Ajker Patrika

অস্ত্রসংকটে ইউক্রেন, সঙ্গে পশ্চিমা সমর্থন হারানোর শঙ্কা

আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ২১: ০৯
অস্ত্রসংকটে ইউক্রেন, সঙ্গে পশ্চিমা সমর্থন হারানোর শঙ্কা

এক বছর আগেও ইউক্রেন কমান্ডার ভলোদিমিরের সেনারা বিএম-২১ গ্রাদ রকেট লাঞ্চার থেকে ৪০ ব্যারেল গোলা একসঙ্গে রুশ সেনাদের অভিমুখে ছুড়তে পারতেন। কিন্তু এখন ছুড়তে পারছেন মাত্র একটি। ভলোদিমির বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নেই।’

ভলোদিমিরের ইউনিটের নাম ট্যাংক ব্যাটালিয়ন-১৭। তাঁরা এখন বাখমুতের প্রান্তে লড়াই চালিয়ে যেতে গোলাবারুদের সহায়তা চাচ্ছেন। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের শহর বাখমুত দখলের জন্য রুশ সেনারা কয়েক মাস ধরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। রুশ সেনারা ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হলেও খোয়াতে হচ্ছে অনেক কিছুই।

ইউক্রেনের বাখমুতে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি কভার করছেন বিবিসির প্রতিরক্ষা বিটের প্রতিনিধি জোনাথন বিয়াল। তাঁর মুখেই শোনা যাক ইউক্রেন কমান্ডারে বর্তমান সংকট।

‘আমরা যখন গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম তখন ভলোদিমির ১৫ কিলোমিটার দূরে রুশ মর্টার শেল লক্ষ্য করে রকেট ফায়ার করার একটি বার্তা পান। বার্তা পাওয়ার পর তাঁরা নিজেদের যানবাহনটি লতাপাতার আচ্ছাদন খুলে ফেলে সামনের ফাঁকা মাঠের দিকে এগোতে থাকেন। এক কিলোমিটার যাওয়ার পর লক্ষ্যবস্তুর অভিমুখে গোলা ছোড়েন। এ সময় ইউক্রেনীয় একটি ড্রোন আমাদের মাথার ওপর চক্রাকারে ঘুরছিল। পরে তাঁরা জানান, প্রথম গোলাটি ৫০ মিটারের হেরফেরের জন্য লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারেনি। তাই তাঁরা যানবাহন সঠিক স্থানে নিয়ে আরও দুটি গোলা ছুড়ে জঙ্গলে ফিরে আসেন। এই দুটি গোলা শত্রুপক্ষের যথাস্থানে আঘাত করেছে বলেও জানান তাঁরা।

নিরাশার কণ্ঠে ভলোদিমির বিবিসির সাংবাদিকে বলেন, ‘আমাদের হাতে যথেষ্ট গোলাবারুদ থাকলে বাখমুতের বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া সহযোগীদের আরও সাহায্য করতে পারতাম। আমাদের হাতে থাকা গ্রাদ অ্যামুনিশন শেষ হয়ে আসছে। এখন আমরা অন্য দেশের রকেটের ওপর নির্ভর করছি। চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও পাকিস্তান থেকে এসব সহায়তা পাচ্ছি। এসবের গুণমান ভালো না।’

যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে ইউক্রেন সেনাদের ততই অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকট বাড়ছে। হাঁকডাক করলেও শক্তিধরদের সাড়া মিলছে না। ফলে তারা এখন আক্রমণাত্মক নীতির দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু ইউক্রেনকে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে বিপুল সম্পদ ব্যয় করতে হচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আধুনিক ট্যাংক ও অস্ত্র ইউক্রেনে পৌঁছালেও ইউক্রেন সেনারা এখনো সোভিয়েত আমলের অস্ত্রের ওপরই নির্ভরশীল। 

ইউক্রেন সেনা ঘাঁটিতে রাশিয়ার তৈরি বাক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চাহিদা এখনো সবচেয়ে বেশি। এটি আকাশসীমার মধ্যে নিচু বা উঁচুতে উড়ে আসা রকেট, ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে সহজেই। যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এই অস্ত্রটি রুশ আক্রমণকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটি ইউক্রেনীয় সম্মুখ সমরের সেনা বা জঙ্গলের মধ্যেও আর তেমন চোখে পড়ছে না। 

বাক পরিচালনার কমান্ডার জোসেফ বলেন, ‘এই ব্যবস্থা রাশিয়ার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। আমরা এসব অস্ত্র রক্ষার জন্য অনেক সতর্কতা অবলম্বন করছি।’ জোসেফ এই কথাগুলো বলছিলেন তখন তাঁদের হাতে থাকা বাকের মাথায় দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যেখানে সাধারণত চারটি থাকে। 

চলতি মাসের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালার গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। এসব নথির সত্যতা ও ইউক্রেনে বাক ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের বিষয়ে জোসেফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এটি সত্য নয়।’ তবে তিনি জানান, ইউক্রেনের আরও বাক মিসাইল দরকার।

সোভিয়েত আমলের গ্রাদ রকেট লাঞ্চারই ইউক্রেনের ভরসা। চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও পাকিস্তান থেকে এই অস্ত্র আসছেজোসেফ আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত বাক ক্ষেপণাস্ত্র নেই। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশও আমাদের কাছে নেই। কারণ, ইউক্রেনে এসবের কারখানা নেই।’

যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস হওয়ার কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে জোসেফ বলেন, ‘এসব নথি ফাঁস হয়ে আসলে কি কোনো গোপন তথ্য বেরিয়ে পড়েছে? আমাদের আমেরিকার সঙ্গে বিরোধের কোনো কারণ আছে কি? ওই সব নথিতে আমাদের সম্পর্কে যেসব তথ্য ছিল, সেসব রাশিয়া ২০ বছর আগে থেকেই জানত। এসব আসলেই হাস্যকর।’ 
 
এদিকে রাশিয়া এখনো জানে না ইউক্রেনের আক্রমণাত্মক নীতি কখন বা কোথা থেকে শুরু হবে। ইউক্রেন এখন শুধু হারানো ৮০০ মাইল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। এর জন্য তারা আক্রমণাত্মক নীতিতে যাওয়ার আগে অস্ত্র সরঞ্জাম সংগ্রহ ও নতুন ইউনিট তৈরি করছে। যখনই ইউক্রেন আক্রমণাত্মক নীতিতে যাবে রাশিয়াকেও কিছু নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এখন দুই পক্ষই রণক্ষেত্রের সম্মুখভাগকে শক্তিশালী করছে। 

বাখমুতের পাশের একটি অঞ্চলে ইউক্রেন সেনাদের ৮০ নম্বর ব্রিগেডকে শত শত কামান প্রস্তুত করতে দেখা গেছে। তারা রুশ সেনাদের প্রতিহত করতে আগেভাগেই প্রস্তুত হচ্ছেন। তারা পশ্চিম থেকে আসা বিভিন্ন অস্ত্রও ব্যবহার করছে। 

এই ব্রিগেডের সেনাপতি সেরহি ও তাঁর সেনারা ব্রিটিশদের তৈরি এল-১১৯ কামানের গোলা ব্যবহার করছেন। সেহরি বলেন, ‘আমরা এসব পাচ্ছি রেশনের মতো। দিনে মাত্র ৩০টি গোলা ছুড়তে পারি। আমাদের যথেষ্ট সৈন্য রয়েছে এখন। কিন্তু সংকট গোলাবারুদের।’

এ বছর ইউক্রেনের জন্য জয় বা পরাজয় নির্ধারণের বছর কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা যদি আক্রমণাত্মক নীতিতে যাই এবং হারানো অঞ্চল দখলে নিতে পারি, তাহলে এ বছরেই আমরা যুদ্ধে জিতে যাব। কিন্তু এমনটি যদি না হয় তাহলে কী হবে জানি না। কেননা, ৫ বা ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে নেই।’

গ্রাদ কমান্ডার ভলোদিমিরের বক্তব্য আরও হতাশাজনক। তিনি বলেন, ‘দেশবাসী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিও অচল হয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধনীতি এ বছরই নির্ধারণ করা না হলে পশ্চিমা সমর্থন কমতে পারে। পশ্চিমারাও সাহায্য করতে করতে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটি নিয়ে আমরা আরও উদ্বিগ্ন।’ 

ইউক্রেনের বাখমুত থেকে বিবিসির জোনাথন বিয়াল। অনুবাদ করেছেন মুহম্মদ আবদুল বাছেদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া সীমান্তে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভগবান বিষ্ণুর একটি মূর্তি ধ্বংসের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে ভারত। আজ বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনাকে একটি ‘অসম্মানজনক কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট দুই দেশকেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

কম্বোডিয়ার প্রিয়া বিহার প্রদেশের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) থাই সামরিক বাহিনী একটি এক্সকাভেটর ব্যবহার করে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তিটি গুঁড়িয়ে দেয়।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ মিটার ভেতরে কম্বোডিয়ার আন সেস এলাকায় অবস্থিত ছিল।

প্রিয়া বিহারের মুখপাত্র লিম চানপানহা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘বৌদ্ধ ও হিন্দু অনুসারীদের কাছে পূজনীয় প্রাচীন মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসের এই ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।’ তবে থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, সীমান্ত বিরোধের জের ধরে এ ধরনের কাজ অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, ‘ভূখণ্ড নিয়ে দাবি যাই থাকুক না কেন, এ ধরনের অসম্মানজনক কাজ বিশ্বজুড়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এমন ঘটনা ঘটা উচিত নয়।’

ভারত আবারও উভয় পক্ষকে শান্তি বজায় রাখতে এবং জানমাল ও ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সংলাপ ও কূটনীতির পথে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ঔপনিবেশিক আমলের সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে এই বিরোধের শুরু। গত জুলাইয়ে পাঁচ দিনের লড়াইয়ে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতে এ পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

বুধবার থেকে উভয় দেশের সামরিক কর্মকর্তারা আবারও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।

বিষ্ণু মূর্তি ধ্বংসের এই ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মহল আশা করছে, সংঘাতের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান হবে। হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবতারা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র এবং এটি আমাদের অভিন্ন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই বড়দিনের আনন্দ খুঁজছে ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে

গাজা উপত্যকায় গত দুই বছর ধরে চলা ধ্বংসলীলা আর লাশের মিছিলের মাঝেও বড়দিনের আনন্দ ফিরে পাওয়ার এক বিষাদময় চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানকার ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়। একটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি আর বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে।

৭৬ বছর বয়সী আত্তাল্লাহ তরাজি সম্প্রতি বড়দিনের উপহার হিসেবে এক জোড়া মোজা আর স্কার্ফ পেয়েছেন। গাজার কনকনে শীত থেকে বাঁচতে এগুলোই এখন তাঁর বড় সম্বল। গির্জার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তরাজি যখন গাইলেন—‘খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে, হালেলুইয়া’ (একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ প্রভুর প্রশংসা), তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বিভীষিকা ঢাকা পড়েছিল বিশ্বাসের সুরে।

গাজার সেন্ট্রাল সিটি এলাকার ‘হলি ফ্যামিলি চার্চ’ কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া তরাজি বলেন, ‘আমরা এই পবিত্র মুহূর্তে যুদ্ধ, বিপদ আর বোমাবর্ষণের কথা ভুলে যেতে চাই। খ্রিস্টের জন্মের আনন্দ আমাদের সব তিক্ততাকে ছাপিয়ে যাক।’

তবে সবার জন্য উৎসবের অনুভূতি এক নয়। শাদি আবু দাউদের জন্য এবারের বড়দিনটি অত্যন্ত কষ্টের। গত জুলাই মাসে এই ক্যাথলিক চার্চ কম্পাউন্ডেই ইজরায়েলি হামলায় তাঁর মা নিহত হন ও ছেলে আহত হয়। ইজরায়েল একে ‘দুর্ঘটনা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করলেও স্বজন হারানোর ক্ষত এখনও দগদগে। আবু দাউদ বলেন, জখম এখনও কাঁচা। এখানে কোনো উৎসব নেই, আমরা এখনও ‘না যুদ্ধ না শান্তি’র এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বাস করছি।

গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা এখন নগণ্য। যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী ওয়াফা ইমাদ এলসায়েঘ জানান, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা না থাকায় আগের মতো আমেজ নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে সাজসজ্জা করছি ঠিকই, কিন্তু যাদের সাথে সব আনন্দ ভাগ করে নিতাম, তারা আজ গাজায় নেই। এই পরিবেশ আগের মতো করে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’

৩৫ বছর বয়সী মা এলিনোর আমাশ তাঁর সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে ঘরে বড়দিনের গাছ (ক্রিসমাস ট্রি) সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা কিছু চকলেট আর মিষ্টি পেয়ে বোমার ভয় ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু তাবুগুলোতে বসবাসকারী মানুষের কষ্ট দেখে চোখে জল আসে।’

গাজার খ্রিস্টানরা মনে করেন, তাঁরা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন, এটি এই ভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের এক অটল সাক্ষ্য। আত্তাল্লাহ তরাজি প্রার্থনা করেন যেন তাঁর জাতি শান্তি ও স্বাধীনতা পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই পরিস্থিতির চেয়েও বড়দিনের আনন্দ এবং তাঁদের বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী।

গত অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গাজায় হামলার তীব্রতা কমলেও মাঝেমধ্যেই প্রাণঘাতী আঘাত আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

অতিবৃষ্টিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের তাবুগুলো তলিয়ে গেছে, যা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মস্কোতে বিস্ফোরণ, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত তিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৪২
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক বিস্ফোরণে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আরেকজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার তদন্ত সংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, দক্ষিণ মস্কোর ইয়েলেতস্কায়া স্ট্রিট এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোরে। ঘটনাস্থলটি সেই জায়গার কাছে, যেখানে চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক রুশ জেনারেল গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন।

রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বিবৃতির বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা করার সময় বিস্ফোরণটি ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তারা যখন ওই ব্যক্তির কাছে যান, তখনই একটি বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এ সময় তাঁদের পাশে থাকা আরেকজন ব্যক্তিও বিস্ফোরণে নিহত হন।

নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বয়স ছিল ২৪ ও ২৫ বছর। আল জাজিরার মস্কো প্রতিনিধি ইউলিয়া শাপোভালোভার তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে একজনের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি তাদের পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।’ বিস্ফোরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। কাছাকাছি বসবাসকারী আলেক্সান্ডার নামের এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘একটা ভয়ংকর শব্দ হয়েছিল, কয়েক দিন আগের গাড়ি বিস্ফোরণের মতোই।’ আরেক বাসিন্দা রোজা জানান, বিস্ফোরণের সময় তাঁদের পুরো ভবনটি কেঁপে ওঠে এবং তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

বিস্ফোরণের পরপরই এলাকাটি ঘিরে ফেলে পুলিশ বাহিনী। রুশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তদন্তকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেছে।

এই বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই এলাকার কাছে, যেখানে গত সোমবার রুশ জেনারেল ফানিল সারভারভ গাড়ির নিচে পেতে রাখা বিস্ফোরক ডিভাইসের মাধ্যমে নিহত হন। সারভারভ রুশ জেনারেল স্টাফের অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানের জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

রাশিয়া জেনারেল সারভারভ হত্যার পেছনে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তবে ইউক্রেন এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া ও দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় রুশ সামরিক কর্মকর্তা এবং এই যুদ্ধের সমর্থক বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শানলিউরফা: নবীদের যে নগরে মিলেছে তিন ধর্মের মানুষ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের শানলিউরফা শহরকে বলা হয় ‘নবীদের নগরী’। সিরিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি হাজার বছরের ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগস্থল। এখানে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম—এই তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের কাহিনি এসে মিলেছে।

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, শানলিউরফার পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নীলাভ পানির ‘বালিক্লিগোল’ বা ‘মাছের হ্রদ’। মূলত এখানে আছে দুটি পুকুর। ধর্মীয় মতে, দুটি পুকুরের বড়টিতে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন মেসোপটেমিয়ার রাজা নমরুদ। আল্লাহ তৎক্ষণাৎ ওই আগুনকে পানি এবং জ্বলন্ত কাঠকে মাছে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ ছাড়া ‘আইনজেলিহা’ নামের ছোট পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে নমরুদের কন্যা জেলিহার নামে। ইব্রাহিম নবীর প্রতি বিশ্বাসের কারণে এই পুকুরে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জেলিহা প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস।

দুটি পুকুরই কালো দাগওয়ালা কার্প মাছে ভরা। এগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। তাই এই মাছগুলোকে ধরা বা এগুলোর ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই কারণেই বালিক্লিগোল শুধু একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং গভীর ধর্মীয় আবেগ ও ইতিহাসের প্রতীক। মাছের গায়ে থাকা কালো দাগগুলোকে আগুনের ছাইয়ের চিহ্ন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন
বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শানলিউরফা নানা নামে পরিচিত ছিল। আরামীয়রা একে ডাকত উরহাই, গ্রিক শাসনামলে নাম ছিল এডেসা, আরব বিজয়ের পর নাম হয় রোহা। অটোমানেরা ১৬০৭ সালে এই নগরীর নাম রাখে উরফা। পরে ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিরোধের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্ত হয় ‘শানলি’, অর্থাৎ ‘গৌরবময়’।

এই শহরটি ইব্রাহিম (আ.), আইয়ুব (আ.), নূহ (আ.) ও জেথ্রোর মতো নবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিশ্বাস করা হয়। পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত বালিক্লিগোল মুসলিম তীর্থযাত্রীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। এখানেই রয়েছে মেভলিদ-ই-হালিল গুহা। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই জন্ম হয়েছিল ইব্রাহিম নবীর। নারীরা সন্তান কামনায় ও আরোগ্য লাভের আশায় এই গুহায় আসেন।

তবে শানলিউরফার ইতিহাস শুধু ধর্মগ্রন্থেই সীমাবদ্ধ নয়। শহরটি থেকে ১৪ মাইল দূরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। প্রায় ১১-১২ হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটি মানবসভ্যতার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯৬০০ সালের এই নিওলিথিক স্থাপনাটি কৃষি ও মৃৎশিল্পের আগেই নির্মিত—যা প্রমাণ করে, ধর্মীয় আচার হয়তো সভ্যতার সূচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে পাওয়া টি-আকৃতির স্তম্ভ ও খোদাই করা পশুর ভাস্কর্য বিশ্বব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন

শানলিউরফা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি নিদর্শন। এর মধ্যে ‘উরফা ম্যান’ নামের ১১ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো মানব মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশেই হালেপলিবাহচে মোজাইক জাদুঘর ও কিজিলকয়ুন নেক্রোপলিস শহরের রোমান যুগের ইতিহাস তুলে ধরে।

ইতিহাস ও ধর্মের পাশাপাশি শানলিউরফা খাবার ও আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত। উরফা কাবাব, পাটলিজান কাবাব, চি কফতে ও শিল্লিক তাতলিসি এখানকার জনপ্রিয় খাবার। স্থানীয়দের সঙ্গে ধীরে চা পান, পুরোনো বাজারে হাঁটা আর ‘সিরা গেসেসি’ নামের সাংস্কৃতিক আড্ডায় অংশ নিলে বোঝা যায়—এই শহর শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও।

শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন
শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন

বলা যায়—শানলিউরফা যেন এক জীবন্ত জাদুঘর; যেখানে ধর্ম, ইতিহাস ও মানবসভ্যতার গল্প একসূত্রে গেঁথে পাশাপাশি হাঁটে অতীত ও বর্তমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত