Ajker Patrika

অ্যালগরিদম: মানুষের মন যেখানে মুনাফার মেশিন

আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫, ২০: ৪০
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি কেবল সরঞ্জাম নয়, আমাদের চেতনা, পরিচয় ও আচরণ বদলে দিচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম; নিরবে পর্যবেক্ষণ ও প্রভাবিত করছে আমাদের মনোযোগ, অনুভূতি এবং আচরণকে। এই সব মাধ্যমগুলোর মালিকরা যা করছে, তা নিরব বিপ্লব—ধীর, কিন্তু গভীর।

দেড় দশক আগে যখন এগুলোর প্রভাব এতটা প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়নি, তখন ফরাসি দার্শনিক বার্নার্ড স্টিগলার এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। ‘টেকিং কেয়ার অব ইয়ুথ অ্যান্ড জেনারেশন’ শীর্ষক বইতে তিনি লিখেছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের চেতনার মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠছে—আমাদের মনোযোগ, ইচ্ছা ও যত্নকে প্রভাবিত করছে। আমাদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য প্রতিটি নোটিফিকেশন, ফিড, বা সার্চ রেজাল্ট সুকৌশলে ডিজাইন করা হয়েছে। এর ফলে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা এবং স্বায়ত্তশাসন ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। আমরা আর নিজের পছন্দে নয়, বরং অ্যালগরিদ-নির্ধারিত তথ্যপ্রবাহে চালিত হচ্ছি।

২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের তরুণ ভোক্তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তে সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞাপনের প্রভাব’ শীর্ষক ঢাকা শহরে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, তরুণদের ক্রয় সিদ্ধান্তে ৫৩.৫% প্রভাব ফেলে ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে তথ্যের উৎস, অভিনব বিজ্ঞাপন, সময় সাশ্রয়, নিরাপত্তা, অর্ডার করার সুবিধা ও ফিডব্যাক এই সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মানুষের সামাজিক জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী শেরি টার্কল। তাঁর মতে, প্রযুক্তি আমাদের সংযোগের সুযোগ সৃষ্টি করলেও তা এক ধরনের নতুন নিঃসঙ্গতা ও আবেগীয় সম্পৃক্ততার ঘাটতি তৈরি করতে পারে।

২০১১ সালে প্রকাশিত ‘অ্যালোন টুগেদার: হোয়াই উই এক্সপেক্ট মোর ফ্রম টেকনোলজি অ্যান্ড লেস ফ্রম ইচ আদার’ বইতে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়তে আমরা যেভাবে ক্রমাগত প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, তাতে আমাদের সম্পর্ক, অন্তরঙ্গতা এবং এমনকি নিজেদের পরিচয়বোধও প্রভাবিত হচ্ছে। এই ‘সিমুলেটেড কানেকশন’ বা কৃত্রিম সংযোগ আমাদের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমরা একে অপরের কাছ থেকে কম প্রত্যাশা করি, অথচ প্রযুক্তির কাছে প্রত্যাশা করি আরও বেশি।

প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সামাজিক ও মানসিক দিকগুলো নিয়ে গভীর সতর্কবার্তা দেয় তাঁর বই। তিনি লিখেছেন, ঘনিষ্ঠতার পেছনেই ছোটে প্রযুক্তি, কিন্তু প্রকৃত মানবিক সম্পর্কের পরিবর্তে অ্যালগরিদমের তৈরি ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথস্ক্রিয়া দেয়। আমরা নিজেদের সংযুক্ত মনে করি, কিন্তু আসলে ক্রমশ একা হয়ে পড়ছি। আমাদের মন প্রযুক্তির ছন্দে নাচছে; পরিণতিতে সর্বাধিক মুনাফার জন্য ডিজাইন করা ‘মনোযোগ অর্থনীতির’ নিস্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠছে।

অ্যালগরিদমিক ডিজাইন: মন নিয়ে খেলা

আমাদের উপলব্ধিকে প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর নকশা তৈরি করা হয়েছে। দ্য রিলেভেন্স অব অ্যালগরদিম শীর্ষক বইতে টারলেটন গিলেসপি এবং অ্যালগরিদম অব অপরেসন শীর্ষক বইতে সাফিয়া নোবেলে বলছেন, অ্যালগরিদমগুলো নিরপেক্ষ নয়—এগুলো কর্পোরেট ডিজাইনারদের সুর্নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তৈরি। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্যবহারকারীদের আচরণ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া এবং তা প্রভাবিত করে বিজ্ঞাপন ও পরিষেবা বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।

তুর্কি সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ টুফেকচির গবেষণা দেখিয়েছে, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর এনগেজমেন্টভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের ধীরে ধীরে চরম ও বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তুর দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে মানব মনে ধ্রুব মনস্তাত্ত্বিক নীরিক্ষা চলতে; ব্যবহারকারীরা কার্যত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর পরীক্ষাগারে পরিণত হয়।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

হাইপার-পারসনালাইজেশন ও আত্ম পণ্যায়ন

প্রযুক্তির মূল শক্তি ব্যবহারকারীদের আচরণগত এবং বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করা, বিশ্লেষণ করা এবং তার ভিত্তিতে তাদের সামনে নির্দিষ্ট তথ্য ও পণ্য তুলে ধরা। এতে একধরনের রিঅ্যাকশন লুপ তৈরি হয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা যা দেখে তা-ই বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং যা বিশ্বাস করে তা আরও দেখে।

শোশানা জুবফ (২০১৯) এই বাস্তবতার নাম দিয়েছেন ‘সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম’ বা নজরদারি পুঁজিবাদ, যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস, চিন্তা ও অনুভূতি পর্যবেক্ষণ করে তা বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত করা হয়। এটি কেবল বাণিজ্যিক কৌশল নয়—নতুন ধরণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির নির্মাণ।

২০২৩ সালে এই মডেলের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য দেখা গেছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই মডেল ব্যবহার করে ওই বছর অ্যাপল ৯৭ বিলিয়ন, অ্যালফাবেট (গুগল) ৭৩.৮ বিলিয়ন, মেটা (ফেসবুক) ৩৯.১ বিলিয়ন ও অ্যামাজন ৩০.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হাতিয়েছে। আর এই মুনাফা এসেছে মানুষের মনোযোগ এবং আচরণ বিক্রি করে—ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন বা শ্রমের মাধ্যমে নয়।

প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজমের বাস্তব অভিঘাত

এই প্রযুক্তিভিত্তিক শোষণ কেবল ভার্চুয়াল জগতে সীমাবদ্ধ নয়—এটি বাস্তব জগতে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। তার কিছু বাস্তব দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।

রোহিঙ্গা গণহত্যা (মিয়ানমার) : ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার হয়েছে। এটি মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলে জাতিসংঘের ভাষ্য।

ইথিওপিয়ার সংঘাতেও ফেসবুক ও টুইটারে ভুল তথ্য ছড়িয়ে জাতিগত সহিংসতা উসকে দেয়া হয়।

কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতি: ইনস্টাগ্রামের কনটেন্ট শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে।

ক্যাপিটল হিল হামলা (যুক্তরাষ্ট্র, ২০২১) : ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ব্যবহার করে ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব ছড়ানো হয়েছে, যা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।

ভারতে গণপিটুনি ও সহিংসতা: হোয়াটসঅ্যাপে ভুয়া বার্তা ভাইরাল হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

লাইভস্ট্রিমকৃত গণহত্যা: ক্রাইস্টচার্চ (নিউজিল্যান্ড) ও বাফেলো (যুক্তরাষ্ট্র) হামলায় খুনিরা হামলার দৃশ্য লাইভস্ট্রিম করে, অনলাইন দর্শকদের সামনে ট্র্যাজেডিকে বিনোদনে পরিণত করে।

অনলাইন হয়রানি ও আত্মহত্যা: সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়রানির ফলে কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।

এই সব ঘটনা প্রমাণ করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যালগরিদম ও নজরদারি কৌশল কীভাবে বিশ্বজুড়ে চরম মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়েছে।

মুনাফায় প্রযুক্তি কোম্পানির পোয়াবারো

২০২৪ সালে বিশ্বের সর্বাধিক লাভজনক শীর্ষ ১০টি কোম্পানির তালিকায় প্রযুক্তি খাতভুক্ত কোম্পানিগুলোর অবস্থান ছিল উল্লেখযোগ্য। ফরচুন ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, এই শীর্ষ দশে মোট চারটি প্রযুক্তি কোম্পানি জায়গা করে নিয়েছে। বিগ টেকের মুনাফা শুধু বিপুল নয়, তুলনামূলক বিশ্লেষণও বিস্ময়কর।

এই তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপল। গত বছর ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করেছিল এই কোম্পানি। তেল কোম্পানি এক্সনমোবিল (৩৬ বিলিয়ন ডলার) ও বিশ্বখ্যাত গাড়িনির্মাতা টয়োটা (২৯ বিলিয়ন ডলার) সম্মিলিত মুনাফার চেয়ে বেশি।

তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে আছে গুগলের মালিক প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, যার মুনাফা ৭৩.৮ বিলিয়ন ডলার। মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রস্তুতকারক ফাইজারের তুলনায় দ্বিগুণ এই মুনাফা। অ্যালফাবেটের পরেই মাইক্রোসফটের অবস্থান, কোম্পানিটি ৭২.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে।

মুনাফায় শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় নবম স্থানে আছে বিশ্বের শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা। মার্ক জাকার্বার্গের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ২০২৪ সালে ৩৯.১ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। মেটার লাভ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ভোগ্যপণ্য নির্মাতা কোম্পানি প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের প্রায় তিনগুণ।

তাদের সম্মিলিত মুনাফা ছিল প্রায় ২৮২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার ও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের উপরে ভর করে দুর্দান্ত মুনাফা করেছে, যেখানে মানব শ্রম বা প্রকৃত উৎপাদনের ভূমিকা নিতান্ত নগন্য।

ডিজিটাল শ্রম এবং শোষণের নতুন রূপ

এই মুনাফার পেছনে যে শ্রম রয়েছে তা আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা যখন ফেসবুকে পোস্ট করি, ইউটিউবে ভিডিও দেখি, বা টিকটকে স্ক্রল করি, তখন আমরা যে শুধু এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করছি তা নয়, আমরা শ্রমও দিচ্ছি— এটিই ‘ডিজিটাল শ্রম’। ব্যবহারকারীদের সময়, মনোযোগ ও ডেটার অনবরত প্রবাহকে বিশ্লেষণ করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হাজার হাজার গুণ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।

ইতালীয় মার্ক্সবাদী পণ্ডিতরা এটিকে ‘আনজাস্ট এনক্লোজার’ অর্থাৎ ‘যৌথ চেতনার ব্যক্তিগত মালিকানা’ আখ্যা দিয়েছেন। এই নতুন রূপের শোষণে শ্রমিকের শরীর নয়, ব্যবহৃত হচ্ছে মন ও আবেগ।

মুক্তির পথ কোথায়

প্রযুক্তি আমাদের চেতনায় যে প্রভাব ফেলছে, তা নিছক প্রযুক্তিগত ইস্যু নয়—এটি একটি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকট। আমাদের মনকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, এবং আমরা অজান্তেই বিগ টেক তথা আগ্রাসী প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপনিবেশিকরণের অংশ হয়ে পড়েছি। এই পরিস্থিতির বদল না হলে আমরা প্রযুক্তির বন্দী হয়ে যাব নিজেদের অজান্তেই।

পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল প্রযুক্তি নীতিমালা গ্রহণ অপরিহার্য। তার সঙ্গে দরকার ব্যবহারকারীর তথ্যের উপর সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি কোম্পনিগুলোর পক্ষ থেকে অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমেই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব।

লেখক:

সহকারী বার্তা সম্পাদক

আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত