শেখ ফজলে শামস পরশ

খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হইচই। আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মায়ের পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাচ্ছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন, দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।
এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচিকে বললেন, ‘ফাতু (শেখ সেলিম কাকার সহধর্মিণী ফাতেমা চাচি), আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।’
সেলিম কাকা (শেখ সেলিম কাকা) আর চাচি বাবা-মার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই। আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ, মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।
মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।
মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
ওটাই বোধ হয় মায়ের শেষ কথা। এর পর কী হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচি তখন আমাদের নিয়ে তাঁর ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন, যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।
এর পর আর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর মারুফ কাকা অন্য এক গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
এর পর সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচি, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে, ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ওই বাসায় ফিরতে পারব না। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল এক বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নিই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই, আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ। এর পর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।
কোনো বাসায় দুদিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচিদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল। কয়েকটি বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্নেই ছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে সে বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারিনি। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ওই কান্নার আড়ালের অন্তর্নিহিত কারণ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্ট তাঁর বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) ও চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছেন। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল।
আমার চাচির আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর (শেখ সেলিম কাকার শ্বশুর) বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচির বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল।
পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আংকেল। চাচির মেজো ভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা, সেলিম কাকা, মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরই তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর লাশটাও ওরা ফেরত দেয়নি।
সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাইবোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবা কান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ, তখনো আমদের বলা হয়নি যে, আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।
সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচি সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন। সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোনায় ফেলে দেয়।
ঠিক তখনই ওরা গুলি শুরু করে। রুমের কোনায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তো–বা গুলি তাঁর গায়ে লাগেনি। ওই মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেননি। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তো গুলি লাগার পর তাঁর আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।
১৫ আগস্টের পর অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পর অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজো ফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটি বাসা ভাড়া নেন। ওই বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি। তত দিনে সেলিম কাকা, মারুফ কাকাসহ আমার মামারাও (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহ) জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশে তাঁদের জীবন বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আরামবাগের বাসায় মঞ্জু ফুপার সাথে খেলা করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় আমার মাথা ফেটে যায়। বাসায় ডাক্তার এনে মাথায় সেলাই দিতে হয়েছিল। মনে হয় হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না, অথবা সাহস পাননি নিয়ে যেতে আমার দাদি-ফুফুরা।
যেহেতু চাচা-মামারা তত দিনে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, আমরাও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রস্তুতিটা বেশ কঠিন ছিল। প্রথমত, বর্ডার দিয়ে যেতে হবে। কারণ, স্বাভাবিক উপায়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মোশতাক সরকার যদি ধরতে পারে, তাহলে মেরে ফেলবে। নিজের রাষ্ট্র থেকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়, সে অভিজ্ঞতা যে কী পরিমাণ আতঙ্কের হতে পারে, সেটা তখন অনুধাবন না করলেও এখন বুঝতে পারি। চিন্তা করলে আমার পরিবারের সবার জন্য বুক ফেটে যায়। সারা জীবন এই দেশটা সৃষ্টি করতে গিয়ে এবং এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জেল-জুলুম আর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন আমাদের দাদু, বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক রকম হয়রানিও করেছে পাকিস্তানি সরকার। আর সেই দেশ সৃষ্টির মাত্র তিন বছর পরই এই কী পরিণতি! এটা কী রকম বিচার!
দ্বিতীয়ত, বর্ডার পার হয়ে যেতে পারব কি–না, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পথে পথে ভয়। প্রথম প্রচেষ্টায় আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারিনি। আগরতলা বর্ডারের একদম পাশে যে বাসায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, তারা আমাদের গবাদিপশুর সাথে গোয়ালঘরে থাকতে দিয়েছিল। তারা আমাদের ধরিয়ে দেওয়া, আর লুট করার পরিকল্পনা করেছিল। দাদি আড়ি পেতে সেই পরিকল্পনার কথা শুনতে পেয়ে পরদিন সকালে জিনিসপত্র ওই বাসায় রেখে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়ে ফেরত আসেন।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আমরা বর্ডার পাড়ি দিই। এবার আমরা মেহেরপুর দিয়ে যাই। মেহেরপুরের সাবেক এমপি সহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় আমরা আশ্রয় নিই। তাঁর ছেলে, ফরহাদ হোসেনের (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) সাথে আমি দুটি কুকুরের বাচ্চা লালু-ভুলুকে নিয়ে খেলা করি। ফরহাদ আমাদের বয়সী ছিল।
সব ধরনের যানবাহনেই চলতে হয়েছিল বর্ডার পার হতে গিয়ে। গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে ডোবানালাও অতিক্রম করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল গরুর গাড়ি চড়া, ছাউনিঅলা গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে অনেক ঝাঁকি খেতে হয়, মাথায় আঘাত লাগে। আমি কান্নাকাটি করছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দাদি আর রেখা ফুফু (ছোট ফুফু) আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, ‘আর একটু পথ, এই তো চলে এসেছি।’ কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সহ্য করেছিলাম শুধু জেনে যে, ওপারে পৌঁছালে বাবা-মাকে পাব। তখনো আমরা জানি না—বাবা-মা নেই। আমাদের বলা হয়েছিল বাবা-মা আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। ওপারে পৌঁছালে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবেন।
এমনকি ছোট্ট তাপসও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘পরশ দাদা আরেকটু কষ্ট করো। ওপারে গেলেই সেলিম কাকা, মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে।’ ওটাই ছিল আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল।
ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থইথই পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সাথে সেলিম কাকা নজরুল নামে এক লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। উনি না থাকলে হয়তোবা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এল—এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বিএসএফ বর্ডারে পৌঁছলাম। সেখানে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাশতাও খেতে দিয়েছিল।
সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সকল কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে, এবং আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে? সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন।
তাদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেই দিন। তাঁরা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিনড্রেলার বাসায় নিয়ে এলেন। বাসাটি সংলগ্ন সিনড্রেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। এ কারণেই বাসাটি সিনড্রেলার বাসা নামে পরিচিত। ওই বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে।
কান্তা আপু আমাদের থেকে দু-তিন বছরের বড়। এ ছাড়া ওখানে তত দিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন, যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে, তাঁরাও পালিয়ে এসেছিলেন। অনেকে ছিলেন; কিন্তু বাবা-মা ছিল না।
আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেন বাবা-মাকে চাইতে চাইতে আর না পেতে পেতে অতিষ্ঠ। জিদ করে বাবা-মার কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দিই এক সময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিল হয়তোবা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ, আমাদের সেটাই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হতো।
আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাব। একসময় বুঝতে পারলাম, বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা।
যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিছু মাস পর আমরা বাসা বদলি করে আরেকটি বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। ওখানে আরেকটি পরিবার থাকত। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ওই ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই। তবে তাঁর স্ত্রী, তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাঁদের দুই সন্তান—নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সী হবে, আর নান্টু আমার থেকে দু-এক বছরের বড়। শিগগিরই ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতি মাসেই কোনো-না-কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকত। প্রথমটাতে যাওয়ার পর আমার লোভ হয়ে গেল। আমি তারপর থেকে সবগুলো পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগত।
কান্তা আপুও মাঝেমধ্যে আসতেন। আমরা একসঙ্গে খেলা করতাম। একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এক অভিযানে বের হলাম—আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়ে দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায়, ওখানে যাব। আমরা মাঠঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম যে আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা ওঠাতে পারছি না।
দেখলাম, যতই চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে—আমি প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিল। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করল। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পাও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা ওঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফলাফল। আর দাদির কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি। ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত ও মন খারাপ করছিলাম।
স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কী পেরেশানি! স্যান্ডেল–জোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে বুঝলাম, ওর বাবা চাকরিজীবী, সীমিত আয়। তাই আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে।
আমরা একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের ঘরে খেলছি। হঠাৎ দেখি, কে যেন বাইরের দরজায় করা নাড়ছে। শুনলাম পাশের ঘরে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে দেখি দাদি একটা দাঁড়ি ও লম্বা চুলঅলা অল্প বয়সী লোককে ধরে কাঁদছেন। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল চিনতে যে লোকটা আমার মারুফ কাকা। ১৫ আগস্টের পর মারুফ কাকার সাথে মনে হয় ওই প্রথম আমার দেখা। মারুফ কাকাকে চেনাই যাচ্ছিল না। তাঁর যে জংলি অবস্থা! সারা শরীরে তাঁর দাগ আর ক্ষত। পরে শুনলাম মারুফ কাকা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মারুফ কাকা’ ৭১ আর’ ৭৫-এ মোট দুবার যুদ্ধ করেছেন। শুধু’ ৭৫-এ তিনি দুবার তাঁর বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত দুবারই সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়।
চাচি আমাদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। চাচির প্রধান লক্ষ্য ছিল, আমাদের যেন মন খারাপ না হয়; কান্নাকাটি না করি। সুভাষ (শেখ ফাহিম, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট) তখন ছয় মাসের হবে। সেলিম কাকা আর দাদির কাছে সুভাষকে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সার্কাস দেখতে, অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে, আর শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন। আমরা কোনো কিছুতেই ‘না’ করতাম না। চাচি আমাদের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। কারও বোঝার উপায় ছিল না যে, আমরা চাচির সন্তান নই। ২৪ ঘণ্টা চাচি আমাদের পেছনে সময় দিতেন। শুধু রাতে ঘুমাতাম দাদি আর রেখা ফুফুর সাথে। চাচি সারাক্ষণ আমাদের আগলে রাখতেন।
মায়ের শেষ কথাটা—‘আমার পরশ-তাপসকে তুমি দেইখো’, চাচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
একদিন চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। রেখা ফুফুও তখন ছোট, ১৫ বছর বয়স হবে। চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অস্থির আমি, চাচির হাত থেকে ছুটে দৌড় দিই একটা বাসের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপারে। বাসটা বিকট আওয়াজ করে কষে ব্রেক করে। চাচি আর রেখা ফুফু সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিলেন। চাচি তো রীতিমতো কাঁপছিলেন। তিনি কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি কি জবাব দিতাম, যদি কিছু হইতো।’
তখন বুঝলাম যে আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। দেখতে দেখতে এভাবে প্রায় বছর খানেক পেরিয়ে যায়। আমাদেরও বাসা পরিবর্তন করার সময় চলে আসে। বাসা পরিবর্তন করা মানেই মায়ার টানাপোড়েন। আমার তন্দ্রা কাকি, আর নান্টুকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। আমরা বাঙ্গরের আরেকটা এলাকায় বাসা নিই। নতুন বাসাটা দোতলা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আর নতুন এলাকা। আশপাশের প্রতিবেশীরা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আমাদের গ্রহণ করল। আমাদের মা-বাবা না থাকার ঘটনাটা মনে হয় ওরা জানত।
আমরা নিজেরাই তখনো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নই ব্যাপারটাতে। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম যে, মানুষজন আমাদের একটু আলাদা চোখেই দেখত, আর আমাদের একটু বেশি মায়া করত। ওখানে আশপাশে অনেকগুলো পরিবার, বেশির ভাগই অল্পবয়স্ক মেয়েরা। চাচি ও রেখা ফুফুর সাথে ওদের ভালো সখ্য হয়ে গেল। আমার বয়সী মনে হয় তেমন ছেলেপেলে ছিল না বা থাকলেও ওদের সাথে আমার নান্টুর মতো বন্ধুত্ব হলো না।
তবে ওখানে পেলাম অন্যরকম আকর্ষণ। আমাদের ঠিক সামনের বাসাটা একটি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি। এই বাসায় একটা তেজি সেবেল জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল, নাম মিকি। মিকিকে ঠিক সন্ধ্যার সময় বের করে রাস্তায় ছাড়ত। মিকি আমাদের গেটের সামনে আসত আর আমি ওকে বাসা থেকে এনে পাউরুটি খাওয়াতাম। আমার দারুণ ভালো লাগত। মিকিকে বল ছুড়ে মারলে ও বল নিয়ে আসতে পারত।
মিকিদের পাশের বাসাটা একটা দোতলা বাসা। ওই বাসায় একজন বয়স্ক মহিলা থাকতেন। তারও একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল। ওর নামটা আমার মনে নেই। সাদা আর হালকা বাদামি এই শেফার্ডটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল। ও কারও সাথে খেলত না।
সেই বাসায় থাকতে আমি দুটি খরগোশ পালতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, খরগোশ দুটির রক্তাক্ত অর্ধাংশ; ওপরের অংশটা শুধু আছে। বড়রা বোঝালেন, বিড়াল এসে খাঁচা ভেঙে আমার খরগোশ দুটি খেয়ে গেছে। আমি বিস্মিত হলাম আর সারা দিন কাঁদলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিক্ষা নিলাম যে আমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল; ওদের ঘরের ভেতরে আরও নিরাপদে রাখা দরকার ছিল। এটা তখন আমার কল্পনার বাইরে ছিল যে, বাইরের বিড়াল খরগোশ খাবে।
আরও ছোটবেলা থেকেই আমার পশুপাখির প্রতি অনেক ঝোঁক। একবার আমি টুঙ্গিপাড়া থেকে আসার সময় জিদ ও বায়না করে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম লঞ্চে করে ঢাকায়। ওরাও ১৫ আগস্টের শিকার হয়েছিল। আমার নানা, আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায়ও দুটি লাল গরু ছিল। একবার আমি গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে কাছে গিয়েছি। হঠাৎ একটা গরু ছুটে আমাকে তাড়া করেছিল এবং গুঁতাও মেরেছিল। মায়ের কী পেরেশানি! তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু দাদার বাসায় যেতে পছন্দ করার অন্যতম কারণ ছিল, ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু ছিল। কবুতর, কুকুর, মোরগ-মুরগি এবং অন্যান্য। একবার ওই বাসায় গিয়ে দেখি, একটা মুরগি অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে। আমি ওদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম এবং ওদের ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলাম না। বায়না ধরলাম, আমারও ওগুলো লাগবে। মা তো মহা–মুসিবতে পড়লেন। আমি কিছুতেই ওদের পিছ ছাড়ি না। মা আমাকে একরকম জোর করে নিয়ে এলেন।
আমি কাঁদতে কাঁদতে ও-বাসা থেকে চলে এলাম। বাসায় আসার পর বিকেলে দেখি আপন দাদি (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মুরগি আর মুরগির বাচ্চাগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওই বাসায় আমি আপন দাদির অনেক ভক্ত ছিলাম। উনি আমাকে সবকিছুতে প্রশ্রয় দিতেন। আমার নিজের দাদিকে বাদ দিয়ে তাঁকেই ‘আপন দাদি’ বলে ডাকতাম। এই ছিল আমাদের মধুর সম্পর্ক।
আরেকজনের আমি খুব ভক্ত ছিলাম, যিনি হচ্ছেন হাসুমণি (জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা)। তিনি আমার মায়ের শুধু মামাতো বোনই ছিলেন না, মায়ের বান্ধবীও ছিলেন। তাই হাসুমণির কোলে জয়কে (সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য) দেখলে আমি অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করতাম, ‘হাসুমণির কোলে জয় কেন?’
হাসুমণির যেই গুনটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, তা হচ্ছে তাঁর মমত্ববোধ। প্রান্তিক মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সমবেদনা ছিল। শিশুদের থেকে শুরু করে গৃহকর্মীদের প্রতি, এমনকি পশুপাখি ও জীবজন্তুর প্রতিও হাসুমণির প্রচণ্ড মায়া ছিল। এই মানবিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় তিনি সবার থেকে আলাদা। তিনি আমাদের বাচ্চাদের সাথে অত্যন্ত সদয় ছিলেন। বাচ্চাদের তিনি অনেক সময় দিতেন, এবং সত্যিকার অর্থে যত্নশীল ছিলেন শিশুদের মত ও মতামতের প্রতি।
একবার আমরা দিল্লি গেলাম। দাদি-নানি (আমার দাদি আর নানি দুই বোন), রেখা ফুফু আর আমরা দুই ভাই। হাসুমণি, রেহানা ফুফু আমাদের পেয়ে প্রচণ্ড আদর-যত্ন করলেন। তাঁরা মনে হয় আমাদের পেয়ে তাঁদের নিজ শোক সংবরণ করার শক্তি পেলেন। আমার সব দুষ্টামি তাঁরা মেনে নিতেন। জয় অনেক ঠান্ডা প্রকৃতির এবং সৃষ্টিশীল ছিল। সারাক্ষণ প্লেডো দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাত। ওর ধৈর্য দেখে আমি অস্থির হয়ে যেতাম। আমি ওর সাথে দৌড়াদৌড়ি বা ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলতে চাইতাম। কিন্তু ওর ওসব খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। অনেক শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করত। আমি অস্থির হয়ে ওর তৈরি করা সবকিছু ভেঙে দিতাম। ও রাগ করে আমার পিছে দৌড়াত, এতে আমার উদ্দেশ্যও হাসিল হতো। আমি পালাতাম। দাদি আর নানি আমাদের গোলমাল ঠেকাতে এসে মাঝেমধ্যে ব্যথাও পেতেন।
জয় সেটাতে অনেক বিচলিত হয়ে আমার নানিকে বলত, ‘আপনে কেন মাঝখানে এসে ব্যথা পেলেন?’ দাদিকে দেখিয়ে বলত, ‘উনি তো ঠেকাতে আসে না!’ হাসুমণি রেহানা ফুফু কিছুই বলত না। আমাদের এসব কার্যকলাপ দেখে মনে হয় মজা পেতেন। তাঁদের অনেক ধৈর্যশক্তি।
এভাবে প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম বাবা-মা ছাড়া জীবনে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আবার সীমানা পেরিয়ে ফিরে আসা। আমাদের বাঙ্গরের প্রতিবেশীরা অনেক মন খারাপ করল। ওদের সাথে আমাদের খুব আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিল, পরিবারের মতো। ঠিক হলো আমি, তাপস, রেখা ফুফু, দাদি আগে ফিরব। পরে চাচারা আসবে। ফিরে আসতে আসল কষ্টটা ছিল কঠোর বাস্তবতার অনুধাবন যে, বাবা-মা আসলে লন্ডনেও নাই; তাঁরা আকাশে হারিয়ে গেছে অজস্র তারার মাঝে। এই বাস্তবতায় মন মানতে না চাইলেও আমাদের কোনো কিছু করার ছিল না। কাকে কী বলব? কেউ তো ভালো নেই। খামাখা সবাইকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করে লাভ কী? তাঁরা তো বাবা-মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, পারলে তো আগেই দিতেন।
আমার মা গান গাইতে অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় গাইতেন আঞ্জুমান আরা বেগমের সেই বিখ্যাত ঘুমপাড়ানি গান—‘খোকন সোনা বলি শোন/থাকবে না আর দুঃখ কোনো/মানুষ যদি হতে পারো।/এই কথাটি মনে রেখ/দুঃখীজনের সহায় থেকো।’ আমরা দুই ভাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ার সেই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেন ঘুমপাড়ানি এই গানের মধ্য দিয়ে, মা জীবনের সকল উপদেশ দিয়ে গেছেন। শুধু আফসোস মা দেখতে পারলেন না! দেখতে পারলেন না যে, আমরা পড়াশোনা শিখে তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি।
মায়ের লেখাপড়ার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এমএ পরীক্ষার ফল বের হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছিলেন।
আগস্ট মাস এলে মানুষ জানতে চায়, বাবা-মা হারা আমাদের ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে। কেমন ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা? তাঁদের জন্যই আমার এই লেখা। অবশ্যই আমাদের বেড়ে ওঠা আর দশটা বাচ্চার মতো ছিল না। অত্যন্ত কোমল বয়সেই আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। আমি এও জানি, নির্বাসিত শিশু হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা এক আকর্ষণীয় একাডেমিক আলোচনা হিসেবে জায়গা পেতে পারে। তবুও বলব, তুলনামূলকভাবে অনেক এতিম বাচ্চার তুলনায় আমাদের শৈশব কেটেছে পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতায়। আমার আত্মীয়-স্বজনদের আমাদের প্রতি মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বরং আমরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে, বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বঞ্চিত হলেও অন্য স্বজনদের স্নেহ-মমতা আমরা অনেক বেশিই পেয়েছি। যেটা কেউই পায় না। তবে এত আদর-যত্ন, ভালোবাসার মধ্যেও আমি অবশ্যই বাবা-মাকে খুঁজেছি।
মায়ের গাওয়া নির্মলা মিশ্রার আরেকটি গানের কথা মনে হয়—‘ও তোতা পাখীরে/শিকল খুলে উড়িয়ে দিব/আমার মাকে যদি এনে দাও/… ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে,/কখন যে মা গেল চলে? সবাই বলে ওই আকাশে/লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও।’ যতই অনুভূতি রুদ্ধ করে রাখি, যতই খেলাধুলায় মেতে থাকি, শিশুরা যে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াবে—এটাই প্রকৃতির রীতি।
[বি. দ্র. : এই লেখা সম্পূর্ণরূপে আমার শিশুকালের স্মরণশক্তির ওপর ভিত্তি করে লেখা। তাই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই মর্মে যে, যদি ভুলবশত কাউকে আমি ভুলে গিয়ে থাকি। এখানে অনেক ঘটনা অসম্পূর্ণ ও আংশিক সত্য হতে পারে। কারণ, অপরিপক্ব এক ছয় বছরের শিশুর খণ্ড খণ্ড স্মৃতির ওপর এই কাহিনি গাথা। তাই পরিপূর্ণ সত্যতার কোনো দাবি এখানে আমি করছি না। ]
শেখ ফজলে শামস পরশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির বড় ছেলে। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

খুব ভোরে প্রচণ্ড ভাঙচুরের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙে। উঠে দেখি মা নেই পাশে। বিছানায় শুধু আমরা দুই ভাই। জানালা দিয়ে ঝড়ের মতো গোলাগুলি হচ্ছে। গুলিগুলো দেয়াল ফুটো করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। সিঁড়িঘরে অনেক কান্নাকাটির আওয়াজ, হইচই। আমরা দুই ভাই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়িঘরের দিকে গিয়ে দেখি বাবা-মা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়া। মায়ের পা দুটো বাবার বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। দাদির শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি যাচ্ছে, আর দাদি পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন, দেয়ালে কপাল ঠুকছেন।
এ অবস্থায় উনি আমার বড় চাচিকে বললেন, ‘ফাতু (শেখ সেলিম কাকার সহধর্মিণী ফাতেমা চাচি), আরজুর পা দুটি মণির বুকের ওপর থেকে সরাও।’
সেলিম কাকা (শেখ সেলিম কাকা) আর চাচি বাবা-মার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছেন। আর বাবা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মুখে কোনো কষ্টের চিহ্ন নাই। মনে হচ্ছে উনি যেন শান্তির নিদ্রায় বিভোর। শুধু গলায় কণ্ঠমণির নিচে চামড়া উঠে যাওয়ার একটা চিহ্ন। বাবার শরীরের অন্য কোথাও কোনো ক্ষত আমার মনে নাই। আমরা দুই ভাই কান্নাকাটি করছিলাম। মনে হয় আমরা ভয়েই কাঁদছিলাম; কারণ, মৃত্যু কাকে বলে তখনো আমরা জানি না। মৃত্যুর পর যে মানুষকে আর পাওয়া যায় না, সেটাও আমার জানা ছিল না। মৃত্যুর সাথে ওই আমার প্রথম পরিচয়। একসাথে অনেকগুলো মৃত্যু।
মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ।
মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
ওটাই বোধ হয় মায়ের শেষ কথা। এর পর কী হলো আমি জানি না। গুলির আওয়াজ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল এবং কারা যেন এদিকে আবার আসছিল। আমার চাচি তখন আমাদের নিয়ে তাঁর ড্রেসিংরুমে পালালেন। আমাদের মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন, যাতে গুলি না লাগে। গুলি মনে হয় বাথরুমের জানালা দিয়ে ড্রেসিংরুমেও ঢুকে যাচ্ছিল।
এর পর আর বাবা-মার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয় নাই। শুনেছি সেলিম কাকা একটা গাড়িতে করে মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর মারুফ কাকা অন্য এক গাড়িতে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
এর পর সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুই ভাই, চাচি, দাদি, আর রেখা ফুফু এক কাপড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। তখনো বুঝি নাই যে, ওটাই নিজেদের বাসা থেকে আমাদের শেষ প্রস্থান। আর কখনো ওই বাসায় ফিরতে পারব না। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর, আর আমার ভাই তাপসের বয়স চার বছর। আমাদের বাসাটা ছিল ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডে একটা কানাগলির রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই ছিল এক বিদেশি রাষ্ট্রদূত ভবন। আমরা সেখানেই আশ্রয় নিই। ওখান থেকে আমরা দেখতে পাই, আমাদের বাসায় আর্মিদের আনাগোনা, লুটতরাজ। এর পর শুরু হয় আমাদের ভবঘুরে জীবনযাপন; একেক দিন একেক বাসায়।
কোনো বাসায় দুদিন, কোনো বাসায় চার দিন। আশ্রয়ার্থী হিসেবে এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক মাস। আমার কোনো ধারণা ছিল না, কেন আমরা নিজের বাসায় ফেরত যেতে পারছি না। পরে দাদি-চাচিদের মাধ্যমে বুঝলাম যে আর্মিরা আমাদের খুঁজছিল। কয়েকটি বাসায় আর্মিরা আমাদের খুঁজতেও এসেছিল। ভাগ্যিস আমরা সময়মতো সেই বাসা থেকে পালিয়ে অন্য বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
মাহুতটুলিতে মঞ্জু খালার বাসায় আমরা মনে হয় বেশ কিছুদিন ছিলাম। মঞ্জু খালা আমাদের পেয়ে অস্থির! আদর-যত্নেই ছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে সে বাসায়ও শান্তিতে থাকতে পারিনি। চলে আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জু খালা ভীষণ কেঁদেছিলেন। তখনো জানতাম না ওই কান্নার আড়ালের অন্তর্নিহিত কারণ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মঞ্জু খালাও ১৫ আগস্ট তাঁর বাবা (আবদুর রব সেরনিয়াবাত), দুই বোন (আমার মা ও বেবি খালা), ভাই (আরিফ মামা) ও চার বছরের ভাতিজাকে (সুকান্ত বাবু) হারিয়েছেন। তারপর আবার আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়াই তো ওনাদের জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ ছিল।
আমার চাচির আব্বা, মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরীর (শেখ সেলিম কাকার শ্বশুর) বাসায়ও আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই বাসায় আর্মিরা রেইডও করেছিল। চাচির বড়বোন, আনু খালার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান লিমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল।
পরে অনেক কসরত করে এবং ধস্তাধস্তি করে লিমাকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় ওর বাবা আজাদ আংকেল। চাচির মেজো ভাই, বাচ্চু মামাকেও আর্মিরা তুলে নিয়ে যায়। বাচ্চু মামা, সেলিম কাকা, মারুফ কাকাদের সীমানা পার করে দিয়ে আসার পরই তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান কর্নেল শাহরিয়ার। আর তাঁকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর লাশটাও ওরা ফেরত দেয়নি।
সবাই তখন সারাক্ষণ শুধু কাঁদত। কারও সন্তান হারানোর ব্যথা, কারও ভাইবোন হারানোর কষ্ট, আর আমাদের বাবা-মা হারানোর অন্তহীন কান্না। তবে কেউ কারও সামনে কাঁদতে পারত না। আড়ালে গিয়ে বোবা কান্না কাঁদত। আমাদের সামনে সবাই কান্না আড়াল করে ফেলত। কারণ, তখনো আমদের বলা হয়নি যে, আমাদের বাবা-মা আর নেই। এভাবেই জীবননাশের হুমকি আর ভয়ভীতিকে সঙ্গী করে আমাদের শোকাহত পরিবারের জীবনের গাড়ি চলতে থাকে।
সেলিম কাকা আর মারুফ কাকার জীবনে তখন চরম ঝুঁকি। মারুফ কাকা তখন খুনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিতে মেঘালয় চলে যান। সেলিম কাকাকে তো গুলিই করা হয়েছিল। অল্পের জন্য অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান। শুনেছি খুনিরা যখন বাবাকে মারতে আসে, চাচি সেলিম কাকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খবর দেন। সেলিম কাকা হুড়মুড় করে গিয়ে দেখে ওরা বন্দুক তাক করে আছে বাবার দিকে। সেলিম কাকা ওদের ধাক্কা দিলে ওরাও তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িঘরের কোনায় ফেলে দেয়।
ঠিক তখনই ওরা গুলি শুরু করে। রুমের কোনায় এবং নিচে পড়েছিলেন বলে হয়তো–বা গুলি তাঁর গায়ে লাগেনি। ওই মুহূর্তে মা তখন রুম থেকে বের হয়ে এসে বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেননি। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তো গুলি লাগার পর তাঁর আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না।
১৫ আগস্টের পর অনেকে আমাদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। আবার অনেকে জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সবার কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমি দুঃখিত। তবে তখন আমদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইত না। কয়েক মাস পর অনেক কষ্টে রেবা ফুফু (মেজো ফুফু) আরামবাগে আমাদের জন্য একটি বাসা ভাড়া নেন। ওই বাসায় আমরা কয়েক মাস থাকি। তত দিনে সেলিম কাকা, মারুফ কাকাসহ আমার মামারাও (আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহ) জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কারণ, বাংলাদেশে তাঁদের জীবন বাঁচানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আরামবাগের বাসায় মঞ্জু ফুপার সাথে খেলা করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় আমার মাথা ফেটে যায়। বাসায় ডাক্তার এনে মাথায় সেলাই দিতে হয়েছিল। মনে হয় হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিবেশ ছিল না, অথবা সাহস পাননি নিয়ে যেতে আমার দাদি-ফুফুরা।
যেহেতু চাচা-মামারা তত দিনে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, আমরাও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রস্তুতিটা বেশ কঠিন ছিল। প্রথমত, বর্ডার দিয়ে যেতে হবে। কারণ, স্বাভাবিক উপায়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মোশতাক সরকার যদি ধরতে পারে, তাহলে মেরে ফেলবে। নিজের রাষ্ট্র থেকে যখন পালিয়ে বেড়াতে হয়, সে অভিজ্ঞতা যে কী পরিমাণ আতঙ্কের হতে পারে, সেটা তখন অনুধাবন না করলেও এখন বুঝতে পারি। চিন্তা করলে আমার পরিবারের সবার জন্য বুক ফেটে যায়। সারা জীবন এই দেশটা সৃষ্টি করতে গিয়ে এবং এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, জেল-জুলুম আর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন আমাদের দাদু, বঙ্গবন্ধু। শুধু তাই নয়, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেক রকম হয়রানিও করেছে পাকিস্তানি সরকার। আর সেই দেশ সৃষ্টির মাত্র তিন বছর পরই এই কী পরিণতি! এটা কী রকম বিচার!
দ্বিতীয়ত, বর্ডার পার হয়ে যেতে পারব কি–না, সেটার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পথে পথে ভয়। প্রথম প্রচেষ্টায় আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারিনি। আগরতলা বর্ডারের একদম পাশে যে বাসায় আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম, তারা আমাদের গবাদিপশুর সাথে গোয়ালঘরে থাকতে দিয়েছিল। তারা আমাদের ধরিয়ে দেওয়া, আর লুট করার পরিকল্পনা করেছিল। দাদি আড়ি পেতে সেই পরিকল্পনার কথা শুনতে পেয়ে পরদিন সকালে জিনিসপত্র ওই বাসায় রেখে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের নিয়ে পালিয়ে ফেরত আসেন।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আমরা বর্ডার পাড়ি দিই। এবার আমরা মেহেরপুর দিয়ে যাই। মেহেরপুরের সাবেক এমপি সহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় আমরা আশ্রয় নিই। তাঁর ছেলে, ফরহাদ হোসেনের (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) সাথে আমি দুটি কুকুরের বাচ্চা লালু-ভুলুকে নিয়ে খেলা করি। ফরহাদ আমাদের বয়সী ছিল।
সব ধরনের যানবাহনেই চলতে হয়েছিল বর্ডার পার হতে গিয়ে। গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে ডোবানালাও অতিক্রম করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল গরুর গাড়ি চড়া, ছাউনিঅলা গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে অনেক ঝাঁকি খেতে হয়, মাথায় আঘাত লাগে। আমি কান্নাকাটি করছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দাদি আর রেখা ফুফু (ছোট ফুফু) আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, ‘আর একটু পথ, এই তো চলে এসেছি।’ কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সহ্য করেছিলাম শুধু জেনে যে, ওপারে পৌঁছালে বাবা-মাকে পাব। তখনো আমরা জানি না—বাবা-মা নেই। আমাদের বলা হয়েছিল বাবা-মা আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। ওপারে পৌঁছালে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবেন।
এমনকি ছোট্ট তাপসও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘পরশ দাদা আরেকটু কষ্ট করো। ওপারে গেলেই সেলিম কাকা, মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে।’ ওটাই ছিল আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল।
ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থইথই পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সাথে সেলিম কাকা নজরুল নামে এক লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। উনি না থাকলে হয়তোবা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এল—এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বিএসএফ বর্ডারে পৌঁছলাম। সেখানে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাশতাও খেতে দিয়েছিল।
সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সকল কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে, এবং আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে? সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন।
তাদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেই দিন। তাঁরা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিনড্রেলার বাসায় নিয়ে এলেন। বাসাটি সংলগ্ন সিনড্রেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। এ কারণেই বাসাটি সিনড্রেলার বাসা নামে পরিচিত। ওই বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে।
কান্তা আপু আমাদের থেকে দু-তিন বছরের বড়। এ ছাড়া ওখানে তত দিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন, যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে, তাঁরাও পালিয়ে এসেছিলেন। অনেকে ছিলেন; কিন্তু বাবা-মা ছিল না।
আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেন বাবা-মাকে চাইতে চাইতে আর না পেতে পেতে অতিষ্ঠ। জিদ করে বাবা-মার কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দিই এক সময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিল হয়তোবা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ, আমাদের সেটাই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হতো।
আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাব। একসময় বুঝতে পারলাম, বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা।
যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিছু মাস পর আমরা বাসা বদলি করে আরেকটি বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। ওখানে আরেকটি পরিবার থাকত। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ওই ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই। তবে তাঁর স্ত্রী, তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাঁদের দুই সন্তান—নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সী হবে, আর নান্টু আমার থেকে দু-এক বছরের বড়। শিগগিরই ওদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতি মাসেই কোনো-না-কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকত। প্রথমটাতে যাওয়ার পর আমার লোভ হয়ে গেল। আমি তারপর থেকে সবগুলো পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগত।
কান্তা আপুও মাঝেমধ্যে আসতেন। আমরা একসঙ্গে খেলা করতাম। একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এক অভিযানে বের হলাম—আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়ে দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায়, ওখানে যাব। আমরা মাঠঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম যে আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা ওঠাতে পারছি না।
দেখলাম, যতই চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে—আমি প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিল। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করল। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পাও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা ওঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফলাফল। আর দাদির কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি। ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত ও মন খারাপ করছিলাম।
স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কী পেরেশানি! স্যান্ডেল–জোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে বুঝলাম, ওর বাবা চাকরিজীবী, সীমিত আয়। তাই আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে।
আমরা একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের ঘরে খেলছি। হঠাৎ দেখি, কে যেন বাইরের দরজায় করা নাড়ছে। শুনলাম পাশের ঘরে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে দেখি দাদি একটা দাঁড়ি ও লম্বা চুলঅলা অল্প বয়সী লোককে ধরে কাঁদছেন। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল চিনতে যে লোকটা আমার মারুফ কাকা। ১৫ আগস্টের পর মারুফ কাকার সাথে মনে হয় ওই প্রথম আমার দেখা। মারুফ কাকাকে চেনাই যাচ্ছিল না। তাঁর যে জংলি অবস্থা! সারা শরীরে তাঁর দাগ আর ক্ষত। পরে শুনলাম মারুফ কাকা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মারুফ কাকা’ ৭১ আর’ ৭৫-এ মোট দুবার যুদ্ধ করেছেন। শুধু’ ৭৫-এ তিনি দুবার তাঁর বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত দুবারই সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়।
চাচি আমাদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। চাচির প্রধান লক্ষ্য ছিল, আমাদের যেন মন খারাপ না হয়; কান্নাকাটি না করি। সুভাষ (শেখ ফাহিম, এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট) তখন ছয় মাসের হবে। সেলিম কাকা আর দাদির কাছে সুভাষকে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সার্কাস দেখতে, অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে, আর শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন। আমরা কোনো কিছুতেই ‘না’ করতাম না। চাচি আমাদের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। কারও বোঝার উপায় ছিল না যে, আমরা চাচির সন্তান নই। ২৪ ঘণ্টা চাচি আমাদের পেছনে সময় দিতেন। শুধু রাতে ঘুমাতাম দাদি আর রেখা ফুফুর সাথে। চাচি সারাক্ষণ আমাদের আগলে রাখতেন।
মায়ের শেষ কথাটা—‘আমার পরশ-তাপসকে তুমি দেইখো’, চাচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
একদিন চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। রেখা ফুফুও তখন ছোট, ১৫ বছর বয়স হবে। চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অস্থির আমি, চাচির হাত থেকে ছুটে দৌড় দিই একটা বাসের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপারে। বাসটা বিকট আওয়াজ করে কষে ব্রেক করে। চাচি আর রেখা ফুফু সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিলেন। চাচি তো রীতিমতো কাঁপছিলেন। তিনি কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি কি জবাব দিতাম, যদি কিছু হইতো।’
তখন বুঝলাম যে আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। দেখতে দেখতে এভাবে প্রায় বছর খানেক পেরিয়ে যায়। আমাদেরও বাসা পরিবর্তন করার সময় চলে আসে। বাসা পরিবর্তন করা মানেই মায়ার টানাপোড়েন। আমার তন্দ্রা কাকি, আর নান্টুকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। আমরা বাঙ্গরের আরেকটা এলাকায় বাসা নিই। নতুন বাসাটা দোতলা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আর নতুন এলাকা। আশপাশের প্রতিবেশীরা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আমাদের গ্রহণ করল। আমাদের মা-বাবা না থাকার ঘটনাটা মনে হয় ওরা জানত।
আমরা নিজেরাই তখনো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নই ব্যাপারটাতে। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম যে, মানুষজন আমাদের একটু আলাদা চোখেই দেখত, আর আমাদের একটু বেশি মায়া করত। ওখানে আশপাশে অনেকগুলো পরিবার, বেশির ভাগই অল্পবয়স্ক মেয়েরা। চাচি ও রেখা ফুফুর সাথে ওদের ভালো সখ্য হয়ে গেল। আমার বয়সী মনে হয় তেমন ছেলেপেলে ছিল না বা থাকলেও ওদের সাথে আমার নান্টুর মতো বন্ধুত্ব হলো না।
তবে ওখানে পেলাম অন্যরকম আকর্ষণ। আমাদের ঠিক সামনের বাসাটা একটি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি। এই বাসায় একটা তেজি সেবেল জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল, নাম মিকি। মিকিকে ঠিক সন্ধ্যার সময় বের করে রাস্তায় ছাড়ত। মিকি আমাদের গেটের সামনে আসত আর আমি ওকে বাসা থেকে এনে পাউরুটি খাওয়াতাম। আমার দারুণ ভালো লাগত। মিকিকে বল ছুড়ে মারলে ও বল নিয়ে আসতে পারত।
মিকিদের পাশের বাসাটা একটা দোতলা বাসা। ওই বাসায় একজন বয়স্ক মহিলা থাকতেন। তারও একটা জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল। ওর নামটা আমার মনে নেই। সাদা আর হালকা বাদামি এই শেফার্ডটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল। ও কারও সাথে খেলত না।
সেই বাসায় থাকতে আমি দুটি খরগোশ পালতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, খরগোশ দুটির রক্তাক্ত অর্ধাংশ; ওপরের অংশটা শুধু আছে। বড়রা বোঝালেন, বিড়াল এসে খাঁচা ভেঙে আমার খরগোশ দুটি খেয়ে গেছে। আমি বিস্মিত হলাম আর সারা দিন কাঁদলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিক্ষা নিলাম যে আমার আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল; ওদের ঘরের ভেতরে আরও নিরাপদে রাখা দরকার ছিল। এটা তখন আমার কল্পনার বাইরে ছিল যে, বাইরের বিড়াল খরগোশ খাবে।
আরও ছোটবেলা থেকেই আমার পশুপাখির প্রতি অনেক ঝোঁক। একবার আমি টুঙ্গিপাড়া থেকে আসার সময় জিদ ও বায়না করে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম লঞ্চে করে ঢাকায়। ওরাও ১৫ আগস্টের শিকার হয়েছিল। আমার নানা, আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায়ও দুটি লাল গরু ছিল। একবার আমি গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে কাছে গিয়েছি। হঠাৎ একটা গরু ছুটে আমাকে তাড়া করেছিল এবং গুঁতাও মেরেছিল। মায়ের কী পেরেশানি! তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু দাদার বাসায় যেতে পছন্দ করার অন্যতম কারণ ছিল, ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু ছিল। কবুতর, কুকুর, মোরগ-মুরগি এবং অন্যান্য। একবার ওই বাসায় গিয়ে দেখি, একটা মুরগি অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে। আমি ওদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম এবং ওদের ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলাম না। বায়না ধরলাম, আমারও ওগুলো লাগবে। মা তো মহা–মুসিবতে পড়লেন। আমি কিছুতেই ওদের পিছ ছাড়ি না। মা আমাকে একরকম জোর করে নিয়ে এলেন।
আমি কাঁদতে কাঁদতে ও-বাসা থেকে চলে এলাম। বাসায় আসার পর বিকেলে দেখি আপন দাদি (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মুরগি আর মুরগির বাচ্চাগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওই বাসায় আমি আপন দাদির অনেক ভক্ত ছিলাম। উনি আমাকে সবকিছুতে প্রশ্রয় দিতেন। আমার নিজের দাদিকে বাদ দিয়ে তাঁকেই ‘আপন দাদি’ বলে ডাকতাম। এই ছিল আমাদের মধুর সম্পর্ক।
আরেকজনের আমি খুব ভক্ত ছিলাম, যিনি হচ্ছেন হাসুমণি (জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা)। তিনি আমার মায়ের শুধু মামাতো বোনই ছিলেন না, মায়ের বান্ধবীও ছিলেন। তাই হাসুমণির কোলে জয়কে (সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য) দেখলে আমি অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করতাম, ‘হাসুমণির কোলে জয় কেন?’
হাসুমণির যেই গুনটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, তা হচ্ছে তাঁর মমত্ববোধ। প্রান্তিক মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সমবেদনা ছিল। শিশুদের থেকে শুরু করে গৃহকর্মীদের প্রতি, এমনকি পশুপাখি ও জীবজন্তুর প্রতিও হাসুমণির প্রচণ্ড মায়া ছিল। এই মানবিক বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় তিনি সবার থেকে আলাদা। তিনি আমাদের বাচ্চাদের সাথে অত্যন্ত সদয় ছিলেন। বাচ্চাদের তিনি অনেক সময় দিতেন, এবং সত্যিকার অর্থে যত্নশীল ছিলেন শিশুদের মত ও মতামতের প্রতি।
একবার আমরা দিল্লি গেলাম। দাদি-নানি (আমার দাদি আর নানি দুই বোন), রেখা ফুফু আর আমরা দুই ভাই। হাসুমণি, রেহানা ফুফু আমাদের পেয়ে প্রচণ্ড আদর-যত্ন করলেন। তাঁরা মনে হয় আমাদের পেয়ে তাঁদের নিজ শোক সংবরণ করার শক্তি পেলেন। আমার সব দুষ্টামি তাঁরা মেনে নিতেন। জয় অনেক ঠান্ডা প্রকৃতির এবং সৃষ্টিশীল ছিল। সারাক্ষণ প্লেডো দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাত। ওর ধৈর্য দেখে আমি অস্থির হয়ে যেতাম। আমি ওর সাথে দৌড়াদৌড়ি বা ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলতে চাইতাম। কিন্তু ওর ওসব খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। অনেক শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করত। আমি অস্থির হয়ে ওর তৈরি করা সবকিছু ভেঙে দিতাম। ও রাগ করে আমার পিছে দৌড়াত, এতে আমার উদ্দেশ্যও হাসিল হতো। আমি পালাতাম। দাদি আর নানি আমাদের গোলমাল ঠেকাতে এসে মাঝেমধ্যে ব্যথাও পেতেন।
জয় সেটাতে অনেক বিচলিত হয়ে আমার নানিকে বলত, ‘আপনে কেন মাঝখানে এসে ব্যথা পেলেন?’ দাদিকে দেখিয়ে বলত, ‘উনি তো ঠেকাতে আসে না!’ হাসুমণি রেহানা ফুফু কিছুই বলত না। আমাদের এসব কার্যকলাপ দেখে মনে হয় মজা পেতেন। তাঁদের অনেক ধৈর্যশক্তি।
এভাবে প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম বাবা-মা ছাড়া জীবনে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আবার সীমানা পেরিয়ে ফিরে আসা। আমাদের বাঙ্গরের প্রতিবেশীরা অনেক মন খারাপ করল। ওদের সাথে আমাদের খুব আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিল, পরিবারের মতো। ঠিক হলো আমি, তাপস, রেখা ফুফু, দাদি আগে ফিরব। পরে চাচারা আসবে। ফিরে আসতে আসল কষ্টটা ছিল কঠোর বাস্তবতার অনুধাবন যে, বাবা-মা আসলে লন্ডনেও নাই; তাঁরা আকাশে হারিয়ে গেছে অজস্র তারার মাঝে। এই বাস্তবতায় মন মানতে না চাইলেও আমাদের কোনো কিছু করার ছিল না। কাকে কী বলব? কেউ তো ভালো নেই। খামাখা সবাইকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করে লাভ কী? তাঁরা তো বাবা-মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, পারলে তো আগেই দিতেন।
আমার মা গান গাইতে অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় গাইতেন আঞ্জুমান আরা বেগমের সেই বিখ্যাত ঘুমপাড়ানি গান—‘খোকন সোনা বলি শোন/থাকবে না আর দুঃখ কোনো/মানুষ যদি হতে পারো।/এই কথাটি মনে রেখ/দুঃখীজনের সহায় থেকো।’ আমরা দুই ভাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ার সেই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেন ঘুমপাড়ানি এই গানের মধ্য দিয়ে, মা জীবনের সকল উপদেশ দিয়ে গেছেন। শুধু আফসোস মা দেখতে পারলেন না! দেখতে পারলেন না যে, আমরা পড়াশোনা শিখে তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি।
মায়ের লেখাপড়ার প্রতি অনেক ঝোঁক ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এমএ পরীক্ষার ফল বের হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছিলেন।
আগস্ট মাস এলে মানুষ জানতে চায়, বাবা-মা হারা আমাদের ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে। কেমন ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা? তাঁদের জন্যই আমার এই লেখা। অবশ্যই আমাদের বেড়ে ওঠা আর দশটা বাচ্চার মতো ছিল না। অত্যন্ত কোমল বয়সেই আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। আমি এও জানি, নির্বাসিত শিশু হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা এক আকর্ষণীয় একাডেমিক আলোচনা হিসেবে জায়গা পেতে পারে। তবুও বলব, তুলনামূলকভাবে অনেক এতিম বাচ্চার তুলনায় আমাদের শৈশব কেটেছে পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতায়। আমার আত্মীয়-স্বজনদের আমাদের প্রতি মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বরং আমরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে, বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বঞ্চিত হলেও অন্য স্বজনদের স্নেহ-মমতা আমরা অনেক বেশিই পেয়েছি। যেটা কেউই পায় না। তবে এত আদর-যত্ন, ভালোবাসার মধ্যেও আমি অবশ্যই বাবা-মাকে খুঁজেছি।
মায়ের গাওয়া নির্মলা মিশ্রার আরেকটি গানের কথা মনে হয়—‘ও তোতা পাখীরে/শিকল খুলে উড়িয়ে দিব/আমার মাকে যদি এনে দাও/… ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে,/কখন যে মা গেল চলে? সবাই বলে ওই আকাশে/লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও।’ যতই অনুভূতি রুদ্ধ করে রাখি, যতই খেলাধুলায় মেতে থাকি, শিশুরা যে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াবে—এটাই প্রকৃতির রীতি।
[বি. দ্র. : এই লেখা সম্পূর্ণরূপে আমার শিশুকালের স্মরণশক্তির ওপর ভিত্তি করে লেখা। তাই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই মর্মে যে, যদি ভুলবশত কাউকে আমি ভুলে গিয়ে থাকি। এখানে অনেক ঘটনা অসম্পূর্ণ ও আংশিক সত্য হতে পারে। কারণ, অপরিপক্ব এক ছয় বছরের শিশুর খণ্ড খণ্ড স্মৃতির ওপর এই কাহিনি গাথা। তাই পরিপূর্ণ সত্যতার কোনো দাবি এখানে আমি করছি না। ]
শেখ ফজলে শামস পরশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির বড় ছেলে। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা
মাসুদ রানা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

মায়ের মনে হয় অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের ফেলে যেতে। মা পানি খেতে চাচ্ছিলেন এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। বাইরে তখনো গুলির আওয়াজ থামে নাই। ভয়ানক গোলাগুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে জানালা ভাঙচুরের আওয়াজ। মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’
১৪ আগস্ট ২০২১
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে