Ajker Patrika

নারী জাগরণ, নারীবিদ্বেষ ও নারীশক্তি

অজয় দাশগুপ্ত
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশে নারী জাগরণ অভূতপূর্ব। এটা বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। বীরকন্যা প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া থেকে জাহানারা ইমামে এর উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে নারীর অধীনে। এরশাদের পতনের পর সরাসরি সামরিক শাসনের অবসান হলে খালেদা জিয়া দেশ শাসনে আসেন। এরপর শেখ হাসিনা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে তাঁরা দুজন দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করেছেন। শেখ হাসিনাকে একসময় অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় মনে হলেও তাঁকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে, যা পলায়ন বলেও চিহ্নিত করা চলে।

এর পর থেকে নারীর অবস্থান নাজুক। কথাটা আমার নয়, এখন যেসব তরুণী ও উঠতি বিপ্লবীরা কথা বলেন, তাঁরা সবাই একমত যে দেশে নারীদের অবস্থা সুবিধার নয়। এমনকি এটাও বলা হচ্ছে, সুপরিকল্পিতভাবে নারীদের বাদ দেওয়া ও এক পাশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা পদ-পদবি ও নিজেদের অবস্থান হারাচ্ছেন।

কথা মিথ্যা নয়। বিশেষ করে শহরের বাইরে নারীদের অবস্থা করুণ। কিছুদিন বা কয়েক মাস ধরে দেশব্যাপী শুধু মারামারি আর হানাহানি। এই হানাহানি অনেকটা গরম মেজাজ ও সুবিধা নেওয়ার মারামারি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, কোথাও কোনো প্রতিরোধ নেই।

নারীর প্রতি এত রাগ, এত বিদ্বেষ সমাজে আগে দেখা যায়নি। এখানে যেসব কারণ জড়িত, তার মধ্যে ধর্মের নামে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও কম নয়। তারা যেকোনোভাবে নারীকে দুশমন ও ত্যাজ্য বানাতে বদ্ধপরিকর। এর মধ্যে যে ষড়যন্ত্র বা উসকানি, তার নাম রাজনীতি। রাজনীতি না হলে, কথায় কথায় আফগানিস্তানের নাম আসবে কেন?

বাদশাহ জহির শাহর কাবুল চলে গিয়েছিল কমিউনিস্টদের হাতে। আমাদের যৌবনে আফগানিস্তানের রাজনীতিবিদ বাবরাক কারমাল, নূর মোহাম্মদ তারাকি ছিলেন এশিয়ার আদর্শ। অথচ কাউন্টার রেভল্যুশনের নামে তাঁদের সরানো হলো। দিবালোকে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে অন্যরা দমে যায়; সাহস হারিয়ে ফেলে। তা-ই হয়েছিল আফগানিস্তানে। এরপর তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সবচেয়ে বিপাকে রয়েছেন নারীরা। সে দেশে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না। বাজার-হাটে একা যেতে পারে না। ইদানীং তাঁদের পার্কে যাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই তালেবান কিন্তু আমেরিকার কোলে জন্ম নেওয়া এক শক্তি। যারা এখন পুরো দেশ কবজা করে রেখেছে। লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে আমেরিকা। আমেরিকা পালানোর আগে তাদের স্বভাবমতো সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। এখন সে দেশে নারী শুধু অসহায় গোষ্ঠী।

এই অসহায়ত্ব রপ্তানি বা আমদানি কোনোভাবেই ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। অথচ এই ধারণার জোর প্রচার চলছে দেশে। পাকিস্তানের কথাও বলা দরকার। সে দেশের নারীদের একাংশ উচ্চ শ্রেণির। তারা তালেবানি শাসন মানবে না। আমার অভিজ্ঞতা বলে, পাকিস্তানি এলিট নারীরা বাংলাদেশের নারীদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। তাঁরা পারিবারিক ঘরোয়া আড্ডায় পুরুষের সঙ্গে বসে আড্ডা দেন, গল্প করেন, খাবার খান। অথচ বাংলাদেশের এলিট নারীরা পানাহার করলেও মূলত অবরোধবাসিনী। এ জন্য আমাদের অন্ধরা রাজনীতিতে পাকিস্তানপ্রেমী হলেও আখেরে চায় আফগানি বাস্তবতা। দেশে যত দিন নারীর শাসন ছিল, তত দিন তারা ঘাপটি মেরে অপেক্ষায় ছিল। এখন তারা যা করছে, তাতে এটি স্পষ্ট।

নারীদের আসন নিয়ে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈঠকে কোনো নারীকে রাখা হয়নি। তারা মনে করে, নারীর দরকার নেই। পুরুষশাসিত সমাজ ও দেশে পুরুষই ঠিক করবে যে নারীরা কী করবে। নারীর এত কথা বলার কী দরকার। তারা টিপ পরবে না। চুড়ি পরবে না। কালে কালে শাড়িও পরবে না। এই অপপ্রক্রিয়া কতটা ভয়ানক, তার প্রমাণ এখনকার সমাজ। যে সমাজে নারীদের কেউ কেউ নারীর বাইরে যাওয়া বা সহজ জীবন মানে না, তারা এ-ও বলে, নারীর কাজ ঘরে থাকা, সন্তান জন্ম দেওয়া, চাকরি তার জন্য নয়।

এই যে বলছিলাম নারী জাগরণের দেশ বাংলাদেশ। এটা তারা বোঝে, কিন্তু মানে না। অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালে জানত, কী শক্তি রাখে নারীরা। হঠাৎ করে নারী জাগরণ, নারীর অংশগ্রহণ বন্ধ করা যায় না। এটা নারীর চাওয়া। এসব তাদের অধিকার। জুলাই বিপ্লব বলা মানুষেরা নারীর সাহায্য নিয়ে গদিতে চড়ে এখন বেমালুম তা ভুলে গেছেন। তাই বলে কি সময় চুপ থাকবে?

নারীদেরও মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। আজকাল তাদের মুখে এমন সব ভাষা ও স্লোগান শুনি, যা কখনো চিন্তাও করা যায়নি। অনেকে বলবেন, আমি পুরুষবাদী। না, মোটেও তা নয়। সব সমাজ ও সভ্যতার একটা নিয়ম থাকে। জনপদ, প্রকৃতি আর আবহ মিলে যে পরিপার্শ্ব তৈরি হয়, তার নামই নিয়ম। সে নিয়ম অনুযায়ী আমাদের নারীরা ঘরমুখী ও শালীন। শালীন বলতে সমাজের বাদ-প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে সমান অংশ নিয়েও তারা হয় অন্তর্জগৎচারী। তাই তাদের প্রিয়ংবদা বলা হতো এককালে। অর্থাৎ যিনি বা যাঁরা প্রিয় বাক্য বলেন। পুরুষ যত নরম আর প্রিয় কথা বলুক, তা নারীর মতো হয় না। সে কারণে আমাদের সমাজে নারীরা হচ্ছে মিষ্টি কথা ও শালীনতার প্রতীক। সেই নারীদের মুখ ছুটেছে এখন। তাদের এমন সব ভাষা, যা শুনলে কান গরম হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য জুলাই মাসে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁরা এসব শুনলে লজ্জায় মাথা নোয়াতেন।

নারীদের একাংশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে কী বোঝে, সেটি বুঝতে পারি না। তারা যদি মনে করে থাকে যে এই স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা বলা বা আজেবাজে অশ্লীল কথা বলার অধিকার, তাহলে বলার কিছু নেই। নারীদের অন্তর্জগতে যে পরিবর্তন ঘটুক না কেন, বাহ্যিক সরলতা নষ্ট হলে সমাজে অশুভ ছায়া পড়বেই। এবং তা এখন স্পষ্ট।

শালীনতা ও সভ্যতার মধ্যে থাকা বাঙালি নারীরা আমাদের জয় এনে দিয়েছে বারবার, যেমন প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল কিংবা জাহানারা ইমাম। আজ হঠাৎ বিপ্লবী বনে যাওয়ার কালে আমরা নারীদের একাংশে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর সমাজের বিরুদ্ধাচরণ দেখছি। এদের বাদ দিলে বাকি যারা, তারাই মূল শক্তি।

আবারও বলি, নারীদের অংশগ্রহণ আর সমর্থন বা ভূমিকা ছাড়া বাংলাদেশের গৌরব অকার্যকর। অতি সম্প্রতি আমাদের নারী ফুটবলাররা এর বড় উদাহরণ। জীবনের সর্বত্র তারা আমাদের এগিয়ে রাখে। এই নারীশক্তিকে মৌলবাদ আর অন্ধশক্তি ছাড়া কেউ ভয় পায় না। বাদবাকি সবাই ভালোবাসায় রাখুন তাদের। তাদের জয়ই আমাদের দেশের জয়।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

সমঝোতায় পৌঁছেছি, আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব: নাহিদ ইসলাম

মাকে দেখতে মাঝরাতে হাসপাতালে তারেক রহমান

জামায়াত-এনসিপির প্রার্থী হওয়ার চেয়ে লং স্ট্যান্ডিং পজিশন ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ: মাহফুজ আলম

আত্মসমর্পণ করে দুই মামলায় জামিন পেলেন এনসিপির আখতার

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ