুন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আলেক্সান্দ্রিয়ার শিক্ষা: ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা

আসিফ
নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর। ছবি: আজকের পত্রিকা
নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর। ছবি: আজকের পত্রিকা

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।

এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।

এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।

এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।

উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।

এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—

ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।

আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।

বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।

আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।

প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

নতুন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বুদ্ধিজীবী হত্যা: দুর্ভাগ্যজনক সব বক্তব্য

দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য।

আবু তাহের খান 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ছবি: আজকের পত্রিকা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?

একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।

অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।

পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

নতুন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত