আব্দুর রহমান

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)
আব্দুর রহমান

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার
২ ঘণ্টা আগে
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
৩ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার আবশ্যকতার ওপর ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়েছি।’
বস্তুত, এই প্রস্তাব দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চীনকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিকল্প জোট তৈরির ইঙ্গিত। বিশেষত এমন এক সময়ে যখন ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে এই অঞ্চলের প্রধান সংস্থা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজওনাল কো-অপারেশন বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা–সার্ক কার্যকারিতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে।
গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, এই সহযোগিতা ‘কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রতি লক্ষ্য করে নয়।’
দারের এই মন্তব্য এমন এক প্রেক্ষাপটে এল, যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে—পাকিস্তান–ভারতের কয়েক দশকের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী গত মে মাসে চার দিনের যুদ্ধে জড়িয়েছিল, যা সম্পর্ককে আরও টানাপোড়েনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ঢাকা–নয়াদিল্লি সম্পর্কও ব্যাপক খারাপ হয়েছে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান এবং নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়নি। গত নভেম্বরে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো–সার্কে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং আফগানিস্তান রয়েছে–তারা কি এই নতুন আঞ্চলিক জোটকে মেনে নেবে? মনে হচ্ছে এই জোট ভারতকে বাদ দেওয়ার, কিংবা অন্তত দেশটির প্রভাবকে সীমিত করার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হচ্ছে।
উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে এই ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের লক্ষ্য হলো—অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রগুলোতে ‘পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি’ করা এবং এই ধারণাটি আরও দেশ ও অঞ্চলে ‘বিস্তৃত ও অনুকরণযোগ্য’ হতে পারে। তিনি ইসলামাবাদ কনক্লেভে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বহুমুখী বাস্তবতা থাকতে পারে।’
তিনি ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজন এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকারগুলো কারও গোঁড়ামির কাছে জিম্মি থাকতে পারে না এবং আপনারা জানেন, আমি কাকে ইঙ্গিত করছি।’ ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যেকার উত্তেজনা প্রসঙ্গে দার উল্লেখ করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘কাঠামোগত আলোচনার’ প্রক্রিয়া ‘১১ বছরের বেশি’ সময় ধরে থমকে আছে। তিনি আরও যোগ করেন, অন্যান্য আঞ্চলিক দেশগুলোরও ‘আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দোদুল্যমান সম্পর্কের’ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে ‘বিভাজনের’ জায়গায় যোগাযোগ ও সহযোগিতা স্থান নেবে, যেখানে অর্থনীতিগুলো পারস্পরিক সমন্বয়ে বৃদ্ধি পাবে, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুসারে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধের সমাধান হবে এবং যেখানে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে শান্তি বজায় থাকবে। শিক্ষাবিদ রাবিয়া আখতারের মতে, এই পর্যায়ে প্রস্তাবটি ‘কার্যকর হওয়ার চেয়ে আকাঙ্ক্ষামূলক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের (সিএসএসপিআর) পরিচালক আখতার বলেন, ‘কিন্তু এটি এমন এক সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে বৈচিত্র্যময় করে তোলার ও নতুন করে সাজানোর পাকিস্তানের উদ্দেশ্যকে তুলে ধরেছে, যখন সার্ক স্থবির হয়ে আছে।’
সার্ক ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় একটি শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর সাতটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ ছিল—বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান অষ্টম সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। সার্কের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশীয়দের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটানো।
এর মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও, সংস্থাটি গত ৪০ বছর ধরেই লক্ষ্য অর্জনে লড়াই করেছে। এর মূল কারণ হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার কয়েক দশকের পুরোনো উত্তেজনা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা এবং উপমহাদেশ বিভাজনের পর এই দুই প্রতিবেশী তিনটি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯ তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু ভারত শাসিত কাশ্মীরে এক প্রাণঘাতী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
সিএসএসপিআর-এর আখতার বলেন, ‘এই সংস্থাটির কাজ করার জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন, আর দুটি বৃহত্তম সদস্য দেশের কাছ থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ থেকে আলাদা রাখার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সার্ক সামনে এগোতে পারে না।’
আঞ্চলিক এই সংস্থাটির শেষ শীর্ষ সম্মেলন ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে বিশ্লেষকেরা বলেন, সার্ক নিষ্ক্রিয় থাকলেও এই অঞ্চলের জন্য কাজ করার সম্ভাবনা তার আছে–যদি ভারত ও পাকিস্তান তাদের সেই সুযোগ দেয়। ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্বের দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বসবাস করে, যা দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল করে তুলেছে।
তবুও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য খুবই কম, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের একটি জোট আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ। আসিয়ান জোটের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি।
বিশ্বব্যাংকের অনুমান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি বাণিজ্য বাধাগুলো হ্রাস করে, তাহলে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিনিময় করতে পারত–যা তাদের বর্তমান বাণিজ্যের তিন গুণ। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য এখনো করুণ। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সাল নাগাদ তা আরও কমে অর্ধেকে অর্থাৎ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। যদিও অন্যান্য দেশের মাধ্যমে পরিচালিত তাদের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের।
আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্য সংযোগের একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালে, এই জোট একটি মোটর ভেহিক্যালস চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল, যার ফলে ইউরোপের মতো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে গাড়ি ও ট্রাক চলাচল করতে পারত। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তান সেই চুক্তি–এবং আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা সম্পর্কিত একটি পৃথক চুক্তি–আটকে দেয়।
তারপর থেকে এই জোটের একত্রে আসার ক্ষমতা কয়েকটি উপলক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন কোভিড-১৯ মহামারির সময় যখন সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি জরুরি তহবিল গঠন করে এবং জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করার জন্য ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। বিশ্লেষক ফারওয়া আমের বলেন, ‘যদি এই দুটি দেশ (ভারত ও পাকিস্তান) বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে সহযোগিতার সীমিত পথও চিহ্নিত করতে পারত, তাহলে নীতিগতভাবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা যেত।’
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের (এএসপিআই) দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক আমের যোগ করেন, ‘তবে, বর্তমান রাজনৈতিক গতিশীলতা বিবেচনা করে, এমন একটি সাফল্য একটি সুদূর সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছে।’
তবে আঞ্চলিক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে সার্ককে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা পাকিস্তানই প্রথম করছে না। সার্ক একটি আঞ্চলিক পরিবহন চুক্তি অনুমোদন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল–দেশগুলোর আদ্যক্ষর অনুসারে বিবিআইএন নামে একটি জোট তৈরি করে–নিজেদের মধ্যে একই ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আমের উল্লেখ করেন, ভারত অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা, যেমন বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) অংশ। বিমসটেকে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড রয়েছে।
তবুও, আমের সামগ্রিকভাবে বলেন, ‘অল্প বা মাঝারি মেয়াদে’ আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতার চেয়ে ‘দ্বিপক্ষীয় ও ত্রয়ী ব্যবস্থাগুলোই প্রাধান্য’ পাবে। কারণ, এক বা দুটি দেশের সঙ্গে একবারে কাজ করা ‘বেশি নমনীয়তা, পরিষ্কার প্রণোদনা এবং বাস্তব ফলাফল পাওয়ার বৃহত্তর সম্ভাবনা’ দেয়।
এই অবস্থায় পাকিস্তান যে প্রস্তাব দিচ্ছে, নতুন জোটের তা কার্যকর হবে কী—এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ আখতার বলেন, ‘প্রস্তাবটি কার্যকর হবে কিনা তা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, প্রথাগত কাঠামো যখন থমকে আছে, তখন সম্ভাব্য দেশগুলো ছোট, বিষয়-কেন্দ্রিক দলগুলোতে কার্যকরী মূল্য দেখতে পাচ্ছে কিনা এবং দ্বিতীয়ত, এই অংশগ্রহণের কারণে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে কোনো মূল্য দিতে হচ্ছে কিনা।’
আখতার বলেন, বেশ কয়েকটি দক্ষিণ এশীয় দেশ পাকিস্তানের প্রস্তাবিত আঞ্চলিক উদ্যোগে প্রাথমিক আগ্রহ দেখাতে পারে, যদিও আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের দিকে কোনো পদক্ষেপ সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ এবং হয়তো ভুটানের মতো দেশগুলো অনুসন্ধানী আলোচনায়, বিশেষ করে যোগাযোগ, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে, খোলা থাকতে পারে।’
তবে আখতার উল্লেখ করেন, ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা এবং পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ‘আসল সদস্যপদ গ্রহণ সতর্কতার সঙ্গে হবে।’ এই বিষয়ে এএসপিআই-এর আমের মনে করেন পাকিস্তানের প্রস্তাবটি ‘কৌশলগতভাবে সুসংগত।’ তিনি বলেন, ‘দেশটি এখন কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে আছে। তারা চীনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে নতুন ও উন্নত সম্পর্ক তৈরি করেছে।’
আমেরের মতে, ‘এই দ্বৈত-পথের সম্পৃক্ততা ইসলামাবাদকে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিনেতা হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়েছে। কার্যত, আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রে একটি আসন ফিরে পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার আবশ্যকতার ওপর ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়েছি।’
বস্তুত, এই প্রস্তাব দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চীনকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিকল্প জোট তৈরির ইঙ্গিত। বিশেষত এমন এক সময়ে যখন ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে এই অঞ্চলের প্রধান সংস্থা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজওনাল কো-অপারেশন বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা–সার্ক কার্যকারিতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে।
গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, এই সহযোগিতা ‘কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রতি লক্ষ্য করে নয়।’
দারের এই মন্তব্য এমন এক প্রেক্ষাপটে এল, যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে—পাকিস্তান–ভারতের কয়েক দশকের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী গত মে মাসে চার দিনের যুদ্ধে জড়িয়েছিল, যা সম্পর্ককে আরও টানাপোড়েনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ঢাকা–নয়াদিল্লি সম্পর্কও ব্যাপক খারাপ হয়েছে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান এবং নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়নি। গত নভেম্বরে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো–সার্কে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং আফগানিস্তান রয়েছে–তারা কি এই নতুন আঞ্চলিক জোটকে মেনে নেবে? মনে হচ্ছে এই জোট ভারতকে বাদ দেওয়ার, কিংবা অন্তত দেশটির প্রভাবকে সীমিত করার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হচ্ছে।
উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে এই ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের লক্ষ্য হলো—অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রগুলোতে ‘পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি’ করা এবং এই ধারণাটি আরও দেশ ও অঞ্চলে ‘বিস্তৃত ও অনুকরণযোগ্য’ হতে পারে। তিনি ইসলামাবাদ কনক্লেভে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, অর্থনীতি থেকে প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে বহুমুখী বাস্তবতা থাকতে পারে।’
তিনি ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজন এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকারগুলো কারও গোঁড়ামির কাছে জিম্মি থাকতে পারে না এবং আপনারা জানেন, আমি কাকে ইঙ্গিত করছি।’ ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যেকার উত্তেজনা প্রসঙ্গে দার উল্লেখ করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘কাঠামোগত আলোচনার’ প্রক্রিয়া ‘১১ বছরের বেশি’ সময় ধরে থমকে আছে। তিনি আরও যোগ করেন, অন্যান্য আঞ্চলিক দেশগুলোরও ‘আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দোদুল্যমান সম্পর্কের’ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে ‘বিভাজনের’ জায়গায় যোগাযোগ ও সহযোগিতা স্থান নেবে, যেখানে অর্থনীতিগুলো পারস্পরিক সমন্বয়ে বৃদ্ধি পাবে, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুসারে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধের সমাধান হবে এবং যেখানে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে শান্তি বজায় থাকবে। শিক্ষাবিদ রাবিয়া আখতারের মতে, এই পর্যায়ে প্রস্তাবটি ‘কার্যকর হওয়ার চেয়ে আকাঙ্ক্ষামূলক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের (সিএসএসপিআর) পরিচালক আখতার বলেন, ‘কিন্তু এটি এমন এক সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে বৈচিত্র্যময় করে তোলার ও নতুন করে সাজানোর পাকিস্তানের উদ্দেশ্যকে তুলে ধরেছে, যখন সার্ক স্থবির হয়ে আছে।’
সার্ক ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় একটি শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর সাতটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ ছিল—বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে আফগানিস্তান অষ্টম সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। সার্কের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশীয়দের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটানো।
এর মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও, সংস্থাটি গত ৪০ বছর ধরেই লক্ষ্য অর্জনে লড়াই করেছে। এর মূল কারণ হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার কয়েক দশকের পুরোনো উত্তেজনা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা এবং উপমহাদেশ বিভাজনের পর এই দুই প্রতিবেশী তিনটি পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯ তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু ভারত শাসিত কাশ্মীরে এক প্রাণঘাতী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
সিএসএসপিআর-এর আখতার বলেন, ‘এই সংস্থাটির কাজ করার জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন, আর দুটি বৃহত্তম সদস্য দেশের কাছ থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ থেকে আলাদা রাখার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সার্ক সামনে এগোতে পারে না।’
আঞ্চলিক এই সংস্থাটির শেষ শীর্ষ সম্মেলন ২০১৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে বিশ্লেষকেরা বলেন, সার্ক নিষ্ক্রিয় থাকলেও এই অঞ্চলের জন্য কাজ করার সম্ভাবনা তার আছে–যদি ভারত ও পাকিস্তান তাদের সেই সুযোগ দেয়। ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্বের দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বসবাস করে, যা দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল করে তুলেছে।
তবুও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য খুবই কম, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের একটি জোট আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ। আসিয়ান জোটের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি।
বিশ্বব্যাংকের অনুমান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি বাণিজ্য বাধাগুলো হ্রাস করে, তাহলে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিনিময় করতে পারত–যা তাদের বর্তমান বাণিজ্যের তিন গুণ। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য এখনো করুণ। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সাল নাগাদ তা আরও কমে অর্ধেকে অর্থাৎ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। যদিও অন্যান্য দেশের মাধ্যমে পরিচালিত তাদের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের।
আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাবকে এই অঞ্চলের দুর্বল বাণিজ্য সংযোগের একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালে, এই জোট একটি মোটর ভেহিক্যালস চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল, যার ফলে ইউরোপের মতো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে গাড়ি ও ট্রাক চলাচল করতে পারত। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তান সেই চুক্তি–এবং আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা সম্পর্কিত একটি পৃথক চুক্তি–আটকে দেয়।
তারপর থেকে এই জোটের একত্রে আসার ক্ষমতা কয়েকটি উপলক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন কোভিড-১৯ মহামারির সময় যখন সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি জরুরি তহবিল গঠন করে এবং জনস্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করার জন্য ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। বিশ্লেষক ফারওয়া আমের বলেন, ‘যদি এই দুটি দেশ (ভারত ও পাকিস্তান) বৃহত্তর আঞ্চলিক স্বার্থে সহযোগিতার সীমিত পথও চিহ্নিত করতে পারত, তাহলে নীতিগতভাবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা যেত।’
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের (এএসপিআই) দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক আমের যোগ করেন, ‘তবে, বর্তমান রাজনৈতিক গতিশীলতা বিবেচনা করে, এমন একটি সাফল্য একটি সুদূর সম্ভাবনা বলে মনে হচ্ছে।’
তবে আঞ্চলিক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে সার্ককে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা পাকিস্তানই প্রথম করছে না। সার্ক একটি আঞ্চলিক পরিবহন চুক্তি অনুমোদন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল–দেশগুলোর আদ্যক্ষর অনুসারে বিবিআইএন নামে একটি জোট তৈরি করে–নিজেদের মধ্যে একই ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আমের উল্লেখ করেন, ভারত অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা, যেমন বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের (বিমসটেক) অংশ। বিমসটেকে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড রয়েছে।
তবুও, আমের সামগ্রিকভাবে বলেন, ‘অল্প বা মাঝারি মেয়াদে’ আঞ্চলিক বহুপাক্ষিকতার চেয়ে ‘দ্বিপক্ষীয় ও ত্রয়ী ব্যবস্থাগুলোই প্রাধান্য’ পাবে। কারণ, এক বা দুটি দেশের সঙ্গে একবারে কাজ করা ‘বেশি নমনীয়তা, পরিষ্কার প্রণোদনা এবং বাস্তব ফলাফল পাওয়ার বৃহত্তর সম্ভাবনা’ দেয়।
এই অবস্থায় পাকিস্তান যে প্রস্তাব দিচ্ছে, নতুন জোটের তা কার্যকর হবে কী—এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ আখতার বলেন, ‘প্রস্তাবটি কার্যকর হবে কিনা তা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, প্রথাগত কাঠামো যখন থমকে আছে, তখন সম্ভাব্য দেশগুলো ছোট, বিষয়-কেন্দ্রিক দলগুলোতে কার্যকরী মূল্য দেখতে পাচ্ছে কিনা এবং দ্বিতীয়ত, এই অংশগ্রহণের কারণে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে কোনো মূল্য দিতে হচ্ছে কিনা।’
আখতার বলেন, বেশ কয়েকটি দক্ষিণ এশীয় দেশ পাকিস্তানের প্রস্তাবিত আঞ্চলিক উদ্যোগে প্রাথমিক আগ্রহ দেখাতে পারে, যদিও আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের দিকে কোনো পদক্ষেপ সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ এবং হয়তো ভুটানের মতো দেশগুলো অনুসন্ধানী আলোচনায়, বিশেষ করে যোগাযোগ, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে, খোলা থাকতে পারে।’
তবে আখতার উল্লেখ করেন, ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা এবং পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ‘আসল সদস্যপদ গ্রহণ সতর্কতার সঙ্গে হবে।’ এই বিষয়ে এএসপিআই-এর আমের মনে করেন পাকিস্তানের প্রস্তাবটি ‘কৌশলগতভাবে সুসংগত।’ তিনি বলেন, ‘দেশটি এখন কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে আছে। তারা চীনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে নতুন ও উন্নত সম্পর্ক তৈরি করেছে।’
আমেরের মতে, ‘এই দ্বৈত-পথের সম্পৃক্ততা ইসলামাবাদকে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিনেতা হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়েছে। কার্যত, আঞ্চলিক কূটনীতির কেন্দ্রে একটি আসন ফিরে পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
৩ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

রুশদের মতে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেন তাদের শর্তগুলো মানতে চাইছে না, সেটাই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে কিয়েভ এবং তার অধিকাংশ ইউরোপীয় মিত্রদের বক্তব্য, এই যুদ্ধবিরতির চুক্তির পথে প্রধান বাধা হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল মস্কোয় যান। সেখানে পুতিনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়, যা চলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে। এই দলে ছিলেন আমেরিকার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।
পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ এই বৈঠককে ‘খুবই কাজের এবং গঠনমূলক’ বললেও স্বীকার করেন যে, ‘সামনে অনেক পথ বাকি।’ তিনি বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা হলো ‘মূল প্রশ্ন।’ তবে তিনি এটাও মেনে নেন যে, ভূখণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো সমঝোতা হয়নি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা রাশিয়ার অবস্থানকে একেবারেই হাস্যকর মনে করছেন। কারণ, মস্কোই ২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। তাদের ধারণা, ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে লাগাতার বোমা হামলা চলার কারণে পুতিনের আসলে শান্তিতে কোনো প্রকৃত আগ্রহ নেই।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ভিজিটিং ফেলো ও রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলিয়া বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘যেমনটা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, আমেরিকান এবং ক্রেমলিনের মধ্যে যা ঘটছে, তা নিয়ে তাদের ধারণা মূলত আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রস্তাবের মূল ধারণা হিসেবে আমেরিকানরা ভূখণ্ড বিনিময়ের যে চেষ্টা করেছিল, তাতে পুতিনের বিশেষ আগ্রহ নেই। তিনি আসলে পূর্ব ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা কাঠামো পাল্টে দিতে আগ্রহী।’
রাশিয়ার অনেকে ক্রেমলিনের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন এবং অনেকটা একই ভাষায় কথা বলেন। মস্কোভিত্তিক থিংক ট্যাংক ডিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাবের সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্পার্টাক বারানভস্কির মতামত রুশ সরকারের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কিয়েভ সরকারের ক্রমাগত নাশকতা, তথ্য বিকৃত করা এবং অনিবার্যকে বিলম্বিত করার চেষ্টা আলোচনা প্রক্রিয়াকে অনেক জটিল করে তুলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনীয় পক্ষ প্রথমে মিনস্ক চুক্তি কার্যকর করতে রাজি হয়নি এবং পরে ইস্তাম্বুলে আলোচনা হওয়া প্রাথমিক শান্তি চুক্তির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে। এমন এক ভরসা করার অযোগ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে গঠনমূলক আলাপ চালানো সত্যিই কঠিন।’
মিনস্ক চুক্তি ছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সই হওয়া একাধিক চুক্তিমালা, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের দনবাসে চলা যুদ্ধ থামানো, যেখানে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিল। ২০২২ সালের পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে বেলারুশ ও তুরস্কে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই শান্তি আনতে পারেনি।
যদিও মস্কোয় সর্বশেষ বৈঠকে কী আলোচিত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ফাঁস হয়নি, তবু রাশিয়ায় সামান্য হলেও একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের শেষ হয়তো কাছাকাছি। সেন্ট পিটার্সবার্গের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী তাতিয়ানা এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই দোষ দেন। তবে তিনি মনে করেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররাই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে বাধ্য করছেন।
তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে যখন একমাত্র ট্রাম্পকেই কিছুটা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে। যিনি কিনা আবার স্বভাবগতভাবেই সম্পূর্ণ উন্মাদ। তাহলে বুঝুন দুনিয়ার কী হাল হয়েছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি সবার জন্যই আরও খারাপ। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে স্পষ্টতই রাশিয়ার পাল্লা ভারী, যা আমেরিকান জেনারেলরাও ভালোই বোঝেন।’
গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা করেন, রুশ সৈন্যরা অবশেষে পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখল করেছে। এর ফলে দুই বছরের অবরোধের অবসান ঘটেছে। ইউক্রেন শহর পতনের কথা অস্বীকার করলেও, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রুশদের অগ্রযাত্রা থামাতে তাদের সেনারা বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনকে দনবাস অঞ্চলের যেসব অংশ এখনো রাশিয়ার দখলে যায়নি, সেখান থেকে সেনা সরাতে হবে। ওই এলাকা একটি নিরপেক্ষ নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হবে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে তা রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হবে। একই সঙ্গে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকস, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া বা রুশ-সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা ৬ লাখের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
এর বিনিময়ে, রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা আর কোনো ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করবে না এবং এই প্রতিশ্রুতি তাদের আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া, যুদ্ধাপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবও আছে। গত সপ্তাহে পুতিন স্বীকার করেন যে এই পরিকল্পনা ‘ভবিষ্যতের চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।’ তবে তিনি যোগ করেন, ‘যদি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা তাদের দখল করা এলাকাগুলো ছেড়ে যায়, তবে আমরা যুদ্ধ থামাব। যদি না যায়, তবে আমরা সামরিকভাবেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ করব।’
সূত্র মারফত জানা যায়, গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেনীয় মধ্যস্থতাকারীরা তাদের আমেরিকান প্রতিপক্ষকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে—কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী রুশ অর্থনীতিবিদ ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত নয়, বরং তার শর্তগুলো পূরণ হওয়া পর্যন্ত।’
মঙ্গলবার বৈঠকের আগে, পুতিন ইউরোপকে হুমকি দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি সতর্ক করে দেন যে রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে না, ‘তবে ইউরোপ যদি চায় এবং শুরু করে, আমরা এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।’
বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘পুতিন এর জন্যই প্রস্তুতি নেবেন, ঠিক যেমন ২০২২ সালের আগে তিনি বলেছিলেন যে—রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে না, যা বিপরীতটাই ইঙ্গিত করেছিল।’ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকার পরও ইনোজেমতসেভ এবং বারানভস্কি দুজনেই একমত যে রাশিয়া অনির্দিষ্টকাল ধরে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম। ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘এতটা তীব্রতায় বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মোটেও কোনো সমস্যা নয়।’
তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধের শুরুতে যত সমস্যা ছিল, এখন তার চেয়ে কম। কারণ, শুরুতে আমরা দেখেছি তাদের লোক জড়ো করতে হয়েছিল; এখন তারা বেশ ভালো বেতন দেয় এবং (নতুন স্বেচ্ছাসেবকেরা) ক্রমাগত তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া, তাদের অস্ত্রের সমস্যা ছিল এবং ভাষ্যকাররা লিখেছিলেন যে তিন মাসের মধ্যে তাদের শেল ফুরিয়ে যাবে। বাস্তবে, এখন যুদ্ধের আগের চেয়েও বেশি সক্রিয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে।’
ইনোজেমতসেভ মনে করেন, এখন ‘আমেরিকানরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে—হয় এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, না হয় ইউক্রেনের প্রতি সব রকম সমর্থন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই বার্তা এখন কিয়েভকে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। আর তাই, ইউক্রেনীয়দের কোনো না কোনোভাবে রাজি করানো হবে...ইউক্রেনীয়রা জানে যে ইউরোপ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। অর্থাৎ, যদি এখন আমেরিকানরা এই প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে দাঁড়ায়, তবে ইউরোপের কাছে বছরের পর বছর ধরে এই কারণকে সমর্থন করার মতো অর্থ বা সংকল্প কোনোটাই থাকবে না।’
ইনোজেমতসেভ উল্লেখ করেন, একটি চুক্তি হলেও তা ইউক্রেনের স্বার্থে আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর জন্য ৬ লাখ সৈন্য এবং অন্তত কয়েক বছরের জন্য একটি বিরতি নিশ্চিত করতে পারে, তবে বাস্তবে এটিই সমস্যার সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘পুতিন সব সময়ই একটি হুমকি হয়ে থাকবেন এবং তাই পশ্চিমের প্রধান কাজ হলো (৭৩ বছর বয়সী) পুতিনকে উতরে যাওয়া। যদি তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য লড়াইয়ে বিরতি আসে, তবে এটি তার জীবনের শেষের দিকে পৌঁছে যাবে, যা স্বভাবতই তাঁকে কম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।’
এ ছাড়া, যেকোনো সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার রুশ অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে। তবে ইনোজেমতসেভ ও বুদ্রাইৎস্কিস সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জীবন ২০২২ সালের আগের মতো স্বাভাবিক হবে। তাঁদের অনুমান, সমাজ প্রবলভাবে সামরিক এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘শান্তি আসতে পারে না। এমন এক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ফেরা সম্ভব নয় যেখানে পূর্ণাঙ্গ দমনমূলক সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্রের উপযোগী এই সমস্ত ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে, কারণ আমাদের আর কোনো সরাসরি বাহ্যিক হুমকি নেই।’
তাঁর মতে, ‘এটাই রাশিয়ার পুতিন রেজিমের নকশা। তাঁর ক্ষমতা এভাবেই সাজানো হয়েছে যে, এখানে এক অন্তহীন যুদ্ধ চলবে, যেখানে রুশ অভিজাতরা পতাকার নিচে একত্রিত থাকবে, দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলবে...এগুলো কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চালু করা কিছু অসাধারণ ব্যবস্থা নয়, বরং এভাবেই তিনি শাসন চালিয়ে যাবেন।’
তিনি আরও যোগ করেন, ইউক্রেন, ইউরোপ, বাল্টিক রাষ্ট্র বা ‘যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো রূপে যুদ্ধ’ হলো পুতিন ২০২২ সালের পরে রাশিয়ায় যে ‘স্বাভাবিকতা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার অবিচ্ছেদ্য চালিকাশক্তি। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘সুতরাং, এই রেজিম টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলতে থাকবে।’
কিছু রুশ নাগরিক ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতির জন্য নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। মস্কোর গণমাধ্যম সের্গেই কালেনিক বলেন, ‘আমেরিকা যত দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার না করবে, তত দিন যুদ্ধ শেষ হবে না।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

রুশদের মতে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেন তাদের শর্তগুলো মানতে চাইছে না, সেটাই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে কিয়েভ এবং তার অধিকাংশ ইউরোপীয় মিত্রদের বক্তব্য, এই যুদ্ধবিরতির চুক্তির পথে প্রধান বাধা হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল মস্কোয় যান। সেখানে পুতিনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়, যা চলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে। এই দলে ছিলেন আমেরিকার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।
পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ এই বৈঠককে ‘খুবই কাজের এবং গঠনমূলক’ বললেও স্বীকার করেন যে, ‘সামনে অনেক পথ বাকি।’ তিনি বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা হলো ‘মূল প্রশ্ন।’ তবে তিনি এটাও মেনে নেন যে, ভূখণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো সমঝোতা হয়নি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা রাশিয়ার অবস্থানকে একেবারেই হাস্যকর মনে করছেন। কারণ, মস্কোই ২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। তাদের ধারণা, ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে লাগাতার বোমা হামলা চলার কারণে পুতিনের আসলে শান্তিতে কোনো প্রকৃত আগ্রহ নেই।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ভিজিটিং ফেলো ও রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলিয়া বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘যেমনটা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, আমেরিকান এবং ক্রেমলিনের মধ্যে যা ঘটছে, তা নিয়ে তাদের ধারণা মূলত আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রস্তাবের মূল ধারণা হিসেবে আমেরিকানরা ভূখণ্ড বিনিময়ের যে চেষ্টা করেছিল, তাতে পুতিনের বিশেষ আগ্রহ নেই। তিনি আসলে পূর্ব ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা কাঠামো পাল্টে দিতে আগ্রহী।’
রাশিয়ার অনেকে ক্রেমলিনের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন এবং অনেকটা একই ভাষায় কথা বলেন। মস্কোভিত্তিক থিংক ট্যাংক ডিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাবের সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্পার্টাক বারানভস্কির মতামত রুশ সরকারের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কিয়েভ সরকারের ক্রমাগত নাশকতা, তথ্য বিকৃত করা এবং অনিবার্যকে বিলম্বিত করার চেষ্টা আলোচনা প্রক্রিয়াকে অনেক জটিল করে তুলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনীয় পক্ষ প্রথমে মিনস্ক চুক্তি কার্যকর করতে রাজি হয়নি এবং পরে ইস্তাম্বুলে আলোচনা হওয়া প্রাথমিক শান্তি চুক্তির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে। এমন এক ভরসা করার অযোগ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে গঠনমূলক আলাপ চালানো সত্যিই কঠিন।’
মিনস্ক চুক্তি ছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সই হওয়া একাধিক চুক্তিমালা, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের দনবাসে চলা যুদ্ধ থামানো, যেখানে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিল। ২০২২ সালের পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে বেলারুশ ও তুরস্কে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই শান্তি আনতে পারেনি।
যদিও মস্কোয় সর্বশেষ বৈঠকে কী আলোচিত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ফাঁস হয়নি, তবু রাশিয়ায় সামান্য হলেও একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের শেষ হয়তো কাছাকাছি। সেন্ট পিটার্সবার্গের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী তাতিয়ানা এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই দোষ দেন। তবে তিনি মনে করেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররাই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে বাধ্য করছেন।
তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে যখন একমাত্র ট্রাম্পকেই কিছুটা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে। যিনি কিনা আবার স্বভাবগতভাবেই সম্পূর্ণ উন্মাদ। তাহলে বুঝুন দুনিয়ার কী হাল হয়েছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি সবার জন্যই আরও খারাপ। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে স্পষ্টতই রাশিয়ার পাল্লা ভারী, যা আমেরিকান জেনারেলরাও ভালোই বোঝেন।’
গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা করেন, রুশ সৈন্যরা অবশেষে পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখল করেছে। এর ফলে দুই বছরের অবরোধের অবসান ঘটেছে। ইউক্রেন শহর পতনের কথা অস্বীকার করলেও, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রুশদের অগ্রযাত্রা থামাতে তাদের সেনারা বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনকে দনবাস অঞ্চলের যেসব অংশ এখনো রাশিয়ার দখলে যায়নি, সেখান থেকে সেনা সরাতে হবে। ওই এলাকা একটি নিরপেক্ষ নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হবে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে তা রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হবে। একই সঙ্গে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকস, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া বা রুশ-সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা ৬ লাখের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
এর বিনিময়ে, রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা আর কোনো ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করবে না এবং এই প্রতিশ্রুতি তাদের আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া, যুদ্ধাপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবও আছে। গত সপ্তাহে পুতিন স্বীকার করেন যে এই পরিকল্পনা ‘ভবিষ্যতের চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।’ তবে তিনি যোগ করেন, ‘যদি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা তাদের দখল করা এলাকাগুলো ছেড়ে যায়, তবে আমরা যুদ্ধ থামাব। যদি না যায়, তবে আমরা সামরিকভাবেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ করব।’
সূত্র মারফত জানা যায়, গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেনীয় মধ্যস্থতাকারীরা তাদের আমেরিকান প্রতিপক্ষকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে—কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী রুশ অর্থনীতিবিদ ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত নয়, বরং তার শর্তগুলো পূরণ হওয়া পর্যন্ত।’
মঙ্গলবার বৈঠকের আগে, পুতিন ইউরোপকে হুমকি দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি সতর্ক করে দেন যে রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে না, ‘তবে ইউরোপ যদি চায় এবং শুরু করে, আমরা এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।’
বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘পুতিন এর জন্যই প্রস্তুতি নেবেন, ঠিক যেমন ২০২২ সালের আগে তিনি বলেছিলেন যে—রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে না, যা বিপরীতটাই ইঙ্গিত করেছিল।’ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকার পরও ইনোজেমতসেভ এবং বারানভস্কি দুজনেই একমত যে রাশিয়া অনির্দিষ্টকাল ধরে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম। ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘এতটা তীব্রতায় বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মোটেও কোনো সমস্যা নয়।’
তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধের শুরুতে যত সমস্যা ছিল, এখন তার চেয়ে কম। কারণ, শুরুতে আমরা দেখেছি তাদের লোক জড়ো করতে হয়েছিল; এখন তারা বেশ ভালো বেতন দেয় এবং (নতুন স্বেচ্ছাসেবকেরা) ক্রমাগত তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া, তাদের অস্ত্রের সমস্যা ছিল এবং ভাষ্যকাররা লিখেছিলেন যে তিন মাসের মধ্যে তাদের শেল ফুরিয়ে যাবে। বাস্তবে, এখন যুদ্ধের আগের চেয়েও বেশি সক্রিয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে।’
ইনোজেমতসেভ মনে করেন, এখন ‘আমেরিকানরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে—হয় এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, না হয় ইউক্রেনের প্রতি সব রকম সমর্থন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই বার্তা এখন কিয়েভকে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। আর তাই, ইউক্রেনীয়দের কোনো না কোনোভাবে রাজি করানো হবে...ইউক্রেনীয়রা জানে যে ইউরোপ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। অর্থাৎ, যদি এখন আমেরিকানরা এই প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে দাঁড়ায়, তবে ইউরোপের কাছে বছরের পর বছর ধরে এই কারণকে সমর্থন করার মতো অর্থ বা সংকল্প কোনোটাই থাকবে না।’
ইনোজেমতসেভ উল্লেখ করেন, একটি চুক্তি হলেও তা ইউক্রেনের স্বার্থে আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর জন্য ৬ লাখ সৈন্য এবং অন্তত কয়েক বছরের জন্য একটি বিরতি নিশ্চিত করতে পারে, তবে বাস্তবে এটিই সমস্যার সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘পুতিন সব সময়ই একটি হুমকি হয়ে থাকবেন এবং তাই পশ্চিমের প্রধান কাজ হলো (৭৩ বছর বয়সী) পুতিনকে উতরে যাওয়া। যদি তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য লড়াইয়ে বিরতি আসে, তবে এটি তার জীবনের শেষের দিকে পৌঁছে যাবে, যা স্বভাবতই তাঁকে কম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।’
এ ছাড়া, যেকোনো সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার রুশ অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে। তবে ইনোজেমতসেভ ও বুদ্রাইৎস্কিস সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জীবন ২০২২ সালের আগের মতো স্বাভাবিক হবে। তাঁদের অনুমান, সমাজ প্রবলভাবে সামরিক এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘শান্তি আসতে পারে না। এমন এক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ফেরা সম্ভব নয় যেখানে পূর্ণাঙ্গ দমনমূলক সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্রের উপযোগী এই সমস্ত ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে, কারণ আমাদের আর কোনো সরাসরি বাহ্যিক হুমকি নেই।’
তাঁর মতে, ‘এটাই রাশিয়ার পুতিন রেজিমের নকশা। তাঁর ক্ষমতা এভাবেই সাজানো হয়েছে যে, এখানে এক অন্তহীন যুদ্ধ চলবে, যেখানে রুশ অভিজাতরা পতাকার নিচে একত্রিত থাকবে, দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলবে...এগুলো কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চালু করা কিছু অসাধারণ ব্যবস্থা নয়, বরং এভাবেই তিনি শাসন চালিয়ে যাবেন।’
তিনি আরও যোগ করেন, ইউক্রেন, ইউরোপ, বাল্টিক রাষ্ট্র বা ‘যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো রূপে যুদ্ধ’ হলো পুতিন ২০২২ সালের পরে রাশিয়ায় যে ‘স্বাভাবিকতা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার অবিচ্ছেদ্য চালিকাশক্তি। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘সুতরাং, এই রেজিম টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলতে থাকবে।’
কিছু রুশ নাগরিক ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতির জন্য নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। মস্কোর গণমাধ্যম সের্গেই কালেনিক বলেন, ‘আমেরিকা যত দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার না করবে, তত দিন যুদ্ধ শেষ হবে না।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার
২ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।
প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।
পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।
পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।
কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।
দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।
শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।
কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।
উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।
ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।
রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।
দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।
দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।
জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।
রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।
প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।
পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।
পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।
কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।
দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।
শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।
কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।
উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।
ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।
রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।
দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।
দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।
জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।
রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার
২ ঘণ্টা আগে
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
৩ ঘণ্টা আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।
উদ্ভাবন কি থেমে যাবে
অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।
যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।
বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে
ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে
গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।
চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব
বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
আল-জাজিরা অবলম্বনে

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।
উদ্ভাবন কি থেমে যাবে
অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।
যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।
বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে
ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে
গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।
চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব
বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
আল-জাজিরা অবলম্বনে

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তা অন্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরেও ‘বিস্তৃত’ হতে পারে। তিনি গত বুধবার ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে বলেন, ‘আমরা শূন্য-সমষ্টিগত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছি এবং সংঘাতের বদলে সহযোগিতার
২ ঘণ্টা আগে
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
৩ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে