Ajker Patrika

সৌদিতে বাংলাদেশি শ্রমিক: প্রতারিত, নির্যাতিত হয়ে খালি হাতে দেশে ফেরার গল্প

সৌদিতে বাংলাদেশি শ্রমিক: প্রতারিত, নির্যাতিত হয়ে খালি হাতে দেশে ফেরার গল্প

ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেটে পরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনের দৃশ্য অনেকটাই পরিচিত। তবে আরও একটি দৃশ্যও দেখা যায় সেখানে—দাঁড়িয়ে আছেন একদল যাত্রী। অনেকটাই হতভম্ব! এই মানুষদের বেশির ভাগের কাছেই একটি পাতলা কম্বল ছাড়া আর কিছুই নেই। কম্বলটিও তাঁরা উড়োজাহাজেই পেয়েছিলেন। তাঁদের পরনে সাধারণত থাকে ট্রাউজার, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। কেউ কেউ হাঁটেন খালি পায়ে। 

তাঁদের বেশির ভাগই সৌদি আরব বিতাড়িত শ্রমিক। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের মানুষ ফিরছে বাংলাদেশে। ২০২২ সালে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিককে বিতাড়িত করা হয়েছে সৌদি আরব থেকে। বেশির ভাগেরই ছিল না সেখানে বসবাসের এবং কাজ করার অনুমতি, যা ইকামা নামে পরিচিত। 

বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ থেকে তাঁরা ফিরে আসেন ক্ষুধার্ত, শরীরে জখম নিয়ে ও নিঃস্ব অবস্থায়। দেশে ফেরার পর তাঁদের হাতে বাসের টিকিট কেনার টাকাও থাকে না। তাঁরা কেবল সঙ্গে করে নিয়ে আসেন প্রতারিত, নিপীড়িত, ভুয়া চুক্তি ও মজুরি না পাওয়ার হৃদয়বিদারক সব গল্প। 

এমন একজন আমির হোসেন। সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্টদের ৪ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাত্র এক বছর পরই তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এই এক বছরের মধ্যে নয় মাস বিনা বেতনে কাজ করেছেন তিনি। 

আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আমি একটি পাঁচতারকা হোটেলে কাজ করব। কিন্তু শেষে কাজ করতে হয়েছে একটি চায়ের স্টলে!’ 

তৃতীয় ব্যক্তি বলেন, তিনি তিন মাস কাজ করেছেন। কিন্তু মাত্র এক মাসের বেতন পেয়েছেন। 

২০৩৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। এই স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, সেটি নির্ভর করছে এই মানুষগুলোর মতো কয়েক লাখ সস্তা শ্রমিকের ওপর। 

চলতি বছরই ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশের নাম ঘোষণা করবে ফিফা। আয়োজক হিসেবে দ্বিতীয় কোনো দেশের নাম আসেনি। ফলে সৌদি আরবের স্বাগতিক হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর এটি হলে নাটকীয়ভাবে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

তবে সৌদি নিয়োগকর্তাদের হাতে শ্রমিকদের নিপীড়িত হওয়ার অভিযোগ ফিফার কাছে গেলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের সময়ও অনেক অভিবাসী শ্রমিকের নির্যাতিত হওয়ার খবর বের হয়েছিল। তখন ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল আয়োজক দেশটি।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে সতর্ক করছে যে, সৌদি আরব অভিবাসী কর্মীদের নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আরেকটি বিশ্বকাপের গায়ে লাগতে পারে শ্রমিকের ওপর শোষণ ও নির্যাতনের কলঙ্ক। 

বসবাসের বৈধ কাগজপত্র না থাকার জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাধারণত দায়ী করা যায় না। বাংলাদেশে ফিরে আসা অনেকেই দাবি করেন, সৌদি আরবে তাঁদের নিয়োগকর্তা বা পৃষ্ঠপোষক তাঁদের ইকামা নথি সংগৃহ করতে বা নবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সৌদি আরবে সাড়ে তিন বছর কাজ করা মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ বলেন, ‘আমার বস আমাকে না জানিয়েই আমার ইকামা বাতিল করে দিয়েছেন। পুলিশ আমাকে ধরে আমার বসকে ডেকেছিল। বস এসে পুলিশকে বললেন, আমাকে দেশে ফেরত পাঠাতে। তাঁর কাছে আমার ছয় মাসের মজুরি পাওনা।’ 

আবার অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের অভিযোগ, তাঁদের ইকামার বৈধতা থাকলেও সৌদি আরব থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। শাহাবুদ্দিন নামের এমন এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি পুলিশকে বলেছিলাম, আমাকে গ্রেপ্তার করছেন কেন? তারা আমাকে চুপ করতে বলেছিল।’ 

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, সৌদি আরবে অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ এবং শ্রমিকেরা সেখানে স্পনসরশিপ ব্যবস্থার অধীনে নির্যাতিত এবং শোষিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে অমানবিক পরিস্থিতিতে আটকে রাখা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। শেষে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নিজ দেশে। 

সৌদি আরবে কাফালা সিস্টেম বাতিল করা হয়েছে। এই ব্যবস্থার অধীনেই নিয়োগকর্তার সঙ্গে আবদ্ধ থাকতেন শ্রমিকেরা। তবে অভিবাসীদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন মাইগ্র্যান্ট–রাইটস অর্গানাইজেশনের সম্পাদক আলী মোহাম্মদ বলেন, নিয়োগকর্তারা ওয়ার্ক পারমিট প্রত্যাহার বা নবায়ন না করার ক্ষমতা রাখেন। শ্রমিক পালিয়ে গেলে মামলাও করতে পারেন। শ্রমিকের বিরুদ্ধে কাজে অনিয়মিত থাকার অভিযোগ তুলে দেশ থেকে বিতাড়িতও করতে পারেন। 

তিনি আরও বলেন, অভিবাসীদের গ্রেপ্তার এবং নির্বাসনকে নিয়োগকর্তাদের এখতিয়ারে রাখা এই ধারণাকেই শক্তিশালী করে যে, সৌদি কর্তৃপক্ষ অভিবাসীদের কেবল শোষণযোগ্য শ্রমিক হিসেবেই বিবেচনা করে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শ্রমিকেরা বলেছেন, তাঁদের রাস্তায় আটক করা হয়েছিল বা সকালের নাশতা খাওয়ার সময় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর তাঁদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আটক কেন্দ্রে। সেখান থেকে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশে। এর আগে আটক কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল এক থেকে দুই সপ্তাহ। 

এই আটক কেন্দ্রের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়। অনেকে বলেন, তাঁদের রাখা হয়েছিল বিশাল এক ঘরে। সেখানে একসঙ্গে থাকে ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষ। গোসলের কোনো সুযোগ ছিল না। খাবার ছিল সামান্য। ১৬ দিন আটক থেকে দেশে ফেরা রহমতউল্লাহ বলেন, ‘পরিস্থিতি শোচনীয় ছিল। আমি আমার জীবনে এমন জায়গা দেখিনি।’ 

সৌদি আরব থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ ফেরত শ্রমিকদের অবস্থা সাধারণত নাজুক থাকে। প্রায় সব অভিবাসী শ্রমিককেই উপসাগরীয় দেশটিতে কাজের জন্য রিক্রুটিং এজেন্টকে টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশিদের কাছ থেকে এই ফি সর্বোচ্চ। অনেককে তাঁদের নিয়োগের খরচ মেটাতে পারার আগেই বাড়ি ফিরতে বাধ্য করা হয়। 

সৌদি আরবে ২৬ বছর কাটিয়ে আসা ৬৫ বছর বয়সী সাবির আহমেদ ঢাকা বিমানবন্দরে এসেছেন ছোট একটি ব্যাগ নিয়ে। তাতে প্রায় কিছুই নেই। বাসে বাড়ি যাওয়ার টাকাও তার কাছে নেই। সাবির আহমেদ বলেন, ‘আমি বাড়ি পৌঁছালে আমার পরিবারকে বাস ভাড়া দিতে হবে।’ এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন খালি ব্যাগটি নিয়ে। তিন দশক কাজ করার পর খালি ব্যাগটি ছাড়া তাঁর কাছে আর কিছুই নেই। 

সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, কাজ এবং আবাসিক বিধিলঙ্ঘন করেছে বলে প্রমাণিত ব্যক্তিদেরই প্রত্যাবাসন করেন তাঁরা। সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া মেনে এবং নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের মধ্যে সমন্বয় করেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আটক কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হয়। শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি এবং পরিষ্কার ও নিরাপদ পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। 

দ্য গার্ডিয়ানের নিবন্ধ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া সীমান্তে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভগবান বিষ্ণুর একটি মূর্তি ধ্বংসের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে ভারত। আজ বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনাকে একটি ‘অসম্মানজনক কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট দুই দেশকেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

কম্বোডিয়ার প্রিয়া বিহার প্রদেশের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) থাই সামরিক বাহিনী একটি এক্সকাভেটর ব্যবহার করে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তিটি গুঁড়িয়ে দেয়।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ মিটার ভেতরে কম্বোডিয়ার আন সেস এলাকায় অবস্থিত ছিল।

প্রিয়া বিহারের মুখপাত্র লিম চানপানহা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘বৌদ্ধ ও হিন্দু অনুসারীদের কাছে পূজনীয় প্রাচীন মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসের এই ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।’ তবে থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, সীমান্ত বিরোধের জের ধরে এ ধরনের কাজ অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, ‘ভূখণ্ড নিয়ে দাবি যাই থাকুক না কেন, এ ধরনের অসম্মানজনক কাজ বিশ্বজুড়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এমন ঘটনা ঘটা উচিত নয়।’

ভারত আবারও উভয় পক্ষকে শান্তি বজায় রাখতে এবং জানমাল ও ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সংলাপ ও কূটনীতির পথে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ঔপনিবেশিক আমলের সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে এই বিরোধের শুরু। গত জুলাইয়ে পাঁচ দিনের লড়াইয়ে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতে এ পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

বুধবার থেকে উভয় দেশের সামরিক কর্মকর্তারা আবারও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।

বিষ্ণু মূর্তি ধ্বংসের এই ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মহল আশা করছে, সংঘাতের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান হবে। হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবতারা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র এবং এটি আমাদের অভিন্ন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই বড়দিনের আনন্দ খুঁজছে ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে

গাজা উপত্যকায় গত দুই বছর ধরে চলা ধ্বংসলীলা আর লাশের মিছিলের মাঝেও বড়দিনের আনন্দ ফিরে পাওয়ার এক বিষাদময় চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানকার ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়। একটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি আর বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে।

৭৬ বছর বয়সী আত্তাল্লাহ তরাজি সম্প্রতি বড়দিনের উপহার হিসেবে এক জোড়া মোজা আর স্কার্ফ পেয়েছেন। গাজার কনকনে শীত থেকে বাঁচতে এগুলোই এখন তাঁর বড় সম্বল। গির্জার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তরাজি যখন গাইলেন—‘খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে, হালেলুইয়া’ (একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ প্রভুর প্রশংসা), তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বিভীষিকা ঢাকা পড়েছিল বিশ্বাসের সুরে।

গাজার সেন্ট্রাল সিটি এলাকার ‘হলি ফ্যামিলি চার্চ’ কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া তরাজি বলেন, ‘আমরা এই পবিত্র মুহূর্তে যুদ্ধ, বিপদ আর বোমাবর্ষণের কথা ভুলে যেতে চাই। খ্রিস্টের জন্মের আনন্দ আমাদের সব তিক্ততাকে ছাপিয়ে যাক।’

তবে সবার জন্য উৎসবের অনুভূতি এক নয়। শাদি আবু দাউদের জন্য এবারের বড়দিনটি অত্যন্ত কষ্টের। গত জুলাই মাসে এই ক্যাথলিক চার্চ কম্পাউন্ডেই ইজরায়েলি হামলায় তাঁর মা নিহত হন ও ছেলে আহত হয়। ইজরায়েল একে ‘দুর্ঘটনা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করলেও স্বজন হারানোর ক্ষত এখনও দগদগে। আবু দাউদ বলেন, জখম এখনও কাঁচা। এখানে কোনো উৎসব নেই, আমরা এখনও ‘না যুদ্ধ না শান্তি’র এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বাস করছি।

গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা এখন নগণ্য। যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী ওয়াফা ইমাদ এলসায়েঘ জানান, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা না থাকায় আগের মতো আমেজ নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে সাজসজ্জা করছি ঠিকই, কিন্তু যাদের সাথে সব আনন্দ ভাগ করে নিতাম, তারা আজ গাজায় নেই। এই পরিবেশ আগের মতো করে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’

৩৫ বছর বয়সী মা এলিনোর আমাশ তাঁর সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে ঘরে বড়দিনের গাছ (ক্রিসমাস ট্রি) সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা কিছু চকলেট আর মিষ্টি পেয়ে বোমার ভয় ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু তাবুগুলোতে বসবাসকারী মানুষের কষ্ট দেখে চোখে জল আসে।’

গাজার খ্রিস্টানরা মনে করেন, তাঁরা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন, এটি এই ভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের এক অটল সাক্ষ্য। আত্তাল্লাহ তরাজি প্রার্থনা করেন যেন তাঁর জাতি শান্তি ও স্বাধীনতা পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই পরিস্থিতির চেয়েও বড়দিনের আনন্দ এবং তাঁদের বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী।

গত অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গাজায় হামলার তীব্রতা কমলেও মাঝেমধ্যেই প্রাণঘাতী আঘাত আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

অতিবৃষ্টিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের তাবুগুলো তলিয়ে গেছে, যা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মস্কোতে বিস্ফোরণ, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত তিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৪২
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক বিস্ফোরণে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আরেকজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার তদন্ত সংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, দক্ষিণ মস্কোর ইয়েলেতস্কায়া স্ট্রিট এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোরে। ঘটনাস্থলটি সেই জায়গার কাছে, যেখানে চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক রুশ জেনারেল গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন।

রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বিবৃতির বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা করার সময় বিস্ফোরণটি ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তারা যখন ওই ব্যক্তির কাছে যান, তখনই একটি বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এ সময় তাঁদের পাশে থাকা আরেকজন ব্যক্তিও বিস্ফোরণে নিহত হন।

নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বয়স ছিল ২৪ ও ২৫ বছর। আল জাজিরার মস্কো প্রতিনিধি ইউলিয়া শাপোভালোভার তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে একজনের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি তাদের পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।’ বিস্ফোরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। কাছাকাছি বসবাসকারী আলেক্সান্ডার নামের এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘একটা ভয়ংকর শব্দ হয়েছিল, কয়েক দিন আগের গাড়ি বিস্ফোরণের মতোই।’ আরেক বাসিন্দা রোজা জানান, বিস্ফোরণের সময় তাঁদের পুরো ভবনটি কেঁপে ওঠে এবং তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

বিস্ফোরণের পরপরই এলাকাটি ঘিরে ফেলে পুলিশ বাহিনী। রুশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তদন্তকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেছে।

এই বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই এলাকার কাছে, যেখানে গত সোমবার রুশ জেনারেল ফানিল সারভারভ গাড়ির নিচে পেতে রাখা বিস্ফোরক ডিভাইসের মাধ্যমে নিহত হন। সারভারভ রুশ জেনারেল স্টাফের অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানের জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

রাশিয়া জেনারেল সারভারভ হত্যার পেছনে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তবে ইউক্রেন এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া ও দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় রুশ সামরিক কর্মকর্তা এবং এই যুদ্ধের সমর্থক বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শানলিউরফা: নবীদের যে নগরে মিলেছে তিন ধর্মের মানুষ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের শানলিউরফা শহরকে বলা হয় ‘নবীদের নগরী’। সিরিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি হাজার বছরের ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগস্থল। এখানে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম—এই তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের কাহিনি এসে মিলেছে।

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, শানলিউরফার পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নীলাভ পানির ‘বালিক্লিগোল’ বা ‘মাছের হ্রদ’। মূলত এখানে আছে দুটি পুকুর। ধর্মীয় মতে, দুটি পুকুরের বড়টিতে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন মেসোপটেমিয়ার রাজা নমরুদ। আল্লাহ তৎক্ষণাৎ ওই আগুনকে পানি এবং জ্বলন্ত কাঠকে মাছে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ ছাড়া ‘আইনজেলিহা’ নামের ছোট পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে নমরুদের কন্যা জেলিহার নামে। ইব্রাহিম নবীর প্রতি বিশ্বাসের কারণে এই পুকুরে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জেলিহা প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস।

দুটি পুকুরই কালো দাগওয়ালা কার্প মাছে ভরা। এগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। তাই এই মাছগুলোকে ধরা বা এগুলোর ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই কারণেই বালিক্লিগোল শুধু একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং গভীর ধর্মীয় আবেগ ও ইতিহাসের প্রতীক। মাছের গায়ে থাকা কালো দাগগুলোকে আগুনের ছাইয়ের চিহ্ন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন
বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শানলিউরফা নানা নামে পরিচিত ছিল। আরামীয়রা একে ডাকত উরহাই, গ্রিক শাসনামলে নাম ছিল এডেসা, আরব বিজয়ের পর নাম হয় রোহা। অটোমানেরা ১৬০৭ সালে এই নগরীর নাম রাখে উরফা। পরে ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিরোধের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্ত হয় ‘শানলি’, অর্থাৎ ‘গৌরবময়’।

এই শহরটি ইব্রাহিম (আ.), আইয়ুব (আ.), নূহ (আ.) ও জেথ্রোর মতো নবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিশ্বাস করা হয়। পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত বালিক্লিগোল মুসলিম তীর্থযাত্রীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। এখানেই রয়েছে মেভলিদ-ই-হালিল গুহা। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই জন্ম হয়েছিল ইব্রাহিম নবীর। নারীরা সন্তান কামনায় ও আরোগ্য লাভের আশায় এই গুহায় আসেন।

তবে শানলিউরফার ইতিহাস শুধু ধর্মগ্রন্থেই সীমাবদ্ধ নয়। শহরটি থেকে ১৪ মাইল দূরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। প্রায় ১১-১২ হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটি মানবসভ্যতার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯৬০০ সালের এই নিওলিথিক স্থাপনাটি কৃষি ও মৃৎশিল্পের আগেই নির্মিত—যা প্রমাণ করে, ধর্মীয় আচার হয়তো সভ্যতার সূচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে পাওয়া টি-আকৃতির স্তম্ভ ও খোদাই করা পশুর ভাস্কর্য বিশ্বব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন

শানলিউরফা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি নিদর্শন। এর মধ্যে ‘উরফা ম্যান’ নামের ১১ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো মানব মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশেই হালেপলিবাহচে মোজাইক জাদুঘর ও কিজিলকয়ুন নেক্রোপলিস শহরের রোমান যুগের ইতিহাস তুলে ধরে।

ইতিহাস ও ধর্মের পাশাপাশি শানলিউরফা খাবার ও আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত। উরফা কাবাব, পাটলিজান কাবাব, চি কফতে ও শিল্লিক তাতলিসি এখানকার জনপ্রিয় খাবার। স্থানীয়দের সঙ্গে ধীরে চা পান, পুরোনো বাজারে হাঁটা আর ‘সিরা গেসেসি’ নামের সাংস্কৃতিক আড্ডায় অংশ নিলে বোঝা যায়—এই শহর শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও।

শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন
শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন

বলা যায়—শানলিউরফা যেন এক জীবন্ত জাদুঘর; যেখানে ধর্ম, ইতিহাস ও মানবসভ্যতার গল্প একসূত্রে গেঁথে পাশাপাশি হাঁটে অতীত ও বর্তমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত