Ajker Patrika

ফাঁসির আসামির মুক্ত জীবন

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১৫
ফাঁসির আসামির মুক্ত জীবন

জেলখানায় ঢুকতে না ঢুকতেই ক্ষমা পেয়ে বেরিয়ে গেলেন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া খুনের এক আসামি। খবর বলতে ছিল এটুকুই। আদালত, প্রসিকিউশন, আইনজীবী—কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। কারাগারও মুখ খোলে না। ভাবছি হাল ছেড়ে দেব, ঠিক তখনই সুড়ঙ্গের মুখে আলোর দেখা।

তার পরে যা ঘটল রীতিমতো অবিশ্বাস্য। সেই খবর ছাপা হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে সংসদে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠল। আইনমন্ত্রীকে তিনবার সংবাদ সম্মেলন করতে হলো। তাতেও শেষ নয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা পর্যন্ত করলেন আইনমন্ত্রী। রাজনীতির মাঠ আর সরকারের ভেতর-বাহির যেন তেতে উঠল একটি ছোট্ট খবরে। আজ ‘আষাঢ়ে নয়’-এর জন্য সেই গল্পটা।

প্রথম আলোয় যোগ দিয়েছি কিছুদিন আগে। হাতে বড় কোনো খবর নেই। খবরের খোঁজে দিনরাত টো টো করে ঘুরি। অফিসে ঢুকলে কর্তাব্যক্তিরা চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান, কিন্তু কিছু বলেন না। হঠাৎ পেলাম এই খবর। হাল ভাঙা নাবিকের মতো খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো ছুটলাম সেই খবরের পেছনে—যদি কিছু মেলে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার ছিলেন কামরুল ইসলাম। তাঁর সাফ জবাব, এই আসামির কোনো কাগজপত্র নেই। কারণ, ক্ষমার আবেদনটি নিজেরাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন। পরে জেলখানার এক কর্মকর্তার পেছনে দুই দিন ঘোরাঘুরি করলে তিনি এক ব্যক্তির ঠিকানা লেখা একটি চিরকুট হাতে ধরিয়ে দিলেন। তাতে লেখা—আসামির নাম মহিউদ্দিন আহমেদ জিন্টু, পিতার নাম মরহুম শহীদুল্লাহ। ঠিকানা ডিস্টিলারি রোড, গেন্ডারিয়া। ব্যাস, ক্লু হাতে। এবার ছুট গেন্ডারিয়ার দিকে।

আসগর আলী জেনারেল হাসপাতাল এখন যেখানে, তার একটু সামনে হাসপাতালের দিক থেকে যেতে বাম হাতে ছিল একটি ওষুধের দোকান। সেই দোকানের পেছনেই বাড়িটি। ঠিকানা ধরে গেলাম, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলে না। ডাকাডাকি করার পর একজন এসে বললেন, জিন্টু নামে কেউ সেখানে নেই। ফিরে গেলাম সেই ওষুধের দোকানে। দোকানের মালিকের সামনে সেদিনের দৈনিক পত্রিকা। পরিচয় দিতেই তেপায়া একটা টুল ঠেলে বসতে বললেন। নানা কথার ফাঁকে আসল কথা তুললাম। শুনে তিনি একটু চিন্তিত হলেন। বললেন, আজ যান, দেখি কাল কী করা যায়। পরের দিন গেলাম। তিনি বললেন দুই দিন পরে আবার যেতে। গিয়ে দেখি দোকান বন্ধ। এক দিন পর ঈদের ছুটি। আমার হাতে সময় নেই। পরের দিন আবার গেলাম।

একটি খবরের জন্য এভাবে ঘুরছি দেখে দোকানি খুবই মুগ্ধ হলেন। বললেন, জেল থেকে আসার পর জিন্টু নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়িতে গোপনে আছেন। কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। আপনি অপেক্ষা করেন। আজ সন্ধ্যার পর দেখা হবেই। সেটা ছিল ২০০৫ সালের ১৮ জানুয়ারি।

সন্ধ্যা ৭টা কি ৮টা হবে। একটি দোতলা বাড়িতে আমি আর সেই দোকানি। দেখলাম, যাকে খুঁজছি, তিনি সেই দোকানির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দোকানি আমাকে এমনভাবে পরিচয় করালেন, যেন তাঁর সঙ্গে আমার অনেক দিনের সখ্য। তাতে বরফ গলল। আমাকে ঘরের ভেতরে ডাকলেন সেই মহিউদ্দিন আহমেদ জিন্টু। একটি বিছানায় তাঁর মা ছালেহা বেগম শুয়ে আছেন। পাশে ভাই মিন্টু। আমি এমনভাবে শুরু করলাম, যেন সবকিছুই আমার জানা। এতে কাজ হলো। জিন্টু নিজে থেকেই কথার ঝাঁপি খুললেন। আমার পকেটে ৯০ মিনিট রেকর্ডের মিনি টেপরেকর্ডার, তাতে নতুন ব্যাটারি। সব রেকর্ড হচ্ছে।

বললেন, ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী আবদুল খালেক রানা ও ফিরোজ আল মামুন খুন হন। সেই সময়ের আলোচিত সন্ত্রাসী গালকাটা কামাল ও তাঁর সহযোগীরা তাঁদের খুন করেন। সেই মামলায় এরশাদের মন্ত্রী রুহুল আমীন হাওলাদার ও জিন্টুকে অভিযুক্ত করা হয়। সামরিক আদালত ১৯৮২ সালের ২০ জুলাই রায় দেন। তাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী গালকাটা কামাল, তাঁর দুই সহযোগী শহীদ হোসেন ও আবুল কাসেমের সঙ্গে মহিউদ্দিন জিন্টুর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। সেই আদেশ কার্যকরও হয়। অবশ্য শুরু থেকেই জিন্টু পলাতক ছিলেন।

রায় ঘোষণার পর ভারতে পালিয়ে যান জিন্টু। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা সুলতান আহমেদের আশ্রয়ে তিন বছর কাটান। ভারতে অবস্থানের সময় তিনি গোপনে ভারতীয় পাসপোর্টও করেন। সেই পাসপোর্টে ভিসা নিয়ে চুপিসারে জাপানে চলে যান। তার আগে একবার ভারতীয় পাসপোর্টে থাইল্যান্ড ঘুরে আসেন। ভারত ত্যাগের পর তাঁর ভারতীয় পাসপোর্টের বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা জেনে যায়। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের কাছে নোটিশ পাঠায়। জাপানের টোকিওতে পুলিশ তাঁকে তিন দিন আটকে রেখে জেরা করলে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চান। কিন্তু জাপান তাঁকে আশ্রয় না দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। টোকিওতে বসে একই সঙ্গে তিনি কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সুইডেনের ভিসা নেন।

ঢাকা থেকে বিএনপির নেতা মরহুম আবদুস সালাম তালুকদার, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর রায় তাঁকে চিঠি দিয়ে কানাডায় না গিয়ে সুইডেনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর থেকে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সুইডেনে বাস করেন। সেখানে ‘পায়েল’ নামে তাঁর একটি রেস্টুরেন্ট জমিয়ে তোলেন। বিএনপির বড় বড় নেতা সুইডেনে গেলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। তিনিও তাঁদের খাতির-যত্ন করতেন। এভাবে হয়ে যান সুইডেন শাখা বিএনপির সভাপতি। পলাতক থাকা অবস্থায় ১৯৯২ সালে তিনি টেলিফোনে ঢাকায় বিয়েও করেন।

প্রথম দফায় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন দেশে আসার জন্য। সব ঠিকঠাক থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁকে বসেন। দ্বিতীয় দফায় বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি আবার যোগাযোগ করেন। মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর রায়সহ দলের অনেক নেতা তাঁকে ফিরে আসার পরামর্শ দেন।

এরপর সবকিছু ঠিক করে ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় আসেন। ৩ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালতকে বলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করায় ভয়ে আত্মগোপন করেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। এতে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। আত্মসমর্পণের ১০ দিন পর ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দ্রুত তাঁর সাজা মওকুফ করেন। ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেই খবর ছাপা হয়। খবর ছাপা হওয়ার দিনই তিনি দেশ ত্যাগ করেন। এরপর শুরু হয় হইচই।

সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তখন অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধার লঙ্ঘন করেছেন। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি সেই অভিযোগ করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সম্পাদক ইনায়েতুর রহীম আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে দায়ী করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, দণ্ড মওকুফ হওয়ার আগে আইনমন্ত্রী সুইডেনে জিন্টুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আইনমন্ত্রী এই বিবৃতি মিথ্যা দাবি করে মানহানির মামলা করেন। মামলার পরপরই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ইনায়েতুর রহীমের বাসায় দুই দফা পুলিশ অভিযান চালায়। এভাবে পাল্টাপাল্টি চলতে থাকে প্রায় বছরজুড়ে। এরপর ধীর ধীরে নতুন ঘটনার ভিড়ে হারিয়ে যায় জিন্টুর ঘটনা।

আমার হাতেও অনেক কাজ। নানা ব্যস্ততার ভিড়ে ভুলে গেছি জিন্টুর ঘটনা। হঠাৎ একদিন রাতে ফোন করলেন জিন্টুদের হাতে যে দুজন নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন ফিরোজ আল মামুনের স্ত্রী। তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ। বললেন, ‘সাংবাদিক সাহেব বিরাট চাকরি করেন। কাঁড়িকাঁড়ি টাকা বেতন পান। কিন্তু আমার মতো অসহায় মানুষের কথা কখনো ভাবেন? খোঁজ নিয়েছেন, স্বামী খুন হওয়ার পর আমরা এত বছর ধরে কীভাবে বেঁচে আছি, কেউ কি নিয়েছে?’ আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দেন।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ মেঘ করলে কখনো কখনো যেমন একা লাগে, ঠিক তেমনই নিঃসঙ্গ মনে হলো নিজেকে।

বিষয়:

আষাঢ়ে-নয়
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সৌদি আরবে অপহরণ, ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি দেশে

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সৌদি আরবে এক প্রবাসী ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে বাংলাদেশে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে একটি চক্র। না দিলে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে (এমএফএস) ধাপে ধাপে মোট ৩৫ লাখ টাকা পাঠালে সৌদি আরবের রিয়াদে অচেতন অবস্থায় তাঁকে ফেলে যায় অপহরণকারীরা।

গত মঙ্গলবার অপহরণকারী এই চক্রের বাংলাদেশি সদস্য মো. জিয়াউর রহমানকে (৪২) মাগুরার শালিখা থানার হরিপুর বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

গ্রেপ্তারের পর সংস্থার বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান জানান, অপহরণকারীদের দেওয়া এমএফএস ও ব্যাংক হিসাব নম্বর বিশ্লেষণ করে জিয়াউর রহমানকে শনাক্ত করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মুক্তিপণ থেকে ৫ লাখ টাকা কমিশন নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি মো. রাসেল নামের ওই প্রবাসীকে অপহরণের পর সে মাসের ২১ তারিখে তাঁর শ্বশুর রাজধানীর খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলাটি সিআইডির ঢাকা মেট্রো (পূর্ব) ইউনিট তদন্ত করছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, মো. রাসেল ২০ বছর ধরে রিয়াদে ব্যবসা করছেন। ১২ জানুয়ারি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাঁকে অপহরণ করে তাঁর বড় ভাই সাইফুল ইসলামের কাছে ইমু ও ভিওআইপিতে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না দিলে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। কয়েক ধাপে টাকা পাঠানোর পর তাঁকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুলিশের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ২০: ২৫
ডিবির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। ছবি: আজকের পত্রিকা
ডিবির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। ছবি: আজকের পত্রিকা

অরাজকতা প্রতিহত করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে অসদাচরণ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। তিনি বলেছেন, পুলিশ যখন অরাজকতা ঠেকানোর চেষ্টা করছে, তখন তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ডিএমপি কমিশনার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমার অফিসারদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করবেন না।’

আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

সাম্প্রতিক অরাজকতা প্রতিরোধের সময় পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ‘পুলিশ যখন অরাজকতা প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল, তখন আমার অফিসারদের সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। আমার অফিসারদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। আমরা সংঘাতে জড়াতে চাই না; আমরা সেবা দিতে চাই। আপনারা যেটি করতে চাচ্ছিলেন, সেটি করলে সমাজে, ঢাকায় এবং পুরো দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।’

কমিশনার জানান, একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন যদি একই ধরনের কার্যকলাপ দেখা যায়, তাহলে সমাজে অস্থিরতা বাড়বে। এ জন্যই পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রতি এমন আচরণ কোনো শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

পল্লবী থানার সামনে ককটেল বিস্ফোরণে এক পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার নিরপরাধ অফিসারকে যেভাবে ককটেল মেরে আহত করা হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এতে সদস্যদের মনোবল নষ্ট হয় এবং এর ক্ষতি সমাজকেই ভোগ করতে হয়। যদি পুলিশের মনোবল ভেঙে যায়, তবে ৫ আগস্টের পর যেভাবে ৮০ বছরের বৃদ্ধও লাঠি হাতে নিয়ে মহল্লা পাহারা দিয়েছেন, সেই পরিস্থিতি আবার তৈরি হতে পারে।’

যারা ককটেল ছোড়া বা এ ধরনের দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন—‘এই কাজটি করবেন না।’

গুলির নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনা নয়, এটি দেশের আইন। আইন পুলিশ বানায় না, পার্লামেন্ট বানায়। আইন যা বলেছে, আমরা শুধু সেটাই অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছি।’

ডিএমপি কমিশনার জানান, দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ মোকাবিলায় আধুনিক সক্ষমতা গড়ে তুলতেই ডিবির সাইবার সাপোর্ট সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে। এখানে থাকবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত ল্যাব, দক্ষ তদন্তকারী দল, ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং ২৪ ঘণ্টার রেসপন্স টিম। ফেসবুক পেজ, ই-মেইল এবং ডিবির অনলাইন চ্যানেলের মাধ্যমে নাগরিকেরা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন। প্রযুক্তিনির্ভর, সময়োপযোগী ও প্রমাণভিত্তিক পুলিশ সেবা নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, বর্তমান সময়ে অনলাইন জালিয়াতি, প্রতারণা, ডিজিটাল হয়রানি, মানহানি, অনলাইন গ্যাম্বলিংসহ নানা অপরাধ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও আর্থিক সুরক্ষাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ডিএমপি তার সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।

নারী ও কিশোরদের সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সাইবার সাপোর্ট সেন্টার কাজ করবে উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী ও কিশোরদের ওপর হয়রানির অভিযোগ দ্রুত সমাধানের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। হয়রানির শিকার হলে দ্রুত সহায়তা নিশ্চিত করাই তাদের অন্যতম অঙ্গীকার।

সাইবার নিরাপত্তা শুধু পুলিশের দায়িত্ব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ অনলাইন পরিবেশ গড়ে তুলতে তিনি সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অতি লোভে তাঁতি নষ্ট: ৬০০ কোটি টাকা হারালেন নওগাঁর ৮০০ জন!

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ৩৪
বুধবার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার মো. নাজিম উদ্দিন তনু। ছবি: সিআইডি
বুধবার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার মো. নাজিম উদ্দিন তনু। ছবি: সিআইডি

‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’— প্রচলিত প্রবাদ যে হুবহু বাস্তবে ঘটতে পারে, তার প্রমাণ মিলল উত্তরাঞ্চলের জেলা নওগাঁয়। এই জেলার ৮০০ জনের বেশি মানুষকে অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে।

বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অন্যতম হোতা মো. নাজিম উদ্দিন তনুকে (৩৭) গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ—সিআইডি। গতকাল বুধবার সকালে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখান এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সিআইডির পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার মো. নাজিম উদ্দিন তনুর বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার জগৎসিংহপুরে। প্রায় এক বছর আগে ২০২৪ সালের ১২ নভেম্বর নওগাঁ সদর থানায় নাজিম উদ্দিনসহ কয়েকজনের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করেছিলেন এক ব্যক্তি। মামলাটি বর্তমানে সিআইডির নওগাঁ জেলা ইউনিট পরিচালনা করছে।

মামলার তদন্তে জানা যায়, প্রতি মাসে ১ লাখ টাকার বিপরীতে ২ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের টাকা নেয় ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি এনজিও। এনজিওটির কার্যালয় নওগাঁ সদরের অফিসপাড়া এলাকায়। পরিচালক মো. নাজিম উদ্দিন তনু।

প্রথম দিকে পরিচালকদের মনোনীত কিছু গ্রাহককে এই হারে লভ্যাংশ দেয় বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন। পরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা সুকৌশলে প্রচার করা শুরু করেন। তাঁদের এই ফাঁদে পড়ে বহু সাধারণ মানুষ বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে গ্রাহক হিসেবে বিনিয়োগে আগ্রহী হন। মামলার বাদী নিজেই ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে আর্থিক লেনদেনে অস্বচ্ছতা দেখা দেয়। ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা সে সময় থেকে তাঁদের জমাকৃত কিংবা ঋণের অর্থ ঠিকঠাক উত্তোলন করতে পারছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে অভিযাগ জানালে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে গ্রাহকদের কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নেন পরিচালক তনু।

কিন্তু গত বছরের নভেম্বরে আও বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে গিয়ে বাদীসহ অন্য ভুক্তভোগীরা নিজেদের অর্থ ফেরত চাইলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে গ্রাহকদের অর্থ দেওয়া হবে না মর্মে জানিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার পর বাদী নওগাঁ সদর থানায় মামলা (মামলা নম্বর ২০, তারিখ ১২-১১-২০২৪, ধারা-৪০৬/৪২০ পেনাল কোড-১৮৬০) করেন। বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন যে ভুক্তভোগীদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল।

তবে সিআইডি জানায়, এ পর্যন্ত আট শতাধিক ভুক্তভোগী ৬০০ কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় মো. নাজিম উদ্দিন তনুসহ মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন ত্রাস ‘সন্ত্রাসী রনি’

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৪
সন্ত্রাসী মামুন হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সন্ত্রাসী রনি। ছবি: সংগৃহীত
সন্ত্রাসী মামুন হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন সন্ত্রাসী রনি। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর অপরাধজগতে নতুন পর্দা নামিয়েছেন রনি নামের এক সন্ত্রাসী। দুই লাখ টাকায় খুনি ভাড়া দিয়ে তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করিয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, রনি সানজিদুল ইসলাম ইমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। প্রথমে মুদিদোকানদার, পরে ডিশ ব্যবসায়ী। এখন ঢাকার অপরাধজগতের নতুন নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে জানান, রনি মূলত মুদিদোকানি ছিলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগারে থাকাকালে রনির সঙ্গে পরিচয় হয়। ইমন তাঁর মাধ্যমে অপরাধ চক্রের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন। শুরুতে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার ডিশ ব্যবসা দখল, চাঁদাবাজি ও হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আদায় করে কারাগারে থাকা ইমনকে পাঠাতেন। পরে সন্ত্রাসী ইমনের শিষ্যদের ব্যবহার করে বড় বড় কাজ করতে থাকেন। মিরপুর এলাকায়ও ব্যবসা বড় করতে থাকেন। এভাবে রনি ধীরে ধীরে ঢাকার অপরাধজগতের পরিচিত মুখে পরিণত হন।

ডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল ইমনের। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রনির নির্দেশে ফারুক হোসেন ফয়সাল ও রবিন আহম্মেদ পিয়াস গুলি করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি। পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত ফারুক রবিন, রুবেল, শামীম আহম্মেদ ও ইউসুফ ওরফে জীবনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও রনির খোঁজ মিলছে না।

ডিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর ভেলানগর থেকে ফারুক, রবিন, শামীম ও রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যার পর তাঁরা প্রথমে ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ফারুক ও রবিন ব্যবহৃত অস্ত্র ও অব্যবহৃত গুলি রনির নির্দেশে রুবেলের কাছে রেখে আসেন। পরে রুবেল পেশায় দরজি ইউসুফের কাছে অস্ত্রগুলো হস্তান্তর করেন।

পুলিশ জানিয়েছে, ইউসুফ মোহাম্মদপুরে তাঁর বাসায় অস্ত্র ও গুলি লুকিয়ে রেখেছিলেন। মোটরসাইকেল, অস্ত্র ও নগদ ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। রনি পারিশ্রমিক হিসেবে এই টাকা দুই ভাগে ভাগ করে দুই শুটারকে দেন।

ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, জামিনে মুক্তির পর মামুন আবার অপরাধজগতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। রনিকে পাত্তা না দিয়ে তাঁর এলাকা দখল করতে চান। তখনই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সঙ্গে পরার্মশ করে মামুনকে পথ থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেন রনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই লাখ টাকায় ভাড়াটে খুনি ব্যবহার করেন।

পুলিশ ও ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, এই হত্যাকাণ্ড আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতা। মামুন ও ইমন দুজনই ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী, যাঁরা প্রভাব বিস্তার ও এলাকা দখল নিয়ে লড়াই করছিলেন। ইমনের সহযোগী হিসেবে রনি দ্রুত অপরাধজগতে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ মামুন হত্যার পর তিনি এখন ঢাকার অপরাধজগতে নতুন চরিত্র। ডিবি অভিযান চালিয়ে মূল পরিকল্পনাকারী রনি ও তাঁর সহযোগীদের ধরার চেষ্টা করছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

পাঁচজন রিমান্ডে

মামুন হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচজনকে গতকাল মোহাম্মদপুর থানার অস্ত্র আইনের মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে ডিবি পুলিশ। আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পার্থ ভদ্র প্রত্যেকের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত