আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তাঁর টেবিলে সাজানো বইয়ের মধ্যে একটির প্রচ্ছদে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নেতা ও আসন্ন নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রার্থী বইটি চলতি বছর বেইজিং সফরের সময় উপহার পান। পাঁচ খণ্ডের বইটিতে রয়েছে মূলত চীনা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও নিজের লেখা।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিককে বলেন, সফরটি খুবই চমৎকার ছিল। চীন তাঁদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো চীন জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তাহেরের এই সফর শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের চারপাশের অন্য দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও কাছে টানতে চীনের বৃহত্তর কৌশলের অংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে চীন শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নিতে চাইছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ মাসে অন্তত সাতবার চীনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ পাঁচ বছরের মেয়াদে এমন বৈঠক হয়েছিল মাত্র আটবার।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে বেইজিং। চলতি বছরই পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে অন্তত ২২ বার উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে চীন। গত বছরের ৩০টি বৈঠকের রেকর্ড ছিল। এ বছরও সে পথেই হাঁটছে তারা। ভারতের চারপাশের ছোট দেশগুলোতেও সক্রিয় চীন। চলতি বছর নেপালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তত ছয়বার এবং শ্রীলঙ্কার নেতাদের সঙ্গে অন্তত পাঁচবার বৈঠক করেছে বেইজিং।
এ কূটনৈতিক তৎপরতার পেছনে রয়েছে গভীর কৌশল। বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া চীন ও ভারত দুই দেশই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে। চীনের এ ধরনের ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপে একদিকে ভারতকে ব্যস্ত করে তুলছে, অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রবেশাধিকারও নিশ্চিত করছে বেইজিং।
চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের চীন ও দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, ‘ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের ঘেরাটোপে পড়ার আশঙ্কা ভারতের জন্য কখনো এত বাস্তব ও কঠোর মনে হয়নি। বহুদিন ধরেই নয়াদিল্লির এই ভীতি রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারতের সেই নীতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। গত মাসে তিনি নতুন করে ঘোষণা করেন, বিদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য বহুল ব্যবহৃত এইচ-১বি ভিসার ফি হবে এক লাখ ডলার। এই কর্মীদের অধিকাংশই ভারতীয়।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক অমিত রঞ্জন বলেন, ‘চীন জানে, ভারত এখন ব্যস্ত ও দুর্বল। তাই তারা মনে করতে পারে, এটাই সুযোগ ভারতের বিপরীতে সুবিধা নেওয়ার।’ রঞ্জনের মতে, বর্তমানে চারপাশের দেশগুলোর মধ্যে নয়াদিল্লির ভালো সম্পর্ক আছে মাত্র তিনটির সঙ্গে—শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটান। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের প্রভাবও আছে, আর ভুটানের সীমান্তেও চীন ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে।
আঞ্চলিক জোটের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সেটি স্পষ্ট হয়েছে গত মে মাসে। চীনের দেওয়া যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর গোয়েন্দা তথ্য সহায়তায় সীমান্ত সংঘাতে ভারতের ছয়টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি, বরং অনেক সময় ভারতের প্রতি উদাসীন বা বিরূপ আচরণ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় মিত্রদের চোখে ভারতের একঘরে হয়ে পড়া শুধু চীনের জন্যই সুযোগ তৈরি করবে। এতে ভারত মহাসাগরে বেইজিং আরও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। বিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবাহিত মোট জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশই যায় ভারত মহাসাগর দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সুশান্ত সিং বলেন, ‘এখানে অবশ্যই একটা আশঙ্কা আছে যে ভারতের চারপাশে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো একজোট হচ্ছে। আর ভারতের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, দিল্লির অবস্থান হলো—এসব পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখা এবং প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, ‘নিরাপদ’ ও ‘সমৃদ্ধ’ এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। তাদের দাবি, কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশকে টার্গেট করার ব্যাপার নেই।
বাংলাদেশে চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে। ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ শেখ হাসিনাকে ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয় গত বছর। এর পর থেকেই বেইজিং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে। চলতি বছরের মার্চে ড. ইউনূসের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরও ছিল বেইজিংয়ে, যেখানে তিনি সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো বৈঠক হয়নি। এপ্রিলে ব্যাংককে এক আঞ্চলিক বৈঠকের ফাঁকে তাঁদের সামান্য কথোপকথন হয়েছিল। ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। গত ডিসেম্বরে বেইজিং সফর চূড়ান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে নয়াদিল্লির কাছে দ্বিপক্ষীয় সফরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’
বাংলাদেশে কূটনৈতিক তৎপরতায় চীন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের সাবেক প্রধান লিউ সিয়ানচাওয়ের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। লিউ ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিতই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়া, গত জুনে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীও ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিল ২৫০ জনের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল।
তবে চীনের দৃষ্টি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। গত জুনে বেইজিং কুনমিং শহরে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে বিনিয়োগ থেকে শুরু করে অবকাঠামো পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়। তিন দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণাও দেয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগস্টে সাংবাদিকদের জানান, শ্রীলঙ্কাও এ উদ্যোগে যোগ দিতে পারে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে গত জুনে চীনা গবেষক লিউ জোংই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বজুড়ে বড় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস চলছে।’ তিনি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন।
চীন-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরোনো। ১৯৬২ সালে হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। ২০২০ সালে সীমান্তে মারামারিতে উভয় পক্ষের সেনারা হতাহত হয়। এ বছরের মে মাসেও উত্তেজনা বাড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে চীনা অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায়। পারমাণবিক শক্তিধর চীন ও ভারত সম্প্রতি সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি কৌশলগত পদক্ষেপ। কারণ, দুই দেশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে কাছে টানার প্রচেষ্টা শুধু অস্ত্র বিক্রিতে সীমাবদ্ধ নয়; তারা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। এ প্রচেষ্টার মূল হাতিয়ার হচ্ছে বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ (বিআরআই) অবকাঠামো কর্মসূচি।
চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে লিউ জোংই লিখেছেন, ‘ভারতের এমন নিজস্ব সামর্থ্য নেই যে তারা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু অন্য কোনো দেশ যদি প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করতে চায়, সেখানেও ভারত অনীহা দেখায়। কারণ, ভারত চায় তার ভূরাজনৈতিক আধিপত্য অটুট থাকুক।’
চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, চীন ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার বা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে না, বরং ভারতই সক্রিয়ভাবে চীনকে আটকে রাখতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দিয়ে। এর মধ্যে আছে ‘কোয়াড’, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে।
লিনের ভাষায়, ‘ভারতের মানসিকতা হলো—দক্ষিণ এশিয়াকে নিজের উঠান হিসেবে রাখা, এটিকে নিজের প্রভাববলয় হিসেবে ধরে রাখা।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু চীনের উত্থান বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর নেপালের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। তাই এখন দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছে।’
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গভীর কিন্তু ভারতের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের হলো—বাংলাদেশে বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তার। ভারতের ধারণা, ড. ইউনূসের সরকার ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে নরম অবস্থান নিয়েছে। আবার সরকারের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কারণ, এতে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্তে (সেভেন সিস্টার্স) উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওই রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডর (চিকেনস নেক) নিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
চলতি বছরের মার্চে বেইজিং সফরে ড. ইউনূস ভারতের এসব আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ওই অঞ্চলকে সমুদ্রপথে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের ওপরই ভরসা রাখতে হবে। ড. ইউনূস আরও বলেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ‘চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের একটি অংশ’ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ আবারও চীনের সহায়তায় তিস্তা নদী ঘিরে সীমান্তবর্তী কৌশলগত এলাকা উন্নয়নের প্রকল্প শুরু করতে চাচ্ছে। পাশাপাশি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের সুযোগও দিয়েছে চীনকে।
বাংলাদেশ চীনের তৈরি জে-১০ ‘ভিগোরাস ড্রাগন’ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। এই একই যুদ্ধবিমান পাকিস্তান বিমানবাহিনী ব্যবহার করে গত মে মাসে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল। পাশাপাশি ভারত ভিত্তিক মিসইনফরমেশন মোকাবিলায়ও চীনের সহায়তা চেয়েছে ঢাকা—এমনটাই জানিয়েছেন ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠরা।
বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হবে।’ তাঁর মতে, এতে ভারতের ওপর চাপ তৈরি হবে। অন্যদিকে অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল।
বাংলাদেশি থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানির বড় অংশই আসে চীন থেকে। চীন নরম শর্তে ও বাণিজ্যিক ঋণ দিয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে বিষয়টি বদলাচ্ছে, তা হলো রাজনৈতিক সম্পর্ক। অর্থাৎ ভারত থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে এগোনো।’
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতিও চীনের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রাকে সহায়তা করছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, বাংলাদেশি পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে বেইজিং, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে সুযোগ তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।’ অবশ্য পরে যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে।
চীনের আরেকটি বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক পুনর্গঠন। পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
চলতি বছরের শুরু থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান-চীন যৌথভাবে নির্মিত জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর সরাসরি বাণিজ্য সংযোগ পুনরায় চালু করেছে। আগস্টে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকা সফর করেন। এটি গত দশ বছরে ঢাকায় এমন উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর।
যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত বিষয়াবলি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ‘এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে সকলেই মনে করছে, ১৯৭১ সালের বিষয়কে এড়িয়ে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব নয়।’
এদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগস্টের শুরুতে পাকিস্তান চীনের জেড-১০ এমই অ্যাটাক হেলিকপ্টার ফ্লিটে যুক্ত করেছে। চীনের এই হেলিকপ্টার প্রথম কোনো বিদেশি সেনাবাহিনীর বহরে যুক্ত হলো।
একই মাসে চায়না শিপবিল্ডিং অ্যান্ড অফশোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পিত আটটি হাঙর-ক্লাস ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনের তৃতীয়টি কমিশন করেছে। এই সাবমেরিনগুলো পাকিস্তানকে আরব সাগরে ভারতকে মোকাবিলায় বাড়তি সক্ষমতা দেবে।
পাকিস্তানের বিমানবাহিনী চীনের সঙ্গে ২০২৬ সালের মধ্যে তিন ডজনেরও বেশি জে-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট কেনার বিষয়ে আলোচনায় রয়েছে। স্টিমসন সেন্টারের চীন প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, ‘চীনের অস্ত্র পাকিস্তানের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পুনর্মিলনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি পাকিস্তান ও তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সম্পর্কেও মধ্যস্থতা করছে চীন। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি এবং চীনা কর্মীদের হত্যা, প্রায় ১০ লাখ আফগান শরণার্থীর পাকিস্তান থেকে বিতাড়নের কারণে এই সম্পর্ক নাজুক হয়ে উঠেছে। চীন তালেবানকে আফগান মাটিতে থাকা উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
মে মাসের শেষ দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসলামাবাদ ও কাবুলের কাছে রাষ্ট্রদূত বিনিময় এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সহযোগিতা গভীর করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন। কার্যত বেইজিং কূটনীতিতে নয়াদিল্লিকে একঘরে করতে কাজ করছে, যদিও দুই দেশ প্রকাশ্যে তিক্ত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
ওয়াং ই গত আগস্টে দিল্লি সফর করেন, আর এর ১০ দিন পরই মোদি সাত বছরের মধ্যে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রথমবার চীন সফর করেন। সেখানে মোদিকে সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে দেখা যায়। সি তাঁকে বলেন, চীন ও ভারত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, অংশীদার’ এবং দুই দেশ এ মাস থেকে সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০২০ থেকে স্থগিত ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সম্পর্কের উন্নতি ট্রাম্পের নির্বাচনের আগেই শুরু হয়েছিল এবং মূলত দুই পক্ষের বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই এখানে ভূমিকা রেখেছে। যেমন—ভারতের লক্ষ্য উৎপাদন ব্যবস্থার মান উন্নত করা, অ্যাপলের মতো কোম্পানির সরবরাহকারীদের আকর্ষণ করা, কিন্তু এর জন্য চীনা উপাদান ও দক্ষতার প্রয়োজন। এটি এমন সময় হচ্ছে যখন চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
স্টিমসন সেন্টারের মার্কি বলেন, ‘এটি একটি কৌশলগত, হিসাব-নিকাশ করে দেখানো আগ্রহ। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সম্পর্কিত কার্যক্রমে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে বের করার জন্য দুই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি ভারতের চীনের প্রতি অবস্থান বা উদ্বেগ পুনর্বিবেচনার বিষয় নয়।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্যাভেকালের বিশ্লেষক টম মিলার এক প্রতিবেদনে বলেন, ভারত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার ঐতিহাসিক ‘কৌশলগত স্বাধীনতা’ নীতি অনুসরণ করছে। যার মাধ্যমে দেশটি ‘অনেক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে, কিন্তু কোনো একটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জুড়ে যাবে না’। তিনি বলেন, ‘চীন এখনো (ভারতের) শত্রু, তবে এরপরও এই যোগাযোগ অর্থনৈতিকভাবে (উভয় পক্ষের জন্য) সহায়ক হতে পারে।’
পুরোনো মিত্র চীনের ঘনিষ্ঠতা অর্জনে ভারতের দিক থেকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, সেসবের একটি ধারণা দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলাম। গত আগস্টে বেইজিং সফরকালে নাহিদও সেই বইটি স্মারক উপহার হিসেবে পেয়েছেন, যেটি জামায়াত নেতা তাহেরের ডেস্কে রয়েছে। নাহিদ বলেন, চীনের কাছে বাংলাদেশ ‘নতুন রাজনৈতিক অভিমুখের’ অংশ। বেইজিং অনেক দূরদৃষ্টি নিয়ে ভাবছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চীন আমাদের অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, তারা মনে করে আমরা একটি তরুণ রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধি এবং তারা মনে করে, আমরা বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারি।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে পুনর্লিখন করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তাঁর টেবিলে সাজানো বইয়ের মধ্যে একটির প্রচ্ছদে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নেতা ও আসন্ন নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রার্থী বইটি চলতি বছর বেইজিং সফরের সময় উপহার পান। পাঁচ খণ্ডের বইটিতে রয়েছে মূলত চীনা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও নিজের লেখা।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিককে বলেন, সফরটি খুবই চমৎকার ছিল। চীন তাঁদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো চীন জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তাহেরের এই সফর শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের চারপাশের অন্য দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও কাছে টানতে চীনের বৃহত্তর কৌশলের অংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে চীন শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নিতে চাইছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ মাসে অন্তত সাতবার চীনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ পাঁচ বছরের মেয়াদে এমন বৈঠক হয়েছিল মাত্র আটবার।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে বেইজিং। চলতি বছরই পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে অন্তত ২২ বার উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে চীন। গত বছরের ৩০টি বৈঠকের রেকর্ড ছিল। এ বছরও সে পথেই হাঁটছে তারা। ভারতের চারপাশের ছোট দেশগুলোতেও সক্রিয় চীন। চলতি বছর নেপালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তত ছয়বার এবং শ্রীলঙ্কার নেতাদের সঙ্গে অন্তত পাঁচবার বৈঠক করেছে বেইজিং।
এ কূটনৈতিক তৎপরতার পেছনে রয়েছে গভীর কৌশল। বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া চীন ও ভারত দুই দেশই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে। চীনের এ ধরনের ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপে একদিকে ভারতকে ব্যস্ত করে তুলছে, অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রবেশাধিকারও নিশ্চিত করছে বেইজিং।
চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের চীন ও দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, ‘ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের ঘেরাটোপে পড়ার আশঙ্কা ভারতের জন্য কখনো এত বাস্তব ও কঠোর মনে হয়নি। বহুদিন ধরেই নয়াদিল্লির এই ভীতি রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারতের সেই নীতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। গত মাসে তিনি নতুন করে ঘোষণা করেন, বিদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য বহুল ব্যবহৃত এইচ-১বি ভিসার ফি হবে এক লাখ ডলার। এই কর্মীদের অধিকাংশই ভারতীয়।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক অমিত রঞ্জন বলেন, ‘চীন জানে, ভারত এখন ব্যস্ত ও দুর্বল। তাই তারা মনে করতে পারে, এটাই সুযোগ ভারতের বিপরীতে সুবিধা নেওয়ার।’ রঞ্জনের মতে, বর্তমানে চারপাশের দেশগুলোর মধ্যে নয়াদিল্লির ভালো সম্পর্ক আছে মাত্র তিনটির সঙ্গে—শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটান। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের প্রভাবও আছে, আর ভুটানের সীমান্তেও চীন ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে।
আঞ্চলিক জোটের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সেটি স্পষ্ট হয়েছে গত মে মাসে। চীনের দেওয়া যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর গোয়েন্দা তথ্য সহায়তায় সীমান্ত সংঘাতে ভারতের ছয়টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি, বরং অনেক সময় ভারতের প্রতি উদাসীন বা বিরূপ আচরণ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় মিত্রদের চোখে ভারতের একঘরে হয়ে পড়া শুধু চীনের জন্যই সুযোগ তৈরি করবে। এতে ভারত মহাসাগরে বেইজিং আরও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। বিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবাহিত মোট জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশই যায় ভারত মহাসাগর দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সুশান্ত সিং বলেন, ‘এখানে অবশ্যই একটা আশঙ্কা আছে যে ভারতের চারপাশে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো একজোট হচ্ছে। আর ভারতের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, দিল্লির অবস্থান হলো—এসব পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখা এবং প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, ‘নিরাপদ’ ও ‘সমৃদ্ধ’ এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। তাদের দাবি, কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশকে টার্গেট করার ব্যাপার নেই।
বাংলাদেশে চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে। ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ শেখ হাসিনাকে ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয় গত বছর। এর পর থেকেই বেইজিং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে। চলতি বছরের মার্চে ড. ইউনূসের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরও ছিল বেইজিংয়ে, যেখানে তিনি সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো বৈঠক হয়নি। এপ্রিলে ব্যাংককে এক আঞ্চলিক বৈঠকের ফাঁকে তাঁদের সামান্য কথোপকথন হয়েছিল। ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। গত ডিসেম্বরে বেইজিং সফর চূড়ান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে নয়াদিল্লির কাছে দ্বিপক্ষীয় সফরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’
বাংলাদেশে কূটনৈতিক তৎপরতায় চীন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের সাবেক প্রধান লিউ সিয়ানচাওয়ের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। লিউ ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিতই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়া, গত জুনে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীও ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিল ২৫০ জনের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল।
তবে চীনের দৃষ্টি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। গত জুনে বেইজিং কুনমিং শহরে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে বিনিয়োগ থেকে শুরু করে অবকাঠামো পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়। তিন দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণাও দেয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগস্টে সাংবাদিকদের জানান, শ্রীলঙ্কাও এ উদ্যোগে যোগ দিতে পারে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে গত জুনে চীনা গবেষক লিউ জোংই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বজুড়ে বড় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস চলছে।’ তিনি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন।
চীন-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরোনো। ১৯৬২ সালে হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। ২০২০ সালে সীমান্তে মারামারিতে উভয় পক্ষের সেনারা হতাহত হয়। এ বছরের মে মাসেও উত্তেজনা বাড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে চীনা অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায়। পারমাণবিক শক্তিধর চীন ও ভারত সম্প্রতি সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি কৌশলগত পদক্ষেপ। কারণ, দুই দেশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে কাছে টানার প্রচেষ্টা শুধু অস্ত্র বিক্রিতে সীমাবদ্ধ নয়; তারা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। এ প্রচেষ্টার মূল হাতিয়ার হচ্ছে বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ (বিআরআই) অবকাঠামো কর্মসূচি।
চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে লিউ জোংই লিখেছেন, ‘ভারতের এমন নিজস্ব সামর্থ্য নেই যে তারা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু অন্য কোনো দেশ যদি প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করতে চায়, সেখানেও ভারত অনীহা দেখায়। কারণ, ভারত চায় তার ভূরাজনৈতিক আধিপত্য অটুট থাকুক।’
চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, চীন ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার বা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে না, বরং ভারতই সক্রিয়ভাবে চীনকে আটকে রাখতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দিয়ে। এর মধ্যে আছে ‘কোয়াড’, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে।
লিনের ভাষায়, ‘ভারতের মানসিকতা হলো—দক্ষিণ এশিয়াকে নিজের উঠান হিসেবে রাখা, এটিকে নিজের প্রভাববলয় হিসেবে ধরে রাখা।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু চীনের উত্থান বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর নেপালের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। তাই এখন দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছে।’
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গভীর কিন্তু ভারতের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের হলো—বাংলাদেশে বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তার। ভারতের ধারণা, ড. ইউনূসের সরকার ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে নরম অবস্থান নিয়েছে। আবার সরকারের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কারণ, এতে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্তে (সেভেন সিস্টার্স) উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওই রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডর (চিকেনস নেক) নিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
চলতি বছরের মার্চে বেইজিং সফরে ড. ইউনূস ভারতের এসব আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ওই অঞ্চলকে সমুদ্রপথে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের ওপরই ভরসা রাখতে হবে। ড. ইউনূস আরও বলেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ‘চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের একটি অংশ’ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ আবারও চীনের সহায়তায় তিস্তা নদী ঘিরে সীমান্তবর্তী কৌশলগত এলাকা উন্নয়নের প্রকল্প শুরু করতে চাচ্ছে। পাশাপাশি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের সুযোগও দিয়েছে চীনকে।
বাংলাদেশ চীনের তৈরি জে-১০ ‘ভিগোরাস ড্রাগন’ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। এই একই যুদ্ধবিমান পাকিস্তান বিমানবাহিনী ব্যবহার করে গত মে মাসে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল। পাশাপাশি ভারত ভিত্তিক মিসইনফরমেশন মোকাবিলায়ও চীনের সহায়তা চেয়েছে ঢাকা—এমনটাই জানিয়েছেন ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠরা।
বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হবে।’ তাঁর মতে, এতে ভারতের ওপর চাপ তৈরি হবে। অন্যদিকে অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল।
বাংলাদেশি থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানির বড় অংশই আসে চীন থেকে। চীন নরম শর্তে ও বাণিজ্যিক ঋণ দিয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে বিষয়টি বদলাচ্ছে, তা হলো রাজনৈতিক সম্পর্ক। অর্থাৎ ভারত থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে এগোনো।’
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতিও চীনের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রাকে সহায়তা করছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, বাংলাদেশি পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে বেইজিং, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে সুযোগ তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।’ অবশ্য পরে যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে।
চীনের আরেকটি বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক পুনর্গঠন। পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
চলতি বছরের শুরু থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান-চীন যৌথভাবে নির্মিত জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর সরাসরি বাণিজ্য সংযোগ পুনরায় চালু করেছে। আগস্টে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকা সফর করেন। এটি গত দশ বছরে ঢাকায় এমন উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর।
যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত বিষয়াবলি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ‘এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে সকলেই মনে করছে, ১৯৭১ সালের বিষয়কে এড়িয়ে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব নয়।’
এদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগস্টের শুরুতে পাকিস্তান চীনের জেড-১০ এমই অ্যাটাক হেলিকপ্টার ফ্লিটে যুক্ত করেছে। চীনের এই হেলিকপ্টার প্রথম কোনো বিদেশি সেনাবাহিনীর বহরে যুক্ত হলো।
একই মাসে চায়না শিপবিল্ডিং অ্যান্ড অফশোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পিত আটটি হাঙর-ক্লাস ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনের তৃতীয়টি কমিশন করেছে। এই সাবমেরিনগুলো পাকিস্তানকে আরব সাগরে ভারতকে মোকাবিলায় বাড়তি সক্ষমতা দেবে।
পাকিস্তানের বিমানবাহিনী চীনের সঙ্গে ২০২৬ সালের মধ্যে তিন ডজনেরও বেশি জে-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট কেনার বিষয়ে আলোচনায় রয়েছে। স্টিমসন সেন্টারের চীন প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, ‘চীনের অস্ত্র পাকিস্তানের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পুনর্মিলনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি পাকিস্তান ও তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সম্পর্কেও মধ্যস্থতা করছে চীন। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি এবং চীনা কর্মীদের হত্যা, প্রায় ১০ লাখ আফগান শরণার্থীর পাকিস্তান থেকে বিতাড়নের কারণে এই সম্পর্ক নাজুক হয়ে উঠেছে। চীন তালেবানকে আফগান মাটিতে থাকা উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
মে মাসের শেষ দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসলামাবাদ ও কাবুলের কাছে রাষ্ট্রদূত বিনিময় এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সহযোগিতা গভীর করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন। কার্যত বেইজিং কূটনীতিতে নয়াদিল্লিকে একঘরে করতে কাজ করছে, যদিও দুই দেশ প্রকাশ্যে তিক্ত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
ওয়াং ই গত আগস্টে দিল্লি সফর করেন, আর এর ১০ দিন পরই মোদি সাত বছরের মধ্যে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রথমবার চীন সফর করেন। সেখানে মোদিকে সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে দেখা যায়। সি তাঁকে বলেন, চীন ও ভারত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, অংশীদার’ এবং দুই দেশ এ মাস থেকে সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০২০ থেকে স্থগিত ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সম্পর্কের উন্নতি ট্রাম্পের নির্বাচনের আগেই শুরু হয়েছিল এবং মূলত দুই পক্ষের বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই এখানে ভূমিকা রেখেছে। যেমন—ভারতের লক্ষ্য উৎপাদন ব্যবস্থার মান উন্নত করা, অ্যাপলের মতো কোম্পানির সরবরাহকারীদের আকর্ষণ করা, কিন্তু এর জন্য চীনা উপাদান ও দক্ষতার প্রয়োজন। এটি এমন সময় হচ্ছে যখন চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
স্টিমসন সেন্টারের মার্কি বলেন, ‘এটি একটি কৌশলগত, হিসাব-নিকাশ করে দেখানো আগ্রহ। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সম্পর্কিত কার্যক্রমে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে বের করার জন্য দুই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি ভারতের চীনের প্রতি অবস্থান বা উদ্বেগ পুনর্বিবেচনার বিষয় নয়।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্যাভেকালের বিশ্লেষক টম মিলার এক প্রতিবেদনে বলেন, ভারত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার ঐতিহাসিক ‘কৌশলগত স্বাধীনতা’ নীতি অনুসরণ করছে। যার মাধ্যমে দেশটি ‘অনেক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে, কিন্তু কোনো একটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জুড়ে যাবে না’। তিনি বলেন, ‘চীন এখনো (ভারতের) শত্রু, তবে এরপরও এই যোগাযোগ অর্থনৈতিকভাবে (উভয় পক্ষের জন্য) সহায়ক হতে পারে।’
পুরোনো মিত্র চীনের ঘনিষ্ঠতা অর্জনে ভারতের দিক থেকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, সেসবের একটি ধারণা দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলাম। গত আগস্টে বেইজিং সফরকালে নাহিদও সেই বইটি স্মারক উপহার হিসেবে পেয়েছেন, যেটি জামায়াত নেতা তাহেরের ডেস্কে রয়েছে। নাহিদ বলেন, চীনের কাছে বাংলাদেশ ‘নতুন রাজনৈতিক অভিমুখের’ অংশ। বেইজিং অনেক দূরদৃষ্টি নিয়ে ভাবছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চীন আমাদের অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, তারা মনে করে আমরা একটি তরুণ রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধি এবং তারা মনে করে, আমরা বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারি।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে পুনর্লিখন করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।
০৬ অক্টোবর ২০২৫
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।
০৬ অক্টোবর ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।
০৬ অক্টোবর ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।
০৬ অক্টোবর ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে