প্রবাসে থাকার সময় শাশুড়ির নামে পাঠানো টাকা আত্মসাৎ ও দুই সন্তান রেখে অন্যকে বিয়ে করার প্রতিশোধ নিতে প্রাক্তন স্ত্রীকে অপহরণ করে হত্যা করে লাশ যমুনা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় স্বজনদের করা নিখোঁজ সংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরির অনুসন্ধানকালে বড় ভাইসহ প্রাক্তন স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর মূল রহস্য উদ্ঘাটন করেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গাজীপুর।
গ্রেপ্তার আসামিরা গতকাল শুক্রবার বিকেলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা হত্যার কারণ ও নিজেদের দায় স্বীকার করেছেন বলে জানায় পুলিশ।
হত্যার শিকার নারীর নাম জনি আক্তার রুপা (২০)। তিনি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার ফাজিলপুর গ্রামের রবিউল ইসলামের মেয়ে। তাঁর মরদেহ এখন নিখোঁজ রয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলেন, জনি আক্তার রুপার প্রথম স্বামী মো. মোজাম্মেল হক (৩২) ও তাঁর বড় ভাই মো. জহির আলী (৩৯)। তারা উভয়ে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার হিদাগারী গ্রামের মৃত সোহরাব প্রামানিকের ছেলে। গত বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) সকালে তাঁদেরকে গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন চাঁন্দনা চৌরাস্তা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ শনিবার সকালে এসব নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বিপিএম-সেবা।
পুলিশ সুপার আরও জানান, ২০১৫ সালে মো. মোজাম্মেল হকের সঙ্গে জনি আক্তার রুপার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। এরপর তাঁদের দাম্পত্য জীবনে দুটি ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। পারিবারিক ও আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে মোজাম্মেল ২০১৯ সালে মালয়েশিয়া চলে যান। দীর্ঘ ৪ বছর মালয়েশিয়া থাকাকালে শাশুড়ির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৯ লাখ টাকা পাঠান তিনি। ৪ বৎসর পর দেশে ফিরে এসে মোজাম্মেল জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী রুপা মোজাম্মেলের বোনের সতিনের ছেলে মো. উজ্জল মিয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গোপনে বিয়ে করেছেন এবং মোজাম্মেলের সংসার ত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর ছোট দুটি সন্তানকে রেখে উজ্জলের সঙ্গে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার বালিগাঁও গ্রামে বসবাস করছেন।
তিনি আরও জানান, পরে মোজাম্মেল তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী রুপা এবং তাঁর মায়ের কাছে টাকার হিসাব চাইলে তাঁরা কোনো হিসাব দিতে পারেননি। এরপর পারিবারিক মীমাংসায় তাঁরা মোজাম্মেলকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ফেরত দেন। কিন্তু বাকি টাকা ফেরত দেননি।
এরপর পর পরে গ্রেপ্তারকৃতরা প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী মোজাম্মেল গত ৬ জানুয়ারি মোবাইলের মাধ্যমে রুপাকে তাঁদের দুই সন্তানদের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য গ্রামে আসতে অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধে রুপা তাঁর দ্বিতীয় স্বামীকে কিছু না জানিয়ে গত ৬ জানুয়ারি কালীগঞ্জের তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর ভাড়া বাড়ি থেকে মোজাম্মেলের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।
আসামিরা স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার জানান, গত ৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে রুপা জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌঁছার পর মোজাম্মেল তাঁকে বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রহণ করেন এবং তাঁকে নিয়ে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি যমুনা নদীর চরে তাঁর এক বন্ধুর বাসায় বসে আলাপ আলোচনা করার জন্য নিয়ে যান। একই সময়ে তাঁর বড় ভাই জহির আলীকে একটি নৌকা নিয়ে মাদারগঞ্জ থানার জামথৈল ঘাটে আসতে বলেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা রুপাসহ জামথৈল ঘাট থেকে নৌকাযোগে যমুনার চরে রওনা দেন। পথে প্রথমে তাঁরা রুপার পরিহিত ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন এবং আসামি মোজাম্মেল তাঁর সঙ্গে আনা দা দিয়ে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করে মৃতদেহ বালুভর্তি বস্তায় ভরে যমুনা নদীর গভীর পানিতে ফেলে দেন।
পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজের পর রুপার দ্বিতীয় স্বামী উজ্জল মিয়া গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানায় ২৪ জানুয়ারি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে রুপার পরিবার জিডির বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য পিবিআই গাজীপুর জেলাকে অনুরোধ করে। পিবিআই অনুসন্ধানকালে ঘটনার ২ মাস ২৪ দিন পর প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগী রুপাকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে সাক্ষ্য প্রমাণ পায়। পরে রুপার দ্বিতীয় স্বামী বাদী হয়ে গত বুধবার (২৯ মার্চ) কালীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে মামলাটি তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সনজিৎ বিশ্বাস জানান, মামলা রুজুর পর পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স ঢাকা মামলাটি অধিগ্রহণ করে পিবিআই গাজীপুর জেলাকে মামলাটি তদন্তের জন্য নির্দেশ প্রদান করে। তদন্তকালে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানের নেতৃত্বে পিবিআই গাজীপুর জেলার একটি দল গত বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) আসামিদের গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভুক্তভোগীর মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা করছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এসআই সনজিৎ বিশ্বাস আরও বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা গতকাল শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। পরে তাঁদের আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে