
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা, সংস্কারসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার ও মাসুদ রানার সঙ্গে।
বিভুরঞ্জন সরকার

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন আমরা কয়েকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন বিগত সরকার উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করেছিল, সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। তথ্য-উপাত্তের মধ্যে নানা ধরনের অসংগতি ছিল, একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প নিয়ে অতি মূল্যায়ন ও প্রচার ছিল। বিগত সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে না পারার একটা ব্যাপার ছিল। একই সঙ্গে কর আদায় করতে না পারা, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ না দেওয়া। এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিল।
আমরা তো প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে শ্বেতপত্র করলাম। এটা দিয়ে উত্তরাধিকারের ভিত্তিভূমিটা পরিষ্কার হলো। এরপর এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ দাঁড়াল—অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ক্রমে বাড়ছিল, টাকার দাম দুর্বল হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছিল না। তার প্রভাব জ্বালানিসহ অন্যান্য সেক্টরেও পড়েছিল। সেই জায়গায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকার ৮-৯ মাসে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। এখন টাকার মূল্যমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকা এবং রপ্তানি চালু থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা না গেলে অর্থনীতিকে যেভাবে সচল, দক্ষ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চাই, সেভাবে এটি করা সম্ভব না। ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক খাতের অন্যান্য দিক, যেমন কর আহরণ ও অর্থায়ন এবং দক্ষভাবে সরকারিভাবে উন্নয়ন নীতি পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জ্বালানি খাত এবং অতি মূল্যায়িত সরকারি প্রকল্পগুলোতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং এগুলোকে যৌক্তিকভাবে তৈরি করা যায়—এগুলো একটা সংস্কারের ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুনভাবে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করা যায়। সরকার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষভাবে তা প্রতিভাত হয়নি।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে টেকসই করা এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে বেগবান করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ তথা ব্যক্তি খাতে মোট বিনিয়োগ আগামী বছর বাজেটে গুরুত্ব পাবে আশা করি। এর ভেতর দিয়ে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনকে গভীর করতে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। এর মূল কারণ কী?
বিনিয়োগের পতনের বিষয়টি নতুন না। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ও জাতীয় আয় আনুমানিক ২৩ শতাংশে আটকে ছিল। তাই বিনিয়োগের স্থবিরতার বিষয়টি হলো দেড় দশকের আলোচনার বিষয়। বিষয়টি হলো, আমরা বিনিয়োগের ধারাটিকে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারি? সমস্যাটা হলো, আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। ফলে আইএমএফসহ অন্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, অর্থনীতির সংকোচনের মধ্যে পড়লে, সেখানে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এটা কমানোর একটা জায়গা হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া কমানো। অর্থাৎ, সুদের হার এমন করতে হবে যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে লাভ করতে পারবে না। এখানে সেটাই হয়েছে। সুদের হার এমন জায়গায় গেছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা টাকা ধার করে লাভজনক থাকতে পারছেন না।
এখন যদি মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসে এবং টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আশা করা যায়, সুদের হার কমবে এবং বিনিয়োগের হার বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে যথেষ্ট দক্ষ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করার, তবে অগ্রগতি খুব সামান্য (আইনশৃঙ্খলাসহ)। কিন্তু যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তাতে কিছুটা চাপ কমানো যায়।
একদিকে হলো গ্রহণযোগ্য সুদে অর্থ পাওয়ার ব্যাপার, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকটটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এলএনজি নিয়ে এসে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমরা বুঝতে চাই। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম কমছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করা হোক। দেশের ভেতরও গ্যাস অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
আর একটা বিষয় হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ন্যূনতম মজুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং মজুরির বাইরে তাঁদের ন্যায্য যে পাওনাগুলো আছে, যেমন সামাজিক সুরক্ষা, তা তাঁদের দিতে হবে। এসব হলো আধুনিক শিল্প সম্পর্কের অনুষঙ্গ। শুধু দেশের মধ্যে না, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের কোনো মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা মধ্যমেয়াদি ভাবনা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। এ সরকার যদি আগামী এক বছর পর না থাকে এবং নতুন সরকার যদি আসে তাহলে এখনকার নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এটাও একধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে ঘনীভূত করতে পারে।
আবার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ার কারণে অর্থনীতির রোডম্যাপেও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। এখন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি?
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার-সম্পর্কিত কমিটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৫-এর মতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের হাতে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য সরকার
কোনো কমিশন গঠন করেনি। শ্বেতপত্র কমিটিতে আমরা অতীতের অবস্থার ব্যবচ্ছেদ করেছি মাত্র। আর একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, সেটা কিছু কিছু পরিস্থিতি নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে বড় কাজ হচ্ছে। জ্বালানি খাত নিয়েও একটা বড় ধরনের কাজ হচ্ছে। অর্থনীতির কাজের পরিপূরক হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের বিষয়। এর বাইরে অন্যান্য উপরিকাঠামোর পরিবর্তন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থনীতির ভিত ঠিক রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই জায়গায় আমি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামনে জাতীয় বাজেট পেশ হবে। জাতীয় বাজেটের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল—যথাযথভাবে কর ব্যবস্থাপনা করা হবে। আমাদের দেশ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যক্ষ কর যাঁরা
দেন, তাঁদের আরও করের বোঝা চাপানো হয়। এ জন্য আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ করকে বিস্তৃত করার জন্য যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দেন না এবং তাঁরা টাকা কীভাবে নিয়ে যান। এঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবার রাজস্ব ব্যয় যেমন ভাতা, বেতন, ভর্তুকি ও সুদ দিতেই ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আমার প্রত্যাশা ছিল, রাজস্ব ব্যয় এমনভাবে দাঁড় করানো হবে, যেন উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়।
বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প নিয়ে এত সমালোচনার পর ঝেড়ে-মুছে ফেলে দেওয়া হলো কি না বা নতুন প্রকল্প কোন মাপকাঠিতে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে ঘাটতি বাজেট আমরা বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অথবা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মিটিয়ে থাকি। ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করা হবে, সেটা আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের জানা-বোঝার আকাঙ্ক্ষাটা অর্থনীতি-সম্পর্কিত হলেও, তার কোনো খবর আমরা এখন পর্যন্ত জানি না।
আবার অনেক লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন চিনি ও পাটকল আছে, এসবকে কীভাবে পরিবর্তনের মধ্যে আনা হবে—আমরা জানতে চেয়েছি। এরপর গার্মেন্টসের পরে যেসব শিল্প আছে, তা নিয়ে নাটকীয় কী পরিবর্তন করা হবে, এসব বোঝার ব্যাপার ছিল। আবার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার জন্য যেসব ভাতা চালু ছিল—তাদের নিয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রাপ্ত লোকের কাছে পৌঁছাবে কি না, জবাবদিহি কীভাবে করা হবে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো ভাবনা চোখে পড়ছে না।
আমরা বারবার বলেছি, মানুষ যদি ঠিকভাবে খেতে-পরতে না পারে এবং স্বস্তিতে না থাকে, কর্মসংস্থান না হয়—এই ছাত্র-যুবকেরা যে আন্দোলন করল চাকরির জন্য কোটার বিরুদ্ধে, সেই শোভন কর্মসংস্থান যদি না হয়, তাহলে যতই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হোক, কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক করিডর নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
এই দুটি বিষয়ের একটিতেও আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝি, এইসব বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বার্থকে দেখে, জাতীয় সক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল ভূকৌশল অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মতামত নিয়ে এসব করা উচিত। এ জন্য মুক্ত আলোচনা এবং জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই—তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটা তো পরিষ্কার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ছিল, তাদের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তাদের যদি সেই সমর্থন না থাকত, তাহলে তারা যেসব দুরাচার করেছে, সে মাত্রায় করতে পারত না। কিন্তু ভারত কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। তারা যে বিবেচনা থেকে কাজটি করেছিল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা তারা এখনো স্বীকার করে নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক ও সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি নিজেই এর সাক্ষী। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন, তখন এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সভা হয়েছে। সেই সভা আমি দেখেছি। সেই সভা কিন্তু আমাদের আগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছিল, যাতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা জায়গামতো ফিরে আসে। এই সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ঢাকায় সফর করেছিলেন। এটাও একটা অগ্রগতি ছিল। সেই সময়ে আমরা চেয়েছি উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং হোক। আবার আমাদের আগ্রহের কারণেই বিমসটেক সম্মেলনের পাশেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোকে আমি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে নির্মাণের ব্যাপার হিসেবে দেখি।
তারপরে প্রতাশ্যার পরে যে ঘটনাগুলো ঘটল এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো, সেটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা স্থলপথে সুতা আনা বন্ধ করে দিলাম। তারা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল আমাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার। কিছুদিন আগে আমরা জাহাজনির্মাণ চুক্তি বাতিল করলাম। এ ধরনের রেষারেষি দুই দেশের জন্যই ভালো হবে না। বাংলাদেশ ভারতকে যেমন সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে না, আমরাও ভারতকে হিমালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব না। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ককে সুস্থ রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর গড়ে তোলার ব্যাপার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি মনে করে এ সরকারের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম করবে না, তাহলে সেটা বিবেচনাপ্রসূত হবে না।
আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি যেকোনো ঘটনাবলিকে ভারতের ওপর দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটাও উপকারী হবে না। আমার কাছে মনে হয়, বিজ্ঞ, বিবেচনাপ্রসূত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাধারা ও উভয়ের মৌল স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের একেক দেশের একেক রকম স্বার্থ। আমরা কি আসলেই স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আপনি কী মনে করেন?
আমরা এখনো অন্যের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি না। তবে কোন কোন দেশের এই ভূ-রাজনীতির খেলা নিয়ে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুটির একটিও আমাদের জন্য উপকারী হবে না। আমাদের খেলার ভিকটিম হওয়ার জন্য এবং প্লেয়ার হওয়ার জন্য উচ্চাশা করা ঠিক হবে না। জ্ঞানোচিত, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত। এটা চটজলদির বিষয় না। এটাকে মধ্য মেয়াদে দেখা উচিত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো একক পক্ষের বিষয় না। অন্য কাউকে ছোট বা বড় করার ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে দুই পক্ষের ঐকমত্য লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানের মানুষ। আমরা কি তাঁর এই ৯ মাসের শাসনামলে ইউনূস ম্যাজিক দেখতে পেলাম?
তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা আমি জানি না। তবে তাঁকে তো ম্যাজিশিয়ান মনে করেই জাতি নিয়ে এসেছিল। ছোট বা বড় ম্যাজিক থাকে। অনেক সময় দর্শকেরা ম্যাজিকের কলকবজা ধরেও ফেলতে পারে। সেই অর্থে দেশে কিন্তু অনেক কিছু ঘটছে। অর্থনীতি একটা খাত থেকে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সিভিল আনরেস্ট থেকে বের হতে পেরেছে। বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্বাভাবিক করতে পেরেছি। সুতরাং এই ৯ মাসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে একটা নতুন উচ্চ রেখায় আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটা তো বিবর্তনশীল একটা উত্তরণকালীন সময়।
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটা উত্তর এবং পূর্ব পর্ব থাকে। উত্তর ও পূর্ব কালের মাঝখানে একটা কালপর্ব থাকে। কালপর্বের মধ্যে ধ্বংস ও সৃষ্টিও থাকে। এ জন্য এটা একটা উত্তরণকালীন সময়ও বটে। এ সময়েই মানুষের মাঝে জমে থাকা সব ধরনের ক্লেদ, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও হতাশা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে কলুষ মনের প্রকাশ ঘটে। এটা আমাদের নারী, বিপন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতি এবং সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আমরা আমাদের হিংসা ও বিদ্বেষ ধাবিত করি। আবার তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাও সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। এ রকম একটা সময়ের ভেতরে আমরা এখন অবস্থান করছি। এ সময়ে আমাদের সবচেয়ে কলুষ জিনিসটা প্রকাশ পাচ্ছে, একই রকমভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ড মানবিকতার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুর্বলভাবে হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। এটার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে।
ইউনূস ম্যাজিকের বাতাবরণ আমাদেরকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
মব জাস্টিস নিয়ে কী বলবেন?
যে কালপর্ব চলছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কলুষ দিকটি বের হয়ে আসে, সংঘবদ্ধভাবে তারা মানুষের ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করে। সেটিকে মব জাস্টিস বলা হচ্ছে। মব কীভাবে বিচারের মধ্যে পড়ে, সেটা আমার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই মবের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান সরকারের মনোযোগের জায়গাটা শুরু হয়েছিল সংস্কার নিয়ে, তারপর সেই সংস্কার থেকে সরে গিয়ে কোনো কোনো দল নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশি নিমজ্জিত থাকতে হচ্ছে এখন। স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে সংঘবদ্ধভাবে পুরো সমাজকে বিপন্ন করে দিতে পারে এবং একটা রাষ্ট্রকে অসহায় করে দিতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বড় শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপার আছে। কীভাবে নাগরিকেরা এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। শ্রীলঙ্কায় আমাদের মতো অভ্যুত্থান হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেন তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না?
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পার্থক্যটা হলো, সেখানে আমাদের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়ে রাজনৈতিক সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু তাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি পেশাদার ছিল। সেগুলো অনেক বেশি অরাজনৈতিকভাবে কাজ করত। ১৫-২০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ এবং নজরদারি করার জন্য কমিশনগুলো শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি পেশাদারত্ব ও অরাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে দলীয় প্রভাব তৈরি করে।
সে জন্য শ্রীলঙ্কা যত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, বাংলাদেশ সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, নেপালে একটা মাওবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। কিন্তু কখনো শুনেছেন নেপালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোনো দল বিতর্কে জড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করেছে। এসব দেশ থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
আপনি কি এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখতে পান?
এই মুহূর্তে সরকারের ভেতরে শুধু (অর্থনীতির বিষয়ে বলতে চাই) সমন্বয়হীনতার চেয়েও বেশি দেখি সহযোগিতার অভাব। এটা হলো একটা অনির্বাচিত সরকার, সীমিত ম্যান্ডেটের সরকার এবং নির্দিষ্ট সময়ের সরকার। সরকারের সবার সঙ্গে সহযোগিতা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আমি এখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা করলেও তাঁর সহযোগীরা সেটা করেন না। তাঁদের পক্ষপাতও আমি অনেক সময় দেখতে পাই। তাঁরা টিম হিসেবেও কাজ করেন না। তাঁরা আসলে নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং সে কারণে সংস্কারের পরম্পরাও দেখা যাচ্ছে না।
সবশেষ হলো স্বচ্ছতা। তাঁরা যেসব কাজ করেন, সেটাও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে উন্নতিটুকু হলো, সেটার ক্রেডিটও তাঁরা নিতে পারেন না কৌশলগত যোগাযোগের অভাবে। আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে জানতে হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদি অর্থনীতি নিয়ে ব্রিফ করেন, তখন জানতে পারি। মানে অর্থ উপদেষ্টা সেভাবে জানাতে পারেন না। এসব ঘটে সহযোগিতার অভাবের কারণে। সহযোগিতা, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতার অভাব দেখছি। একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাবও দেখছি।
এ সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এই সরকার সম্পর্কে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেটা যেন হতাশায় পরিণত না হয়। আমরা সেই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থাকতে চাই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল একটা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য। সেই কাঠামোগত সংস্কারের সুযোগটা এই দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল। সেই সুযোগটা তারা যেন নষ্ট না করে। এখন পর্যন্ত সেই জায়গায় কোনো অগ্রগতি দেখছি না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বলব, একটা সঠিক নির্বাচনই হলো এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক সঠিক নির্বাচন (আসন ভাগাভাগির নির্বাচন না)—এ রকম একটা নির্বাচন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় আছে।
সবকিছু মিলিয়ে কী মনে করেন, সেই ধরনের একটি নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
বাংলার মানুষ সব সময় আমাদের চমকিত করেছে। আশা করি, এবারও করবে। আমি ভরসা রাখি মানুষের ওপরে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন আমরা কয়েকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন বিগত সরকার উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করেছিল, সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। তথ্য-উপাত্তের মধ্যে নানা ধরনের অসংগতি ছিল, একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প নিয়ে অতি মূল্যায়ন ও প্রচার ছিল। বিগত সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে না পারার একটা ব্যাপার ছিল। একই সঙ্গে কর আদায় করতে না পারা, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ না দেওয়া। এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিল।
আমরা তো প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে শ্বেতপত্র করলাম। এটা দিয়ে উত্তরাধিকারের ভিত্তিভূমিটা পরিষ্কার হলো। এরপর এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ দাঁড়াল—অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ক্রমে বাড়ছিল, টাকার দাম দুর্বল হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছিল না। তার প্রভাব জ্বালানিসহ অন্যান্য সেক্টরেও পড়েছিল। সেই জায়গায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকার ৮-৯ মাসে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। এখন টাকার মূল্যমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকা এবং রপ্তানি চালু থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা না গেলে অর্থনীতিকে যেভাবে সচল, দক্ষ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চাই, সেভাবে এটি করা সম্ভব না। ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক খাতের অন্যান্য দিক, যেমন কর আহরণ ও অর্থায়ন এবং দক্ষভাবে সরকারিভাবে উন্নয়ন নীতি পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জ্বালানি খাত এবং অতি মূল্যায়িত সরকারি প্রকল্পগুলোতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং এগুলোকে যৌক্তিকভাবে তৈরি করা যায়—এগুলো একটা সংস্কারের ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুনভাবে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করা যায়। সরকার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষভাবে তা প্রতিভাত হয়নি।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে টেকসই করা এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে বেগবান করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ তথা ব্যক্তি খাতে মোট বিনিয়োগ আগামী বছর বাজেটে গুরুত্ব পাবে আশা করি। এর ভেতর দিয়ে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনকে গভীর করতে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। এর মূল কারণ কী?
বিনিয়োগের পতনের বিষয়টি নতুন না। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ও জাতীয় আয় আনুমানিক ২৩ শতাংশে আটকে ছিল। তাই বিনিয়োগের স্থবিরতার বিষয়টি হলো দেড় দশকের আলোচনার বিষয়। বিষয়টি হলো, আমরা বিনিয়োগের ধারাটিকে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারি? সমস্যাটা হলো, আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। ফলে আইএমএফসহ অন্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, অর্থনীতির সংকোচনের মধ্যে পড়লে, সেখানে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এটা কমানোর একটা জায়গা হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া কমানো। অর্থাৎ, সুদের হার এমন করতে হবে যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে লাভ করতে পারবে না। এখানে সেটাই হয়েছে। সুদের হার এমন জায়গায় গেছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা টাকা ধার করে লাভজনক থাকতে পারছেন না।
এখন যদি মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসে এবং টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আশা করা যায়, সুদের হার কমবে এবং বিনিয়োগের হার বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে যথেষ্ট দক্ষ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করার, তবে অগ্রগতি খুব সামান্য (আইনশৃঙ্খলাসহ)। কিন্তু যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তাতে কিছুটা চাপ কমানো যায়।
একদিকে হলো গ্রহণযোগ্য সুদে অর্থ পাওয়ার ব্যাপার, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকটটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এলএনজি নিয়ে এসে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমরা বুঝতে চাই। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম কমছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করা হোক। দেশের ভেতরও গ্যাস অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
আর একটা বিষয় হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ন্যূনতম মজুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং মজুরির বাইরে তাঁদের ন্যায্য যে পাওনাগুলো আছে, যেমন সামাজিক সুরক্ষা, তা তাঁদের দিতে হবে। এসব হলো আধুনিক শিল্প সম্পর্কের অনুষঙ্গ। শুধু দেশের মধ্যে না, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের কোনো মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা মধ্যমেয়াদি ভাবনা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। এ সরকার যদি আগামী এক বছর পর না থাকে এবং নতুন সরকার যদি আসে তাহলে এখনকার নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এটাও একধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে ঘনীভূত করতে পারে।
আবার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ার কারণে অর্থনীতির রোডম্যাপেও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। এখন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি?
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার-সম্পর্কিত কমিটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৫-এর মতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের হাতে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য সরকার
কোনো কমিশন গঠন করেনি। শ্বেতপত্র কমিটিতে আমরা অতীতের অবস্থার ব্যবচ্ছেদ করেছি মাত্র। আর একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, সেটা কিছু কিছু পরিস্থিতি নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে বড় কাজ হচ্ছে। জ্বালানি খাত নিয়েও একটা বড় ধরনের কাজ হচ্ছে। অর্থনীতির কাজের পরিপূরক হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের বিষয়। এর বাইরে অন্যান্য উপরিকাঠামোর পরিবর্তন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থনীতির ভিত ঠিক রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই জায়গায় আমি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামনে জাতীয় বাজেট পেশ হবে। জাতীয় বাজেটের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল—যথাযথভাবে কর ব্যবস্থাপনা করা হবে। আমাদের দেশ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যক্ষ কর যাঁরা
দেন, তাঁদের আরও করের বোঝা চাপানো হয়। এ জন্য আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ করকে বিস্তৃত করার জন্য যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দেন না এবং তাঁরা টাকা কীভাবে নিয়ে যান। এঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবার রাজস্ব ব্যয় যেমন ভাতা, বেতন, ভর্তুকি ও সুদ দিতেই ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আমার প্রত্যাশা ছিল, রাজস্ব ব্যয় এমনভাবে দাঁড় করানো হবে, যেন উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়।
বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প নিয়ে এত সমালোচনার পর ঝেড়ে-মুছে ফেলে দেওয়া হলো কি না বা নতুন প্রকল্প কোন মাপকাঠিতে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে ঘাটতি বাজেট আমরা বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অথবা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মিটিয়ে থাকি। ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করা হবে, সেটা আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের জানা-বোঝার আকাঙ্ক্ষাটা অর্থনীতি-সম্পর্কিত হলেও, তার কোনো খবর আমরা এখন পর্যন্ত জানি না।
আবার অনেক লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন চিনি ও পাটকল আছে, এসবকে কীভাবে পরিবর্তনের মধ্যে আনা হবে—আমরা জানতে চেয়েছি। এরপর গার্মেন্টসের পরে যেসব শিল্প আছে, তা নিয়ে নাটকীয় কী পরিবর্তন করা হবে, এসব বোঝার ব্যাপার ছিল। আবার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার জন্য যেসব ভাতা চালু ছিল—তাদের নিয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রাপ্ত লোকের কাছে পৌঁছাবে কি না, জবাবদিহি কীভাবে করা হবে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো ভাবনা চোখে পড়ছে না।
আমরা বারবার বলেছি, মানুষ যদি ঠিকভাবে খেতে-পরতে না পারে এবং স্বস্তিতে না থাকে, কর্মসংস্থান না হয়—এই ছাত্র-যুবকেরা যে আন্দোলন করল চাকরির জন্য কোটার বিরুদ্ধে, সেই শোভন কর্মসংস্থান যদি না হয়, তাহলে যতই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হোক, কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক করিডর নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
এই দুটি বিষয়ের একটিতেও আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝি, এইসব বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বার্থকে দেখে, জাতীয় সক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল ভূকৌশল অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মতামত নিয়ে এসব করা উচিত। এ জন্য মুক্ত আলোচনা এবং জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই—তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটা তো পরিষ্কার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ছিল, তাদের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তাদের যদি সেই সমর্থন না থাকত, তাহলে তারা যেসব দুরাচার করেছে, সে মাত্রায় করতে পারত না। কিন্তু ভারত কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। তারা যে বিবেচনা থেকে কাজটি করেছিল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা তারা এখনো স্বীকার করে নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক ও সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি নিজেই এর সাক্ষী। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন, তখন এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সভা হয়েছে। সেই সভা আমি দেখেছি। সেই সভা কিন্তু আমাদের আগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছিল, যাতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা জায়গামতো ফিরে আসে। এই সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ঢাকায় সফর করেছিলেন। এটাও একটা অগ্রগতি ছিল। সেই সময়ে আমরা চেয়েছি উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং হোক। আবার আমাদের আগ্রহের কারণেই বিমসটেক সম্মেলনের পাশেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোকে আমি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে নির্মাণের ব্যাপার হিসেবে দেখি।
তারপরে প্রতাশ্যার পরে যে ঘটনাগুলো ঘটল এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো, সেটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা স্থলপথে সুতা আনা বন্ধ করে দিলাম। তারা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল আমাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার। কিছুদিন আগে আমরা জাহাজনির্মাণ চুক্তি বাতিল করলাম। এ ধরনের রেষারেষি দুই দেশের জন্যই ভালো হবে না। বাংলাদেশ ভারতকে যেমন সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে না, আমরাও ভারতকে হিমালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব না। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ককে সুস্থ রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর গড়ে তোলার ব্যাপার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি মনে করে এ সরকারের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম করবে না, তাহলে সেটা বিবেচনাপ্রসূত হবে না।
আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি যেকোনো ঘটনাবলিকে ভারতের ওপর দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটাও উপকারী হবে না। আমার কাছে মনে হয়, বিজ্ঞ, বিবেচনাপ্রসূত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাধারা ও উভয়ের মৌল স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের একেক দেশের একেক রকম স্বার্থ। আমরা কি আসলেই স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আপনি কী মনে করেন?
আমরা এখনো অন্যের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি না। তবে কোন কোন দেশের এই ভূ-রাজনীতির খেলা নিয়ে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুটির একটিও আমাদের জন্য উপকারী হবে না। আমাদের খেলার ভিকটিম হওয়ার জন্য এবং প্লেয়ার হওয়ার জন্য উচ্চাশা করা ঠিক হবে না। জ্ঞানোচিত, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত। এটা চটজলদির বিষয় না। এটাকে মধ্য মেয়াদে দেখা উচিত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো একক পক্ষের বিষয় না। অন্য কাউকে ছোট বা বড় করার ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে দুই পক্ষের ঐকমত্য লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানের মানুষ। আমরা কি তাঁর এই ৯ মাসের শাসনামলে ইউনূস ম্যাজিক দেখতে পেলাম?
তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা আমি জানি না। তবে তাঁকে তো ম্যাজিশিয়ান মনে করেই জাতি নিয়ে এসেছিল। ছোট বা বড় ম্যাজিক থাকে। অনেক সময় দর্শকেরা ম্যাজিকের কলকবজা ধরেও ফেলতে পারে। সেই অর্থে দেশে কিন্তু অনেক কিছু ঘটছে। অর্থনীতি একটা খাত থেকে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সিভিল আনরেস্ট থেকে বের হতে পেরেছে। বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্বাভাবিক করতে পেরেছি। সুতরাং এই ৯ মাসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে একটা নতুন উচ্চ রেখায় আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটা তো বিবর্তনশীল একটা উত্তরণকালীন সময়।
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটা উত্তর এবং পূর্ব পর্ব থাকে। উত্তর ও পূর্ব কালের মাঝখানে একটা কালপর্ব থাকে। কালপর্বের মধ্যে ধ্বংস ও সৃষ্টিও থাকে। এ জন্য এটা একটা উত্তরণকালীন সময়ও বটে। এ সময়েই মানুষের মাঝে জমে থাকা সব ধরনের ক্লেদ, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও হতাশা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে কলুষ মনের প্রকাশ ঘটে। এটা আমাদের নারী, বিপন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতি এবং সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আমরা আমাদের হিংসা ও বিদ্বেষ ধাবিত করি। আবার তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাও সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। এ রকম একটা সময়ের ভেতরে আমরা এখন অবস্থান করছি। এ সময়ে আমাদের সবচেয়ে কলুষ জিনিসটা প্রকাশ পাচ্ছে, একই রকমভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ড মানবিকতার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুর্বলভাবে হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। এটার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে।
ইউনূস ম্যাজিকের বাতাবরণ আমাদেরকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
মব জাস্টিস নিয়ে কী বলবেন?
যে কালপর্ব চলছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কলুষ দিকটি বের হয়ে আসে, সংঘবদ্ধভাবে তারা মানুষের ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করে। সেটিকে মব জাস্টিস বলা হচ্ছে। মব কীভাবে বিচারের মধ্যে পড়ে, সেটা আমার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই মবের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান সরকারের মনোযোগের জায়গাটা শুরু হয়েছিল সংস্কার নিয়ে, তারপর সেই সংস্কার থেকে সরে গিয়ে কোনো কোনো দল নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশি নিমজ্জিত থাকতে হচ্ছে এখন। স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে সংঘবদ্ধভাবে পুরো সমাজকে বিপন্ন করে দিতে পারে এবং একটা রাষ্ট্রকে অসহায় করে দিতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বড় শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপার আছে। কীভাবে নাগরিকেরা এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। শ্রীলঙ্কায় আমাদের মতো অভ্যুত্থান হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেন তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না?
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পার্থক্যটা হলো, সেখানে আমাদের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়ে রাজনৈতিক সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু তাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি পেশাদার ছিল। সেগুলো অনেক বেশি অরাজনৈতিকভাবে কাজ করত। ১৫-২০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ এবং নজরদারি করার জন্য কমিশনগুলো শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি পেশাদারত্ব ও অরাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে দলীয় প্রভাব তৈরি করে।
সে জন্য শ্রীলঙ্কা যত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, বাংলাদেশ সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, নেপালে একটা মাওবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। কিন্তু কখনো শুনেছেন নেপালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোনো দল বিতর্কে জড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করেছে। এসব দেশ থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
আপনি কি এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখতে পান?
এই মুহূর্তে সরকারের ভেতরে শুধু (অর্থনীতির বিষয়ে বলতে চাই) সমন্বয়হীনতার চেয়েও বেশি দেখি সহযোগিতার অভাব। এটা হলো একটা অনির্বাচিত সরকার, সীমিত ম্যান্ডেটের সরকার এবং নির্দিষ্ট সময়ের সরকার। সরকারের সবার সঙ্গে সহযোগিতা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আমি এখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা করলেও তাঁর সহযোগীরা সেটা করেন না। তাঁদের পক্ষপাতও আমি অনেক সময় দেখতে পাই। তাঁরা টিম হিসেবেও কাজ করেন না। তাঁরা আসলে নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং সে কারণে সংস্কারের পরম্পরাও দেখা যাচ্ছে না।
সবশেষ হলো স্বচ্ছতা। তাঁরা যেসব কাজ করেন, সেটাও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে উন্নতিটুকু হলো, সেটার ক্রেডিটও তাঁরা নিতে পারেন না কৌশলগত যোগাযোগের অভাবে। আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে জানতে হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদি অর্থনীতি নিয়ে ব্রিফ করেন, তখন জানতে পারি। মানে অর্থ উপদেষ্টা সেভাবে জানাতে পারেন না। এসব ঘটে সহযোগিতার অভাবের কারণে। সহযোগিতা, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতার অভাব দেখছি। একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাবও দেখছি।
এ সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এই সরকার সম্পর্কে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেটা যেন হতাশায় পরিণত না হয়। আমরা সেই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থাকতে চাই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল একটা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য। সেই কাঠামোগত সংস্কারের সুযোগটা এই দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল। সেই সুযোগটা তারা যেন নষ্ট না করে। এখন পর্যন্ত সেই জায়গায় কোনো অগ্রগতি দেখছি না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বলব, একটা সঠিক নির্বাচনই হলো এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক সঠিক নির্বাচন (আসন ভাগাভাগির নির্বাচন না)—এ রকম একটা নির্বাচন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় আছে।
সবকিছু মিলিয়ে কী মনে করেন, সেই ধরনের একটি নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
বাংলার মানুষ সব সময় আমাদের চমকিত করেছে। আশা করি, এবারও করবে। আমি ভরসা রাখি মানুষের ওপরে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা, সংস্কারসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার ও মাসুদ রানার সঙ্গে।
বিভুরঞ্জন সরকার

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন আমরা কয়েকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন বিগত সরকার উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করেছিল, সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। তথ্য-উপাত্তের মধ্যে নানা ধরনের অসংগতি ছিল, একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প নিয়ে অতি মূল্যায়ন ও প্রচার ছিল। বিগত সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে না পারার একটা ব্যাপার ছিল। একই সঙ্গে কর আদায় করতে না পারা, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ না দেওয়া। এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিল।
আমরা তো প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে শ্বেতপত্র করলাম। এটা দিয়ে উত্তরাধিকারের ভিত্তিভূমিটা পরিষ্কার হলো। এরপর এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ দাঁড়াল—অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ক্রমে বাড়ছিল, টাকার দাম দুর্বল হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছিল না। তার প্রভাব জ্বালানিসহ অন্যান্য সেক্টরেও পড়েছিল। সেই জায়গায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকার ৮-৯ মাসে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। এখন টাকার মূল্যমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকা এবং রপ্তানি চালু থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা না গেলে অর্থনীতিকে যেভাবে সচল, দক্ষ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চাই, সেভাবে এটি করা সম্ভব না। ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক খাতের অন্যান্য দিক, যেমন কর আহরণ ও অর্থায়ন এবং দক্ষভাবে সরকারিভাবে উন্নয়ন নীতি পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জ্বালানি খাত এবং অতি মূল্যায়িত সরকারি প্রকল্পগুলোতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং এগুলোকে যৌক্তিকভাবে তৈরি করা যায়—এগুলো একটা সংস্কারের ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুনভাবে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করা যায়। সরকার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষভাবে তা প্রতিভাত হয়নি।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে টেকসই করা এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে বেগবান করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ তথা ব্যক্তি খাতে মোট বিনিয়োগ আগামী বছর বাজেটে গুরুত্ব পাবে আশা করি। এর ভেতর দিয়ে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনকে গভীর করতে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। এর মূল কারণ কী?
বিনিয়োগের পতনের বিষয়টি নতুন না। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ও জাতীয় আয় আনুমানিক ২৩ শতাংশে আটকে ছিল। তাই বিনিয়োগের স্থবিরতার বিষয়টি হলো দেড় দশকের আলোচনার বিষয়। বিষয়টি হলো, আমরা বিনিয়োগের ধারাটিকে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারি? সমস্যাটা হলো, আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। ফলে আইএমএফসহ অন্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, অর্থনীতির সংকোচনের মধ্যে পড়লে, সেখানে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এটা কমানোর একটা জায়গা হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া কমানো। অর্থাৎ, সুদের হার এমন করতে হবে যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে লাভ করতে পারবে না। এখানে সেটাই হয়েছে। সুদের হার এমন জায়গায় গেছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা টাকা ধার করে লাভজনক থাকতে পারছেন না।
এখন যদি মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসে এবং টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আশা করা যায়, সুদের হার কমবে এবং বিনিয়োগের হার বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে যথেষ্ট দক্ষ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করার, তবে অগ্রগতি খুব সামান্য (আইনশৃঙ্খলাসহ)। কিন্তু যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তাতে কিছুটা চাপ কমানো যায়।
একদিকে হলো গ্রহণযোগ্য সুদে অর্থ পাওয়ার ব্যাপার, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকটটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এলএনজি নিয়ে এসে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমরা বুঝতে চাই। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম কমছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করা হোক। দেশের ভেতরও গ্যাস অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
আর একটা বিষয় হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ন্যূনতম মজুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং মজুরির বাইরে তাঁদের ন্যায্য যে পাওনাগুলো আছে, যেমন সামাজিক সুরক্ষা, তা তাঁদের দিতে হবে। এসব হলো আধুনিক শিল্প সম্পর্কের অনুষঙ্গ। শুধু দেশের মধ্যে না, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের কোনো মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা মধ্যমেয়াদি ভাবনা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। এ সরকার যদি আগামী এক বছর পর না থাকে এবং নতুন সরকার যদি আসে তাহলে এখনকার নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এটাও একধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে ঘনীভূত করতে পারে।
আবার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ার কারণে অর্থনীতির রোডম্যাপেও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। এখন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি?
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার-সম্পর্কিত কমিটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৫-এর মতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের হাতে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য সরকার
কোনো কমিশন গঠন করেনি। শ্বেতপত্র কমিটিতে আমরা অতীতের অবস্থার ব্যবচ্ছেদ করেছি মাত্র। আর একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, সেটা কিছু কিছু পরিস্থিতি নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে বড় কাজ হচ্ছে। জ্বালানি খাত নিয়েও একটা বড় ধরনের কাজ হচ্ছে। অর্থনীতির কাজের পরিপূরক হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের বিষয়। এর বাইরে অন্যান্য উপরিকাঠামোর পরিবর্তন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থনীতির ভিত ঠিক রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই জায়গায় আমি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামনে জাতীয় বাজেট পেশ হবে। জাতীয় বাজেটের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল—যথাযথভাবে কর ব্যবস্থাপনা করা হবে। আমাদের দেশ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যক্ষ কর যাঁরা
দেন, তাঁদের আরও করের বোঝা চাপানো হয়। এ জন্য আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ করকে বিস্তৃত করার জন্য যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দেন না এবং তাঁরা টাকা কীভাবে নিয়ে যান। এঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবার রাজস্ব ব্যয় যেমন ভাতা, বেতন, ভর্তুকি ও সুদ দিতেই ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আমার প্রত্যাশা ছিল, রাজস্ব ব্যয় এমনভাবে দাঁড় করানো হবে, যেন উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়।
বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প নিয়ে এত সমালোচনার পর ঝেড়ে-মুছে ফেলে দেওয়া হলো কি না বা নতুন প্রকল্প কোন মাপকাঠিতে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে ঘাটতি বাজেট আমরা বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অথবা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মিটিয়ে থাকি। ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করা হবে, সেটা আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের জানা-বোঝার আকাঙ্ক্ষাটা অর্থনীতি-সম্পর্কিত হলেও, তার কোনো খবর আমরা এখন পর্যন্ত জানি না।
আবার অনেক লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন চিনি ও পাটকল আছে, এসবকে কীভাবে পরিবর্তনের মধ্যে আনা হবে—আমরা জানতে চেয়েছি। এরপর গার্মেন্টসের পরে যেসব শিল্প আছে, তা নিয়ে নাটকীয় কী পরিবর্তন করা হবে, এসব বোঝার ব্যাপার ছিল। আবার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার জন্য যেসব ভাতা চালু ছিল—তাদের নিয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রাপ্ত লোকের কাছে পৌঁছাবে কি না, জবাবদিহি কীভাবে করা হবে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো ভাবনা চোখে পড়ছে না।
আমরা বারবার বলেছি, মানুষ যদি ঠিকভাবে খেতে-পরতে না পারে এবং স্বস্তিতে না থাকে, কর্মসংস্থান না হয়—এই ছাত্র-যুবকেরা যে আন্দোলন করল চাকরির জন্য কোটার বিরুদ্ধে, সেই শোভন কর্মসংস্থান যদি না হয়, তাহলে যতই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হোক, কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক করিডর নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
এই দুটি বিষয়ের একটিতেও আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝি, এইসব বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বার্থকে দেখে, জাতীয় সক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল ভূকৌশল অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মতামত নিয়ে এসব করা উচিত। এ জন্য মুক্ত আলোচনা এবং জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই—তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটা তো পরিষ্কার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ছিল, তাদের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তাদের যদি সেই সমর্থন না থাকত, তাহলে তারা যেসব দুরাচার করেছে, সে মাত্রায় করতে পারত না। কিন্তু ভারত কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। তারা যে বিবেচনা থেকে কাজটি করেছিল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা তারা এখনো স্বীকার করে নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক ও সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি নিজেই এর সাক্ষী। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন, তখন এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সভা হয়েছে। সেই সভা আমি দেখেছি। সেই সভা কিন্তু আমাদের আগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছিল, যাতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা জায়গামতো ফিরে আসে। এই সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ঢাকায় সফর করেছিলেন। এটাও একটা অগ্রগতি ছিল। সেই সময়ে আমরা চেয়েছি উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং হোক। আবার আমাদের আগ্রহের কারণেই বিমসটেক সম্মেলনের পাশেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোকে আমি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে নির্মাণের ব্যাপার হিসেবে দেখি।
তারপরে প্রতাশ্যার পরে যে ঘটনাগুলো ঘটল এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো, সেটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা স্থলপথে সুতা আনা বন্ধ করে দিলাম। তারা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল আমাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার। কিছুদিন আগে আমরা জাহাজনির্মাণ চুক্তি বাতিল করলাম। এ ধরনের রেষারেষি দুই দেশের জন্যই ভালো হবে না। বাংলাদেশ ভারতকে যেমন সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে না, আমরাও ভারতকে হিমালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব না। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ককে সুস্থ রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর গড়ে তোলার ব্যাপার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি মনে করে এ সরকারের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম করবে না, তাহলে সেটা বিবেচনাপ্রসূত হবে না।
আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি যেকোনো ঘটনাবলিকে ভারতের ওপর দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটাও উপকারী হবে না। আমার কাছে মনে হয়, বিজ্ঞ, বিবেচনাপ্রসূত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাধারা ও উভয়ের মৌল স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের একেক দেশের একেক রকম স্বার্থ। আমরা কি আসলেই স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আপনি কী মনে করেন?
আমরা এখনো অন্যের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি না। তবে কোন কোন দেশের এই ভূ-রাজনীতির খেলা নিয়ে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুটির একটিও আমাদের জন্য উপকারী হবে না। আমাদের খেলার ভিকটিম হওয়ার জন্য এবং প্লেয়ার হওয়ার জন্য উচ্চাশা করা ঠিক হবে না। জ্ঞানোচিত, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত। এটা চটজলদির বিষয় না। এটাকে মধ্য মেয়াদে দেখা উচিত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো একক পক্ষের বিষয় না। অন্য কাউকে ছোট বা বড় করার ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে দুই পক্ষের ঐকমত্য লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানের মানুষ। আমরা কি তাঁর এই ৯ মাসের শাসনামলে ইউনূস ম্যাজিক দেখতে পেলাম?
তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা আমি জানি না। তবে তাঁকে তো ম্যাজিশিয়ান মনে করেই জাতি নিয়ে এসেছিল। ছোট বা বড় ম্যাজিক থাকে। অনেক সময় দর্শকেরা ম্যাজিকের কলকবজা ধরেও ফেলতে পারে। সেই অর্থে দেশে কিন্তু অনেক কিছু ঘটছে। অর্থনীতি একটা খাত থেকে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সিভিল আনরেস্ট থেকে বের হতে পেরেছে। বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্বাভাবিক করতে পেরেছি। সুতরাং এই ৯ মাসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে একটা নতুন উচ্চ রেখায় আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটা তো বিবর্তনশীল একটা উত্তরণকালীন সময়।
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটা উত্তর এবং পূর্ব পর্ব থাকে। উত্তর ও পূর্ব কালের মাঝখানে একটা কালপর্ব থাকে। কালপর্বের মধ্যে ধ্বংস ও সৃষ্টিও থাকে। এ জন্য এটা একটা উত্তরণকালীন সময়ও বটে। এ সময়েই মানুষের মাঝে জমে থাকা সব ধরনের ক্লেদ, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও হতাশা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে কলুষ মনের প্রকাশ ঘটে। এটা আমাদের নারী, বিপন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতি এবং সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আমরা আমাদের হিংসা ও বিদ্বেষ ধাবিত করি। আবার তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাও সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। এ রকম একটা সময়ের ভেতরে আমরা এখন অবস্থান করছি। এ সময়ে আমাদের সবচেয়ে কলুষ জিনিসটা প্রকাশ পাচ্ছে, একই রকমভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ড মানবিকতার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুর্বলভাবে হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। এটার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে।
ইউনূস ম্যাজিকের বাতাবরণ আমাদেরকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
মব জাস্টিস নিয়ে কী বলবেন?
যে কালপর্ব চলছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কলুষ দিকটি বের হয়ে আসে, সংঘবদ্ধভাবে তারা মানুষের ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করে। সেটিকে মব জাস্টিস বলা হচ্ছে। মব কীভাবে বিচারের মধ্যে পড়ে, সেটা আমার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই মবের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান সরকারের মনোযোগের জায়গাটা শুরু হয়েছিল সংস্কার নিয়ে, তারপর সেই সংস্কার থেকে সরে গিয়ে কোনো কোনো দল নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশি নিমজ্জিত থাকতে হচ্ছে এখন। স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে সংঘবদ্ধভাবে পুরো সমাজকে বিপন্ন করে দিতে পারে এবং একটা রাষ্ট্রকে অসহায় করে দিতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বড় শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপার আছে। কীভাবে নাগরিকেরা এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। শ্রীলঙ্কায় আমাদের মতো অভ্যুত্থান হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেন তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না?
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পার্থক্যটা হলো, সেখানে আমাদের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়ে রাজনৈতিক সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু তাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি পেশাদার ছিল। সেগুলো অনেক বেশি অরাজনৈতিকভাবে কাজ করত। ১৫-২০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ এবং নজরদারি করার জন্য কমিশনগুলো শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি পেশাদারত্ব ও অরাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে দলীয় প্রভাব তৈরি করে।
সে জন্য শ্রীলঙ্কা যত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, বাংলাদেশ সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, নেপালে একটা মাওবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। কিন্তু কখনো শুনেছেন নেপালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোনো দল বিতর্কে জড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করেছে। এসব দেশ থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
আপনি কি এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখতে পান?
এই মুহূর্তে সরকারের ভেতরে শুধু (অর্থনীতির বিষয়ে বলতে চাই) সমন্বয়হীনতার চেয়েও বেশি দেখি সহযোগিতার অভাব। এটা হলো একটা অনির্বাচিত সরকার, সীমিত ম্যান্ডেটের সরকার এবং নির্দিষ্ট সময়ের সরকার। সরকারের সবার সঙ্গে সহযোগিতা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আমি এখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা করলেও তাঁর সহযোগীরা সেটা করেন না। তাঁদের পক্ষপাতও আমি অনেক সময় দেখতে পাই। তাঁরা টিম হিসেবেও কাজ করেন না। তাঁরা আসলে নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং সে কারণে সংস্কারের পরম্পরাও দেখা যাচ্ছে না।
সবশেষ হলো স্বচ্ছতা। তাঁরা যেসব কাজ করেন, সেটাও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে উন্নতিটুকু হলো, সেটার ক্রেডিটও তাঁরা নিতে পারেন না কৌশলগত যোগাযোগের অভাবে। আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে জানতে হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদি অর্থনীতি নিয়ে ব্রিফ করেন, তখন জানতে পারি। মানে অর্থ উপদেষ্টা সেভাবে জানাতে পারেন না। এসব ঘটে সহযোগিতার অভাবের কারণে। সহযোগিতা, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতার অভাব দেখছি। একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাবও দেখছি।
এ সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এই সরকার সম্পর্কে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেটা যেন হতাশায় পরিণত না হয়। আমরা সেই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থাকতে চাই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল একটা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য। সেই কাঠামোগত সংস্কারের সুযোগটা এই দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল। সেই সুযোগটা তারা যেন নষ্ট না করে। এখন পর্যন্ত সেই জায়গায় কোনো অগ্রগতি দেখছি না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বলব, একটা সঠিক নির্বাচনই হলো এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক সঠিক নির্বাচন (আসন ভাগাভাগির নির্বাচন না)—এ রকম একটা নির্বাচন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় আছে।
সবকিছু মিলিয়ে কী মনে করেন, সেই ধরনের একটি নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
বাংলার মানুষ সব সময় আমাদের চমকিত করেছে। আশা করি, এবারও করবে। আমি ভরসা রাখি মানুষের ওপরে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন আমরা কয়েকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন বিগত সরকার উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করেছিল, সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। তথ্য-উপাত্তের মধ্যে নানা ধরনের অসংগতি ছিল, একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প নিয়ে অতি মূল্যায়ন ও প্রচার ছিল। বিগত সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে না পারার একটা ব্যাপার ছিল। একই সঙ্গে কর আদায় করতে না পারা, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ না দেওয়া। এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিল।
আমরা তো প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে শ্বেতপত্র করলাম। এটা দিয়ে উত্তরাধিকারের ভিত্তিভূমিটা পরিষ্কার হলো। এরপর এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ দাঁড়াল—অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ক্রমে বাড়ছিল, টাকার দাম দুর্বল হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছিল না। তার প্রভাব জ্বালানিসহ অন্যান্য সেক্টরেও পড়েছিল। সেই জায়গায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকার ৮-৯ মাসে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। এখন টাকার মূল্যমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকা এবং রপ্তানি চালু থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা না গেলে অর্থনীতিকে যেভাবে সচল, দক্ষ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চাই, সেভাবে এটি করা সম্ভব না। ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক খাতের অন্যান্য দিক, যেমন কর আহরণ ও অর্থায়ন এবং দক্ষভাবে সরকারিভাবে উন্নয়ন নীতি পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জ্বালানি খাত এবং অতি মূল্যায়িত সরকারি প্রকল্পগুলোতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং এগুলোকে যৌক্তিকভাবে তৈরি করা যায়—এগুলো একটা সংস্কারের ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুনভাবে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করা যায়। সরকার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষভাবে তা প্রতিভাত হয়নি।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে টেকসই করা এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে বেগবান করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ তথা ব্যক্তি খাতে মোট বিনিয়োগ আগামী বছর বাজেটে গুরুত্ব পাবে আশা করি। এর ভেতর দিয়ে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনকে গভীর করতে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। এর মূল কারণ কী?
বিনিয়োগের পতনের বিষয়টি নতুন না। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ও জাতীয় আয় আনুমানিক ২৩ শতাংশে আটকে ছিল। তাই বিনিয়োগের স্থবিরতার বিষয়টি হলো দেড় দশকের আলোচনার বিষয়। বিষয়টি হলো, আমরা বিনিয়োগের ধারাটিকে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারি? সমস্যাটা হলো, আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। ফলে আইএমএফসহ অন্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, অর্থনীতির সংকোচনের মধ্যে পড়লে, সেখানে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এটা কমানোর একটা জায়গা হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া কমানো। অর্থাৎ, সুদের হার এমন করতে হবে যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে লাভ করতে পারবে না। এখানে সেটাই হয়েছে। সুদের হার এমন জায়গায় গেছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা টাকা ধার করে লাভজনক থাকতে পারছেন না।
এখন যদি মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসে এবং টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আশা করা যায়, সুদের হার কমবে এবং বিনিয়োগের হার বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে যথেষ্ট দক্ষ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করার, তবে অগ্রগতি খুব সামান্য (আইনশৃঙ্খলাসহ)। কিন্তু যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তাতে কিছুটা চাপ কমানো যায়।
একদিকে হলো গ্রহণযোগ্য সুদে অর্থ পাওয়ার ব্যাপার, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকটটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এলএনজি নিয়ে এসে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমরা বুঝতে চাই। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম কমছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করা হোক। দেশের ভেতরও গ্যাস অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
আর একটা বিষয় হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ন্যূনতম মজুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং মজুরির বাইরে তাঁদের ন্যায্য যে পাওনাগুলো আছে, যেমন সামাজিক সুরক্ষা, তা তাঁদের দিতে হবে। এসব হলো আধুনিক শিল্প সম্পর্কের অনুষঙ্গ। শুধু দেশের মধ্যে না, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের কোনো মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা মধ্যমেয়াদি ভাবনা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। এ সরকার যদি আগামী এক বছর পর না থাকে এবং নতুন সরকার যদি আসে তাহলে এখনকার নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এটাও একধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে ঘনীভূত করতে পারে।
আবার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ার কারণে অর্থনীতির রোডম্যাপেও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। এখন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি?
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার-সম্পর্কিত কমিটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৫-এর মতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের হাতে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য সরকার
কোনো কমিশন গঠন করেনি। শ্বেতপত্র কমিটিতে আমরা অতীতের অবস্থার ব্যবচ্ছেদ করেছি মাত্র। আর একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, সেটা কিছু কিছু পরিস্থিতি নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে বড় কাজ হচ্ছে। জ্বালানি খাত নিয়েও একটা বড় ধরনের কাজ হচ্ছে। অর্থনীতির কাজের পরিপূরক হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের বিষয়। এর বাইরে অন্যান্য উপরিকাঠামোর পরিবর্তন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থনীতির ভিত ঠিক রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই জায়গায় আমি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামনে জাতীয় বাজেট পেশ হবে। জাতীয় বাজেটের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল—যথাযথভাবে কর ব্যবস্থাপনা করা হবে। আমাদের দেশ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যক্ষ কর যাঁরা
দেন, তাঁদের আরও করের বোঝা চাপানো হয়। এ জন্য আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ করকে বিস্তৃত করার জন্য যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দেন না এবং তাঁরা টাকা কীভাবে নিয়ে যান। এঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবার রাজস্ব ব্যয় যেমন ভাতা, বেতন, ভর্তুকি ও সুদ দিতেই ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আমার প্রত্যাশা ছিল, রাজস্ব ব্যয় এমনভাবে দাঁড় করানো হবে, যেন উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়।
বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প নিয়ে এত সমালোচনার পর ঝেড়ে-মুছে ফেলে দেওয়া হলো কি না বা নতুন প্রকল্প কোন মাপকাঠিতে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে ঘাটতি বাজেট আমরা বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অথবা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মিটিয়ে থাকি। ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করা হবে, সেটা আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের জানা-বোঝার আকাঙ্ক্ষাটা অর্থনীতি-সম্পর্কিত হলেও, তার কোনো খবর আমরা এখন পর্যন্ত জানি না।
আবার অনেক লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন চিনি ও পাটকল আছে, এসবকে কীভাবে পরিবর্তনের মধ্যে আনা হবে—আমরা জানতে চেয়েছি। এরপর গার্মেন্টসের পরে যেসব শিল্প আছে, তা নিয়ে নাটকীয় কী পরিবর্তন করা হবে, এসব বোঝার ব্যাপার ছিল। আবার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার জন্য যেসব ভাতা চালু ছিল—তাদের নিয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রাপ্ত লোকের কাছে পৌঁছাবে কি না, জবাবদিহি কীভাবে করা হবে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো ভাবনা চোখে পড়ছে না।
আমরা বারবার বলেছি, মানুষ যদি ঠিকভাবে খেতে-পরতে না পারে এবং স্বস্তিতে না থাকে, কর্মসংস্থান না হয়—এই ছাত্র-যুবকেরা যে আন্দোলন করল চাকরির জন্য কোটার বিরুদ্ধে, সেই শোভন কর্মসংস্থান যদি না হয়, তাহলে যতই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হোক, কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক করিডর নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
এই দুটি বিষয়ের একটিতেও আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝি, এইসব বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বার্থকে দেখে, জাতীয় সক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল ভূকৌশল অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মতামত নিয়ে এসব করা উচিত। এ জন্য মুক্ত আলোচনা এবং জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই—তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটা তো পরিষ্কার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ছিল, তাদের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তাদের যদি সেই সমর্থন না থাকত, তাহলে তারা যেসব দুরাচার করেছে, সে মাত্রায় করতে পারত না। কিন্তু ভারত কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। তারা যে বিবেচনা থেকে কাজটি করেছিল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা তারা এখনো স্বীকার করে নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক ও সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি নিজেই এর সাক্ষী। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন, তখন এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সভা হয়েছে। সেই সভা আমি দেখেছি। সেই সভা কিন্তু আমাদের আগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছিল, যাতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা জায়গামতো ফিরে আসে। এই সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ঢাকায় সফর করেছিলেন। এটাও একটা অগ্রগতি ছিল। সেই সময়ে আমরা চেয়েছি উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং হোক। আবার আমাদের আগ্রহের কারণেই বিমসটেক সম্মেলনের পাশেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোকে আমি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে নির্মাণের ব্যাপার হিসেবে দেখি।
তারপরে প্রতাশ্যার পরে যে ঘটনাগুলো ঘটল এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো, সেটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা স্থলপথে সুতা আনা বন্ধ করে দিলাম। তারা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল আমাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার। কিছুদিন আগে আমরা জাহাজনির্মাণ চুক্তি বাতিল করলাম। এ ধরনের রেষারেষি দুই দেশের জন্যই ভালো হবে না। বাংলাদেশ ভারতকে যেমন সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে না, আমরাও ভারতকে হিমালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব না। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ককে সুস্থ রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর গড়ে তোলার ব্যাপার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি মনে করে এ সরকারের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম করবে না, তাহলে সেটা বিবেচনাপ্রসূত হবে না।
আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি যেকোনো ঘটনাবলিকে ভারতের ওপর দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটাও উপকারী হবে না। আমার কাছে মনে হয়, বিজ্ঞ, বিবেচনাপ্রসূত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাধারা ও উভয়ের মৌল স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের একেক দেশের একেক রকম স্বার্থ। আমরা কি আসলেই স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আপনি কী মনে করেন?
আমরা এখনো অন্যের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি না। তবে কোন কোন দেশের এই ভূ-রাজনীতির খেলা নিয়ে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুটির একটিও আমাদের জন্য উপকারী হবে না। আমাদের খেলার ভিকটিম হওয়ার জন্য এবং প্লেয়ার হওয়ার জন্য উচ্চাশা করা ঠিক হবে না। জ্ঞানোচিত, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত। এটা চটজলদির বিষয় না। এটাকে মধ্য মেয়াদে দেখা উচিত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো একক পক্ষের বিষয় না। অন্য কাউকে ছোট বা বড় করার ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে দুই পক্ষের ঐকমত্য লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানের মানুষ। আমরা কি তাঁর এই ৯ মাসের শাসনামলে ইউনূস ম্যাজিক দেখতে পেলাম?
তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা আমি জানি না। তবে তাঁকে তো ম্যাজিশিয়ান মনে করেই জাতি নিয়ে এসেছিল। ছোট বা বড় ম্যাজিক থাকে। অনেক সময় দর্শকেরা ম্যাজিকের কলকবজা ধরেও ফেলতে পারে। সেই অর্থে দেশে কিন্তু অনেক কিছু ঘটছে। অর্থনীতি একটা খাত থেকে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সিভিল আনরেস্ট থেকে বের হতে পেরেছে। বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্বাভাবিক করতে পেরেছি। সুতরাং এই ৯ মাসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে একটা নতুন উচ্চ রেখায় আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটা তো বিবর্তনশীল একটা উত্তরণকালীন সময়।
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটা উত্তর এবং পূর্ব পর্ব থাকে। উত্তর ও পূর্ব কালের মাঝখানে একটা কালপর্ব থাকে। কালপর্বের মধ্যে ধ্বংস ও সৃষ্টিও থাকে। এ জন্য এটা একটা উত্তরণকালীন সময়ও বটে। এ সময়েই মানুষের মাঝে জমে থাকা সব ধরনের ক্লেদ, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও হতাশা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে কলুষ মনের প্রকাশ ঘটে। এটা আমাদের নারী, বিপন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতি এবং সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আমরা আমাদের হিংসা ও বিদ্বেষ ধাবিত করি। আবার তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাও সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। এ রকম একটা সময়ের ভেতরে আমরা এখন অবস্থান করছি। এ সময়ে আমাদের সবচেয়ে কলুষ জিনিসটা প্রকাশ পাচ্ছে, একই রকমভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ড মানবিকতার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুর্বলভাবে হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। এটার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে।
ইউনূস ম্যাজিকের বাতাবরণ আমাদেরকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
মব জাস্টিস নিয়ে কী বলবেন?
যে কালপর্ব চলছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কলুষ দিকটি বের হয়ে আসে, সংঘবদ্ধভাবে তারা মানুষের ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করে। সেটিকে মব জাস্টিস বলা হচ্ছে। মব কীভাবে বিচারের মধ্যে পড়ে, সেটা আমার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই মবের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান সরকারের মনোযোগের জায়গাটা শুরু হয়েছিল সংস্কার নিয়ে, তারপর সেই সংস্কার থেকে সরে গিয়ে কোনো কোনো দল নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশি নিমজ্জিত থাকতে হচ্ছে এখন। স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে সংঘবদ্ধভাবে পুরো সমাজকে বিপন্ন করে দিতে পারে এবং একটা রাষ্ট্রকে অসহায় করে দিতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বড় শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপার আছে। কীভাবে নাগরিকেরা এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। শ্রীলঙ্কায় আমাদের মতো অভ্যুত্থান হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেন তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না?
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পার্থক্যটা হলো, সেখানে আমাদের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়ে রাজনৈতিক সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু তাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি পেশাদার ছিল। সেগুলো অনেক বেশি অরাজনৈতিকভাবে কাজ করত। ১৫-২০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ এবং নজরদারি করার জন্য কমিশনগুলো শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি পেশাদারত্ব ও অরাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে দলীয় প্রভাব তৈরি করে।
সে জন্য শ্রীলঙ্কা যত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, বাংলাদেশ সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, নেপালে একটা মাওবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। কিন্তু কখনো শুনেছেন নেপালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোনো দল বিতর্কে জড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করেছে। এসব দেশ থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
আপনি কি এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখতে পান?
এই মুহূর্তে সরকারের ভেতরে শুধু (অর্থনীতির বিষয়ে বলতে চাই) সমন্বয়হীনতার চেয়েও বেশি দেখি সহযোগিতার অভাব। এটা হলো একটা অনির্বাচিত সরকার, সীমিত ম্যান্ডেটের সরকার এবং নির্দিষ্ট সময়ের সরকার। সরকারের সবার সঙ্গে সহযোগিতা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আমি এখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা করলেও তাঁর সহযোগীরা সেটা করেন না। তাঁদের পক্ষপাতও আমি অনেক সময় দেখতে পাই। তাঁরা টিম হিসেবেও কাজ করেন না। তাঁরা আসলে নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং সে কারণে সংস্কারের পরম্পরাও দেখা যাচ্ছে না।
সবশেষ হলো স্বচ্ছতা। তাঁরা যেসব কাজ করেন, সেটাও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে উন্নতিটুকু হলো, সেটার ক্রেডিটও তাঁরা নিতে পারেন না কৌশলগত যোগাযোগের অভাবে। আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে জানতে হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদি অর্থনীতি নিয়ে ব্রিফ করেন, তখন জানতে পারি। মানে অর্থ উপদেষ্টা সেভাবে জানাতে পারেন না। এসব ঘটে সহযোগিতার অভাবের কারণে। সহযোগিতা, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতার অভাব দেখছি। একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাবও দেখছি।
এ সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এই সরকার সম্পর্কে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেটা যেন হতাশায় পরিণত না হয়। আমরা সেই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থাকতে চাই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল একটা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য। সেই কাঠামোগত সংস্কারের সুযোগটা এই দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল। সেই সুযোগটা তারা যেন নষ্ট না করে। এখন পর্যন্ত সেই জায়গায় কোনো অগ্রগতি দেখছি না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বলব, একটা সঠিক নির্বাচনই হলো এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক সঠিক নির্বাচন (আসন ভাগাভাগির নির্বাচন না)—এ রকম একটা নির্বাচন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় আছে।
সবকিছু মিলিয়ে কী মনে করেন, সেই ধরনের একটি নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
বাংলার মানুষ সব সময় আমাদের চমকিত করেছে। আশা করি, এবারও করবে। আমি ভরসা রাখি মানুষের ওপরে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।

নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
২ দিন আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৫ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান। নাটকটি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন এই অভিনেতা।
বিনোদন প্রতিবেদক, ঢাকা

‘ভাসানে উজান’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য জেন্টেল স্পিরিট অবলম্বনে এই নাটক। দস্তয়ভস্কি মানেই মানুষের অন্তর্লোকের গভীরতম স্তরে প্রবেশ। ভাসানে উজান আমার জন্য শুধুই একটি নাটক নয়, এটি একধরনের আত্মসংলাপ। এই গল্পে ঢুকতে গিয়ে আমাকে বারবার নিজের ভেতরের অচেনা কোণগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ছাড়া অপূর্বদার নাট্যরূপে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন অটুট আছে, তেমনি আছে মঞ্চের ভাষা। আর শুভাশীষদার নির্দেশনা ছিল ধ্যানের মতো—নীরব, গভীর এবং সংযত। এই দুজনের সমন্বয় আমাকে অভিনয়ে আরও সংযমী করেছে।
ভাসানে উজানের চরিত্রটি উপস্থাপনে মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এই চরিত্রটি বাহিরের নয়, ভেতরের অভিনয় দাবি করে। এখানে কান্না নেই, চিৎকার নেই—আছে চাপা অপরাধবোধ আর নীরব অনুশোচনা। এই নীরবতাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি মনে করি, আজকের মানুষ ভেতরে ভেতরে খুব একা। ভাসানে উজান সেই একাকিত্বের আয়না। দর্শক যদি নিজের ছায়াটা একটু দেখতে পান, সেটাই আমাদের সাফল্য।
চতুর্থ প্রদর্শনীতে এসে ভাসানে উজান নাটকে কি কোনো পরিবর্তন বা পরিণতি এসেছে?
প্রতিটি প্রদর্শনীতেই নাটকটা একটু একটু করে বদলায়। আমি নিজেও বদলাই। দর্শকের নিশ্বাস, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে নাটকটি আরও পরিণত হয়ে ওঠে।
একক অভিনয়ে দীর্ঘ সময় মঞ্চে থাকতে হয়, সঙ্গ দেওয়ার কেউ থাকে না। এই একাকিত্বকে কীভাবে অনুভব করেন?
একাকিত্ব এখানে শূন্যতা নয়, বরং একধরনের গভীর উপস্থিতি। দর্শক, আলো, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি হয়। সেই সংলাপই আমাকে টেনে নেয় পুরো সময়জুড়ে।
দীর্ঘ দুই দশকের নাট্যচর্চার পরেও কি নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে ভয় বা উত্তেজনা কাজ করে?
ভয় না থাকলে অভিনয় মৃত হয়ে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আমি নতুন করে ভয় পাই, এই ভয় আমাকে সৎ রাখে, জীবিত রাখে একজন অভিনেতা হিসেবে।
ভবিষ্যতে একক নাটক ও থিয়েটার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমি চাই, থিয়েটার আরও স্থির হোক, আরও গভীর হোক। একক নাটক নিয়ে আরও গবেষণাধর্মী কাজ করতে চাই, যেখানে অভিনয় হবে আত্মানুসন্ধানের একটি মাধ্যম।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের আসন্ন কাজ নিয়ে দর্শকদের জন্য কী বলতে চান?
আমার অভিনীত নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি নতুন একটি রেপার্টরি নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ ছাড়া কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের কাজও শেষের পথে। নাটকগুলো শিগগির দর্শকদের সামনে আসবে।
‘ভাসানে উজান’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য জেন্টেল স্পিরিট অবলম্বনে এই নাটক। দস্তয়ভস্কি মানেই মানুষের অন্তর্লোকের গভীরতম স্তরে প্রবেশ। ভাসানে উজান আমার জন্য শুধুই একটি নাটক নয়, এটি একধরনের আত্মসংলাপ। এই গল্পে ঢুকতে গিয়ে আমাকে বারবার নিজের ভেতরের অচেনা কোণগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ছাড়া অপূর্বদার নাট্যরূপে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন অটুট আছে, তেমনি আছে মঞ্চের ভাষা। আর শুভাশীষদার নির্দেশনা ছিল ধ্যানের মতো—নীরব, গভীর এবং সংযত। এই দুজনের সমন্বয় আমাকে অভিনয়ে আরও সংযমী করেছে।
ভাসানে উজানের চরিত্রটি উপস্থাপনে মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এই চরিত্রটি বাহিরের নয়, ভেতরের অভিনয় দাবি করে। এখানে কান্না নেই, চিৎকার নেই—আছে চাপা অপরাধবোধ আর নীরব অনুশোচনা। এই নীরবতাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি মনে করি, আজকের মানুষ ভেতরে ভেতরে খুব একা। ভাসানে উজান সেই একাকিত্বের আয়না। দর্শক যদি নিজের ছায়াটা একটু দেখতে পান, সেটাই আমাদের সাফল্য।
চতুর্থ প্রদর্শনীতে এসে ভাসানে উজান নাটকে কি কোনো পরিবর্তন বা পরিণতি এসেছে?
প্রতিটি প্রদর্শনীতেই নাটকটা একটু একটু করে বদলায়। আমি নিজেও বদলাই। দর্শকের নিশ্বাস, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে নাটকটি আরও পরিণত হয়ে ওঠে।
একক অভিনয়ে দীর্ঘ সময় মঞ্চে থাকতে হয়, সঙ্গ দেওয়ার কেউ থাকে না। এই একাকিত্বকে কীভাবে অনুভব করেন?
একাকিত্ব এখানে শূন্যতা নয়, বরং একধরনের গভীর উপস্থিতি। দর্শক, আলো, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি হয়। সেই সংলাপই আমাকে টেনে নেয় পুরো সময়জুড়ে।
দীর্ঘ দুই দশকের নাট্যচর্চার পরেও কি নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে ভয় বা উত্তেজনা কাজ করে?
ভয় না থাকলে অভিনয় মৃত হয়ে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আমি নতুন করে ভয় পাই, এই ভয় আমাকে সৎ রাখে, জীবিত রাখে একজন অভিনেতা হিসেবে।
ভবিষ্যতে একক নাটক ও থিয়েটার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমি চাই, থিয়েটার আরও স্থির হোক, আরও গভীর হোক। একক নাটক নিয়ে আরও গবেষণাধর্মী কাজ করতে চাই, যেখানে অভিনয় হবে আত্মানুসন্ধানের একটি মাধ্যম।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের আসন্ন কাজ নিয়ে দর্শকদের জন্য কী বলতে চান?
আমার অভিনীত নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি নতুন একটি রেপার্টরি নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ ছাড়া কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের কাজও শেষের পথে। নাটকগুলো শিগগির দর্শকদের সামনে আসবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক।
০১ জুন ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৫ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে পর্দার আড়ালের সেই অভিজ্ঞতাগুলোই তুলে ধরেছেন মনিরুল ইসলাম।
মনিরুল ইসলাম

কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক।
০১ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
২ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশে প্যানোরামা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে বর্ষণ অভিনীত দুটি সিনেমা। ইমতিয়াজ বর্ষণের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিহাব আহমেদ।
শিহাব আহমেদ

দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক।
০১ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
২ দিন আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৫ দিন আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। নিলয় বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি নিজের অসামান্য কৃতিত্বের নেপথ্যের গল্প জানিয়েছেন আজকের পত্রিকাকে। তার কথাগুলো শুনেছেন ইলিয়াস শান্ত।
ইলিয়াস শান্ত

গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।
গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক।
০১ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
২ দিন আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৫ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫