Ajker Patrika

মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবন-সংগ্রাম ও বাংলাদেশে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২১, ১৬: ১৩
মহানায়ক উত্তম কুমারের জীবন-সংগ্রাম ও বাংলাদেশে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

বয়স, পেশা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাংলা সিনেমার অভিনয়ের সম্রাট, মহানায়ক উত্তম কুমারের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তারা একান্তে উত্তমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্মৃতির মণিকোঠায়। তারা উপলব্ধি করেছেন, সংবেদনশীল ও মানব দরদি উত্তম কুমার তাঁর সিনেমায় জীবনের থেকেও বড়, চিরন্তন এক প্রেমিক-প্রতিমূর্তি গড়েছিলেন অভিনয়ের মাধ্যমে এবং তিনি তা করেছিলেন জেনে-বুঝেই। দেখে মনে হয়, একাডেমিশিয়ানরা সিনেমায় উত্তম কুমারের অভিনয়ের ব্যাপারটা পূর্বধারণা বা ঘরানার নিরিখে দেখলেও দর্শক তা দেখেছে হৃদয় দিয়ে। তাই আমাদের সিনেমা পণ্ডিতেরা উত্তম কুমারকে বুঝে উঠতে পারেননি, বোঝার চেষ্টাও করেননি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংগঠক ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের নেতাদের মনে এ বিষয়ে সচেতনতা ও সুস্পষ্ট বোঝাপড়া সৃষ্টি না হওয়ার কারণেই সম্ভবত পাশের বাড়ির অভিনয় শিল্পীর বিরাটত্বের বিষয়টি তাদের কাছে যোগ্য মর্যাদা পায়নি বা অবহেলিতই থেকে গেছে। 

অভিনয়ের বরপুত্র উত্তম কুমারের ৪১ তম প্রয়াণবার্ষিকীতে এ কথা বলতেই হচ্ছে, কালেভদ্রে সংবাদপত্রের বিনোদন পাতা ছাড়া, বাংলাদেশের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ উত্তম কুমারকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনলাইনে কিছু গ্রুপ অ্যাকটিভিটি থাকলেও উত্তম-চর্চার কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তি বা তৎপরতা বাংলাদেশে এখনো দৃশ্যমান নয়। এর কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক ও খণ্ডিত ভৌগোলিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উত্তম কুমার সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ও সময় দুটোই কম পেয়েছে। 

বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারার অভিনয়ের প্রবর্তন করেন উত্তম কুমার। নায়ক সিনেমার একটি দৃশ্যএখানকার চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মান এখনো অপরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। তা ছাড়া যাত্রা, পালাগান ও মঞ্চ অধ্যুষিত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের অভিনয়ের স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত। এমনকি সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হয়েছে এবং সরকারিভাবে যে ‘বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ (বিসিটিআই) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামেও অভিনয়ের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি এখনো। একদল একাডেমিশিয়ানের মনে এ ধারণাও বদ্ধমূল হয়তো—উত্তম কুমার বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেতা, তিনি ইউরোপীয় সিনেমার কেউ নন, তাঁকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? তাঁরা উপমহাদেশের চলচ্চিত্র আলোচনার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক–এর বাইরে ইদানীং অপর্ণা সেন-ঋতুপর্ণ ঘোষ-মণিকাউল-মীরা নায়ার, আর নানামুখী আলোচনায় স্মিতা পাতিল-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-শাবানা আজমি পর্যন্ত আলোচনা করতে রাজি আছেন, এর বাইরে একদম নয়। 

সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির চরম দুঃসময়ে বাঙালি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল উত্তম কুমারের কাছেবাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের যখন এই ঘোর অমানিশা, তখন প্রশ্ন হলো এ দেশের মানুষের কাছে উত্তম কুমার এত জনপ্রিয় হলেন কীভাবে? বিশেষত, মৃত্যুর চার দশক পরও কীভাবে তিনি দর্শক হৃদয়ে অক্ষয়–অব্যয় আসন ধরে রাখতে পারলেন? মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের উত্তম কুমার দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধি। তখন সার্বিকভাবে দেশভাগের পর বেদনা-জর্জরিত ছিল বাংলার উভয় অংশের মানুষের মন। দেশভাগের দগদগে ক্ষত এবং আর্থিক সমস্যা তখন বিভক্ত দুই বাংলার ঘরে ঘরে। সাধারণ দর্শক এই দৈন্য ও দুর্দশার বিপরীতে বাংলা ছবির পর্দায় তাদেরই জীবনের ছোট ছোট সাফল্য ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার চিত্রায়ণ দেখতে পায়। বিগত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এমন সব চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল অভিনয় করতে শুরু করেন উত্তম কুমার। পশ্চিমবঙ্গের মতো পূর্ববঙ্গের দর্শকেরও তখন মনে হয়, ছেলেটা তাদের মনের কথা বলছে। যুবক-যুবতীরা ভাবত উত্তমের ফ্যাশনের কথা। পত্রিকার কাটতি হতো উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন—এসব খবর ছেপে! তা নিয়ে তুমুল তর্ক হতো চায়ের স্টলে, বাঙালির আড্ডায়। নরসুন্দরের দোকানের দেয়ালে টানানো থাকত খবরের কাগজে ছাপা উত্তম কুমারের ছবি। স্কুল–কলেজে, বাজারে–খেয়াঘাটে, রান্নাঘরে, ড্রয়িংরুমে—সর্বত্র সবারই মনে হতো, যদি উত্তম হতে পারতাম! এভাবেই উত্তম কুমার চলচ্চিত্র তারকার গণ্ডি টপকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঢোকেন এবং হয়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। এভাবেই বাঙালি দর্শকের মনে রোমান্টিক শিল্পী উত্তম কুমারের জাদুকরী প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি হয়। 

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান উত্তমকে পাড়ার অভিনেতা থেকে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ হয়ে উঠতে তাঁকে করতে হয়েছে বিপুল পরিশ্রমসাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উত্তমের উত্থান হলেও চেনা উত্তম কুমারকে পাড়ার অভিনেতা থেকে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার’ হয়ে উঠতে কিন্তু বিপুল পরিশ্রম করতে হয়েছে! ছোটবেলার খেলার সাথি ও প্রাণাধিক প্রিয় দিদির মৃত্যুর নিদারুণ শোক আজীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়াও তাঁকে দীর্ঘ স্নায়ুক্ষয়ী সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। সংগীত রচনা থেকে অশ্বারোহণ, ঘরের বেড়া দেওয়া থেকে সাঁতার কাটা, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই শিখতে হয়েছিল জীবন থেকে। এই পরিক্রমায় তাঁকে সময়ের অভিঘাত পর্যবেক্ষণ ও মর্মস্থ করতে হয়, মাতৃভাষা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজিসহ অনেক ভাষাও মজ্জাগত করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অনেকের চক্রান্তে তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭)–এ অপরিমেয় ব্যয়ের পরও ছবিটি ফ্লপ হয়। তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যান। টাকার জন্য তিনি তখন বিভিন্ন মঞ্চেও গান গেয়েছেন। 

বাংলাদেশের দর্শকের কাছে উত্তম-সুচিত্রা এক ও অদ্বিতীয়, চিরসবুজ ও চিরতরুণ জুটির নামবিশেষত সংগীতের প্রতি উত্তমের ছিল অসীম একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই কিন্তু তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও হয়েছিল এই গান শেখানোর মধ্য দিয়ে। অসামান্য গলা আর অসাধারণ গায়ন রীতির অধিকারী ছিলেন তিনি। অভিনয় যদি তিনি না করতেন, তাহলে উত্তম কুমার হয়তো হতেন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী। উত্তম গান শিখেছিলেন ক্ল্যাসিক সংগীত শিল্পী নিদান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। প্রায় ৩০টি রাগের ওপর তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। উত্তমকে তিনি স্পেশাল সারগাম প্র্যাকটিস করাতেন, যাতে সুরের ওপর তিনি স্পষ্ট দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। শৈশব থেকেই মঞ্চনাটক, গান, আর যাত্রাপালার ভক্ত ছিলেন; ছিলেন সম্পৃক্তও। উত্তম কুমার একসময় স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর অভিনীত শ্যামলী (১৯৫৩) নাটকটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। যৌবনে ভারতবর্ষ পরাধীন থাকাকালের উন্মাতাল বৈশ্বিক রাজনীতি এবং আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর মনে স্বাজাত্যবোধ, সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়েছিল। তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন উত্তম কুমার। তরুণ বয়স থেকেই রচনা করতে শুরু করেন দেশাত্মবোধক গান ও বিপ্লবী গণসংগীত। এসব গানে সুর দিয়ে স্বকণ্ঠে ও সদলবলে গাইতেন সভা-সমিতিতে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিলেও অংশ নিতেন। স্বদেশি ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং কুৎসিত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকতে এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিতেও দেখা গেছে তাঁকে। দেশের মানুষ এই রোমান্টিক-বিপ্লবী ও সংগ্রামী উত্তমকে ভালোবাসত। 

প্রাথমিক জীবনে গানের শিক্ষক হিসেবেই টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন উত্তম কুমারভাবলে অবাক লাগে ১৯৪৭ সালে মুক্তি না-পাওয়া হিন্দি সিনেমা মায়াডোর-এ মাত্র পাঁচ-সিকা পারিশ্রমিকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে একস্ট্রা শিল্পী হিসেবে অভিনয় জীবন শুরু করেন উত্তম কুমার। সে ছবি কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সাহসী ছেলেটি বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ার মেয়ে ও নিজের গানের ছাত্রী গৌরী দেবীকে বিয়ে করে ফেললেন। সিনেমাপাড়ার ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ (এফএমজি) তখনো অসফলতার ধারাবাহিকতায় ছবিতে নাম পাল্টাচ্ছেন একের পর এক। প্রথমে অরুণ কুমার থেকে অরূপ কুমার, তারপর অরূপ কুমার থেকে উত্তম কুমার। অতঃপর পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে। অভিনয়ের জন্য এবার প্রশংসিত হলেন। ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হলেন প্রথমবারের মতো। সেখান থেকেই একটু একটু করে জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠার শুরু। ক্যারিয়ারের ৩৩ বছরে অন্তত ৫০টি অসাধারণ মানের ছবিসহ বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ ছবি উপহার দিয়ে হয়ে উঠলেন একাধারে চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনয় শিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক ও সংগঠক। এভাবে নিজেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হলেন। 

উত্তম কুমার তাঁর যুগের এবং বাংলা সিনেমার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক। মঞ্চ ও যাত্রার ফর্ম ভেঙে দিয়ে, তিনিই প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে পরিশীলিত অভিনয় রীতির প্রবর্তন করেন। বিচিত্র ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা। সিনেমার চিত্রভাষা বুঝতেন তিনি। বাঙালির মন ও রুচি ভালো করেই বুঝতেন। তিনি জানতেন বাঙালি-মানস প্রেমের জলে হাবুডুবু খায় ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে বিবাহপূর্ব মেলামেশা অনুমোদন করে না কিছুতেই। দৈহিক সম্পর্ক দেখালে ‘ভদ্র-বাঙালি’ পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে আসে না। কিন্তু লুকিয়ে বাইজি নাচের আসরে তার নিত্য আসা যাওয়া। তিনি আরও জানতেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে প্রেমিকের বাহ্যিক আচরণ অভিভাবকসুলভ। তাই শারীরিক সান্নিধ্য ছাড়াই তিনি প্রেমের রসায়ন জমিয়ে দিলেন বাংলা সিনেমার পর্দায়। আর মধ্যবিত্তের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও সংযম পরিশীলন; শিক্ষা ও রুচিশীলতার চর্চা; ইতিহাস, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার পরিচর্যা ও পরিমিতিবোধের লালন—এসবই ছিল উত্তম কুমারের অভিনয়ের মৌলিক উপাদান! তাই তো তাঁর অভিনয়ে প্রতিফলন ঘটল বাঙালির ভদ্রতার মুখোশ ও আদর্শ—দুটোরই। 

নায়ক সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে সত্যজিৎ রায়ও তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারেননিউত্তম কুমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানে অবলীলায় ঠোঁট মিলিয়েছেন। কারণ, গানটা তিনি বুঝতেন। জীবনের শুরুতেই গানের সঙ্গে বোঝা-পড়াটা তাঁর হয়েছিল একবারে অন্তর্গতভাবেই। আর এসব অমর গান বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া করে তোলে। রোমান্টিক প্রেমের ছবির পাশাপাশি প্রচুর ভিন্ন স্বাদের ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। কমেডি ও ট্র্যাজেডিতেও ছিলেন সমান পারদর্শী। মানুষের সঙ্গে একদম তার মতো মিশে যেতে পারতেন। যে চরিত্রে অভিনয় করতেন, মনে হতো তিনি সেই মানুষটাই। প্রতিটি চরিত্রের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। চরিত্রটির মতো হয়ে ওঠার জন্য আর তাঁর সেন্স অব টাইমিং ছিল অসাধারণ। অভিনয়ের এই নিষ্ঠার জন্য মূল্য দিতে গিয়ে ১৯৭১ সালে নকশালদের হাতে খুন হতে হতেও বেঁচে যান। কিন্তু এ জন্য তিনি ভয় পেয়ে অভিনয় ছেড়ে দেননি। কিছুদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে বিপুল সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। বন্যা-ঝঞ্ঝা-খরা ও নিপীড়িত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের কাছে তাই এই হার না-মানা সংগ্রামী উত্তম কুমার ভীষণ পছন্দের; একান্ত আপনার। 

বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন এবং ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়সহ সিনেমায় উত্তমের নায়িকা হয়েছিলেন সর্বমোট ৪৬ জন। প্রথম ছয় বছরে নয়জন বয়োজ্যেষ্ঠ নায়িকার সঙ্গে উত্তমের অভিনয় তাঁর ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও এরপরই শুরু হয় কিংবদন্তি উত্তম-সুচিত্রা যুগের। তরুণী নায়িকা সুচিত্রা সেনকে পাশে পেয়ে অভিনয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দেন উত্তম। তিনি নিজেই বলেন—‘সুচিত্রা পাশে না থাকলে আমি কখনোই উত্তম কুমার হতে পারতাম না।’ বাংলাদেশের মানুষ এ জন্য এখনো গর্ববোধ করে এবং তারা কথাটা বিশ্বাসও করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক অপার বিস্ময়ের নাম। 

সাগরিকা সিনেমায় উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনতাঁদের প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)-এর পর থেকেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক জাদুকরী রসায়নের নাম হয়ে ওঠেন উত্তম-সুচিত্রা। এ যেন প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনের একসঙ্গে স্ট্রাগল করা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা, দুজন দুজনার আশ্রয় হয়ে ওঠা—বাঙালি রুচির এমন ধারণার সমার্থক চিরকালীন রোমান্টিক তারকা জুটি! বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের ধারাই পাল্টে দেন তাঁরা। অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), সবার উপরে (১৯৫৫), শাপ মোচন (১৯৫৫), শিল্পী (১৯৫৬), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরী (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), আলো আমার আলো (১৯৭১)-সহ একে একে ৩১টি ছবিতে অভিনয় করে তাঁরা হয়ে যান বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন রোমান্টিক আইকন। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে উত্তম-সুচিত্রা তাই এক ও অদ্বিতীয়, অবিচ্ছেদ্য, চিরসবুজ ও চিরতরুণ জুটির নাম। উত্তমকে ছাড়া সুচিত্রাকে কিংবা সুচিত্রাকে ছাড়া উত্তমকে বাঙালি দর্শক একেবারেই দেখতে চান না। কারণ, দুর্দিনে বাঙালিকে যে হাসিয়ে-কাঁদিয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা! তাই তো উত্তমের মৃত্যুর দীর্ঘ চার দশক পর এখনো কান পাতলে শোনা যায় পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিচ্ছেদ-ব্যথায় কাতর প্রৌঢ় বাঙালির দীর্ঘশ্বাস। 

সমকালীন অন্য ডাকসাইটে নায়িকাদের মধ্যে উত্তম কুমারের হৃদয়ের রানি ছিলেন আরেক কিংবদন্তিতুল্য নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। সাজগোজ নিয়ে আধুনিকা সুপ্রিয়ার ছিল না কোনো মাথাব্যথা, ছিল পড়াশোনার নেশা। উত্তম কুমারকে সাম্প্রতিক সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন তিনি। নির্মল দের বসু পরিবার (১৯৫২) ছবিতে উত্তম তাঁর বন্ধুর বোন বেণু ওরফে সুপ্রিয়া দেবীকে পেয়েছিলেন সহ–অভিনেত্রী হিসেবে। পরে তিনিই পর্দায় উত্তমের অন্যতম সফল সিনেমা-জুটি এবং ব্যক্তি ও দাম্পত্যজীবনে প্রেরণাদাত্রী হয়ে ওঠেন। বাস্তব জীবনেও তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের জুটি। উত্তম-সুপ্রিয়া উত্তরায়ণ (১৯৬৩), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), বাঘ বন্দীর খেলা (১৯৭৫), সন্ন্যাসী রাজা (১৯৭৫) প্রভৃতি তুমুল জনপ্রিয় ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে উত্তম কুমারের সঙ্গে ঢাকার মেয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জুটিও জনপ্রিয় হয়। তাঁর অভিনয়গুণে মুগ্ধ ছিলেন মহানায়ক। হাত বাড়ালেই বন্ধু (১৯৬০), দুই ভাই (১৯৬১), মোমের আলো (১৯৬৮), নিশি পদ্ম (১৯৭০) ইত্যাদি সিনেমায় তাঁদের জুটিও প্রশংসিত হয়। ধন্যি মেয়ে (১৯৭১), মৌচাক (১৯৭৫)-এর মত কমেডি ছবিতে সাবিত্রী-উত্তম জুটির অভিনয় রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে আছে। 

সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে পর্দা ও পর্দার বাইরে—দু জায়গাতেই দারুণ রসায়ন তৈরি হয়েছিল উত্তম কুমারেরপঞ্চাশের দশকে যখন চলচ্চিত্রের আকাশ রাঙিয়ে দিতে শুরু করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছেও আপন হয়ে আছেন উত্তম কুমার। কারণ, ১৯৪৭-এ দেশভাগ হলেও এ দেশের সিনেমা হলগুলোতে তখনো ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পরে পাকিস্তানে ভারত-বিদ্বেষ প্রকট ও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেই সুযোগ সীমিত হয়ে হয়ে পড়ে। কিন্তু তত দিনে উত্তম-সুচিত্রা জুটির স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বাঙালি দর্শকের ঘরে ঘরে, অন্দর মহলে। উত্তমের সাবলীল অভিনয়ই তাঁর প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের চুম্বকশক্তি। এখনো বাংলা সিনেমার পুরোনো দর্শকেরা তাই উত্তম কুমারকেই খুঁজে ফেরে। সিনেমা হলে ভিএইচএস ক্যাসেটে, সিডি/ডিভিডিতে, ইন্টারনেটে যে ফর্মেই হোক, বাংলাদেশে ‘উত্তমকুমারের সিনেমা’ দেখার জোয়ার কমেনি কখনো। এমনকি করোনাকালীন লকডাউনের সময়েও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে উত্তম কুমারের দর্শক বেড়েছে; তারা ঘুরেফিরে বারবারই দেখছেন উত্তম কুমার অভিনীত ছবি। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চলচ্চিত্রের বন্দিদশা কিন্তু রয়ে গেছে আগের মতোই। ছিটেফোঁটা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ চলচ্চিত্র বিনিময় বন্ধ রয়েছে যথারীতি আগের মতোই। বাণিজ্যিক স্বার্থের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় বাংলা ছবিই প্রদর্শিত হচ্ছে না, আর পুরোনো দিনের সিনেমা তো একদমই নিষিদ্ধ বস্তু। কিন্তু ওই বস্তুর প্রতিই বাঙালির অমোঘ আকর্ষণের পেছনের কারণ সেই উত্তম কুমারই। আকাশ সংস্কৃতি আর অন্তর্জালের দুনিয়া আজ সব বাধা-বিপত্তি বানের জলের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে, নিজের ঘরে বসে অথবা হাতের তালুতে অবাধে উত্তম কুমারের সংবর্ধনা রচনা করছে বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর ছবি গোগ্রাসে গিলছে মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ থেকে নতুন প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই। শুনেছি বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এখন ‘টেলিভিশনের খবরে, সিনেমার পর্দায়, বাস্তবে—সর্বত্রই মানুষ প্রতিনিয়ত জটিল ও নিম্ন রুচির কনটেন্ট আর অশ্লীলতা ও ভায়োলেন্স দেখানো হয়, যা দর্শকের মনে স্বস্তি দিতে পারে না। বিশেষ করে, মানুষ যখন দৈনন্দিন জীবনের জটিলতায় বিধ্বস্ত, তখন সে রূঢ়-বাস্তবতা থেকে পালিয়ে মুক্তি পেতে চায়। উত্তমের ছবিতে সেই স্বস্তির সন্ধান আছে, আজকের বাঙালি নির্বিশেষে তাই ফিরে যেতে চায় সেই রোমান্টিকতার জগতে! বাংলা সিনেমার রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাই এখনো উত্তম কুমারই সবার পছন্দ। প্রয়াণ দিবসে তাই আমিও মহানায়ক উত্তম কুমারকে জানাই প্রাণের প্রণতি। 

জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ: কবি, গবেষক ও চলচ্চিত্রকার

আরও পড়ুন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত