বিভুরঞ্জন সরকার

দত্তবাড়ির পর বোদার চন্দবাড়ির কথা না লিখলে চলে না। দত্তবাড়ির মতো চন্দবাড়িতেও আছে আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আবার দত্ত ও চন্দবাড়ির মধ্যেও আছে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক।
বোদার থানাপাড়া এখন অনেক বড়। অনেক বাড়িঘর। আর আমাদের ছোটবেলায় থানা, ওয়াপদা অফিস এবং একদিকে চন্দবাড়ি, অন্যদিকে হকিকুল ডাক্তার সাহেবের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল বলে মনে পড়ে না।
উমেশ চন্দ্র চন্দ ও মন্মথ চন্দ দুই ভাই। উমেশ চন্দের দুই ছেলে সুধীর চন্দ্র চন্দ ও অধীর চন্দ্র চন্দ। উমেশ বাবুকে আমি দেখিনি। তবে মন্মথ বাবুকে দেখেছি। তাঁর বাড়ি অবশ্য থানাপাড়ায় ছিল না। তাঁর বাড়ি বাজার থেকে সিরাজ সরকার সাহেবের বাড়ি যেতে আগে পড়ত। হাতের বাঁয়ে। এখনো আছে সেই বাড়ি। মন্মথ চন্দের মেয়ে ছায়াদিকে বিয়ে করেন দত্তবাড়ির শিবেন দত্ত।
উমেশ চন্দের দুই ছেলের থানাপাড়ার বাসায় আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। বড় ছেলে সুধীর চন্দের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। শিবানী চন্দ, কল্যাণী চন্দ (সুনু), সুধাংশু চন্দ (স্বপন), নারায়ণী চন্দ (বেণু), হিমাংশু চন্দ (তপন/তপু) ও প্রবীর চন্দ (নয়ন)। শিবানী চন্দকে আমি দেখিনি। তিনি অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে মামাবাড়িতে একেবারে ছোট থেকেই বড় হয়েছেন। আর দেশে আসেননি। অন্য সবাই বোদায় ছিলেন বা আছেন। এর মধ্যে স্বপনদা অকালপ্রয়াত। সুনুদি, স্বপনদা ও বেণু আমার বড়। তবে বড় হলেও বেণু আর তপু আমার সহপাঠী। পরে সম্ভবত ক্লাস ফাইভ থেকে বেণু আমার ‘জুনিয়র’ হয়ে যায়। আর তপু হয়ে ওঠে আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। আমি, তপু ও দত্তবাড়ির বিজন—এই তিনজন ছিলাম (দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও এখনো আছি) ‘এক দেহ, এক প্রাণ’। কত কথাই না মনে পড়ছে। একটি ঘটনার কথা না বলে পারছি না। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমরা কয়েকজন (এর মধ্যে বিজন, তপু আর আমি কমন) প্রতি বৃহস্পতিবার টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যেতাম সিনেমা দেখার জন্য। শুক্রবার নতুন ছবি শুরু হতো, কাজেই বৃহস্পতিবার আমরা বিদায়ী ছবিটা দেখতাম। বলাকা টকিজ নামের সিনেমা হলটির মালিক ছিলেন মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া নামে সমধিক পরিচিত)। তিনি ছিলেন বর্তমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের শ্বশুর।
স্কুল থেকে পালিয়ে আমরা একত্রিত হতাম সাতখামারে শামসুদ্দিন ডাক্তার সাহেবের ডিসপেনসারিতে। দুপুরবেলা ওটা ফাঁকা থাকত। আমার বাড়ি ছিল তার পাশেই। ওটা ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার সড়কের একেবারে লাগোয়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে কেউ দেখে ফেলতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠতাম। প্রবাদ আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’। একদিন আমাদের শামসুদ্দিন ডাক্তার চাচার ডিসপেনসারিতে জটলারত অবস্থায় দেখতে পান ডা. ফয়জুল করিম, আমাদের মশিয়ারের (মশিয়ার রহমান, এখন পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বাবা। আমরা যে স্কুল পালিয়ে ওখানে সমবেত হয়েছি, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি সম্ভবত রোগী দেখে সাইকেলে চেপে ফিরছিলেন। তিনি নিজে আমাদের কিছু বললেন না। তবে বাজারে গিয়ে তপুর বাবা সুধীর কাকুকে বিষয়টি অবগত করেন। কাকু দ্রুত ছুটে আসেন এবং আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তপুকে পাকড়াও করে পায়ের কাবলি স্যান্ডেল দিয়ে বেদম পেটাতে থাকেন। তপু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকে, ‘দোহাই বাবা, আর মেরো না।’ কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
তপু ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্য সবচেয়ে ছোটখাটো। তাই ওকে নিয়ে কত ধরনের কাণ্ডই না আমরা করতাম। সেই তপু, হিমাংশু চন্দ এখন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রধান নির্বাহী। তপুও খুব সরল মনের সাদাসিধে মানুষ। জীবনে টাকা-পয়সা যেমন উপার্জন করেছে, তেমন খরচও করেছে। ওর বাবা, আমাদের সুধীর কাকুও ছিলেন অত্যন্ত দরাজ দিল মানুষ। আমি তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।
আমার বন্ধু তপুর বাবা, আমাদের সুধীর কাকু ছিলেন আমার দেখা ‘অসাধারণ’ মানুষদের একজন। দেখতে ছিলেন সুদর্শন। অমন উন্নত নাক, গৌর বর্ণ, মাথা উঁচু করে হাঁটাচলা করা; দেখলেই মনের মধ্যে একটি সমীহ ভাব চলে আসত। তাঁকে আমরা একধরনের ভয়মিশ্রিত সমীহই করতাম। একেবারে ছোটবেলায় এড়িয়ে চলতাম। আস্তে আস্তে যতই তাঁর নৈকট্য লাভ করেছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর মনের ভেতরটা কত নরম। পরিণত বয়সেও তিনি ঝুনা নারকেল না হয়ে কচি ডাবের মতোই ছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। জলপাইগুড়ি জেলায়ও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা ছোটবেলায়ও তাঁকে বোদা হাইস্কুল মাঠে শৌখিন খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে দেখেছি। সুধীর কাকু, ডা. ফয়জুল চাচারা মাঠে নামলে জমে উঠত খেলা। তরুণদের উৎসাহিত করার জন্যই সে সময় তাঁরা নিয়মিত মাঠে যেতেন।
তপুর মা, মানে আমাদের কাকি মারা যান সম্ভবত ১৯৫৭ সালে। আমি হয়তো তাঁকে দেখিওনি। শুনেছি নয়নের তখন মাত্র দেড় বছর বয়স। তপুর তিন-সাড়ে তিন। কাজেই মায়ের কোনো স্মৃতি ওদের মনে থাকার কথা নয়। ওরা প্রকৃতপক্ষে মাতৃস্নেহে বড় হয়েছে দিদিমার কাছে। দিদিমা সরজুবালা দেবী ছিলেন সুধীর কাকুর মাসিমা। তিনি বাল্যবিধবা। বিয়ের অল্প পরই স্বামীহারা হয়ে সুধীর কাকুর সংসারে স্থায়ী হয়েছিলেন। তপু ও নয়ন এই দিদিমার কোলেপিঠে মানুষ। তাই তিনি ছিলেন ওদের মা, দিদিমা নয়!
এই মহীয়সী নারীকে যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবেন না। তিনিই কার্যত চন্দবাড়িতে অভিভাবক ছিলেন। তাঁর ছায়া-মায়ায় তপুরা ভাইবোন মানুষ হয়েছে। আরও একজন তপুদের মায়ের অভাব পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন—তপুদের কাকিমা, অধীর কাকুর স্ত্রী। এই কাকিমার নাম রেখা রানী চন্দ। নিজের তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসন্তানের সঙ্গে ভাশুরের সন্তানদেরও তিনি অকৃপণ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন।
সুধীর কাকুর স্ত্রীবিয়োগের পর অনেকে তাঁকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন এমন রেওয়াজ ছিল, কিন্তু প্রথম স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছিল। একসময় আমি চন্দবাড়ির সদস্যের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির হাঁড়িতে আমার জন্য দুমুঠো চাল যেন দেওয়াই থাকত। আমি গেলে দিদিমা, কাকিমা কেউ বিরক্ত না হয়ে খুশি হতেন। হাসিমুখেই আমাকে স্বাগত জানাতেন। দিদিমা আর নেই। প্রায় ৯০ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কাকিমা এখনো সক্রিয় আছেন, সেঞ্চুরি করার অপেক্ষায়।
তপুর কাকাতো বোন রেবা রানী চন্দ; ডাক নাম পুতুল। আমাদের ছোট। দেখতে অনেকটা পুতুলের মতোই ছিল। আমি একটু বড় হওয়ার পর, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মনে হয়, কেউ কেউ পুতুলের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন বলে আমি শুনেছি। তবে বিষয়টি জোরালো হয়ে ওঠেনি।
তপুদের ভাইবোনেরা সবাই মুক্ত মনের অধিকারী। তপু আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে মাখামাখি সম্পর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওর বড় ভাই স্বপনদা এবং ছোট ভাই নয়নের সঙ্গেও গোড়া থেকেই আমার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রীতিময়। নয়ন এখন বোদার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। কলেজে অধ্যাপনা থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়ে সংস্কৃতি-সাহিত্য-সমাজ নিয়ে কাজ করেন, লেখালেখি করেন। কবিতা ও গদ্যে সমান পারদর্শী।
এই পরিবারের সঙ্গে আমার অতি ঘনিষ্ঠতার আরেকটি বড় কারণ বোধ হয় এটাই যে, এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলেন। পার্টির সদস্য না হয়েও এরা ছিলেন পার্টি অন্তপ্রাণ। এ রকম পরিবার বোদায় আরও দু-চারটি ছিল।
চন্দবাড়ির সুধীর চন্দের জন্ম ১৯১৭ সালের কোনো এক বুধবার। ওই বছর পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। অক্টোবর বিপ্লব বলে পরিচিত সেই বিপ্লবের অভিঘাত তখনই বোদায় গিয়ে পৌঁছানোর কথা নয়। তাই সুধীর চন্দের চেতনায় বিপ্লব আঘাত হানেনি। তবে একধরনের উদার মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তাঁর বাড়ির পরিবেশ যে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়েছিল, সেটা আগে উল্লেখ করেছি। একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু একই বারে। বুধবার। ২০০০ সালের এক বুধবার তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। প্রায় ৮৩ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি।
সুধীর চন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন সম্ভবত ১৯৩৭ সালে। তাঁর সঙ্গে একই বছর প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন বোদা হাইস্কুলের শিক্ষক সেলিমের বাবা সিদ্দিক সাহেব। ম্যাট্রিক পাসের পর সুধীর চন্দ আর পড়াশোনা না করে চাকরিতে ঢোকেন। তিনি অবিভক্ত ভারতেই জুট করপোরেশনে প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বন বিভাগেও নাকি তাঁর চাকরি হয়েছিল। সাপ, মশা ইত্যাদির ভয়ে তিনি সেই চাকরিতে যোগ দেননি।
ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ১৯৪৭ সালে বিদায় নেয়। সে সময় সুধীর চন্দ তৎকালীন পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাঁর চাকরি ন্যস্ত হয় ডিসি কালেক্টরে তহসিল অফিসে, তহসিলদার হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত তিনি ওই চাকরি করেছেন। বোদা ছাড়াও দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জে তিনি তহসিলদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি লুথার্ন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন নামের একটি সাহায্য সংস্থায় চাকরি নেন। পরে এই সংগঠন আরডিআরএস নামে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে এই সংস্থা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তখন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আরডিআরএসের কনস্ট্রাকশন বিভাগে কাজ করেছে আমার বন্ধু হিমাংশু চন্দ তপন বা তপু। বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিধ্বস্ত ভবন নতুন করে তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্ব পালন করেছে তপু। সুধীর কাকু আরডিআরএসের চাকরি করেছেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ফলে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঠাকুরগাঁওয়েই বসবাস করেছেন। বাসা ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন। তপু ও নয়ন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়ত। তপু ওই কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে আর নয়ন এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স করে বোদায় ফিরে পাথরাজ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে। তপু বিয়েশাদি করে ঠাকুরগাঁওয়েই স্থায়ী হয়েছে।
তপুদের ঠাকুরগাঁওয়ের বাসায়ও নানা কারণে আমাকে বহুদিন রাত কাটাতে হয়েছে এবং পাত পাততে হয়েছে। তখন ঢাকায় আসার জন্য আমাকে হয় দিনাজপুর অথবা ঠাকুরগাঁও থেকে গাড়ি ধরতে হতো। পঞ্চগড় থেকে কোনো কোচ ডে কিংবা নাইট তখনো চালু হয়নি। ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে আমার রাত্রিকালীন অবস্থান হতো তপুদের বাসায়। রান্নাঘরে একসঙ্গে বসে আমরা চারজন রাতের খাবার খেতাম। সুধীর কাকু পরম মমতায় আমাকে পুত্রবৎ পাশে বসাতেন। আহা, কত প্রীতিময় ছিল সেই দিনগুলো!
আগেই বলেছি, কাকু ছিলেন একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি সাত-আটবার ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) শিল্ড কাপ খেলেছেন। ট্রফি জিতেছেন। হেড করে গোল করায় তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। তখন মাঝগ্রামের আবদুর রহমান সাহেবও ভালো ফুটবল খেলতেন। তাঁর কর্নার কিক মানেই ছিল অবধারিত গোল। সে জন্যই তখন বলা হতো সুধীর চন্দের হেড আর আব্দুর রহমানের কর্নার কিক ইকুয়াল টু গোল। তিনি রংপুর ও দিনাজপুরে গিয়েও খেলেছেন।
সুধীর কাকু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ না নিলেও শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নানা উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতায় ছিলেন সদা তৎপর। যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী ওপারে গিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য বড় সহায় ছিলেন সুধীর কাকু। কিন্তু কিছু মানুষ যেমন যুদ্ধ শেষের পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুধীর কাকু ছিলেন সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
চন্দবাড়ির স্বপনদা ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের, একটু যেন আপনভোলা মানুষ। সংসার করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংসারী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা ছিলেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। মাথার ওপর সুধীর কাকুর মতো বটবৃক্ষসম বাবা থাকলে অমনই বোধ হয় হওয়ার কথা।
স্বপনদা আমার বড়। বন্ধুর বড় ভাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল। তিনি আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমাদের এলাকা থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কামু ভাই, অ্যাডভোকেট কামরুল হোসেন। মনে আছে, ওই নির্বাচনী প্রচারে আমি আর স্বপনদা একসঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বিভিন্ন গ্রাম বা ইউনিয়নে আমাদের উভয়ের পরিচিতদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছি। আমি সাইকেল চালাতে পারতাম না। স্বপনদা সাইকেল চালিয়ে আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। আলপথে অনেক কষ্ট করেই আমাদের যেতে হতো। হাসিমুখেই এই কষ্টকর কাজটি স্বপনদা করতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, জনমত আমাদের অনুকূলে নয়। তার পরও কিসের আশায়, কিসের নেশায় যে দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়ি ছুটে বেড়াতাম!
আমি ঢাকায় আসার পর স্বপনদার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তার পরও ছুটিছাঁটায় বোদায় গেলে স্বপনদা ছুটে আসতেন। কত জিজ্ঞাসা নিয়ে আমার কাছে সেসবের উত্তর জানতে চাইতেন। তাঁর সব কৌতূহল মেটানোর সাধ্য আমার ছিল না। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় স্বপনদা একটি পা হারান। তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতেন। শেষদিকে সম্ভবত ছাত্র পড়িয়ে উপার্জন করতেন। ২০০৩ সালে স্বপনদার মৃত্যু হয়। তিনি রেখে গেছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান। বৌদি তাঁর দেবরদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। বড় মেয়ে চৈতালি চন্দ সোমার বর ঝাড়বাড়ি কলেজের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে বিপাশা চন্দ দোলন বরিশালে বিয়ে হলেও এখন সম্ভবত বোদাতেই আছে। ছেলে সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ কৃতী ছাত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। জয়দ্বীপ জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিল, সভাপতি হয়েছিল। বাম রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ হয়তো এখনো বহাল আছে। গুজরাটে যাওয়ার আগে দৈনিক সমকালে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছে। লেখালেখির হাত ভালো। এর মধ্যেই গবেষণামূলক কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছে।
আমার বন্ধু হিমাংশু তপুও একজন সফল মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে ওর একটি এনজিও আছে। অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ছাত্রাবস্থাতেই তপু উপার্জনমুখী হয়েছে। প্রথমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, তারপর ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কসমেটিকসের দোকান এবং সব শেষে শার্প নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা। নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মেও তপু সময় দেয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও ছাত্রাবস্থায় তপুর ভেতরের এত প্রতিভা সম্পর্কে আমরা কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। তপুর একমাত্র ছেলে বুদ্ধদেব চন্দ তমাল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এসে এখন বগুড়ায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছে। তমাল বিয়ে করে এক সন্তানের জনকও হয়েছে। আমার বন্ধু তপু গর্বিত দাদু হিসেবে পরিতৃপ্তি নিয়ে সংসার করছে।
ভাইদের মধ্যে ছোট প্রবীর চন্দ নয়ন। মূলত সে-ই এখন চন্দবাড়ির অভিভাবক। বোদার একজন সচেতন ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই। নিয়মিত কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকে। দুটি কবিতার বইও বের হয়েছে। দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশের অপেক্ষায়। তার স্ত্রীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলে শুভ্র প্রতিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে একটি অ্যাড ফার্মে চাকরি করছে। মেয়ে দেবলীনা দৈবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী।
চন্দবাড়ির মেয়েদের কথা কিছু না বললেই নয়। সুধীর চন্দের বড় মেয়ে জলপাইগুড়িতে থেকেছেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু-তিনবার তিনি বোদায় এসেছেন। আমি তখন বোদা ছেড়েছি। ফলে শিবানী চন্দ আমার অদেখা বড় দিদি। কল্যাণী; অর্থাৎ সুনুদিই হলেন আমাদের দেখা বড় দিদি। কী হাসিখুশি মানুষ সুনুদি! মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি যেমন তাঁর আছে, তেমনি আছে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।
আমাদের ছোটবেলায় সুনুদির বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। মধু জামাইবাবুও খুব সুন্দর ছিলেন। সুনুদি তো অবশ্যই সুন্দরী। ভালোই চলছিল সব। সময় গড়িয়ে দুটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জনক-জননী হন তাঁরা। তারপর যে কোথা থেকে কী হয়। জামাইবাবুকে আর বোদায় দেখা যায় না। তিনি সংসারত্যাগী হন। কী দুঃসহ মর্মজ্বালা বুকে চেপে সুনুদি তাঁর দুই ছেলে মিহির ও বিজনকে মানুষ করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা কঠিন। বাবা এবং পরিবারের সহযোগিতা-সমর্থন তিনি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কুচুটে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করা যে কত কঠিন, সেটা না বললেও চলে। সুনুদি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছোট ছেলে বিজন সরকারও একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বড় ছেলে মিহির সরকার একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত বলে শুনেছিলাম।
চন্দবাড়ির আরেক মেয়ে বেণু ওরফে নারায়ণী চন্দ, আমার বন্ধু এবং মামি। আমার মায়ের কোনো ভাইবোন নেই। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তবে মায়ের কয়েকজন পাতানো ভাই আছে, যারা আমার মামা। এ রকম একজন হলেন নারায়ণ চন্দ্র সাহা। ঢাকার বিক্রমপুরে বাড়ি। চাকরির সুবাদে বোদায় যান গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি কিছুদিন লজিং থাকতেন আমার পিসার বাসায়; অর্থাৎ কার্তিকদা-জ্যোতিষদাদের বাসায়। তখন অবশ্য পিসেমশাই শরৎ চন্দ্র সরকার জীবিত ছিলেন। যা হোক, ওই বাসায় লজিং থাকার সুবাদেই হয়তো আমার মায়ের ভাই হয়ে যান নারায়ণ সাহা। আমার মামা। এই মামাই বিয়ে করেন চন্দবাড়ির মেয়ে বেণুকে। বন্ধু হেয় গেল মামি। বিয়ের পর নতুন সংসার গোছানোর আগে কিছুদিন তাঁরা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারের সঙ্গেও আমার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একসময় এমনও ছিল যে, ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে রাতটা আমি নারায়ণ মামার বাসাতেই কাটাতাম। ততদিনে তাঁদের মেয়ে ও ছেলে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়। মামার নাম নারায়ণ আর যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম নারায়ণী। আমাকে আমার দু-এক বন্ধু তখন ঠাট্টা করে বলত, আমার স্ত্রীর নাম নাকি হবে হয় বিভা, না হয় রঞ্জনা! না, সেটা হয়নি।
বেণুও প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেছে। ছেলে বাপ্পা ওরফে স্বরূপ সাহা এসএসসি পাস করে কলকাতায় চলে যায়। এমবিএ পাস করে বাপ্পা এখন বেঙ্গালুরুতে আছে বলে শুনেছি। বাপ্পা আমাকে মামা বলে ডাকে। কী অদ্ভুত সামাজিক সম্পর্কগুলো! বেণুর মেয়ে শম্পা কিছুদিন ঢাকায় ছিল। তারপর নাকি আমেরিকায় চলে গেছে। নারায়ণ মামার জীবনাবসান হয়েছে। মামি এখন অবসরজীবন যাপন করছেন।
নটে গাছটি মুড়োল, চন্দবাড়ির গল্প ফুরোল।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

দত্তবাড়ির পর বোদার চন্দবাড়ির কথা না লিখলে চলে না। দত্তবাড়ির মতো চন্দবাড়িতেও আছে আমার সহপাঠী ও বন্ধু। আবার দত্ত ও চন্দবাড়ির মধ্যেও আছে পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক।
বোদার থানাপাড়া এখন অনেক বড়। অনেক বাড়িঘর। আর আমাদের ছোটবেলায় থানা, ওয়াপদা অফিস এবং একদিকে চন্দবাড়ি, অন্যদিকে হকিকুল ডাক্তার সাহেবের বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িঘর ছিল বলে মনে পড়ে না।
উমেশ চন্দ্র চন্দ ও মন্মথ চন্দ দুই ভাই। উমেশ চন্দের দুই ছেলে সুধীর চন্দ্র চন্দ ও অধীর চন্দ্র চন্দ। উমেশ বাবুকে আমি দেখিনি। তবে মন্মথ বাবুকে দেখেছি। তাঁর বাড়ি অবশ্য থানাপাড়ায় ছিল না। তাঁর বাড়ি বাজার থেকে সিরাজ সরকার সাহেবের বাড়ি যেতে আগে পড়ত। হাতের বাঁয়ে। এখনো আছে সেই বাড়ি। মন্মথ চন্দের মেয়ে ছায়াদিকে বিয়ে করেন দত্তবাড়ির শিবেন দত্ত।
উমেশ চন্দের দুই ছেলের থানাপাড়ার বাসায় আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। বড় ছেলে সুধীর চন্দের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। শিবানী চন্দ, কল্যাণী চন্দ (সুনু), সুধাংশু চন্দ (স্বপন), নারায়ণী চন্দ (বেণু), হিমাংশু চন্দ (তপন/তপু) ও প্রবীর চন্দ (নয়ন)। শিবানী চন্দকে আমি দেখিনি। তিনি অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে মামাবাড়িতে একেবারে ছোট থেকেই বড় হয়েছেন। আর দেশে আসেননি। অন্য সবাই বোদায় ছিলেন বা আছেন। এর মধ্যে স্বপনদা অকালপ্রয়াত। সুনুদি, স্বপনদা ও বেণু আমার বড়। তবে বড় হলেও বেণু আর তপু আমার সহপাঠী। পরে সম্ভবত ক্লাস ফাইভ থেকে বেণু আমার ‘জুনিয়র’ হয়ে যায়। আর তপু হয়ে ওঠে আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন। আমি, তপু ও দত্তবাড়ির বিজন—এই তিনজন ছিলাম (দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও এখনো আছি) ‘এক দেহ, এক প্রাণ’। কত কথাই না মনে পড়ছে। একটি ঘটনার কথা না বলে পারছি না। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমরা কয়েকজন (এর মধ্যে বিজন, তপু আর আমি কমন) প্রতি বৃহস্পতিবার টিফিনের সময় স্কুল পালিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যেতাম সিনেমা দেখার জন্য। শুক্রবার নতুন ছবি শুরু হতো, কাজেই বৃহস্পতিবার আমরা বিদায়ী ছবিটা দেখতাম। বলাকা টকিজ নামের সিনেমা হলটির মালিক ছিলেন মির্জা রুহুল আমিন (চখা মিয়া নামে সমধিক পরিচিত)। তিনি ছিলেন বর্তমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাবা এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের শ্বশুর।
স্কুল থেকে পালিয়ে আমরা একত্রিত হতাম সাতখামারে শামসুদ্দিন ডাক্তার সাহেবের ডিসপেনসারিতে। দুপুরবেলা ওটা ফাঁকা থাকত। আমার বাড়ি ছিল তার পাশেই। ওটা ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার সড়কের একেবারে লাগোয়া। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে কেউ দেখে ফেলতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠতাম। প্রবাদ আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়’। একদিন আমাদের শামসুদ্দিন ডাক্তার চাচার ডিসপেনসারিতে জটলারত অবস্থায় দেখতে পান ডা. ফয়জুল করিম, আমাদের মশিয়ারের (মশিয়ার রহমান, এখন পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) বাবা। আমরা যে স্কুল পালিয়ে ওখানে সমবেত হয়েছি, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি সম্ভবত রোগী দেখে সাইকেলে চেপে ফিরছিলেন। তিনি নিজে আমাদের কিছু বললেন না। তবে বাজারে গিয়ে তপুর বাবা সুধীর কাকুকে বিষয়টি অবগত করেন। কাকু দ্রুত ছুটে আসেন এবং আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তপুকে পাকড়াও করে পায়ের কাবলি স্যান্ডেল দিয়ে বেদম পেটাতে থাকেন। তপু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করে বলতে থাকে, ‘দোহাই বাবা, আর মেরো না।’ কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
তপু ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্য সবচেয়ে ছোটখাটো। তাই ওকে নিয়ে কত ধরনের কাণ্ডই না আমরা করতাম। সেই তপু, হিমাংশু চন্দ এখন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রধান নির্বাহী। তপুও খুব সরল মনের সাদাসিধে মানুষ। জীবনে টাকা-পয়সা যেমন উপার্জন করেছে, তেমন খরচও করেছে। ওর বাবা, আমাদের সুধীর কাকুও ছিলেন অত্যন্ত দরাজ দিল মানুষ। আমি তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।
আমার বন্ধু তপুর বাবা, আমাদের সুধীর কাকু ছিলেন আমার দেখা ‘অসাধারণ’ মানুষদের একজন। দেখতে ছিলেন সুদর্শন। অমন উন্নত নাক, গৌর বর্ণ, মাথা উঁচু করে হাঁটাচলা করা; দেখলেই মনের মধ্যে একটি সমীহ ভাব চলে আসত। তাঁকে আমরা একধরনের ভয়মিশ্রিত সমীহই করতাম। একেবারে ছোটবেলায় এড়িয়ে চলতাম। আস্তে আস্তে যতই তাঁর নৈকট্য লাভ করেছি, ততই মনে হয়েছে তাঁর মনের ভেতরটা কত নরম। পরিণত বয়সেও তিনি ঝুনা নারকেল না হয়ে কচি ডাবের মতোই ছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। জলপাইগুড়ি জেলায়ও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা ছোটবেলায়ও তাঁকে বোদা হাইস্কুল মাঠে শৌখিন খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে দেখেছি। সুধীর কাকু, ডা. ফয়জুল চাচারা মাঠে নামলে জমে উঠত খেলা। তরুণদের উৎসাহিত করার জন্যই সে সময় তাঁরা নিয়মিত মাঠে যেতেন।
তপুর মা, মানে আমাদের কাকি মারা যান সম্ভবত ১৯৫৭ সালে। আমি হয়তো তাঁকে দেখিওনি। শুনেছি নয়নের তখন মাত্র দেড় বছর বয়স। তপুর তিন-সাড়ে তিন। কাজেই মায়ের কোনো স্মৃতি ওদের মনে থাকার কথা নয়। ওরা প্রকৃতপক্ষে মাতৃস্নেহে বড় হয়েছে দিদিমার কাছে। দিদিমা সরজুবালা দেবী ছিলেন সুধীর কাকুর মাসিমা। তিনি বাল্যবিধবা। বিয়ের অল্প পরই স্বামীহারা হয়ে সুধীর কাকুর সংসারে স্থায়ী হয়েছিলেন। তপু ও নয়ন এই দিদিমার কোলেপিঠে মানুষ। তাই তিনি ছিলেন ওদের মা, দিদিমা নয়!
এই মহীয়সী নারীকে যাঁরা না দেখেছেন, তাঁরা তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারবেন না। তিনিই কার্যত চন্দবাড়িতে অভিভাবক ছিলেন। তাঁর ছায়া-মায়ায় তপুরা ভাইবোন মানুষ হয়েছে। আরও একজন তপুদের মায়ের অভাব পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন—তপুদের কাকিমা, অধীর কাকুর স্ত্রী। এই কাকিমার নাম রেখা রানী চন্দ। নিজের তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসন্তানের সঙ্গে ভাশুরের সন্তানদেরও তিনি অকৃপণ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন।
সুধীর কাকুর স্ত্রীবিয়োগের পর অনেকে তাঁকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন এমন রেওয়াজ ছিল, কিন্তু প্রথম স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছিল। একসময় আমি চন্দবাড়ির সদস্যের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির হাঁড়িতে আমার জন্য দুমুঠো চাল যেন দেওয়াই থাকত। আমি গেলে দিদিমা, কাকিমা কেউ বিরক্ত না হয়ে খুশি হতেন। হাসিমুখেই আমাকে স্বাগত জানাতেন। দিদিমা আর নেই। প্রায় ৯০ বছর বয়সে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। কাকিমা এখনো সক্রিয় আছেন, সেঞ্চুরি করার অপেক্ষায়।
তপুর কাকাতো বোন রেবা রানী চন্দ; ডাক নাম পুতুল। আমাদের ছোট। দেখতে অনেকটা পুতুলের মতোই ছিল। আমি একটু বড় হওয়ার পর, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মনে হয়, কেউ কেউ পুতুলের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন বলে আমি শুনেছি। তবে বিষয়টি জোরালো হয়ে ওঠেনি।
তপুদের ভাইবোনেরা সবাই মুক্ত মনের অধিকারী। তপু আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে মাখামাখি সম্পর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওর বড় ভাই স্বপনদা এবং ছোট ভাই নয়নের সঙ্গেও গোড়া থেকেই আমার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রীতিময়। নয়ন এখন বোদার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। কলেজে অধ্যাপনা থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়ে সংস্কৃতি-সাহিত্য-সমাজ নিয়ে কাজ করেন, লেখালেখি করেন। কবিতা ও গদ্যে সমান পারদর্শী।
এই পরিবারের সঙ্গে আমার অতি ঘনিষ্ঠতার আরেকটি বড় কারণ বোধ হয় এটাই যে, এরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিলেন। পার্টির সদস্য না হয়েও এরা ছিলেন পার্টি অন্তপ্রাণ। এ রকম পরিবার বোদায় আরও দু-চারটি ছিল।
চন্দবাড়ির সুধীর চন্দের জন্ম ১৯১৭ সালের কোনো এক বুধবার। ওই বছর পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। অক্টোবর বিপ্লব বলে পরিচিত সেই বিপ্লবের অভিঘাত তখনই বোদায় গিয়ে পৌঁছানোর কথা নয়। তাই সুধীর চন্দের চেতনায় বিপ্লব আঘাত হানেনি। তবে একধরনের উদার মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তাঁর বাড়ির পরিবেশ যে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়েছিল, সেটা আগে উল্লেখ করেছি। একটি কাকতালীয় ব্যাপার হলো তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু একই বারে। বুধবার। ২০০০ সালের এক বুধবার তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। প্রায় ৮৩ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি।
সুধীর চন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন সম্ভবত ১৯৩৭ সালে। তাঁর সঙ্গে একই বছর প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন বোদা হাইস্কুলের শিক্ষক সেলিমের বাবা সিদ্দিক সাহেব। ম্যাট্রিক পাসের পর সুধীর চন্দ আর পড়াশোনা না করে চাকরিতে ঢোকেন। তিনি অবিভক্ত ভারতেই জুট করপোরেশনে প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। বন বিভাগেও নাকি তাঁর চাকরি হয়েছিল। সাপ, মশা ইত্যাদির ভয়ে তিনি সেই চাকরিতে যোগ দেননি।
ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত দুই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ১৯৪৭ সালে বিদায় নেয়। সে সময় সুধীর চন্দ তৎকালীন পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন তাঁর চাকরি ন্যস্ত হয় ডিসি কালেক্টরে তহসিল অফিসে, তহসিলদার হিসেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত তিনি ওই চাকরি করেছেন। বোদা ছাড়াও দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় ও সেতাবগঞ্জে তিনি তহসিলদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি লুথার্ন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন নামের একটি সাহায্য সংস্থায় চাকরি নেন। পরে এই সংগঠন আরডিআরএস নামে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে এই সংস্থা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তখন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আরডিআরএসের কনস্ট্রাকশন বিভাগে কাজ করেছে আমার বন্ধু হিমাংশু চন্দ তপন বা তপু। বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিধ্বস্ত ভবন নতুন করে তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্ব পালন করেছে তপু। সুধীর কাকু আরডিআরএসের চাকরি করেছেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। ফলে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঠাকুরগাঁওয়েই বসবাস করেছেন। বাসা ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি থাকতেন। তপু ও নয়ন ঠাকুরগাঁও কলেজে পড়ত। তপু ওই কলেজ থেকে বিএ পাস করেছে আর নয়ন এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স করে বোদায় ফিরে পাথরাজ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে। তপু বিয়েশাদি করে ঠাকুরগাঁওয়েই স্থায়ী হয়েছে।
তপুদের ঠাকুরগাঁওয়ের বাসায়ও নানা কারণে আমাকে বহুদিন রাত কাটাতে হয়েছে এবং পাত পাততে হয়েছে। তখন ঢাকায় আসার জন্য আমাকে হয় দিনাজপুর অথবা ঠাকুরগাঁও থেকে গাড়ি ধরতে হতো। পঞ্চগড় থেকে কোনো কোচ ডে কিংবা নাইট তখনো চালু হয়নি। ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া এবং বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে আমার রাত্রিকালীন অবস্থান হতো তপুদের বাসায়। রান্নাঘরে একসঙ্গে বসে আমরা চারজন রাতের খাবার খেতাম। সুধীর কাকু পরম মমতায় আমাকে পুত্রবৎ পাশে বসাতেন। আহা, কত প্রীতিময় ছিল সেই দিনগুলো!
আগেই বলেছি, কাকু ছিলেন একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাবের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি সাত-আটবার ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) শিল্ড কাপ খেলেছেন। ট্রফি জিতেছেন। হেড করে গোল করায় তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। তখন মাঝগ্রামের আবদুর রহমান সাহেবও ভালো ফুটবল খেলতেন। তাঁর কর্নার কিক মানেই ছিল অবধারিত গোল। সে জন্যই তখন বলা হতো সুধীর চন্দের হেড আর আব্দুর রহমানের কর্নার কিক ইকুয়াল টু গোল। তিনি রংপুর ও দিনাজপুরে গিয়েও খেলেছেন।
সুধীর কাকু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। অস্ত্র হাতে সম্মুখ সমরে অংশ না নিলেও শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নানা উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতায় ছিলেন সদা তৎপর। যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী ওপারে গিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য বড় সহায় ছিলেন সুধীর কাকু। কিন্তু কিছু মানুষ যেমন যুদ্ধ শেষের পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুধীর কাকু ছিলেন সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
চন্দবাড়ির স্বপনদা ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের, একটু যেন আপনভোলা মানুষ। সংসার করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সংসারী বলতে যা বোঝায়, তিনি তা ছিলেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। মাথার ওপর সুধীর কাকুর মতো বটবৃক্ষসম বাবা থাকলে অমনই বোধ হয় হওয়ার কথা।
স্বপনদা আমার বড়। বন্ধুর বড় ভাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল। তিনি আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতেন। রাজনীতি সচেতন ছিলেন। দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমাদের এলাকা থেকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কামু ভাই, অ্যাডভোকেট কামরুল হোসেন। মনে আছে, ওই নির্বাচনী প্রচারে আমি আর স্বপনদা একসঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছি। বিভিন্ন গ্রাম বা ইউনিয়নে আমাদের উভয়ের পরিচিতদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেছি। আমি সাইকেল চালাতে পারতাম না। স্বপনদা সাইকেল চালিয়ে আমাকে নিয়ে যেতেন। তখন গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। আলপথে অনেক কষ্ট করেই আমাদের যেতে হতো। হাসিমুখেই এই কষ্টকর কাজটি স্বপনদা করতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, জনমত আমাদের অনুকূলে নয়। তার পরও কিসের আশায়, কিসের নেশায় যে দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়ি ছুটে বেড়াতাম!
আমি ঢাকায় আসার পর স্বপনদার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তার পরও ছুটিছাঁটায় বোদায় গেলে স্বপনদা ছুটে আসতেন। কত জিজ্ঞাসা নিয়ে আমার কাছে সেসবের উত্তর জানতে চাইতেন। তাঁর সব কৌতূহল মেটানোর সাধ্য আমার ছিল না। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় স্বপনদা একটি পা হারান। তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতেন। শেষদিকে সম্ভবত ছাত্র পড়িয়ে উপার্জন করতেন। ২০০৩ সালে স্বপনদার মৃত্যু হয়। তিনি রেখে গেছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান। বৌদি তাঁর দেবরদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। বড় মেয়ে চৈতালি চন্দ সোমার বর ঝাড়বাড়ি কলেজের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক। ছোট মেয়ে বিপাশা চন্দ দোলন বরিশালে বিয়ে হলেও এখন সম্ভবত বোদাতেই আছে। ছেলে সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ কৃতী ছাত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। জয়দ্বীপ জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিল, সভাপতি হয়েছিল। বাম রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ হয়তো এখনো বহাল আছে। গুজরাটে যাওয়ার আগে দৈনিক সমকালে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছে। লেখালেখির হাত ভালো। এর মধ্যেই গবেষণামূলক কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছে।
আমার বন্ধু হিমাংশু তপুও একজন সফল মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ে ওর একটি এনজিও আছে। অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ছাত্রাবস্থাতেই তপু উপার্জনমুখী হয়েছে। প্রথমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, তারপর ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কসমেটিকসের দোকান এবং সব শেষে শার্প নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা। নানা ধরনের সামাজিক কাজকর্মেও তপু সময় দেয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েও ছাত্রাবস্থায় তপুর ভেতরের এত প্রতিভা সম্পর্কে আমরা কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। তপুর একমাত্র ছেলে বুদ্ধদেব চন্দ তমাল কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এসে এখন বগুড়ায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছে। তমাল বিয়ে করে এক সন্তানের জনকও হয়েছে। আমার বন্ধু তপু গর্বিত দাদু হিসেবে পরিতৃপ্তি নিয়ে সংসার করছে।
ভাইদের মধ্যে ছোট প্রবীর চন্দ নয়ন। মূলত সে-ই এখন চন্দবাড়ির অভিভাবক। বোদার একজন সচেতন ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেও সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন থেকেই। নিয়মিত কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকে। দুটি কবিতার বইও বের হয়েছে। দুটি প্রবন্ধের বই প্রকাশের অপেক্ষায়। তার স্ত্রীও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছেলে শুভ্র প্রতিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে একটি অ্যাড ফার্মে চাকরি করছে। মেয়ে দেবলীনা দৈবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী।
চন্দবাড়ির মেয়েদের কথা কিছু না বললেই নয়। সুধীর চন্দের বড় মেয়ে জলপাইগুড়িতে থেকেছেন বলে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু-তিনবার তিনি বোদায় এসেছেন। আমি তখন বোদা ছেড়েছি। ফলে শিবানী চন্দ আমার অদেখা বড় দিদি। কল্যাণী; অর্থাৎ সুনুদিই হলেন আমাদের দেখা বড় দিদি। কী হাসিখুশি মানুষ সুনুদি! মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি যেমন তাঁর আছে, তেমনি আছে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে চলার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।
আমাদের ছোটবেলায় সুনুদির বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। মধু জামাইবাবুও খুব সুন্দর ছিলেন। সুনুদি তো অবশ্যই সুন্দরী। ভালোই চলছিল সব। সময় গড়িয়ে দুটি ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জনক-জননী হন তাঁরা। তারপর যে কোথা থেকে কী হয়। জামাইবাবুকে আর বোদায় দেখা যায় না। তিনি সংসারত্যাগী হন। কী দুঃসহ মর্মজ্বালা বুকে চেপে সুনুদি তাঁর দুই ছেলে মিহির ও বিজনকে মানুষ করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা কঠিন। বাবা এবং পরিবারের সহযোগিতা-সমর্থন তিনি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের কুচুটে সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করা যে কত কঠিন, সেটা না বললেও চলে। সুনুদি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছোট ছেলে বিজন সরকারও একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বড় ছেলে মিহির সরকার একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত বলে শুনেছিলাম।
চন্দবাড়ির আরেক মেয়ে বেণু ওরফে নারায়ণী চন্দ, আমার বন্ধু এবং মামি। আমার মায়ের কোনো ভাইবোন নেই। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তবে মায়ের কয়েকজন পাতানো ভাই আছে, যারা আমার মামা। এ রকম একজন হলেন নারায়ণ চন্দ্র সাহা। ঢাকার বিক্রমপুরে বাড়ি। চাকরির সুবাদে বোদায় যান গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি কিছুদিন লজিং থাকতেন আমার পিসার বাসায়; অর্থাৎ কার্তিকদা-জ্যোতিষদাদের বাসায়। তখন অবশ্য পিসেমশাই শরৎ চন্দ্র সরকার জীবিত ছিলেন। যা হোক, ওই বাসায় লজিং থাকার সুবাদেই হয়তো আমার মায়ের ভাই হয়ে যান নারায়ণ সাহা। আমার মামা। এই মামাই বিয়ে করেন চন্দবাড়ির মেয়ে বেণুকে। বন্ধু হেয় গেল মামি। বিয়ের পর নতুন সংসার গোছানোর আগে কিছুদিন তাঁরা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারের সঙ্গেও আমার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একসময় এমনও ছিল যে, ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে রাতটা আমি নারায়ণ মামার বাসাতেই কাটাতাম। ততদিনে তাঁদের মেয়ে ও ছেলে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয়। মামার নাম নারায়ণ আর যাকে বিয়ে করলেন তাঁর নাম নারায়ণী। আমাকে আমার দু-এক বন্ধু তখন ঠাট্টা করে বলত, আমার স্ত্রীর নাম নাকি হবে হয় বিভা, না হয় রঞ্জনা! না, সেটা হয়নি।
বেণুও প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেছে। ছেলে বাপ্পা ওরফে স্বরূপ সাহা এসএসসি পাস করে কলকাতায় চলে যায়। এমবিএ পাস করে বাপ্পা এখন বেঙ্গালুরুতে আছে বলে শুনেছি। বাপ্পা আমাকে মামা বলে ডাকে। কী অদ্ভুত সামাজিক সম্পর্কগুলো! বেণুর মেয়ে শম্পা কিছুদিন ঢাকায় ছিল। তারপর নাকি আমেরিকায় চলে গেছে। নারায়ণ মামার জীবনাবসান হয়েছে। মামি এখন অবসরজীবন যাপন করছেন।
নটে গাছটি মুড়োল, চন্দবাড়ির গল্প ফুরোল।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
০৫ মে ২০২২
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।
আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।
যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।
এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।
সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।
সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।
মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।
তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীনতাকেই খোঁজে।

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।
আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।
যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।
এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।
সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।
সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।
মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।
তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীনতাকেই খোঁজে।

কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
০৫ মে ২০২২
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেআসিফ

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।
এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।
এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।
উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—
ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।
আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।
এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।
এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।
উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—
ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।
আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
০৫ মে ২০২২
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেদীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য।
আবু তাহের খান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

কাকু কোনো কথা শোনেন না। একপর্যায়ে পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আমাদের সবাইকে শাসিয়ে তিনি চলে যান। আমরা ভাবলাম, অত পিটুনি খেয়ে তপু হয়তো আর সিনেমা দেখতে যাবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে তপু বলল, ‘মার তো খেয়েই ফেলেছি, তাহলে আর সিনেমা দেখা থেকে বঞ্চিত হব কেন?’
০৫ মে ২০২২
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে