আজকের পত্রিকা ডেস্ক

এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।

শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।
বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।
মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’
মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’
বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।

ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।
শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।
আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।
গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’
ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।
তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।
সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’
এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।
গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’
দশক পুরোনো প্রচারণা
ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।
আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।
আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।
সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’
কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।
সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।
২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’
স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।
নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।
এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’

গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।
রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।
কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’
স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’
উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার
শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’
তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’
তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’
তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’
কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’
এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’
আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।

শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।
বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।
মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’
মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’
বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।

ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।
শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।
আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।
গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’
ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।
তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।
সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’
এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।
গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’
দশক পুরোনো প্রচারণা
ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।
আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।
আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।
সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’
কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।
সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।
২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’
স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।
নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।
এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’

গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।
রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।
কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’
স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’
উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার
শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’
তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’
তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’
তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’
কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’
এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’
আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।

শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।
বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।
মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’
মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’
বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।

ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।
শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।
আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।
গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’
ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।
তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।
সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’
এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।
গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’
দশক পুরোনো প্রচারণা
ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।
আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।
আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।
সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’
কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।
সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।
২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’
স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।
নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।
এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’

গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।
রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।
কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’
স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’
উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার
শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’
তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’
তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’
তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’
কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’
এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’
আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।

শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।
বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।
মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’
মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’
বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।

ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।
শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।
আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।
গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’
ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।
তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।
সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’
এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।
গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’
দশক পুরোনো প্রচারণা
ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।
আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।
আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।
সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’
কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।
সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।
২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’
স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।
নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।
এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’

গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।
রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।
কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’
স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’
উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার
শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’
তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’
তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’
তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’
কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’
এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’
আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

গত ২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্য দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
২ দিন আগে
মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
২ দিন আগে
নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছন
২ দিন আগে
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।
সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।
২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।
ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।
হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।
এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।
সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।
ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।
তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।
সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।
পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।
সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।
২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।
ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।
হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।
এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।
সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।
ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।
তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।
সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।
পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না।
০৮ অক্টোবর ২০২৫
মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
২ দিন আগে
নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছন
২ দিন আগে
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলামিক স্টেট কী
ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।
পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়
মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল
আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।
আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা
কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলামিক স্টেট কী
ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।
পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়
মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল
আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।
আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা
কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না।
০৮ অক্টোবর ২০২৫
গত ২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্য দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
২ দিন আগে
নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছন
২ দিন আগে
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।
ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’
গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।
কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।
তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে
নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।
নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান
ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।
এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।
নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।
এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’
এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।
ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’
গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।
কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।
তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে
নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।
নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান
ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।
এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।
নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।
এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’
এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না।
০৮ অক্টোবর ২০২৫
গত ২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্য দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
২ দিন আগে
মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
২ দিন আগে
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৭ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না।
০৮ অক্টোবর ২০২৫
গত ২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্য দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
২ দিন আগে
মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।
২ দিন আগে
নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছন
২ দিন আগে