বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্পের নীতিতে প্রাধান্য পাবে কোনটি—গণতন্ত্র নাকি বাণিজ্য

অনলাইন ডেস্ক    
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৩: ২৬
ট্রাম্পের নতুন দক্ষিণ এশিয়া নীতি কেমন হবে তা নিয়ে অঞ্চলটির দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। ছবি: সাউথ এশিয়া পারস্পেক্টিভের সৌজন্যে

২০২৪ সালের বহুল প্রতীক্ষিত মার্কিন নির্বাচন শেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির দ্বন্দ্ব-সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ, ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’—স্লোগান পররাষ্ট্রনীতিতে পারস্পরিকতার ওপর জোর দিলেও চীনের বিরুদ্ধে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রায়ই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দেখা গিয়েছিল কিছু অগোছালো, অজ্ঞ এবং অস্থির পদক্ষেপ। ফলে, ট্রাম্প ফিরে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতাই বজায় থাকতে পারে, সামান্য কিছু পরিবর্তন নিয়ে। ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান পেছনের সারিতে থাকলেও বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার জন্য নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি মূলত দুটি পরস্পর সম্পর্কিত কৌশলের ফল। তাঁর এই নীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’। এর লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের সহায়ক ভূমিকা বন্ধে চাপ দেওয়া এবং ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা।

ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসন প্রথমে আফগানিস্তানে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। তবে ২০১৯ সালের মধ্যে তিনি শর্তসাপেক্ষে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয় তাঁর সরকার, তবে আফগান সরকারের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিদেশি সাহায্য কমিয়ে আনে।

তালেবান চুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা নেওয়ার পরও পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই ও আফগানিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে বড় বাধা হিসেবে দেখা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প পাকিস্তানকে ‘মিথ্যা ও প্রতারণার’ জন্য অভিযুক্ত করেন এবং এরপরই ইসলামাবাদের জন্য বরাদ্দ নিরাপত্তা সাহায্য স্থগিত করা হয়। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কোনো লেনদেনের সুবিধা দেয়নি।

ট্রাম্পের অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে মূলত চীনের প্রভাব ঠেকাতে সার্বভৌমত্ব, শান্তি, মুক্ত ও পারস্পরিক বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও মানদণ্ডকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই মূল্যবোধভিত্তিক শৃঙ্খলা ধরে রাখতে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও নেপালের মতো ছোট দেশগুলোকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এই নীতির অংশ হিসেবে ২০২০ সালে মালদ্বীপে কূটনৈতিক মিশন ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ ওয়াশিংটনের বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) অন্যতম শীর্ষ গন্তব্য হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তার জন্য মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি) প্রকল্পের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে ট্রাম্পের অনাগ্রহ বিশেষত শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাড়ানো এবং কৌশলগত সুবিধা নেওয়ার প্রতি ট্রাম্পের জোর দেওয়া প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করে। মালদ্বীপ একটি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে, শ্রীলঙ্কা অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (এসিএসএ) স্বাক্ষর করে এবং স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট নবায়নের বিষয়ে আলোচনা করে। বাংলাদেশের সঙ্গে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) এবং এসিএসএ স্বাক্ষরের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই জোরালো সম্পর্ক, বাণিজ্য যুদ্ধ, চীন থেকে দূরে সরতে বারবার আহ্বান, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিরুদ্ধে ভূ-অর্থনৈতিক পদক্ষেপ এবং ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়াকে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রভাগে নিয়ে এসেছে। এতে ছোট দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে সতর্ক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের পর ক্ষমতায় আসা জো বাইডেন তাঁর পূর্বসূরির ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেন। এ সময় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব কমে যায়। ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়া করে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে। এরপর অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসে। তবে, বাইডেন মানবিক সহায়তা পুনরায় শুরু করেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি একটি নির্বাহী আদেশে আফগানিস্তানের জব্দ তহবিলের একটি অংশ ত্রাণ কার্যক্রম এবং ৯ / ১১ হামলার ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

বাইডেন আমলে পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদে তাদের সহযোগিতার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহনশীলতা এক প্রকার শেষ হয়ে যায়। বাইডেন ২০২৪ সালের মার্চে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে প্রথমবার যোগাযোগ করেন, যা দেশটির কমে যাওয়া গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়। বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়। এই নীতি দিল্লির সঙ্গে একটি স্পষ্ট ভিন্নতা তৈরি করে।

অন্য দিকে, বাইডেন ভারতকে আঞ্চলিক নেতৃত্বে ভূমিকা নিতে উৎসাহিত করেন। নেপালের এমসিসি প্রকল্প ও কলম্বো পোর্ট সিটি প্রকল্পে ভারতীয় নেতৃত্বে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ট্রাম্প প্রশাসনের মতো লেনদেন-কেন্দ্রিক নীতিতে গুরুত্ব না দিলেও, বাইডেনের নীতি ছিল গণতন্ত্রকেন্দ্রিক। বিশেষত বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে বাইডেনের কৌশল ছিল সুস্পষ্ট।

ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন সম্ভবত তাঁর পূর্বসূরির নীতিগুলোর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে, তবে প্রথম মেয়াদের মতো কিছু বিরোধিতাও দেখা যাবে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে একটি সুসংহত পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। এই দুই দেশে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা এবং উন্নয়ন কার্যক্রম চালু থাকবে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ চীনের প্রভাব মোকাবিলা ও চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) ঠেকানোর দিকেই বেশি। গণতন্ত্র ও জাতি গঠনে ট্রাম্পের কম মনোযোগ তালেবানদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। তবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো অর্থনৈতিক বা কৌশলগত সুবিধাহীন দেশগুলোতে ট্রাম্প কতটা বিনিয়োগ করবেন, তা স্পষ্ট নয়।

অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে, যেগুলো এখনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে—যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আর্থিক লাভ তুলনামূলকভাবে কম। তবে ইন্দো-প্যাসিফিকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, উন্নয়ন সহায়তা এবং বিদেশি বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে। এতে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে এড়িয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে ট্রাম্পের কম উদ্বেগ একটি সম্ভাব্য সমস্যাকে নিরসন করবে। তবে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক শাসন পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’—এর লক্ষ্যে ট্রাম্প সম্ভবত এই অঞ্চলে ভারতের নেতৃত্বের ভূমিকা বাড়ানোর সুযোগ দেবেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে সুবিধা নেওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের সমালোচনা ও দূরত্ব বজায় রাখা হোয়াইট হাউসের সমালোচনার মুখে ও চাপে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে। ট্রাম্পের ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা এবং চীনের প্রতি আক্রমণাত্মক অবস্থান দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে পক্ষ নেওয়ার চাপে রাখবে। ট্রাম্প চান, এই ছোট দেশগুলো মুক্ত, উন্মুক্ত ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করুক, যদিও তারা চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং সমালোচনা হোয়াইট হাউসের চাপ বাড়াবে।

ট্রাম্পের সময় শুরু হওয়া বিভিন্ন প্রকল্প ও আলোচনার মধ্যে কিছু স্থগিত রয়েছে বা এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এমসিসি ও স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস (এসওএফএ) চুক্তি। দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়ন সহযোগিতার রাজনীতিকীকরণ, পাশাপাশি ট্রাম্পের লেনদেনমুখী ও অস্থির পররাষ্ট্রনীতি, এই চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও গভীর করবে।

ভারতীয় থিংক ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নিবন্ধ থেকে অনূদিত

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত