Ajker Patrika

মতামত /শেখ হাসিনার জঙ্গি দমনের পেছনের গল্প

এম আবুল কালাম আজাদ
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২: ০১
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় এক অধ্যায় রচিত হয় জঙ্গিদমন অভিযানে, কিন্তু সেটা মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে শুধু সরকার ও তার বাহিনীর বয়ান তুলে ধরা, যেখানে কতটা দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে তারা জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করেছে সে চিত্র ফুটে উঠত। এর পেছনে যে এক অন্যায় ও অমানবিক দিক রয়েছে তা মিডিয়ায় উঠে আসেনি, ফলে সেটা অন্ধকারেই রয়ে যায়।

আমরা জানি, ২০১৩ সাল থেকে জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলা হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা হয় হলি আর্টিজান বেকারিতে। এসব হামলায় বিদেশি নাগরিকসহ অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। আওয়ামী লীগ সরকার সেসব হামলা প্রতিহত করতে না পারলেও শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে সংসদে দাবি করেন জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল।

এমন দাবির পেছনে কারণ রয়েছে বলে যুক্তিও দেওয়া হয়। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জঙ্গিদের দমনে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ বাড়ে। তাই যেকোনো মূল্যে জঙ্গিদমনে সাফল্য দেখানোর প্রয়োজন। এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা জঙ্গিদের আটক করতে মরিয়া হয়ে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একের পর এক জঙ্গি আস্তানা খুঁজে পায় এবং সফল অভিযানে বড় বড় জঙ্গির মৃত্যু ঘটে। একই সঙ্গে শুরু হয় জঙ্গি আটকের হিড়িক। নবগঠিত সিটিটিসি ছাড়াও পুলিশ, র‍্যাব ও ডিবি দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে শত শত মানুষকে জঙ্গি হিসেবে আটক শুরু করে।

পরিস্থিতি দেখে মনে হয় যে পুরো দেশ জঙ্গিতে ছেয়ে গেছে। বাংলাদেশ যেন এক জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাংবাদিক হিসেবে জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও জঙ্গি আটকের ঘটনা নিয়ে আমাদের মাঝে সন্দেহ জন্মে। অনেকে মনে করে, অভিযান বা আটকের অনেক কিছু সাজানো। তবে যেহেতু তখন কেউ তা খতিয়ে দেখেনি বা আনুসন্ধান করেনি তাই পুলিশের দেওয়া তথ্য বা ন্যারেটিভের বাইরে অন্যকোনো গল্প থাকলেও তা চাপা পড়ে যায়।

দু-তিনটি ঘটনা নিয়ে মিডিয়া আনুসন্ধান করলে ভিন্ন রকম তথ্য বেরিয়ে আসে, যার সঙ্গে পুলিশ বা র‍্যাবের দেওয়া তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। এ থেকে ধারণা হয়, প্রতিটি ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো অন্য গল্প লুকিয়ে আছে।

সে সময় জঙ্গি ধরার এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয় বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে। প্রকৃত জঙ্গিদের ধরার পাশাপাশি নিরীহ নারী-পুরুষদের জঙ্গি বানানোর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তারা নানান রকম গল্পের আশ্রয় নেয়। কিন্তু কীভাবে, কেন এমন অন্যায় করা হয় তা জানতেই ২০২১ সালে নারী জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করি। অবাক হয়ে দেখি, জঙ্গিদমনে সাজানো নাটক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপকতা দেখে। ঘটনার যত ভেতরে প্রবেশ করি ততই জানতে পারি র‍্যাব, পুলিশ, ডিবি একই ধরনের গল্পের অবতারণা করে কীভাবে নিরপরাধ মানুষদের আটক করেছে, অনেককে বড় জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

পরিসং‌খ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানের অনেক ঘটনাই অসত্য। অর্থাৎ জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিদমন অভিযান সম্পর্কে আমরা বাইরে থেকে বা গণমাধ্যম থেকে যা জানি, তার বাইরেও আছে অন্য ঘটনা। সারা দেশ চষে বেড়িয়ে যেসব ঘটনা তুলে এনেছিলাম তার কয়েকটির কথা আজ তুলে ধরলেই বোঝা যাবে কেন ঘটনার পেছনের ঘটনা খুঁজতে হবে।

ভুয়া সুইসাইড স্কোয়াড মেম্বার

২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জ জেলা ডিবি পুলিশ চার নারীকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে জানায় যে, তারা নব্য জেএমবির সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য এবং ফিদায়ি হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ডিবি রাত আড়াইটায় তাদের এক গ্রাম থেকে আটক করে। আটক এক নারীর বাড়িতে তারা গোপন বৈঠক করছিল।

নারীদের মধ্যে ছিল একজন মা ও তার দুই অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে, আর মধ্য বয়সী আরেকজন। যারা দুজনেই নিরক্ষর।

এই ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুসারে, অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম আটক নারীদের ছবি ও ভিডিওসহ ফলাও করে রিপোর্ট করে।

অথচ প্রকৃত ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই নারীদের ডিবি পুলিশ এক মাস পূর্বে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং সেটা দিনের বেলায় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে। এরপর তাদের পুলিশ ডিবি অফিসে আটকে রেখে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও শারীরিক নির্যাতন করে জবানবন্দী আদায় করা হয়।

সত্য ঘটনা বের করা কঠিন ছিল না। এই নারীদের সিরাজগাঞ্জ শহর থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরের গ্রাম থেকে তুলে আনা হয়। গণমাধ্যম চাইলেই সেখানে গিয়ে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পারত। তা করা হয়নি। ফলে পুলিশের বানানো গল্প সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, গ্রামের নিরীহ নারীরা সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে খ্যাতি পায়।

সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের এমন ভূমিকায় পুলিশ আরও উৎসাহিত হয়।

সিরাজগঞ্জ ডিবির ওই টিম একই ধরনের আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়। আবার তারা চার নারীকে হাজির করে দাবি করে যে, তাদের শহরের এক বাড়িতে মধ্যরাতে গোপন বৈঠক করার সময় আটক করা হয়। সাংবাদিকেরা এবারও যাচাই বা অনুসন্ধান না করে পুলিশের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরে।

এই দুই ঘটনার অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, ওই নারীদের বাড়ি বিভিন্ন জেলায় এবং ডিবি একেক জনকে একেক স্থান একেক সময়ে তুলে এনে পূর্বের ঘটনার মতো অফিসে আটকে রেখে ও একই কায়দায় জবানবন্দী আদায় করে। এভাবেই তারা সফলভাবে জঙ্গি দমনের একেকটা উদাহরণ তৈরি করতে থাকে।

পহেলা বৈশাখবিরোধী লিফলেট ও ৯ জঙ্গি

২০১৮ সালে রাজশাহী জেলার এক বালিকা বিদ্যালয়ে দুজন ছাত্রী লিফলেট বিলি করে, যেখানে লেখা ছিল পহেলা বৈশাখ পালন করা ইসলামবিরোধী তাই তা পরিহার করা উচিত। তারা স্থানীয় ইসলামি ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

ঘটনার তিন দিন পর পুলিশ স্থানীয় এক জামায়াত নেতার বাড়িতে মধ্যরাতে অভিযান করে জামায়াত নেতা, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও তাঁর ভাইয়ের তিন মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে সাংবাদিকদের সামনে তাঁদের উপস্থাপন করে পুলিশ জানায়, আটককৃতরা নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা রাত ২টার সময় গোপন বৈঠক করে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। বৈঠকে বোমা হামলা চালিয়ে জীবন দিয়ে হলেও তাঁরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন প্রতিহত করবে বলে সভায় তাঁরা আলোচনা করেন।

স্থানীয় সাংবাদিকেরা পুলিশের ভাষ্যমতে রিপোর্ট করে।

ওই এলাকায় কয়েকদিন অনুসন্ধানের পর জানা যায়, ঘটনাটা এক ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলের নেতারা লিফলেটের ঘটনাকে ঘিরে ওই জামায়াত নেতাকে শায়েস্তা করতে চায়। আর তাই মধ্যরাতে অভিযান চালাতে দেরি হয়। স্থানীয় অনেক বাসিন্দা এসব জানেন। জঙ্গি ধরতে পুলিশ এতোটাই বেপরোয়া হয় যে, ওই ঘটনায় করা মামলায় তারা দূরের আরেকটি গ্রাম থেকে জামায়াত নেতার আত্মীয় দুজন নারীকে আটক করে।

স্থানীয় এক সাংবাদিক জানান, তিনি প্রকৃত ঘটনা জানলেও সেটা নিয়ে রিপোর্ট করার সাহস পাননি।

২ দিনব্যাপী বন্দুক যুদ্ধ, ২টি লাশ

২০১৭ সালের এপ্রিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে জঙ্গি অভিযানে পারদর্শী সিটিটিসি ও সোয়াতের সদস্যরা সেখানে যায়। গ্রামবাসীদের সরিয়ে দিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে দুই দিনব্যাপী গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যেন বড় এক সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। দুই দিন পর আস্তানার বাড়িতে ঢুকে পুলিশ দুটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। দাবি করে, এরা নিজেরা বোমা ফাটিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পায়ে গুলিবদ্ধ এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তাঁর শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে পুলিশ। এমন ভাষ্য সব মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।

পুলিশের নথিতে বলা হয়, পুলিশ মোট ২ হাজার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এর বিপরীতে জঙ্গিদের দিক থেকেও অনেক গুলি করার কথা। সে ক্ষেত্রে জঙ্গিদের কাছে ভারি অস্ত্র ও গুলি থাকার কথা। কিন্তু তার প্রমাণ অভিযান শেষে পাওয়া যায়নি।

আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত বাড়ির দেয়ালে অনেক গুলির দাগ থাকলেও আশপাশের কোনো বাড়ির দেয়ালে দেখা যায়নি। জঙ্গিরা গুলি করলে তা থাকার কথা।

এখানেও সন্দেহের অনেক উপাদান থাকায় অনুসন্ধানে করতে নেমে অন্যরকম তথ্য পাওয়া যায়। আহত নারী ও তাঁর স্বামী যে বাড়িতে বসবাস করতেন সেটি ছিল এক প্রবাসীর। তিনি তাঁদের সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। ওই নারীর স্বামী যাকে পুলিশ বড় জঙ্গি হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে খুব ধার্মিক ও ভিন্নভাবে নামাজ পড়ার কারণে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখত বলে আহত নারী ও আশপাশের গ্রামবাসীরা জানায়।

অন্য যে ব্যক্তির লাশ সেখানে পাওয়া গেছে তিনি বড় জঙ্গি ছিলেন। ওই জঙ্গি ঢাকার ডিবি অফিস থেকে পালিয়ে যান। তবে পুলিশ তাঁকে আবার আটক করে। অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশের দুজন সদস্য জানান, তাঁকে আগেই মেরে লাশ ওই বাড়িতে নেওয়া হয়েছিল। আর আহত নারীর স্বামীকে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক গুলি করা হয় বলে তাঁরা জানান।

ফলে মধ্যরাতের অনেক গোপন বৈঠক আসলেই যে সংগঠিত হয়নি এগুলো তার প্রমাণ।

সত্যিকার অর্থে প্রায় সব জঙ্গি ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো গল্প আছে যা আমরা জানি না।

যেমন, ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনায় শাকিরা নামের এক নারী আত্মঘাতী হামলা চালায়। দেশের ইতিহাসে সেটা প্রথম। সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় সেটা প্রকাশিত হয়। আত্মসমর্পণ না করে ওই নারী তার কোমরে বেঁধে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে সেখানে তার মৃত্যু হয়। সঙ্গে থাকা তার মেয়ে আহত হলেও উপস্থিত কোনো পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়নি।

এই ঘটনা নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করেনি। তবে এর সঙ্গেও অন্য এক সত্য লুকিয়ে আছে। আর তা হলো, শাকিরাকে খুব কাছে থেকে গুলি করা হয়, যা সিটিটিসি একাধিক সদস্য নিশ্চিত করেছে।

সোয়াতের এক শুটার যিনি সে সময় উপস্থিত ছিলেন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, তিনি নিজেও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন এবং সেগুলো শাকিরাকে বিদ্ধ করে। মজার ব্যাপার হলো, শাকিরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলির কথা উল্লেখ করা হয়নি। এমন ঘটনাও ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। শাকিরা আত্মঘাতী হয়েছে, নাকি গুলিতে মারা গেছে সে প্রশ্ন অমীমাংসিত।

বাংলাদেশের নারী জঙ্গিদের আগাপাশতলা জানতে প্রায় তিন বছর আমরা গবেষণা করেছি। গবষেণালব্ধ ফল জার্মানি থেকে ২০২৩ সালে ‘উইমেন ইন টেরোরিজম ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটির সহ-লেখক জার্মান গবেষক ও লেখক ড. ইয়াসমিন লরচ।

সেই বইয়ে নিহত শাকিরার ঘটনার মতো আরো অনেক কাহিনীর বর্ণনা উঠে এসেছে।

যৌথ এই গবেষণায় বেরিয়ে আসে, ১২০ জন নারীকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে, যাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন নিরপরাধ। এই সংখ্যা পুরুষ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি বলে পুলিশ ও র‍্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

জঙ্গি দমনে নাটক কেন?

জঙ্গি দমনে হাসিনা সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ছাড়াও সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও জঙ্গি ধরার জন্য বিশেষ প্রণোদনা, পুরস্কার, পদোন্নতি, ভালো পদায়ন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় আকর্ষণের বিষয় ছিল মিডিয়ায় ব্যাপক কাভারেজ।

২০১৬ সাল থেকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে জঙ্গি ধরার এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যে যত সফল জঙ্গি অভিযান ও জঙ্গি আটক করেছে তারা ততই বাহিনী ও সরকারের বাহাবা পেয়েছে। বিপিএম ও পিপিএম তো ছিলই। ফলে এই প্রতিযোগিতা মাঠ পর্যায়ের পুলিশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

আবার অভিযানের ঘটনাকে বড় করে দেখানো হয় বেশি মিডিয়া কাভারেজ ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির জন্য। প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে, ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পুলিশ দমন করতে পারে।

২০১৫ সাল থেকে নারী জঙ্গির সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। যেহেতু নারীদের সংবাদমূল্য বেশি ফলে প্রকৃত নারী জঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিবাদে জড়িত না এমন অনেককে আটক করা হয়। নারীদের একটা গ্রুপ হিসেবে দেখালে গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এই প্রবণতা প্রবল আকার ধারণ করে।

গবেষণা ও অনুসন্ধানের সময় অনেক পুলিশ ও র‍্যাবের কর্মকর্তা তথ্য ও নথি দিয়ে সহায়তা করেন।

এদের অনেকে জানিয়েছেন কীভাবে তৈরি গল্পের মাধ্যমে নিরাপরাধ নারী-পুরুষদের জঙ্গি বানানো হয়েছে। আর এটা বেশি করেছে র‍্যাব। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপে এটা করতে হয়েছে বলেও দাবি তাদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্র্যাপ করে কিছু ধার্মিক ব্যক্তিকে জঙ্গি হিসেবে ধরা হয়, সে তথ্য অবলীলায় স্বীকার করেছেন দুই কর্মকর্তা।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে সবাই জানতেন কীভাবে এমন অন্যায় কাজ করা হচ্ছে। সবাই নীরব ছিলেন। কারণ এ থেকে তাঁরা নিজেরা ও সরকার বড় ধরনের সুবিধা পেত।

ব্যাপারটা সরকারের ভেতরে অজানা ছিল না। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক শহিদুল হকের লেখা বই থেকে এর প্রমাণ মেলে। তিনি তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, পান্থপথে জঙ্গি অভিযানের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছিলেন, এখানে এসে এমন নাটক না করলেও পারতে।

প্রকৃত ও ফেইক জঙ্গি সবাই নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। ধনী পরিবারের সদস্য ছাড়া কেউই সহজে আইনি সুবিধা পায়নি, জামিনও পায়নি। জঙ্গিদের আইনি সহযোগিতা না দেওয়ার জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেই উকিলদের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

এটা নিরপরাধ ব্যক্তিদের জন্য বেশি মর্মান্তিক। একদিকে তারা জঙ্গিবাদে জড়িত না, অন্যদিকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আইনি লড়াইয়ের জন্য উকিল না পাওয়া, বছরের পর বছর কারাবন্দি থাকা তাদের জন্য অনেক বড় অন্যায়। জামিনের পর মামলার ঘানি বয়ে বেড়ানো তো আছেই।

একজন নিরপরাধ নারী বা পুরুষকে জঙ্গি তকমা দিলে তার ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যায়। এই কালিমা তার পক্ষে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রের সব ধরনের সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত হয়। চাকরি না পেয়ে তারা পরিবার ও সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তারা অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের কাছে জঙ্গিবাদ বড় একটি রাজনৈতিক কার্ড ছিল। এই কার্ড তারা শেষ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। কিন্তু জঙ্গি দমনের নামে বড় সংখ্যক নিরপরাধ মানুষের ওপর অত্যাচার ও তাদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করা বড় ধরনের অন্যায়। কিন্তু মিডিয়া জেনে অথবা না জেনে বিষয়টি এড়িয়ে যায় বলে এখনো মানুষ সে সম্পর্কে জানে না।

মিডিয়া যে কোনো ঘটনা বিনা প্রশ্নে বা খতিয়ে দেখা ছাড়া প্রকাশ করলে সেটা মানুষ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনে না, বরং অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। জঙ্গিবাদ সাংবাদিকতা এর বড় উদাহরণ।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইমরান খান

সম্পাদকীয়
ইমরান খান

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।

পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।

ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’

পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

জাহীদ রেজা নূর
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।

কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।

২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।

ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।

অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।

হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।

৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’

‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।

এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।

একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।

একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।

৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।

মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।

এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।

সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!

শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।

৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

স্বপ্না রেজা
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।

যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।

একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।

যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

সানজিদা সামরিন
সানজিদা সামরিন
সানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।

গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।

ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!

অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।

নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।

একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।

তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্‌বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত