Ajker Patrika

জুলাই বিপ্লবে অপ্রতিরোধ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মুশফিকুর রিজন, জাবি
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৩০
৫ আগষ্ট, লং মার্চে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল।
৫ আগষ্ট, লং মার্চে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল।

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় গণজাগরণ, যা ২০২৪ সালের ১ জুলাই শুরু হয়ে ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে। ৩৬ দিনের এই আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যেখানে প্রতিদিন নিরবচ্ছিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনের সূচনা ঘটে ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে। সেদিন সরকারি চাকরির নিয়োগব্যবস্থায় কোটা সংস্কারের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের সরকারপ্রদত্ত একটি সার্কুলারকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ অবৈধ ঘোষণা করে। এর পরপরই শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে এবং ৫৬ শতাংশ কোটা সুবিধা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়, যার মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একটি। ৬ জুনও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয়; তবে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং ১ জুলাই ছুটি শেষে পুনরায় আন্দোলনের সূচনা হয়।

জাহাঙ্গীরনগরে প্রতিটি কর্মসূচির শুরু হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে। সেখানেই গণতান্ত্রিক আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচি ও ব্যানার নির্ধারিত হতো। একই সঙ্গে আন্দোলন চালাতে ক্রাউড ফান্ডিংও চলত। সারা দেশে যে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে কর্মসূচি চলেছে, তার নাম প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর থেকেই।

৫ আগষ্ট, লং মার্চে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল।
৫ আগষ্ট, লং মার্চে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল।

এ বিষয়ে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তৌহিদ সিয়াম জানান, ‘আমরা লাইব্রেরির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই কীভাবে আন্দোলন পরিচালিত হবে। ২৯ জুন আমরা একটি সাধারণ সভা করি, যেখানে সিদ্ধান্ত হয় একটি একক ব্যানারে আন্দোলন পরিচালনা করা হবে। ওই দিনই আমাদের ইন্টারনাল গ্রুপে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা’ নামটি প্রস্তাব করি এবং পরদিন ৩০ জুন তা পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এরপর ১ জুলাই থেকে সারা দেশে এই ব্যানারে আন্দোলন চলে।’

১ জুলাই থেকে প্রতিদিনই জাহাঙ্গীরনগরে লাগাতার কর্মসূচি চলতে থাকে এবং প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রতীকী অবরোধ করে। ৪ জুলাই একটি রায় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই রায় শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে গেলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ওই দিনই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল এবং সদস্যসচিব হন পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজ ইসলাম মেঘ। পরে ৩৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি সমন্বয়ক কমিটিও গঠন করা হয়।

৫ জুলাই মানববন্ধনের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং ৬ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ৭ জুলাই সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ ডাকা হয়। যদিও কেন্দ্র থেকে বিকেল ৩টায় ব্লকেড শুরুর নির্দেশনা ছিল, জাহাঙ্গীরনগরে সকাল সাড়ে ১১টা থেকেই এটি শুরু হয়—যা ছিল দেশের প্রথম ব্লকেড কর্মসূচি।

১০ জুলাই পর্যন্ত টানা ব্লকড কর্মসূচি চলে। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ কোটার ওপর চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন। পরদিন ১১ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তবে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে মহাসড়ক অবরোধ করে জাবি শিক্ষার্থীরা। ১২ ও ১৩ জুলাই পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার বিতর্কিত ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ মন্তব্যের প্রতিবাদে সারা দেশের মত জাবির ক্যাম্পাসেও ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগের হামলা ও হল সিসিটিভি না দেখানোর প্রতিবাদে হল প্রাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেন।

২রা জুলাই  ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রতীকী অবরোধ
২রা জুলাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রতীকী অবরোধ

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই দিন সন্ধ্যায় মশাল মিছিলের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে সময় পরিবর্তন করে বিকেল পাঁচটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে পৌঁছালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এ সময় নারী শিক্ষার্থীদেরও মারধর করা হয়। পরে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। এই ঘটনায় অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন।

এই ঘটনার বিচার দাবিতে শিক্ষার্থীরা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে জড়ো হন এবং পরে উপাচার্যের বাসভবনের দিকে যান। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তারা তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাননি। এদিকে একই সময় ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে আসে। রাত বারোটার দিকে তারা উপাচার্যের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়। হামলার খবর আগেভাগেই আন্দোলনকারীরা জেনে গেলে তারা উপাচার্যের বাসভবনের মধ্যে আশ্রয় নেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে বাসভবন ঘিরে ফেললেও উপাচার্য শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানান। রাত দেড়টার দিকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ, এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

৩রা জুলাই, ঢাকা - আরিচা মহাসড়কে ছাত্র সমাবেশ
৩রা জুলাই, ঢাকা - আরিচা মহাসড়কে ছাত্র সমাবেশ

এই সময়কার একটি লাইভ ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে হামলার খবর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করেন। ওই রাতেই ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের রুম ভাঙচুর করেন এবং ১৬ জুলাই প্রথম প্রহরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করেন। সারা বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল প্রথম ক্যাম্পাস, যেখান থেকে ছাত্রলীগকে পুরোপুরি বিতাড়িত করা হয়।

১৬ জুলাই সকালে সাভারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা একে একে জাহাঙ্গীরনগরে আসতে থাকেন। সারা দিনজুড়ে ‘জাবি, তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’—স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। সেদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। সন্ধ্যায় খবর আসে যে, ছাত্রলীগ আবার হলে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে—এ জন্য শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে থেকে পাহারা দেন।

১ আগষ্ট, নিজের কার্যালয় থেকে শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলেন জাবি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা
১ আগষ্ট, নিজের কার্যালয় থেকে শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলেন জাবি অধ্যাপক শামীমা সুলতানা

১৭ জুলাই সকালে জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি (ভ্যাকেন্ট) ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় প্রশাসন নিজেদের নিরাপত্তার অজুহাতে ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশ করায়। সকাল থেকেই পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। বিকেল পাঁচটার দিকে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ছররা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়। শিক্ষার্থীরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দুই ঘণ্টা পর পুলিশ ক্যাম্পাসের বাইরে সরে গিয়ে মূল ফটকে অবস্থান নেয়। এই ঘটনায় প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। রাতে পুলিশ জোরপূর্বক সকল শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করে।

১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কমে যায়। অনেকেই বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফিরে যান, আর কিছু শিক্ষার্থী আশপাশের ইসলামনগর, গেরুয়া ও আমবাগান এলাকায় অবস্থান নেন। এদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মৌন মিছিল করেন। বিকেলে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে পুলিশকে বের করে দেন।

১৯ জুলাইও শিক্ষার্থীরা স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালন করেন। ২০ জুলাই বিকেলে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ‘অদম্য–২৪ ’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় পুরোনো ফজিলাতুন্নেছা হলের সামনে। এরপর শিক্ষার্থীরা কারফিউ ভেঙে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেন। এ সময় ‘ঘোড়ার ডিমের কারফিউ, মানি না, মানব না’ স্লোগানে মুখরিত হয় আন্দোলন।

১৮ জুলাই থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন সাধারণ জনতা। তখন নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হলে অফলাইনে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। তখন আন্দোলনের সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের ৪৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসিব জামান। তিনি জানান, ‘আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাসায় চলে যাওয়ায় স্থানীয় জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। এ সময় আমার দায়িত্ব ছিল আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আমাদের কর্মসূচির বিষয়ে জানানো ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা। এই কাজে আমাকে সহায়তা করেন আমাদের ক্যাম্পাসের অরিত্র সত্তার এবং তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোসাদ্দেক ভাই। এ ছাড়া স্থানীয় বিএনপির ও জামায়াতের অনেক নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছিল। তাঁদের অনেক নেতা-কর্মী আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন।’

২৬ জুলাই রাতে সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ‘সেতু ভবন’ মামলায় ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এ বিষয়ে তিনি জানান, ‘২৪ তারিখের দিকে আমার কাছে একটি মেসেজ আসে; সব সিনিয়র নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায় আমাকে পুরো দেশের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে এবং ঢাকায় চলে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে এবং পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আমি আমবাগানের বাসায় যাই। সেখান থেকেই ব্লক রেইড দিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয় দিনের রিমান্ড শেষে আবার ছেড়ে দেওয়া হয় এবং এরপর আবার আন্দোলনে যোগ দিই। আমি ৩ আগস্ট মুক্তি পাই এবং সেদিনই ‘এক দফা’ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়।’

আরিফ সোহেলের গ্রেপ্তারের পর যাঁদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলমান থাকে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুর রশিদ জিতু। তিনি জানান, ‘১৮ জুলাইয়ের পর থেকে একপ্রকার পালিয়ে পালিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। সিম পরিবর্তন করতে হয়েছে, প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ভয়ে আমি কয়েক রাত নৌকায় ঘুমিয়েছি। সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমরা আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছি।’

২৮ ও ২৯ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক ও স্থানীয় জনগণ মিলে বিক্ষোভ মিছিল করেন। ৩০ জুলাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিলে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আরও বাড়তে থাকে এবং সেদিনের মিছিলেও অনেক বেশি শিক্ষক যোগ দেন।

১ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভিন্নধর্মী প্রতিবাদী গানের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ১২ জন শিক্ষক যোগ দেন। এদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হলেও দমে যাননি। ওই দিন দুপুরেই নিজের অফিস কক্ষ থেকে শেখ হাসিনার ছবি সরিয়ে ফেলে প্রতিবাদ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা। এ বিষয়ে অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থীরা আমার সন্তানের মতো। যার হাতে আমার সন্তানের রক্ত, তার ছবি আমার দেয়ালে থাকতে পারে না। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে, যার কারণে আমরা আগে তাঁর ছবি টাঙিয়েছিলাম, তিনি আর সেই পদে থাকার যোগ্য নন। তাঁর জন্য তখন সবাই অনিরাপদ হয়ে পড়েছিল।’

ছবি নামানোর পর কোনো চাপ এসেছিল কি না? এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে তখন শোকজ করা হয়েছিল। কেন ছবি নামিয়েছি, সে বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে অনেক শিক্ষক। অনেকে ফোন করে জানিয়েছে, আমার ছবি কোথায় কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আমি সেসব নিয়ে ভাবিনি। আমার একমাত্র চিন্তা ছিল—আমার সন্তানসম শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা।’

২, ৩ ও ৪ আগস্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নেন। এই আন্দোলনে ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা সব ধরনের সহায়তা করেছেন। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির তৎকালীন সভাপতি আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল জানান, ‘আমরা সম্ভবপর সব ধরনের তথ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের সহায়তা করার চেষ্টা করতাম। একই সঙ্গে আমাদের পেশাদারিত্ব বজায় রাখাও আমাদের দায়িত্ব ছিল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও আমরা অফিসে কল করে সংবাদ পাঠাতাম। আমরা চাইতাম, এই আন্দোলনের ভেতর থেকেও জাহাঙ্গীরনগর যেন অদৃশ্য না হয়ে যায়—সবাই যেন এখানকার কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে জানতে পারে। পাশাপাশি আশপাশের মানুষদেরও আমরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করতাম।’

৫ আগস্টের লং মার্চে অংশ নিতে সকাল থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় জনগণ। বেলা ১২টার দিকে আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে প্রায় ২০ হাজার মানুষের একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বের হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল কারখানা শ্রমিক ও গার্মেন্টস কর্মী। তবে সাভার এলাকায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মিছিলটি পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিতে আসা শ্রাবণ গাজী নামে এক শিক্ষার্থী শহীদ হন। পুলিশের বাধায় শিক্ষার্থীরা ঢাকা পৌঁছাতে না পেরে শহীদ শ্রাবণ গাজীর মরদেহ নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ধীরে ধীরে বাইরের অংশগ্রহণকারীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। দেশের সেই উত্তাল পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনেকটাই অরক্ষিত হয়ে পড়ে। রাতের বেলায় শিক্ষার্থীরাই একত্র হয়ে ক্যাম্পাস পাহারায় অংশ নেন।

বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ‘গণ–অভ্যুত্থানের সরকার: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ২৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা ও বর্তমান জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সেখানে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় যখন আমরা মনোবল ও আশা হারিয়ে ফেলছিলাম, তখন জাহাঙ্গীরনগর আমাদের সাহস জুগিয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সমুদ্রের বাতাসে স্বাস্থ্যের বার্তা

ক্যাম্পাস ডেস্ক 
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪৫
সমুদ্রের বাতাসে স্বাস্থ্যের বার্তা

কক্সবাজারের সোনারপাড়া মেরিন ড্রাইভ সড়কে সম্প্রতি এক বর্ণাঢ্য ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বিদেশ থেকে মোট ৫০০ জন দৌড়বিদ এই আয়োজনে অংশ নেন।

ভোর ৬টায় উখিয়ার সোনারপাড়া বিচ পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে দৌড়টি শেষ হয় সকাল ৭টায় তারকা মানের হোটেল অর্কিড ব্লুতে। পুরুষ ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হন মোহাম্মদ সায়েদ (০১৫৯), প্রথম রানারআপ তারেক (০৪৫৬) এবং দ্বিতীয় রানারআপ আশিক (০১৬০)। নারীদের বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন বিদেশি প্রতিযোগী জোহানা (০২৩৯), প্রথম রানারআপ আভা (০০৬৫) এবং দ্বিতীয় রানারআপ কুজো (০০৮৭)।

ম্যারাথন আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাসিঘর ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন উপদেষ্টা এ এইচ সেলিম উল্লাহ, প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াসিন সিকদার, উখিয়া শাখার সভাপতি পিএম মোবারক, ইনস্টিটিউশনাল অ্যাফেয়ার্স উইংয়ের সিডিসিও শাইফুল ইসলাম শিহাব, উবায়েদ উল্লাহ শুভ, শাকিবুল ইসলাম, সাইয়েদ মোবারক, মেহেদী হাসান, শাহরিয়ার তানভীর রিফাত, আর জে রাফি, আবুল কাশেমসহ সংগঠনের অন্য সদস্যরা।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইয়াসিন সিকদার বলেন, ‘বিপুল সাড়া পাওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত। এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য তরুণদের মাদক থেকে দূরে রাখা এবং স্বাস্থ্যসচেতন হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।’

ম্যারাথনের সমাপ্তির পর অংশগ্রহণকারীরা আরও এরূপ আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছেন। আয়োজকেরা জানান, আগামী বছরও তাঁরা একটি নতুন ম্যারাথন আয়োজনের চেষ্টা করবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এআইইউবিতে সাইবার গেমিং ফেস্ট

ক্যাম্পাস ডেস্ক 
এআইইউবিতে সাইবার গেমিং ফেস্ট

আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (এআইইউবি) কম্পিউটার ক্লাবের (এসিসি) আয়োজনে এবং অফিস অব স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের সহযোগিতায় এআইইউবি সাইবার গেমিং ফেস্ট ২০২৫ সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। চার দিনব্যাপী এই আয়োজনে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী অংশ নেন।

উদ্বোধনী ও বিভিন্ন পর্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এআইইউবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহমান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মঞ্জুর এইচ খান, অফিস অব স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বিশেষ সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক অভিজিৎ ভৌমিক, সহকারী অধ্যাপক এবং বিশেষ সহকারী মো. মাজেদ-উল-হক এবং প্রভাষক ও বিশেষ সহকারী এস এম আবদুল্লাহ শাফি।

অনলাইন ও অন-ক্যাম্পাস প্রতিযোগিতার সমন্বয়ে আয়োজিত এই উৎসবে এআইইউবি ক্যাম্পাস পরিণত হয় এক প্রাণবন্ত ও প্রতিযোগিতামূলক গেমিং অঙ্গনে। পাবজি মোবাইল প্রতিযোগিতার অনলাইন কোয়ালিফায়ার পর্বে ৫১টি দল অংশ নেয়। সেখান থেকে ৩২টি দল সেমিফাইনালে এবং পরবর্তী সময়ে ১৬টি দল ক্যাম্পাস ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। চূড়ান্ত দিনে অনুষ্ঠিত চারটি উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ শেষে ব্ল্যাকবিয়ার্ড পাইরেটস চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

ভ্যালোরান্ট বিভাগে অনলাইন লোয়ার-ব্র্যাকেট পর্ব ও ক্যাম্পাসে ল্যান ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। লোয়ার-ব্র্যাকেট থেকে উঠে এসে অলস্টারস দল গ্র্যান্ড ফাইনালে ন্যাক্সআর ই-স্পোর্টসের মুখোমুখি হয়। তিন ম্যাচের রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে শেষ পর্যন্ত অলস্টারস চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত করে।

এ ছাড়া উৎসবে মোবাইল লেজেন্ডস: ব্যাঙ ব্যাঙ (এমএলবিবি), এফসি ২৫ এবং ই-ফুটবল প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়। এমএলবিবি বিভাগে ভাইপার স্ট্রাইকার্স, এফসি ২৫ বিভাগে নিও, ই-ফুটবল একক বিভাগে শাওন শান্ত এবং দলীয় বিভাগে পিএনজি বট চ্যাম্পিয়ন হয়।

সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এআইইউবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মিস নাদিয়া আনোয়ার, উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম এবং উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুর রহমান। বক্তারা আয়োজনের ব্যাপ্তি, পেশাদার ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিযোগিতামূলক গেমিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কারের অর্থ ও ক্রেস্ট বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি তিনজন সেরা ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর এবং এআইইউবি ফটোগ্রাফি ক্লাব, এআইইউবি ই-স্পোর্টস ক্লাব ও এআইইউবি পারফর্মিং আর্টস ক্লাবকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নতুন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা

শিক্ষা ডেস্ক
নতুন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা

মো. রাকিব আল হাসান
মো. রাকিব আল হাসান

নতুন বছর মানে শুধু ক্যালেন্ডারের একটি সংখ্যা বদলে যাওয়া নয়; বরং পুরোনো ক্লান্তি, হতাশা ও ব্যর্থতা পেছনে ফেলে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা এবং সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিটি নতুন বছর আসে নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। একদিকে পড়াশোনা, ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ, অন্যদিকে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার দৃঢ়সংকল্প। বাস্তবতা ও স্বপ্নের এ মিশ্রণই নতুন বছরে তাঁদের প্রত্যাশাকে করে তোলে গভীর ও অর্থবহ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সেই ভাবনা ও প্রত্যাশার কথাই তুলে ধরছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রাকিব আল হাসান

মো. আশিক মাহমুদ
মো. আশিক মাহমুদ

ক্যাম্পাস হোক রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত

মো. আশিক মাহমুদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন বছর আমার কাছে শুধু সময়ের পরিবর্তন নয়; এটি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ। আমার প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা হবে রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত; যেখানে জ্ঞানচর্চাই হবে মুখ্য। ক্লাসরুমে ফিরে আসুক শিক্ষার প্রকৃত জৌলুশ ও গুণগত মান। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে, যেন যোগ্যতার ভিত্তিতে কাঙ্ক্ষিত কর্মজীবনের পথে এগোতে পারি। একই সঙ্গে জাগতিক সাফল্যের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠাই হোক নতুন বছরের লক্ষ্য।

রাইসা আমিন,
রাইসা আমিন,

সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের বন্ধন আরও দৃঢ় হোক

রাইসা আমিন, শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন বছর মানে আমার কাছে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ এবং নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ। আমি প্রত্যাশা করি, শিক্ষাঙ্গন হবে আরও প্রাণবন্ত, গবেষণামুখী এবং সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ। পড়াশোনার পাশাপাশি নেতৃত্বগুণ, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা বাড়ুক। মতের ভিন্নতা থাকলেও পরস্পরের প্রতি সম্মান বজায় থাকুক—মতভেদ হোক, কিন্তু বিভেদ নয়। সহপাঠীদের মধ্যে সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের বন্ধন আরও দৃঢ় হোক। ব্যক্তিগত জীবনে সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং লক্ষ্যভিত্তিক পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে চাই।

মো. মাহামুদুল হাসান
মো. মাহামুদুল হাসান

তরুণ প্রজন্মের অন্তরে এক অদম্য আশার স্রোত

মো. মাহামুদুল হাসান, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন বছরের সূচনায় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অন্তরে জেগে উঠেছে এক অদম্য আশার স্রোত। আর্থসামাজিক অস্থিরতা, বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও প্রযুক্তির অগ্রগতি; বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ব্লকচেইনের মতো ক্ষেত্র—আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। প্রতিহিংসা নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক ও স্বনির্ভর সমাজ গঠনের স্বপ্নই আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঐক্যবদ্ধ যুবশক্তির হাত ধরে বাংলাদেশ পৌঁছাবে নতুন উচ্চতায়।

মেহরাজ হোসেন
মেহরাজ হোসেন

গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে যাক

মেহরাজ হোসেন, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন বছর একদিকে যেমন বিদায়ের বার্তা দেয়, অন্যদিকে সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দেয়। সাম্প্রতিক আন্দোলনের ইতিবাচক প্রভাবে ক্যাম্পাসগুলোতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন, র‍্যাগিং ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান—সবই শিক্ষার্থীদের সচেতনতার প্রতিফলন। নতুন বছরে প্রত্যাশা, ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও এগিয়ে যাবে জ্ঞান ও গবেষণায়। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে দেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমাদের যৌথ লক্ষ্য।

সমাপ্তি খান
সমাপ্তি খান

নিজেকে মানবিক ও সচেতন করে গড়ে তুলতে চাই

সমাপ্তি খান, শিক্ষার্থী, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন বছর আমাদের কাছে নতুন স্বপ্নের পাশাপাশি নতুন দায়বদ্ধতার সময়। এটি শুধু ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন নয়; বরং নিজের সঙ্গে নতুন করে অঙ্গীকার করার মুহূর্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই নিজেকে আরও দায়িত্বশীল, মানবিক এবং সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণা, দক্ষতা অর্জন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা জরুরি বলে আমি মনে করি। নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমরা স্বপ্ন দেখতে ছাড়িনি। আমাদের প্রত্যাশা, একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা, নিরাপদ ক্যাম্পাসজীবন এবং ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যৎ। নতুন বছর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাহস জোগাক।

উম্মে হাবিবা নিশাত
উম্মে হাবিবা নিশাত

নবসূর্যের নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি

উম্মে হাবিবা নিশাত, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

নতুন বছর আমার কাছে নিঃশব্দ এক প্রতিশ্রুতি—ধীরে বাঁচার সাহস ও গভীরভাবে অনুভব করার শক্তি। চাই সম্পর্কগুলো হোক বোঝাপড়ার জায়গা, নীরবতাগুলো হোক হৃদয়ের ভাষা। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে ধৈর্য ও কোমলতা বজায় রাখতে চাই। অল্পতেই সুখ খুঁজে পাওয়ার প্রজ্ঞা এবং নিজের ভেতরের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে নতুনভাবে জেগে ওঠার প্রত্যয়—এই হোক নতুন বছরের সঙ্গী। নবসূর্যের মতো নীরব অথচ উজ্জ্বল হোক আগামীর দিনগুলো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জ্ঞান, নৈতিকতা এবং উৎকর্ষের ধারায় তিন দশকের গৌরবময় অগ্রযাত্রা

মিজানুর রহমান ভূঁইয়া
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৮
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্থায়ী ক্যাম্পাস। ছবি: সংগৃহীত
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্থায়ী ক্যাম্পাস। ছবি: সংগৃহীত

দেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে গত তিন যুগ ছিল পরিবর্তন ও সম্প্রসারণের সময়। এই সময়ে শিক্ষা শুধু শহরকেন্দ্রিক থেকে বেড়ে ধীরে ধীরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতা, গুণগত মান ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সমন্বয়ে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এইউবি) সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।

১৯৯৬ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি তিন দশকে পদার্পণ করছে। মাত্র ২৯৫ শিক্ষার্থী নিয়েযাত্রা শুরু হয়। এইউবি আজ দেশের সুপরিচিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আশুলিয়ার টংগাবাড়িতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিকোণ

সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রবিউল আলম বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডে পিএইচডি রিসার্চার। তিনি বলেন, ‘৩০ বছর মানে শুধু সময় পার হওয়া নয়, বরং সময়টা চিন্তার ধারাবাহিকতাও। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের শুধু ডিগ্রি অর্জনে নয়; প্রশ্ন করতে, নিজস্ব বাস্তবতা বুঝতে এবং জ্ঞানকে নতুনভাবে ভাবতে উৎসাহ দিয়েছে। এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত শক্তি।’

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সামসুন্নাহার পিংকি বলেন, ‘এইউবি আমাদের স্বপ্ন গড়ার জায়গা। এখানে শিক্ষকেরা শুধু বইয়ের জ্ঞান দেন না, ভালো মানুষ হতে শেখান। তাঁদের আন্তরিকতা, ধৈর্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রতিদিন এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আশা করি, আগামীর দিনগুলোতেও এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবে।’

এক স্বপ্নদ্রষ্টার উদ্যোগ

প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আবুল হাসান এম সাদেক একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর কানাডায় পিএইচডি সম্পন্ন করেন। বিদেশে কর্মজীবনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ব্যক্তিগত সঞ্চয়, অভিজ্ঞতা এবং শ্রম বিনিয়োগ করার মধ্য

দিয়ে ১৯৯৬ সালে এইউবি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সীমিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আমরা স্বল্প খরচে শিক্ষাদান করছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে বিভিন্ন খাতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে কাজ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মানের; আইসিটি, স্মার্ট ক্লাসরুম, অনলাইন লার্নিং এবং আধুনিক কারিকুলাম চালু রয়েছে।’

শিক্ষা দর্শন ও একাডেমিক পরিবেশ

এইউবির শিক্ষা দর্শনের মূল ভিত্তি নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও মানবিক মূল্যবোধ। এখানে শিক্ষা শুধু সনদ অর্জনে সীমাবদ্ধ নয়; ব্যক্তিত্ব ও দায়িত্ববোধ গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আধুনিক ও কর্মবাজারমুখী পাঠ্যক্রম, অভিজ্ঞ শিক্ষক ও গবেষকদের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি স্থিতিশীল একাডেমিক পরিবেশ তৈরি করেছে। গবেষণা, সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণী ও সৃজনশীল চিন্তায় উৎসাহ দেওয়া হয়।

গ্র্যাজুয়েটদের অবস্থান

দেশ-বিদেশে ব্যাংকিং, করপোরেট খাত, শিক্ষা, গবেষণা, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রশাসন, গণমাধ্যম ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কর্মরত। পেশাদারি ও নৈতিক আচরণে সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

মান নিশ্চয়তা ও অবকাঠামো

শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়টি গঠন করেছে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি)। ১০ একর জমির স্থায়ী ক্যাম্পাসে রয়েছে ১০ তলা একাডেমিক ভবন, আধুনিক শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, সেমিনার কক্ষ, দুটি খেলার মাঠ, সাতটি কম্পিউটার ল্যাব এবং লাখো বইয়ের লাইব্রেরি ও জার্নাল। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে হোস্টেল সুবিধা ও বিনা মূল্যের পরিবহনব্যবস্থা।

সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সুযোগ

স্বল্প ফি কাঠামোর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাকে সহজলভ্য করা এইউবির লক্ষ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য পূর্ণ বৃত্তি এবং মেধাবী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপ প্রোগ্রাম রয়েছে। নারী শিক্ষা, সহশিক্ষা কার্যক্রম, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক আয়োজন, খেলাধুলা ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে সহায়ক।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য

তিন দশকের অভিজ্ঞতায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এখন একটি স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গবেষণা, ডিজিটাল লার্নিং, উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং উদ্যোক্তা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত