Ajker Patrika

আমি খুব কম মানুষের মৃত্যুতে কেঁদেছি

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১৬: ০৪
আমি খুব কম মানুষের মৃত্যুতে কেঁদেছি

কেন জানি না, গত বছর পূজায় গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী ও পুরুষদের ছবি তুলে রেখেছিলাম। এর মধ্যে একজন গোলেনুর বেগম। যাঁদের ছবি তুলেছিলাম, তাঁদের মধ্যে দুজন গত পূজার তিন মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃতদের একজনও গোলেনুর। 

গল্পটা মৃত্যুর নয়। গল্পটা জীবনের। গত ৩৩ বছরের এক অবিচ্ছেদ্য গল্প। গত তিন দশকের বেশি সময় আমাদের বাড়িতে যত বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে, যতবার পূজা হয়েছে, যতবার কেউ মারা গেছেন, যতবার কেউ জন্মেছে, ততবারই গোলেনুর উপস্থিত ছিলেন পরিবারের সদস্যের মতো। তিনি কেঁদেছেন, হেসেছেন, খেয়েছেন এবং আশীর্বাদ করেছেন। কিন্তু এবার আসেননি। গোলেনুর মারা গেছেন। 

গোলেনুর একজন অতিসাধারণ নারীর নাম, যার কথা তাঁর পরিবারের মানুষেরাই মনে রাখেননি। ১৯৮৮ সালের বন্যায় বাড়িঘর সব হারিয়ে উলিপুর থেকে গোলেনুর কীভাবে যেন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সপরিবারে। সেই থেকে শুরু। তিনি আমাদের প্রায় সব ভাইবোনকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। আমার প্র্যাকটিসিং বৈষ্ণব ঠাকুরদার জন্য সকালের খাবার বানাতেন। আমার বোনদের বিয়ের বিদায়ে তিনি হাপুস নয়নে কেঁদেছেন। তাদের সন্তান জন্মের খবরে মিষ্টিতে ভাগ বসিয়েছেন। 

গোলেনুরের কথা আজ কেন? 
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রোজা রাখা এবং বোরকা পরা গোলেনুর গত ৩৩ বছর আমাদের সঙ্গে থেকেছেন। তাতে তাঁর কিংবা আমাদের ধর্মে বাধেনি। আজ যখন ধর্ম নিয়ে বেশ পরীক্ষা দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে, তখন মনে পড়ে গেল, গোলেনুর এবার পূজায় অনুপস্থিত ছিলেন তাঁর মৃত্যুজনিত কারণে। 

গোলেনুরকে আমরা বেটি বলে ডাকতাম। বেটি মানে উত্তরবঙ্গে বিশেষত রংপুরে ফুফু; অর্থাৎ, পিসিমা মানে বাবার বোন। গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনো এ সম্পর্কে আবদ্ধ। গোলেনুর বেগম আমার ঠাকুরদাকে ধর্ম বাবা বানিয়েছিলেন। সেই সূত্রে তিনি আমার বাবা-কাকার বোন আর আমাদের বেটি বা পিসিমা কিংবা ফুফু। 

এর বেশি কিছু আমাদের জানা ছিল না, গোলেনুরও জানতেন না সম্ভবত। সে জন্য পূজার মতো ঈদে আমাদের বাড়িতে আসত সেমাই, চিনি আর দুধ। কোরবানির ঈদে আসত খাসির মাংস। 

সবকিছু এখন অতীত। ধূসর অতীত। তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষ গোলেনুর বেগম এবার পূজায় আসেননি। আসবেন না কোনো দিন। শুধু যখন সংকট আসবে, যখন আমাদের সবাইকে ধর্মের পরীক্ষা দিতে হবে, তখন গোলেনুর বেগমকে আমার মনে পড়বে। 

না, উলিপুরের কোনো এক গ্রামের লেখাপড়া না জানা এক অতি তুচ্ছ নারী গোলেনুর বেগম আমাদের অসাম্প্রদায়িক হওয়া শেখাননি। শিখিয়েছিলেন জীবনযাপন। যে জীবনে ধর্ম ছিল, প্রাণ ছিল, মানুষ ছিল। গোলেনুর বেগমের কাছে এই জীবনযাপনের শিক্ষা পেয়েছিলাম বলেই হয়তো তাঁর মৃত্যুসংবাদে ‘পরাণের গহীন ভিতর’ থেকে উঠে এসেছিল কান্না। আমি খুব কম মানুষের মৃত্যুতে কেঁদেছি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বধ্যভূমি ৭১

সম্পাদকীয়
বধ্যভূমি ৭১

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ সড়কে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স-সংলগ্ন ভুরভুরিয়াছড়ার পাশেই বধ্যভূমি ৭১ পার্ক অবস্থিত। সেখানে প্রাচীন একটি বটগাছ রয়েছে, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে। পাকিস্তান আমলে গাছটির নিচে ছিল এক সাধুর আস্তানা। চা-শ্রমিক ও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে এসে পূজা দিত, মনোবাসনা পূরণে মানত করত। সবাই জায়গাটিকে চিনত ‘সাধু বাবার থলি’ নামে। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। হত্যার আগে বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে তাঁদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজন ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষও বাদ যাননি। গাছের ডালে উল্টো করে বেঁধে রাখা হতো তাঁদের। নির্যাতনের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে তাঁরা শহীদ হন। সেই সব শহীদের ত্যাগকে অমর করে রাখতে এখানে নির্মিত হয় ‘বধ্যভূমি ৭১’ নামের স্মৃতিস্তম্ভটি। একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিটিতে আরও রয়েছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১’ নামে একটি ভাস্কর্য।

ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রহনপুর গণকবর

সম্পাদকীয়
রহনপুর গণকবর

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশনের কাছেই রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সহযোগীদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রহনপুর ও আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক সাধারণ বাঙালিকে এই বধ্যভূমিতে বিভিন্ন সময় ধরে এনে হত্যা করে। শহীদদের সংখ্যাটা প্রায় ১০ হাজার! রহনপুর সরকারি এ বি উচ্চবিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। এখানেও শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমির যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই শহীদদের সম্মানে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এই বধ্যভূমিটি রহনপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর নামে পরিচিত।

ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে শাহাদুজ্জামান

সম্পাদকীয়
ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে শাহাদুজ্জামান

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। হাসান আজিজুল হকের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন তুমুল আড্ডাবাজ মানুষ। আর তাঁর সঙ্গে জগৎ সংসারের যেকোনো বিষয়ে আলাপ করা যেত। এমন কোনো বিষয় নেই যাতে তাঁর আগ্রহ নেই। তাঁর সাক্ষাৎকারে এমন কিছু প্রসঙ্গে আলাপ করেছি, যা হয়তো অত স্বচ্ছন্দে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে করতে পারতাম না। যেমন ধরেন যৌনতা-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো। তবে আড্ডাবাজ ব্যক্তিত্বের জন্যও তাঁর সাক্ষাৎকারটি হয়েছে অনেক প্রাণবন্ত। তাঁকে তো বাম ঘরানার লেখকই ধরা হয়, মার্ক্সবাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবে তিনি কিন্তু গোঁড়া মার্ক্সবাদী ছিলেন না।

আমি এ ব্যাপারটিও তাঁর সঙ্গে খোলাসা করার জন্য আলাপ করেছি। সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজমের নামে একসময় একধরনের যান্ত্রিক মার্ক্সবাদ চর্চা হয়েছে সাহিত্যে। তিনি এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এ সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, এ দেশের মার্ক্সবাদীদের অনেক জ্ঞান থাকলেও কাণ্ডজ্ঞান নেই। তিনি তাঁর লেখায় জীবনকে একেবারে ভেতর থেকে ধরার চেষ্টা করেছেন। অহেতুক শ্রমিকশ্রেণির জয়গান গাননি, লাল পতাকা ওঠাননি। আমার সাক্ষাৎকারে সেক্সের সঙ্গে ক্লাস পজিশনের সম্পর্ক নিয়ে কথা আছে। তিনি এও বলছেন, তাঁর চিলেকোঠার সেপাইয়ের রিকশাশ্রমিক হাড্ডি খিজির যে চরিত্র, তাকে তিনি মহান করে দেখাননি, শুধু শ্রমিকশ্রেণির বিজয়গাথা তিনি দেখাননি।

বরং হাড্ডি খিজির যে একটি লুম্পেন চরিত্র, তার ভেতর যে নানা জোচ্চুরি আছে, সেটাকেও দেখিয়েছেন। এই যে মানুষকে টোটালিটিতে দেখতে এবং দেখাতে পারা, এটাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শক্তি।

তো এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা হতো তাঁর সঙ্গে, সেটাকেই আমি সাক্ষাৎকারে ধরতে চেষ্টা করেছি।

সূত্র: মঞ্জুরুল আজিম পলাশ কর্তৃক কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ‘দূরগামী কথার ভেতর’, পৃষ্ঠা: ২৭-২৮।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি

১৯৭১ সালে পুরো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু রাজধানীর মিরপুর তখনো শত্রুদের দখলে। পরের বছর জানুয়ারিতে শত্রুমুক্ত হলে একে একে সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে বধ্যভূমিগুলোর। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি মিরপুর অঞ্চলে। আর মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাশ পাওয়া যায় শিয়ালবাড়ি এলাকায়। মিরপুরের প্রশিকা ভবন থেকে কমার্স কলেজের দিকে যেতে একটি কালভার্ট ছিল। এখন যদিও রাস্তার মাঝে ঢাকা পড়েছে। সেখানেই ৬০টি বস্তায় প্রায় ৩৫০টি মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। সৈয়দ আলী জামে মসজিদের পাশের কুয়ায় পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য লাশ। ৬ নম্বর লেনের শেষ প্রান্তের মাঠে স্তূপাকারে পড়ে থাকা দুই শতাধিক লাশ শিয়ালবাড়ি গণকবরে কবর দেওয়া হয়। এটি ছিল ১০ কাঠা জমির ওপর। বেশির ভাগই দখল হয়ে গেছে। যেটুকু অংশ বাকি আছে, তা বর্তমানে মাতবরবাড়ি পারিবারিক কবরস্থান। শিয়ালবাড়ির যেসব কুয়ায় শহীদদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে এখন বহুতল ভবন, কারখানা, শপিং মল।

তথ্য ও ছবি: মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি, মিরাজ মিজু

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত