জাহীদ রেজা নূর

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।
জাহীদ রেজা নূর

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।

জেলের ভেতর মুনীর চৌধুরী একটা চিরকুট পেলেন। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা। সেটা ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাস। চিরকুটে মুনীর চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লেখার জন্য। একাঙ্কিকা। জেলের ভেতরেই যেন তার অভিনয় করা যায়, এ রকমভাবে লিখতে হবে।
মুনীর চৌধুরী এই অনুরোধটি রাখলেন এবং যা সৃষ্টি করলেন, তা হয়ে রইল আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অক্ষয় দলিল।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেলখানাতেই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল।
রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, সে কথায় কার কী এসে যায়?
দুই.
রণেশ দাশগুপ্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক লেখার জন্য মুনীর চৌধুরীকে চিঠিটি লিখেছিলেন কি স্বাধীন পাকিস্তানের মুক্ত ভূমি থেকে, নাকি তিনিও ছিলেন জেলে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, আমরা এই কমরেডের জীবনী পড়তে গেলে পাই যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর বিপজ্জনক বিবেচনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু চার মাস পর আবার বন্দী হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি জেলেই ছিলেন। জেল থেকেই লিখেছিলেন এই চিরকুট। বিনা বিচারে আটক রাজবন্দী রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন ১৯৫৫ সালে।
১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠিত হলে অনেক কমিউনিস্টই সে দলে যোগ দেন। সে সময় রণেশ দাশগুপ্ত বামপন্থীদের পত্রিকা দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। যত দিন বাংলাদেশে ছিলেন, তত দিন দৈনিক সংবাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ছিল।
তিন
ঢাকার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়া ১৯৩৪ সাল থেকে। এর আগে ১৯৩১ সালে একবার ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত সারা বাংলার কলেজছাত্রদের জন্য একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেই পুরস্কার আনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
জীবনী লিখছি না। শুধু জানিয়ে রাখি, তাঁর জন্ম হয়েছিল ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে, ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। ডিব্রুগড় ছিল রণেশের মা ইন্দুপ্রভা (সেন) দাশগুপ্তের পিত্রালয়। ইন্দুপ্রভার বাবা কালীমোহন সেনের আদিনিবাস ছিল বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে।
রণেশের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। রাঁচিতেই তাঁর চাকরি হয়।
রণেশের ডাকনাম ছিল খোকা। রাঁচি জেলা স্কুল থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। বিজ্ঞানে পড়বেন বলে ভর্তি হন বাঁকুড়া খ্রিস্টিয়ান কলেজে। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন আইএসসি। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে, সেখানে ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
বরিশালে তিনি উঠেছিলেন তাঁর জেঠু সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের জেঠতুতো দাদা। এখানে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে ওঠেন। বিএ পাস না করেই ১৯৩৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বিক্রমপুরের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এর আগে বাবা আহত হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাবার মৃত্যু হলে তাঁরা চলে আসেন তাঁতীবাজারে।
৪
একবার যখন কলকাতায় এলেন, তখন যোগানন্দ জ্যাঠামশাই বললেন, তাঁর বউদিকে নিয়ে বরিশালে যেতে হবে। এই বউদি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী। শিয়ালদহ স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই আসবেন বউদি। বউদিকে খুঁজতে খুঁজতে ট্রেনের একটা কামরার সামনে এলেন রণেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন যোগানন্দ দাশ। বউদি চোখ ইশারায় যোগানন্দ দাশকে প্রণাম করতে বললেন। রণেশ খুব উদ্ধত ছিলেন। প্রণাম তিনি করলেন না। যোগানন্দ দাশ বললেন, ‘ও কি প্রণাম করবে? ও তো বলশেভিক!’
রণেশ তখনো বলশেভিক ব্যাপারটি ভালোমতো জানতেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কিছু একটা হচ্ছে সে ব্যাপারটি বুঝতেন কিন্তু সেই দেশ থেকে খুব বেশি খবর আসত না।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি রণেশ দাশগুপ্তকে খুব আকৃষ্ট করে।
৫
রবীন্দ্রনাথের কথা আসায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সে সময় তিনি বরিশালে ছিলেন। কলেজ হোস্টেলে। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশজুড়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। কলেজ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পড়লেন। তাতে বরিশালের নবীন কবি হিসেবে নাম হলো রণেশের। বিভিন্ন জায়গা থেকে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন।
একবার সরস্বতী সমাজের আমন্ত্রণে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে গিয়েছিলেন, সেটি ছিল গীতা জয়ন্তীর অনুষ্ঠান। সে সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশালের রাশভারী উকিল রায়বাহাদুর গণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ তাঁর নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা পাঠ করার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলেন ‘ও মশায়’ ‘ও মশায়’ বলে চিৎকার। প্রথমে রণেশ বুঝতে পারেননি কে কাকে ডাকছে। পরে আরও কয়েকবার ডাকার পর পেছন ফিরে দেখলেন সভাপতি মশাই ডাকছেন। তিনি বলছেন, ‘এটা রাজনীতির সভা নয়, আপনি পড়া বন্ধ করুন।’
রণেশ কবিতায় বলছিলেন বিপ্লবের কথা এবং তা গীতার ভাষ্য হিসেবে। সভাপতির কথায় তিনি মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলেন। দর্শক-শ্রোতারা সে কবিতা শুনতে চাইছিল। রণেশ চলে যাওয়ায় হল হয়ে গেল খালি। প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এলেন দর্শক-শ্রোতারা।
৬
বিভিন্ন সময়ে যেসব দাঙ্গা হয়েছে, রণেশ দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার এবং লেখায় তা নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। মনোযোগী পাঠক সে সময়ের একটা চিত্র খুঁজে পাবেন তাতে। সে আলোচনায় না গিয়ে সাহিত্যে দাঙ্গাবিষয়ক যে ভাবনার জন্ম হচ্ছিল এবং তা অনুপ্রাণিত করেছিল রণেশ দাশগুপ্তকে, সে কথা বলি।
সোমেন চন্দের বিখ্যাত ‘দাঙ্গা’ গল্পটির কথা তো বলতেই হয়। বলতে হয় সমরেশ বসুর ‘আদাব’ নামের গল্পটির কথা। অসীম রায়ের ‘বিক্ষোভ’ উপন্যাসের কথা। সাদাত হাসান মান্টো, কীষণ চন্দর দাঙ্গা এবং দেশভাগ নিয়ে প্রচুর মহাকাব্যিক লেখা লিখেছেন। দাঙ্গার বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা রয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ওপর শওকত ওসমানের লেখা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসটার কথাও বলতে হয়।
সে সময় পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু পরিবারগুলো দলে দলে চলে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। তেমনি মুসলিম পরিবারগুলো পশ্চিম বাংলা থেকে চলে এসেছিল পূর্ব বাংলায়। কলকাতা থেকে আসা বাঙালি মুসলমানেরা মূলত খুলনা, যশোর ও সৈয়দপুরে এসেছিলেন বেশি। সে সময়ের কিছু কথা রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় মূর্ত হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশের নতুন ধরনের কবিতাগুলো মানুষকে পরিচিত গণ্ডির কবিতার আবেশ থেকে বের করে আনছিল। কিন্তু জীবনানন্দের গদ্য সম্ভারের সন্ধান তখনো পাওয়া যায়নি। জীবনানন্দ মার্ক্সিস্ট ছিলেন বলে কখনোই প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁর অন্তত দুটি উপন্যাসে মার্ক্স, লেনিন ও কমিউনিস্টরা উঠে এসেছেন। উপন্যাস দুটির নাম ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ আর ‘জলপাইহাটি’। রণেশ দাশগুপ্তের ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ বইটিতে জীবনানন্দের এই দুটি উপন্যাস নিয়ে বৃহৎ আলোচনা আছে।
৭
‘দোটানা’ নামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ বা ফিচার আছে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ নামের বইটিতে। সরাসরি সাম্যবাদের কোনো কথা সেখানে নেই। কিন্তু বর্ণনার সহজতায় পাঠক বুঝে নিতে পারবেন রণেশ দাশগুপ্তের লেখার মর্মার্থ। প্রবন্ধের কয়েকটা লাইন এ রকম:
‘বদলাব বদলাব করে সাত দিন ধরে পরা সার্ট পায়জামা বদলানো হয়নি। সার্টটার হাতে দুটো ভয়ানকভাবে ময়লা হয়ে গেছে। পাজামাটা চটের থলে। হলঘরে অতগুলি লোকের দশা কি হতে পারে, সে কথা না ভেবেই নেহায়েত স্বার্থপরের মত মনে মনে বললাম, “ধরণী দ্বিধা হও”।
‘মুশকিলটা হয়েছে এই যে, আজ অফিসে কাজে আসার সময়ও দুদিন আগে পরা সার্ট পাজামা ভয়ানক ময়লা লাগল। না বদলে পারলাম না। অথচ আসতে আসতে যেসব মেহনতি মানুষ চোখে পড়েছে, তাদের অনেকেরই গায়ে কাজের জামা, আধ ময়লা জামা, নোংরা জামা, ছেঁড়া জামা। একজন আমার চেনা। সে একজন ফিটার। তার গায়ে দেখলাম, তেল কালিমাখা একটা হাফসার্ট। অথচ আমি জানি, উৎসবের দিনে এই লোকটি যে পোশাক পরিচ্ছদ পরে তা যেমন রুচিসম্মত, তেমনি প্রদীপ্ত। মানায়ও তাকে। মনে হয়, এ সম্পূর্ণ পৃথক একটি লোক, এর কিন্তু কাজের জামা পরতে মোটেই দ্বিধা জাগে বলে মনে হয় না। স্বচ্ছন্দে চলে গেল বুক ফুলিয়ে মহানগরীর ভিড় ঠেলে।’
‘বড় দোটানায় পড়ে গিয়েছি। ভাবছি, পকেট এ কলম, তার বদলে যদি হাতে একটা হাতুড়ি আর কিছু করার থাকতো তাহলে সম্ভবত এমন ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম না। হয়েছি কলমজীবী, না ঘরকা না ঘাটকা।'
দীর্ঘ এই উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। আমার মনে হয়, এ সময় রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে থাকলে জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরও কিছুটা পাল্টাত। মানুষ দিনে দিনে আরও বেশি চতুর, দুর্নীতিবাজ, তেলবাজ হয়ে উঠেছে, সেটা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে বিশ্বাস ছিল, সে বিশ্বাসে আঘাত আসত কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যাঁরা পোড় খাওয়া মন ও শরীর নিয়ে পার্টি করে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবিতাবস্থায় পার্টির নতুন নেতৃত্বের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার ব্যতিক্রম নয়। নয়া নেতৃত্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে যেভাবে দল চালিয়েছেন, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে বড়সড় ভাবনা থাকলেও নিজ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই ছিল আলোচনার বাইরে। অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো গুণী মানুষদের এড়িয়ে।
একটা উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক জগতে ঝ্দানোভ চালিয়েছিলেন এক বীভৎস পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন। লেখক, সাহিত্যিক, কবি পার্টির নির্দেশে লেখালেখি করতেন। সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় আঘাত আর কিছুই হতে পারে না। এই বীভৎসতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার বিষে জর্জরিত হয়েছিল খোলা মনের মানুষ। এখন নানাভাবে সেই বীভৎসতার চিত্রগুলো তুলে আনা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির পক্ষেই গুণগান গাইছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতারা। ভারতবর্ষেও সেই চপেটাঘাত পড়েছিল। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে যে অশ্বডিম্বটি পাড়া হয়েছিল, সেটি যে মানবিক বিকাশের অন্তরায়, সে কথা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ কারণেই বুঝি কমরেড ফরহাদ যখন ‘নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তখন তার সমালোচনা করতে হলো সনজীদা খাতুনকে।
সন্জীদা খাতুন তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি লেখার আগে রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের তো কোনো কথা জিজ্ঞেস করে না।’
কিন্তু পার্টির প্রতি অগাধ মমত্বের কারণে তিনি মলিনমুখে বলেছিলেন, ‘সেম সাইড হয়ে যায় না?’ অর্থাৎ কমরেড ফরহাদের লেখার বিরুদ্ধে সন্জীদা খাতুন লিখলে সেটা পার্টি লাইনের বাইরের কিছু হয় কি না, সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।
সে সময় যদি প্রতিবাদ করতেন তিনি বা তাঁর মতো বিচক্ষণ মানুষেরা, তাহলে পার্টি হয়তো তাঁদের দিকনির্দেশনায় ঋদ্ধ হতে পারত।
৮
রণেশ দাশগুপ্তের অসাধারণ একটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’ নামের বইয়ে। প্রবন্ধটির নাম, ‘বাংলাদেশ নয় এ মধুর খেলা রচয়িত্রীরা’।
মূলত বাংলাদেশের নারী লেখকদের নিয়ে প্রবন্ধটি। বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমামকে নিয়ে যখন তিনি এই প্রবন্ধ লিখছেন, তখন প্রথমজনের বয়স ৯২ এবং দ্বিতীয়জনের ৮২। এখন বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ বিভাজন মানা হয় না। সে সময় মানা হতো বলে লেখার শব্দগুলোকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিখছেন, ‘বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম জাহানারা ইমাম।... এই দুই প্রবীণা বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিভাবিকারূপে বিবেচিতা। বেগম সুফিয়া কামাল বিশ্বের দশক থেকেই বিশিষ্টা কবি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্যা ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা সুফিয়া কামাল বরাবরই প্রগতিবাদিনী। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকা। যে মুক্তি ধারায় স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটল, তার সঙ্গে আপন চিন্তাভাবনা ও নারী সমাজের অন্তরঙ্গতা ও একাত্মতা প্রকাশের সহজ সরল বাণীরূপ নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার জগত।... বেগম জাহানারা ইমাম ’৪৬-এ কলকাতা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। রংপুরের মেয়ে জাহানারা ইমাম দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় চলে যান এবং বিবাহিত সাংসারিক জীবনযাপন করেন স্কুলশিক্ষকের কাজের পাশাপাশি। এই অবস্থান থেকেই বেগম জাহানারা ইমাম বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও ব্যাপক গণহত্যা পতাকাবাহী নিরুপায় সামনে এসে গিয়েছেন।’
এ দুজনের কথা বলার পর রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তিনি লিখছেন, ‘ঢাকা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কলাম বইটিতে লেনিনের অনুসারী কমিউনিস্টদের যে উল্লেখ রয়েছে, তাতে কমিউনিস্টদের পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নারীদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন বলে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। ঊনিশ শতকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলকে নারীর ভোটাধিকার বিরোধী বলে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত “নির্বাচিত কলাম” বইটিতে “যাব না কেন? যাব”কে যুক্ত করে যে সার্বিক বা পরিপূরক বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে ’৯০-৯১–এর সমাজতন্ত্রের সংকট ও লেনিনের অবমাননার এক বিস্ময়কর আবেগময় প্রস্তাবনা বেরিয়ে এসেছে লেখিকার কলম থেকে। এ ধরনের বক্তব্যকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে মনে করে নিলে ভুল হবে। এই কলামটিতে তসলিমা নাসরিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনে লেনিনের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় শোকাহত মস্তক অবনত করেছেন।’
এরপর তিনি লেখক মতিয়া চৌধুরীর কথা বলেছেন। স্বনামধন্য এই রাজনীতির মানুষটি ষাটের দশকের শেষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দৈনিক সংবাদে তিনি ধারাবাহিকভাবে জেলের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘মতিয়া চৌধুরী প্রধানত বাংলাদেশের বিপ্লবের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনগণের রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতিনিধিরূপে বাংলাদেশের মুক্তির ধারাভাষ্য উপস্থিত করেছেন মুখ্যত বিশাল বিশাল জনসমাবেশ প্রদত্ত ভাষণে। সেই কারণে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এর বাইরে তার কোনো ভাষ্যকে পাওয়া যাবে না, তবে তার লেখা কারা কাহিনীটি দলিত বঞ্চিত নারী জীবনের ছবি দেশবাসীকে বিবেকের কাছে তীব্র ও তীক্ষ্ণতাবোধ উপস্থিত করেছিল।’
এরপর তিনি বলেছেন মালেকা বেগমের কথা, সেলিনা হোসেনের কথা, পান্না কায়সারের কথা।
এই প্রবন্ধটি পাঠ করতে বলব শুধু এই কারণে যে একজন লেখক তাঁর পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতাকে এড়িয়ে নির্মোহ ভঙ্গিতে কীভাবে কোনো বই বা মানুষের বিশ্লেষণ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
৯
অগাধ পড়াশোনা করেছেন তিনি। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। রাজনীতির মাঠে তিনি একজন নান্দনিক শিল্পী। সংস্কৃতিই ছিল তাঁর শক্তিমত্তার বড় জায়গা। রাজনীতির কথা বলতে গেলে ১৯৫৮ সালের মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের কথা বলতে হয়। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। ৩৫টি পদের মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয় মুসলিম লীগ, বাকি পদগুলো পায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল।
একটি মাত্র পদে নির্বাচিত হয় কমিউনিস্ট প্রার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীর নাম রণেশ দাশগুপ্ত।
১০.
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই ব্যক্তির আরেকটি অসামান্য কাজের কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
তাঁর ছদ্মনাম ছিল জমিল শরাফী। দৈনিক সংবাদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি বিভিন্ন বই সম্পাদনা করতেন। ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংকলন’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল জমিল শরাফীর সম্পাদনায়।
তবে দাদা জীবনানন্দ দাশের ওপর বই সম্পাদনা করেছেন তিনি স্বনামেই। ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার’ নামের বইটিই ছিল বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চার প্রথম উদ্যোগ। এই বইটিতেই জীবনানন্দের পুরো কাব্যসম্ভার এক মলাটের মধ্যে পায় বাংলাদেশের অধিবাসীরা।
১১
১৯৭৫ সালে এ দেশের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা দেখেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। সে বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি ফিরতি বিমান টিকিটসহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। আগস্ট মাসে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড। কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই নভেম্বরের জেলহত্যার কথা শুনতে পান। বন্ধুরা এ সময় তাঁকে বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করেন। সেই থেকে শুরু হয় কলকাতার জীবন। কিন্তু নিজেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষ ভাবতেই পছন্দ করতেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। ভারতীয় সরকারের কোনো ভাতা নেননি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনেক ঠিকানা বদলের পর তাঁর থাকার জায়গা হয় লেনিন স্কুলে। কায়ক্লেশে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। বাংলাদেশ-ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ঢাকায়ই হয় তাঁর শেষকৃত্য। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হলে শহীদ মিনারে বিপুল জনসমাগম হয়।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৫ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৫ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৫ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৫ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৫ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৫ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৫ ঘণ্টা আগেজাহীদ রেজা নূর

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৫ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৫ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৫ ঘণ্টা আগেস্বপ্না রেজা

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৫ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৫ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৫ ঘণ্টা আগেসানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

রণেশ দাশগুপ্ত এখন বিস্মৃতপ্রায় এক নাম। এখন সাম্যবাদের আন্দোলনের বেগ স্তিমিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মনে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারও ফিকে হয়ে এসেছে। পৃথিবী এখন বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাই একদা কোনো এক কালে একজন রণেশ দাশগুপ্ত কেন সাম্যবাদের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিল
০৪ নভেম্বর ২০২১
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৫ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৫ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৫ ঘণ্টা আগে