Ajker Patrika

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

নিশানায় নারী, মামলা করতে ভয়

  • সাত মাসে সহিংসতা ও হয়রানির শিকার ১,২৫৫ নারী।
  • যৌনকর্মী থেকে শুরু, আক্রান্ত সব শ্রেণির নারী।
  • মামলার বদলে মীমাংসায় আগ্রহী পুলিশ-প্রশাসন।
অর্চি হক, ঢাকা 
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৫, ১৩: ৪২
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের কিছুদিন পর, গত বছরের ২৯ আগস্ট রাজধানীর শ্যামলী স্কয়ারে প্রকাশ্যে মারধরের শিকার হন কয়েকজন নারী যৌনকর্মী। হামলাকারী এক যুবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেই সেই ঘটনার ভিডিও প্রচার করেন। ঘটনাটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিলেও হামলাকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এরপর পেরিয়ে গেছে ছয় মাস। অব্যাহতভাবে নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে এখনো প্রায় সব শ্রেণির নারীরাই হয়রানি, হুমকি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এতে নারীদের মধ্যে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, সরকার কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

হয়রানি বা সহিংসতার শিকার নারীরা নানা কারণে মামলা করতে ভয় পান। সে কারণে এ ধরনের অনেক ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। গত ২৭ আগস্ট থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হয়রানির আলোচিত ১০টি ঘটনার মধ্যে কেবল দুটির ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে। বাকিগুলোর কয়েকটিতে পুলিশ ও প্রশাসন দুই পক্ষকে ডেকে আপস মীমাংসা করেছে।

সর্বশেষ গত ৫ মার্চ হয়রানির শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষার্থী। তাঁর অভিযোগ, শালীনভাবে ওড়নাসহ সালোয়ার-কামিজ পরা থাকার পরও তাঁকে বেপর্দা বলে অভিযুক্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী এক যুবক। এ ঘটনায় মামলা করার পর অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হন। তবে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয় দেওয়া কিছু লোক তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে রাতভর থানার সামনে অবস্থান নেন। পরদিনই অভিযুক্ত জামিনে মুক্ত হন। এরপর মামলা তুলে নিতে থানায় আবেদন করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। তিনি জানান, হত্যা-ধর্ষণের হুমকি পাওয়াই এর কারণ। ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ‘মব’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতা)-এর হাতে তুলে দিয়েছে, যা তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

নারীদের ফুটবল ম্যাচ ঘিরেও হয়েছে সহিংসতা। উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর বাধার কারণে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও রংপুরে নারীদের তিনটি ফুটবল ম্যাচ স্থগিত হয়ে যায়। দিনাজপুরের হাকিমপুরে ম্যাচ ঘিরে হামলায় কমপক্ষে চারজন আহত হন। জয়পুরহাটে স্থানীয় মাদ্রাসাশিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ম্যাচের আগে হামলা চালিয়ে মাঠের বেষ্টনী ভেঙে ফেলেন। রংপুরের তারাগঞ্জে কট্টরপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীর বাধার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি হয়। এই তিনটি ঘটনার একটিতেও মামলা হয়নি।

সহিংসতার পরেও মামলা না হওয়া প্রসঙ্গে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘এটা ভুল-বোঝাবুঝি থেকে ঘটেছিল। যারা ম্যাচে বাধা দিয়েছিল, তারা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষমা চেয়েছে।’

সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ধর্মীয় গোষ্ঠীর হয়রানির শিকার হয়েছেন কয়েকজন নারী অভিনয়শিল্পীও। গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রামে মেহজাবীন চৌধুরী, ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে পরীমণি এবং ২৯ জানুয়ারি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে অপু বিশ্বাসকে ‘তৌহিদি জনতা’র বাধার মুখে অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়। অনুষ্ঠানগুলো ছিল নিছক সাধারণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতির সময় শ্লীলতাহানির শিকার হন একাধিক নারী যাত্রী।

আজকের পত্রিকাকে বিভিন্ন বয়স-শ্রেণি ও পেশার বেশ কয়েকজন নারী জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক এসব ঘটনার কারণে তাঁরা এখন সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন: নারী ও কন্যার উন্নয়ন’।

নারী আন্দোলন, মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মীদের পাশাপাশি আইনজীবীরা নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি রোধে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদের এবং সরকারকে সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘মাত্র কয়েক মাস আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারীরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু এখন নারীদের সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবন, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে নানান ধরনের হুমকি এবং বাধার সামনে পড়তে হচ্ছে। এভাবে নারীদেরকে জনজীবন থেকে বের করার চেষ্টা যারা করছে, তাদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করা উচিত। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারীদের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এটা নিশ্চিতভাবেই নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির পথে বড় বাধা। সরকার এসব ঘটনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফৌজদারি অপরাধেও ক্ষমা চেয়ে বা আপস করে মীমাংসা হচ্ছে। এটা অগ্রহণযোগ্য।’

মহিলা পরিষদ বলছে, গত আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ১ হাজার ২৫৫ জন নারী নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি মনে করা হয়। কারণ, ৫ আগস্টের পর দীর্ঘ সময় থানার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ ছাড়া অসংখ্য খবরের ভিড়ে সংবাদপত্রে নারীর প্রতি সহিংসতার সব খবর জায়গা পায়নি।

বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নাগরিকদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ জানিয়েছি। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখিনি; বরং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অনেক নারী শ্লীলতাহানির ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘যারা নারীদের হয়রানি করছে, মব চালাচ্ছে, হয় তারা সরকারের সমর্থন পাচ্ছে, অথবা সরকার পরোক্ষভাবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এগুলো কোনো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় নয় যে আপসের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত