তাপস বড়ুয়া

মহসিন সাহেব আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের দুঃখের কথা সকলকে জানিয়ে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছেন। মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে তোলপাড় চলছে। শেষমেশ বিটিআরসি কোর্টে গেছে এই ঘটনার যে ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিস্তার ঠেকাতে।
এই খবরগুলোর অনেকগুলোরই হেডলাইন ছিল—একজন চিত্রনায়কের শ্বশুর আত্মহত্যা করেছেন। যে মানুষটি মারা গেলেন নিজের হাতে, তিনি নিজেও তো একজন ব্যক্তি, আলাদা সত্তা। কার শ্বশুর, সেটা তো পরের কথা। দু-একটি পত্রিকা ছাড়া কেউই এই মানুষটিকে, যিনি একই সঙ্গে হত্যাকারী ও হত্যার শিকার, হেডলাইনে আনল না। অন্যের পরিচয়ে তাঁকে পরিচিত করানো হলো চিত্রনায়কের শ্বশুর হিসেবে।
অমনি ‘ঢি ঢি’ পড়ে গেল। চিত্রনায়ক বা তাঁর স্ত্রী এই মানুষটির নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিছু করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এসব সমালোচনাকারীর অনেকেই তাঁদের বৃদ্ধ মা-বাবাকে, অথবা একাকী মাকে বা একাকী বাবাকে শহরে নিজের কাছে না রেখে গ্রামে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে বাধ্য করছেন। ব্যতিক্রম বাদে, কারও বাবা বা মা তো কারও শ্বশুর বা শাশুড়িও। নিজের বা নিজেদের মা-বাবা শ্বশুর-শাশুড়ির একাকিত্বের সময় কাছে টেনে না নিয়ে ‘গ্রামেই ওনারা ভালো থাকেন; ঢাকায় হাঁপিয়ে ওঠেন’ ইত্যাদি বলে দায় এড়ানো লোকেরাই সমস্বরে বলতে লাগলেন—এই মৃত্যুর পেছনে চিত্রনায়ক ও তাঁর স্ত্রীর পরোক্ষ দায় আছে বুঝিবা। এটাই সমাজমানস আজকাল।
মহসিন সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যবসার খারাপ অবস্থা, শরীরের ক্যানসার, আর দীর্ঘদিন একা থাকা—সব মিলে তিনি হয়তো প্রচণ্ডভাবে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। এই তিনটির যেকোনো একটিই মানুষের বিষণ্নতাকে উসকে দিতে যথেষ্ট। সেটা বেশি মাত্রায় গেলে এবং তিনি একবারে নিরাশ হয়ে গেলে আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এমন উদাহরণ যথেষ্ট। বেশ কয়েক বছর আগে ব্যবসার ক্ষতি ও ঋণের ধাক্কা সামলাতে না পেরে কালান্দর কবীরের আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় এসেছিল। আর্থিক ক্ষতি মাথায় নিয়ে রেললাইনের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন সুমন জাহিদ। পত্রিকায় খবর হয়েছিল। তিনি কিন্তু একা ছিলেন না। পত্রিকায় খবর হয় না, কিন্তু অর্থকষ্ট বা দুরারোগ্য ব্যাধির যন্ত্রণা নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা সারা দেশে প্রচুর ঘটে।
মহসিন সাহেবও ভেবেছেন, এই জীবন যাপন করা, আর না করা একই কথা। তিনি নিজেকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের মধ্যে আলোচনায় বেশি আসছে তাঁর একাকিত্বের প্রসঙ্গটি।
শুধু কি পাশে মানুষ না থাকলে মানুষ একা হয়। এই শহরে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার দুই বোনের বছরের পর বছর স্বেচ্ছা-গৃহবন্দীত্ব এবং মৃতপ্রায় অবস্থায় একটি মানবাধিকার সংস্থার তাঁদেরকে বের করে নিয়ে আসার খবর আমরা জানি। আমাদের স্মৃতিসৌধের বরেণ্য স্থপতি মঈনুল ইসলাম জীবনের শেষ পর্যায়ে একটা ঘরেই থাকতেন। বেরোতেন না। সুতরাং, জীবনানন্দের কথায়, ‘সকল লোকের মাঝে থেকেও’ মানুষ একা হতে পারে। ‘বধূ শুয়েছিলো পাশে—শিশুটিও ছিলো;/প্রেম ছিলো, আশা ছিলো–জ্যোৎস্নায়’; তবু ভূত দেখতে পারে একজন মানুষ; একগোছা দড়ি হাতে যেতে পারে গাছতলায়। মানুষের মনের মধ্যে এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ খেলা করতেই পারে। সেটার কতটা সাইকোলজি, কতটা বায়োলজি, আর কতটা এই দুয়ের মিশ্রণে সাইকিয়াট্রি এই প্রশ্নের হয়তো কোনো সঠিক জবাব নেই। এর কতটা জেনেটিক, আর কতটা পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে জেনেটিক ব্যাপারটার সাথে পারিপার্শ্বিক অবস্থা যোগ হলে ব্যাপারটা প্রবল হয়ে ওঠে।
জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে/আরেকটি প্রভাতের ইশারায়/—অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে’। তবু কোনো কোনো মানুষ বেছে নেয় প্রস্থানের পথ। মানুষ একা হয়, সবার মধ্যে থেকেও হয়; কাছের লোকেরা কাছে না থাকলেও হয়। সকল লোকের মধ্যে থেকে যে আস্তে আস্তে গুটিয়ে যায়, তার একাকিত্বই সবচেয়ে দুর্বিষহ। কারণ, তার একাকিত্ব নিজের একান্ত গভীরে। চারপাশ বলে কিছু নেই সেই গহিনে। গভীর ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তার খুব বেশি। এসব মানুষেরা সব খারাপে নিজের দোষ খুঁজে পান। নিজেকে সবকিছুর জন্য দায়ী মনে করে শাস্তি দিতে চান। যদিও গভীর ডিপ্রেশনে থাকা, একেবারে ভেঙে পড়া মানুষদের আত্মহত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাও অবশিষ্ট থাকে না। ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার পথে সে কিছুটা ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থায়ই যখন কিছুটা মনের জোর আস্তে আস্তে অর্জন করে, আত্মহত্যার ঝুঁকি তখন বেশি বলে মনে করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট সাপোলস্কি, জীববিজ্ঞান ও মানুষের আচরণ নিয়ে যাঁর গভীর কাজ রয়েছে।
বিষণ্নতায় ভোগা মানুষ তার চারপাশের মানুষকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। তাদের জীবনকেও নিজের অজান্তে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিতে পারে, বিষিয়ে তুলতে পারে। আবার এই কাছের মানুষদেরই তার দরকার হয় ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় আঁকড়ে ধরার জন্য। হাত বাড়ালে যদি সে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু না পায়, সে সরে যেতে পারে দূর থেকে আরও দূরে।
আলবেয়ার কাম্যু বলেছেন, মানুষ প্রতি মুহূর্তে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নেয়, সে আত্মহত্যা করবে কি-না। অন্য কথায়, সে বিবেচনা করে দেখে, এই যে জীবন তার, সেটা যাপন করার কোনো মানে আছে কি-না। যদি দেখে এই জীবন যাপনের কোনো মানে আর নেই। সে আত্মহত্যা করে। না হলে সে বেঁচে থাকে। অবচেতনে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
এ তো গেল শারীরিকভাবে আত্মহত্যার কথা। কাম্যু আরেক ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেছেন—বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মহত্যা। যা তার মন সায় দেয় না, সেটাও মেনে নেওয়া। সে জানে কাজটি ঠিক নয়; তবু সে মানিয়ে নেয়; কাজটি করা চালিয়ে যায়। এমন তো সব মানুষই করে, করতে হয়। কাম্যুর মতে বুদ্ধিজীবীরা বেশি করে।
নচিকেতা গেয়েছেন, ‘প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা/আমাদের স্বপ্ন; আমাদের চেতনা/...এরপর কোনো রাতে চাকরটা অজ্ঞাতে/সামান্য টাকা নিয়ে ধরা পড়ে হাতেনাতে/সকলে সমস্বরে, একরাশ ঘৃণা ভরে/চিৎকার করে বলে, “চোর, চোর, চোর…”।’ কোন চুরিটা বড় চুরি এটা নিয়ে ভাসা-ভাসা চিন্তা; অথবা চিন্তার প্রক্রিয়াকেই এড়িয়ে যাওয়া এবং স্রোতে গা-ভাসানো বোধ হয় কাম্যুর বলা বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মহত্যাই, যা আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি।
ধরুন, আমেরিকায় একটি সামরিক ঘাঁটিতে কাজ করেন একজন মানুষ। তিনি সকালে স্যুট-টাই পরে অফিসে যান, পথে সন্তানকে স্কুলে নামিয়ে দেন। স্কুল গেটে সন্তানের কপালে চুমু খান। তার পর অফিসে গিয়ে স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে দেখে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী বোমারু বিমানের পাইলটদের পরামর্শ দেন, ঠিক কোন পয়েন্টে বোমা ফেলতে হবে। তারপর বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় স্ত্রীকে নিয়ে রোমান্টিক ডিনারে যান। রাতে দিব্যি ঘুমান। সকালে আবার একইরকম একটা দিন শুরু করেন। আমাদের শেখানো হয়েছে, এই মানুষটি স্বাভাবিক, ব্যালান্সড পার্সোনালিটির মানুষ। আর রাস্তায় যে মানুষটি অসংলগ্ন আচরণ করেন, অগোছালো কথা বলেন, কিন্তু অন্যের কোনো ক্ষতি করেন না, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, মানসিক রোগী। এই ধারণা যে বিশ্বে প্রচলিত, সেখানে যে মারাত্মক কোনো একটা সমস্যা আছে—এটা বুঝতে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস’ পড়া লাগে না।
আমরা সেই বিশ্বের, সেই সমাজের মানুষ। ভালো, আর মন্দের বিচারে আমরা খুব ওস্তাদ। ত্বরিত বিচার করে একজন কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারলেই আমরা সমস্বরে বলি, চেঁচিয়ে বলি—ওই যে, ও দোষী। এবং নিশ্চিত হই যে, দোষী লোকটা আমি নই; এটা প্রমাণ করতে পেরেছি।
আসুন তো, গত দু-তিন বছরের মধ্যে এই শহরে ঘটে যাওয়া আর অন্তত দুটো ঘটনা মনে করে নিই।
মগবাজারের খাইরুল ইসলাম আত্মহত্যা করেছিলেন। আর্থিক সংকট ছিল। মানসিক অসুস্থতা ছিল। সেগুলো তাঁকে আত্মহত্যাপ্রবণ হতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু আত্মহত্যার আগে তিনি একটি খুন করেছেন। তিনি খুন করেছেন নিজের সন্তানকে। একজন বাবা তাঁর নিজের সন্তানকে খুন করেছেন নিজেকে খুন করার আগে। যে মানুষটার ওপরে তাঁর কোনো ক্ষোভ, কোনো রাগ, কোনো অপছন্দ ছিল না; উল্টো ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকেই তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর সেই অতি আদরের ধন মানুষের অনাদর, অবহেলা, এমনকি নির্যাতনের শিকার হবে—এই অনিশ্চয়তা তাঁর মনে গভীরভাবে বাসা বেঁধেছিল।
বিষয়টি নিছক একটি হত্যা এবং তার পরে হত্যাকারীর আত্মহত্যা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এখানে হত্যার কারণ বিরাগ নয়; বরং অনুরাগ। ছেলেটি অটিস্টিক ছিল। এ রকম একজন সন্তানের বাবা-মায়ের সব সময়ের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, আমাদের মৃত্যুর পর আমার এই সন্তানের কী হবে, সে কোথায় যাবে, কে তাকে দেখে রাখবে। এমন একটি সন্তানের প্রতি মা-বাবার আবেগ, ভালো লাগা স্বাভাবিক একজন সন্তানের চেয়ে বেশি থাকে বলে ধারণা করা যায়। কারণ, মা-বাবা জানেন, এই সন্তানের সারা জীবন তাঁকে দরকার হবে গায়ে গা ঘেঁষে থাকার। এই বোধ থেকেই মা-বাবার সার্বক্ষণিক চিন্তাই থাকে, আমি যখন থাকব না, তখন আমার সন্তানটি কোথায় যাবে? সে কি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে? সে রকম ছবি কল্পনা করে নির্ঘুম রাত কাটানো বা আঁতকে ওঠা প্রতি মুহূর্তের ব্যাপার।
নিজে তিনি এমনিতেও মারা যেতে পারতেন, আর্থিক দুরবস্থাই হোক, আর মানসিক অসুস্থতাই হোক আত্মহত্যা তিনি করতে পারতেন। আত্মহত্যা কোনো গ্রহণযোগ্য বিষয় না হলেও আত্মহত্যা অনেকেই করে থাকেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু প্রিয়তম সন্তানের জীবনে যে দুঃখের অধ্যায় সৃষ্টি করবে, সেটা থেকে তাকে ‘মুক্তি’ দিয়ে নির্ভার হয়ে নিজেকে হত্যা করা বা আত্মহত্যা করার বিষয়টি আমাদের এই রাষ্ট্রকে, সমাজকে, আমাদের সবাইকে অপরাধী করে দেয়।
আমরা এমন একটি সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি, যেখানে একজন বাবা বা মা তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, যে অন্যদের সাথে কাড়াকাড়ি করে খেতে পারবে না, তাকে রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজতে পারেন।
তার এক বছর আগে টিকাটুলিতে এক বৃদ্ধ তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীকে খুন করেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। পত্রপত্রিকায় খবর এসেছিল সত্তরোর্ধ্ব ওই মানুষটি স্ত্রীকে খুন করেছিলেন এমন একটি অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ থেকে যে, তিনি মারা গেলে স্ত্রীকে কে দেখে রাখবে!
এতে মনে করার সুযোগ রয়েছে, রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে রাখবে এই আস্থা এই মানুষগুলোর ছিল না। মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে তাঁরা হত্যা এবং আত্মহত্যার মতো গুরুতর বিষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়লেও এ রকম মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তাঁদের মানসিক ভারসাম্যহীনতার সাথে এই অনিশ্চয়তার চাপের গুরুতর সংযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা থেকে অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং সময়ের সাথে সাথে জীবনের অন্যান্য চাপে সেটা বাড়তে বাড়তে একসময় চূড়ান্ত ঘটনাগুলো তাঁরা ঘটিয়েছেন।
অবশ্য এই প্রশ্ন করাই যায়, মানসিক ভারসাম্যহীন স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার আশা আদৌ কি এ দেশের মানুষ কখনো করেছে? রাষ্ট্রের কাছ থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়া যাবে এই বিশ্বাস, এই আস্থা কি কখনো এ দেশের মানুষের ছিল? স্বপ্ন থাকতে পারে, প্রত্যাশা থাকতে পারে; আস্থা গড়ে ওঠার মতো কোনো পরিবেশ কখনোই হয়তো ছিল না।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী পাবনার হাসপাতালটি পরিচিতি পেয়েছে ‘পাগলা গারদ’ হিসেবে; চিকিৎসা কেন্দ্র নয়। এতেই মানসিক রোগ ও রোগীদের প্রতি আমাদের মনোভাব বোঝা যায়।
কিন্তু সমাজের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ছিল। সেটা আমরা কয়েক দশক আগেও তো দেখেছি। সেই বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল এ ধরনের মানুষের প্রতি সমাজের মানুষের সদয় আচরণ। অবজ্ঞা ছিল অনেকের মধ্যেই; কিন্তু হিংস্রতা ছিল না। এদের নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ পাওয়ার ব্যাপারটিকে সমাজ খারাপ চোখে দেখত। শুধু গ্রামে কেন, শহরেও এ ধরনের কোনো মানুষ থাকলে তাঁকে মহল্লার সবাই চিনতেন, তাঁর প্রতি সদয় আচরণ করতেন। এ কারণে একজন এ রকম শিশুর মা বা বাবা অন্তত ভাবতে পারতেন, চারপাশের পরিচিত মানুষদের মধ্যে সে থাকবে। সম্মান না পেলেও সুরক্ষা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে। সেই পরিস্থিতি দিন দিন বদলে যাচ্ছে। খারাপের দিকে যাচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী পাবনার হাসপাতালটি পরিচিতি পেয়েছে ‘পাগলা গারদ’ হিসেবে; চিকিৎসা কেন্দ্র নয়। এতেই মানসিক রোগ ও রোগীদের প্রতি আমাদের মনোভাব বোঝা যায়। তাদের গারদে আটকে রাখাকে স্বাভাবিক বলে আমরা মনে করতে শিখেছি। সেখানকার রোগীরা সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও বছরের পর বছর পরিবার তাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বহুবার।
ঢাকার আদাবরের মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পাওয়া গেছে নির্যাতন কেন্দ্র। সাউন্ড প্রুফ রুম তৈরি করা হয়েছে, যাতে নির্যাতনের সময় ভিকটিমের চিৎকার, কান্না বাইরে থেকে শোনা না যায়। অদৃশ্য এমন এক সাউন্ডপ্রুফ ঘরে আমরা সবাই আছি, নির্যাতিত হচ্ছি জীবনের নানা প্রতিকূলতা দ্বারা। কান্নার শব্দ অন্যের কাছে পৌঁছাবার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ট্যাবু দূর করাটা বোধ হয় প্রথম এবং প্রধান কাজ এখন। মানুষ যেন মনে করে, শরীরের মতো মনও খারাপ হতে পারে। সে কথা সবাইকে জানালে, চিকিৎসা নিলে ক্ষতির কিছু নেই, লজ্জার কিছু নেই। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের হাতের নাগালে আনাটা প্রচণ্ড জরুরি।
আর দরকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগে প্রচুর সংখ্যায় বৃদ্ধাশ্রম, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র, যেখানে তাঁদের সঙ্গ দেওয়ার লোক থাকবে, যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে, চিকিৎসা সুবিধা থাকবে। তাঁদের কাছের মানুষেরা জানবেন, ‘আমি না থাকলেও সে খুব খারাপ থাকবে না।’ বেসরকারি উদ্যোগেও এগুলো হতে পারে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গেলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ কমবে। একা হয়ে যাওয়া একজন বয়স্ক মানুষ সেখানে থাকলে সমবয়সীদের সঙ্গ পাবেন; নতুন বন্ধুবান্ধব হবে; সুখ-দুঃখের গল্প করে সময় কাটবে। একেবারে একা থাকা, কথা বলার মতো কাউকে না পাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। সমাজে বৃদ্ধাশ্রম ব্যাপারটা নিয়ে যে ট্যাবু আছে, সেটা দূর করতে হবে।
আদর্শ পরিস্থিতিতে, সবাই পারিবারিক পরিবেশে যত্ন-আত্তির মধ্যে থাকবেন—এই সমাধান যে প্রায় হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে, এই কঠিন সত্যটি মেনে নিয়েই আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য পরিবর্তিত সমাধান খুঁজতে হবে।
লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ও কলাম লেখক

মহসিন সাহেব আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ফেসবুক লাইভে এসে নিজের দুঃখের কথা সকলকে জানিয়ে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছেন। মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে তোলপাড় চলছে। শেষমেশ বিটিআরসি কোর্টে গেছে এই ঘটনার যে ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিস্তার ঠেকাতে।
এই খবরগুলোর অনেকগুলোরই হেডলাইন ছিল—একজন চিত্রনায়কের শ্বশুর আত্মহত্যা করেছেন। যে মানুষটি মারা গেলেন নিজের হাতে, তিনি নিজেও তো একজন ব্যক্তি, আলাদা সত্তা। কার শ্বশুর, সেটা তো পরের কথা। দু-একটি পত্রিকা ছাড়া কেউই এই মানুষটিকে, যিনি একই সঙ্গে হত্যাকারী ও হত্যার শিকার, হেডলাইনে আনল না। অন্যের পরিচয়ে তাঁকে পরিচিত করানো হলো চিত্রনায়কের শ্বশুর হিসেবে।
অমনি ‘ঢি ঢি’ পড়ে গেল। চিত্রনায়ক বা তাঁর স্ত্রী এই মানুষটির নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিছু করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এসব সমালোচনাকারীর অনেকেই তাঁদের বৃদ্ধ মা-বাবাকে, অথবা একাকী মাকে বা একাকী বাবাকে শহরে নিজের কাছে না রেখে গ্রামে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে বাধ্য করছেন। ব্যতিক্রম বাদে, কারও বাবা বা মা তো কারও শ্বশুর বা শাশুড়িও। নিজের বা নিজেদের মা-বাবা শ্বশুর-শাশুড়ির একাকিত্বের সময় কাছে টেনে না নিয়ে ‘গ্রামেই ওনারা ভালো থাকেন; ঢাকায় হাঁপিয়ে ওঠেন’ ইত্যাদি বলে দায় এড়ানো লোকেরাই সমস্বরে বলতে লাগলেন—এই মৃত্যুর পেছনে চিত্রনায়ক ও তাঁর স্ত্রীর পরোক্ষ দায় আছে বুঝিবা। এটাই সমাজমানস আজকাল।
মহসিন সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যবসার খারাপ অবস্থা, শরীরের ক্যানসার, আর দীর্ঘদিন একা থাকা—সব মিলে তিনি হয়তো প্রচণ্ডভাবে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। এই তিনটির যেকোনো একটিই মানুষের বিষণ্নতাকে উসকে দিতে যথেষ্ট। সেটা বেশি মাত্রায় গেলে এবং তিনি একবারে নিরাশ হয়ে গেলে আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এমন উদাহরণ যথেষ্ট। বেশ কয়েক বছর আগে ব্যবসার ক্ষতি ও ঋণের ধাক্কা সামলাতে না পেরে কালান্দর কবীরের আত্মহত্যার খবর পত্রিকায় এসেছিল। আর্থিক ক্ষতি মাথায় নিয়ে রেললাইনের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন সুমন জাহিদ। পত্রিকায় খবর হয়েছিল। তিনি কিন্তু একা ছিলেন না। পত্রিকায় খবর হয় না, কিন্তু অর্থকষ্ট বা দুরারোগ্য ব্যাধির যন্ত্রণা নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা সারা দেশে প্রচুর ঘটে।
মহসিন সাহেবও ভেবেছেন, এই জীবন যাপন করা, আর না করা একই কথা। তিনি নিজেকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের মধ্যে আলোচনায় বেশি আসছে তাঁর একাকিত্বের প্রসঙ্গটি।
শুধু কি পাশে মানুষ না থাকলে মানুষ একা হয়। এই শহরে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার দুই বোনের বছরের পর বছর স্বেচ্ছা-গৃহবন্দীত্ব এবং মৃতপ্রায় অবস্থায় একটি মানবাধিকার সংস্থার তাঁদেরকে বের করে নিয়ে আসার খবর আমরা জানি। আমাদের স্মৃতিসৌধের বরেণ্য স্থপতি মঈনুল ইসলাম জীবনের শেষ পর্যায়ে একটা ঘরেই থাকতেন। বেরোতেন না। সুতরাং, জীবনানন্দের কথায়, ‘সকল লোকের মাঝে থেকেও’ মানুষ একা হতে পারে। ‘বধূ শুয়েছিলো পাশে—শিশুটিও ছিলো;/প্রেম ছিলো, আশা ছিলো–জ্যোৎস্নায়’; তবু ভূত দেখতে পারে একজন মানুষ; একগোছা দড়ি হাতে যেতে পারে গাছতলায়। মানুষের মনের মধ্যে এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ খেলা করতেই পারে। সেটার কতটা সাইকোলজি, কতটা বায়োলজি, আর কতটা এই দুয়ের মিশ্রণে সাইকিয়াট্রি এই প্রশ্নের হয়তো কোনো সঠিক জবাব নেই। এর কতটা জেনেটিক, আর কতটা পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে জেনেটিক ব্যাপারটার সাথে পারিপার্শ্বিক অবস্থা যোগ হলে ব্যাপারটা প্রবল হয়ে ওঠে।
জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে/আরেকটি প্রভাতের ইশারায়/—অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে’। তবু কোনো কোনো মানুষ বেছে নেয় প্রস্থানের পথ। মানুষ একা হয়, সবার মধ্যে থেকেও হয়; কাছের লোকেরা কাছে না থাকলেও হয়। সকল লোকের মধ্যে থেকে যে আস্তে আস্তে গুটিয়ে যায়, তার একাকিত্বই সবচেয়ে দুর্বিষহ। কারণ, তার একাকিত্ব নিজের একান্ত গভীরে। চারপাশ বলে কিছু নেই সেই গহিনে। গভীর ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তার খুব বেশি। এসব মানুষেরা সব খারাপে নিজের দোষ খুঁজে পান। নিজেকে সবকিছুর জন্য দায়ী মনে করে শাস্তি দিতে চান। যদিও গভীর ডিপ্রেশনে থাকা, একেবারে ভেঙে পড়া মানুষদের আত্মহত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাও অবশিষ্ট থাকে না। ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার পথে সে কিছুটা ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থায়ই যখন কিছুটা মনের জোর আস্তে আস্তে অর্জন করে, আত্মহত্যার ঝুঁকি তখন বেশি বলে মনে করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট সাপোলস্কি, জীববিজ্ঞান ও মানুষের আচরণ নিয়ে যাঁর গভীর কাজ রয়েছে।
বিষণ্নতায় ভোগা মানুষ তার চারপাশের মানুষকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। তাদের জীবনকেও নিজের অজান্তে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিতে পারে, বিষিয়ে তুলতে পারে। আবার এই কাছের মানুষদেরই তার দরকার হয় ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় আঁকড়ে ধরার জন্য। হাত বাড়ালে যদি সে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু না পায়, সে সরে যেতে পারে দূর থেকে আরও দূরে।
আলবেয়ার কাম্যু বলেছেন, মানুষ প্রতি মুহূর্তে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নেয়, সে আত্মহত্যা করবে কি-না। অন্য কথায়, সে বিবেচনা করে দেখে, এই যে জীবন তার, সেটা যাপন করার কোনো মানে আছে কি-না। যদি দেখে এই জীবন যাপনের কোনো মানে আর নেই। সে আত্মহত্যা করে। না হলে সে বেঁচে থাকে। অবচেতনে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
এ তো গেল শারীরিকভাবে আত্মহত্যার কথা। কাম্যু আরেক ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেছেন—বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মহত্যা। যা তার মন সায় দেয় না, সেটাও মেনে নেওয়া। সে জানে কাজটি ঠিক নয়; তবু সে মানিয়ে নেয়; কাজটি করা চালিয়ে যায়। এমন তো সব মানুষই করে, করতে হয়। কাম্যুর মতে বুদ্ধিজীবীরা বেশি করে।
নচিকেতা গেয়েছেন, ‘প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা/আমাদের স্বপ্ন; আমাদের চেতনা/...এরপর কোনো রাতে চাকরটা অজ্ঞাতে/সামান্য টাকা নিয়ে ধরা পড়ে হাতেনাতে/সকলে সমস্বরে, একরাশ ঘৃণা ভরে/চিৎকার করে বলে, “চোর, চোর, চোর…”।’ কোন চুরিটা বড় চুরি এটা নিয়ে ভাসা-ভাসা চিন্তা; অথবা চিন্তার প্রক্রিয়াকেই এড়িয়ে যাওয়া এবং স্রোতে গা-ভাসানো বোধ হয় কাম্যুর বলা বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মহত্যাই, যা আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি।
ধরুন, আমেরিকায় একটি সামরিক ঘাঁটিতে কাজ করেন একজন মানুষ। তিনি সকালে স্যুট-টাই পরে অফিসে যান, পথে সন্তানকে স্কুলে নামিয়ে দেন। স্কুল গেটে সন্তানের কপালে চুমু খান। তার পর অফিসে গিয়ে স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে দেখে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী বোমারু বিমানের পাইলটদের পরামর্শ দেন, ঠিক কোন পয়েন্টে বোমা ফেলতে হবে। তারপর বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় স্ত্রীকে নিয়ে রোমান্টিক ডিনারে যান। রাতে দিব্যি ঘুমান। সকালে আবার একইরকম একটা দিন শুরু করেন। আমাদের শেখানো হয়েছে, এই মানুষটি স্বাভাবিক, ব্যালান্সড পার্সোনালিটির মানুষ। আর রাস্তায় যে মানুষটি অসংলগ্ন আচরণ করেন, অগোছালো কথা বলেন, কিন্তু অন্যের কোনো ক্ষতি করেন না, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ, মানসিক রোগী। এই ধারণা যে বিশ্বে প্রচলিত, সেখানে যে মারাত্মক কোনো একটা সমস্যা আছে—এটা বুঝতে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস’ পড়া লাগে না।
আমরা সেই বিশ্বের, সেই সমাজের মানুষ। ভালো, আর মন্দের বিচারে আমরা খুব ওস্তাদ। ত্বরিত বিচার করে একজন কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারলেই আমরা সমস্বরে বলি, চেঁচিয়ে বলি—ওই যে, ও দোষী। এবং নিশ্চিত হই যে, দোষী লোকটা আমি নই; এটা প্রমাণ করতে পেরেছি।
আসুন তো, গত দু-তিন বছরের মধ্যে এই শহরে ঘটে যাওয়া আর অন্তত দুটো ঘটনা মনে করে নিই।
মগবাজারের খাইরুল ইসলাম আত্মহত্যা করেছিলেন। আর্থিক সংকট ছিল। মানসিক অসুস্থতা ছিল। সেগুলো তাঁকে আত্মহত্যাপ্রবণ হতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু আত্মহত্যার আগে তিনি একটি খুন করেছেন। তিনি খুন করেছেন নিজের সন্তানকে। একজন বাবা তাঁর নিজের সন্তানকে খুন করেছেন নিজেকে খুন করার আগে। যে মানুষটার ওপরে তাঁর কোনো ক্ষোভ, কোনো রাগ, কোনো অপছন্দ ছিল না; উল্টো ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভালোবাসা থেকেই তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর সেই অতি আদরের ধন মানুষের অনাদর, অবহেলা, এমনকি নির্যাতনের শিকার হবে—এই অনিশ্চয়তা তাঁর মনে গভীরভাবে বাসা বেঁধেছিল।
বিষয়টি নিছক একটি হত্যা এবং তার পরে হত্যাকারীর আত্মহত্যা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এখানে হত্যার কারণ বিরাগ নয়; বরং অনুরাগ। ছেলেটি অটিস্টিক ছিল। এ রকম একজন সন্তানের বাবা-মায়ের সব সময়ের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, আমাদের মৃত্যুর পর আমার এই সন্তানের কী হবে, সে কোথায় যাবে, কে তাকে দেখে রাখবে। এমন একটি সন্তানের প্রতি মা-বাবার আবেগ, ভালো লাগা স্বাভাবিক একজন সন্তানের চেয়ে বেশি থাকে বলে ধারণা করা যায়। কারণ, মা-বাবা জানেন, এই সন্তানের সারা জীবন তাঁকে দরকার হবে গায়ে গা ঘেঁষে থাকার। এই বোধ থেকেই মা-বাবার সার্বক্ষণিক চিন্তাই থাকে, আমি যখন থাকব না, তখন আমার সন্তানটি কোথায় যাবে? সে কি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে? সে রকম ছবি কল্পনা করে নির্ঘুম রাত কাটানো বা আঁতকে ওঠা প্রতি মুহূর্তের ব্যাপার।
নিজে তিনি এমনিতেও মারা যেতে পারতেন, আর্থিক দুরবস্থাই হোক, আর মানসিক অসুস্থতাই হোক আত্মহত্যা তিনি করতে পারতেন। আত্মহত্যা কোনো গ্রহণযোগ্য বিষয় না হলেও আত্মহত্যা অনেকেই করে থাকেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু প্রিয়তম সন্তানের জীবনে যে দুঃখের অধ্যায় সৃষ্টি করবে, সেটা থেকে তাকে ‘মুক্তি’ দিয়ে নির্ভার হয়ে নিজেকে হত্যা করা বা আত্মহত্যা করার বিষয়টি আমাদের এই রাষ্ট্রকে, সমাজকে, আমাদের সবাইকে অপরাধী করে দেয়।
আমরা এমন একটি সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি করতে পারিনি, যেখানে একজন বাবা বা মা তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, যে অন্যদের সাথে কাড়াকাড়ি করে খেতে পারবে না, তাকে রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজতে পারেন।
তার এক বছর আগে টিকাটুলিতে এক বৃদ্ধ তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীকে খুন করেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। পত্রপত্রিকায় খবর এসেছিল সত্তরোর্ধ্ব ওই মানুষটি স্ত্রীকে খুন করেছিলেন এমন একটি অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ থেকে যে, তিনি মারা গেলে স্ত্রীকে কে দেখে রাখবে!
এতে মনে করার সুযোগ রয়েছে, রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে রাখবে এই আস্থা এই মানুষগুলোর ছিল না। মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে তাঁরা হত্যা এবং আত্মহত্যার মতো গুরুতর বিষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়লেও এ রকম মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তাঁদের মানসিক ভারসাম্যহীনতার সাথে এই অনিশ্চয়তার চাপের গুরুতর সংযোগ রয়েছে। অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা থেকে অতিরিক্ত উদ্বেগ এবং সময়ের সাথে সাথে জীবনের অন্যান্য চাপে সেটা বাড়তে বাড়তে একসময় চূড়ান্ত ঘটনাগুলো তাঁরা ঘটিয়েছেন।
অবশ্য এই প্রশ্ন করাই যায়, মানসিক ভারসাম্যহীন স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার আশা আদৌ কি এ দেশের মানুষ কখনো করেছে? রাষ্ট্রের কাছ থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়া যাবে এই বিশ্বাস, এই আস্থা কি কখনো এ দেশের মানুষের ছিল? স্বপ্ন থাকতে পারে, প্রত্যাশা থাকতে পারে; আস্থা গড়ে ওঠার মতো কোনো পরিবেশ কখনোই হয়তো ছিল না।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী পাবনার হাসপাতালটি পরিচিতি পেয়েছে ‘পাগলা গারদ’ হিসেবে; চিকিৎসা কেন্দ্র নয়। এতেই মানসিক রোগ ও রোগীদের প্রতি আমাদের মনোভাব বোঝা যায়।
কিন্তু সমাজের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ছিল। সেটা আমরা কয়েক দশক আগেও তো দেখেছি। সেই বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল এ ধরনের মানুষের প্রতি সমাজের মানুষের সদয় আচরণ। অবজ্ঞা ছিল অনেকের মধ্যেই; কিন্তু হিংস্রতা ছিল না। এদের নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ পাওয়ার ব্যাপারটিকে সমাজ খারাপ চোখে দেখত। শুধু গ্রামে কেন, শহরেও এ ধরনের কোনো মানুষ থাকলে তাঁকে মহল্লার সবাই চিনতেন, তাঁর প্রতি সদয় আচরণ করতেন। এ কারণে একজন এ রকম শিশুর মা বা বাবা অন্তত ভাবতে পারতেন, চারপাশের পরিচিত মানুষদের মধ্যে সে থাকবে। সম্মান না পেলেও সুরক্ষা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে। সেই পরিস্থিতি দিন দিন বদলে যাচ্ছে। খারাপের দিকে যাচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী পাবনার হাসপাতালটি পরিচিতি পেয়েছে ‘পাগলা গারদ’ হিসেবে; চিকিৎসা কেন্দ্র নয়। এতেই মানসিক রোগ ও রোগীদের প্রতি আমাদের মনোভাব বোঝা যায়। তাদের গারদে আটকে রাখাকে স্বাভাবিক বলে আমরা মনে করতে শিখেছি। সেখানকার রোগীরা সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও বছরের পর বছর পরিবার তাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বহুবার।
ঢাকার আদাবরের মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পাওয়া গেছে নির্যাতন কেন্দ্র। সাউন্ড প্রুফ রুম তৈরি করা হয়েছে, যাতে নির্যাতনের সময় ভিকটিমের চিৎকার, কান্না বাইরে থেকে শোনা না যায়। অদৃশ্য এমন এক সাউন্ডপ্রুফ ঘরে আমরা সবাই আছি, নির্যাতিত হচ্ছি জীবনের নানা প্রতিকূলতা দ্বারা। কান্নার শব্দ অন্যের কাছে পৌঁছাবার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ট্যাবু দূর করাটা বোধ হয় প্রথম এবং প্রধান কাজ এখন। মানুষ যেন মনে করে, শরীরের মতো মনও খারাপ হতে পারে। সে কথা সবাইকে জানালে, চিকিৎসা নিলে ক্ষতির কিছু নেই, লজ্জার কিছু নেই। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা মানুষের হাতের নাগালে আনাটা প্রচণ্ড জরুরি।
আর দরকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগে প্রচুর সংখ্যায় বৃদ্ধাশ্রম, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র, যেখানে তাঁদের সঙ্গ দেওয়ার লোক থাকবে, যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে, চিকিৎসা সুবিধা থাকবে। তাঁদের কাছের মানুষেরা জানবেন, ‘আমি না থাকলেও সে খুব খারাপ থাকবে না।’ বেসরকারি উদ্যোগেও এগুলো হতে পারে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গেলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ কমবে। একা হয়ে যাওয়া একজন বয়স্ক মানুষ সেখানে থাকলে সমবয়সীদের সঙ্গ পাবেন; নতুন বন্ধুবান্ধব হবে; সুখ-দুঃখের গল্প করে সময় কাটবে। একেবারে একা থাকা, কথা বলার মতো কাউকে না পাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। সমাজে বৃদ্ধাশ্রম ব্যাপারটা নিয়ে যে ট্যাবু আছে, সেটা দূর করতে হবে।
আদর্শ পরিস্থিতিতে, সবাই পারিবারিক পরিবেশে যত্ন-আত্তির মধ্যে থাকবেন—এই সমাধান যে প্রায় হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে, এই কঠিন সত্যটি মেনে নিয়েই আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য পরিবর্তিত সমাধান খুঁজতে হবে।
লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ও কলাম লেখক

ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
৭ ঘণ্টা আগে
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব দীর্ঘদিনের। সেই অর্থে বাংলাদেশ রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত অংশীদার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এখন আমরা জানার চেষ্টা করব স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কী। বস্তুত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত অংশীদার হলো...
৭ ঘণ্টা আগে
নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
৮ ঘণ্টা আগে
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা।
১ দিন আগে
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু এবং রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল?
আশঙ্কা বাস্তবতাবিবর্জিত ছিল না। প্রাথমিকভাবে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পৌঁছামাত্রই সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া তা-ই প্রমাণ করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংঘটিত পূর্ববর্তী (অ)রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টার ধারাবাহিকতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম অস্থিরতা মোকাবিলায় ব্যর্থতাই হাদির ওপর গুলিবর্ষণে সাহস জুগিয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলকে। তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনী
আবহ শুরু হওয়ামাত্রই প্রকাশ্যে এই আলোচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থীর ওপর গুলি এবং হামলাকারীদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্য অশনিসংকেত। এই ঘটনা জনমনে ভয় সৃষ্টি করবে, যা রাজনৈতিক সহিংসতা, চোরাগোপ্তা হামলা, মব ভায়োলেন্সের মাত্রাসহ হত্যাচেষ্টার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে, যদি দ্রুত ও অর্থবহ তদন্ত না হয় এবং অভিযুক্ত সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে তা ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিযোগকেও আরও দৃঢ় করবে।
নির্বাচনের আগে এ ধরনের সহিংস ঘটনা কি নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে? আপনি কী বলবেন?
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকাই অন্যতম প্রধান সম্ভাব্য কারণ। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ব্যাপারে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ ইত্যাদি যোগ করা; কারও পক্ষ থেকে প্রতিরোধ কিংবা বর্জনের হুমকি এই আশঙ্কাকে ভিত্তি দিচ্ছে। তবে বিস্তর বিশ্লেষণের স্বার্থে এই হত্যা অন্যান্য সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ও কারণ কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ঘটনার সময়কাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিনই হাদির ওপর হামলা হওয়ার ক্ষেত্রে, ঘটনার পরপরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাঁর পদত্যাগ দাবি, ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর পরিস্থিতি, ‘বিচার না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ এমন হুমকি, মৃত্যুসংবাদের পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া এবং নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরকে শারীরিক লাঞ্ছনা—সব মিলিয়ে নির্বাচন বানচালের শঙ্কা থেকে যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের পারস্পরিক চূড়ান্ত দোষারোপের পেছনের রাজনীতি, অভিযুক্ত গুলিবর্ষণকারীর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি হুমকি, এমনকি কার সঙ্গে কখন, কোথায় অভিযুক্ত হত্যাকারী সময় কাটিয়েছে, তার ছবি বিশ্লেষণ—এসবই ইঙ্গিত করে নির্বাচনকে লক্ষ্যবস্তু করে একটি ‘নির্বাচনভীতি’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের ঘটনার বিচার না হওয়া অথবা লাশকে সুবিধা আদায়ের রাজনীতিতে পরিণত করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তদলীয় সহিংসতা বৃদ্ধি করে তৃতীয় পক্ষ সার্বিক পরিস্থিতিকে সাংঘর্ষিক করে তুলতে পারে, যা নির্বাচন ব্যাহত করার রাজনীতিই বটে।
আগামী নির্বাচনে এই রাজনৈতিক সহিংসতা কী প্রভাব ফেলতে পারে?
নির্বাচন নানাভাবে প্রভাবিত করা হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলো দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সহিংস চক্রের সঙ্গে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এসবই সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে। অন্তত তিনটি সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়নের দাবি রাখে—৫ আগস্ট ২০২৪-এ লুণ্ঠন হওয়া অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি, ভোটযাত্রায় ভয় ও নিষ্ক্রিয়তা এবং উসকানিমূলক বক্তব্য ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির মেরুকরণ বৃদ্ধি। ভয় ও অনিশ্চয়তার কারণে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমতে পারে। আবার, সরকারের দায়সারা মনোভাব এই হামলাকে ভিকটিমহুড (সিম্বলিক মার্টায়ারডম) বা শক্তি প্রদর্শনের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে কোনো কোনো পক্ষ। অন্যদিকে, রাষ্ট্র
যদি লোকদেখানো মাত্রাতিরিক্ত কঠোর নিরাপত্তা আরোপ করে, নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের সক্ষমতা ও পেশাদারত্বের ওপর।
এই হামলার পর ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে যে ধরনের আলটিমেটাম কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দুইভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। একদিকে আবেগ তথা বৈধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যা স্বাভাবিক। অন্যদিকে, অদূরদর্শী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। বিশেষত, শহুরে রাজনীতিতে আন্দোলন ও আলটিমেটাম একটি পরিচিত রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এগুলো যখন মুহূর্তের উত্তেজনায় জ্বালাও-পোড়াও রূপে রূপান্তর হয় বা সহিংস চরিত্র ধারণ করে, তখন মূল ইস্যু চাপা পড়ে, সাধারণ জনগণ বিরক্ত হয়, আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। শান্তিপূর্ণ ও আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে দাবি উত্থাপনই দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হয়, যা স্থায়িত্ব দেয়। তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায়, সহিংস ঘটনার জবাব সহিংসতা, ঘৃণা কিংবা মব ভায়োলেন্স নয়, বরং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সহিষ্ণু, সৃজনশীল এবং জনমুখী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ফলপ্রসূ হয়।
এই ঘটনায় চিহ্নিত অপরাধী কীভাবে দেশ ছাড়তে পারল? এখানে কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল?
আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়, সীমান্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি এবং দ্রুত গ্রেপ্তার বাস্তবায়নে গুরুতর গ্যাপ ছিল। সন্দেহভাজনেরা মোটরসাইকেলে ভুয়া নম্বরপ্লেট ব্যবহার, মোবাইল সিম ও ফোন ফেলে দেওয়া, একাধিক যানবাহন বদল করে সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা, যা পূর্বপরিকল্পিত সমন্বয়ভিত্তিক আঁতাতনির্ভর পলায়নের ইঙ্গিত। সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা, আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ প্রতিরোধ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা নিয়োজিত রয়েছে, তাদের সহায়তা থাকতে পারে। কোনো একক সংস্থার ব্যর্থতা নয় এটি।
হাদির মৃত্যুসংবাদের পর যেসব সহিংস ঘটনা ঘটল, সেগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অবস্থাদৃষ্টে, কেবল ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার চরম শৈথিল্য ও প্রতিশোধপরায়ণ সুসংগঠিত উসকানির সম্মিলিত ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী সহিংসতার খবরগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ‘লড়াকু যোদ্ধা’ হিসেবে অনেকের কাছে ওসমান হাদির যে পরিচিতি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশে ম্লান করেছে বলেই অনুমান।
দেশের যে দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা অফিস পোড়ানো হয়েছে, সেখানে জুলাইয়ের অনেক স্মৃতি-স্মারকও ছিল। ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়েছে ২৮ জন পেশাজীবীকে। অথচ এই দুটি পত্রিকা পতিত সরকারের সময় গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিষিদ্ধ ছিল। ছায়ানটের ওপর কিসের রাগ? সাংস্কৃতিক দর্শনের সঙ্গে মতবিরোধ নতুন কিছু নয়। মানুষকে আকৃষ্ট করবে এমন পাল্টা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেষ্টা
না করে, এ রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে কারা উৎসাহ দিচ্ছে?
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ আরও স্পষ্ট করে ঘটনার পেছনের অশুভ শক্তির সংযোগ।
ওসমান হাদির নিজের বক্তব্য এবং অবস্থানের সঙ্গেও এই জঘন্য সহিংস ঘটনাগুলো সাংঘর্ষিক। কেননা, এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যও ছিল স্পষ্ট: ‘পারলে আরও দশটা প্রথম আলো তৈরি করে দেখান। প্রথম আলো অফিসের সামনে আপনার কাজ কী?’ সবকিছু বিবেচনায়, এই সহিংসতা তরুণদের নিজস্ব বিবেচনায় সংঘটিত হয়েছে—এমনটা মনে হওয়ার কারণ সীমিত। ‘বিশেষ’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রতিশোধমূলক রাজনীতি তরুণদের আবেগকে পুঁজি করছে বলেই অনুমান (ইনস্ট্রুমেন্টালাইজেশন অব ইয়ুথ)। বিনা উসকানিতে দুঃশাসন পতনোত্তর (রেজিম ফল) বাস্তবতায় এ রকম সংঘবদ্ধ সহিংসতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং সর্বোপরি শান্তি বিনির্মাণের পথে প্রধান অন্তরায়। বিশ্ব পরিমণ্ডলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যার দায় সরকারের ওপর চাপবে।
সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
এই বিষয়ে মোটাদাগে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আইনের শাসন তথা কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অপরাধের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি সমাজকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীবিশেষে আইনের কঠোরতা, নমনীয়তা এমনকি বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিপন্থী। দ্রুত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের পাশাপাশি প্রতিটি তদন্তের অগ্রগতি ও চূড়ান্ত ফল জনসমক্ষে নিয়মিত প্রকাশ জরুরি। সীমান্ত নজরদারি
এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্রুত তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ। দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। সঙ্গে বিদ্যমান ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, যার ওপর টেকসই স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। ভিন্নমতের কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারও সহিংস মৃত্যুর ঘটনায় আজকাল উল্লাস—এসবই সুস্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বিলুপ্তির পূর্বাভাস।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য ও সুশিক্ষার অভাব। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক বিভাজনগুলো এখন শত্রু-মিত্রের বাইনারিতে পরিণত হয়েছে। ফলে সামষ্টিক জাতীয় স্বার্থ কিংবা জাতীয়তাবোধ তৈরি হচ্ছে না। রাজনীতিতে ধর্মের যাচ্ছেতাই ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগতকরণের বিপরীতে বিতর্কিতকরণের হীন প্রয়াস, যাকে-তাকে যখন-তখন ভারত-পাকিস্তানপন্থী ট্যাগিং—এসবই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভয়ানক ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য নির্বাচনী আচরণবিধি বা দেশের বিদ্যমান আইনবিধির আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং প্রথম পরামর্শ অনুযায়ী অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম ও ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান—এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ পরিসরের জাতীয় রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও রাখা যেতে পারে এই কমিশনে, যাতে কমিশন মান বজায় রেখে নিরপেক্ষ এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।
অধিকন্তু, সীমিত সম্পদের বিপরীতে দেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে, যার বড় একটি অংশের কাছে রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে উঠেছে বিনা বেতনে তাদের ‘নিয়োগকারী কর্ম সংস্থা’। বিনা বেতনে তথাকথিত এই ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ’ দিয়ে তাদের অনেককে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত করছেন দলের এলিট নেতারা। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই মূলত এদের বেশির ভাগ জড়াচ্ছে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে, নিয়োজিত হচ্ছে বিরোধীমত নিয়ন্ত্রণের
মতো অপরাধমূলক কাজে। ফলে রাজনৈতিক সচেতনতা বাদ দিয়ে রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠছে সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। তৈরি হচ্ছে অপরাধের এক ভিশাস সাইকেল (পরিবর্তনের নেতিবাচক চক্র)। ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে এবং স্থিতিশীলতা পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে।
অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল?
আশঙ্কা বাস্তবতাবিবর্জিত ছিল না। প্রাথমিকভাবে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পৌঁছামাত্রই সহিংসতা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া তা-ই প্রমাণ করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংঘটিত পূর্ববর্তী (অ)রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টার ধারাবাহিকতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক চরম অস্থিরতা মোকাবিলায় ব্যর্থতাই হাদির ওপর গুলিবর্ষণে সাহস জুগিয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলকে। তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচনী
আবহ শুরু হওয়ামাত্রই প্রকাশ্যে এই আলোচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থীর ওপর গুলি এবং হামলাকারীদের নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্য অশনিসংকেত। এই ঘটনা জনমনে ভয় সৃষ্টি করবে, যা রাজনৈতিক সহিংসতা, চোরাগোপ্তা হামলা, মব ভায়োলেন্সের মাত্রাসহ হত্যাচেষ্টার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশেষ করে, যদি দ্রুত ও অর্থবহ তদন্ত না হয় এবং অভিযুক্ত সন্ত্রাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তাহলে তা ব্যর্থ রাষ্ট্রের অভিযোগকেও আরও দৃঢ় করবে।
নির্বাচনের আগে এ ধরনের সহিংস ঘটনা কি নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে? আপনি কী বলবেন?
নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকাই অন্যতম প্রধান সম্ভাব্য কারণ। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ব্যাপারে ‘যদি, কিন্তু, তবে’ ইত্যাদি যোগ করা; কারও পক্ষ থেকে প্রতিরোধ কিংবা বর্জনের হুমকি এই আশঙ্কাকে ভিত্তি দিচ্ছে। তবে বিস্তর বিশ্লেষণের স্বার্থে এই হত্যা অন্যান্য সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ও কারণ কর্তৃপক্ষের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ঘটনার সময়কাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিনই হাদির ওপর হামলা হওয়ার ক্ষেত্রে, ঘটনার পরপরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাঁর পদত্যাগ দাবি, ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর পরিস্থিতি, ‘বিচার না হলে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ এমন হুমকি, মৃত্যুসংবাদের পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া এবং নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরকে শারীরিক লাঞ্ছনা—সব মিলিয়ে নির্বাচন বানচালের শঙ্কা থেকে যায়।
গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের পারস্পরিক চূড়ান্ত দোষারোপের পেছনের রাজনীতি, অভিযুক্ত গুলিবর্ষণকারীর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি হুমকি, এমনকি কার সঙ্গে কখন, কোথায় অভিযুক্ত হত্যাকারী সময় কাটিয়েছে, তার ছবি বিশ্লেষণ—এসবই ইঙ্গিত করে নির্বাচনকে লক্ষ্যবস্তু করে একটি ‘নির্বাচনভীতি’ তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের ঘটনার বিচার না হওয়া অথবা লাশকে সুবিধা আদায়ের রাজনীতিতে পরিণত করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তদলীয় সহিংসতা বৃদ্ধি করে তৃতীয় পক্ষ সার্বিক পরিস্থিতিকে সাংঘর্ষিক করে তুলতে পারে, যা নির্বাচন ব্যাহত করার রাজনীতিই বটে।
আগামী নির্বাচনে এই রাজনৈতিক সহিংসতা কী প্রভাব ফেলতে পারে?
নির্বাচন নানাভাবে প্রভাবিত করা হতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও ক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলো দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সহিংস চক্রের সঙ্গে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এসবই সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে। অন্তত তিনটি সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়নের দাবি রাখে—৫ আগস্ট ২০২৪-এ লুণ্ঠন হওয়া অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি, ভোটযাত্রায় ভয় ও নিষ্ক্রিয়তা এবং উসকানিমূলক বক্তব্য ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির মেরুকরণ বৃদ্ধি। ভয় ও অনিশ্চয়তার কারণে ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমতে পারে। আবার, সরকারের দায়সারা মনোভাব এই হামলাকে ভিকটিমহুড (সিম্বলিক মার্টায়ারডম) বা শক্তি প্রদর্শনের উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার করতে পারে কোনো কোনো পক্ষ। অন্যদিকে, রাষ্ট্র
যদি লোকদেখানো মাত্রাতিরিক্ত কঠোর নিরাপত্তা আরোপ করে, নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের সক্ষমতা ও পেশাদারত্বের ওপর।
এই হামলার পর ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে যে ধরনের আলটিমেটাম কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দুইভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। একদিকে আবেগ তথা বৈধ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যা স্বাভাবিক। অন্যদিকে, অদূরদর্শী ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। বিশেষত, শহুরে রাজনীতিতে আন্দোলন ও আলটিমেটাম একটি পরিচিত রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু এগুলো যখন মুহূর্তের উত্তেজনায় জ্বালাও-পোড়াও রূপে রূপান্তর হয় বা সহিংস চরিত্র ধারণ করে, তখন মূল ইস্যু চাপা পড়ে, সাধারণ জনগণ বিরক্ত হয়, আপাতদৃষ্টে তা-ই মনে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক মূল্যবোধ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। শান্তিপূর্ণ ও আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে দাবি উত্থাপনই দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হয়, যা স্থায়িত্ব দেয়। তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায়, সহিংস ঘটনার জবাব সহিংসতা, ঘৃণা কিংবা মব ভায়োলেন্স নয়, বরং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সহিষ্ণু, সৃজনশীল এবং জনমুখী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে মোকাবিলা দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ফলপ্রসূ হয়।
এই ঘটনায় চিহ্নিত অপরাধী কীভাবে দেশ ছাড়তে পারল? এখানে কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল?
আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়, সীমান্ত ও গোয়েন্দা নজরদারি এবং দ্রুত গ্রেপ্তার বাস্তবায়নে গুরুতর গ্যাপ ছিল। সন্দেহভাজনেরা মোটরসাইকেলে ভুয়া নম্বরপ্লেট ব্যবহার, মোবাইল সিম ও ফোন ফেলে দেওয়া, একাধিক যানবাহন বদল করে সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা, যা পূর্বপরিকল্পিত সমন্বয়ভিত্তিক আঁতাতনির্ভর পলায়নের ইঙ্গিত। সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা, আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ প্রতিরোধ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যারা নিয়োজিত রয়েছে, তাদের সহায়তা থাকতে পারে। কোনো একক সংস্থার ব্যর্থতা নয় এটি।
হাদির মৃত্যুসংবাদের পর যেসব সহিংস ঘটনা ঘটল, সেগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অবস্থাদৃষ্টে, কেবল ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে নয়, বরং শাসনব্যবস্থার চরম শৈথিল্য ও প্রতিশোধপরায়ণ সুসংগঠিত উসকানির সম্মিলিত ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী সহিংসতার খবরগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ‘লড়াকু যোদ্ধা’ হিসেবে অনেকের কাছে ওসমান হাদির যে পরিচিতি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশে ম্লান করেছে বলেই অনুমান।
দেশের যে দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা অফিস পোড়ানো হয়েছে, সেখানে জুলাইয়ের অনেক স্মৃতি-স্মারকও ছিল। ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়েছে ২৮ জন পেশাজীবীকে। অথচ এই দুটি পত্রিকা পতিত সরকারের সময় গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিষিদ্ধ ছিল। ছায়ানটের ওপর কিসের রাগ? সাংস্কৃতিক দর্শনের সঙ্গে মতবিরোধ নতুন কিছু নয়। মানুষকে আকৃষ্ট করবে এমন পাল্টা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেষ্টা
না করে, এ রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে কারা উৎসাহ দিচ্ছে?
নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ আরও স্পষ্ট করে ঘটনার পেছনের অশুভ শক্তির সংযোগ।
ওসমান হাদির নিজের বক্তব্য এবং অবস্থানের সঙ্গেও এই জঘন্য সহিংস ঘটনাগুলো সাংঘর্ষিক। কেননা, এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্যও ছিল স্পষ্ট: ‘পারলে আরও দশটা প্রথম আলো তৈরি করে দেখান। প্রথম আলো অফিসের সামনে আপনার কাজ কী?’ সবকিছু বিবেচনায়, এই সহিংসতা তরুণদের নিজস্ব বিবেচনায় সংঘটিত হয়েছে—এমনটা মনে হওয়ার কারণ সীমিত। ‘বিশেষ’ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রতিশোধমূলক রাজনীতি তরুণদের আবেগকে পুঁজি করছে বলেই অনুমান (ইনস্ট্রুমেন্টালাইজেশন অব ইয়ুথ)। বিনা উসকানিতে দুঃশাসন পতনোত্তর (রেজিম ফল) বাস্তবতায় এ রকম সংঘবদ্ধ সহিংসতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং সর্বোপরি শান্তি বিনির্মাণের পথে প্রধান অন্তরায়। বিশ্ব পরিমণ্ডলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যার দায় সরকারের ওপর চাপবে।
সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আপনার পরামর্শ কী?
এই বিষয়ে মোটাদাগে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আইনের শাসন তথা কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অপরাধের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি সমাজকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীবিশেষে আইনের কঠোরতা, নমনীয়তা এমনকি বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিপন্থী। দ্রুত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের পাশাপাশি প্রতিটি তদন্তের অগ্রগতি ও চূড়ান্ত ফল জনসমক্ষে নিয়মিত প্রকাশ জরুরি। সীমান্ত নজরদারি
এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্রুত তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ। দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন। সঙ্গে বিদ্যমান ত্রুটিযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, যার ওপর টেকসই স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে। ভিন্নমতের কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারও সহিংস মৃত্যুর ঘটনায় আজকাল উল্লাস—এসবই সুস্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বিলুপ্তির পূর্বাভাস।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য ও সুশিক্ষার অভাব। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক বিভাজনগুলো এখন শত্রু-মিত্রের বাইনারিতে পরিণত হয়েছে। ফলে সামষ্টিক জাতীয় স্বার্থ কিংবা জাতীয়তাবোধ তৈরি হচ্ছে না। রাজনীতিতে ধর্মের যাচ্ছেতাই ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগতকরণের বিপরীতে বিতর্কিতকরণের হীন প্রয়াস, যাকে-তাকে যখন-তখন ভারত-পাকিস্তানপন্থী ট্যাগিং—এসবই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভয়ানক ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য নির্বাচনী আচরণবিধি বা দেশের বিদ্যমান আইনবিধির আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং প্রথম পরামর্শ অনুযায়ী অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তত মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম ও ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান—এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বৃহৎ পরিসরের জাতীয় রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততাও রাখা যেতে পারে এই কমিশনে, যাতে কমিশন মান বজায় রেখে নিরপেক্ষ এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।
অধিকন্তু, সীমিত সম্পদের বিপরীতে দেশে বিপুলসংখ্যক অদক্ষ বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে, যার বড় একটি অংশের কাছে রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে উঠেছে বিনা বেতনে তাদের ‘নিয়োগকারী কর্ম সংস্থা’। বিনা বেতনে তথাকথিত এই ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ’ দিয়ে তাদের অনেককে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত করছেন দলের এলিট নেতারা। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই মূলত এদের বেশির ভাগ জড়াচ্ছে অন্যায় ও সহিংস কর্মকাণ্ডে, নিয়োজিত হচ্ছে বিরোধীমত নিয়ন্ত্রণের
মতো অপরাধমূলক কাজে। ফলে রাজনৈতিক সচেতনতা বাদ দিয়ে রাজনীতিপ্রবণ হয়ে উঠছে সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। তৈরি হচ্ছে অপরাধের এক ভিশাস সাইকেল (পরিবর্তনের নেতিবাচক চক্র)। ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে এবং স্থিতিশীলতা পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে।

রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে রাখবে এই আস্থা এই মানুষগুলোর ছিল না। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার আশা আদৌ কি এ দেশের মানুষ কখনো করেছে?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব দীর্ঘদিনের। সেই অর্থে বাংলাদেশ রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত অংশীদার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এখন আমরা জানার চেষ্টা করব স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কী। বস্তুত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত অংশীদার হলো...
৭ ঘণ্টা আগে
নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
৮ ঘণ্টা আগে
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা।
১ দিন আগেরুশো তাহের

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব দীর্ঘদিনের। সেই অর্থে বাংলাদেশ রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত অংশীদার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এখন আমরা জানার চেষ্টা করব স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কী। বস্তুত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত অংশীদার হলো এমন একটি কোম্পানি বা সংস্থা, যা অন্য একটি কোম্পানি বা সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপন করে, যাতে তারা সম্পদ ভাগ করে নিতে পারে, সাধারণ লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারে এবং পারস্পরিক সুবিধা পেতে পারে, যা একা অর্জন করা কঠিন হবে। এই অংশীদারত্বে অর্থ, দক্ষতা বা তথ্য ভাগ করে নেওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে এবং এগুলো প্রায়ই পরিপূরক পণ্য বা পরিষেবার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। এগুলো আইনি অংশীদারত্ব (লিগ্যাল পার্টনারশিপ), এজেন্সি বা করপোরেট সহযোগী (করপোরেট অ্যাফিলিয়েট) থেকে আলাদা, যেখানে অংশীদারেরা স্বতন্ত্র থাকলেও যৌথ উদ্যোগে সহযোগিতা করে।
এদিকে পৃথিবীর দেশে দেশে রুশ ফেডারেশন তার স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার দেশগুলোয় রাশিয়ান স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি করপোরেশন ‘রোসাটম’-এর মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করে যাচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে বিশ্ব নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে রুশ ফেডারেশনের প্রভাব বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট আজ যে রুশ নিউক্লিয়ার টেকনোলজির ভিভিইআর-১২০০ (থ্রি প্লাস) রি-অ্যাক্টর স্থাপনে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বারতা নিয়ে কমিশনিংয়ের দ্বারপ্রান্তে, তা-ও রাশিয়া ও বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্বের অনিবার্য ফল।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পৃথিবীর অন্য যেসব দেশের সঙ্গে রুশ ফেডারেশনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ রয়েছে, সেসব দেশেও রুশ ফেডারেশন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে আর্থিক ও কারিগরি এমনকি বিশেষজ্ঞ সেবা দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। সেই ইতিহাস খানিকটা আলোকপাত করছি। বস্তুত নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর স্থাপন ও পরিচালনায় বিশ্বের বৃহৎ কোম্পানিগুলোর একটি হচ্ছে রোসাটম। এটি শুধু দেশে নয়, বরং পৃথিবীর নানা দেশে নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর তথা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। মোদ্দাকথা, সারা বিশ্বে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি সম্প্রসারণে রোসাটম গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য প্রতিষ্ঠান। আগামী দিনেও পৃথিবীর অনেক দেশে রোসাটম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনায় অংশ নিতে যাচ্ছে। যেমন তুরস্কে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের চারটি রি-অ্যাক্টর স্থাপনের চুক্তি রোসাটম ও তুরস্ক সরকারের মধ্যে সই হয় ২০১০ সালে, যা তুরস্কের পার্লামেন্টেও অনুমোদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালে নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু তুর্কি সেনাবাহিনী কর্তৃক ২০১৫ সালে ২৪ নভেম্বর সিরিয়ার রুশ বিমান ভূপাতিত এবং সে কারণে আইএস কর্তৃক রুশ স্পেশাল ফোর্সের প্রাণহানিতে সেই চুক্তি পিছিয়ে যায়। তবে পরবর্তী সময়ে মস্কো ও আঙ্কারা সেই ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর মাধ্যমে তুরস্কে রোসাটম কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা চালায়।
রুশ ফেডারেশনের আরেক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হচ্ছে বেলারুশ। বেলারুশে রোসাটম ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টরের নির্মাণকাজ শুরু করে ২০১০ সালে। যেগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় যথাক্রমে ২০১৮ সালে ও ২০২০ সালে। এদিকে ইরানে ভিভিইআর-১০০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টর স্থাপন চুক্তি রোসাটম ও ইরান সরকারের মধ্যে সই হয় ২০১৪ সালে। উল্লেখ্য, ইরান জার্মানির সহযোগিতায় নির্মিত
ও পরিচালিত রি-অ্যাক্টর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির জায়গায় রুশ ফেডারেশনকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করল ইরান। উল্লেখ্য, ইরানের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নাম বুশের-১। ২০১৩ সালে এই প্রকল্পের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ফেডারেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এদিকে বুশের-২ নামে আরেকটি প্রকল্পে আরও ছয়টি রি-অ্যাক্টর স্থাপনে ইরান ও রুশ ফেডারেশন চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৯৮৮ সালে ভারতের কুদানকুলামে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। তবে সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে নির্মাণ শুরুর ১১ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে অপারেশনে আসে কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রুশ ফেডারেশন ও ভারত ঘোষণা করে যে কুদানকুলাম-২-এর পরিকল্পনা প্রস্তুত এবং সেই অনুযায়ী ২০১৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। উল্লেখ্য, কুদানকুলাম-২ থ্রি প্লাস রি-অ্যাক্টর উন্নয়নের কাজও চলছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট কর্তৃক।
এশিয়ার আরেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামে নিন তুয়ান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ এখন পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। যেখানে রুশ টেকনোলজির ভিভিইআর-১২০০ মডেলের থ্রি-প্লাস প্রজন্মের রি-অ্যাক্টর স্থাপনের কথা ছিল।
এটি হতো ভিয়েতনামের প্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১৪ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং সেই অনুযায়ী সাইট উন্নয়নও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম সরকার নিরাপত্তার ইস্যুগুলো নিশ্চিতকল্পের লক্ষ্যে নিন তুয়ান প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থগিত করে। উল্লেখ্য, ভিয়েতনামের ওই প্রকল্প রুশ ফেডারেশনের ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তায় নির্মিত হতে যাচ্ছিল।
‘পাকস-২ প্রকল্প’ নামে হাঙ্গেরিতে ২০১৮ সালে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টর স্থাপনে হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানি এমজিএম এবং রোসাটমের মধ্যে ২০১৪ সালের শেষের দিকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উল্লেখ্য, প্রাথমিক পাকস-নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। ফিনল্যান্ডে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের একটি রি-অ্যাক্টরের নির্মাণকাজ ২০১৮ সালে শুরু করে রোসাটম। যেটির কারিগরি সহায়তা ও অর্থায়নও করে রোসাটম। কিন্তু সম্প্রতি ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের সম্পর্কটি দোটানায় পড়ে যায়।
উল্লেখ্য, রুশ ফেডারেশনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গভীর সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্কের প্রতিফলনই রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ, যার অনিবার্য ফল বাংলাদেশের রূপপুরে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টর স্থাপনে রাশিয়ার স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি করপোরেশন অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের অনন্য অবদান।
রুশো তাহের, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও যোগাযোগ পরামর্শক

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব দীর্ঘদিনের। সেই অর্থে বাংলাদেশ রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত অংশীদার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এখন আমরা জানার চেষ্টা করব স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কী। বস্তুত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত অংশীদার হলো এমন একটি কোম্পানি বা সংস্থা, যা অন্য একটি কোম্পানি বা সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপন করে, যাতে তারা সম্পদ ভাগ করে নিতে পারে, সাধারণ লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারে এবং পারস্পরিক সুবিধা পেতে পারে, যা একা অর্জন করা কঠিন হবে। এই অংশীদারত্বে অর্থ, দক্ষতা বা তথ্য ভাগ করে নেওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে এবং এগুলো প্রায়ই পরিপূরক পণ্য বা পরিষেবার ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। এগুলো আইনি অংশীদারত্ব (লিগ্যাল পার্টনারশিপ), এজেন্সি বা করপোরেট সহযোগী (করপোরেট অ্যাফিলিয়েট) থেকে আলাদা, যেখানে অংশীদারেরা স্বতন্ত্র থাকলেও যৌথ উদ্যোগে সহযোগিতা করে।
এদিকে পৃথিবীর দেশে দেশে রুশ ফেডারেশন তার স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার দেশগুলোয় রাশিয়ান স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি করপোরেশন ‘রোসাটম’-এর মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করে যাচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে বিশ্ব নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে রুশ ফেডারেশনের প্রভাব বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট আজ যে রুশ নিউক্লিয়ার টেকনোলজির ভিভিইআর-১২০০ (থ্রি প্লাস) রি-অ্যাক্টর স্থাপনে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বারতা নিয়ে কমিশনিংয়ের দ্বারপ্রান্তে, তা-ও রাশিয়া ও বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্বের অনিবার্য ফল।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পৃথিবীর অন্য যেসব দেশের সঙ্গে রুশ ফেডারেশনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ রয়েছে, সেসব দেশেও রুশ ফেডারেশন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে আর্থিক ও কারিগরি এমনকি বিশেষজ্ঞ সেবা দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। সেই ইতিহাস খানিকটা আলোকপাত করছি। বস্তুত নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর স্থাপন ও পরিচালনায় বিশ্বের বৃহৎ কোম্পানিগুলোর একটি হচ্ছে রোসাটম। এটি শুধু দেশে নয়, বরং পৃথিবীর নানা দেশে নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর তথা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। মোদ্দাকথা, সারা বিশ্বে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি সম্প্রসারণে রোসাটম গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য প্রতিষ্ঠান। আগামী দিনেও পৃথিবীর অনেক দেশে রোসাটম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনায় অংশ নিতে যাচ্ছে। যেমন তুরস্কে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের চারটি রি-অ্যাক্টর স্থাপনের চুক্তি রোসাটম ও তুরস্ক সরকারের মধ্যে সই হয় ২০১০ সালে, যা তুরস্কের পার্লামেন্টেও অনুমোদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালে নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু তুর্কি সেনাবাহিনী কর্তৃক ২০১৫ সালে ২৪ নভেম্বর সিরিয়ার রুশ বিমান ভূপাতিত এবং সে কারণে আইএস কর্তৃক রুশ স্পেশাল ফোর্সের প্রাণহানিতে সেই চুক্তি পিছিয়ে যায়। তবে পরবর্তী সময়ে মস্কো ও আঙ্কারা সেই ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর মাধ্যমে তুরস্কে রোসাটম কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা চালায়।
রুশ ফেডারেশনের আরেক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হচ্ছে বেলারুশ। বেলারুশে রোসাটম ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টরের নির্মাণকাজ শুরু করে ২০১০ সালে। যেগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় যথাক্রমে ২০১৮ সালে ও ২০২০ সালে। এদিকে ইরানে ভিভিইআর-১০০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টর স্থাপন চুক্তি রোসাটম ও ইরান সরকারের মধ্যে সই হয় ২০১৪ সালে। উল্লেখ্য, ইরান জার্মানির সহযোগিতায় নির্মিত
ও পরিচালিত রি-অ্যাক্টর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির জায়গায় রুশ ফেডারেশনকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করল ইরান। উল্লেখ্য, ইরানের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নাম বুশের-১। ২০১৩ সালে এই প্রকল্পের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ফেডারেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এদিকে বুশের-২ নামে আরেকটি প্রকল্পে আরও ছয়টি রি-অ্যাক্টর স্থাপনে ইরান ও রুশ ফেডারেশন চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৯৮৮ সালে ভারতের কুদানকুলামে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। তবে সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে নির্মাণ শুরুর ১১ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে অপারেশনে আসে কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রুশ ফেডারেশন ও ভারত ঘোষণা করে যে কুদানকুলাম-২-এর পরিকল্পনা প্রস্তুত এবং সেই অনুযায়ী ২০১৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। উল্লেখ্য, কুদানকুলাম-২ থ্রি প্লাস রি-অ্যাক্টর উন্নয়নের কাজও চলছে রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট কর্তৃক।
এশিয়ার আরেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামে নিন তুয়ান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ এখন পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। যেখানে রুশ টেকনোলজির ভিভিইআর-১২০০ মডেলের থ্রি-প্লাস প্রজন্মের রি-অ্যাক্টর স্থাপনের কথা ছিল।
এটি হতো ভিয়েতনামের প্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১৪ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং সেই অনুযায়ী সাইট উন্নয়নও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম সরকার নিরাপত্তার ইস্যুগুলো নিশ্চিতকল্পের লক্ষ্যে নিন তুয়ান প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থগিত করে। উল্লেখ্য, ভিয়েতনামের ওই প্রকল্প রুশ ফেডারেশনের ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তায় নির্মিত হতে যাচ্ছিল।
‘পাকস-২ প্রকল্প’ নামে হাঙ্গেরিতে ২০১৮ সালে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টর স্থাপনে হাঙ্গেরিয়ান কোম্পানি এমজিএম এবং রোসাটমের মধ্যে ২০১৪ সালের শেষের দিকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উল্লেখ্য, প্রাথমিক পাকস-নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। ফিনল্যান্ডে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের একটি রি-অ্যাক্টরের নির্মাণকাজ ২০১৮ সালে শুরু করে রোসাটম। যেটির কারিগরি সহায়তা ও অর্থায়নও করে রোসাটম। কিন্তু সম্প্রতি ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের সম্পর্কটি দোটানায় পড়ে যায়।
উল্লেখ্য, রুশ ফেডারেশনের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গভীর সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্কের প্রতিফলনই রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ, যার অনিবার্য ফল বাংলাদেশের রূপপুরে থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি রি-অ্যাক্টর স্থাপনে রাশিয়ার স্টেট নিউক্লিয়ার এনার্জি করপোরেশন অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্টের অনন্য অবদান।
রুশো তাহের, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও যোগাযোগ পরামর্শক

রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে রাখবে এই আস্থা এই মানুষগুলোর ছিল না। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার আশা আদৌ কি এ দেশের মানুষ কখনো করেছে?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
৭ ঘণ্টা আগে
নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
৮ ঘণ্টা আগে
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
এই বার্তা দেওয়া না হলে দেশ পড়ে যায় বিপদে। এরই মধ্যে বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র। দুটি পত্রিকা অফিস এবং ছায়ানট ও উদীচীতে উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে দলটি। এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এই নৈরাজ্যের নিন্দা জানানো হয়েছে। মুশকিল হলো, নিন্দা জানালে জনগণ সংকটগুলো বুঝতে পারে বটে, কিন্তু শৈশবে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দেওয়া একটি বাক্যের কথা তখন তাদের মনে পড়ে যায়। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মরিয়া গেল’—এই বাক্যের ইংরেজি অনুবাদ করেননি, এমন পড়ুয়া খুব কম আছেন।
এবারও দেখা গেল, শাহবাগ থেকে কিছু মানুষ এসে প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাঙচুর চালাচ্ছে। সংখ্যায় এরা বেশি নয়, কিন্তু যে রকম মারমুখী, তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মূলত এই আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পত্রিকা অফিস কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর যখন হামলে পড়ল কিছু মানুষ, তখন তাদের থামানোর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য সেখানে মোতায়েন ছিল না। ভাঙচুর শেষে আগুন দেওয়ার পর এসে হাজির হয়। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার পর হাজির হয় ফায়ার সার্ভিস।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ভাঙচুরের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, নিন্দা জানানো হয়েছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা অরাজক বাহিনী যে সুযোগ নিয়েছে, তা বন্ধ করার জন্য সরকার কী কী ব্যবস্থা নেয়, সেটা এখন দেখার বিষয়। যেকোনো বিষয়কে ইস্যু করে যে কেউ অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারাকে স্বাধীনতা বলে না, তাকে বলা হয় অরাজকতা। এই কথা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বুঝতে হবে। উত্তেজিত জনতা যুক্তি বোঝে না।
তাদের উত্তেজিত করছে কে, সেটাই আসলে খুঁজে বের করা দরকার।
জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি সময় এসে গেছে। এ সময় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হলে তা শক্ত হাতে দমন করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারি মহল থেকে যে ধরনের কথা শোনা যায়, তাতে মনে হয়, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে সরকার। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই এখন সবার চাওয়া। সে রকম পরিবেশ তৈরির করার জন্য নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সরকারকে। যারা ঝোপ বুঝে কোপ মারে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক না হলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
দেশে বহুমত, বাক্স্বাধীনতা, সংস্কৃতির প্রবহমানতার ওপর আঘাত এলে তা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দেশের মানুষের শান্তি এখন খুব প্রয়োজন।

নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
এই বার্তা দেওয়া না হলে দেশ পড়ে যায় বিপদে। এরই মধ্যে বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র। দুটি পত্রিকা অফিস এবং ছায়ানট ও উদীচীতে উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে দলটি। এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এই নৈরাজ্যের নিন্দা জানানো হয়েছে। মুশকিল হলো, নিন্দা জানালে জনগণ সংকটগুলো বুঝতে পারে বটে, কিন্তু শৈশবে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দেওয়া একটি বাক্যের কথা তখন তাদের মনে পড়ে যায়। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মরিয়া গেল’—এই বাক্যের ইংরেজি অনুবাদ করেননি, এমন পড়ুয়া খুব কম আছেন।
এবারও দেখা গেল, শাহবাগ থেকে কিছু মানুষ এসে প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাঙচুর চালাচ্ছে। সংখ্যায় এরা বেশি নয়, কিন্তু যে রকম মারমুখী, তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মূলত এই আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পত্রিকা অফিস কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর যখন হামলে পড়ল কিছু মানুষ, তখন তাদের থামানোর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য সেখানে মোতায়েন ছিল না। ভাঙচুর শেষে আগুন দেওয়ার পর এসে হাজির হয়। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার পর হাজির হয় ফায়ার সার্ভিস।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ভাঙচুরের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, নিন্দা জানানো হয়েছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা অরাজক বাহিনী যে সুযোগ নিয়েছে, তা বন্ধ করার জন্য সরকার কী কী ব্যবস্থা নেয়, সেটা এখন দেখার বিষয়। যেকোনো বিষয়কে ইস্যু করে যে কেউ অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারাকে স্বাধীনতা বলে না, তাকে বলা হয় অরাজকতা। এই কথা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বুঝতে হবে। উত্তেজিত জনতা যুক্তি বোঝে না।
তাদের উত্তেজিত করছে কে, সেটাই আসলে খুঁজে বের করা দরকার।
জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি সময় এসে গেছে। এ সময় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হলে তা শক্ত হাতে দমন করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারি মহল থেকে যে ধরনের কথা শোনা যায়, তাতে মনে হয়, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে সরকার। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই এখন সবার চাওয়া। সে রকম পরিবেশ তৈরির করার জন্য নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সরকারকে। যারা ঝোপ বুঝে কোপ মারে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক না হলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
দেশে বহুমত, বাক্স্বাধীনতা, সংস্কৃতির প্রবহমানতার ওপর আঘাত এলে তা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দেশের মানুষের শান্তি এখন খুব প্রয়োজন।

রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে রাখবে এই আস্থা এই মানুষগুলোর ছিল না। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার আশা আদৌ কি এ দেশের মানুষ কখনো করেছে?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
৭ ঘণ্টা আগে
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব দীর্ঘদিনের। সেই অর্থে বাংলাদেশ রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত অংশীদার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এখন আমরা জানার চেষ্টা করব স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কী। বস্তুত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত অংশীদার হলো...
৭ ঘণ্টা আগে
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। ইতিহাস বলে, উত্তেজনার মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। এ ধরনের নৃশংস ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন নাগরিকের প্রাণহানি মানেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত। এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য।
তবে এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পাশাপাশি যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে দুটি গণমাধ্যম ও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান—যা-ই থাকুক না কেন, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজের শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার পরিসরকে আঘাত করা। এসব কর্মকাণ্ড কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। কেন তাঁকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করা হলো, তা বোধগম্য নয়।
এই পরিস্থিতিতে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই ছাড়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। এই সময়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় হলো—সংযত ভাষা ব্যবহার করা, তথ্য যাচাই করা এবং উসকানিমূলক পোস্ট বা মন্তব্য থেকে বিরত থাকা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জন করাও জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে—উসকানি নয়, সংলাপ ও সহনশীলতার পথ বেছে নিতে হবে।
দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এ সময় প্রতিটি দলকেই ধৈর্য ধরতে হবে। শান্ত থাকতে হবে। শান্ত রাখতে হবে দলের কর্মীদের। নেতারা যদি এ সময় দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে দেশের পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহু কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে প্রতিটি রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অরাজকতার মোকাবিলা করতে পারে, তাহলেই কেবল সামনে আশার আলো দেখা যাবে। বিশেষ করে তরুণসমাজকে মনে রাখতে হবে—দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই পথেই দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয়। বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। ইতিহাস বলে, উত্তেজনার মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। এ ধরনের নৃশংস ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন নাগরিকের প্রাণহানি মানেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত। এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য।
তবে এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পাশাপাশি যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে দুটি গণমাধ্যম ও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান—যা-ই থাকুক না কেন, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজের শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার পরিসরকে আঘাত করা। এসব কর্মকাণ্ড কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। কেন তাঁকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করা হলো, তা বোধগম্য নয়।
এই পরিস্থিতিতে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই ছাড়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। এই সময়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় হলো—সংযত ভাষা ব্যবহার করা, তথ্য যাচাই করা এবং উসকানিমূলক পোস্ট বা মন্তব্য থেকে বিরত থাকা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জন করাও জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে—উসকানি নয়, সংলাপ ও সহনশীলতার পথ বেছে নিতে হবে।
দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এ সময় প্রতিটি দলকেই ধৈর্য ধরতে হবে। শান্ত থাকতে হবে। শান্ত রাখতে হবে দলের কর্মীদের। নেতারা যদি এ সময় দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে দেশের পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহু কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে প্রতিটি রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অরাজকতার মোকাবিলা করতে পারে, তাহলেই কেবল সামনে আশার আলো দেখা যাবে। বিশেষ করে তরুণসমাজকে মনে রাখতে হবে—দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই পথেই দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয়। বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে দেখে রাখবে এই আস্থা এই মানুষগুলোর ছিল না। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বজনদের জন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার আশা আদৌ কি এ দেশের মানুষ কখনো করেছে?
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচড...
৭ ঘণ্টা আগে
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রুশ ফেডারেশন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব দীর্ঘদিনের। সেই অর্থে বাংলাদেশ রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত অংশীদার বা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। এখন আমরা জানার চেষ্টা করব স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার কী। বস্তুত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত অংশীদার হলো...
৭ ঘণ্টা আগে
নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।
৮ ঘণ্টা আগে