Ajker Patrika

বিদায়ী বছরে যেমন ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি

ফয়সাল হাসান, ঢাকা
আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৭: ৫১
বিদায়ী বছরে যেমন ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে পররাষ্ট্রনীতির চিরায়ত অবস্থান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপ একরকম বিস্ময়ই ছিল অনেকের কাছে। তবে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন জো বাইডেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তাঁর স্থির অবস্থান একদিকে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতে বাইডেনের নীতি কতটা সফল হবে, তা নিয়ে রয়ে গেছে অনিশ্চয়তা। সবকিছু ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল বাইডেনের প্রথম মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নানান দিক।

ওয়াশিংটন কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বা যোগাযোগ রক্ষা করবে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি এবং মার্কিন স্বার্থ বজায় রেখে বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিস্তৃত পরিকল্পনা নিয়ে গত জানুয়ারির ২০ তারিখে দেশ পরিচালনা শুরু করেন বাইডেন।

২০২১ সাল শেষ হওয়ার আগে প্রকৃতপক্ষেই মূল মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় নিজ অবস্থান দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার রক্ষায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার সম্মুখীনও হয়েছেন বাইডেন, যেখানে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শগত পার্থক্য। তবে এমন এক সময়ে এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যখন বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণবিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিজে ক্রাউলি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২০২১ ছিল রূপান্তরের একটি বছর। ট্রাম্পের উদাসীনতাকে বাস্তববাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এটি একদিকে যেমন বড় কৃতিত্ব, তেমনি ২০২২ সালের জন্য একটি বড় পরীক্ষাও বটে। কারণ, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরোনো ধারা ফিরিয়ে আনার পর বাইডেন এর অর্থপূর্ণ ফলাফল বয়ে আনতে পারবেন কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।’

বাইডেন প্রশাসনের ডাকা গণতন্ত্র সম্মেলনের অতিথি তালিকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বিস্তরসম্পর্কের টানাপোড়েন
ক্ষমতায় বসার পরপরই বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা ও মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে জোর দিয়েছিলেন বাইডেন। হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করে প্রথম দিনই পুনরায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন জো বাইডেন। এর আগে যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২০ সালে প্যারিস চুক্তি ও ডব্লিউএইচও থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ট্রাম্প।

এ ছাড়া ন্যাটো মিত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা, উত্তর আমেরিকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং করোনা মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ওয়াশিংটন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ‘নিরলস মার্কিন কূটনীতির’ নতুন এক যুগের সূচনার কথাও বলেন বাইডেন।

বছরের শেষ দিকে এসে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’-এর আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র, যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি আদায় করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সম্মেলনের অতিথি তালিকা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন বাইডেন।

দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্ররা বিশ্বমঞ্চে বাইডেনের ‘অনুমানযোগ্য’ পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও, ক্ষমতার প্রথম বছরে বিতর্ক বা সমালোচনা এড়াতে পারেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আকস্মিক ঘোষণায় কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ওয়াশিংটনের বিশ্বাসযোগ্যতা। এ ছাড়া সম্প্রতি ইউক্রেন-রুশ সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বাইডেন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার আলোচনা ক্ষুব্ধ করেছে ন্যাটো সদস্যদের। ত্রিদেশীয় ‘অকাস’ প্রতিরক্ষা চুক্তি করেও পুরোনো মিত্র ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় ওয়াশিংটনের।

গত নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন জো বাইডেন‘মাথাব্যথা’ যখন চীন
প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর গত নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ভার্চুয়ালি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন জো বাইডেন। নানা ইস্যুতে দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাকে শীতল করার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হয় এই সম্মেলনকে। যদিও ২০১৮ সাল থেকে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত ওয়াশিংটন ও বেইজিং, যা বাইডেনের শাসনামলেও অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া চীনা প্রভাব মোকাবিলায় ইউরোপীয় ও এশীয় মিত্রদের একত্রিত করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন।

পররাষ্ট্রনীতিতে বেইজিংকে শীর্ষ অগ্রাধিকারমূলক অবস্থানে রাখার বিষয়টি এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে বাইডেন প্রশাসন। গত মার্চে এক সভায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী একমাত্র দেশ হিসেবে চীনের নাম উল্লেখ করেছেন, যারা স্থিতিশীল ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা রাখে। 

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার পরাশক্তি চীনের সঙ্গে ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে বিভিন্ন পক্ষ ইঙ্গিত দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বাইডেন। যদিও নিয়মিতভাবেই এশিয়া অঞ্চলে চীনের ‘জবরদস্তিমূলক এবং ‘দৃঢ় পদক্ষেপের’ বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান, হংকং ও জিনজিয়াং প্রদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে তাইওয়ান ইস্যুতেই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। এই ইস্যুতে ‘কৌশলগত অস্পষ্টতার’ নীতি থেকে সরে এসে সরাসরি তাইওয়ানের পক্ষ নিতেও দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। যদিও সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনার পর সেই অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটেছেন বাইডেন। 

চলতি বছরের ১৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালেবান যোদ্ধারাআফগানিস্তানে ‘কৌশলগত ব্যর্থতা’
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মে মাসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। কিন্তু ওই চুক্তিতে মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য সে সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ট্রাম্প। কারণ, এর মাধ্যমেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পথ অনেকটা সুগম হয় তালেবানের জন্য।

এরপর ক্ষমতায় এসে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা পিছিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়ে যান বাইডেন। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের করা চুক্তিতেই অনড় থাকেন তিনি। আর এর মধ্যেই চলতি বছরের ১৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালেবান যোদ্ধারা। এর পরের পরিস্থিতি কারও অজানা নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে নেমে এসেছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়। অনেকে বলে থাকেন, বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে দেশটি। ফলে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ধীরে ধীরে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পরিবর্তে তাড়াহুড়া করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে আফগানিস্তানকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়ার দায় অনেকটাই বর্তেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর। যদিও তা মানতে নারাজ ওয়াশিংটন। তাদের দাবি, মার্কিন সেনাদের জীবন বাঁচাতেই নেওয়া হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত।

এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ওয়াশিংটন। তবে কাতারকে দেশটিতে কূটনৈতিক দূত হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকেও মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা। আফগানিস্তানের ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট বিবেচনায় সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন জাতিসংঘ এবং বেসরকারি কিছু সংস্থার মাধ্যমে দেশটিতে সাহায্যের অর্থ পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আটকে রাখা সম্পদ ছাড়ের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্ব
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অধীনে শুরু হওয়া এবং ট্রাম্পের অধীনে অব্যাহত থাকা মধ্যপ্রাচ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার নীতিতেই অটল আছে বাইডেন প্রশাসন। গত ৯ ডিসেম্বর ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। যদিও এই অঞ্চলের শীর্ষ এক মার্কিন কমান্ডার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) জানিয়েছেন, ইরাকে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা মূলত ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে ‘উপদেষ্টা এবং সহায়তার’ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে, যা অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। একই সঙ্গে খুব শিগগিরই প্রত্যাহার করা হচ্ছে না সিরিয়ায় অবশিষ্ট থাকা প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনাকে।

এদিকে, গত নভেম্বরে প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ইসরায়েলের সঙ্গে লোহিত সাগরে এক যৌথ নৌ মহড়ার আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে শক্তিশালী অবস্থান না নেওয়ার জন্য সমালোচিতও হয়েছেন। একই সময়ে নতুন মার্কিন প্রশাসন ট্রাম্পের অধীনে ইসরায়েলের প্রতি ‘অনুমতিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে সরে আসারও ইঙ্গিত দিয়েছে।

আইনজীবীরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন কোনো অঙ্গীকার করেনি যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরও তাঁর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। যদিও ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের আক্রমণাত্মক অভিযানকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। আর মিসরের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য মার্কিন সুরক্ষা সহায়তার অংশ হিসেবে বড় তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে।

ইরানের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলে ‘বিকল্প’ ভাবার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনইরান পরমাণু চুক্তি: সমঝোতা অথবা নিষেধাজ্ঞা
গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত ইরান পরমাণু চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টায় আলোচনা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর কয়েকটি রাষ্ট্র। এ আলোচনা সফল হলে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি কমাতে হবে তেহরানকে। তবে আলোচনা ব্যর্থ হলে ‘বিকল্প’ ভাবার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। 

পরমাণু অস্ত্র না বাড়ানোর শর্তে ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে চুক্তিটি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি। কিন্তু ওবামার আমলে সম্পাদিত ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে তেহরানের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ট্রাম্প। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ই পরমাণু চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী হলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সময়সীমা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে দুই দেশের মধ্যে। ইরানে গত আগস্টের নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ নীতি মেনে চলার আশা ছিল বাইডেনেররাশিয়ায় ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’
ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ নীতি মেনে চলার আশা ছিল বাইডেনের। অগ্রগতিও হয়েছিল বেশ কিছুটা। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ভেস্তে গেছে।

গত ৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল এক বৈঠকে ইউক্রেনে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে রাশিয়াকে ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বাইডেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেনে হামলা চালালে রাশিয়াকে এমন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে, যা তিনি (পুতিন) আগে কখনো দেখেননি।’

তবে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার আইনগত ভিত্তি নেই উল্লেখ করে বাইডেন জানিয়েছেন, রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য এখনই একতরফাভাবে শক্তি ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।

এদিকে বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ‘কৌশলগত স্থিতিশীলতা’ বজায় রেখে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। আর আগামী জানুয়ারিতে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।

আফ্রিকায় সতর্ক পদক্ষেপ
এখন পর্যন্ত আফ্রিকার প্রতি বাইডেন প্রশাসনের কূটনীতি মূলত ইথিওপিয়ায় চলমান সংঘাত এবং সুদানের সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থান পরিস্থিতি শান্ত করা নিয়েই আবর্তিত। পাশাপাশি ট্রাম্পের অধীনে চালু হওয়া একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগকেও সমর্থন জানাচ্ছেন বাইডেন।

গত নভেম্বরে আফ্রিকায় নিজের প্রথম সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ওই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের নীতির একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন তুলে ধরেন, যেখানে মহাদেশটিকে শুধু চীনা প্রভাব মোকাবিলার ক্ষেত্র হিসেবে নয়, আখ্যায়িত করা হয়েছে একটি ‘প্রধান ভূ-রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবেও। পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য আফ্রিকান নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনেরও প্রস্তুতি নিয়েছেন বাইডেন। যদিও এর দিনক্ষণ এখনো ঠিক করা হয়নি।

অভিবাসন নীতিতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
ট্রাম্পের কট্টর নীতির পরিবর্তে আরও ‘মানবিক’ অভিবাসন নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে তিনটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। সম্প্রতি শরণার্থী সংকটের ‘মূল কারণ’ খুঁজে বের করতে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। আর এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

তবে অভিবাসন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা এবং মেক্সিকো সীমান্ত আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের বিষয়ে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত বাইডেনের প্রতিশ্রুতির (অভিবাসন ব্যবস্থা সংস্কার) সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য করোনা মহামারির মধ্যেও বিতর্কিত ‘টাইটেল ৪২’ আইন অনুসরণ করেছে বাইডেন প্রশাসন।

সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

‘প্রশ্ন ফাঁসের’ অভিযোগ ওঠার পর প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

‘প্রশ্ন ফাঁসের’ অভিযোগ ওঠার পর প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

‘প্রশ্ন ফাঁসের’ অভিযোগ ওঠার পর প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

‘প্রশ্ন ফাঁসের’ অভিযোগ ওঠার পর প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

‘প্রশ্ন ফাঁসের’ অভিযোগ ওঠার পর প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত