Ajker Patrika

কলাবতী শাড়ির রূপকার দুই নারী

ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট ও  মাহিদুল ইসলাম, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) 
কলাবতী শাড়ির রূপকার দুই নারী

প্রতিটি সাফল্যের পেছনে থাকে দারুণ সব গল্প। কলাগাছের সুতা দিয়ে শাড়ি বানানোর সফলতার যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছে, এর পেছনের গল্পটিও দারুণ। অদ্ভুত বিষয়, এ সফলতার পেছনে জড়িয়ে আছে দুই নারীর চিন্তা ও কর্মতৎপরতা। তাঁদের একজন রাধাবতী দেবী, অন্যজন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। 

একজন রাধাবতী দেবী
সংগ্রামমুখর এক জীবন তাঁর। প্রায় ৬৫ বছর আগে কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রাধাবতী দেবী। পৃথিবীতে আসার কয়েক মাস পর বাবাকে হারান। ফলে মা মালতী দেবী হয়ে ওঠেন তাঁর ভরসার জায়গা। কিছুদিন পর মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

ফলে রাধাবতী বড় হন চাচার কাছে। স্থানীয় তেতইগাঁও রশিদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। সংসারজীবন শুরুর মাত্র তিন মাস পর বিচ্ছেদ হয়ে যায়! ২০১৬ সালে তাঁর মা মারা যান। এত সব বিচ্ছেদ আর বিষণ্নতার গল্প নিয়ে রাধাবতী দেবী বয়ে চলেছেন ৬৬ বছরের জীবন। বর্তমানে চাচাতো ভাই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক রণজিৎ সিংহের পরিবারে থাকেন তিনি। সাধ্যমতো কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন রাধাবতী। সাধারণত সব মণিপুরি নারীই তাঁত বুনতে পারেন। তিনিও এর ব্যতিক্রম 
নন। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি তাঁত বয়নের কাজ শুরু করেন এবং ১৯৯২ সাল থেকে শাড়ি তৈরি শুরু করেন।

এই দীর্ঘ তাঁত বয়নের অভিজ্ঞতা তাঁকে দক্ষ করে তুলেছে। সেই দক্ষতার খোঁজ পান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। ফলে এক দারুণ উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখে।

কলাবতী শাড়ি তৈরির পর বান্দরবান জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে রাধাবতী দেবীকে অর্থসহায়তা এবং একটি স্মার্টফোন উপহার দেওয়া হয়। তবে উপহার আর মজুরির চেয়ে তাঁর 
কাছে আনন্দের বিষয়, তিনি দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন। এ জন্য সরকার, বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও ফুফাতো ভাই গুণমনির কাছে ঋণী বলে জানান রাধাবতী দেবী।

 জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির সঙ্গে রাধাবতী দেবীএকটি প্রকল্প এবং ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি 
কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরির পেছনে আছে একটি প্রকল্পের দীর্ঘদিন ধরে নীরবে কাজ করে যাওয়ার গল্প। সেই প্রকল্পটি হলো কলাগাছের আঁশ থেকে বানানো সুতায় হস্তশিল্প তৈরি। এর নেপথ্য কারিগর বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কলাগাছের তন্তু দিয়ে হস্তজাত শিল্প তৈরির এ পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে বান্দরবানে। অফিস-আদালত বা সভা-সেমিনারে ব্যবহারের জন্য ফোল্ডার, ঝুড়ি, শতরঞ্জি, কলমদানি, পাঁচ তারকা হোটেলের কক্ষে পরার জন্য জুতাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে কলাগাছের তন্তু দিয়ে। প্রথম পর্বের কাজে সফলতা এলে এই সুতা দিয়ে কাপড় বা শাড়ি বানানো যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সেই চিন্তার সূত্র ধরে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে তাঁতে কাপড় বোনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে আসে সাফল্য। তবে সেই কাপড় অনেক মোটা আর খসখসে। কিন্তু ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি ভাবতে থাকেন, কাপড় যেহেতু বানানো গেছে, আরেকটু চেষ্টা করলে শাড়িও বানানো সম্ভব। এ চিন্তা থেকে অগ্রসর হতে হতে এ বছরের একেবারে শুরুতে শাড়ি তৈরির প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় রাধাবতী দেবীকে। শাড়ি বানানোর জন্য মৌলভীবাজার থেকে তাঁতও আনা হয়। এতেই আসে সফলতা।

ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ‘দক্ষ তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবীকে আমরা সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়ে তৈরি করিয়েছি শাড়িটি। এ জন্য তাঁকে স্মরণ রাখতে শাড়ির নাম দিয়েছি “কলাবতী”। কলাগাছের “কলা” আর রাধাবতীর “বতী” যোগ করে নির্ধারণ করা হয়েছে এই নাম।’

তবে পুরো প্রকল্পকে শতভাগ সফল বলা যায় না এখনো। ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জানান, সুতাকে কতটা নমনীয় করা যায়, কীভাবে আরও বেশি সুতা উৎপন্ন করা যায়—এসব নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা হওয়া দরকার। সে কারণে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, তাঁত বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠানো হচ্ছে বলেও জানান ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি।

শাড়িটি যেমন
কলাগাছের সুতা থেকে তৈরি শাড়িটি অনেকটা মণিপুরি ও জামদানি শাড়ির মতো অথবা এ দুই শাড়ির মাঝামাঝি। ঘিয়ে রঙের জমিনে লাল ও সবুজ রঙের সুতা দিয়ে নকশা করা হয়েছে শাড়িটি। স্থানীয় পদ্ধতিতে সুতা নরম করার চেষ্টা করা হয়েছে। শাড়ি তৈরি করতে প্রায় ৮০০ গ্রাম সুতা ব্যবহার করা হয়। শাড়ির পাড় বোনা হয়েছে কোরিয়ান সুতা দিয়ে আর শাড়ির জমিন ও আঁচল তৈরি করা হয়েছে কলাগাছের সুতা দিয়ে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কারিগরের মজুরিসহ শাড়ির দাম চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা হবে।

উদ্যোগ সফল হলে ভালো লাগে সবার। রাধাবতী দেবী কিংবা ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি—দুজনই খানিকটা তৃপ্ত। তাঁরা জানান, কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। এখান থেকে স্থানীয় মানুষ যাতে লাভবান হয়, সে পথ খুঁজে বের করতে হবে।

আমরাও আশায় আছি, একসময় পথের দিশা পাওয়া যাবে। স্থানীয় পরিসরে তো বটেই, একদিন রাধাবতী দেবী কিংবা ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজির উত্তরসূরিরা আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে যাবেন তাঁদের সফলতার গল্প।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দিলরুবা হক মিলি: বনরক্ষী এক নারীর গল্প

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান 
দিলরুবা হক মিলি। ছবি: সংগৃহীত
দিলরুবা হক মিলি। ছবি: সংগৃহীত

কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণের হার বাড়লেও কিছু কিছু পেশা এখনো প্রচলিতভাবে নারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এমনই এক চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছেন পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার মেয়ে দিলরুবা হক মিলি। বাংলাদেশের প্রথম নারী বনরক্ষী তিনি।

এ পেশায় তাঁর পথচলা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং দেশের নারীদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

প্রকৃতিপ্রেম থেকে স্বপ্নের শুরু

২০১৬ সাল মিলির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বছর। সে বছর বনরক্ষী হিসেবে যোগ দেন তিনি। তবে এই পেশায় প্রবেশের গল্প মোটেও সহজ বা পরিকল্পিত ছিল না। ছোটবেলা থেকে মিলির মধ্যে ছিল প্রকৃতি, গাছপালা আর বনের প্রতি একধরনের টান। বরিশালের মানুষ হিসেবে শৈশব থেকে তিনি দেখেছেন নদীর তীর, ঘন সবুজ গাছ আর প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য। পিরোজপুরের কাউখালীতে স্কুল ও কলেজ পর্বের পড়াশোনা শেষ করে তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

আকস্মিক সুযোগ

পড়াশোনা শেষ করার পর যখন স্থায়ী একটি চাকরির ভাবনা মাথায় ঘুরছিল, তখনই চোখে পড়ে বনরক্ষী পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। প্রকৃতির সঙ্গে কাজ করার এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা মিলিকে সেই পদে আবেদন করতে উৎসাহিত করে। যদিও তখনো তিনি জানতেন না, এই পদের ইতিহাসে তিনিই হবেন প্রথম নারী।

প্রশিক্ষণেই প্রথম বাধা

লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মিলি সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। তবে তাঁর জন্য আসল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছিল প্রশিক্ষণপর্বে। রাজশাহীর পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে প্রথম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিতে চাইছিলেন না। তাঁদের ধারণা ছিল, ‘মেয়েরা এ ধরনের চাকরি করে না’। কাগজপত্র দেখানোর পর তাঁরা অবাক হন এবং তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দেন।

শারীরিক ও মানসিক সংগ্রাম

প্রশিক্ষণপর্বে শুরু হয় বাস্তব লড়াই। শারীরিক, মানসিক ও পরিবেশগত প্রতিটি ধাপেই তাঁকে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে। মিলি বলেন, ‘প্রথম দিকে নিজের মধ্যেও ভয় ছিল, পারব তো? তারপর বুঝলাম, প্রতিকূলতাকে পাত্তা দিলে চলবে না। একবার সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক কিছুই সম্ভব।’

প্রশিক্ষণপর্বে দৃঢ়তা, পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাঁকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পুরুষ সহপ্রশিক্ষণার্থীরা শুরুতে অবাক হলেও পরে তাঁকে সহায়তা করতে শুরু করেন।

আজকের এই অবস্থানে আসতে মিলিকে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ। কিন্তু ধৈর্য, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস তাঁকে দেশের প্রথম নারী বনরক্ষী হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে।

মিরপুর উদ্ভিদ উদ্যানে দায়িত্ব

২০১৬ সালে ঢাকায় বনরক্ষী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে কর্মস্থল তাঁর দ্বিতীয়

ঘর হয়ে ওঠে। বর্তমানে তিনি কর্মরত রয়েছেন মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে; যা একদিকে দেশের সবচেয়ে বড় উদ্ভিদ সংরক্ষণাগার, অন্যদিকে ফুল, গাছ ও বিরল উদ্ভিদের দুর্লভ সংগ্রহশালা। তিনি বলেন, ‘উদ্ভিদ উদ্যানটা আমার কাছে বড় একটা জাদুঘরের মতো। প্রতিদিন এই উদ্ভিদ উদ্যানে দায়িত্ব পালন করতে এসে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকতে পারি, এটাই আমার বড় পাওয়া।’

নিরাপত্তা নিশ্চিতের কঠিন কাজ

একজন বনরক্ষীর দায়িত্ব যেমন কঠিন, তেমনি চ্যালেঞ্জিং। সকাল থেকে পুরো উদ্যানে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। একসময় উদ্যানে ছিল অপরাধীদের আনাগোনা—ছিনতাই, হয়রানির মতো ঘটনা ঘটত প্রতিদিন। মিলি এবং তাঁর সহকর্মীরা দিনরাত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে পরিবেশটা নিরাপদ করে তোলেন। ধীরে ধীরে দর্শনার্থীদের আস্থা ফিরে আসে, সংখ্যা বাড়ে; সেই সঙ্গে রাজস্বও।

সহকর্মীদের স্বীকৃতি

এ ধরনের কাজ নারীদের অনুকূলে নয় বলে সবার ধারণা। কিন্তু মিলি সেসবে কখনো গুরুত্ব দেননি; বরং নিজের কর্মদক্ষতা দিয়ে সবার মন জয় করেছেন। তাঁর সহকর্মী আমিনুল্লাহ খন্দকার বলেন, ‘মিলি আমাদের একমাত্র নারী বনরক্ষী। কিন্তু সাহস আর নেতৃত্বদানে তিনি কারও চেয়ে কম নন। যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন একদম নির্ভয়ে।’

সহকর্মী এখলাসুর রহমান ও মামুনুর রশীদেরাও মিলির আন্তরিকতা, সাহস ও দায়িত্ববোধের প্রশংসা করেন।

সমতার দৃঢ় বিশ্বাস

আজকের এই অবস্থানে আসতে মিলিকে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ। কিন্তু ধৈর্য, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস তাঁকে দেশের প্রথম নারী বনরক্ষী হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর সাফল্যের গল্প ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখো মানুষের ভালোবাসা ও অভিনন্দন পেয়েছেন তিনি। দিলরুবা হক মিলি বিশ্বাস করেন, নারী ও পুরুষ সমান। মানুষের সামর্থ্যই আসল। তিনি বলেন, ‘যে কাজটি আনন্দ নিয়ে করা যায়, সেটিই করা উচিত। কাজের ক্ষেত্রে লৈঙ্গিকভেদে কোনো পার্থক্য হওয়া উচিত নয়।’

সাহসী নারীদের হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে—এমনটাই আশা করেন দিলরুবা হক মিলি। তিনি এখন কেবল একজন বনরক্ষী নন; সাহসেরও প্রতীক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বেগম রোকেয়া

অতীতের আলো, বর্তমানের অন্ধকার

নুসরাত রুষা
বেগম রোকেয়া। ছবি: সংগৃহীত
বেগম রোকেয়া। ছবি: সংগৃহীত

বাংলার নারী জাগরণের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম বেগম রোকেয়া। তিনি ছিলেন আন্দোলনকারিণী, পথপ্রদর্শিকা আর সাহসিকার আরেক নাম। যে যুগে নারীর মুখ উঁচু করে হাঁটা পর্যন্ত ‘অপমানজনক’ ভাবা হতো, সে সময় তিনি নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং অধিকারের কথা বলে গেছেন। এখনো তাঁর লেখা পড়লে মনে হয়—এ যেন আজকের সমাজেরই কথা।

বেগম রোকেয়ার বড় শক্তি ছিল তাঁর মন। আর তাঁর বড় সহায় ছিলেন স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। উনিশ শতকের শেষে—একজন পুরুষের পক্ষে নিজের স্ত্রীকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করা, ইংরেজি শেখানো কিংবা সামাজিক কাজে যুক্ত থাকার সমর্থন দেওয়া ছিল বিরল ঘটনা। বেগম রোকেয়ার ভাষায়, ‘আমার স্বামী আমাকে ‘সহধর্মিণী’ হিসেবে বিবেচনা করতেন—দাসী হিসেবে নয়।’ এই একটি বাক্যে বোঝা যায়, বেগম রোকেয়ার পথ কতটা আলোয় ভরা ছিল, আর কতটা সম্মানের ওপর দাঁড়ানো ছিল।

হাসির বিষয়, আমরা যেটিকে ‘মডার্ন’ বলে গর্ব করি, সেই আধুনিক যুগে এসে সম্পর্কের ভিত্তি যেন সংকুচিত হয়ে গেছে। ডিগ্রি, চাকরি, প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দেশের হাজারো তরুণের মানসিকতা এখনো প্রাচীন। তাঁদের স্ত্রী পড়াশোনা করতে চাইলে বলেন, ‘তোমার এত পড়াশোনার কী দরকার?’ চাকরি করতে চাওয়ার বেলাতেও তাঁদের অভিব্যক্তি একই থাকে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া—সবই আছে, কিন্তু নারীর স্বাধীনতায় সমর্থন দেওয়ার যে মানবিকতা, তা নেই।

যে যুগে বেগম রোকেয়া বেঁচে ছিলেন, সে যুগ ছিল নারীদের জন্য অন্ধকার। সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষাহীনতা হলো নারীর মূল শত্রু।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞানই পারে নারীকে মুক্ত করতে। তাই সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পর তিনি নিজের জমানো টাকা দিয়ে খুললেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল। মেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের রাজি করাতেন। যাঁরা বলতেন, ‘মেয়েরা লেখাপড়া করলে নষ্ট হয়ে যাবে’, তাঁদের মুখের ওপর বেগম রোকেয়া বলতেন, ‘মেয়ে নষ্ট হয় অজ্ঞতায়, শিক্ষায় নয়।’

কিন্তু এখন? নারীরা যে যুগে মহাকাশে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তো বটেই, পড়াচ্ছেও, নেতৃত্ব দিচ্ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে, সে যুগেও একদল মানুষ বেগম রোকেয়ার নামে বেষ্টনী টেনে দেয়। তাদের কাছে রোকেয়া মানে ‘ধর্মদ্রোহী’, ‘নারীবাদের বিষ’। সামাজিক অগ্রগতির দাবিতে মুখ খুললেই তারা তেড়ে আসে। যেন নারীর উন্নতি মানেই সমাজের ভাঙন, আর নারীর স্বাধীনতা মানেই পুরুষের ক্ষতি।

বস্তুত, আমাদের সামাজিক মানসিকতার এই পশ্চাৎগতি গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। বেগম রোকেয়া যখন নারীর শিক্ষার দাবি করেছিলেন, তখন তা ছিল মাত্র কিছু মানুষের রাগের বিষয়; এখন, শত বছর পরে, সেই রাগই যেন আরও তীব্র হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বললেই মন্তব্যের ঘরে নোংরা শব্দের বন্যা। যেন নারী মানুষ নয়, তার ইচ্ছা, অনুভূতি বা স্বপ্ন থাকার কোনো অধিকার নেই।

বেগম রোকেয়া যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তবে নিশ্চয় বিস্মিত হতেন। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন—শিক্ষা বাড়বে, সমাজ এগোবে, মানুষ পরিণত হবে আরও উন্নত চিন্তার স্তরে। কিন্তু কী ভীষণ বিপরীত ছবি আমরা দেখি। বেগম রোকেয়া যে সমাজকে আলোর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা কি আজ সেটিকে পিছিয়ে দিচ্ছি?

বেগম রোকেয়া আমাদের শেখান, নারীর অগ্রগতি কোনো ‘ফ্যাশন’ নয়, কোনো ‘বিদ্রোহ’ নয়—এটা সমাজের অগ্রগতির পূর্বশর্ত। পুরুষের সমর্থন ছাড়া নারী এগোতে পারে না, আর নারীকে দমিয়ে রেখে পুরুষও এগোতে পারে না।

বেগম রোকেয়া একা যুদ্ধ করে দেখিয়েছিলেন—একজন আলোকিত পুরুষ পাশে থাকলে নারী ভেঙে দিতে পারে অজস্র সীমাবদ্ধতা। সেই সমর্থন, সেই মানবিকতা, আমাদের আজ বেশি দরকার।

লেখক: অধিকারকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জন্মনিবন্ধন করতে বাবার এনআইডি বা তথ্য বাধ্যতামূলক নয়

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৩
জন্মনিবন্ধন করতে বাবার এনআইডি বা তথ্য বাধ্যতামূলক নয়

প্রশ্ন: সন্তানের জন্মনিবন্ধন দরকার স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। কিন্তু তার বাবার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। এই অবস্থায় জন্মনিবন্ধন করতে গেলে শুধু মায়ের আইডি কার্ড বা জন্মনিবন্ধন দিয়ে কি সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা যাবে।

শবনম মনিরা, কুড়িগ্রাম

উত্তর: বাংলাদেশে সন্তানের জন্মনিবন্ধন মায়ের তথ্য দিয়েই করা সম্ভব, বিশেষ করে যখন বাবা কোনো নথি দিতে অনিচ্ছুক বা যোগাযোগের বাইরে থাকেন।

জন্মনিবন্ধন আইন ও স্থানীয় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, সন্তান যাঁর তত্ত্বাবধানে থাকে অথবা যিনি ‘অভিভাবক’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন; তিনি জন্মনিবন্ধনের আবেদন করতে পারেন। বাবা অনুপস্থিত বা সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানালে মায়ের তথ্য দিয়েই জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাবার তথ্য ‘আননোন’ বা ‘নট অ্যাপ্লিকেবল’ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। এটি ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধন কর্মকর্তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।

বাবা সহযোগিতা না করলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আইনগতভাবে মায়ের তথ্য দিয়েই সন্তানের জন্মনিবন্ধন করা যায়। মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সন্তানের জন্মের প্রমাণ থাকলেই নিবন্ধন সম্পন্ন হবে।

আপনার যেসব নথি লাগবে

  • মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি
  • সন্তানের জন্মসংক্রান্ত প্রমাণ
  • হাসপাতালে জন্ম হলে জন্মসনদ বা ডেলিভারি স্লিপ
  • বাড়িতে জন্ম হলে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার বা কাউন্সিলরের দেওয়া প্রত্যয়নপত্র
  • মায়ের আবেদন ফরম
  • প্রয়োজনে ডিভোর্স-সংক্রান্ত কাগজ। এটি অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু জটিলতা এড়ানোর জন্য সঙ্গে রাখলে ভালো।

জন্মনিবন্ধন করতে বাবার এনআইডি বা তথ্য বাধ্যতামূলক নয়, বিশেষ করে যখন মায়ের কাছে তা পাওয়া সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে স্কুলে ভর্তি, চিকিৎসা, পাসপোর্ট ইত্যাদি করাতে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না। কারণ, সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মা-ই স্বীকৃত। নিবন্ধনের সময় আপনি উল্লেখ করতে পারেন, বাবা অনুপস্থিত বা যোগাযোগের অযোগ্য। কর্মকর্তারা বিষয়টি বুঝে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন।

জন্মনিবন্ধন কোথায় করাবেন

আপনার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধন অফিসে গিয়ে সরাসরি আবেদন করা যায়। অথবা অনলাইনেও আবেদন করা যায় এই ঠিকানায়: bdris.gov.bd

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নারী আন্তর্জাতিক পেশাদার বক্সিংয়ে হিজাব, নিরাপত্তা নাকি প্রথা

ফিচার ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বার্লিনের বসতঘরে সেদিন এক অন্য রকম পরিবেশ। ১৩ বছরের কিশোরী জেইনা নাসার বসেছে মা-বাবার মুখোমুখি। তার একটাই দাবি বা অনুরোধ—বক্সিং করতে দিতে হবে। না, তর্ক নয়। সেদিন নাসার তার অভিভাবককে বুঝিয়েছিল, বক্সিং স্কুলে তার মনোযোগ বাড়াবে, সে কেবল মেয়েদের জিমে যাবে আর খেলাটা আসলে সম্মান ও শৃঙ্খলার নামান্তর। কথা শুনে মা-বাবা মুগ্ধ হলেন, রাজিও হয়ে গেলেন। কিন্তু জেইনা জানত, এই রাজি করানোটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে সহজ কাজ। খেলে যাওয়াটাই বরং কঠিন।

ইউটিউবে নারী মুষ্টিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ভিডিও দেখেই তার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ জন্মেছিল জার্মানিতে জন্ম নেওয়া লেবানিজ বংশোদ্ভূত এই কিশোরীর। প্যাডের ওপর ঘুষির শব্দ, গতি আর প্রতিটি চালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি তাকে টানত। ২৭ বছর বয়সী জেইনা বলেন, ‘আমি ওটা দেখতাম আর দেখতাম। আমার ভেতরে এক বোধ জন্মাল, এটাই আমি চাই।’

মুসলিম হিসেবে হিজাব ছিল জেইনা নাসারের পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু স্থানীয় জিমে যোগ দেওয়ার পর তিনি বুঝলেন, তাঁর আসল লড়াইটা অপেক্ষা করছে খেলার নিয়মের জালে। সে সময় জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো নিয়মেই প্রতিযোগিতার সময় হিজাব পরে অংশ নেওয়ার অনুমতি ছিল না। বিবিসিকে জেইনা বলেন, ‘মানুষজন আমাকে স্পষ্ট বলল, হয় হিজাব ছাড়ো, নয়তো খেলা। আমি বুঝতে পারতাম না কেন আমাকে একটিকে বেছে নিতে হবে? আমি তো কাউকে আঘাত করছি না। আমি শুধু বক্সিং করতে চাই।’ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর তাগিদই তাঁর জীবন আর ক্যারিয়ারকে নতুন দিশা দিল।

সাহস আর জেদ ছিল জেইনার বড় অস্ত্র। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই জার্মান অপেশাদার বক্সিংয়ের নিয়ম বদলে দিতে সমর্থ হলো সে। ফলে এখন একজন নারী মুষ্টিযোদ্ধা লম্বা হাতা এবং হেড স্কার্ফ পরে রিংয়ে নামতে পারেন। তবে প্রথমবার রিংয়ে নামার সময় অ্যাড্রেনালিনে শরীর কাঁপলেও কিশোরী জেইনা অনুভব করে অজস্র মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি।

সেই বয়সে জেইনা কেবল পারফরম্যান্সে মনোযোগ দিতে চাইল। রিংয়ের পারদর্শিতা ধীরে ধীরে সে মনোভাবে পরিবর্তন শুরু হলো। পরের ধাপে জেইনা জিতে নিলেন একাধিক বার্লিন ও জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। একই সঙ্গে নিজের বিশ্বাসের প্রতিও থাকেন অবিচল।

যখন আন্তর্জাতিক বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (আইবিএ) ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য জেইনাকে আমন্ত্রণ জানাল, তখন আবার বাধা। আন্তর্জাতিক স্তরে হিজাব তখনো নিষিদ্ধ।

তাই ১৯ বছর বয়সে জেইনা বৈশ্বিক মঞ্চে এই নিয়ম বদলের জন্য প্রচার শুরু করলেন। তাঁর অক্লান্ত সংগ্রামের ফল আসে ২০১৯ সালে। আইবিএ হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বর্তমানে অলিম্পিক বক্সিং পরিচালনাকারী ওয়ার্ল্ড বক্সিংও হিজাবসহ পুরো শরীর ঢাকা পোশাকের অনুমতি দেয়। জেইনা নাসার একেই জীবনের সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করেন।

২০১৭ সালে নাইকি ব্র্যান্ড অ্যাথলেটদের জন্য যখন নতুন হিজাব বাজারে আনে, তখন জেইনা নাসার হয়ে ওঠেন তাদের প্রধান মুখ। কিন্তু পেশাদারির জগতে তাঁর পথ কি খুব সহজ ছিল?

অনেকে হিজাবের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মাঝেমধ্যে রিংয়ে হিজাব খুলে যাওয়ার ঝুঁকি বা তার কারণে কোনো বাড়তি সুবিধা পাওয়ার বিতর্কও উঠেছিল। জার্মান বক্সিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট অলিভার উইটম্যান এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জেইনা নাসার এর জবাবে তুলে ধরেন নিজের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১০০টি অপেশাদার লড়াইয়ে এটি একবারের জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করেনি’। এদিকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জেইনার পক্ষেই দাঁড়ান।

জেইনা নাসারের পেশাদার অভিষেক হচ্ছে পাকিস্তানের লাহোরে। সেই মঞ্চে চার দিনের লড়াই হবে। ২০ হাজারের বেশি দর্শক সমাগম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত