Ajker Patrika

আল জাজিরার প্রতিবেদন /বিহার নির্বাচন: ফের ‘বাংলাদেশি রাক্ষস’ ও ‘মুসলমান’ জিগির তুলেছে মোদির বিজেপি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বিজেপির বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী—অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত অবস্থায় মুখতার আলম। ছবি: আল–জাজিরা
বিজেপির বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী—অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত অবস্থায় মুখতার আলম। ছবি: আল–জাজিরা

এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।

কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।

বিহারের মুসলিমেরা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তকমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন। তবে তাদের শঙ্কা এখনো দূরীভূত হয়নি। ছবি: আল–জাজিরা
বিহারের মুসলিমেরা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ তকমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন। তবে তাদের শঙ্কা এখনো দূরীভূত হয়নি। ছবি: আল–জাজিরা

শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।

বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।

মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’

মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’

বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।

শেরশাহাবাদী মুসলিম নারীরা হাতে বিড়ি তৈরি করছেন। ছবি: আল–জাজিরা।
শেরশাহাবাদী মুসলিম নারীরা হাতে বিড়ি তৈরি করছেন। ছবি: আল–জাজিরা।

ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।

শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন

গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’

তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।

আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।

আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।

গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’

এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’

ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।

চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।

তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।

সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’

এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।

গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।

আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’

মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’

দশক পুরোনো প্রচারণা

ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।

আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।

আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।

সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’

কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।

সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।

২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’

কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’

স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন

ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।

নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।

এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’

কাটিহার জেলায় নদী পারাপার হচ্ছেন স্থানীয়রা। ভারতের অন্যতম দরিদ্র্য রাজ্য বিহারের অনুন্নত জেলাগুলোর একটি এই কাটিহার। ছবি: আল–জাজিরা
কাটিহার জেলায় নদী পারাপার হচ্ছেন স্থানীয়রা। ভারতের অন্যতম দরিদ্র্য রাজ্য বিহারের অনুন্নত জেলাগুলোর একটি এই কাটিহার। ছবি: আল–জাজিরা

গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।

রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।

কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’

স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’

উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার

শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’

তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’

একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’

তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’

তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’

কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’

এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’

আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত