
আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনঃপাঠ, বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক, শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম, গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ শুনতে চাই?
ছাত্র-শ্রমিক-সৈনিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় আট মাস হতে চলল। সময়ের হিসাবে এটা বেশি নয়। তবে ইতিমধ্যে পেরিয়ে আসা সময়ের কিছু মূল্যায়ন করাই যায়।
প্রথম যেটা মনে হয়, গত আগস্টে মানুষের মাঝে যে বিপুল প্রত্যাশা ছিল, সেটা এখন অনেকটা থিতিয়ে গেছে। কিছু গোষ্ঠী অভ্যুত্থানের মালিকানা থেকে গণমানুষের অংশীদারত্ব মুছে দিতে চাইছে। তারা অভ্যুত্থানের কর্তৃত্ব আত্মসাৎ করতে তৎপর হয়েছে এবং তাতে কিছুটা সফলও তারা। জাতীয় পর্যায়ের প্রচারমাধ্যমগুলোও ওই গোষ্ঠীর হয়ে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ রকম গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটা মেলবন্ধন ঘটেছে। এ রকম হওয়ার পরও মানুষ বিক্ষুব্ধ হতো না—যদি অভ্যুত্থানের সরকার শ্রমিক, কৃষক ও শহুরে দরিদ্রদের অবস্থার পরিবর্তনে মৌলিক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারত। সে রকম কিছু মোটাদাগে এখনো দেখা যায়নি।
অভ্যুত্থানকে আমরা বলেছিলাম বৈষম্যবিরোধী। সমাজে বৈষম্যের শিকার প্রধান গোষ্ঠীগুলো এখনো বৈষম্য নামের দানবের হাত থেকে তেমন রেহাই পায়নি। বৈষম্যের কাঠামোটা বেশ সবল ও সচলই আছে, গ্রাম-শহর মিলে।
আপনি বলতে চাইছেন বহুল আলোচিত সংস্কার কিছু হচ্ছে না?
সংস্কার বিষয়ে কয়েকটি কমিশন হয়েছে। কমিশনগুলো প্রায় সবাই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু মৌলিক ধাঁচের সংস্কারের জন্য যে জাতীয় ঐকমত্য দরকার, সেটা তো এখন আর নেই। সেটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সংস্কার এমন একটা প্রস্তাব—যার বিরুদ্ধে এতদিনকার রাষ্ট্রীয় সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী বাধা দেবে। ফলে অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনবাদী শক্তিগুলো একজোট না থাকলে সংস্কার করতে পারবে না। করলেও সেটা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরপরই দক্ষিণপন্থীরা আন্দোলনের ভরকেন্দ্র থেকে রূপান্তরবাদী র্যাডিক্যালদের বড় অংশকে বিচ্ছিন্ন করে নানা ধরনের ট্যাগ দিয়ে তাড়িয়েছে। তারপর নিজেরা অভ্যুত্থানের এজেন্সি দাবি করে চারদিকে মব তৈরি করেছে এবং সমাজে একটা দাপুটে ভাব নিয়েছে মূলত প্রশাসনকে নিজেদের প্রভাবে রাখার জন্য। সে কাজে তারা সফলও হয়েছে। কিন্তু তার নেতিবাচক পার্শ্বফল হিসেবে সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে এগোনো এখন কঠিন হবে। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের বিভক্তির সুযোগ নেবেই।
নির্বাচন নিয়ে আলাপ হচ্ছে চারদিকে। কেউ কেউ অনিশ্চয়তাও দেখছেন। আপনি কি মনে করছেন?
দেশের মানুষের ন্যূনতম চাওয়া এখন নির্বাচন। নির্বাচন হলে যে সাধারণ মানুষের বড় কোনো পরিবর্তন হয়ে যাবে, এমন নয়। কিন্তু মানুষ চায় দেশ অন্তত দ্রুত নির্বাচনী সংস্কৃতিতে হাঁটুক। মানুষের এই চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে দ্রুত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হওয়া দরকার। স্থানীয় নির্বাচন না হওয়ায় উন্নয়নকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষ রাজনৈতিকভাবে এতিম হয়ে আছে। আর জাতীয় নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচিত নেতৃত্ব না থাকায় দেশ কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় আছে। কিন্তু নির্বাচন আদৌ শিগগির হবে কি না, এই নিয়ে সমাজে বড় ধরনের অনিশ্চয়তাও আছে। সবাই চাইছে ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটা নির্বাচন হয়ে যাক। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অনেক শক্তি এটাকে পেছাতে চাইছে। কেউ কেউ আগামী বছর পর্যন্ত নির্বাচনকে টেনে নিতে চাইছে।
নির্বাচন পেছানোর অজুহাত ও যুক্তি হিসেবে সংস্কারকে সামনে আনা হচ্ছে। এটা বেশ বিস্ময়কর একটা প্রস্তাব। কারণ, ছোটখাটো প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, আইনগত সংস্কারের জন্য নির্বাচন পেছানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এখনই সেসব শুরু হতে পারে। গত আট মাসে কেন এ রকম সংস্কার হয়নি, সেটাই বরং প্রশ্ন জাগে?
শ্রমিকদের জন্য জাতীয় মজুরি, অর্থনীতিতে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা, প্রশাসনকে জনমুখী করা—এ রকম সব বিষয়ে কি কোনো রাজনৈতিক দল আপত্তি করবে এখন? আমার তো তা মনে হয় না। সাংবিধানিক কিছু সংস্কারে রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকবে। সেসব বিষয়ে হয় গণপরিষদ নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন লাগবে। সেটাও পেছানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া সমীচীন হবে।
নির্বাচন যত দেরিতে হবে, সমাজে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য তত বাড়বে। ইতিমধ্যে তার আলামত দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চাপ কেবল সেনাবাহিনীকে বইতে দিলে তো হবে না। সামাজিক বাস্তবতা ও প্রত্যাশা আমলে নেওয়া বেসামরিক কর্তৃপক্ষের জন্যও জরুরি বৈকি।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না-করা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, তা বড় কোনো রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে পারে কি?
এটা এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। গত ১৫ বছর এবং চব্বিশে আন্দোলনকালে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এবং সরকার হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে এ প্রসঙ্গ ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবে? কার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার?
এ মুহূর্তে সংসদ নেই। তাহলে বাকি বিকল্প হলো আন্দোলনের শক্তিগুলোকে বসে যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের একসঙ্গে বসে
এই বিষয়ে একটা মীমাংসায় আসতে হবে। রাজপথে, সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে, ফেসবুকের পোস্টের চাপে এ রকম বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ নেই। কারণ, সে রকম সিদ্ধান্ত টেকসই হয় না। যদি একসঙ্গে বৈঠকে বসে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে না পারে, তাহলে গণভোট হতে পারে। এ রকম একটা বিষয়ে আন্দোলনের শক্তিগুলোর মাঝে মতভিন্নতাকে বৈরিতার পর্যায়ে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু সেটা শুরু হয়েছে।
নতুন জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) মধ্যে যেভাবে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা যাচ্ছে, তাতে এই দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন সব সময় একটা শুভ ঘটনা। এতে রাজনীতির ময়দানে প্রতিযোগিতা বাড়বে। তাতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাপার মতো দলগুলো একধরনের চ্যালেঞ্জে থাকবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের মন্ত্রী হওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এবং দল গঠনও ভুল সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে হয়তো অন্যদের অন্য রকম মত থাকবে। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের উচিত ছিল এবং দরকারও ছিল—রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগকারী সামাজিক শক্তি হিসেবে আরও অনেক দিন কাজ করে যাওয়া।
গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সমাজে যে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা রাজনীতিবিদদের দিয়ে করিয়ে নেওয়ার জন্য, অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানকে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনে রূপান্তরের জন্য বিপুল জনমত তৈরির কাজটি তাদের মাঠে-ময়দানে থেকে করার দরকার ছিল। তার জন্য তারা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকলে ভালো হতো। এখন অভ্যুত্থানের ভেতর থেকে একটা গোষ্ঠী একটা দল গঠন করেছে। জামায়াত-শিবিরপন্থীরা শুনছি আরেকটা দল গঠন করবে। অনুমান করি, বামপন্থী ছাত্র-শ্রমিকেরাও হয়তো আরেকটা দল গঠন করবে। তার ফল হবে এদেরই পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পাশাপাশি শুরু হবে নানান বিতর্ক ও সংঘাত। ইতিমধ্যে সেটা শুরুও হয়ে গেছে।
বর্তমান প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় খুব র্যাডিক্যাল কেউ মন্ত্রী হয়ে আমূল কিছু যে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, সেটা নিশ্চয়ই আন্দোলনের শক্তিগুলো ইতিমধ্যে টের পেয়েছে হাতে-কলমে। আবার আন্দোলনকারী পুরো জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে ধরে রাখার মডেল বাদ দিয়ে তার একাংশ নিয়ে দল গঠন করে, নির্বাচন করে কিছু আসন পেয়ে কী হবে? এই দুটো কাজ বাদ দিয়ে মাঠে থেকে আগস্টের শক্তি হিসেবে সবাইকে এক জায়গায় রেখে সংস্কারের অ্যাজেন্ডাগুলোর জন্য প্রচণ্ড চাপ তৈরির কৌশল বেশি কার্যকর হতো বলে মনে করি। কিন্তু সেই মুহূর্তটা বোধ হয় হারিয়ে গেল।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে পারবেন কি না?
কোনো এক ব্যক্তির সুনামের চেয়ে জরুরি বিষয় হলো গণ-অভ্যুত্থানের সরকার, যাকে আমরা বলছি অন্তর্বর্তী সরকার—তারা সুনামের সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে বিদায় নিতে পারবে কি না, পারছে কি না?
একজন মুহাম্মদ ইউনূসের চেয়ে চব্বিশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের ভবিষ্যতের প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নের উত্তর তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। প্রথমত, গত ১৫ বছরের অত্যাচার-নির্যাতন-দুর্নীতির বিচার। এই বিচারটা আবার আক্রোশ মেটানোর কায়দায় যেনতেনভাবে না হওয়া উচিত হবে। বিচার হতে হবে সঠিক তদন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য স্বচ্ছতায়। এক হাজার মানুষ যে আন্দোলনকালে মারা গেছেন, শহীদ হয়েছেন, সেটা তো সত্য। এই মানুষগুলোর হত্যার তদন্ত ও বিচার দরকার। এটা বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে হওয়াই ভালো। এর ফলে আগামী দিনে এ রকম গণহত্যা বন্ধ হতে পারে। কাজটি তাড়াহুড়ো যেমন কাম্য নয়, তেমনি অতি বিলম্বও কাম্য নয়।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সমাজে পরিবর্তন ও সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তার অন্তত কিছু অংশের বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে যা ঘটেছে তাতে অবশ্য আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
তৃতীয় বিষয় হলো, একটা অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন। এই তিনটি বিষয় যদি বর্তমান সরকার করতে পারে, তাহলে সেই সরকারের সব উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাই জাতীয় সম্মানের নিশ্চয়তাসহ সুন্দরভাবে বিদায় নিতে পারবেন। আর সেটা না ঘটলে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে তার বিলম্ব ঘটলে—সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হবে, দেশের মানুষের মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা চরম হতাশা তৈরি হবে।
দেখুন, এ দেশটা প্রায় ২০ কোটি মানুষের ভারে ভারাক্রান্ত। ৩-৪ কোটি মানুষ দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র। পরিবেশের দিক থেকে চরম ঝুঁকিতে থাকা একটা জনপদ এটা। আমাদের জন্য পরিবর্তনের কাজে বেশি সময় হাতে নেই। ইতিহাসের শেষ সুযোগ হারাতে পারি আমরা এবারও।
এসব বিষয়ে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য কিছু বলার আছে কি আপনার?
নাগরিক হিসেবে আমরা যেন এই গণ-অভ্যুত্থানকে সফল করতে আরও সচেতন হই, সেই আহ্বান রাখতে চাই। আমরা যেন ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের সর্বাগ্রে চিন্তা করি এবং দেশটার গণতান্ত্রিক বিকাশে নিজেদের ভূমিকা রাখি, সেটা খুব জরুরি। কোনো একটা মহল অপর মহলের ওপর কোনো ধরনের একরোখা শ্রেষ্ঠত্ববাদী আচরণ করলে এ দেশ এগোতে পারবে না। হয়তো টিকবেও না।
সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়ায় আজকাল পপুলিজমের যে উৎপাত চলছে, তাতে পাঠক হিসেবে ভেসে গেলে মুশকিল। পাঠক, শ্রোতা, দর্শককে নির্মম সত্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, জনপ্রিয় কথাবার্তাকে নয়।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ শুনতে চাই?
ছাত্র-শ্রমিক-সৈনিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় আট মাস হতে চলল। সময়ের হিসাবে এটা বেশি নয়। তবে ইতিমধ্যে পেরিয়ে আসা সময়ের কিছু মূল্যায়ন করাই যায়।
প্রথম যেটা মনে হয়, গত আগস্টে মানুষের মাঝে যে বিপুল প্রত্যাশা ছিল, সেটা এখন অনেকটা থিতিয়ে গেছে। কিছু গোষ্ঠী অভ্যুত্থানের মালিকানা থেকে গণমানুষের অংশীদারত্ব মুছে দিতে চাইছে। তারা অভ্যুত্থানের কর্তৃত্ব আত্মসাৎ করতে তৎপর হয়েছে এবং তাতে কিছুটা সফলও তারা। জাতীয় পর্যায়ের প্রচারমাধ্যমগুলোও ওই গোষ্ঠীর হয়ে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ রকম গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটা মেলবন্ধন ঘটেছে। এ রকম হওয়ার পরও মানুষ বিক্ষুব্ধ হতো না—যদি অভ্যুত্থানের সরকার শ্রমিক, কৃষক ও শহুরে দরিদ্রদের অবস্থার পরিবর্তনে মৌলিক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারত। সে রকম কিছু মোটাদাগে এখনো দেখা যায়নি।
অভ্যুত্থানকে আমরা বলেছিলাম বৈষম্যবিরোধী। সমাজে বৈষম্যের শিকার প্রধান গোষ্ঠীগুলো এখনো বৈষম্য নামের দানবের হাত থেকে তেমন রেহাই পায়নি। বৈষম্যের কাঠামোটা বেশ সবল ও সচলই আছে, গ্রাম-শহর মিলে।
আপনি বলতে চাইছেন বহুল আলোচিত সংস্কার কিছু হচ্ছে না?
সংস্কার বিষয়ে কয়েকটি কমিশন হয়েছে। কমিশনগুলো প্রায় সবাই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু মৌলিক ধাঁচের সংস্কারের জন্য যে জাতীয় ঐকমত্য দরকার, সেটা তো এখন আর নেই। সেটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে এবং ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সংস্কার এমন একটা প্রস্তাব—যার বিরুদ্ধে এতদিনকার রাষ্ট্রীয় সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী বাধা দেবে। ফলে অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনবাদী শক্তিগুলো একজোট না থাকলে সংস্কার করতে পারবে না। করলেও সেটা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরপরই দক্ষিণপন্থীরা আন্দোলনের ভরকেন্দ্র থেকে রূপান্তরবাদী র্যাডিক্যালদের বড় অংশকে বিচ্ছিন্ন করে নানা ধরনের ট্যাগ দিয়ে তাড়িয়েছে। তারপর নিজেরা অভ্যুত্থানের এজেন্সি দাবি করে চারদিকে মব তৈরি করেছে এবং সমাজে একটা দাপুটে ভাব নিয়েছে মূলত প্রশাসনকে নিজেদের প্রভাবে রাখার জন্য। সে কাজে তারা সফলও হয়েছে। কিন্তু তার নেতিবাচক পার্শ্বফল হিসেবে সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে এগোনো এখন কঠিন হবে। ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের বিভক্তির সুযোগ নেবেই।
নির্বাচন নিয়ে আলাপ হচ্ছে চারদিকে। কেউ কেউ অনিশ্চয়তাও দেখছেন। আপনি কি মনে করছেন?
দেশের মানুষের ন্যূনতম চাওয়া এখন নির্বাচন। নির্বাচন হলে যে সাধারণ মানুষের বড় কোনো পরিবর্তন হয়ে যাবে, এমন নয়। কিন্তু মানুষ চায় দেশ অন্তত দ্রুত নির্বাচনী সংস্কৃতিতে হাঁটুক। মানুষের এই চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে দ্রুত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হওয়া দরকার। স্থানীয় নির্বাচন না হওয়ায় উন্নয়নকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রান্তিক মানুষ রাজনৈতিকভাবে এতিম হয়ে আছে। আর জাতীয় নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচিত নেতৃত্ব না থাকায় দেশ কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় আছে। কিন্তু নির্বাচন আদৌ শিগগির হবে কি না, এই নিয়ে সমাজে বড় ধরনের অনিশ্চয়তাও আছে। সবাই চাইছে ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটা নির্বাচন হয়ে যাক। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অনেক শক্তি এটাকে পেছাতে চাইছে। কেউ কেউ আগামী বছর পর্যন্ত নির্বাচনকে টেনে নিতে চাইছে।
নির্বাচন পেছানোর অজুহাত ও যুক্তি হিসেবে সংস্কারকে সামনে আনা হচ্ছে। এটা বেশ বিস্ময়কর একটা প্রস্তাব। কারণ, ছোটখাটো প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, আইনগত সংস্কারের জন্য নির্বাচন পেছানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এখনই সেসব শুরু হতে পারে। গত আট মাসে কেন এ রকম সংস্কার হয়নি, সেটাই বরং প্রশ্ন জাগে?
শ্রমিকদের জন্য জাতীয় মজুরি, অর্থনীতিতে প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা, প্রশাসনকে জনমুখী করা—এ রকম সব বিষয়ে কি কোনো রাজনৈতিক দল আপত্তি করবে এখন? আমার তো তা মনে হয় না। সাংবিধানিক কিছু সংস্কারে রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকবে। সেসব বিষয়ে হয় গণপরিষদ নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন লাগবে। সেটাও পেছানোর কোনো প্রয়োজন নেই। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া সমীচীন হবে।
নির্বাচন যত দেরিতে হবে, সমাজে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য তত বাড়বে। ইতিমধ্যে তার আলামত দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চাপ কেবল সেনাবাহিনীকে বইতে দিলে তো হবে না। সামাজিক বাস্তবতা ও প্রত্যাশা আমলে নেওয়া বেসামরিক কর্তৃপক্ষের জন্যও জরুরি বৈকি।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না-করা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, তা বড় কোনো রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে পারে কি?
এটা এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। গত ১৫ বছর এবং চব্বিশে আন্দোলনকালে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এবং সরকার হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে এ প্রসঙ্গ ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবে? কার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার?
এ মুহূর্তে সংসদ নেই। তাহলে বাকি বিকল্প হলো আন্দোলনের শক্তিগুলোকে বসে যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের একসঙ্গে বসে
এই বিষয়ে একটা মীমাংসায় আসতে হবে। রাজপথে, সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে, ফেসবুকের পোস্টের চাপে এ রকম বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ নেই। কারণ, সে রকম সিদ্ধান্ত টেকসই হয় না। যদি একসঙ্গে বৈঠকে বসে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে না পারে, তাহলে গণভোট হতে পারে। এ রকম একটা বিষয়ে আন্দোলনের শক্তিগুলোর মাঝে মতভিন্নতাকে বৈরিতার পর্যায়ে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু সেটা শুরু হয়েছে।
নতুন জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) মধ্যে যেভাবে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা যাচ্ছে, তাতে এই দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন সব সময় একটা শুভ ঘটনা। এতে রাজনীতির ময়দানে প্রতিযোগিতা বাড়বে। তাতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাপার মতো দলগুলো একধরনের চ্যালেঞ্জে থাকবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের মন্ত্রী হওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এবং দল গঠনও ভুল সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে হয়তো অন্যদের অন্য রকম মত থাকবে। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের উচিত ছিল এবং দরকারও ছিল—রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগকারী সামাজিক শক্তি হিসেবে আরও অনেক দিন কাজ করে যাওয়া।
গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সমাজে যে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা রাজনীতিবিদদের দিয়ে করিয়ে নেওয়ার জন্য, অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানকে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনে রূপান্তরের জন্য বিপুল জনমত তৈরির কাজটি তাদের মাঠে-ময়দানে থেকে করার দরকার ছিল। তার জন্য তারা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকলে ভালো হতো। এখন অভ্যুত্থানের ভেতর থেকে একটা গোষ্ঠী একটা দল গঠন করেছে। জামায়াত-শিবিরপন্থীরা শুনছি আরেকটা দল গঠন করবে। অনুমান করি, বামপন্থী ছাত্র-শ্রমিকেরাও হয়তো আরেকটা দল গঠন করবে। তার ফল হবে এদেরই পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পাশাপাশি শুরু হবে নানান বিতর্ক ও সংঘাত। ইতিমধ্যে সেটা শুরুও হয়ে গেছে।
বর্তমান প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় খুব র্যাডিক্যাল কেউ মন্ত্রী হয়ে আমূল কিছু যে পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, সেটা নিশ্চয়ই আন্দোলনের শক্তিগুলো ইতিমধ্যে টের পেয়েছে হাতে-কলমে। আবার আন্দোলনকারী পুরো জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে ধরে রাখার মডেল বাদ দিয়ে তার একাংশ নিয়ে দল গঠন করে, নির্বাচন করে কিছু আসন পেয়ে কী হবে? এই দুটো কাজ বাদ দিয়ে মাঠে থেকে আগস্টের শক্তি হিসেবে সবাইকে এক জায়গায় রেখে সংস্কারের অ্যাজেন্ডাগুলোর জন্য প্রচণ্ড চাপ তৈরির কৌশল বেশি কার্যকর হতো বলে মনে করি। কিন্তু সেই মুহূর্তটা বোধ হয় হারিয়ে গেল।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে পারবেন কি না?
কোনো এক ব্যক্তির সুনামের চেয়ে জরুরি বিষয় হলো গণ-অভ্যুত্থানের সরকার, যাকে আমরা বলছি অন্তর্বর্তী সরকার—তারা সুনামের সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে বিদায় নিতে পারবে কি না, পারছে কি না?
একজন মুহাম্মদ ইউনূসের চেয়ে চব্বিশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের ভবিষ্যতের প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নের উত্তর তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। প্রথমত, গত ১৫ বছরের অত্যাচার-নির্যাতন-দুর্নীতির বিচার। এই বিচারটা আবার আক্রোশ মেটানোর কায়দায় যেনতেনভাবে না হওয়া উচিত হবে। বিচার হতে হবে সঠিক তদন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য স্বচ্ছতায়। এক হাজার মানুষ যে আন্দোলনকালে মারা গেছেন, শহীদ হয়েছেন, সেটা তো সত্য। এই মানুষগুলোর হত্যার তদন্ত ও বিচার দরকার। এটা বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে হওয়াই ভালো। এর ফলে আগামী দিনে এ রকম গণহত্যা বন্ধ হতে পারে। কাজটি তাড়াহুড়ো যেমন কাম্য নয়, তেমনি অতি বিলম্বও কাম্য নয়।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে সমাজে পরিবর্তন ও সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তার অন্তত কিছু অংশের বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে যা ঘটেছে তাতে অবশ্য আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
তৃতীয় বিষয় হলো, একটা অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন। এই তিনটি বিষয় যদি বর্তমান সরকার করতে পারে, তাহলে সেই সরকারের সব উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাই জাতীয় সম্মানের নিশ্চয়তাসহ সুন্দরভাবে বিদায় নিতে পারবেন। আর সেটা না ঘটলে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে তার বিলম্ব ঘটলে—সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হবে, দেশের মানুষের মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা চরম হতাশা তৈরি হবে।
দেখুন, এ দেশটা প্রায় ২০ কোটি মানুষের ভারে ভারাক্রান্ত। ৩-৪ কোটি মানুষ দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র। পরিবেশের দিক থেকে চরম ঝুঁকিতে থাকা একটা জনপদ এটা। আমাদের জন্য পরিবর্তনের কাজে বেশি সময় হাতে নেই। ইতিহাসের শেষ সুযোগ হারাতে পারি আমরা এবারও।
এসব বিষয়ে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য কিছু বলার আছে কি আপনার?
নাগরিক হিসেবে আমরা যেন এই গণ-অভ্যুত্থানকে সফল করতে আরও সচেতন হই, সেই আহ্বান রাখতে চাই। আমরা যেন ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের সর্বাগ্রে চিন্তা করি এবং দেশটার গণতান্ত্রিক বিকাশে নিজেদের ভূমিকা রাখি, সেটা খুব জরুরি। কোনো একটা মহল অপর মহলের ওপর কোনো ধরনের একরোখা শ্রেষ্ঠত্ববাদী আচরণ করলে এ দেশ এগোতে পারবে না। হয়তো টিকবেও না।
সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়ায় আজকাল পপুলিজমের যে উৎপাত চলছে, তাতে পাঠক হিসেবে ভেসে গেলে মুশকিল। পাঠক, শ্রোতা, দর্শককে নির্মম সত্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, জনপ্রিয় কথাবার্তাকে নয়।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৬ ঘণ্টা আগে
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৬ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।
সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।
অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।
সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।
সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।
অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।
সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনঃপাঠ, বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক, শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম, গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই।
০৬ এপ্রিল ২০২৫
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৬ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’
ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।
রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।
রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’
আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:
— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?
— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।
পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:
— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?
— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।
স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:
নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু
ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।
রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’
কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’
একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’
এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।
কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে
চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।
দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’
প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’
চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।
বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।
২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।
ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।
নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’
ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।
রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।
রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’
আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:
— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?
— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।
পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:
— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?
— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।
স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:
নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু
ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।
রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’
কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’
একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’
এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।
কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে
চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।
দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’
প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’
চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।
বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।
২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।
ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।
নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনঃপাঠ, বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক, শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম, গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই।
০৬ এপ্রিল ২০২৫
সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৬ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেশোয়েব সাম্য সিদ্দিক

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।
এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।
আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।
দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।
তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।
চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।
অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।
আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।
সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।
এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।
আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।
দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।
তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।
চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।
অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।
আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।
সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনঃপাঠ, বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক, শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম, গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই।
০৬ এপ্রিল ২০২৫
সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৬ ঘণ্টা আগে
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৬ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।
আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।
আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর। ডাকসুর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনঃপাঠ, বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক, শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম, গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা প্রভৃতি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই।
০৬ এপ্রিল ২০২৫
সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৬ ঘণ্টা আগে
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৬ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৬ ঘণ্টা আগে