Ajker Patrika

যে ইমরান খানকে আমি চিনতাম—শশী থারুরের স্মৃতিকথায় আশঙ্কা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত

জেলবন্দী পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। তাঁর পরিবার এখন ‘প্রুফ অব লাইফ’ দাবি করছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিতে উত্তরণের সেই যাত্রা ও ব্যক্তিগত স্মৃতি তুলে ধরেছেন ভারতের কংগ্রেস নেতা, কূটনীতিক ও লেখক শশী থারুর।

ইমরান খান একসময় পাকিস্তানের সংস্কার ও জাতীয় পুনর্জাগরণের স্বপ্ন হিসেবে বিবেচিত হতেন। সেই মানুষটাই ২০২৩ সাল থেকে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে বন্দী। ৭২ বছর বয়সী এই নেতাকে ঘিরে এখন গুজব ছড়িয়েছে—তাঁকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। তাঁর ছেলে কাসিম খান এখন বাবার জীবিত থাকার প্রমাণ ও মুক্তি দাবি করেছেন। এসব গুজব সত্য হলে এটি হবে এমন একটি জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি, যে জীবন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতি, জাতীয় নেতৃত্ব এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল।

১৯৫২ সালে লাহোরে সম্ভ্রান্ত পশতু পরিবারে জন্ম ইমরানের। লাহোরের অ্যাচিসন কলেজ, রয়্যাল গ্রামার স্কুল উর্সেস্টার ও অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে শিক্ষাগ্রহণ। ৭০-এর দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ এবং ১৯৯২ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক শিরোপা জয় তাঁকে ক্রিকেট-পুরাণের অমর নায়ক বানিয়ে দেয়।

কৌশল, দূরদর্শিতা ও দলকে এক সুতায় গেঁথে রাখার ক্ষমতা তাঁকে দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের মধ্যেও অসামান্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

ক্রিকেট থেকে জনসেবায়

ক্রিকেট ছাড়ার পর তিনি গড়ে তোলেন শওকত খানম ক্যানসার হাসপাতাল। এটি তাঁর মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম বৃহৎ ক্যানসার হাসপাতাল। সাধারণ মানুষের দানে পরিচালিত এই হাসপাতাল তাঁর জনপ্রিয়তা ও জন-আস্থারই প্রমাণ।

কিন্তু ইমরানের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়টি পুরোপুরি রাজনীতিকে ঘিরে। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠা করলেও দলটি দীর্ঘ সময় প্রান্তিক পর্যায়ে ছিল। ২০১০ সালের পর থেকে তাঁর দুর্নীতিবিরোধী বার্তা, জাতীয় মর্যাদার প্রতিশ্রুতি এবং ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা দেশজুড়ে তরুণদের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া তোলে।

২০১৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ‘নয়া পাকিস্তানের’ স্বপ্ন দেখালেও তাঁর শাসনকালজুড়ে ছিল অর্থনৈতিক অস্থিরতা, কূটনৈতিক চাপ ও সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রভাব—যা শেষ পর্যন্ত তাঁর পতনের কারণ হয়।

শশী থারুর তাঁর জীবনের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইমরান খানকে দেখেছেন।

প্রথম পরিচয়—থারুর যখন জাতিসংঘে কর্মরত, তখন নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে ইমরান খানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। থারুর বলেন, ইমরানের সহজ-সরল আচরণ ও সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁকে মুগ্ধ করে।

দ্বিতীয় পর্যায়—ইমরান তখন অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার হিসেবে নিয়মিত ভারতে আসতেন, বিভিন্ন টেলিভিশনে টক শোতে অংশ নিতেন। থারুরের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো। থারুর বলেন, ইমরান ছিলেন স্পষ্টভাষী, বুদ্ধিদীপ্ত এবং প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে আগ্রহী। ভারত–পাকিস্তান উত্তেজনা সত্ত্বেও ভারতে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অনেক, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে।

ইমরান খানের সঙ্গে শশী থারুরের সবচেয়ে স্মরণীয় সাক্ষাৎটি হয় ২০১৭ সালে ইসলামাবাদে এশিয়ান পার্লামেন্টারি সম্মেলনে। ইমরান তখন বিরোধী দলের নেতা। তিনি থারুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। নিরাপত্তার অজুহাতে পাকিস্তান সরকার থারুরকে হোটেলের বাইরে যেতে দেয়নি। তখন ইমরান নিজেই ছয়জন সহকর্মী নিয়ে হোটেলে যান।

থারুর বলেন, ‘আমাদের সাক্ষাৎটি রাজনৈতিক ছিল না—পুরোটা ছিল ইতিহাস নিয়ে। ইমরান আমার ‘‘An Era of Darkness’’ বই পুরোটা পড়েছেন। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি টেনে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, মতামত দেন, উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জানান। ইমরান আমাকে পাকিস্তানে এসে ইতিহাস নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণও জানান। তবে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।’

থারুর আরও বলেন, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ক্ষমতায় এলেও ইমরান ছিলেন বৈপরীত্যের প্রতীক। ভারতের সঙ্গে শান্তি চান, কিন্তু সামরিক গোয়েন্দাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতায় বাধাপ্রাপ্ত হন। দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিলেও নিজেই অভিযোগের মুখে পড়েন। অর্থনীতি সামাল দিতে গিয়ে চাপে পড়েন।

২০২২ সালে সেনা হস্তক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয়ে ইমরান ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট সংগঠিত করে। এরপর শুরু হয় ধারাবাহিক মামলা, গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। ২০২৩ সালে তিনি কারাবন্দী হন। অনেকের মতো থারুরও মনে করেন, ওই মামলার রায় ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়া, জেলের পরিবেশ, দলের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন—এসব তাঁর বিচ্ছিন্নতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বোনেরা জেলের বাইরে বিক্ষোভ করলে পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এখন তাঁর মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে। কেউ বলছে, সামরিক গোয়েন্দা মহলের ভেতরকার একটি অংশ তাঁকে হত্যা করেছে। এ বিষয়ে কোনো সরকারি বক্তব্য নেই। তবে এই নীরবতা রহস্য আরও গভীর করছে। যদি এটা সত্য হয়, তবে এটি পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে আরও এক অন্ধকার অধ্যায় হয়ে থাকবে।

থারুর মনে করেন, ইমরানের জীবনের পরিসমাপ্তি পাকিস্তানের আরও এক জনপ্রিয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরিণতিরই প্রতিধ্বনি। তিনিও ভেবেছিলেন, সামরিক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে যেতে পারবেন। কিন্তু এর জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল।

থারুর জানান, তাঁর কাছে ইমরান থেকে যাবেন সেই মানুষ হিসেবে—যিনি ইসলামাবাদের হোটেলে এসে এক ঘণ্টা ধরে ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছিলেন এবং রাজনীতির বাইরে একজন চিন্তাশীল, আবেগপ্রবণ ও দৃঢ় বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ