Ajker Patrika

আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২১, ২২: ০৯
আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর

সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন গিয়েছিলাম, তখন প্রথম বর্ষে আমাদের শহরে পড়তে এল রাজন, সেটা ১৯৮৭ সাল। রোস্তভ নামে একটি শহরে প্রস্তুতিপর্বের পড়াশোনা শেষ করে ক্রাসনাদারে এসেছে। মেডিকেলে পড়বে। আমি সদ্য কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ক্লাস শুরু করেছি। আমাদের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সুবিধা ছিল, ক্যাম্পাসেই ক্লাস হতো। সারা শহর ছুটোছুটি করতে হতো না। রাজনদের ক্লাস হতো সারা শহরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ভবনে। ফলে ওদের কষ্টটা ছিল বেশি। ট্রাম, ট্রলিবাস, বাস ব্যবহার করে ক্লাস করত ওরা। 

একটু অবসর পেলেই রাজন চলে আসত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা নানা ধরনের আলোচনা করতাম। সে আলোচনায় থাকত সমাজ বদলের কথা, খোঁজা হতো সাংস্কৃতিক মুক্তির উপায়। তখন আর আমাদের বয়স কত? কুড়ির এপাশ–ওপাশ। কিন্তু ভাবনাগুলো ছিল প্রখর ভালোবাসায় ঘেরা। 

রাজনকে কখনোই আমার মনে হয়নি, ও হিন্দু, কিংবা আমাকেও কখনো মুসলমান ভেবে রাজন কথা বলেনি। এখন ভাবি, সে সময়টায় কী করে আমরা ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে সম্পর্কগুলো গড়ে নিতাম? বলতেই হয়, আমাদের ক্রাসনাদার শহরে জহরদা, শ্যামলদা, বিবেকদা, প্রবীরদা, প্রশান্তদা, সমিত ছিল। কিন্তু এদের কাউকেই কখনো হিন্দু মনে করিনি। জহরদা পরপর দুবার আমাদের শহরের বাঙালি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। সমিত ছিল একবার। 

তার মানে কি সে সময়টায় স্বাধীনতার অঙ্গীকারের একটা রেশ ছিল মানুষের মনে? আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পুরো বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিল। তারই রেশ রয়ে গিয়েছিল? সেটাই কি এই বন্ধুতার কারণ? 

দুই. 
পরে ভেবে দেখেছি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহ মানস গঠনে সাহায্য করেছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বড় ছিল পারিবারিক শিক্ষা। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ছেলেমেয়েরা পড়তে যেত, তাদের বেশির ভাগই পারিবারিকভাবে ছিল অগ্রসর মানুষ। তাদের কাছে আন্তর্জাতিকতাবাদ, দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা কোনো কৃত্রিম বিষয় ছিল না। হয়তো সেটাই ছিল এই বন্ধনের একটা বড় কারণ। এখনো তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এখনো মনে হয় না, তারা অনেক দূরের মানুষ। 

এ বছর দুর্গা পূজায় রাজন চেয়েছিল বড় করে উৎসব করবে। কিন্তু পূজামণ্ডপে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, মানুষ হত্যা ইত্যাদির কারণে ওর পূজার আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল। 

বিজয়া দশমীর দিন তাই ওর বাড়িতে রাতে শুধু আমার পরিবারই ছিল আমন্ত্রিত। আর কেউ নয়। আমরা সহিংসতার আবহে নিজেদের মতো থাকতে চেষ্টা করেছি। ভাবতে চেষ্টা করেছি, সবকিছুর পরও একটা উজ্জ্বল আলো হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু সে ভাবনা যে ধীরে ধীরে একেবারেই অবাস্তব হয়ে উঠছে, সেটা ভেবেও মনে কাঁটা দিয়েছে। 

তিন. 
বাঙালি হিন্দু–মুসলিম সম্পর্কের শুরুটা নিয়ে ভাবলে অনেক কিছু পরিষ্কার হবে। অন্ধতা যাদের গ্রাস করেছে, তাদের ভাবনায় আলো ফেলার জন্যই তা বলতে হবে। 

বাঙালি মুসলমানের অধিকাংশই দেশজ মুসলমান, অর্থাৎ ধর্মান্তরিত মুসলমান। নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সুফি দরবেশরাই বাংলায় এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের জন্য। বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের অনেক আগে থেকেই ধর্মান্তরকরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার মানে, একহাতে কোরআন, অন্য হাতে কৃপাণ নিয়ে মুসলমানরা বলপূর্বক অন্য ধর্মের মানুষকে ধর্মান্তরিত করছিল, এটা আসরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারের ফল। এ দেশের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিল সেন–বর্মণ ও দেব শাসকেরা। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বাংলার উত্তর ও পূর্ব অংশে বৌদ্ধদের সংখ্যা ছিল বেশি। পাল যুগে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব থাকলেও কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাল শাসনের সমাপ্তিতে যে সেন শাসন শুরু হলো, তা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন। অত্যাচারের মাত্রা ভয়াবহরকম হয়ে উঠেছিল। তখন বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। 

কুমিল্লা থেকে শুরু করে রংপুর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালীসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় হিন্দু মন্দির ও পাড়ায় হামলা নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে।বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু হওয়ার পর সুফিদের আগমন আরও বেড়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম ছিল উদার। ইসলাম ধর্ম অন্তত তত্ত্বগতভাবে মানুষে মানুষে সমানাধিকার দেয়। তার ছোঁয়া লাগলে এই ধর্মের কারও জাত যায় না। কোরআন পড়তে তার কোনো বাধা নেই। ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও সুফিদের আমন্ত্রণে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল। কখনোই যে ধর্মান্তরিত করার জন্য মুসলমানেরা চাপ দেয়নি, সে কথা বলা যাবে না, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল শোষণে জর্জরিত হয়েই মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। 

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা দরকার। সুফিদের সাধনায় বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে ভারতীয় যোগের প্রভাব পড়েছিল। তারও আগে ভারতে তান্ত্রিক ধর্মকর্মের ওপর বিশ্বাস ছিল। তান্ত্রিক গুরুরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হতো। সুফি দরবেশদের সাধনাও অনেকটা তান্ত্রিক সাধনা বলে মনে করা হতো। সুফিরা ইসলামের শরিয়তি বিধান মেনে চলতেন না। ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না তাদের। ফলে খুব সহজেই সাধারণ মানুষ তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়। 

এ তো গেল নিম্নবিত্ত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা। হিন্দু উচ্চবিত্ত মানুষের ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে ছিল, মুসলমান হলে জিজিয়া কর দিতে হতো না, উচ্চ রাজপদ লাভ করার সুযোগ আসত। এ ছাড়াও আরেকটা অদ্ভুত কারণে ধর্ম পরিবর্তন করতেন তারা। হিন্দু ধর্মের ভয়াবহ ছুৎমার্গ, অর্থাৎ স্পর্শদোষ, খাদ্যদোষ, দৃষ্টিদোষ ইত্যাদির কারণে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকেই সমাজে পতিত করে রাখা হতো। গোষ্ঠীসমেত তাদের সমাজচ্যুত করা হতো। তখন উপায়ন্তর না দেখে তারা ধর্ম পরিবর্তন করতেন। 

বাংলার শাসনকর্তাদের অধিকাংশই ছিলেন বহিরাগত মুসলমান। তবে নবাবি আমলে যারা মোগল সাম্রাজ্যকে অগ্রাহ্য করে বাংলা শাসন করেছেন, তারা এই দেশের মানুষের মতোই দিনযাপন করতেন। তারা লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু মোগল শাসকেরা যাদের শাসন করতে পাঠাতেন, তারা চলে যাওয়ার সময় এ দেশের সম্পদও নিয়ে যেতেন। 

এত কথা এখানে বলার উদ্দেশ্য হলো: 

ক. বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। অধিকাংশ ধর্মান্তর ঘটে সুফিবাদের প্রভাবে। 

খ. সুফিবাদ শরিয়তি বিধান মেনে চলত না। সুফিবাদী ধারার ইসলাম এবং লোকজ সংস্কৃতির মিশ্রণেই গড়ে উঠেছিল এ দেশের ইসলাম। 

গ. এ দেশে যারা মুসলিম হিসেবে বসবাস করছেন, তাদের প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত মুসলমান। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের থেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এ দেশের মাটিতেই প্রথিত। আরবদেশের সংস্কৃতি থেকে তা বেড়ে ওঠেনি। 

ঘ. খুব অল্পসংখ্যক বিদেশি শাসক এ দেশ শাসন করেছে। তাদের উত্তরাধিকার এত অধিক সংখ্যক নয়, যে নিজেদের আরব–বংশোদ্ভূত বলে দাবি করা যায়। 

চার. 
সম্প্রদায়–প্রশ্নে আমরা হেরে গেলাম কখন? 

মনে করার কোনো কারণ নেই, এ দেশে হিন্দু–মুসলমান সম্পর্ক আগে সোনায় সোহাগা ছিল। জাত–পাতের প্রশ্নে হিন্দুবাড়ি ছিল (মূলত ব্রাহ্মণ) ভীষণরকম রক্ষণশীল। সেখানে মুসলমান ছেলেমেয়েদের খাওয়া–দাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কয়েকটি আত্মজীবনী পড়ে মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে কট্টর মৌলবাদ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল। ইংরেজ আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশের মধ্যে নতুন আলো এসে পড়ায় (যাকে অনেকেই বাংলার রেনেসাঁ নামে আখ্যায়িত করেন) অনেক ধরনের রক্ষণশীলতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। মূলত ইউরোপীয় মূল্যবোধের কারণে তারা অনেক বেশি উদারপন্থী হয়ে ওঠেন। কিন্তু অনগ্রসর গোটা ভারতের রক্ষণশীল মানসিকতা যেমন তার বিকাশের অন্তরায় ছিল, তেমনি দেশজ সংস্কৃতিকে একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল বলে এই মূল্যবোধ খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। ফলে বাংলার রেনেসাঁ বেশ কিছু ভালো স্বপ্ন দেখিয়েছে বটে, কিন্তু স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মেলানো হয়নি বলে সারা দেশের মানুষকে উদ্বেলিত করতে পারেনি। 

বাঙালি মুসলমান তার মুক্তির পথ খুঁজেছে আরও পরে। এবং তা ইংরেজদের হাত ধরেই। সে সব ইতিহাস এখানে না বলে শুধু এ কথা বলাই যথেষ্ট যে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার সময় যে প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, তা হলো হাজার বছর ধরে আচরিত ধর্মবোধের সঙ্গে নতুন চিন্তাধারার সাংঘর্ষিক জায়গাগুলোকে আলোচনায় আনা। এবং প্রমাণ করে দেখিয়ে দেওয়া দরকার ছিল, কীভাবে মানুষকে মানবিক হতে হবে। 

ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে নিজের অপরাধকে ঢেকে ফেলার এক অদ্ভুত খেলায় নিয়োজিত হয়েছে বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করছে মানুষপাঁচ. 
মুক্তবুদ্ধির চর্চাটা রয়ে গেল কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষের মধ্যে। এই ‘শিক্ষিত’ মানুষের বাইরে যে গোটা দেশটা ছিল, সেটা কিন্তু এই আলোয় উদ্ভাসিত হলো না। রাজনীতি থেকে একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা খানিক স্পষ্ট হবে। এ দেশে সর্বস্ব ত্যাগ করে যারা রাজনীতি করল, তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাম্যবাদী। কিন্তু তাদের এই আত্মত্যাগ, সাম্যবাদী চেতনা কেন সাধারণ মানুষ গ্রহণ করল না? কমিউনিস্ট আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন হিসেবেই বিকশিত হলো, নিম্নবিত্ত মানুষকে বাঁচানোর এই লড়াইয়ে নিম্নবিত্ত মানুষ কেন আকৃষ্ট হলো না? কেন মানুষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যেই খুঁজল মুক্তির পথ? 

এখন মনে হয়, এর বড় কারণটিই হলো, দেশের সংস্কৃতির শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে যখন দেশের লাঞ্ছনা, বঞ্চনার কথা বলেছে কোনো জাতীয়তাবাদী নেতা, তখন তা সহজেই বুঝতে পেরেছে মানুষ। কমিউনিস্ট কিংবা ইসলামি চিন্তাধারাকে অগ্রাহ্য করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ। কমিউনিস্টরা বলেছে আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা। নিজ দেশকে তারা সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের অংশ বলে প্রচার করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ থাকে তার নিজের অভাব, সমস্যা, সংকট নিয়ে। অন্য দেশের নির্যাতিত মানুষদের জন্য তার মর্মযাতনা থাকতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই তা নিজের কষ্ট, সংগ্রামের চেয়ে বড় নয়। ফলে, আন্তর্জাতিকতাবাদ এখানে বেড়ে উঠতে পারেনি। এবং এক সময় দেখা গেছে বিপ্লব প্রচারের জন্য সমাজতন্ত্রী টাকার আমদানি বন্ধ হয়ে যেতেই এই আন্দোলনে মরিচা ধরেছে। 

অন্যদিকে, আরব–উদ্ভূত ধর্মীয় রাজনীতিও এই দেশের হালে পানি পায়নি একই কারণে। মানুষ নিজেকে দেশের অংশ বলে ভাবতে শুরু করেছে। আরবের খেজুর সংস্কৃতি দিয়ে এ দেশের ডাল–ভাতের চাহিদা মিটবে না, সেটা বুঝতে সময় নেয়নি আইয়ুবী স্বৈরশাসনের আমলে। 

অথচ সেই আরব সংস্কৃতির রমরমায় বাঙালি তথা এই দেশের মানুষ আজ নতুন করে আবার আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে। সুফিবাদকে একেবারে অগ্রাহ্য করে কট্টর সালাফিবাদের দিকে রওনা দিল বাঙালি মুসলমান। 

কেন এমন হলো? 

ছয়. 
সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে এগোলে এই জেহাদি জোশের একটা প্যাটার্ন হয়তো বোঝা সম্ভব হবে। 

যে কোনো জাতীয়তাবাদের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদও বাঙালির মনে অনেক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, অসাম্প্রদায়িকতাই মুক্তির পথ দেখাবে। সমাজের সকল ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশ। দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে দেশ গড়ার কাজটি যখনই হোঁচট খেয়েছে, তখন জাতীয়তাবাদও হোঁচট খেয়েছে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণ করার দিকে এগিয়েছে ইসলামি জাতীয়তাবাদ। ইসলাম যদি সকল মুসলমানকে এক করতে পারত, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের একটাই দেশ থাকত, কিন্তু সেখানে এতগুলো আলাদা দেশ কেন? 

বাঙালি জাতীয়তাবাদ যখন স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারল না, এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তানে পরিণত করা হলো, তারপর থেকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক–সামাজিক–সাংস্কৃতিক জীবনটা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, বেহুলার বাসরঘরে কী করে সাম্প্রদায়িকতার সাপ ঢুকে পড়ল। 

সাত. 
বাঙালি মুসলমান টেরও পেল না, কীভাবে তারা রাজনীতির শিকার হয়েছে। একই কথা বাঙালি হিন্দুর ক্ষেত্রেও বলা চলে। ১৯০৫ সালে বাঙালি হিন্দু যখন বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তখন বাঙালি সত্তাই ছিল প্রধান পরিচয়। কিন্তু এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দু প্রভাবিত হলো নিখিল ভারতীয় রাজনীতি দিয়ে, এবং কংগ্রেস নেতৃত্বেও গোঁড়াদের অবস্থান দৃঢ় হয়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা তখন হয়ে গেল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। ফলে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণ শঙ্কর রায় যখন দেশভাগের সময় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করছেন, তখন বাংলার হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় পরিচয়টাকে জাতীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় করে দেখেছিল। পূর্ব বাংলার মুসলিমরাও কিছুদিন অবিভক্ত বঙ্গের পক্ষে লড়াই করে একসময় খণ্ডিত বাংলাকে মেনে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছিল। সেই অস্থির সময়টি নিয়ে যে যার মতো ব্যাখ্যা দেয়, কিন্তু সে সময় জাতিগত পরিচয়ে বলীয়ান হতে না পারাই যে পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার আগুনকে উসকে দিয়েছে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। 

আট. 
তাই ভাবতে হবে—ধর্মচর্চার ভার কাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে মসজিদ অনেক বেশি যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা মোটেই অনুপ্রেরণাদায়ক অবস্থানে নেই। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চর্চাহীন, প্রজ্ঞাহীন মুফতে টাকা বানানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে, নৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থান ধরে রেখে কোনো বিষয়ে কথা বলার মতো মানুষ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। শুক্রবার দিন জুম্মার নামাজ আদায় করতে মসজিদে ভিড় করেন মানুষ। সে সময় মসজিদ এলাকায় যে আলোচনা হয়, যে খুতবা শুনে বাড়ি ফেরেন ধর্মভীরু মুসলমান, তাতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো বহু উপাদান থাকে। ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধেও কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। কারণ মসজিদ এলাকায় এই ধরনের ধর্মের লেবাসধারী মানুষেরই আধিক্য। এরা যুক্তি মানে না। 

একজন মুসলমানের কাছে যেমন মসজিদ, একজন হিন্দুর কাছে তেমন মন্দির, খ্রিষ্টানের কাছে চার্চ, বৌদ্ধের কাছে প্যাগোডা ঠিক তেমন। যার যার ধর্ম তার তার। যিনি যে ধর্ম পালন করছেন, তিনি তার ধর্মের অনুশাসন মেনে চলবেন। কিন্তু ধর্মটাকে অর্ধশিক্ষিত মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফলেই এই গোল বেঁধেছে। প্রচলিত ধারণা মতে, উচ্চশিক্ষা লাভকারী মানুষই শিক্ষিত। কথাটা অসার। বহুযুগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় মানুষ যে বিদ্যা করায়ত্ত করেছে, তার যে শক্তি আছে, তা অমূল্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ না নিয়েই সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে কৃষক ফসল ফলায়। কোন জমিতে কতটুকু সার দিতে হবে, কোন সময়টা ফসল রোপণের জন্য উৎকৃষ্ট সময়, কখন ফসল কাটতে হবে এগুলো বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই কৃষক করে যায়। বিজ্ঞান হয়তো সেই শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে আরও কিছু কাজ করে, যা এই প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। 

তাই তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের চেয়ে জীবনের শিক্ষালাভ করেছেন যিনি প্রকৃতি থেকে, তিনি নিশ্চয়ই পিছিয়ে পড়া মানুষ নন। গোল বাধে অর্ধশিক্ষিত মানুষ নিয়ে। এরা না বুঝে বা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নিজের মতো কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নেয়। যেহেতু তাদের কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না, সেহেতু এরা কল্পিত ভাবনাকেই সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায় এবং ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করার রীতি নেই বলে সবাই চুপ করে থাকে। সাধারণ মানুষ ভুলেই যায় যে, প্রশ্নটি ধর্ম নিয়ে নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা নিয়ে। ফলে ওয়াজ, মসজিদের ভুল বয়ানগুলোই ছড়িয়ে যায় সমাজে, সমাজ তার যৌক্তিক অবস্থান হারায় এবং ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাস‌‌ের দিকে অগ্রসর হয়। 

এখন একটি বিষয় আলোচনায় আসা দরকার। দেশের একটা বড় অংশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেশ নেই, দেশের মানুষ নেই, দেশের ইতিহাস নেই, ধর্মীয় পরিচয়টাই সেখানে তার একমাত্র পরিচয়—এ রকম একটা জেলখানা যারা বানিয়েছে, তাদের কাছ থেকে সুস্থ চিন্তা আশা করা যায় না। দেশের উৎপাদনের সঙ্গে এদের যোগাযোগের ব্যবস্থা কে করে দেবে। মসজিদ, মাদ্রাসা ছাড়া তো এদের চাকরির সুযোগ কম। তার মানে, ওই আবহ ছাড়া আর কোনো আবহের মধ্যেই তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। এ রকম জীবনে হতাশা আসাটা স্বাভাবিক। ঢলে তারা কীভাবে অন্যের দুঃখ, কষ্ট অনুভব করবে? 

বাঙালি মুসলমান টেরও পেল না, কীভাবে তারা রাজনীতির শিকার হয়েছেনয়. 
ধর্ম, আরববিশ্ব, মুসলমান পরিচয় ইত্যাদি আসলে কোনো ব্যাপারই নয়। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে নিজের অপরাধকে ঢেকে ফেলার এক অদ্ভুত খেলায় নিয়োজিত হয়েছে বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা। আর সেটাকেই ধর্মীয় বিধান বলে চালানোর চেষ্টা করছে। 

দশ. 
আমাদের স্কুলের নাম ছিল সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়। আমার কাছের বন্ধুদের একজন ছিল জয়ন্ত কুমার ভৌমিক। গত শতাব্দীর সাত ও আটের দশকে স্কুলের নামটি হিন্দু নাম কিনা, জয়ন্ত হিন্দু হয়েও আমার কাছের বন্ধুদের একজন কেন, সে প্রশ্ন ওঠেনি কখনো। অমরজ্যোতি ক্লাবে খেলার সময় আমাদের ওয়ানডাউন ব্যাটসম্যান সৌমিত্র বা টুটুলকে কখনোই ধর্ম পরিচয় দিয়ে বিচার করিনি আমরা। আমার আর সৌমিত্রের জুটি একসঙ্গে অনেকটা সময় ক্রিজে কাটিয়েছি। তখন আমাদের একটাই পরিচয়, রান করে দলকে ভালো জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। এখন কেন ধর্ম পরিচয়টা বড় হয়ে উঠছে? 

বড় হয়ে উঠছে এ কারণে যে, পরিবারে ধর্ম–সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেওয়া হয় না। ফেসবুকে স্ট্যাটাস কিংবা স্ট্যাটাসের মন্তব্যগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমরা কোথায় আছি। নারী সম্পর্কে অধিকাংশ পুরুষের অবস্থানও টের পাবেন। 

এগারো. 
যারা এই অপঘাত থেকে বাঁচাতে পারত, তারা সময়মতো নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। অনেকেই ফেসবুকে, পত্রিকার লেখালেখিতে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন, অথচ যে সংকটকালে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়, সে কাজটি প্রতিবেশীরা করেননি। ধর্মীয় সহনশীলতা থাকলে তো স্থানীয় মুসলমানেরাই হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। কোথাও কোথাও যে সে রকম ঘটনা ঘটেনি, তা–ও নয়। কিন্তু মতলববাজরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে নিয়েছিল আগেই। 

আমাদের যে পোক্ত সমাজ ছিল, তার বন্ধন শিথিল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের কথা টেনে আনার কোনো দরকার নেই। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ যদি বিজেপির মাধ্যমে প্রসারিত হয়, তাহলে সেটাও ভারতের জনজীবনের জন্য খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। তার নিন্দা জানাব। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু মুসলমানের অন্যায়কে জায়েজ করার জন্য ভারতের হিন্দুকে টেনে আনার কোনো অর্থ নেই। সেটাও মতলববাজির চূড়ান্ত। 

বারো. 
সমাজটা হারিয়ে গেছে। সমাজের বন্ধন শিথিল হয়েছে। ধর্মবিদ্বেষ বেড়েছে। 

সমাজ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণগুলো আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া। দেশের মানুষ সাংস্কৃতিক জীবনযাপনে অংশ নিচ্ছে কম। সংস্কৃতিই তো মানুষে মানুষে মিলন আনে। সিনেমা, নাটক, যাত্রার অভিনয় দেখে, সংলাপ শুনে মানুষের মনে বোধ জন্মায়, গানের সুরে সে বুঝতে পারে, হৃদয়ে ভালোবাসা, দেশপ্রেমের চাষবাস করার প্রয়োজনীয়তা। বৈশাখী মেলা, নবান্ন, পিঠা উৎসব ইত্যাদি পোক্ত করে সামাজিক বন্ধন। 

সে সব মুছে গিয়ে মানুষ যান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে। ছুটছে টাকার পেছনে। আরা ছুটছে ধর্মান্ধতার পেছনে। তাই এই আলগা হয়ে যাওয়া বাঁধনকে পোক্ত করা খুব দরকার। কিন্তু তার আলামত পাচ্ছি না। 

আর রাজনীতি? এ ধরনের নিন্দনীয় ঘটনা ঘটার সময় জনপ্রতিনিধিরা কোথায় থাকেন? তারা কেন মানুষকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন না? তাঁরা চাইলেই নিজ সংগঠনের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই সংকটের মোকাবিলা করতে পারেন। 

পাশের বাড়ির মানুষটাও তো পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন? কেন দাঁড়ান না? 

ওই যে বললাম, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর। এটা রবীন্দ্রনাথের কথা। ‘রথের রশি’তে লিখেছিলেন তিনি। সেই বাঁধন পোক্ত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের ওপর। সেটা আপাতত খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। 

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

অরুণ কর্মকার
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।

দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!

তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?

কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

হাসান আলী 
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।

প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।

পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।

আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।

বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।

প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।

আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

সাদিয়া সুলতানা রিমি
সংকট, সম্ভাবনার  সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেও শান্ত থাকা যায়, কীভাবে উত্তেজনার মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা যায়। ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, সংকটের সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই অস্থির সময়ের কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড। আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই গভীর শোকের কারণ। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যে কণ্ঠ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; তরুণদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল আশা, সাহস ও প্রতিবাদের ভাষা। সেই কণ্ঠ আজ নীরব। আর এই নীরবতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

একজন নাগরিকের প্রাণহানি কখনোই ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হতে পারে না। বিশেষত, যখন সেই নাগরিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হাদির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই হত্যার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং পরিবারটির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই দায়বদ্ধতারই একটি বার্তা দেয়। তবে ঘোষণা ও আশ্বাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে এমন হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

কিন্তু শোক ও ক্ষোভের প্রকাশ যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা নিজ উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় এবং দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মানে কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে গণতন্ত্রের শিরায় আঘাত করা। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন সহিংসতা কখনোই ন্যায্যতা পায় না।

বিশেষ করে, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করার ঘটনা আমাদের আরও সতর্ক করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। মতভিন্নতার কারণে কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সমাজকে বিভক্ত করে, যুক্তিকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে। আজ যদি আমরা যুক্তির বদলে লেবেলিংকে বেছে নিই, তবে কাল আর কেউই নিরাপদ থাকবে না।

এই অস্থিরতার পেছনে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য বড় ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন তথ্য, আবেগতাড়িত পোস্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মুহূর্তের মধ্যে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়; বরং তথ্য যাচাই করা, সংযত ভাষা ব্যবহার করা এবং উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে বিরত থাকা। এক একটি ভুয়া পোস্ট এক একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ—যা পুরো সমাজকে দগ্ধ করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনও সমান জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। পুলিশি তৎপরতা যদি একপক্ষীয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা উত্তেজনা কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেবে। তাই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সংলাপ, ব্যাখ্যা ও আস্থার রাজনীতি জরুরি।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উসকানি নয়, সংলাপ; প্রতিহিংসা নয়, সহনশীলতা—এই নীতিই হতে হবে পথনির্দেশক। দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে প্রতিটি দলের ধৈর্য ধরার পরীক্ষা চলছে। নেতারা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, কর্মীদের সংযত না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।

নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। অস্থিতিশীলতা সেই ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দেয়। শরিফ ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অক্ষুণ্ন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই শক্তিশালী করতে হবে।

বিশেষ করে তরুণসমাজের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদির কণ্ঠ যে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছিল, আজ তাদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই দর্শনই পারে দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে। আবেগের বশে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারে।

বাংলাদেশ আজ সংকট, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে শোক, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনা। কোন পথ বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সামষ্টিক প্রজ্ঞা ও সংযমের ওপর। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয় বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি আমরা এই শক্তিকে ধারণ করতে পারি, তবে হাদির রক্ত বৃথা যাবে না; বরং তা হয়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে এক কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক সংগ্রামের প্রেরণা।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত