Ajker Patrika

অ্যালগরিদম: মানুষের মন যেখানে মুনাফার মেশিন

আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫, ২০: ৪০
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি কেবল সরঞ্জাম নয়, আমাদের চেতনা, পরিচয় ও আচরণ বদলে দিচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম; নিরবে পর্যবেক্ষণ ও প্রভাবিত করছে আমাদের মনোযোগ, অনুভূতি এবং আচরণকে। এই সব মাধ্যমগুলোর মালিকরা যা করছে, তা নিরব বিপ্লব—ধীর, কিন্তু গভীর।

দেড় দশক আগে যখন এগুলোর প্রভাব এতটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়নি, তখন ফরাসি দার্শনিক বার্নার্ড স্টিগলার এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। ‘টেকিং কেয়ার অব ইয়ুথ অ্যান্ড জেনারেশন’ শীর্ষক বইতে তিনি লিখেছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের চেতনার মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠছে—আমাদের মনোযোগ, ইচ্ছা ও যত্নকে প্রভাবিত করছে। আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য প্রতিটি নোটিফিকেশন, ফিড, বা সার্চ রেজাল্ট সুকৌশলে ডিজাইন করা হয়েছে। এর ফলে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা এবং স্বায়ত্তশাসন ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। আমরা আর নিজের পছন্দে নয়, বরং অ্যালগরিদ-নির্ধারিত তথ্যপ্রবাহে চালিত হচ্ছি।

২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের তরুণ ভোক্তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তে সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞাপনের প্রভাব’ শীর্ষক ঢাকা শহরে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, তরুণদের ক্রয় সিদ্ধান্তে ৫৩.৫% প্রভাব ফেলে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে তথ্যের উৎস, অভিনব বিজ্ঞাপন, সময় সাশ্রয়, নিরাপত্তা, অর্ডার করার সুবিধা ও ফিডব্যাক এই সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মানুষের সামাজিক জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী শেরি টার্কল। তাঁর মতে, প্রযুক্তি আমাদের সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করলেও তা এক ধরনের নতুন নিঃসঙ্গতা ও আবেগীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি তৈরি করতে পারে।

২০১১ সালে প্রকাশিত ‘অ্যালোন টুগেদার: হোয়াই উই এক্সপেক্ট মোর ফ্রম টেকনোলজি অ্যান্ড লেস ফ্রম ইচ আদার’ বইতে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়তে আমরা যেভাবে ক্রমাগত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, তাতে আমাদের সম্পর্ক, অন্তরঙ্গতা এবং এমনকি নিজেদের পরিচয়বোধও প্রভাবিত হচ্ছে। এই ‘সিমুলেটেড কানেকশন’ বা কৃত্রিম সংযোগ আমাদের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমরা একে অপরের কাছ থেকে কম প্রত্যাশা করি, অথচ প্রযুক্তির কাছে প্রত্যাশা করি আরও বেশি।

প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সামাজিক ও মানসিক দিকগুলো নিয়ে গভীর সতর্কবার্তা দেয় তাঁর বই। তিনি লিখেছেন, ঘনিষ্ঠতার পেছনেই ছোটে প্রযুক্তি, কিন্তু প্রকৃত মানবিক সম্পর্কের পরিবর্তে অ্যালগরিদমের তৈরি ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়া দেয়। আমরা নিজেদের সংযুক্ত মনে করি, কিন্তু আসলে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছি। আমাদের মন প্রযুক্তির ছন্দে নাচছে; পরিণতিতে সর্বাধিক মুনাফার জন্য ডিজাইন করা ‘মনোযোগ অর্থনীতির’ নিস্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠছে।

অ্যালগরিদমিক ডিজাইন: মন নিয়ে খেলা

আমাদের উপলব্ধিকে প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর নকশা তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিলেভেন্স অব অ্যালগরদিম শীর্ষক বইতে টারলেটন গিলেসপি এবং অ্যালগরিদম অব অপরেসন শীর্ষক বইতে সাফিয়া নোবেলে বলছেন, অ্যালগরিদমগুলো নিরপেক্ষ নয়—এগুলো কর্পোরেট ডিজাইনারদের সুর্নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তৈরি। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্যবহারকারীদের আচরণ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া এবং তা প্রভাবিত করে বিজ্ঞাপন ও পরিষেবা বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।

তুর্কি সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ টুফেকচির গবেষণা দেখিয়েছে, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর এনগেজমেন্টভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের ধীরে ধীরে চরম ও বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তুর দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে মানব মনে ধ্রুব মনস্তাত্ত্বিক নীরিক্ষা চলতে; ব্যবহারকারীরা কার্যত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর পরীক্ষাগারে পরিণত হয়।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

হাইপার-পারসনালাইজেশন ও আত্ম পণ্যায়ন

প্রযুক্তির মূল শক্তি ব্যবহারকারীদের আচরণগত এবং বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করা, বিশ্লেষণ করা এবং তার ভিত্তিতে তাদের সামনে নির্দিষ্ট তথ্য ও পণ্য তুলে ধরা। এতে একধরনের রিঅ্যাকশন লুপ তৈরি হয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং যা বিশ্বাস করে তা আরও দেখে।

শোশানা জুবফ (২০১৯) এই বাস্তবতার নাম দিয়েছেন ‘সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম’ বা নজরদারি পুঁজিবাদ, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস, চিন্তা ও অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করে তা বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করা হয়। এটি কেবল বাণিজ্যিক কৌশল নয়—নতুন ধরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির নির্মাণ।

২০২৩ সালে এই মডেলের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই মডেল ব্যবহার করে ওই বছর অ্যাপল ৯৭ বিলিয়ন, অ্যালফাবেট (গুগল) ৭৩.৮ বিলিয়ন, মেটা (ফেসবুক) ৩৯.১ বিলিয়ন ও অ্যামাজন ৩০.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হাতিয়েছে। আর এই মুনাফা এসেছে মানুষের মনোযোগ এবং আচরণ বিক্রি করে—ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন বা শ্রমের মাধ্যমে নয়।

প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজমের বাস্তব অভিঘাত

এই প্রযুক্তিভিত্তিক শোষণ কেবল ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নয়—এটি বাস্তব জগতে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। তার কিছু বাস্তব দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।

রোহিঙ্গা গণহত্যা (মিয়ানমার) : ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার হয়েছে। এটি মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলে জাতিসংঘের ভাষ্য।

ইথিওপিয়ার সংঘাতেও ফেসবুক ও টুইটারে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জাতিগত সহিংসতা উসকে দেয়া হয়।

কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতি: ইনস্টাগ্রামের কনটেন্ট শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে।

ক্যাপিটল হিল হামলা (যুক্তরাষ্ট্র, ২০২১) : ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছে, যা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।

ভারতে গণপিটুনি ও সহিংসতা: হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়া বার্তা ভাইরাল হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

লাইভস্ট্রিমকৃত গণহত্যা: ক্রাইস্টচার্চ (নিউজিল্যান্ড) ও বাফেলো (যুক্তরাষ্ট্র) হামলায় খুনিরা হামলার দৃশ্য লাইভস্ট্রিম করে, অনলাইন দর্শকদের সামনে ট্র্যাজেডিকে বিনোদনে পরিণত করে।

অনলাইন হয়রানি ও আত্মহত্যা: সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়রানির ফলে কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।

এই সব ঘটনা প্রমাণ করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যালগরিদম ও নজরদারি কৌশল কীভাবে বিশ্বজুড়ে চরম মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়েছে।

মুনাফায় প্রযুক্তি কোম্পানির পোয়াবারো

২০২৪ সালে বিশ্বের সর্বাধিক লাভজনক শীর্ষ ১০টি কোম্পানির তালিকায় প্রযুক্তি খাতভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবস্থান ছিল উল্লেখযোগ্য। ফরচুন ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, এই শীর্ষ দশে মোট চারটি প্রযুক্তি কোম্পানি জায়গা করে নিয়েছে। বিগ টেকের মুনাফা শুধু বিপুল নয়, তুলনামূলক বিশ্লেষণও বিস্ময়কর।

এই তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপল। গত বছর ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করেছিল এই কোম্পানি। তেল কোম্পানি এক্সনমোবিল (৩৬ বিলিয়ন ডলার) ও বিশ্বখ্যাত গাড়িনির্মাতা টয়োটা (২৯ বিলিয়ন ডলার) সম্মিলিত মুনাফার চেয়ে বেশি।

তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে আছে গুগলের মালিক প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, যার মুনাফা ৭৩.৮ বিলিয়ন ডলার। মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজারের তুলনায় দ্বিগুণ এই মুনাফা। অ্যালফাবেটের পরেই মাইক্রোসফটের অবস্থান, কোম্পানিটি ৭২.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে।

মুনাফায় শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় নবম স্থানে আছে বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা। মার্ক জাকার্বার্গের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ২০২৪ সালে ৩৯.১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। মেটার লাভ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ভোগ্যপণ্য নির্মাতা কোম্পানি প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের প্রায় তিনগুণ।

তাদের সম্মিলিত মুনাফা ছিল প্রায় ২৮২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার ও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের উপরে ভর করে দুর্দান্ত মুনাফা করেছে, যেখানে মানব শ্রম বা প্রকৃত উৎপাদনের ভূমিকা নিতান্ত নগন্য।

ডিজিটাল শ্রম এবং শোষণের নতুন রূপ

এই মুনাফার পেছনে যে শ্রম রয়েছে তা আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট করি, ইউটিউবে ভিডিও দেখি, বা টিকটকে স্ক্রল করি, তখন আমরা যে শুধু এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করছি তা নয়, আমরা শ্রমও দিচ্ছি— এটিই ‘ডিজিটাল শ্রম’। ব্যবহারকারীদের সময়, মনোযোগ ও ডেটার অনবরত প্রবাহকে বিশ্লেষণ করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হাজার হাজার গুণ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।

ইতালীয় মার্ক্সবাদী পণ্ডিতরা এটিকে ‘আনজাস্ট এনক্লোজার’ অর্থাৎ ‘যৌথ চেতনার ব্যক্তিগত মালিকানা’ আখ্যা দিয়েছেন। এই নতুন রূপের শোষণে শ্রমিকের শরীর নয়, ব্যবহৃত হচ্ছে মন ও আবেগ।

মুক্তির পথ কোথায়

প্রযুক্তি আমাদের চেতনায় যে প্রভাব ফেলছে, তা নিছক প্রযুক্তিগত ইস্যু নয়—এটি একটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকট। আমাদের মনকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, এবং আমরা অজান্তেই বিগ টেক তথা আগ্রাসী প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপনিবেশিকরণের অংশ হয়ে পড়েছি। এই পরিস্থিতির বদল না হলে আমরা প্রযুক্তির বন্দী হয়ে যাব নিজেদের অজান্তেই।

পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল প্রযুক্তি নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য। তার সঙ্গে দরকার ব্যবহারকারীর তথ্যের উপর সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি কোম্পনিগুলোর পক্ষ থেকে অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমেই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব।

লেখক:

সহকারী বার্তা সম্পাদক

আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত