Ajker Patrika

অন্যদের চেয়ে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব বেশি

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
অন্যদের চেয়ে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব বেশি

আওয়ামী লীগ অজেয়, অবিনাশী দল। ১৯৪৯ সালে জন্মের পর থেকে এই দল ক্ষমতার ভেতরের, এমনকি বাইরেরও অনেক শক্তির চক্ষুশূল হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য কম চেষ্টা-অপচেষ্টা হয়নি। যতবারই আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে, ততবারই দলটি যেন ফিনিক্স পাখির মতোই ছাইভস্ম থেকে জেগে উঠেছে এবং দ্বিগুণ-বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

ভারতের কংগ্রেস ও পাকিস্তানের মুসলিম লীগের চেয়েও রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব বা সাফল্য অধিক। কংগ্রেস (১৮৮৫) অবিভক্ত ভারতের প্রাচীনতম ও প্রথম রাজনৈতিক দল; মুসলিম লীগ (১৯০৬) অবিভক্ত ভারতের দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল। তবে আওয়ামী লীগের বয়সও কম হলো না, ৭৪ বছর চলছে এখন দলটির বয়স। কংগ্রেসের ১৩৮ বছর পর এবং মুসলিম লীগের ১১৭ বছর পর আওয়ামী লীগের জন্ম। আওয়ামী লীগের যখন জন্ম হয়, তত দিনে ভারত উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে ভাগ হয়ে যথাক্রমে পাকিস্তান (১৪ আগস্ট ’৪৭) ও ভারত (১৫ আগস্ট ’৪৭) দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং আওয়ামী লীগের জন্ম সালকে (১৯৪৯) ভিত্তি বছর হিসেবে ধরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাবে কর্মকৃতিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের চেয়ে আওয়ামী লীগের সাফল্যের পাল্লাই ভারী। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দুটি দলই একাধিকবার ভেঙেছে এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। পাকিস্তান দেশটাও ভেঙে গেছে। মুসলিম লীগ তো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কংগ্রেস ১৯৬৯ সালে ভেঙে গেলে আর কখনো এক হতে পারেনি। ক্রমান্বয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিশিষ্ট নেতারা একে একে কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও বর্তমানে কংগ্রেসের একটি খণ্ডিত দল মমতার তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে।

সে তুলনায় আওয়ামী লীগ দুবার ভাঙলেও দুবারই জোড়া লেগেছে; ঘরের লোকেরা ঘরে ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগ সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসনের কারণে ২৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। এরপর দুই দফায় আরও ১০ বছর বিরোধী দলের আসনে বসে ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে সক্ষম হয় এবং সেই থেকে অদ্যাবধি ক্ষমতায় আছে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে দলটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ, যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি, সেই দেশ প্রতিষ্ঠা করে অনন্য গৌরবের অধিকারী হয়েছে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগও দুটি দেশ যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। দুই দেশই স্বাধীন হয়েছে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে। বাঙালির মতো যুদ্ধ জয় করে নয়।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও প্রদেশে (পূর্ববঙ্গ, তখনো পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ হয়নি) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি। কেন্দ্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন; প্রদেশে আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী হন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বড় অবদান হলো ব্রিটিশের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত পৃথক নির্বাচন প্রথা বাতিল করে যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনও হয়েছিল পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিতে। তখন মোহামেডান আসন, নন-মোহামেডান আসন, ইউরোপিয়ান আসন, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আসন, ভারতীয় খ্রিষ্টান আসন, শিল্প ও বাণিজ্য আসন, উইমেন’স মোহামেডান আরবান আসন, উইমেন’স জেনারেল আরবান আসন, জমিদার আসন ইত্যাদি আসনে ভাগ করে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক ও আইন পরিষদের ভোট গ্রহণ করা হতো। করদাতারা ছিলেন ভোটার, সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। এর ফলে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে অভিন্ন জাতীয়তার দাবিদার হলেও উক্ত সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় বিভক্ত নির্বাচনী প্রথায় বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যুক্ত নির্বাচন বিল উত্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ‘...যুক্ত নির্বাচন এক দেশ এক জাতিত্ববোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে এবং বিভেদমূলক সকল প্রবণতা নস্যাৎ করবে।’
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী শুধু পৃথক নির্বাচন নয়, ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহর অমিতব্যয়ী, উচ্ছৃঙ্খল পুত্র সলিমুল্লাহকে ১৬ লাখ টাকা লোন দিয়ে ১৯০৬ সালে তাঁকে দিয়ে মুসলিম লীগ গঠন করায়। ঢাকার সমাজ ও জনজীবনের ওপর নবাব পরিবারের প্রভাবের অবসান ঘটানোর জন্য ’৪৭-এর আগেই কলকাতা থেকে ঢাকার এসে আবুল হাশিম ১৫০ মোগলটুলীতে কর্মী শিবির গঠন করেছিলেন। ক্রমান্বয়ে শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ এসে কর্মী শিবিরে যোগদান করেন।

জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার যে হলাহল উৎপন্ন হয়েছিল, সেটি পান করে নীলকণ্ঠ হন শেখ মুজিব। হিন্দু-মুসলিম দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে জাতি। এই বিভক্ত জাতিসত্তাকে একক সত্তায় রূপান্তরের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হয়েছিল। পাকিস্তানি জমানায় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ যাঁরা দেখেছেন বা শুনেছেন, তাঁরা জানেন, তখন মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলের নেতারা জনসভায় বক্তৃতা শুরু করতেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, ‘নাহমাদুহু ওয়ানুছল্লি আলা আম্মা বাআদ’ ইত্যাদি দোয়া-দরুদ পড়ে। আর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সভার শুরুতে কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল থেকে পাঠ করার রেওয়াজ চালু করেছিলেন। এতে বিভক্ত জাতিসত্তার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথ সুগম হয়েছিল। তারপর ৬ দফায় স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই নবজাগ্রত বাঙালি জাতি স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছুতে তৃপ্ত হতে রাজি ছিল না। তাতেই না বঙ্গবন্ধুর মরণজয়ী সংগ্রাম ও সাধনায় আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।

যুক্ত নির্বাচন প্রথার ঐতিহাসিক তাৎপর্য হলো, বঙ্গবন্ধু এক ব্যক্তি এক ভোটের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সেই নীতির ভিত্তিতে ভোট গ্রহণ করা হলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হন। প্রদেশে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের অশুভ আঁতাত একজন বাঙালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে—এটা মানতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। তাই তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে, যার পরিণতিতে বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ৭ মার্চ সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাঙালি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যে অসহযোগ আন্দোলন করেছিল, সেটি ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে নিখিল ভারতজুড়ে অনুষ্ঠিত অসহযোগের চেয়েও সর্বাত্মক, সফল, সার্থক ও সর্বব্যাপী হয়েছিল। দুটি অসহযোগই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু গান্ধীজির অসহযোগের ওপর কংগ্রেসের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে মহাত্মার অহিংস আন্দোলন সহিংস রূপ পরিগ্রহ করে, যার ফলস্বরূপ চৌরিচোরায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা থানা আক্রমণ করে পুলিশকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। এই নিদারুণ হত্যাকাণ্ডে গান্ধীজি এতই ব্যথিত ও বিচলিত হয়েছিলেন যে, তিনি অসহযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

পক্ষান্তরে ’৭১-এ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনে কোনো অপ্রীতিকর হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগের ওপর তিনি ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। বঙ্গভবন ও ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না। সচিবালয়, অফিস-আদালত, ব্যাংক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেই চলত। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল।

একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের নির্দেশে সুশৃঙ্খল উপায়ে পরিচালিত হয়েছে এবং তা অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু জীবনের তরে বন্ধ করে দেবে।’ সেটা মনে রেখে স্বাধীনতাকামী জনতা রাস্তাঘাট কেটে, ব্যারিকেড দিয়ে বাংলাদেশকে অচল করে রেখেছিল। ফলে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক, কামান, রিকয়েললেস রাইফেল, আর্মড ভেহিক্যাল নিয়ে ঢাকার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন জনতার ওই ব্যারিকেডই তাদের অগ্রসর হতে বাধা দিচ্ছিল। সেগুলো সরিয়ে অগ্রসর হতে তাদের বেগ পেতে হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর ঘাঁটিতে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল।

২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার বন্ধ ঘোষণা

হাদির অবস্থা আশঙ্কাজনক, মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত, ফুসফুসেও আঘাত: মেডিকেল বোর্ড

সুদানে সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ শান্তিরক্ষী নিহত, যুদ্ধ চলমান: আইএসপিআর

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

৫ ফুট উচ্চতার সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বেলারুশ থেকে পোল্যান্ডে ১৮০ অভিবাসী, চাঞ্চল্যকর ভিডিও প্রকাশ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ