Ajker Patrika

‘আমার হাতটা ধর তাহলে...’

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২২, ২১: ০৮
‘আমার হাতটা ধর তাহলে...’

গতকাল অভয় দিয়ে বলেছিলেন, জন্মদিনের সকালে তাঁর বাড়িতে যাওয়া যাবে। দরজার বাইরে থেকে তাঁকে দেখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো যাবে। তাতেই আমি অনেকক্ষণ উড়ছিলাম কল্পনার আকাশে।

আজ, ৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টার আগেই পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়িতে। আজ তাঁর ৯০তম জন্মদিন। ৮৯তম জন্মবার্ষিকী।

করোনা তার হাত প্রসারিত করছিল যখন, তখন থেকেই সন্‌জীদা খাতুনের বাড়িতে যাওয়া নিষেধ হয়ে গিয়েছিল সবার জন্য। সে সময় মাঝে মাঝেই তিনি ফোন করতেন আমাকে। ২০২০ সালে করোনার বিভীষিকার মধ্যে নববর্ষের অনুষ্ঠান কীভাবে করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এতগুলো মানুষকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর মত ছিল না। যখন কথাগুলো বলছিলেন আমাকে, বোঝা যাচ্ছিল, তিনি চাইছেন তাঁর এই ভাবনাকে যেন আমি সমর্থন করি। আমিও নির্দ্বিধায় বলেছি, যেভাবে রোগটা ছড়াচ্ছে তাতে এত দিন একসঙ্গে এত মানুষের রিহার্সাল করা ঠিক হবে না। সেবার রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান হয়নি। ভার্চুয়ালি হয়েছিল।

তখন সারা বিশ্বেই কেমন সময় আমরা সবাই মিলে কাটিয়েছি, সেটা কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। প্রত্যেকেই ভুক্তভোগী। কাউকে বলে দিতে হবে না, তখন থেকে একের পর এক মানুষ মুড়ি-মুড়কির মতো মারা যেতে থাকলেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মৃত্যুতালিকায় যোগ হতে থাকলেন কাছের মানুষেরা। মনে হচ্ছিল, এভাবেই ভয়াল রোগটা তার থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে সবাইকে গ্রাস করবে বলে। কেউ একজন মারা গেছেন, সে কথা জানাতে ফোন করেছি যাঁকে, তিনিও তার কিছুদিন পর এই একই অতিমারিতে ভুগে মারা গেছেন। 

তখন মাঝে মাঝেই কথা বলতেন তিনি। এক একটা মৃত্যু তাঁকে বিমর্ষ করে দিচ্ছিল। সে বছর তাঁর যে দুটো বই বের হয়েছিল, সে দুটো আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে দরজা খোলা মানা। তাই ফোনে বলেছিলেন, ‘বাড়ির দারোয়ানের কাছে বই দেওয়া থাকবে, সেখান থেকে নিয়ে যাবি।’

আমি নিয়ে এসেছিলাম।

এরপর ২০২১ সালে একেবারে নিকটাত্মীয়দের হারাতে শুরু করলাম যখন, তখন থেকে আমার নিজেরও কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হতো না। সন্‌জীদা খাতুনও আর খুব বেশি ফোন করতেন না। এ সময় তিনি জানতে পারলেন, তাঁর চোখে এই বয়সে আর অপারেশন করা সম্ভব নয়। অপারেশন করার পর যা যা মানতে হবে, শরীর তাতে সায় দেবে না। তাই পড়ার ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হলো। হাঁটতে সমস্যা হতে শুরু করল। প্রচণ্ডরকমভাবে জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষটি নিজের ওপর বিরক্ত হলেন।

সেই মানুষটি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন, তাঁর বাড়িতে গিয়ে একবার তাঁকে চোখে দেখা সম্ভব।

জন্মদিনে সন্জীদা খাতুন২.
সেই পরিচিত বাড়ি! যখন বলেছেন, তখনই এই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছি। কখনো কখনো তাঁর কথা রেকর্ড করেছি মোবাইল ফোনে। জন্মদিনগুলোতে তিনি যদি কথা বলতে রাজি হতেন, তাহলে কী যে আনন্দে ভরে যেত মন! আমরা সতীর্থ অনেকেই একসঙ্গে গিয়ে হাজির হতাম তাঁর বাড়িতে। লুচি আর তরকারি ছাড়াও আরও অনেক খাবারে ভরা থাকত টেবিল। কারও ইচ্ছে হলে খেয়ে নিত। কেউ তাঁকে শোনাত গান, কেউ করত আবৃত্তি। এবার সে সুযোগ ছিল না।

আমি যখন পৌঁছলাম, তখন নিচ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, লিফটের সাতে আসলে কী হচ্ছে। বাড়ির দারোয়ানদের বললাম, ‘কেউ কি এসেছে?’

তাঁরা বললেন, ‘একজন ওপরে গেছেন।’

আমি আগের দিনের কথামতো ঠিক করে রেখেছি, দরজা খোলা হলে কেকটা বাড়ির ভেতর রেখে তাঁকে একবার দূর থেকে দেখে ফিরে আসব।

সেভাবেই দরজায় দোরঘণ্টি বাজালাম। দরজা খুলে গেল। দেখলাম, আপা বসে আছেন। সামনে বসে আছেন ওয়াদুদ ভাই।

আমি দরজায় দাঁড়িয়েই বললাম, ‘শুভ জন্মদিন। বহুদিন পর দেখা হলো আপনার সঙ্গে!’

কোমল স্বরে তিনি বললেন, ‘ভেতরে আয়।’

আগের দিন বলেছিলেন, করোনা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় এখন আগের মতো সতর্কতা অবলম্বন করেন না।

ঘরে ঢুকেই বুঝলাম একটু বেশি সকালে চলে এসেছি। তিনি তখনো শাড়ি বদলে পরিপাটি হয়ে বসেননি।

চোখে চশমা নেই।

আমি আমার অধিকার খাটিয়ে বললাম, ‘চশমা কোথায়?’

দেখিয়ে দিলেন সামনেই রয়েছে চশমার বাক্সটা।

বললাম, ‘আপনাকে চশমা ছাড়া ভালো লাগে না।’

এবার চশমা দিলেন চোখে। বললেন, ‘কাল রুচিরা শাড়ি বের করে দিয়ে গেছে। এখনো পরতে পারিনি।’

‘ছায়ানটের কর্মীরা কখন আসবে?’

‘নটার পর। বোধ হয়, সাড়ে নটার দিকে। পার্থ এসে ঘরদোর সব ঠিকঠাক করে গেছে। সে সময় পার্থ আবার আসবে। লিসার নাকি খুব জরুরি কাজ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ও সকালে সেখানে গেছে।’

৩.
ওয়াদুদ ভাইয়ের সঙ্গে সংগীত নিয়ে কিছু কথা বললেন তিনি। তার একটা হলো, স্বাভাবিকভাবে যারা গান শুরু করেছে, তাদের মধ্যে উচ্চাঙ্গসংগীতের জুজু ঢুকিয়ে না দেওয়াই ভালো। কিন্তু এখনকার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সহজাত ভঙ্গির মধ্যে জোর করে উচ্চাঙ্গসংগীত ঢুকিয়ে দিতে চান বলে অনেক নতুন শিল্পীই গানের ওপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।

গান হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত।

কথার ফাঁকে ফাঁকে টেলিফোন আসতে থাকে। তিনি আজ সবগুলো ফোন ধরবেন। যাঁরা ফোন করছেন, তাঁরা গভীর ভালোবাসা থেকেই আজকের দিনটিতে তাঁকে স্মরণ করছেন। তিনি সবার সঙ্গেই একটু একটু করে কথা বলছেন।

গতকাল বলেছিলেন, পড়তে অসুবিধা হয়, হাঁটতে অসুবিধা হয়। ‌আজ দেখলাম, কে ফোন করছে সেটাও টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে পড়ে ফেলতে পারছেন। বললেন, বেশিক্ষণ কোনো দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। ছোট মেয়ে রুচিরা একটা জিনিস কিনে দিয়েছেন, যা দিয়ে দেখলে অক্ষরগুলো বড় দেখা যায়। আশাপূর্ণা দেবীর ‘৫০টি গল্প’ নামে একটি বই মাঝে মাঝে পড়ছেন এখন। গল্পগুলোর কোনো কোনোটি ভালো হলেও কোনো কোনোটি ভালো লাগেনি তাঁর, সে কথাও বললেন।

৪.
এ সময় একেবারেই যুক্তিহীনভাবে আমি তাঁকে বললাম, ‘একটা গান করেন।’

চোখেমুখে রাগ ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘না।’

বললাম, ‘আমার জন্য দুটো লাইন গান। ‌ভালো লাগবে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। গান করবেন কি করবেন না, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন গানের কয়েকটি লাইন তুলে আনলেন কণ্ঠে, তখন বুঝলাম, এদিনের সঙ্গে যায়, এমন একটি গানই খুঁজছিলেন এই মৌনতার সময়।

গাইলেন:
‘কী গাব আমি, কী শোনাব আজি আনন্দধামে’।

৫.
তাঁর দুটো ফোনে একের পর এক শুভেচ্ছাবার্তা আসতে শুরু করল।

এর মধ্যে কানাডা থেকে ফোন করলেন পার্থ সারথি শিকদার। মস্কোতে পার্থদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। চিঠি চালাচালি হতো। এরপর ফোন করলেন মাছওয়ালা। বাড়ির কাজের সহযোগী মেয়েটা কড়া ভাষায় জানাল, এখন মাছ কেনার দরকার নেই।

মাছওয়ালা লোভ দেখাচ্ছিল বড় মাছের। কিন্তু এর আগে সম্ভবত মাছ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো অসততা করায় সে কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। একটু পরে মনে হলো মনটা নরম হয়েছে, বাড়ির সহযোগীকে বললেন, ‘গুলশা মাছ দিতে চাইছে, নেব?’

ওয়াদুদ ভাইয়ের আনা ফুল গোছাতে গোছাতে এবার সেই রাগত মেয়েটাও নরম সুরে বলল, ‘দিতে বলেন।’

একটু পরেই ছায়ানটের কর্মীরা আসবে। তাই আমি বললাম, ‘আজ আসি!’

তারপর বললাম, ‘আপনি তো জানেন আমি প্রণাম, সালাম কিছুই করি না। কিন্তু মন থেকে যাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা এমনিতেই আসে, তাঁদের পা ছুঁই!’

‘না না’ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘আমার হাতটা ধর তাহলে!’

তাঁর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ গালের সঙ্গে ধরে রাখলাম। তারপর বললাম, ‘কাল টেলিফোনে যা যা বললেন, তা আমার ভালো লাগেনি। আপনাকে বাঁচতে হবে। অনেক দিন বাঁচতে হবে। মৃত্যুর কথা বলা চলবে না।’

হেসে বললেন, ‘আবার আসিস!’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোচির ইহুদি পরিবারের ঐতিহ্য যেভাবে বাঁচিয়ে রাখছেন এক মুসলিম

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
কোচির ইহুদি পাড়ায় সারা আন্টির রেখে যাওয়া দোকানের সামনে ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।

এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।

থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’

এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’

কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।

এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে
ইব্রাহিম থাহার সারা আন্টি তাঁর পরিণত বয়সে। ছবি: ইব্রাহিম থাহার সৌজন্যে

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।

আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।

থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।

ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’

উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’

এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সারা আন্টির দোকানে কিপ্পা সেলাই করছেন ইব্রাহিম থাহা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’

ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।

থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’

সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’

তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’

থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’

বিবিসি থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
গাবতলী সেতু বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সম্পাদকীয়
সাহিত্যচর্চা এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।

অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।

তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।

কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।

সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।

পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত