মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

বঙ্গবন্ধুর সরকারের শাসনামলের মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারত প্রত্যাগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ভারতের সাথে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানি এবং সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মোকাবিলা করে দেশে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যখন অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেমে আসে এক অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবার, মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগের নেতারাসহ দেশের আপামর জনতা যা কোনো দিন কল্পনাও করেনি, ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হলো ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে। অন্যান্য কর্মব্যস্ত দিনের মতো ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেও বঙ্গবন্ধু রাত ৮-৯টায় গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসায় ফেরেন। তারপর যথারীতি আহার ও অন্যান্য কার্য শেষ করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে গেলেন। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাবেন। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক দলের অপারেশন কমান্ডার আর্মার্ড কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখ তাঁদের অধীন সৈন্য, ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান নিয়ে ১৪ আগস্ট রাত থেকেই অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি দল ধানমন্ডি ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ও ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়ি ঘেরাও করে আক্রমণ করে। শেষোক্ত দুজনের বাড়িতে ভোর ৫টার আগেই আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী ও পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্তসহ সেরানিবাতের বাড়িতে সেই রাতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন আত্মীয় ও আশ্রিতজন এবং গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করে। এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিশ্বস্ত মেজর মহিউদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আক্রমণকারী সেনাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। তখন ভোর সাড়ে ৫টা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দিকে বেশ কয়েকটি ফোন করেন। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও খবর দিতে বলেন যেন সেনাপ্রধান ফোর্স পাঠান। কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেনাপ্রধানের কথা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেটআউট। আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বাড়ির গেটের সামনে গোলমাল ও উত্তেজনা দেখে নিচে নেমে আসেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে ঘাতক সৈনিকেরা শেখ কামালকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পথে মেজর নূরসহ কয়েকজনের মুখোমুখি হন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ অমনি অতর্কিত ব্রাশফায়ারে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তিনি সিঁড়িতে পড়ে গেলেন। তারপর একে একে হত্যা করা হয় শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীকে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের এবং সর্বশেষে কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে। আক্রমণকালে ওই বাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। সে জন্য তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। অন্য অফিসাররা টার্গেট করা বাড়িগুলোর চারদিকে সম্ভাব্য বাধাদানে আসা কোনো পুলিশ বা সৈন্যদের প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয়সাধন।
জেনারেল সফিউল্লাহ যখন বঙ্গবন্ধুর ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। সেনাপ্রধান বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোন করে প্রথম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও শাফায়াত জামিল কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখকেও ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ট্রুপস মুভ করাতে পারেননি। তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেন।
অপারেশন শেষ করে মেজর ডালিম ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং নিজেই বেতারে প্রচার করলেন ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সকাল ৭টায় ঢাকা বেতারে ফারুক হোসেইনের নিয়মিত সংবাদ পাঠে জানা গেল, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে মানুষটি তাঁর সারা জীবন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাঁকে কিনা হত্যা করেছে একদল বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী সৈনিক। আর্মার্ড কোরের মাত্র দুটি ইউনিট এ অভিযানে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও চাইলেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাবু করতে পারত। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তারা তা করেনি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা ভালোবাসেন কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন বা আলোচনা করেন, তাঁরা অনেক সময় বিস্ময় বোধ করেন বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু করে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তেরো বছরের অধিক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বলতে গেলে তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দিশালায়, তিনি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, দীর্ঘসময় অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, ক্ষমতার লোভ কিংবা সম্পদের উচ্চাভিলাষ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি, সেই মানুষটিকে বাঙালিরা কীভাবে হত্যা করল? তাহলে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, ছলচাতুরী এই সব কি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কেমন দেশ বা এ কেমন জাতি? যার মুখের কথা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক জমা হতো, আর যাকে লক্ষ লক্ষ লোক মিছিল করে অভ্যর্থনা করত, যার জয়ধ্বনিতে গগন বিদারিত হতো, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মনে কোনো দুঃখ হলো না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হতো না, আর বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না, তার হত্যার সাথে সাথে সবাই তার কথা হেলায় মন থেকে মুছে ফেলল। এ ঘটনার নজির খুঁজে বের করা কঠিন। এ ব্যাপারে আজও অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তিনি নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। তাঁর এ বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। বাংলাদেশকে ও বাঙালিদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এর প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ১৯৫০-এর মন্বন্তরের সময় মুসলিম যুব কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও সেবাদান করার মধ্যে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আহতদের সেবা করেছেন। ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা হামলার সময়, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়ে বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যেমন এ দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ডাকে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছে। তাঁর একটি স্বপ্ন বাংলার মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাস করুক। আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের স্থান করে নিক। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষুক জাতির পৃথিবীতে কোনো সম্মান নেই।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রারম্ভে উল্লিখিত তাঁর নোটবুকে ৩০.০৫.৭৩ তারিখে ইংরেজিতে লেখা একটি উক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাংলার মানুষের প্রতি হৃদয়ের এই উষ্ণতা ও ভালোবাসার কারণে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মুখে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান ও চিন্তিত হয়ে অনেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের সোর্স মারফত জানতে পারে যে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে ‘র’-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক আর এন কাড ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করলে বঙ্গবন্ধু তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’
বাংলার মানুষের প্রতি এই অবিচল ও সীমাহীন বিশ্বাসই তাঁর উত্তম চরিত্রের ও মহৎ গুণাবলির বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস একদল বিপথগামী বাঙালিই তাঁকে হত্যা করেছে। তবে হত্যাকারীরা বাঙালি হলেও তারা ছিল বহিঃশত্রুর মদদপুষ্ট ও বেতনভুক্ত জল্লাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘মোশতাক-ফারুক-রশীদরা চেয়েছিলেন’ যেকোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ফারুক-রশীদ পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেছেন বিলম্বে। তাঁরা কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেননি। কলকাতায় অবস্থান করেছেন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পৃথিবীর কোটি কোটি দরিদ্র, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩) পর অবশ্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একে একে আমাদের সবাইকে এভাবে শেষ করা হবে। এবার টার্গেট করা হবে আমাকে।’
কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো মনের অগোচরে তিনি এ কথাটি বলে ফেলেছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় খন্দকার মোশতাক এর বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করেন, কিন্তু জেনারেল এমএজি ওসমানী বা ব্যারিস্টার মইনুলের মতো পদত্যাগ করেননি। তিনি পার্লামেন্টেও ছিলেন, মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে খন্দকার মোশতাক ১৪ আগস্ট বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, এ ছাড়া শেখ কামালের বিবাহের উকিলও ছিলেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক আর কাকে বলে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়াস চলে। কিন্তু ঘন কালো মেঘের আড়ালে লুকায়িত সূর্যের উদয়কে যেমন ঠেকানো যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এবং ২০০৯ থেকে একনাগাড়ে আরও তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে যেমন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমনি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বৈরী সময়ের ঘটনাবহুল শাসনামলের আজ নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশ ও জাতিকে শূন্যাবস্থা থেকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, উগ্রবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঁচাত্তরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট কোনো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল।’ পরের প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল টু মাচ। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার হানি না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উৎসই ছিল জনগণ। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে, প্রতারিত, শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্দোলন-সংগ্রাম নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত এবং ত্যাগেই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি তাঁর আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না’ (১৬.৮.১৯৭৫)।
কিউবার সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মতোই বিশাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বিবিসি প্রচার করে, শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত মন্তব্য করেন আপসহীন-সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট মন্তব্য করেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বেতারে শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাহিত্যিক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হবেন।’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ। আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জার্মানিতে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় ভারতে আসার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারকে শেখ হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট দেখালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে সেই অফিসার শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ছিঃ, তোমরা বাংলাদেশিরা জঘন্য জাতি। যে মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’ শেখ হাসিনা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এয়ারপোর্টের লোক দেখল দুই বোনের আহাজারি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জনমত জরিপে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪১১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত হন। যুগে যুগে যেসব বাঙালি মনীষী, কবি সাহিত্যিক বাংলাকে ভালোবেসে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলা যায়:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
(রচনাটি লেখকের ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব-জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

বঙ্গবন্ধুর সরকারের শাসনামলের মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারত প্রত্যাগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ভারতের সাথে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানি এবং সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মোকাবিলা করে দেশে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যখন অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেমে আসে এক অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবার, মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগের নেতারাসহ দেশের আপামর জনতা যা কোনো দিন কল্পনাও করেনি, ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হলো ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে। অন্যান্য কর্মব্যস্ত দিনের মতো ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেও বঙ্গবন্ধু রাত ৮-৯টায় গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসায় ফেরেন। তারপর যথারীতি আহার ও অন্যান্য কার্য শেষ করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে গেলেন। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাবেন। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক দলের অপারেশন কমান্ডার আর্মার্ড কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখ তাঁদের অধীন সৈন্য, ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান নিয়ে ১৪ আগস্ট রাত থেকেই অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি দল ধানমন্ডি ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ও ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়ি ঘেরাও করে আক্রমণ করে। শেষোক্ত দুজনের বাড়িতে ভোর ৫টার আগেই আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী ও পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্তসহ সেরানিবাতের বাড়িতে সেই রাতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন আত্মীয় ও আশ্রিতজন এবং গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করে। এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিশ্বস্ত মেজর মহিউদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আক্রমণকারী সেনাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। তখন ভোর সাড়ে ৫টা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দিকে বেশ কয়েকটি ফোন করেন। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও খবর দিতে বলেন যেন সেনাপ্রধান ফোর্স পাঠান। কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেনাপ্রধানের কথা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেটআউট। আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বাড়ির গেটের সামনে গোলমাল ও উত্তেজনা দেখে নিচে নেমে আসেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে ঘাতক সৈনিকেরা শেখ কামালকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পথে মেজর নূরসহ কয়েকজনের মুখোমুখি হন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ অমনি অতর্কিত ব্রাশফায়ারে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তিনি সিঁড়িতে পড়ে গেলেন। তারপর একে একে হত্যা করা হয় শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীকে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের এবং সর্বশেষে কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে। আক্রমণকালে ওই বাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। সে জন্য তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। অন্য অফিসাররা টার্গেট করা বাড়িগুলোর চারদিকে সম্ভাব্য বাধাদানে আসা কোনো পুলিশ বা সৈন্যদের প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয়সাধন।
জেনারেল সফিউল্লাহ যখন বঙ্গবন্ধুর ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। সেনাপ্রধান বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোন করে প্রথম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও শাফায়াত জামিল কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখকেও ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ট্রুপস মুভ করাতে পারেননি। তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেন।
অপারেশন শেষ করে মেজর ডালিম ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং নিজেই বেতারে প্রচার করলেন ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সকাল ৭টায় ঢাকা বেতারে ফারুক হোসেইনের নিয়মিত সংবাদ পাঠে জানা গেল, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে মানুষটি তাঁর সারা জীবন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাঁকে কিনা হত্যা করেছে একদল বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী সৈনিক। আর্মার্ড কোরের মাত্র দুটি ইউনিট এ অভিযানে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও চাইলেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাবু করতে পারত। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তারা তা করেনি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা ভালোবাসেন কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন বা আলোচনা করেন, তাঁরা অনেক সময় বিস্ময় বোধ করেন বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু করে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তেরো বছরের অধিক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বলতে গেলে তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দিশালায়, তিনি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, দীর্ঘসময় অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, ক্ষমতার লোভ কিংবা সম্পদের উচ্চাভিলাষ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি, সেই মানুষটিকে বাঙালিরা কীভাবে হত্যা করল? তাহলে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, ছলচাতুরী এই সব কি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কেমন দেশ বা এ কেমন জাতি? যার মুখের কথা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক জমা হতো, আর যাকে লক্ষ লক্ষ লোক মিছিল করে অভ্যর্থনা করত, যার জয়ধ্বনিতে গগন বিদারিত হতো, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মনে কোনো দুঃখ হলো না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হতো না, আর বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না, তার হত্যার সাথে সাথে সবাই তার কথা হেলায় মন থেকে মুছে ফেলল। এ ঘটনার নজির খুঁজে বের করা কঠিন। এ ব্যাপারে আজও অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তিনি নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। তাঁর এ বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। বাংলাদেশকে ও বাঙালিদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এর প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ১৯৫০-এর মন্বন্তরের সময় মুসলিম যুব কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও সেবাদান করার মধ্যে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আহতদের সেবা করেছেন। ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা হামলার সময়, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়ে বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যেমন এ দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ডাকে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছে। তাঁর একটি স্বপ্ন বাংলার মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাস করুক। আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের স্থান করে নিক। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষুক জাতির পৃথিবীতে কোনো সম্মান নেই।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রারম্ভে উল্লিখিত তাঁর নোটবুকে ৩০.০৫.৭৩ তারিখে ইংরেজিতে লেখা একটি উক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাংলার মানুষের প্রতি হৃদয়ের এই উষ্ণতা ও ভালোবাসার কারণে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মুখে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান ও চিন্তিত হয়ে অনেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের সোর্স মারফত জানতে পারে যে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে ‘র’-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক আর এন কাড ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করলে বঙ্গবন্ধু তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’
বাংলার মানুষের প্রতি এই অবিচল ও সীমাহীন বিশ্বাসই তাঁর উত্তম চরিত্রের ও মহৎ গুণাবলির বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস একদল বিপথগামী বাঙালিই তাঁকে হত্যা করেছে। তবে হত্যাকারীরা বাঙালি হলেও তারা ছিল বহিঃশত্রুর মদদপুষ্ট ও বেতনভুক্ত জল্লাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘মোশতাক-ফারুক-রশীদরা চেয়েছিলেন’ যেকোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ফারুক-রশীদ পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেছেন বিলম্বে। তাঁরা কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেননি। কলকাতায় অবস্থান করেছেন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পৃথিবীর কোটি কোটি দরিদ্র, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩) পর অবশ্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একে একে আমাদের সবাইকে এভাবে শেষ করা হবে। এবার টার্গেট করা হবে আমাকে।’
কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো মনের অগোচরে তিনি এ কথাটি বলে ফেলেছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় খন্দকার মোশতাক এর বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করেন, কিন্তু জেনারেল এমএজি ওসমানী বা ব্যারিস্টার মইনুলের মতো পদত্যাগ করেননি। তিনি পার্লামেন্টেও ছিলেন, মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে খন্দকার মোশতাক ১৪ আগস্ট বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, এ ছাড়া শেখ কামালের বিবাহের উকিলও ছিলেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক আর কাকে বলে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়াস চলে। কিন্তু ঘন কালো মেঘের আড়ালে লুকায়িত সূর্যের উদয়কে যেমন ঠেকানো যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এবং ২০০৯ থেকে একনাগাড়ে আরও তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে যেমন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমনি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বৈরী সময়ের ঘটনাবহুল শাসনামলের আজ নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশ ও জাতিকে শূন্যাবস্থা থেকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, উগ্রবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঁচাত্তরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট কোনো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল।’ পরের প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল টু মাচ। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার হানি না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উৎসই ছিল জনগণ। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে, প্রতারিত, শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্দোলন-সংগ্রাম নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত এবং ত্যাগেই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি তাঁর আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না’ (১৬.৮.১৯৭৫)।
কিউবার সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মতোই বিশাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বিবিসি প্রচার করে, শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত মন্তব্য করেন আপসহীন-সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট মন্তব্য করেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বেতারে শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাহিত্যিক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হবেন।’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ। আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জার্মানিতে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় ভারতে আসার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারকে শেখ হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট দেখালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে সেই অফিসার শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ছিঃ, তোমরা বাংলাদেশিরা জঘন্য জাতি। যে মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’ শেখ হাসিনা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এয়ারপোর্টের লোক দেখল দুই বোনের আহাজারি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জনমত জরিপে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪১১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত হন। যুগে যুগে যেসব বাঙালি মনীষী, কবি সাহিত্যিক বাংলাকে ভালোবেসে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলা যায়:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
(রচনাটি লেখকের ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব-জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৪ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৪ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৪ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেশহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।
সেলিম জাহান

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৪ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৪ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেমৃত্যুঞ্জয় রায়

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।
সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।
এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।
জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।
এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।
আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা। সেখান থেকে আবার আরেকটি উড়োজাহাজ ধরে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানো। যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তিকর সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মধ্যেই মাথায় মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি কথা—এত লম্বা পথে প্রায় ৪০০ মানুষ আর তাদের ব্যাগেজ নিয়ে এই মহাযানকে উড়ান দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল বেগে ছুটে চলতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে! আর সে শক্তির জন্য কী পরিমাণ জ্বালানি বয়ে নিতে হচ্ছে, তা পোড়াতেও হচ্ছে।
সব সময় তো আমরা পৃথিবীর বুকে চলা লাখ লাখ গাড়িকে দুষছি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর অন্যতম প্রধান খলনায়ক হিসেবে, উড়োজাহাজগুলোর কথা কি আমরা কখনো সেভাবে ভাবি? উড়োজাহাজগুলো কি সত্যিই পরিবেশ দূষণ করছে? সরল জবাব হলো, হ্যাঁ, করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বায়ুমণ্ডলে নন-কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করছে। উড়োজাহাজগুলো পরিবেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে। কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি সেসব যান পুড়িয়ে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ করছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনে তার প্রভাব পড়ছে কতটুকু—এসব প্রশ্নও মাথার মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। জানা গেল, উড়োজাহাজগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী মোট কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনে প্রায় আড়াই শতাংশ অবদান রয়েছে উড়োজাহাজ চলাচলে, যা মোট জলবায়ু প্রভাব হিসাবে ৪ শতাংশ নিরূপিত হয়েছে।
এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মুহূর্তেই সেসব উত্তর পাওয়া যায়। এমনকি কোন ফ্লাইট এখন আকাশের কোথায় অবস্থান করছে, গন্তব্যে পৌঁছাতে কতটুকু সময় লাগবে, তা-ও মানচিত্রে দেখা যায়। কয়েক দিন আগে এ রকম একটি ফ্লাইট নম্বর দিয়ে একটি অ্যাপসের সাহায্যে অনুসন্ধান করতেই ফ্লাইট চলাচলের যে ছবিটি মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল, তা দেখে মনে হলো বিশাল আকাশে আসলে খালি জায়গা কোথায়? সব তো দখল করে ফেলেছে নিত্য চলাচল করা উড়োজাহাজগুলো। জানা গেল, রোজ মানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর আকাশে প্রায় এক লাখ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে। রোজ ১৫ থেকে ২০ হাজার উড়োজাহাজ এসব ফ্লাইট পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও মালামাল বহন, সামরিক ও ব্যক্তিগত উড়োজাহাজও। যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের সংখ্যাই যে সবচেয়ে বেশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সারা বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী উড়োজাহাজে চলাচল করে। উড়োজাহাজের এই পরিষেবা দিতে বছরে ৮৫০০ লাখ টনের বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন ঘটছে, ২০৫০ সালে যা আরও অনেক বাড়বে। পৃথিবীতে প্রধান ১০টি কার্বন নিঃসরণকারীর মধ্যে উড়োজাহাজশিল্প একটি।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকায় সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেখানকার বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা। উড়োজাহাজে চড়ে তার বাইরের তাপমাত্রা কত, তা-ও মনিটরে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখছি, এয়ারক্রাফটের বাইরে বাতাসের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরূপ ঠান্ডায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য ও গ্যাস নির্গত হচ্ছে, সেগুলো ঘন মেঘের মতো জমে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে গভীর আকাশে মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার পর আমরা যেসব ঘন সাদা মেঘের মতো সরল রেখা বা দীর্ঘ দাগ দেখি, এগুলো হলো তাই। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে কন্ট্রেইল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে অতি উচ্চতায় থাকার কারণে সেসব উড়োজাহাজ থেকে যেসব রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, তা এককভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে নাইট্রাস অক্সাইড। উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া এসব জমাটবদ্ধ বাষ্পের রেখাগুলো তাপ আটকে রাখতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের আগে যেসব ধারণা ছিল, বাস্তবে এখন গবেষণা করে তার চেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া উড়োজাহাজ থেকে নির্গত অন্যান্য বায়ুদূষণের মধ্যে রয়েছে জলীয় বাষ্প, স্যুট এবং সালফেটজাতীয় অ্যারোসল। এগুলোও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ও ঘন মেঘ গঠন করে। এর কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে যেখানে ওজোনস্তর রয়েছে সেখানেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় যা এসব উড়োজাহাজ চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেগুলোও পরিবেশদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হাসির কথা হলো, আমরা গবেষণা করে যত বেশি আধুনিক উড়োজাহাজ তৈরি করছি, সেগুলো প্রাচীন উড়োজাহাজের চেয়ে বরং বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে। এগুলো যত বেশি উচ্চতা দিয়ে উড়ছে, তত বেশি দীর্ঘস্থায়ী কন্ট্রেইল বা জমাটবদ্ধ ঘন মেঘের রেখা তৈরি করছে, যা তাপ বাড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক মেঘের মতোই এসব কন্ট্রেইল বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত তাপ ধরে রাখে এবং জেট জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বনের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বেশি অবদান রাখে। এ নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণাকাজও করা হয়েছে। সে গবেষণা দলের প্রধান গবেষক ও গবেষণাপত্রের লেখক ড. এডওয়ার্ড গ্রিসপেয়ার্ডট বলেছেন, অনেকে বোঝেন না যে কন্ট্রেইল ও জেট ফুয়েলের কার্বন নির্গমন জলবায়ুকে দ্বিগুণভাবে উষ্ণ করছে।
জেট প্লেনগুলো ওড়ে ৪০ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে, আধুনিক প্লেনগুলো ওড়ে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে এবং প্রাচীন প্লেনগুলো ওড়ে ৩১ থেকে ৩৮ হাজার ফুটের মধ্যে। উঁচুতে থাকা প্লেনগুলো বেশি কন্ট্রেইল তৈরি করে, নিচুতে থাকাগুলো করে কম। সে গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে কন্ট্রেইল পরিবেশের জন্য উড়োজাহাজের কার্বন নির্গমনের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতিকর, যার কারণে উড়োজাহাজ চলাচলের মোট জলবাযু প্রভাবের প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিম লাইনারের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের কন্ট্রেইল পুরোনো মডেলের চেয়ে বেশি তৈরি হয়। এই গবেষণায় গবেষকেরা নাসার জিওইএস-আর উপগ্রহ থেকে নেওয়া স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করেছেন, যা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজগুলোর ৬৪ হাজারের বেশি কন্ট্রেইল ট্র্যাক করতে সাহায্য করেছে।
এ দৃশ্যের বাইরেও রয়েছে আরও এক দৃশ্য। রোজ প্রায় ১৩ লাখ যাত্রীর খাবার থেকে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? উড়োজাহাজভিত্তিক অন-বোর্ড পরিষেবা, টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ, উড়োজাহাজ শিল্পজনিত বর্জ্য ইত্যাদি কারণেও পরিবেশদূষণ বাড়ছে। এ থেকে দ্রুত নিষ্কৃতি পাওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। কার্বনমুক্ত উড়োজাহাজ চালনা এখনো এক স্বপ্নের ব্যাপার। কেননা, গাড়ির মতো আমরা ইলেকট্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করতে পারিনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহারের সুযোগও তৈরি হয়নি। কেননা, উড়োজাহাজ চালাতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে সেটি কখনো ব্যাটারি দিয়ে সম্ভব নয়। উড়োজাহাজের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ হাইড্রোজেন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ঝুঁকি আছে অনেক বেশি। এতে দাহ্যতার কারণে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। উড়োজাহাজ চালনার জন্য টেকসই জ্বালানি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং উৎপাদনের জন্য ব্যাপক জমি ও পানিসম্পদের দরকার হয়। এ মুহূর্তে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষাও দরকার। কাজেই সে লাইনেও যাওয়া ঠিক হবে না।
আশঙ্কার কথা হলো, দিন দিন অন্যান্য পরিবহন খাতের তুলনায় প্রয়োজনেই উড়োজাহাজের চলাচল দ্রুত হারে বাড়ছে। যদি তা কমানো বা নিয়ন্ত্রণের কোনো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনে বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে তার প্রভাবও বাড়বে। গবেষকদের মতে, এখনই ভাবার সময় এসেছে উড়োজাহাজের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উড়ানে আরও বেশি দক্ষ ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার এবং বিমান চলাচলকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পরিবেশদূষণের ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা পরিবেশ উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৪ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৪ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।
টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সবাই দেখেছেন। কে এই আততায়ী, তা নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। কেউ কেউ বলছেন, মোটরসাইকেলে থাকা দুই দুর্বৃত্ত ওসমান হাদির সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিল।
তফসিল ঘোষণার পরদিন এ রকম এক সহিংসতার ঘটনা ঘটায় অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। যে উৎসবের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সে নির্বাচনের পথে যাত্রার সময়টা এ রকম ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল কেন, সে প্রশ্ন উঠেছে। ওসমান হাদির মতো একজন সুপরিচিত নেতার জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা এই হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই।
টার্গেট কিলিং নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছেন। একজন নেতা বলেছেন, অন্তত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ৫০ জন নেতা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হতে পারেন। এ ধরনের তথ্য দেওয়া হলে তার উৎস ও প্রমাণও হাজির করা উচিত। যদি কেউ সে রকম ষড়যন্ত্র করে থাকে, তবে তার মুখোশ উন্মোচন করাও জরুরি।
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ। কিন্তু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজগুলো করা হলে এবং যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো পরিচালনা করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সত্যিই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অনুকূল হয়ে উঠতে পেরেছে—এই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে তাদের নৈতিক মনোবল যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে, তাতে তাদের কাছ থেকে সত্যিই কি দক্ষ সেবা পাওয়া সম্ভব? মনোবলহীন একটি বাহিনী কতটা সাহসী পদক্ষেপ রাখতে পারে?
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে বিএনপির একজন সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপরও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের পর বিষয়টিকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না। নির্বাচনী ময়দানকে বিশৃঙ্খল করে তোলার জন্য শক্তিশালী কোনো মহল কি এসব কাজে মদদ দিচ্ছে? কারা এসব ঘটাচ্ছে, তা নিয়ে নিবিড় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো গায়েবি হত্যাকারীর গল্প তৈরি করে সত্যিকারের খুনিদের আড়াল করার চেষ্টা হলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে। সত্যিকারের অপরাধীরা ধরা পড়লেই কেবল তাদের লক্ষ্য, তাদের পেছনে কারা সক্রিয় ইত্যাদি বেরিয়ে আসবে। আর সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে কীভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে পারবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রার্থীকে ঘিরে তাঁর সমর্থকদেরও একটা নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে বলিষ্ঠভাবে—এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটবে না।

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৪ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৪ ঘণ্টা আগে
অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলো। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের পথরেখা বেঁধে দিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তফসিল নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন একটি সুস্থির সমাজব্যবস্থার দিকে দেশকে পরিচালিত করবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সদ্য পদত্যাগকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ কার্যকর হয়েছে। এই দুই উপদেষ্টার নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও সক্রিয় দেখা গেছে নানাভাবে। বিভিন্ন দলের নেতাদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন, কথা বলছেন। এরই মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু সংকট তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না, তা নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। যে চাপের কথা তারেক রহমান নিজেই বলেছেন, সেই চাপ দেশের অভ্যন্তরের নাকি বিদেশি কোনো শক্তির তরফ থেকে—সে কথাও আলোচিত হয়েছে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোট সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট, দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে প্যারালাল সরকার চালানোর অভিযোগসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এদিকে ডাকসু নেতাদের কিছু কথা, কিছু কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন জেগেছে মানুষের মনে। তফসিল ঘোষণার দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এক নেতাকে একজন ডাকসু নেতার নেতৃত্বে হেনস্তা করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো, দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়কদের নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন। অজস্র মিথ্যার বেসাতি গড়ে তোলা হচ্ছে, অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করা, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলাসহ বহু অভিযোগ ছিল। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ আমলে, তারাই ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর যে রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তা মোটেই জনগণের প্রত্যাশিত রূপ নয়। সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন দলের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পদ-বাণিজ্য, খুনোখুনির খবর ভেসে আসছে। যে ছাত্র নেতৃত্বের ওপর ভরসা রাখার কথা ভেবেছে তরুণ প্রজন্ম, সেই তরুণেরাও আজ দ্বিধান্বিত। এ রকম এক অস্থির সময়ে আসছে নির্বাচন। আশা থাকবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ব্যবসায়ীদের অবাধে কাজের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজি বন্ধ, সাধারণ মানুষের জীবন ও কাজের নিরাপত্তাসহ কল্যাণকর কাজগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। তবেই অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার একটা উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে।

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১৪ ঘণ্টা আগে
৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেলাম ঢাকা থেকে কাতারের দোহা। এরপর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বিশাল এয়ারক্রাফটে ৩৮ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে দোহা থেকে উড়াল দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার উদ্দেশে। লম্বা পথ, ১৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের একটানা চলা।
১৪ ঘণ্টা আগে
এই সম্পাদকীয়টি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদি সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর ফাঁকে রিকশায় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় মোটরসাইকেলে বসা দুর্বৃত্ত।
১৪ ঘণ্টা আগে